অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৯

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৯
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

বর্ষপঞ্জিকার পাতায় চলছে বৃষ্টিভেজা আষাঢ় মাস।
আষাঢ় হলো প্রেমময় মাস। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। গাছে গাছে কদম ফুলের থোকা। জৈষ্ঠ্যের জ্বালাময়ী রুক্ষতাকে বিদায়ী বার্তা জানিয়ে আগমন ঘটলো আষাঢ়ের। শুষ্কতা বিদায় নিয়ে ঝুম বৃষ্টি নামে। প্রকৃতি সেজে ওঠে নব রূপে। প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটায় প্রেম ঝরে পড়ে। প্রবল বর্ষণ বয়ে আনে শীতলতা। বৃষ্টির তালে তালে ময়ূর পেখম মেলে নাচে। বিলের জলে ফোটে ওঠে রঙিন পদ্ম। আষাঢের এই রহস্যময়ী রূপে জমে ওঠে কপোত-কপোতীর প্রেম।

তরীর আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ভীষণ ইচ্ছে হলো। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছুটলো ছাদে। মনের আনাচ-কানাচে মিষ্টি ভালোলাগা। একটু একটু করে পুরোটাই বৃষ্টির আয়ত্তে চলে গেল তরী। ঝুমঝুমি বৃষ্টির তালে ঘুরে বেড়ালো পুরো ছাদ। নামলো সুখ অনুসন্ধানে। ঘন্টাখানেক মুষলধারে বৃষ্টি হলো। তরী ততক্ষণ ভিজলো। শরীরের সাথে লেপ্টে যাওয়া জামা টে*নে*টু*নে ঠিক করে নামলো সিঁড়ি বেয়ে। মাঝপথেই মাহমুদের সাথে দেখা। পা জোড়া থেমে গেলো সেখানেই। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো তরীর, সাথে আকাশস্পর্শী অস্বস্তি। এলোমেলো দৃষ্টিতে আশপাশে দেখলো। লজ্জাবতী গাছের পাতার মতো নুইয়ে পড়ছে যেন। বারবার জামা ঠিক করার চেষ্টা করছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাহমুদ চোখ ফিরিয়ে নিলো। অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
-“আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে, তরী। দ্রুত ঘরে ফিরুন।”
তরী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। ছুটে পালিয়ে গেলো। আজ আর সে বাসার বাইরে বের হবেনা। কিছুতেই না।
তরীর ছুটে যাওয়া পথে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল মাহমুদ,
-“আমায় সামলে থাকতে দিচ্ছেন না কেন, তরী?”

তরী শুনলোনা প্রেমিক পুরুষের আকুলতা। সে ছুটে চললো এক সমুদ্র লজ্জা নিয়ে। পিছু ফিরলেই যে অনর্থ কিছু ঘটে যাবে।
জামা পাল্টে কাঁথামুড়ি দিলো তরী। মায়ের ডাকাডাকিতেও সাড়া দিলোনা। এখনো তার বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করে উঠছে। হাত-পা কাঁপছে। চোখেমুখে তার লজ্জার আভা। চোখ বুঝে বড়োসড়ো দুটো শ্বাস নিলো।
তখনই ফোনে টুংটাং শব্দ হলো। বার্তা এলো বিপরীত দিক থেকে।
❝বারান্দায় আসুন, তরী। অপেক্ষা করছি আমি।❞

তরী ফোন ওভাবেই রেখে দিলো। সে গেলোনা বারান্দায়। নাকচ করলো মাহমুদের আদেশ। সে যেমন পরিস্থিতিতে ছিলো, এই মুহূর্তে চোখে চোখ রাখতে পারবেনা। ইশ! কেনই বা ভিজতে গেল সে? নিজেকেই দো*ষা*র*প করে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে মাহমুদের সামনে পড়লে নির্ঘাত অস্বস্তিতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে সে। নিজের প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস তার নেই। আধা ঘন্টা সময় পেরিয়ে গেলো। না তরী বারান্দায় গেলো আর না কোন বার্তা এলো। লোকটি কি এখনো দাঁড়িয়ে আছে? মনে মনে কৌতুহল হানা দিতেই ধীর গতিতে বিছানা ছাড়লো তরী। খট করেই বারান্দার দরজা খুলে দিলো। বাইরের ঝড়ো হওয়া উঠিয়ে দিলো তার ভেজা চুল। বাতাসের দাপটে ক্ষীণ হয়ে এলো চোখজোড়া। ঝট করেই ডান পাশে চোখ ফেরালো তরী। মানুষটি যায়নি। তার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছে। বিভোর হয়ে তাকেই দেখছে। তরীর বার কয়েক পলক ঝাপটালেও মাহমুদের পলক পড়লোনা। গভীর অনুযোগের স্বরে মাহমুদ বলল,

