অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭১(২)

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭১(২)
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

সময়ের চাকা ক্লান্তিহীন, বিরতিহীন চক্রে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই চক্রেই পাড় হয়েছে সাতটা দিন। শীতের প্রকোপ বেশ ভালোভাবে চলছে। সকাল প্রায় এগারোটা পর্যন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে চারপাশ। এরপর তাপমাত্রা খানিকটা কমে। বেলার তিনটার পর আবার তীব্রভাবে আঘাত হানে কনকনে শীত। প্রকৃতি নিজের ছন্দে চলছে। কিন্তু ছন্দ হারিয়ে বসেছে কিছু জীবন।

নাজিফা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। বাবার মৃত্যুর ধাক্কাটা শুরুতে মানতে না পারলেও এখন বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। হয়তো এতো সহজে স্বাভাবিক হতোনা। কিন্তু অতিতের কিছু তীব্র আঘাত শক্ত করে দিয়েছে মেয়েটাকে। নিজের ভালোবাসাকে মাটিচাপা দিয়ে অন্যএকজনকে বরণ করেছে। বরণ করা সেই মানুষটাও অকালে চলে গেল। ওকে মাঝপথে ছেড়ে। সন্তানসম্ভবা অবস্থায়। আর এখন নিজের একমাত্র ছত্রছায়াকে হারিয়ে একপ্রকার নিঃস্ব সে। আর নিঃস্ব মানুষদের অনুভূতি মৃতপ্রায়। ঠিক যেমন বর্তমানে নাজিফার অনুভূতি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাজিফার বাবার মৃত্যুর তিনদিন পরেই ভাইয়েরা নিজের বাসায় ফিরে যায়। তারা এখন আলাদাই থাকে। আলাদা থাকার কারণ অনেকটা নাজিফাই। নাজিফার ঐবাড়িতে থাকা নিয়েই ওর ভাবিদের সঙ্গে রেষারেষি হচ্ছিলো দীর্ঘদিন যাবত। যার সুত্র ধরে আলাদা হয়ে যায় ওর ছোটভাই। নিত্যনতুন অশান্তি নাকি তার পোষায় না। তার দেখাদেখি বড় ভাবিও বেঁকে বসে। তারা আলাদা হতে পারলে আমরা কেন নয়? এভাবেই দীর্ঘদিনের একত্রিত সংসারটায় ভাঙন ধরে। সেই শোকেই বোধ হয় আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন নাজিফার বাবা। জোয়ান মেয়ের করুণ দশা, সংসারে ভাঙন একসঙ্গে সহ্য হয়নি বৃদ্ধ শরীরের।

বাবার মৃত্যুতে তিনদিন থেকে যাওয়ার দায় সেড়েই বিদায় নেয় ওর ভাইয়েরা। রেখে যায় সদ্য স্বামী হারা বৃদ্ধা মা, আর অসহায় এক গর্ভবতী বোনকে।
তবে এই এক সপ্তাহ একদম ছায়ার মতো নাজিফা পরিবারের সঙ্গে ছিল উচ্ছ্বাস। ওদের বাজার করে দেওয়া, দিনে দুই তিনবার এসে খবর নেওয়া, ঔষধ দিয়ে যাওয়া, রান্নার জন্যে লোক রাখা সব ওই করেছে। নাজিফা অবাক হয়ে দেখে যায় উচ্ছ্বাসকে। কীভাবে এতো নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জন্যে করে যায় ছেলেটা? সারাজীবন আমের পরিবারের জন্যে করে গেল। তাদের ছাড়তে পারবেনা বলে নিজের ভালোবাসার বলিদান দিল। আর আজ নাজিফার জন্যে করে যাচ্ছে। কোনরকম স্বার্থ ছাড়াই। বিনিময়ে কিচ্ছু চাইনা ওর, কিচ্ছু না। সত্যিই কী এতোটা নিঃস্বার্থ মানুষ হয়? হওয়া সম্ভব? ভাবতে গিয়ে সবকিছু গুলিয়ে যায় নাজিফার।

