অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭১

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭১
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

মিনিট দশেক হল জ্যামে পড়েছে গাড়িটা। অতিষ্ঠ হয়ে কানে ইয়ারফোন গুজে বসে আছে ফারিয়া। হাত ভাঁজ করে তাকিয়ে আছে বাইরে। পাঁচ মিনিট অতিক্রম হওয়ার পর তমালের কপালেও ভ্রুকুটি দেখা দিল। স্টেয়ারিং এ হাত রেখে আঙুল ওঠানামা করাতে করাতে অপেক্ষা করছে জ্যাম ছাড়ার। একটা সিগারেট ধরানোর চিন্তা করেছিল। কিন্তু ফারিয়ার উপস্থিতির কারণে সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দেয়। কুটনি মহিলা ঠিক তুহিনের কাছে গিয়ে নালিশ করবে। সে বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত তমাল।

রানি অর্থাৎ প্রিয়তার পদবীটা জানার পর আর এক মুহূর্তও স্থির হয়ে বসে থাকতে পারেনি তুহিন। সঙ্গে সঙ্গে তমাল আর ফারিয়াকে পাঠায় সেই কলেজে। তুহিনের বিশ্বাস আমের ভিলা আর সোলার সিস্টেমের সকল রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুর খোঁজ ঐ কলেজেই পাওয়া যাবে।
অসহ্যকর জ্যামের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আর চুপ থাকতে পারল না তমাল। আড়চোখে একবার ফারিয়ার দিকে তাকাল। গলা ঝেড়ে বলল, ‘বলছিলাম, তোমারও কী তাই মনে হচ্ছে যেটা তুহিন স্যারের মনে হয়? পদবী মিলে যাওয়ার ব্যপারটা কাকতলীয় হতে পারেনা?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘পারে। কিন্তু নাও হতে পারে।’ বরাবরের মতোই যান্ত্রিক কন্ঠে বলল ফারিয়া।
‘আচ্ছা কলেজে কখনও ওনার পরিবারের কেউ আসেনি?’
‘ওর সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিলোনা আমার। ইনফ্যাক্ট কারো সাথেই ছিলোনা। শুধু চুপচাপ ক্লাসে আসতো। ক্লাস করতো। আবার চলে যেতো। ক্লাস টিচার ছাড়া অন্যকারো সঙ্গে কখনও কথা বলতে দেখিনি ওকে আমি।’
‘স্ট্রেঞ্জ!’
‘হ্যাঁ। আমরাও ওকে দেখে তাই বলতাম, স্ট্রেঞ্জ।’

জ্যাম ছাড়ল। গাড়ি স্টার্ট করল তমাল। এতক্ষণ পরে মুক্তি পেয়ে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে উঠল। আড়চোখে আরও একবার দেখল ফারিয়াকে। কাঁধের খানিকটা নিচে পড়ে ফারিয়ার চুল। এখন সেটা হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে আটকে রেখেছে। সামনের ছোট করে কাটা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। ভালোই লাগছে।
একবার কথা শুরু করতে পেরে সেটা চালিয়ে যেতে ইচ্ছে হলো তমালের। এমনিতেও বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারেনা ও। ব্যপারটা সহজ করতে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই বলল, ‘তা বিয়ে-টিয়ের ব্যপারে কিছু ভেবেছো না-কি? বিয়ের বয়সতো হয়েছে।’

ভ্রু কুঁচকে তমালের দিকে তাকালো ফারিয়া। ‘সেটা নিয়ে তোমার এতো ইন্টারেস্ট কীসের?’
‘বাঃ রে। নিজের সহকর্মীকে নিয়ে এইটুকু ভাবা যায়না বুঝি? না-কি এখনো তুহিন স্যারের অপেক্ষায় বসে আছো?’
কটমটে চোখে তমালের দিকে চাইল ফারিয়া। রাগে গজগজ করে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘আচ্ছা, ওনার গার্লফ্রেন্ডকে ইদানিং ফোন করতে দেখিনা আমি। ওনাদের মধ্যে কী কোন সমস্যা হয়েছে?’

দুষ্টুমি খেলা করা মুখটা হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল তমালের। প্রায় একমিনিটের মতো কোন জবাব দিলোনা ফারিয়ার প্রশ্নের। তারপর বলল, ‘সবকিছু ঠিক না থাকলেও ঠিক হয়ে যাবে। স্যারের মনে ইরা ম্যাম ছাড়া আর কারো জায়গা নেই। সেটা যত তাড়াতাড়ি মানতে পারবে। ততই ভালো।’
‘আমিতো এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম।’
‘যার মনে ইতিমধ্যে অন্যকেউ আছে তার কথা না ভেবে, এমন কারো কথা ভাবো যার মনে কেবল তুমিই আছো।’
‘এমন কেউ আছে বুঝি?’
‘আছে বোধ হয়। ভালোভাবে নিজের আশেপাশে তাকিয়ে দেখো। চোখে পড়লেও পড়তে পারে।’
কথাটা বলে আর ফারিয়ার দিকে তাকাল না। গাড়ি চালানোতেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করল তমাল। তাকালে ঠিকই দেখতে পেত ফারিয়ার ঠোঁটের চাঁপা, মিষ্টি হাসি।

