অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১০

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১০
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

বাতাসের বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে বাস চলছে। বেশ ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। শরীরে ওড়না জড়িয়ে দু-হাতের তালু ঘষে যাচ্ছে তরী। সে ঠিক জানালার পাশ ঘেঁষে বসেছে। কানের পাশে এখনো মাহমুদের গুঁজে দেওয়া কদম ফুল। পাশের সিটেই কারো সাথে গুরুত্বপূর্ণ ফোনালাপে ব্যস্ত মাহমুদ। কথা চলমান রেখেই হাত বাড়িয়ে জানালার গ্লাস আটকে দিল। তরীর যেন ঠান্ডা না লাগে। ব্যস্ততার ভীড়েও তার খেয়াল রইলো তরীর উপর। বাসের দু-একজন লোক তাদের আড় চোখে পর্যবেক্ষণ করছে। তরী আজ নির্লিপ্ত রইলো। কারো নজরকে তোয়াক্কা করলো না।

কথা বলায় ব্যস্ত মাহমুদকে মনযোগী দর্শকের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। শক্তপোক্ত দেহের সাথে আঁটসাঁট হয়ে লেপ্টে আছে কালো শার্ট। আজ আর টপ বোতাম দুটো খোলা নেই। পরিপাটি হয়েই এসেছে। কথা বলার সময়ও তার ভঙ্গিমা বেশ দৃঢ়। তরী চোখ বুজতে ভয় পায়। বিষন্নতা এসে ঝেঁকে ধরে তাকে। তার কল্পিত পুরুষ এখন আর আবছায়া নয়। তরী এখন তাকে স্পষ্ট দেখতে পায়। চোখ বুজলেই মানুষটি চমৎকার হেসে তাকিয়ে থাকে৷ তরী বিমূঢ় হয়, আরেকটু গুটিয়ে যায়। কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায়না এই মানুষটিই তার কল্পনায় ঘুরে বেড়ায়। সে দৃষ্টি ভ্রমের মতো কল্পনা ভ্রম ভেবে উড়িয়ে দেয় সিরিয়াস ব্যাপারটি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তরীর মনে পড়ে গেল ইদের দিনের কথা। মানুষটি কিভাবে তার চিকন হাতটি আঁকড়ে ধরলো। অথচ তরী বাঁধা দিতে পারলোনা। বুক করা ক্যাবের জানালায় মুখ বাড়িয়ে চুপটি করে বসে রইলো। মানুষটির উচ্চারিত প্রতিটি বাক্য তার মনে শিহরণ জাগিয়ে দেয়। তরী স্তব্ধ হয়ে শুনে যায়, অনুভব করে মানুষটির উৎকণ্ঠা। কিন্তু কিছু বলতে পারেনা। তীব্র প্রতিবাদ জানাতে পারেনা, চরম সত্য হলো প্রতিবাদ জানানোর ইচ্ছে হয়না।

সেদিন রাতেই বাবার তোড়জোড় ফোনকলে বাধ্য হয়ে ফিরতে হয়েছে তরী আর মিঠুকে। বাবা বাজারের উপর এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাহমুদ এসে দুজনকে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো। এর কিছুদিন পরই তারা ফিরে এলো।
মাহমুদের কপালের উপর আছড়ে পড়া অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত জোড়া চঞ্চল হয়ে ওঠে। তরী সাহস করে তার অদম্য ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিলো। হাত চালিয়ে দিলো মাহমুদের চুলের ভাঁজে। কপালের চুলগুলো ঠে*লে দিলো পেছন দিকে।

তরীর আকস্মিক কাজে ভারি চমকালো মাহমুদ। তার চোখমুখ সেই কথাই বলছে। জৈষ্ঠ্যমাসের খরতাপের পর এ যেন আষাঢ়ের এক পসলা বৃষ্টি মনে হলো মাহমুদের কাছে। আষাঢ় মানেই আবেগ, প্রেমময় মাস। মাহমুদের মনে হলো সত্যিই তার জীবনে আষাঢ় নামলো। ঝুম বৃষ্টিতে সে তার হৃদয় ভিজে উঠলো। মাহমুদের চোখেমুখে খেলে গেলো এক তৃপ্ত হাসি। অল্পস্বল্প ঠোঁট প্রসারিত করে নিঃশব্দে হাসলো। এতেও ভীষণ চমৎকার দেখাচ্ছে মানুষটিকে। মাহমুদের নিরলস দৃষ্টির কবলে পড়ে ঝট করেই হাত গুটিয়ে নিলো তরী। এবার তার অস্বস্তি হলো। কি দরকার ছিলো এমন একটি কাজ করার? জানালার বাইরে দৃষ্টি ঠেকলো। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেল।
মাহমুদ বুক ভরে শ্বাস নিলো। এখনো ঠোঁটের ধারে ঘেঁষে আছে নজরকাড়া হাসি।