-“এতক্ষণ আসেন নি কেন, তরী? আমি যে আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।”
তরীর ভাসা ভাসা চোখে অবলোকন করলো মাহমুদকে। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখছে তাকে। অপলক, স্থির চাহনি। তরী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,
-“কেন অপেক্ষা করছিলেন?”
-“আমার ভালো থাকার জন্য।”
তরী জবাব দেওয়ার মতো কোন শব্দ খুঁজে পেলোনা। তার শব্দ ভান্ডার ফুরিয়ে এলো। শরীরে বয়ে গেল শীতল স্রোত। তরীর মনে হলো লোকটি এখনো তাকে দেখছে, বেশ মনযোগ দিয়ে দেখছে। তরতর করে তরীর অস্বস্তি বাড়লো। তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,

-“আমি ঘরে যাচ্ছি।”
তরী ঘরে ফেরার জন্য পা বাড়াতেই মাহমুদ বাদ সাধলো। গলায় তীব্র আকুলতা,
-“আরেকটু থাকুন না, তরী।”
তরী কেন যেন ফেলতে পারলোনা মানুষটির কথা। পা থামিয়ে দিল। আরেকটু সময় কাটলো বারান্দায়। যতবার আড়চোখে লোকটিকে দেখেছে, ততবারই নিজের জন্য মানুষটির চোখে মুগ্ধতা দেখেছে।

স্কুল ছুটির সময়। রাস্তায় দলবেঁধে নামলো বাচ্চারা। পরনে সাদা ইউনিফর্ম। তাদের মধ্যে রামি আর মিঠু বন্ধুদের সাথে বাসায় ফিরছে। সহপাঠীদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলো,
-“তোমাদের বাড়ি কোথায় রামি?”
রামি দু’আঙ্গুলে নাক উল্টে নাকের ছিদ্রপথ দেখিয়ে বলল,
-“এই জায়গায় আমাদের বাড়ি।”
মিঠু হেসে কুটিকুটি। হাসতে হাসতেই রাস্তায় বসে পড়লো। যে ছেলেটি প্রশ্ন করেছিল সে বোকা বনে গেল।
মিঠু বলল,

-“এরা হলো গরিবের জাত। বাড়িঘর নেই। আমি আবার দয়ালু ব্যক্তি। একবার এসে আমার পা ধরে গড়াগড়ি খেতেই বাড়িতে জায়গা দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন দেখি গরিবের আরেকটি পরিচয় বের হয়েছে। বেটা মীরজাফর। আমার বাসায় থেকেই আমার সাথে ছ*ল*চা*তু*রী করার চেষ্টা করে।”
রামি উত্তেজিত হলোনা। ঠান্ডা মাথায় নিচে বসে পড়লো। রাস্তার মধ্যেই মিঠুর প্যান্ট টে*নে ধরে বলল,

-“ভাই আপনি দয়ার সাগর, জমিদারের বংশধর। আপনার তুলনা হয়না। আপনার নিশ্চয়ই প্যান্টের অভাব হবেনা। হলেও গাছের ছাল, লতা-পাতা দিয়ে ইজ্জত ঢাকার মতো উদার আপনি। আমাকে এই প্যান্টটি দিন ভাই। আমি গরিব মানুষ। কাপড় কেনার টাকা নেই। আপনি প্যান্ট না দিলে বেইজ্জতি হয়ে মা*রা পড়বো আমি।”
মিঠু দুহাতে প্যান্টের কোমর চেপে ধরে রেখেছে। পা নাড়িয়ে রামিকে সরানোর চেষ্টা করে বলল,
-“প্যান্ট ছাড় রামির বাচ্চা। থা*প*ড়ে তোর গাল লাল করে দেবো।”