স্কলারস স্কুল এন্ড কলেজ। অফিসের রুমে বসে আছে তমাল আর ফারিয়া। ওদের সামনে বসে রেজিস্ট্রার কম্পিউটার ঘাঁটছেন। নিজেদের প্রাক্তন ছাত্রী রানির তথ্য খুঁজছেন। সাল, ব্যাচ, বিভাগ সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে ফারিয়া। ফারিয়াও একই ব্যাচের, একই বিভাগের হওয়াতে ঝামেলা অনেকটাই কমেছে।
ওরা আসার পর শুরুতে তেমন ভাও দিচ্ছিলেন না কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে ব্যপারটার গুরুত্ব বলতেই বেশ তোষামোদ শুরু করে তারা। সম্মানের সঙ্গে ওদের দুজনকে অফিস রুমে নিয়ে যায়। রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেয় ওদের কথা মতো কাজ করার।

‘পেয়েছি!’
রেজিস্ট্রারের গলার আওয়াজে চমকে ওঠে তমাল-ফারিয়া। সে দ্বিতীয়বার বলে, ‘আপনারা যাকে খুঁজছেন তাকে আমরা পেয়েছি।’
উঠে দাঁড়ায় তমাল। দ্রুত এগিয়ে যায় কম্পিউটারের সামনে। উঁবু হয়ে তাকায় মনিটরে। সেখানে জ্বলজ্বল করছে প্রিয়তা ওরফে রানির বায়োগ্রাফি। ফারিয়াও বসে থাকতে পারল না। নিজে গিয়ে দাঁড়াল তমালের পেছনে। তমালের কাঁধে হাত রেখে ঝুঁকে তাকাল মনিটরের দিকে। যা দেখল তাতে তমাল, ফারিয়া দুজনের মুখই হা হয়ে গেল। তারমানে তুহিন যেটা ধারণা করেছিল সেটাই সত্যি! পদবী মিলে যাওয়ার ব্যপারটা কাকতলীয় নয়!

নিজের কেবিনে এসে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয় তুহিন। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। হাত বাড়ির ওয়াটার পটটা নেয়। ঢকঢক করে কিছুটা পানি খেয়ে ভিজিয়ে নেয় গলাটা। তমাল আর ফারিয়া কী খবর নিয়ে আসে সেটা জানার জন্যে উশখুশ করছে ওর মন। সেখানেই তো সব রহস্যের সমাধান!

তুহিন নিজেই যেত। কিন্তু রানির সেই কলেজের দূরত্ব এখান থেকে প্রায় তিন ঘন্টার। কাজ সেড়ে যেতে-আসতে কম করে সাত-আটঘন্টা লেগে যাবে। কিন্তু সেই নকল নার্সের ঠিকানায় যেতে হবে ওকে। খোঁজ নিতে হবে সেই মহিলা আদোও ওখানে থাকে কি-না। আলাদা আলাদাভাবে কাজগুলো করতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাবে। এইমুহূর্তে নষ্ট করার মতো এক সেকেন্ডও নেই ওদের হাতে। ওপর থেকে চাপ আসছে। শান মীর্জা এখনো রুদ্রর হাতে বন্দি। বেঁচে আছে কি-না তাও জানা নেই। তুহিনের নাকের ডগা দিয়ে তাকে নিয়ে গেছে রুদ্র। যদি মে/রে ফেলতেও সক্ষম হয় সেটা তুহিনের আরও এক ব্যর্থতা হবে। আর হেরে যাওয়ার অভ্যেস নেই তুহিনের।

তাই তমাল-ফারিয়াকে স্কলারস্ কলেজে পাঠিয়ে নিজে যায় সেই নকল নার্সের ঠিকানার। কিন্তু সেখানে গিয়ে খুঁজে পায়না তাকে। যদিও তুহিন জানতো পাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। তবে আশেপাশে ভালোভাবে খোঁজ করতেই কিছু তথ্য আসে। সেখান থেকে কিছু সম্ভাব্য ঠিকানা পায়। তারমধ্যে একটা ঠিকানা সাভারের খুব কাছেই। আর শানকেও সাভারের হসপিটাল থেকেই কিডন্যাপ করা হয়েছে। দুইয়ে দুইয়ে কেমন চার হচ্ছে বুঝতে কষ্ট হয়না। তুহিনের ধারণা ওখানে গেলেই পাওয়া যাবে সেই নার্সের খোঁজ।

এরমধ্যে আবার কল করেছিলেন শওকত মীর্জা। আজ তুহিনের সঙ্গে কথা বলতে চান উনি। আসছেন অফিসে। ইচ্ছে না থাকলেও রাজি হয়ে যায় তুহিন। দেখা যাক, কী বলেন ভদ্রলোক।
তুহিনের এসব চিন্তার মাঝে মহিলা এক কন্সটেবল এলো তুহিনের রুমে। নিচু কন্ঠে বলল, ‘স্যার?’
‘কী হয়েছে?’
‘সেই ম্যাডাম বাড়ি ফিরতে চাইছেন। বারবার চেঁচামেচি করে বিরক্ত করছেন।’
‘তাকে বলো, বিকেলে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে। আমি যাবো তার সঙ্গে। তার আগে চেঁচিয়ে গলা ফা/টালেও কোন লাভ নেই।’
‘জ্বী স্যার।’

মহিলাটি চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস চাপল তুহিন। জ্যোতিকে জিজ্ঞেস করেছিল প্রিয়তার ‘রানি’ পরিচয় সম্পর্কে সে কিছু জানে কি-না। কোন উত্তর দেয়নি জ্যোতি। নিশ্চুপ ছিল। তুহিনও বেশি ঘাটায়নি। কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন করছেন এসব? ঐ পরিবারের কেউ নন আপনি। তাদের নিয়ে ভাবতে গিয়ে নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন? কেন বন্দিদশা স্বীকার করে নিচ্ছেন?
উত্তরে জ্যোতি বলেছিল, ‘ওটা রুদ্রর পরিবার স্যার। আর ওর সবকিছু আগলে রাখা আমার দায়িত্ব। জীবনে এতোটা ভালো অন্যকাউকে বাসিনি যতটা ওকে বেসেছি। নিজের শেষ নিঃশ্বাস অবধি ওর সবকিছু আগলে রাখব।’