ঘরের আসবাবপত্র মুছে রাখছেন মা। সাথে সাহায্য করছে তরী। অরুও একটা কাপড় হাতে মোছার কাজ করছে। তরী বলল,
-“তোর মুছতে হবে না, পাকাবুড়ি।”
অরু সোফা মুছতে মুছতেই বলল,
-“আমি সোফা মুছে রাখছি। এটা আমার শশুর বাড়ি নিয়ে যাবো।”
তরীর চোখ চড়কগাছ। মায়ের দিকে তাকিয়ে দুজনেই হেসে ফেললো। তরী শুধালো,
-“তোর শশুর বাড়ি এলো কোথা থেকে?”
অরু বিরক্ত হলো যেন। হাঁপিয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,

-“আমি কি বড় হবো না? তোমার মতো বড় হলে আমার যখন বিয়ে হবে, তখন এই সোফাসেট আমি শশুর বাড়ি নিয়ে যাবো।”
-“এগুলো তো সব মিঠু আর তার বউয়ের।”
অরু তেতে উঠলো,
-“মিঠু পঁচা কুমড়া সব পাবে। আমি মা-বাবার কাছে কিছু পাবো না?”
তরী মিটিমিটি হেসে বলল,

-“তোকে তো কুড়িয়ে পেয়েছি আমরা। তাহলে তোর আবার কিসের আবদার?”
অরু রে*গে গিয়ে ধমকে উঠলো তরীকে,
-“আমার কেউ নেই। মিঠু পঁচা কুমড়া আমার ভাই না, তুমিও আমার বোন না।”
তরী অরুর মতোই গাল ফুলিয়ে রইলো। কথা বললোনা অরুর সাথে। মাঝেমাঝে আড়চোখে অরুকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। অরুর চোখ পড়তেই অন্যদিকে ফিরে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও যখন তরী কথা বললোনা, অরুর চোখে জল ভরে উঠলো। টলমল চোখে তাকিয়ে থেকেও তরীর সাড়া পেলোনা। ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে এসেই তরীকে ঝাপটে ধরে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে ফেলে আদুরে স্বরে বলল,

-“তুমি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো? আমার কান্না পাচ্ছে কেন? তুমি কষ্ট পেওনা। আমিতো মিছেমিছি বলেছি। আমার একটা মিঠু আছে, একটা তরী আছে তো। আমার সবাই আছে।”
তরী বেশিক্ষণ হাসি চেপে রাখতে না পেরে শব্দ করেই হেসে ফেললো। মা-বোন দুজনকে একসাথে হাসতে দেখে লজ্জা পেলো অরু। তরীর ঘাড় থেকে মাথা তুললো না। ওভাবেই কে*টে গেল কয়েক মুহূর্ত।

পুরোনোদের বিদায়ী বেলায় নতুনদের আগমন। ভার্সিটি প্রাঙ্গণ আজ মেতে উঠেছে নবীনদের বরণের উৎসবে। জাঁকজমকপূর্ণ সাজে সেজে উঠেছে ক্যাম্পাস। তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে তরী। বান্ধবীদের সাথে মিলিয়ে খয়েরী রঙের শাড়ি কিনেছে । গোসল সেরে ঝট করেই তৈরি হয়ে নিলো। পিঠ ছড়ানো চুল শুকিয়ে ঢিলে খোঁপা বেঁধে নিলো। অল্পস্বল্প সাজলো। হাতে কাঁচের চুড়ি পরতে পরতেই আয়নায় চোখ স্থির হলো। নিজের কাছেই নিজেকে চমৎকার লাগছে। মিষ্টি করে হাসলো তরী। পার্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই মেসেঞ্জারে টুং করে বার্তা এলো।
❝সামনের দিকে হেঁটে আসুন। আমি সিএনজি নিয়ে অপেক্ষা করছি।❞