নাজিফাকে অনেকটা জোর করেই আজ চেকআপের জন্যে নিয়ে এসেছে উচ্ছ্বাস। এতোটা স্ট্রেস, ধকল যাওয়ার পর চেকআপ না করালেই নয়। তারওপর ডেলিভারির আর মাত্র কুড়ি দিন বাকি। এই মুহূর্তে কোনরকম রিস্ক নেওয়াটা বোকামি।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায় ওদের। উচ্ছ্বাস বলল, ‘কিছু খাবে?’
‘না, বাড়ি গিয়ে একটু রেস্ট করতে চাই। ক্লান্ত লাগছে।’ নাকের নিচের ঘামটা মুছে বলল নাজিফা। ইদানিং সহজেই ঘেমে যায়।

‘তা তো করবেই। কিন্তু কিছু খেয়ে গেলে ভালো হতোনা? কাকির জন্যেও নিয়ে যেতাম।’
‘বাইরে খাওয়ার মতো টাকা আমার কাছে নেই উচ্ছ্বাস।’
ভ্রুকুটি করল উচ্ছ্বাস, ‘টাকার প্রশ্ন আসছে কেন? বারবার টাকার প্রসঙ্গ তুলে আমাকে ছোট করো কেন নাজিফা?’
‘ছোটতো আমি হই উচ্ছ্বাস। এইযে চেকআপ করালে। ডাক্তারের ফীটাও তুমি দিয়েছো। ঔষধের টাকাটা নাওনা। রান্নার লোক রেখেছো, তার টাকাটা অবধি নিচ্ছোনা। বাজারের টাকাটাও জোর করে হাতে ধরিয়ে দিতে হয়। কেন উচ্ছ্বাস? এতে আমি ছোট হচ্ছিনা? আমি কী হই তোমার? কীসের ভিত্তিতে এসব নেব আমি তোমার কাছ থেকে? সেরকম কোন সম্পর্ক আছে আমাদের মধ্যে?’

‘কোন একদিন সেরকম একটা সম্পর্কতো গড়তে চেয়েছিলাম আমরা।’
‘সেটা অতীত। বর্তমানে যার কোন অস্তিত্ব নেই। সেই অতীতকে বর্তমানে টেনে আনা আর কখনও সম্ভবও না উচ্ছ্বাস।’
কথাটা বলতে বলতে গলা কেঁপে উঠল নাজিফার। উচ্ছ্বাস অসহায় বোধ করল। ভুল বলেনি নাজিফা। শুকনো এক ঢোক গিলে নিজেকে সামলালো উচ্ছ্বাস। মলিন হেসে বলল, ‘আর কোন সম্পর্ক নাই থাক। বন্ধুত্বের সম্পর্কটাতো আমাদের মধ্যে বরাবরই আছে নাজিফা। সেই সম্পর্কের ভিত্তিতেই না হয় আমাকে পাশে থাকতে দাও।’

নাজিফা অবাক হয়ে তাকাল। লোকটাকে যত দেখে ততই অবাক হয় ও। খুব বেশি অবাক হয়। চেহারা থেকে অবাক ভাবটা লুকোতে ব্যর্থ হয়ে বলল, ‘কিন্তু তুমিই কোথা থেকে এতো দেবে বলবে? আমের মিলসের বর্তমান অবস্থা আমি জানি। ছাপাখানার অবস্থাও জানা। নিশ্চয়ই তোমাদের গোপন পেশাতেও সেই একই অবস্থা? এমন সময় তুমি আমার পেছনে খরচ করার মতো এতো টাকা কোথায় পাচ্ছো?’
উচ্ছ্বাস নাজিফার দুই বাহুতে হাত রেখে বলল, ‘আহামরি কিছু খরচ হচ্ছেনা তোমার পেছনে। আমার যেটুকু সেভিংস্ আছে তাতে যথেষ্ট হচ্ছে। বুঝলে?’