মেয়েটাকে দেখলে অদ্ভুত মায়া হয় তুহিনের। এক তরফা ভালোবাসার কী ভয়ানক শক্তি তা জ্যোতিকে দেখে জেনেছে তুহিন। রুদ্রর কাছ থেকে কোনভাবে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা পায়নি। তাও এখনো কতটা ভালোবাসা! ভালোবেসে আগলে রেখেছে রুদ্রর পরিবারকে। ভালোবাসা কতটা নিঃস্বার্থ হলে এটা সম্ভব ভাবলেও শরীরে কাঁটা দেয় তুহিনের।
ইরার কথা মনে পড়ল। ঐ মেয়েটাওতো নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছে ওকে। ওর অগোছালো জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যে সবসময় ত্যাগ স্বীকার করেছে। কিন্তু ও কী করেছে? সত্যিই কিছু করেছে কী?

ওদের দুজনের কম্প্রোমাইজিং এর পরিমাপ করতে গেলে তুহিনের পাল্লা বরাবরই হালকা। একটা বেশিই হালকা। একতরফা ত্যাগ স্বীকার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়াটা কী স্বাভাবিক না? ইরার রেগে যাওয়াটা কী খুব বেশি অযৌক্তিক ছিল? নাকি তুহিনের নতি স্বীকার না করে, অহম নিয়ে বসে থাকাটা? উত্তরটা যেন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে তুহিনের। দীর্ঘদিন পর বিবেক দংশনে ভুগছে ও। কিন্তু এখন উত্তরটা পেয়েও কী কোন লাভ আছে? লাভ আছে বিবেকের এই দংশনে? শুনেছে ইরার বাবা ইরার বিয়ে ঠিক করতে চাইছেন। ইরা এতোদিন অমত করেছিল একমাত্র তুহিনের জন্যে। কিন্তু এখন? এখন নিশ্চয়ই না করবে না? করার কোন কারণ অবশিষ্ট নেই।

তারমানে কী দাঁড়ায়? সত্যিই ওর ইরাবতী আর ওর নেই। সত্যিই নেই? ভাবনাটা মনে আসতেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল তুহিনের। নিঃশ্বাস আটকে এলো। হারিয়ে গেল গভীর চিন্তায়।
ফোনের আওয়াজে ধ্যান ভঙ্গ হল ওর। নিরুৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো ফোনের স্ক্রিনে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করে বলল, ‘হ্যাঁ তমাল বলো?’

ওপাশ থেকে তমাল যা বলল তাতে আপনাআপনি ঠোঁটে ধূর্ত হাসি ফুটল তুহিনের। অন্তরীকরণের জটিল অংক মিলে গেলে যেমন চোখ চকচক করে ওঠে। তেমনভাবেই জ্ব/লে উঠল ওর চোখজোড়া। বুক হালকা হল। এতোদিন যাবত যেসব প্রশ্নগুলো ওকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল। তার সমাধান যেন হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যেই।

মুখোমুখি বসে আছে সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদ আর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ এমপি শওকত মীর্জা। তুহিন ল্যাপটপে নিজের কাজে মগ্ন। শওকতের সঙ্গে ফর্মাল আলাপটা সেড়ে, দু কাপ কফি আনতে বলেই মন দিয়েছে কাজে। শওকত মীর্জা বসে আছে পাঁচ মিনিট হয়েছে। অথচ তুহিনের হেলদোল নেই বললেই চলে। পিয়ন কফি নিয়ে এলো। কফি আসার পর এতক্ষণে তুহিন ল্যাপটপ থেকে চোখ সরাল। বন্ধ করতে করতে বলল, ‘দুঃখিত! একটু অপেক্ষা করতে হলো আপনাকে। আসলে হাতের কাজটা না সেড়ে উঠতে পারছিলাম না। কী খাবেন বলুন? চা-কফি না-কি ঠান্ডা কিছু?’

অপমানটা গায়ে মাখল না শওকত। কফির মগ হাতে নিয়ে তীক্ষ্ম চোখে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনিযে দ্রুত কাজ শেষ করে, আমার দিকে তাকানোর সুযোগ পেয়েছেন তাতেই আমি খুশি।’
তুহিন অমায়িক হাসল। নিজের কফির মগটা হাতে নিয়ে বলল, ‘তো বলুন। হঠাৎ এখানে পদধুলি দেওয়ার কারণ?’
‘কারণটা আপনার অজানা নয়। আমার ছেলের কোন খোঁজ এখনো কেন পাওয়া গেলোনা অফিসার?’