পার্সে ফোন ঢুকিয়ে নেমে পড়লো তরী। আজ ভার্সিটিতে নবীনদের বরণের উদ্দেশ্য আয়োজিত অনুষ্ঠানের কথা মাহমুদের জানা। তরীর কাছ থেকেই জেনেছে। তরী ভাবেনি লোকটি তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। সে সামনে এগোলো না। বাড়ির সমানেই দাঁড়িয়ে রইলো রিকশা নেওয়ার উদ্দেশ্যে। তরী নিশ্চিত মানুষটি অন্যদিনের মতো তাকে অস্বস্তিতে ফেলে তাকিয়ে থাকবে। দৃষ্টির নড়চড় হবেনা এক মুহূর্তের জন্য। আজ এমনিতেই একটু বেশি বেশি লজ্জা লাগছে তার। তরীর লজ্জায় ডুবিডুবি অবস্থায় আবারও টুংটাং শব্দে বার্তা এলো। তরী কাঁপা হাতে ফোনের স্ক্রিন অন করলো।
❝আমি অপেক্ষা করছি তো, তরী। দ্রুত আসুন।❞

তরী দোনোমোনো করে পা বাড়ালো সামনে। একটু সামনে এগোতেই সিএনজি নজরে এলো। মাহমুদকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার যাত্রা পথের দিকেই চেয়ে আছে। কোন কথা না বলেই চুপচাপ উঠে পড়লো তরী। মাহমুদের চোখে চোখ রাখতে পারলোনা। বড়োসড়ো এক ধাক্কা লাগলো মাহমুদের বুকে। সবকিছু ভুলে-টুলে তরীকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো৷ তরীর কোমল গাল দুটো আরক্তিম হলো। জড়োসড়ো হয়ে বসলো সে। মাহমুদ ঘোরের মাঝেই বলল,
-“আপনি আমার বুকের ভেতর গড়ে ওঠা প্রেম ঘাটের একমাত্র খেয়াতরী। এই ঘাটে যে আর কোন তরী এসে ভীড়বে না, তরী।”

তরীর কপালে চিকন ঘাম দেখা দিলো। ক্রমাগত ঢোক গিলছে। হাঁসফাঁস করে বলল,
-“আমার ভীষণ গরম লাগছে।”
মাহমুদ ঘোর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। পকেট থেকে টিস্যু বের করে তরীর দিকে বাড়িয়ে দিলো। কপালের ঘাম মুছে নিতে বলে তরীর দিকে পিঠ দিয়ে বসলো। তরী দুর্বল হাতে ঘাম মুছে নিলো। মাহমুদ আর বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই ভুলচুক কিছু একটা হয়ে যাবে। চোখ বুজে লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। আর একটিবারের জন্যেও তাকালোনা তরীর দিকে। বুকের ভেতর দুরুদুরু কম্পন টের পাচ্ছে। তরীকে নামিয়ে দেওয়ার আগে একবার চোখে চোখ রেখে তাকালো। প্রসক্ত কন্ঠে আবদার করে উঠলো,

-“আজ আপনাকে একা ভার্সিটি যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না, তরী। আজ বাসায় চলে গেলে হয় না?”
তরী মৃদু শব্দ করে বলল,
-“বান্ধবীদের কথা দিয়ে ফেলেছি। সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য।”
মাহমুদ ব্যাকুল হয়ে বলল,
-“আমার যে আজ বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে, তরী।”
তরী গুটিয়ে রাখা ডান হাত বাড়িয়ে মাহমুদের হাত ছুঁয়ে দিলো। মাহমুদ আশ্বস্ত হলো। তার মনের মেঘ সরে গিয়ে রোদের দেখা মিললো।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৯

(প্রচন্ড সর্দি-জ্বরে ভুগছি। গতকাল অল্পস্বল্প থাকলেও আজ অসুস্থতা বেড়ে গিয়েছে। রাতের অর্ধেক লিখা ছিলো বিধায় অল্প একটু লিখে পোস্ট করতে পেরেছি। আগামীকাল গল্প না-ও দিতে পারি!)

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১১