‘কিন্তু..’
‘হুশশ.. কী ভেবেছো? ফ্রিতে দিচ্ছি? কত, কত দিচ্ছি হিসেব করে রাখো। এখন অসুবিধায় পরেছো তাই দিচ্ছি। ভবিষ্যতে যখন সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন কিন্তু সুধসহ ফেরত নেব।’
নাজিফা উচ্ছ্বাসের চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। উত্তরে এক অমায়িক হাসি উপহার দিল উচ্ছ্বাস। নাজিফা তপ্ত শ্বাস ফেলল। এমন অদ্ভুতভাবেই ওকে সব তর্কে হারিয়ে দেয় ছেলেটা। সবসময়।

নাজিফাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে যাচ্ছিল উচ্ছ্বাস। কিন্তু বাঁধ সাধলেন নাজিফা মা। নাজমা বেগম। হাত ধরে প্রায় টেনে এনে বসালেন ওকে। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘খাবার কিনে এনেছো। মুখে না দিয়ে কোথায় যাচ্ছো?’
উচ্ছ্বাস বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘অন্যএকদিন খাবো কাকি। কাজ আছে আমার আজকে।’
‘রাখো তোমার কাজ। সবসময় খালি কাজের বাহানা দিয়ে চলে যাও। আজ ছাড়ছিনা আমি। বোসো দেখি।’

শত বাহানা দিয়েও যেতে পারল না উচ্ছ্বাস। জোরপূর্বক খেতে বসালেন নাজমা। নাজিফাও বসল। নাজিফার অসুস্থ লাগছিল বলে আর বাইরে খাওয়ায়নি উচ্ছ্বাস। প্যাক করে নিয়ে এসেছে। খেতে বসে নিজের সংসারের, মেয়ের, এমন দুরাবস্থার কষ্ট নিয়ে বিস্তার আলাপ জুড়লেন নাজমা। নাজিফা থামতে বললেও থামলেন না। উচ্ছ্বাস বরাবরই নীরব শ্রোতা। মেয়ের এমন অবস্থায় বিধবা হওয়া, শ্বশুরবাড়ি ছাড়া , ছেলেদের আলাদা হয়ে যাওয়া, স্বামীর মৃত্যু, সাংসারিক টানাপোড়েনের কথা বলতে বলতে গলা ধরে এলো তার। যখন বললেন, নাজিফাকে আরেকটা বিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। সে শান্তিতে মরতে পারতো। বিরক্ত হলো নাজিফা। অনেকটা চেঁচিয়ে বলল, ‘কী শুরু করেছো তুমি মা? ও কী এখানে তোমার দুঃখের সংবাদ শুনতে এসেছে? যাকে পাও তাকে ধরেই কান্নাকাটি শুরু করে দাও। ভালো লাগেনা আমার আর এসব।’

‘তুই চিৎকার করছিস কেন?’
‘কারণ তুমি ছ্যাঁচড়ামি করছো। একটা অবিবাহিত ছেলের সামনে এসব নিয়ে আলোচনা করাটাকে ছ্যাঁচরামিই বলে।’
উচ্ছ্বাস বাঁধা দিয়ে বলল, ‘নাজিফা! মার সঙ্গে এভাবে কথা বলে কেউ? ওনার অবস্থাটাওতো তোমাকে বুঝতে হবে।’
অশ্রুসিক্ত নয়নে একবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাল নাজিফা। হাত ধুয়ে শব্দ করে গ্লাসটা টেবিলে রাখল। আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে সাবধানে চলে গেল নিজের ঘরে।
নাজিফার মা নীরবে কাঁদছেন। উচ্ছ্বাস তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল, ‘কষ্ট পাবেননা কাকি। এমন অবস্থায় একটু_’