‘কারণ আপনার ছেলে কোন জায়গা নয়। আর আমরা কেউ গুগল ম্যাপ নই। যে সার্চ করবেন আর স্ক্রিনে ভেসে উঠবে।’
তুহিনের ত্যাড়া জবাবে মেজাজ বিগড়ে গেল শওকতের। তেঁতে উঠতে গিয়েও নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। সামনে নির্বাচন। ছোটখাটো কোন ভুলও করা যাবেনা এখন। জোরপূর্বক শান্ত স্বরে বলল, ‘তা আমি জানি। কিন্তু আমার ছেলে নিখোঁজ হয়েছে দুটো দিন হয়ে গেছে অফিসার। একটা সিরিয়াল কি/লারের কাছে আছে ও। আর আপনারা এমন গা ছাড়া কাজ করছেন? জঘন্য ক্রি/মি/নাল কিন্তু ও।’

‘আপনার চেয়ে কম।’ ‘বিড়বিড় করল তুহিন।
‘কী?’
‘হাত পা গুটিয়ে বসে নেই আমরা মিস্টার মীর্জা। খোঁজ চলছে। সারাদিন অলেম্পিকের রেইসের মতো দৌড়তে থাকলেইতো আপনার ছেলেকে খুঁজে পাবোনা আমরা। টেকনিক্যালি কাজ করতে হবে। আর আমরা সেটাই করছি।
শওকত এবার গম্ভীর হলেন। হারিয়ে ফেললেন ধৈর্য্য।টেবিলের দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘কত টাকা চাই আপনার?’
‘মানে?’ ভ্রুকুটি করল তুহিন।

‘আমার ছেলের কিডন্যাপারের খোঁজ আমায় দেবেন। বাকিটা আমি দেখে নেব। বলুন কত লাগবে?’
‘ভেবে চিন্তে কথা বলছেন তো শওকত সাহেব। কোথায়, কার সামনে, কী বলছেন?’
হুঁশ এলো শওকতের। বুঝল ভুল করে ফেলেছে। টাকার কথায় যে তুহিন গলবেনা সেটা সে চেহারা দেখেই বুঝে নিয়েছে। তাই কথা ঘোরাতে কন্ঠে মিথ্যা আবেগ ঢেলে বলল, ‘পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি অফিসার। পাগল হয়ে যাচ্ছি। কদিন আগে নিজের একমাত্র ভাইকে হারালাম। আর আমার ছেলেটা বেঁচে আছে কি-না তাও জানিনা। একটিমাত্র ছেলে আমার। একজন বাবার কাছে মুহূর্তটা কতটা যন্ত্রণার সেটা ভাবুন। একটাবার ভাবুন। নিজের ছেলের এতোবড় বিপদ। কোন বাবা এইসময় স্থির থাকতে পারে? বলতে পারেন?’

তুহিন শওকতের দিকে তাকিয়ে চোখে হেসে কফির মগে চুমুক দিল। মগটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, ‘সেটা জানিনা। তবে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে, নিজের চরম শত্রুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে, নিজেরই একমাত্র মেয়েকে শত্রুগৃহে পাঠিয়েও অনেক বাবা স্থির থাকতে পারে। তাইনা শওকত মীর্জা?’

চকিতে চাইল শওকত। অদ্ভুত এক ভীতি খেলে গেল সমগ্র চেহারা জুড়ে। শীতের মধ্যেও ঘেমে গেল মুখমণ্ডল। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে শুরু করল। সেটা দেখে অদ্ভুত এক আনন্দ পেল তুহিন। সেই আনন্দকে দ্বিগুণ করতে ছুড়লো আরো এক প্রশ্ন বাণ,
‘আপনার একটা মেয়েও আছে শওকত সাহেব। কোথায় সে?’

অতীত ~
আবছা অন্ধকারাচ্ছন্ন আর কুয়াশাঘেরা রাস্তা ভেদ করে এগিয়ে চলেছে উচ্ছ্বাসের গাড়ি। নাজিফা কল দিয়েছিল কিছুক্ষণ আগেই। পাগলের মতো কান্না করছিল। কান্নার দমকে উচ্চারণ করতে পারেনি একটা শব্দও। ভোরবেলা একটা মেয়ে নিজে ফোন করে এভাবে পাগলের মতো কান্না করছে। গুরুত্বর কিছু ঘটে গেছে বুঝতে বাকি থাকেনা উচ্ছ্বাসের। মেয়েটা গর্ভবতী। ডেলিভারীর ডেট এগিয়ে আসছে। কথাগুলো চিন্তা করে দম বন্ধ হয়ে আসে উচ্ছ্বাসের। প্রেয়সী ঠিক নেই। কথাটা চিন্তা করে আর স্থির থাকতে পারেনা। তখনই ছুটে বেরিয়ে আসে। নাজিফার বাড়ি আমের ভিলা থেকে দূরে নয়। অথচ এই অল্প সময়ের পথটাও যুগ যুগান্তরের পথ বলে মনে হলো উচ্ছ্বাসের। বেপরোয়া গাড়ি চালিয়েও যেন শেষ করতে পারছিল না পথটুকু।

নাজিফার বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে নামে উচ্ছ্বাস। লোকজনের ভীড় আর ক্রন্দন ধ্বনি শুনে উচ্ছ্বাস অনেকটা অনুমান করে ফেলে যে কী অঘটন ঘটে গেছে। ভীড় ঠেলে দ্রুত ভেতরে যায়। ভেতর গিয়ে যে দৃশ্য দেখে তাতে আপনাআপনি পা থমকে যায় উচ্ছ্বাসের। নাজিফার বাবাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে খাটিয়াতে। বুঝতে বাকি থাকেনা চির নিন্দ্রায় শায়িত হয়েছেন তিনি। চোখ বন্ধ করে তপ্ত শ্বাস ফেলে উচ্ছ্বাস। চোখ মেলে আশেপাশে চোখ বুলায়। নাজিফার ভাইদের দেখতে পায়। বড় ভাবিকে দেখতে পায়। নাজিফার মা মাটিতে বসে বিলাপ করছেন।
নাজিফার কথা চিন্তা করেই বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে উচ্ছ্বাসের। এই অবস্থায় এই ধাক্কা মেয়েটা কীকরে সহ্য করছে? একমুহূর্ত দাঁড়ায়না উচ্ছ্বাস। দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। গোটা বসার ঘর জুড়ে ঘুরে আসে ওর দৃষ্টি। কেউ নেই ওখানে। কেবল অপিরিচিত লোকের ভীড়।

