অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৪

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৪
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

ভাদ্রের ভ্যাপসা গরম। রক্তিমা সূর্য বিদায় নিয়ে এক টুকরো চাঁদ উঁকি দিচ্ছে আকাশে। শরৎ এর আগমনী বার্তা দিতেই কাশফুলের জন্ম। মরিচ বাতির ঝিকিমিকি আলোয় একঝাঁক হলুদ পাখি স্টেজের দিকে ছুটলো ডালা হাতে। ইরার বোন মিরার হলুদ অনুষ্ঠানে সবাই আজ হলুদ সাজে সেজেছে। হলুদ পাঞ্জাবি আঁটসাঁটভাবে গেঁথে আছে মাহমুদের শরীরে। শক্তপোক্ত পেটানো শরীরে দারুণভাবে রঙটি ফোটে উঠেছে। চমৎকার লাগছে তাকে। মাহমুদের আঁকাবাঁকা দৃষ্টি তরীকে খুঁজে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। কোথাও দেখতে পাচ্ছে না।

রামি আর মিঠু গোয়েন্দা সংস্থার দুইজন ভাঙা অফিসার গোয়ান্দাগিরিতে লেগে পড়েছে। রামির নজর পড়ার সাথে সাথেই খোঁচা মে*রে সেটা মিঠুর কান, চোখ দুটো পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। দুজনে অভিযান চালিয়ে সকাল থেকেই একটা ব্যাপার মাথায় ভালোভাবে গেঁথে নিয়েছে। তা হলো মাহমুদ, তরী দুজনের মাঝেই প্রেম-ভালোবাসা জনিত কিছু একটা আছে। রামি দুঃখী গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“তোর বোন আমাকে ছ্যাকা দিলো রে মিঠু। একটা ফোনও নেই, যে বিরহের গান শুনে নিজেকে শেষ করে দেবো।”
মিঠুর মাথায় অন্য ধরনের চিন্তা। একটা ভাই বড়ো হোক কিংবা ছোটো। ভাইয়ের প্রেম জনিত ব্যাপার যতটা সহজভাবে নিতে পারে, বোনের ক্ষেত্রে ততটা সহজ তারা হতে পারেনা। মিঠুর ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হচ্ছে। বাবা জানতে পারলে আপুর দিকে মুখ ফিরেও তাকাবেন না। বাবা যতটা আদর দিয়ে মাথায় তুলতে পারেন, ঠিক ততটা শাসন করে মাথা থেকে আঁচড়ে ফেলতেও পারেন। প্রচন্ড একরোখা মনোভাব নিয়ে চলাফেরা করেন তিনি।
রামি খোঁচা দিলো মিঠুকে।

-“বেয়াই, ও বেয়াই, ও না হওয়া শা*লা।”
মিঠুর ঘোর কাটলো। গভীর চিন্তা জগৎ থেকে বেরিয়ে বলল,
-“কী হয়েছে?”
রামি গান ধরলো,
”বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিলো নেশা,
কারা যে ডাকিল পিছে!
বসন্ত এসে গেছে।”
মিঠু ভুরু কুঁচকে তাকালো।
-“গন্ডমূর্খ। এখন শরৎকাল।”
-“ওহ। ভুলেই গিয়েছি। ”বলে আরেকটি গান ধরলো।
“হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিলো রে…,

নেশা লাগিলো রে….,
বাঁকা দু-নয়নে নেশা লাগিলো রে।”
মিঠুর কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তাকে আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখলো রামি। কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাকে।
-“কিরে মিঠু! তোর দেখি কোন হেলদোল নেই। কী এত ভাবছিস? কিছু নিয়ে চিন্তিত!”
মিঠু নিজের চিন্তাভাবনা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো।
-“নাহ্, আমার আবার কিসের চিন্তা? চল আর কতক্ষণ এভাবে নজর রাখবি ওদের উপর?”

রামি মিঠুর সাথে গিয়ে চেয়ার টে*নে বসলো।
তরীর আগমন ঘটলো সব মেয়েদের পরে। আয়েশা সুলতানার সাথেই এসেছে। তিনি চোখে চোখে রাখছেন তরীকে। নিজ দায়িত্ব মেয়েটাকে নিয়ে এসেছেন। তাই কোনরূপ সমস্যা যেন না হয়, সেজন্যই বেশি বেশি খেয়াল রাখছেন। মাহমুদের দৃষ্টি অবিচল। হলুদ শাড়িতে মেয়েটিকে মাহমুদের চোখে অপ্সরা লাগছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। তার নিজেরই না নজর লেগে যায়। তরী এখনো মাহমুদকে দেখেনি।
একে একে সবাই মিরাকে হলুদ ছুঁইয়ে সরে গেল। উপস্থিত রইলো ছেলেমেয়েরা। নাচ-গানে মেতে উঠলো সকলে। আয়েশা সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন,