‘আমি বুঝি বাবা। কম আঘাততো পায়নি মেয়েটা। এইজন্যইতো ওর একটু সুখ দেখার জন্যে ছটফট করি আমি। আগেযে কেন বলল না তোমার কথা। আমিও যা_ মেয়ের মাতো। তাই এসব বলে ফেলি। কিছু মনে করোনা বাবা।’
‘আমি কিছু মনে করিনি। বাদ দিন এসব।’
হঠাৎই উচ্ছ্বাসে হাত চেপে ধরলেন নাজমা। কাতর চোখে তাকালেন ওর দিকে। উচ্ছ্বাসও খানিকটা অপ্রস্তুত হল। নাজমা কাতর কন্ঠে বললেন, ‘স্বার্থপরের মতো একটা অন্যায় আবদার করব।’
‘ক্ কী আবদার?’ কাঁপছে উচ্ছ্বাসের গলা।
‘আমার মেয়েটাকে বিয়ে করবে বাবা?’

আমের ফাউন্ডেশনে রাশেদের কেবিনটাতে বসে আছে রুদ্র। কেউ নেই। ও একাই। রাশেদ আমেরের চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। ঐ চেয়ারটা দখল করার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই হয়নি ওর। হয়তো হবেও না। তবে এই কেবিনে বসলে মানুষটাকে মনে পড়ে ভীষণ।
প্রিয়তার সঙ্গেও এরমধ্যে একবার দেখা করে এসেছিল। প্রিয়তার স্কুলের গেইটেই। প্রিয়তা কথা বলেছে ঠিকই। তবে সল্প। মেয়েটাকে দেখলেই অদ্ভুত এক মানসিক শক্তি পায় রুদ্র। তাইতো বারবার ছুটে যায় নিজের প্রিয়র কাছে।

বিগত কয়েকদিনে রুদ্র একটা বিষয় খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে। সব মানুষই একসময় ভাঙে। সব মানুষই জীবনের কোন না কোন সময়ে দুর্বল হয়। সে যত শক্ত বা দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের মানুষই হোক না কেন। তাই হয়তো মৃত্যুর আগে এতোটা ভেঙ্গে পড়েছিলেন রাশেদ আমেরের মতো বজ্রকন্ঠি, দৃঢ় মানুষটা। রুদ্রও কী দুর্বল হয়নি? তিলতিল করে গড়া নিজের সোলার সিস্টেমের পতন। একমাত্র বোনের ধ/র্ষি/ত বিদ্ধস্ত শরীর। বাবার আকস্মিক মৃ/ত্যু। নিজের অনাগত সন্তানকে নিজেরই চোখের সামনে শেষ হতে দেখা। প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর হাজারটা অভিযোগ তী/র সহ্য করে তাকে চলে যেতে দেখা। পরপর এতোগুলো ঘটনা কী ওর মানসিক শক্তিকে একটুও কমায়নি? উত্তর হল, হ্যাঁ। কমিয়েছে। মানসিক দুর্বলতা ঘিরে ধরেছে রুদ্র আমেরকে। সেই হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর, অসাধারণ ব্যক্তিত্বের রুদ্র আমের আজ সত্যিই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

কিন্তু কীকরে হলো এই অসাধ্য সাধন? এতোরকম ভাবে এতো চেষ্টা করেও কোনদিন যে রুদ্র আমেরকে টলানো যায়নি। আন্ডারওয়ার্ল্ডের এতো বিরোধি দল, এতো শক্তিশালী সংস্থা চেষ্টা করেও যে রুদ্র আমেরের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তার অসাধারণ ধূর্ততা আর দূরদর্শীতার জন্যে মাত খেতে হয়েছে বারবার। হঠাৎই কোন এক অদৃশ্য ঝড়ের দমকে যেন মুষড়ে পড়ল রাশেদ আমেরের মতো দৃঢ় বৃক্ষ। নড়বড়ে হয়ে গেল রুদ্র আমেরের মতো অটল প্রস্তর।