ক্লাসের জন্য তৈরি হয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নামলো তরী। সাথে বাবা আছেন। তিনতলায় নামতেই মাহমুদকে বের হতে দেখলো। তরী তাড়া দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে নেমে গেল। মাহমুদ পেছন পেছন নেমে এলো।
বাবা তরীকে নিয়ে একটি সিএনজিতে উঠলেন। তরীকে বাস স্টপেজ এ নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজে যাবেন। মাহমুদ সামনে ড্রাইভারের সাথে চেপে বসলো। তার দৃষ্টি সামনে।

অনেকটা রাস্তা পেরোনোর পর তরীর ধারণা ভ্রান্ত হলো। মাহমুদ রাস্তায় তাকিয়ে নেই। সামনের লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে তাকেই দেখছে। তরী জড়োসড়ো হয়ে বাবার সাথে চেপে বসে রইলো। তিনি ফোনে কথা বলছেন। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। এই বুঝি বাবা দেখে ফেললেন। আবারও আড়চোখে তাকালো তরী। মাহমুদ এখনো শান্ত চোখে তাকেই দেখছে।
তরীর চোখে স্পষ্ট ভীতি। মাহমুদ আর বাড়াবাড়ি করলোনা। তরীকে স্বস্তি দিয়ে সামনে তাকালো। প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়লো তরী। বাবা তাকে নামিয়ে হাতে কচকচে নোট গুঁজে দিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। তরী বাসে উঠে জানালার বাইরে চোখ রাখলো। বাস ছেড়ে দিতেই দোকানের ছাউনি ছেড়ে বেরিয়ে এলো মাহমুদ। দক্ষিণে পা চালিয়ে কলেজ গেইটে ঢুকে পড়লো।

আকাশে ঘন কালো মেঘ। ভার্সিটি থেকে বের হলো তরী। বান্ধবীদের বিদায় জানিয়ে বাস স্টপেজ এর দিকে কদম ফেললো।
-“তরী।”
পেছন ফিরে ভারি চমকালো তরী। ঘড়িতে সময় চেইক করে নিলো। তিনটা বেজে বিশ মিনিট। লোকটি এদিকে এসেছে কেন? এই সময়ে তো তার বাসায় থাকার কথা।
মাহমুদ দ্রুত পা চালিয়ে তরীর পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো।
-“চলুন।”

তরী আশেপাশে সাবধানী নজর বুলিয়ে নিলো। মাহমুদ শান্ত স্বরে বলল,
-“এটা আপনার এলাকা নয় তরী। কেউ চিনবে না। এত কেন ভয় পাচ্ছেন, বলুন তো?”
তরী রাস্তায় দৃষ্টি রেখে হাঁটলো। ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি হঠাৎ এইদিকে?”
মাহমুদ তরীর দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। আবিষ্ট কন্ঠে বলল,
-“গুরুত্বপূর্ণ একজনের সাথে দেখা করার ছিল।”
-“ওহ।”
-“গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি আপনি, তরী।”

তরী চমকালো না। মনে মনে ভেবে রেখেছিল লোকটি এমন কিছুই বলবে। তবে কেমন একটা নতুন অনুভূতির আভাস পেলো। মাথানিচু করে মাহমুদের পাশাপাশি হঁটলো।
তুমুল ঝড়বৃষ্টির দাপটে ভেঙে পড়লো ফুল সমেত কদম ফুলের ডাল। একটি বাচ্চা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুল থেকে ফিরছে। হাতে একগুচ্ছ কদম। তরী মুগ্ধ হয়ে দেখছে ঝরে যাওয়া কদম ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য। মাহমুদ বাচ্চা মেয়েটিকে থামিয়ে একটি কদম ফুল চাইলো।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৮

না করলোনা মেয়েটি। মাহমুদের হাতে একটি কদম গুঁজে স্থান ত্যাগ করলো। মাহমুদ যত্ন করে তরীর কানের পাশে কদম গুঁজে দিলো। তরী ঘনঘন পলক ঝাপটালো। মাহমুদ তরীর চোখে চোখ রেখে বলল,
-“এই ফুল আপনার জন্যই সৃষ্টি, তরী। আর তরী নামক ফুলটি আমার জন্য।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ১০