-“আমার কোমর ব্যথা করছে। নিচে চলে যাচ্ছি। তুমি থাকবে এখানে?”
তরী ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,
-“আপনি যখন নিচে চলে যাচ্ছেন, আমি ও চলে যাবো।”
ইরা বাঁধা দিলো আয়েশা সুলতানাকে।
-“থাক না মা। আপনি গিয়ে রেস্ট নিন। ছোটোরা সবাই এখানে। তরী আপনাদের বড়োদের ভীড়ে বোরিং ফিল করবে।”
-“আচ্ছা, তাহলে ওর দিকে খেয়াল রেখো।”
ইরা হাসতে হাসতে বলল,

-“কোন ছেলেপেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেবো।”
তরী লজ্জা পেল ইরার কথায়।
কনের বড়োবোন হিসেবে ইরার ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। তরীকে বসিয়ে রেখেই উঠে পড়লো সে।
এতক্ষণ যাবত সবটাই সাবধানী নজরে খেয়াল করেছে মাহমুদ।
তরীর মেসেঞ্জারে টুংটাং শব্দ হলো। উচ্চ আওয়াজের গান-বাজনার শব্দে টের পেলোনা তরী। মাহমুদ কখন থেকে অধীর আগ্রহে বসে আছে। তরী ফোন চেইক দিচ্ছে না। এবার কল দিলো।
ফোনের বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠা লক্ষ করে রিসিভ করলো তরী। মাহমুদের কথা স্পষ্ট শুনতে পারছেনা। মেসেজ পাঠাতে গিয়ে দেখলো মাহমুদ আগেই পাঠিয়েছে,

❝ছাদের দিকটায় আসুন।❞
তরী উঠে পড়লো। স্টেজ ছেড়ে বাড়ির ভেতর দিকে প্রবেশ করলো। সিঁড়ির প্রথম ধাপ পার করতেই একটি শক্ত হাত এসে তার হাত আঁকড়ে ধরলো। ভয়ে শিউরে উঠলো তরী। পাশ ফিরে তাকাতেই মাহমুদকে দেখে স্বস্তি পেলো। মাহমুদ নরম স্বরে শুধালো,
-“ভয় পেয়েছেন, তরী?”
তরী অস্ফুট স্বরে বলল,
-“হুম।”
মাহমুদ তরীর হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে কোমল স্বরে বলল,

-“আমি আছি তো, তরী! একদম ভয় পাবেন না।”
তরী মাথানিচু করে মাহমুদের সাথে ছাদে পৌঁছে গেল। মনের গোপন কুঠুরিতে চলল তাদের অপ্রকাশিত প্রেম। ঘন আবেশিত সুর ভেসে আসছে নিচ থেকে। স্টেজ কাঁপিয়ে নেচে চলেছে তরুণ-তরুণী। মাহমুদ ডানহাত বাড়িয়ে দিলো তরীর দিকে। তরী হাত বাড়িয়ে দিতেই তার আঙ্গুল ছুঁয়ে ঘুরিয়ে নিলো কয়েক পাক। মরিচবাতির আলোয় ঘোর লাগা দৃষ্টিতে মাহমুদের চোখে চোখ রাখলো তরী। লজ্জা, ভয়, সংকোচ সবকিছুকে ছুটি দিয়ে আরেকটু কাছাকাছি হতে ইচ্ছে হলো৷ আবেগপ্রবণ তরী ভুলে গেল বাবার ভয়। নরম হাত ছুঁয়ে দিলো মাহমুদের খোঁচা খোঁচা দাড়িযুক্ত গাল। মাহমুদ নিজের গালে তরীর হাত চেপে ধরে চোখ বুজে নিলো। হুট করেই সংবিৎ ফিরে পেলো তরী। ঝট করেই হাত ছাড়িয়ে নিলো। বড্ড অস্থির হয়ে উঠলো মন। প্রচন্ড লজ্জাও লাগছে। দূরে সরে তড়িঘড়ি করে বলল,

-“আমি নিচে যাচ্ছি। মাথা ব্যথা করছে।”
মাহমুদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মিথ্যে বলে নেমে পড়লো। চোখ বুজে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো মাহমুদ। বিড়বিড় করে বলল,
-” খুব শীঘ্রই আমাদের মাঝের দূরত্ব ঘুচবে, তরী। আপনি শুধু আমার তরী হয়ে থাকবেন।”