দৃশ্যমান শত্রুর মোকাবেলা করা সম্ভব। কিন্তু অদৃশ্য শত্রুর মোকাবেলা করাটা ততটাই কঠিন, যতটা খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজা। কিন্তু রুদ্রর সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব ছিল, ও চোখ দেখেই শত্রু চিনতে পারতো। তাইতো ওর নজর থেকে আজ অবধি কোন বিশ্বাসঘাতক বাঁচতে পারেনি।

হোক সে সবুজ, খোকন, তপু কিংবা পারভেজ। এমনকি নিজের ভাতৃসম উচ্ছ্বাস, আপন চাচা জাফরকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয়নি ও। মাইক্রোফোন সেট করা আছে তাদের হোলস্টারেও। এসব ঘটনার পর আরও তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখছে ওদের ওপর। কিন্তু কিছুই তো পায়নি এখনো। তবে কীকরে হচ্ছে এসব? কীকরে? কীকরে কেউ জানতে পেরেছিল ওদের গোপন বৈঠক ঘরের সমস্ত গোপন আলোচনা? মাল ডেলিভারির স্থান, রিসিভিং কোড? এসব তথ্য কেবল রাশেদ, রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফর আর ইকবালই জানতো।

রাশেদ আমের মৃত। ইকবাল নির্দোষ ছিল। বাকি থাকে উচ্ছ্বাস আর জাফর। উচ্ছ্বাস মাইক্রোনের ব্যপারে জানে। সেভাবে জাফরও জানতে পারে নিশ্চয়ই। অর্থাৎ সন্দেহের তীর এখনো এই দুজনের ওপরেই আছে। কিন্তু সেই জ্যাকেট আর পিস্তল! তারপর রাশেদের চায়ে বিষ। অনেকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে রুদ্র। কিন্তু জ্যোতি কিংবা নার্গিস ছাড়া অন্যকেউ চায়ের কাপের ধারকাছেও যায়নি সেটা শতভাগ নিশ্চিত। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে একবার প্রিয়তার কথা মনে হয়েছিল রুদ্রর। কিন্তু তারপরেই মনে পড়ে সেদিন রাত থেকে সকাল অবধি প্রিয়তা রুদ্রর বুকেই ঘুমাচ্ছিল। রুদ্রও সারারাত জেগে ছিল। তাই অন্তত সেই সকালে কিচেনের ধারেকাছেও যায়নি প্রিয়তা। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রুদ্র নিজেই। তাই সেক্ষেত্রে জ্যোতি বা নার্গিসকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারছেনা ও। তাই ঐ দুজনের ওপরেও তীক্ষ্ম নজর রাখা হচ্ছে।

এসব চিন্তা কদিন ধরেই কুড়েকুড়ে খাচ্ছে রুদ্রকে। ওর খুব কাছের লোকই ওকে ধোকা দিয়েছে। ব্যপারটা জানে রুদ্র। কিন্তু কোনভাবেই সে অবধি পৌঁছতে পারছেনা। কোন সমীকরণই একজায়গায় গিয়ে মিলছেনা। বরং আলাদা আলাদা নতুন সমীকরণে পরিণত হচ্ছে। যে রুদ্র আমের চোখ দেখে শত্রু চিনতে পারতো। সে আজ শতখুঁজেও সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতককে খুঁজে বের করতে পারছেনা! চিরুনী তল্লাশি করেও কোন ক্লু পাচ্ছেনা! এতোটা নিখুঁত খেলোয়ার কে? যে রুদ্র আমেরকেও টেক্কা দিতে সক্ষম? ব্যপারটা চিন্তা করে নিজের ওপরেই ভয়ানক রাগ হচ্ছে রুদ্রর। ব্যর্থ মনে হচ্ছে সবকিছু।