নাজিফাকে পাওয়া যায় শোবার করে। দরজার সামনে গিয়েই দাঁড়িয়ে পরে উচ্ছ্বাস। যে দৃশ্য দেখে তারপর আর নড়ার শক্তি পায়না ও। বিছানার ঝুলিয়ে বসে আছে নাজিফা। ওর ছোট ভাবি একপাশে ধরে রেখেছে ওকে। আরেকপাশে এক অপরিচিত মহিলা। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে নাজিফা। একহাতে ধরে রেখে ভারী পেটটা। ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে গেছে। বারবার চোখ উল্টে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করছে মাঝেমাঝে। বোঝাই যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে এখন কাঁদার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। ওর ভাবি, আশেপাশের মহিলারা বোঝানোর চেষ্টা করছে। সান্ত্বনার দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সব যন্ত্রণা কী সান্ত্বনার বাণী দূর করতে পারে?

উচ্ছ্বাসের চোখ ভিজে উঠল নাজিফার পরিণতি দেখে। ভীষণ ইচ্ছে করছে মেয়েটিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে। মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘কীসের এতো কষ্ট তোমার? আমি আছিতো তোমার পাশে। সারাজীবন থাকব।’
কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সবকিছু করার অধিকার থাকেনা। ‘সারাজীবন থাকব’ বলা গেলেও সারাজীবন থাকা যায়না। নিয়তির কাছে আমরা সকলেই তুচ্ছ, অসহায়। সেই অসহায়ত্ত্ব জ্বা/লিয়ে পু/ড়িয়ে শেষ করে দিল উচ্ছ্বাসকে। সাহস হচ্ছেনা নাজিফার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। বারবার মনে হলো, ওর মতো একটা অভিশাপ নাজিফার জীবনে এসেছিল বলেই নাজিফার আজ এই পরিণতি। নিজের অভিশপ্ত জীবনের ছোঁয়া দিয়ে ভালোবাসার মানুষটার জীবনটাও অভিশপ্ত করে দিয়েছে ও। উচ্ছ্বাস যেন শব্দহীন নীরব চিৎকার করে বলল, ‘ক্ষমা করো প্রেয়সী। নিজের জীবনের সমস্ত অভিশাপের অনাকাঙ্ক্ষিত ভাগিদার করে দেওয়ার জন্যে ক্ষমা করো আমাকে।’

তিন রুমের ফ্ল্যাটটা সাবলেট হিসেবেই ভাড়া দেওয়া। তবে ডাইনিংসহ আরেকটা রুম যে ভাড়া নিয়েছে সে নেই। কবে আসবে তারও ঠিক নেই। তাতে প্রিয়তার সুবিধাই হয়েছে। ও ছোট্ট একটা রুম নিয়েছে কেবল। রুদ্র যদি কোনভাবে খোঁজ নিয়ে এখানে পৌঁছেও যায়। তখন যেন কোনভাবেই সন্দেহ করতে না পারে। জমানো কিছু টাকা আর ছোট্ট একটা স্কুলে চাকরি করে কেউ গোটা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে, ব্যপারটা বিশ্বাসযোগ্য হবেনা। শেষ মহুর্তে এসে প্রিয়তা নতুন কোন ভুল করতে চায়না। এখন যা হবে নিখুঁত, নির্ভুল।

দীর্ঘ একঘন্টার শাওয়ার নিয়ে বের হল প্রিয়তা। পরনে কালো রঙের বাথরোব। মাথায় সাদা তোয়ালে পেঁচানো। বেশ শীত পড়েছে আজ। তবুও প্রিয়তার মধ্যে শীতানুভবের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। ফোনে একবার সময়টা দেখে নিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলল। কেটলিতে পানি নিয়ে বৈদ্যুতিক মাধ্যমে পানি গরম হতে দিল। বিছানার নিচ থেকে লাগেজটা তুলে রাখল বিছানার ওপরে। লাগেজটা খুলতেই দৃশ্যমান হলো কিছু পোশাক। পোশাকগুলোতে আনমনেই হাত বুলালো প্রিয়তা। আড়াই বছর যাবত এসব পোশাকই পড়ে আসছে ও। আড়াই বছর। হ্যাঁ, আড়াই বছরইতো। ওর ‘প্রিয়তা’ সত্তার আড়াই বছর!

কথাটা ভেবে মলিন হাসল প্রিয়তা। লাগেজ থেকে একটা নীল রঙের স্যালোয়ার কামিজ বের করে পরে নিল।
পানিটা গরম হতেই কফি মগের এক মগ গরম পানি নিল। কফির বোয়ামটা খুলে দু চামচ কফি নিল মগে। চেয়ারটা টেনে পায়ে পা তুলে বসল। চামচ দিয়ে মিক্সড করতে করতে কল দিল কারো নাম্বারে। রিং হওয়ার প্রায় সাথে সাথে রিসিভ করল ওপাশের ব্যক্তি। প্রিয়তা মগে চামচ ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘তোমার স্যার বেরিয়েছেন?’