মিরার বিয়ের কার্যক্রমের পর থেকেই মাহমুদ একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। তরী তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। আগে সামনে পড়লে মেয়েটা লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যেতো। আজ যতবার সামনে পড়েছে, ততবারই চোখমুখ কঠিন ছিল। মাহমুদ যতবার তাকিয়েছে ততবারই তরীর দৃষ্টি নিচু ছিলো। একটিবারের জন্যেও তাকায়নি। মাহমুদের বুকের ভেতর বিষাদের ঢেউ বয়ে গেল। মনে করার চেষ্টা করলো সে কিছু করেছে কি-না! এমন কিছুই মনে পড়লোনা। বৈঠকখানায় আয়েশা সুলতানার সাথে উদাস হয়ে বসে আছে তরী। রামি, মিঠু দুজনই উপস্থিত। এখানে মায়ের সামনে ডাকা যাবেনা। তাই রামিকে ডাকলো। রামি অনেকক্ষণ ধরেই নজর রাখছিল মাহমুদের উপর। উঠে এসে জিজ্ঞেস করলো,

-“ডেকে দেবো?”
-“হ্যাঁ।” বলেই মাহমুদ চমকে উঠলো।
-“কাকে ডেকে দিবি?”
রামি মিটিমিটি হেসে বলল,
-“তরী আপুকে।”
মাহমুদ বিরক্তি গলায় বলল,
-“এভাবে হাসছিস কেন? প্রয়োজন আছে, ডেকে দে।”
রামি আবারও মিটিমিটি হেসে বলল,
-“তোমার নৌকার মন খা*রা*পে*র কারণ কিন্তু আমি জানি।”
মাহমুদ এবার আর চমকালোনা। রামির চোখমুখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে তার গোয়ান্দাগিরি করে সব জানা শেষ। ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

-“কী জানিস তুই?”
-“এই যে, তরী আপু কেন মন খা*রা*প করে আছে!”
-“কেন?”
-“মা তোমার জন্য মেয়ে দেখছে। তরী আপুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে ‘দেখোতো তরী, মেয়েটাকে মাহমুদের সাথে দারুণ মানাবে, তাইনা?

ওই মেয়েটার খোঁজখবর ও নেওয়া শেষ। তখন থেকেই তোমার তরীর হাওয়া ফুস।”
মাহমুদ আর তরীকে ডাকার চেষ্টা করলোনা। মায়ের সাথে কথা বলা দরকার। তাই মাকে ডাকলো।
আয়েশা সুলতানা উঠে আসতেই মাহমুদ উনাকে একপাশে টে*নে নিয়ে গেল। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

-“রামি বলল তুমি নাকি এখানে এসে মেয়ে দেখছো আমার জন্য!”
-“হ্যাঁ, বিয়ে করতে হবে না তোর? মেয়েটাকে আমার ভীষণ মনে ধরেছে। তরীরও ভালো লেগেছে জিজ্ঞেস করে দেখ।”
মাহমুদ মনে মনে হাসলো মায়ের ওপর। সে সময় নিলোনা। সোজাসাপটা বলে দিলো,
-“মা আমার জন্য অন্য মেয়ে দেখা বাদ দাও। প্রস্তাব পাঠাতে হলে তরীর বাসায় পাঠাও।”
এক মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে চলে গেল মাহমুদ। আয়েশা সুলতানা স্তব্ধ হয়ে রইলেন। আকস্মিক শক খেয়ে কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে।

নিস্তব্ধ রাত। ছাদের এককোনায় উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরী। তার কিছুই ভালো লাগছেনা। এক ছুটে বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছে। তিক্ত বিষাদে মন তেতো হয়ে উঠলো। চোখের কোনে অশ্রুকণার ভীড়। আয়েশা সুলতানার এক কথা, এই মেয়েটিকে তিনি বউ করেই ছাড়বেন। এবার যেভাবেই হোক ছেলেকে রাজি করাবেন। মাহমুদ নিশ্চয়ই মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নেবে। তরী হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠলো। এত কেন কষ্ট হচ্ছে তার?

পরদিনই বাড়িতে ফিরে এলো তরী। গতকাল থেকে একবারও মাহমুদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেনি। মাহমুদ ও আর জোর করেনি। পরে ঠান্ডা মাথায় কথা বলা যাবে।
আয়েশা সুলতানা মাহমুদের ঘরে এসে বসলেন।
-“কিছু বলবে, মা?”

আয়েশা সুলতানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“হ্যাঁ। গতকাল তরীর কথা বলেছিলি কিছু একটা।
কিন্তু এটা কিছুতেই সম্ভব নয়!”
-“কেন?”
-“তরীর বাবা কখনোই মত দেবেন না। তিনি অন্যত্র কথা দিয়ে ফেলেছেন।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৩

চোখমুখ কঠিন হয়ে এলো মাহমুদের। সে সহজে রাগ করতে চায় না। তবে আজ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। তরী তাকে কিছুই জানায়নি!

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১৫