‘এমনটাতো একদিন হওয়ারই ছিল তাইনা রুদ্র? পাপের সম্রাজ্য যত শক্তিশালীই হোক একদিন ধসে পরেই। আর পাপের রাজা যত চতুরই হোক একদিন না একদিন ঠিকই চুকে যায়। এটাই নিয়তি। যা কেউ খন্ডাতে পারেনা।’
পরিচিত কন্ঠস্বরে কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকায় রুদ্র।

জুতোর আওয়াজে পেয়ে তন্দ্রা ভঙ্গ হল ইকবালের। কেউ আসছে। আবার সেই নির্মম অ/ত্যা/চার! ঢোক গিলতে গিয়ে বুঝল পানির অভাবে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। নিজের সমস্ত মানসিক শক্তিকে একত্রিত করল। আবার সেই নির্মম অ/ত্যা/চার সহ্য করার জন্যে তৈরী হয়ে নিল ইকবাল। ম/রে যাবে। তবুও মুখ দিয়ে টু শব্দটাও করবেনা। এটাই যেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তার।
ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছের জুতোর সেই ক্ষীণ শব্দ। চোখ তুলে তাকাচ্ছেনা ইকবাল। তবে যখন বুঝল আগন্তুক ঠিক ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দুর্বল দৃষ্টিতে আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাইল ও। তাকিয়েই চমকে উঠল। প্রিয়তাকে হঠাৎ আজ আবার আশা করেনি ইকবাল।

আজ নীল রঙের ফুল হাতা একটা টিশার্ট আর ঢোলা কালো প্যান্ট পড়েছে প্রিয়তা। ঝুঁটি করেছে মাথায়। তবে কানের নিচ অবধি কাটা ছোট চুলগুলো পড়ে আছে কপালের পাশে। প্রিয়তার হাতে একটা প্যাকেটও দেখতে পেল ইকবাল। মেয়েটার আসল চরিত্র মনে পড়তেই মন বিষিয়ে গেল ওর। তিক্ত কন্ঠে বলল, ‘এবার থেকে আমাকে টর্চারের কাজটা কী তুমি করবে?’
প্রিয়তা জবাব দিলোনা। হাতে দুটো তালি বাজাতেই একগ্লাস পানি নিয়ে ঘরটাতে ঢুকলো জয়। জয়কে দেখেই চমকে উঠল ইকবাল। গতদিন প্রিয়তার হঠাৎ আগমনে এতোটাই শকে ছিল যে জয়কে খেয়ালই করেনি। আজ যখন খেয়াল করল, শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল ইকবালের। গ্লাসটা হাতে নিয়ে, প্যাকেটটা জয়ের হাতে ধরিয়ে দিল প্রিয়তা। ইশারায় কিছু বলল। জয়ও বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে চলে গেল। ভ্রু কুঁচকে গেল ইকবালের। এতো ইশারা-ইঙ্গিতের ব্যপারটা বুঝল না।

জয় চলে যেতেই মুখ খুলল প্রিয়তা। মুচকি হেসে বলল, ‘এটাই ভাবছেন তো জয় এখানে কেন? উপস্ জয় বললেতো আপনি চিনবেন না। রাজু, রাজু বলেইতো চেনেন ওকে আপনারা।’
বিস্মিত ইকবাল বলল, ‘তারমানে রাজু তোমাদেরই লোক? কিন্তু ওতো আড়াই বছর আগেই জয়েন করেছিল। তাহলে..’
‘আমের ভিলায় ঢোকার ছ’মাস আগেই পাঠিয়েছিলাম। এদিকেও তো দু একজন লোক রাখা জরুরি। বোঝেনইতো।’
‘তুমি সত্যিই কালনাগিনী!’

প্রিয়তা হাসল। এগিয়ে গিয়ে গ্লাসটা ইকবালের মুখের সামনে ধরে বলল, ‘পানিটা খেয়ে তারপর গালিগালাজ করুন। শুকনো গলায় গালি দিয়ে মজা নেই।’
প্রিয়তার হাতে পানি খেতে ঘৃণা হচ্ছে ইকবালের। কিন্তু বেঁচে থাকা প্রয়োজন। তাই চুপচাপ পুরোটা পানি খেল। প্রিয়তা গ্লাসটা রেখে ইকবালের মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসল। ইকবাল তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘সেই একই প্রশ্ন করবে?’
‘না।’
‘তবে?’