‘জি ম্যাম। আধ ঘন্টা আগে। আপনি কল না করলে এখন আমিই কল করতাম আপনাকে।’
‘গুড। যেভাবে বলছি সেভাবে কাজ করতে থাকো।’
বলে ফোনটা নামিয়ে রাখল প্রিয়তা। কফির মগটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে গভীর চিন্তায় মগ্ন হল। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে হঠাৎই অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।

স্কুলের গেটের সামনে রিকশা থামে প্রিয়তার। রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে উল্টো ঘুরতেই পা থমকে যায় ওর। গেটের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। চোখে শক্ত দৃষ্টি। প্রিয়তা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে যায় রুদ্রকে। অযত্নে খোচা খোচা দাড়িগুলো হালকা বেরেছে। লালচে চোখ। চুলগুলোও এলোমেলো। অত্যধিক সুদর্শন এই পুরুষের সৌন্দর্য যেন তবুও একবিন্দু কমেনি। বেড়েছে বললে ভুল বলা হবেনা। রুদ্রও একই দৃষ্টিতে দেখছে নিজের প্রিয়কে। বিয়ের পর এতো দীর্ঘদিন একেওপরকে না দেখে কখনও কাটায়নি। তাই হয়তো ভারী নিঃশ্বাসের সঙ্গে একে অপরকে নিষ্পলক দেখে চলেছে। দুজনেই যেন তৃষ্ণার্ত চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে প্রাণভরে। অনুভূতিটা যেন সেই দুবছর আগের, চট্টগ্রামের সেই বাড়িতে টানা বারোদিন পর দেখা হওয়ার মতো।

রুদ্র ভেবে রেখেছিল খুব কঠোর ব্যবহার করবে আজ প্রিয়তার সঙ্গে। মনে মনে সেরকম প্রস্তুতি নিয়েও রেখেছিল। কিন্তু এতোদিনপর প্রিয়কে দেখে বিন্দুমাত্র রাগ পুষে রাখতে পারল না মনে। বুকের মাঝে পরম আদরে আগলে নিতে ইচ্ছে হল।
আস্তে আস্তে প্রিয়তার দিকে এগিয়ে গেল রুদ্র। প্রিয়তা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরালোনা রুদ্রর থেকে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ঠোঁটজোড়া। রুদ্রর চোখের আকুল দৃষ্টি পড়তে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছেনা ওর।
রুদ্র প্রিয়তার একদম মুখোমুখি দাঁড়াল। থমথমে গলায় প্রশ্ন করল, ‘ভালো আছো?’

প্রিয়তার শরীর যেন মৃদু কেঁপে উঠল। কিন্তু সঙ্গেসঙ্গেই লম্বা শ্বাস টেনে বলল, ‘কেনো এসেছেন? আমার বলা সেই কথাটা ভুলে গেছে আপনি? আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগের কোনরকম চেষ্টা করলে আমি নিজেকে শেষ করে দেব। তবুও এলেন? নাকি বাকি সবার মতো আমার জীবনটাও আপনার কাছে মূল্যহীন হয়ে গেছে?’
‘শাট আপ!’

রুদ্রর ধমকে থেমে গেল প্রিয়তা। রুদ্র হ্যাঁচকা টানে প্রিয়তাকে টেনে নিল নিজের দিকে। রাগে প্রায় গজগজ করে বলল, ‘এই মেয়ে! এতোটা নিষ্ঠুর কীকরে হতে পারো তুমি, আমার অশুদ্ধ জীবনের সঙ্গে তোমাকে জড়িয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলাম আমি। মানছি। তার প্রতিশোধ এভাবে নেবে? বারবার এককথা বলে, এভাবে মানসিক আঘাত করে কী শান্তি পাচ্ছো বলবে?’

‘ভুল কিছু বলেছি আমি? কেন এসেছেন এখানে?’
‘তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে।’
‘আমি যাবোনা।’
‘যেতে বাধ্য তুমি। ভালোভাবে না গেলে তুলে নিয়ে যাবো।’
‘কেন? ম/রার জন্যে?’

প্রিয়তার কথায় হাত আলগা হয়ে আসে রুদ্রর। কোমল দৃষ্টিতে তাকায় প্রিয়তার দিকে। অসহায় গলায় বলে, ‘আমি তোমার কিছু হতে দেবোনা প্রিয়। তুমি এভাবে নিরাপদ নও। রঞ্জুকেও মে/রে ফেলেছে ওরা। মৃ/ত্যুর আগে ও বলে গিয়েছিল তোমার বিপদের কথা। বোঝার চেষ্টা করো। তোমার কোন ক্ষতি আমি মেনে নিতে পারবোনা।’
প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। হাতটা ছাড়িয়ে চোখ মুছে বলল, ‘নিজের বোনকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন? বাবাকে বাঁচাতে পেরেছিলেন? আর আমার পুঁচকু সোনা? ওকে বাঁচাতে পেরেছিলেন? রঞ্জু ভাইকেও ম/রতে হলো। পেরেছেন বাঁচাতে? অথচ এটা ভাবছেন যে আপনি আমাকে বাঁচাতে পারবেন। চমৎকার!’

রুদ্র নিরুত্তর। প্রিয়তার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মুখ নেই ওর। রুদ্রকে চুপ থাকতে দেখে প্রিয়তা বলে, ‘তাহলে কোন ভরসায় যাব আমি আপনার সঙ্গে? কেন যাব? যার কাছে আমাদের প্রাণের চেয়েও বেশি মূল্য তার পেশা। তারকাছে ফেরার কোন কারণ আছে কী?’
‘জেদ করোনা প্রিয়।’
‘আজ আপনি জেদ করতে যাবেন না রুদ্র। আপনার জেদ বা গায়ের জোর কোনটাই খাটবেনা আজ। আমি যাবোনা আপনার সঙ্গে। এখন যদি আপনি আমার সঙ্গে জোরাজুরি করেন আমি সত্যিই উল্টাপাল্টা কিছু করে বসব। তারজন্যে দায়ী কিন্তু আপনি থাকবেন।’

প্রিয়তা অনেকটা চেঁচিয়েই বলল কথাগুলো। আশেপাশের অনেকেই তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। নিজেদের মধ্যে সমালোচনা করছে। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক্লান্ত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে এখন কী চাও তুমি?’
প্রিয়তা মাথা দুলিয়ে মলিন হাসল। রুদ্রর দিকে তাচ্ছিল্যেপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলল, ‘আপনি শুনবেন না।’
‘বলেই দেখো?’

‘ছেড়ে দিন আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই জগত। দূরে কোথাও চলে যাবো আমরা। যেখানে কোন অন্ধকার থাকবেনা, র/ক্ত থাকবেনা, মৃ/ত্যু ভয় থাকবেনা। তবেই আমি সব ভুলে আপনার কাছে ফিরব। ঐ বি/ষাক্ত জগতের বি/ষাক্তথা নিয়ে আমি আর বাঁচতে পারবোনা। আমি একটা সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন চাই।’
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। গভীরভাবে চিন্তা করল অনেককিছু। বর্তমানসহ ভবিষ্যতের অনেককিছু বিবেচনা করে শেষে বলল, ‘বেশ। ছেড়ে দেব। দূরে সরে যাবো এই অন্ধকার জগত থেকে। তবে আমার কিছুদিন সময় চাই। কিছু কাজ বাকি আছে আমার। সেগুলো শেষ করে তবেই তোমার কাছে ফিরব আমি। একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নিয়ে। তখন ফিরবেতো তুমি?’

প্রিয়তা বেশ অবাক হল রুদ্র এতো সহজে সব মেনে নেওয়াতে। অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। হঠাৎই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কথা দিচ্ছি।’
এরপর আর দাঁড়াল না। একপলক রুদ্রকে দেখে নিয়ে চলে গেল স্কুলের ভেতরে। যতক্ষণ প্রিয়তাকে দেখা গেল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল রুদ্র। প্রিয়তা চোখের আড়াল হতেই ইশারায় কাউকে ডাকল। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী এক ছেলে বেরিয়ে আসল আড়াল থেকে। শ্যামবর্ণ, ঝাকড়া চুল। রুদ্র ওকে বলল, ‘ম্যাডামের দিকে নজর রাখবি। আড়াল থেকে, লুকিয়ে। কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, সব। ওর কোনরকম কোন বিপদে আভাস পাওয়ামাত্র সঙ্গে সঙ্গে জানাবি আমাকে। এখন থেকে এটাই তোর কাজ। মনে থাকবে।’

বিদ্যুৎতের গতিতে মাথা ঝাকালো ছেলেটি। রুদ্র আবার স্কুলের গেইটের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। এরপর হাঁটা দিল নিজের জিপটার দিকে। উচ্ছ্বাস কল করেছিল। নাজিফার বাবা নাকি মা/রা গেছেন। সেখানেও একবার যেতে হবে ওকে। এইমুহূর্তে প্রিয়তাকে সঙ্গে রাখাটা সত্যিই বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে। সেটা কিছুক্ষণ আগেই অনুধাবন করল রুদ্র। কারণ ওর মন বলছে, শীঘ্রই আমের ভিলা ছাড়তে হতে পারে ওদের। শীঘ্রই।
কিন্তু জানল না, যার কাছে প্রিয়তাকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব সপে দিয়েছে। সে আর কেউ নয়। প্রিয়তারই একনিষ্ঠ চ্যালা। জয়।

মীর্জাদের নিজস্ব অ‍্যাপার্টমেন্ট। শওকত মীর্জা, করিম তাজওয়ার আর শান একসঙ্গে বসে কথা বলছে। সকলের হাতেই জ/লন্ত্ব সিগারেট। কলে আছে পলাশ মীর্জা আর সম্রাট। দুজনেই কাজে আটকে যাওয়ায় আসতে পারেনি। তাই কলের মাধ্যেই যোগ দিয়েছে এই জরুরি মিটিংয়ে। ওদের আলোচনার মধ্যে ওপাশ থেকে সম্রাট বলল, ‘বিদেশী কম্পানিগুলো। বিশেষ করে আফ্রিকার দলদুটো সোলার সিস্টেমকে একটু বেশিই সময় দিচ্ছে। এতোদিন টাকার জন্যে কুকুরের মতো দৌড় করিয়ে মা/রার কথা। অথচ তারা কেবল হুমকি দিচ্ছে!’

শওকত বলল, ‘কিন্তু এ বিষয়ে আমরা কী করত পারি? আমরা কেবল সোলার সিস্টেমদের ওদের সামনে অসহায় করতে পেরেছি। এবার সেই অসহায়ত্ত্বের সুযোগ ওরা কীভাবে নেবে সেটাতো আমরা ঠিক করতে পারিনা।’
‘পারি।’
মেয়েলী কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে কথাটা শুনে ঘাড় ফেরালো শওকত, করিম আর শান। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। গম্ভীর চোখমুখ। শান খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘রানি!’

প্রিয়তার ভাবান্তর হলোনা। দৃঢ় কদমে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘ডিলগুলো যখন আমাদের হাতে, তখন আমরা আমাদের ডিমান্ড বাড়িয়ে দেব। আর আমাদের ডিমান্ড বাড়লে ওদের আরও বেশি বেশি আ/গ্নে/য়াস্ত্র বানানোর দরকার হবে। ওরা না করবেনা। কারণ এমন লাভ কেউ ছাড়তে চায়না। কিন্তু প্রফিটের জন্যে দরকার ইনভেস্টমেন্ট। আর ইনভেস্টমেন্টের জন্যে চাই মানি।’

কথাটা বলে শান যে সিঙ্গেল সোফায় বসেছে তার হ্যান্ডেলের ওপর বসল প্রিয়তা। করিম প্রশ্ন করল, ‘তো?’
প্রিয়তা বলল, ‘টাকাতো গাছে ফলেনা। তাইনা? টাকার যখন খুব দরকার হয় তখন মানুষ সব জায়গা থেকেই টাকা উশুল করে। সোলার সিস্টেমের কাছে এতোকোটি টাকা পাওনা। ছেড়ে দেবে মনে হয়?’

কথাটা বলে ভ্রু নাচাল প্রিয়তা। এতক্ষণে গম্ভীর পরিবেশ কাটিয়ে হাসি ফুটল সবার ঠোঁটে। শানের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে তাতে টান দিল প্রিয়তা। ঠোঁটে ধূর্ত হাসি। করিম বলল, ‘সত্যিই এতক্ষণ ধরে সমস্যাটা নিয়ে ভাবছিলাম। অথচ কী সহজ সমাধান ছিল। এতো সিম্পল ব্যপারটা আমাদের কারো মাথায় আসেনি। তোমাকে শুরুতে সত্যিই আমি ভুল ভেবেছিলাম রানি। সম্রাট ঠিকই বলেছিল, শওকত মীর্জার শিক্ষায় গড়া তুমি। রানি মীর্জা।’
শওকত প্রসন্ন কন্ঠে বলল, ‘আমিতো আগেই বলেছি। ডার্ক নাইটের যোগ্য উত্তরাধিকারী ও।’
প্রিয়তা ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘তোমার ডার্ক নাইট তুমি তোমার ছেলের কোলেই দিয়ে দিও বাবা। আমার চাইনা।’

‘তুমি হঠাৎ এখানে কী করছো রানি? তোমাকে রুদ্র নিতে এসেছিল না? কী খবর ওদিকের?’ ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে সম্রাটের গলা।
প্রিয়তা পানসে গলায় বলে, ‘খবর ভালো বলেইতো নির্দ্বিধায় এখানে আসতে পেরেছি আমি। এখনো যা হচ্ছে, প্লান মাফিক হচ্ছে।’
শান নতুন সিগারেট বের করে বলল, ‘তোর কথা এতো সহজে মেনে নিল রুদ্র?’

‘তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক না আমি।’ প্রিয়তার কন্ঠে বিরক্তি।
শানও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আজব! আমি কী জেনেবুঝে ঘটনাটা ঘটিয়েছিলাম না-কী?’
সম্রাট ধমকের সুরে বলল, ‘নিজেদের মধ্যকার রেষারেষি ছাড়ো। ওসব পরেও করা যাবে। শুধু সোলার সিস্টেমকেই শেষ করাটাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। রুদ্র আর ঐ ওদের আশ্রিত, কী যেন নাম? হ্যাঁ উচ্ছ্বাস। ঐ দুটোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুনিয়া থেকে সরাতে হবে। নয়তো গুড়িয়ে যাওয়া সোলার সিস্টেমকে নতুন করে সাজাতে টাকার দরকার নেই। ঐ দুটোর মগজই যথেষ্ট।’

আরও দশমিনিটের মতো আলোচনা চলল। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হলো সোলার সিস্টেম সম্পূর্ণ ফকির হয়ে যাওয়ার পর রুদ্র আর উচ্ছ্বাসকে কীকরে হ/ত্যা করা হবে। হ/ত্যার প্লানিং প্লটিং নিয়ে বিস্তর আলাপ হল। তবে এবার সম্পূর্ণ আলোচনায় একদম চুপ রইল প্রিয়তা। টু শব্দ অবধি করল না।
আলোচনা শেষে করিম তাজওয়ার বেরিয়ে গেল। সে বেরিয়ে যেতেই উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। শওকত মীর্জাও স্ট্রেচারে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এখনো পর্যন্ত অসাধারণ কাজ করেছো। এখন শুধু শেষ চাল দেওয়াটাই বাকি। আশা করি বাকি খেলাটাও তুমি ভালোই খেলবে।’

শওকতের দিকে রাগ আর আবেগ মিশ্রিত চোখে তাকাল প্রিয়তা। জ্বলছে অপূর্ব চোখদুটো। স্থির কন্ঠে বলল, ‘তুমি আমাকে কী কথা দিয়েছিলে, সেটা ভুলে যেওনা বাবা।’
‘আমি ভুলিনি।’
‘ভালো। যদি ভুলেও যাও। একটা জিনিস কিন্তু ভুলোনা। যে গোটা সোলার সিস্টেমকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। সে কিন্তু ডার্ক নাইট আর ব্লাক হোলকেও মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখে। আমাকে ঘাটালে কিন্তু আমি সবকিছু ঘেটে দেব। আসছি।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭০

শওকত নির্বাক থাকল। নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় প্রিয়তা। কিছু কাজ আছে ওখানে। ওর যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একে ওপরের মুখের দিকে তাকাল শওকত মীর্জা আর শান। দুজনেই দুজনের রক্তশূন্য চেহারা খুব ভালোভাবে অনুভব করতে পারল।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭১(২)