‘জয় খাবার গরম করে নিয়ে আসছে। খাওয়াবো আপনাকে।’
প্রিয়তার কথায় যারপরনাই অবাক হল ইকবাল। এতোদিন একবেলাই খেতে দেওয়া হতো ওকে। তাও শক্ত রুটি, ঠান্ডা পানসে তরকারি। সকালেই খেয়েছে ও। আবার এখন! তাও গরম খাবার! হতভম্ব গলায় বলল, ‘হঠাৎ আমার ওপর এতো দয়া?’
‘আমি আগেও বলেছি ইকবাল ভাই। ঐ “দয়া” জিনিসটা আমার মধ্যে নেই।’
‘তুমিযে কতটা খারাপ তা আমি জেনেছি।’
‘আপনি ভাবতে পারবেন না তারচেয়েও খারাপ।’

এতক্ষণে নড়েচড়ে বসল ইকবাল। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কী চাও বলোতো তুমি?’
প্রিয়তা শব্দ করে হাসল। কৌতুকপূর্ণভাবে বলল, ‘কী চাই? এটাইতো সমস্যা ইকবাল ভাই। আমার চাওয়াগুলো ভীষণ অদ্ভুত। একজায়গায় স্থির থাকেনা। যার ফলে আমার চাওয়াগুলোই আমার শত্রু হয়ে যায়।’
‘মানে?’

‘ভীষণ জটিল ব্যপার। আপনি বুঝবেন না। খাবার আসছে। আপনাকে খাইয়ে দিয়ে চলে যাব আমি।’
হঠাৎই ভীষণ কৌতূহল হল ইকবালের। নিজের সামনে বসা রমনীকে জগতের সবচেয়ে বড় রহস্য মনে হল ওর। ইকবালকে জানতে হবে কে এই মেয়ে? কী তার পরিচয়? কেন আমের ভিলার বউ হয়ে এসেছিল সে? কেন ধ্বংস করে দিল গোটা সোলার সিস্টেমকে? টানা দুই বছরেরও কীকরে রুদ্র বা রাশেদ আমের টের পেলোনা কিছু? ওর উদ্দেশ্য কী? কী চায়? সব জানতে হবে। ইকবাল লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ‘খাবো। তবে একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে। রাখবে?’
প্রিয়তা রহস্যময়ী এক হাসি দিয়ে বলল, ‘রাখার মতো কিছু বলবেন কী?’

‘বলব।’
‘বলুন।’
‘কে তুমি? কেন এসেছিলে আমের ভিলায়? কীকরে এসেছিলে? তোমার আসল উদ্দেশ্য কী? বলবে?’
প্রিয়তার ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হল। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আপনি খুব চালাক ইকবাল ভাই। কৌশলে সবটা শুনতে চাইছেন। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার আগে এখান থেকে বের হতে পারবেননা আপনি। তাই আপনাকে বলাই যায়। আমারও টাইমপাস হবে।’

আশার আলো দেখতে পেল ইকবাল। কিছুটা তথ্য জানার সুযোগ এসেছে। উ‍ৎসাহি গলায় বলল, ‘বলো তবে।’
প্রিয়তার চোখমুখ গম্ভীর হল। দৃষ্টি শূন্য হল। ইকবালকে বলার আগে নিজেও যেন হারিয়ে গেল আড়াই বছরেরও আগের সেই অতীতে। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এই ভয়ানক দাবার প্রথম চাল।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭১

[ আগামী পর্বে প্রিয়তা কেন, কীকরে এবং কী উদ্দেশ্যে আমের ভিলায় এসেছিল তা জানা যাবে।]

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭২