অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭২

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭২
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

প্রিয়তাকে অন্যমনস্ক দেখে কপাল কোঁচকাল ইকবাল। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল প্রিয়তার শূণ্য দৃষ্টি। মিনিট খানেক কেটে যায়। প্রিয়তার উত্তর না পেয়ে ইকবাল অধৈর্য হল। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হালকা করে কাশল। কাশির আওয়াজে মৃদু চমকালো প্রিয়তা। যেন আচমকা ফিরে এলো অন্য এক জগৎ থেকে। সামলে নিতেও বেশি সময় নিলোনা। ঠোঁটে আবার ফুটে উঠল সেই ধূর্ত হাসি। মিথ্যা বিনয় দেখিয়ে বলল, ‘সরি, সরি। আসলে কোথা থেকে শুরু করব সেটাই ভাবছিলাম।’

‘বলবে যখন, শুরু থেকেই শুরু করো। যেখান থেকে এই সর্বনাশের খেলা খেলার চিন্তা এসেছিল তোমাদের মাথায়।’
‘বেশ! কিন্তু সেটা জানার জন্যে, আপনাকে আরও একটা বিষয় জানতে হবে। নাহলে কিছুই বুঝবেন না।’
ইকবাল ভ্রু কোঁচকালো। আর কী জানার আছে? আর কী শুনতে হবে তাকে। ইকবালের কুঁচকে যাওয়া ভ্রু দেখে প্রিয়তা বলল, ‘সত্যিটা শোনার আগে মনটা শক্ত করে নিন। আরেকটা ধাক্কা খেতে চলেছেন।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ইতিমধ্যে যথেষ্ট ধাক্কা খেয়েছি। এখন আর কিছুতেই অবাক হওয়ার নেই।’
‘তাই? দেখা যাক।’
থেমে নাকটা হালকা চুলকে নিল প্রিয়তা। বলল, ‘আমার পরিচয় জানেন আপনি? আমার পরিবার, বাবা-মা কারা?
‘জানি। রুদ্রর সঙ্গে বিয়ের আগে, রাশেদ বাবা যখন তোমার খোঁজ নিচ্ছিল। সঙ্গে গিয়েছিলাম। তোমার বাবা-মা, ব্যাকগ্রাউন্ড সবটাই জানা আমার।’

‘ভুল জানা।’
চমকে উঠল ইকবাল। কন্ঠে রাজ্যের অবিশ্বাস ঢেলে বলল, ‘অসম্ভব! আমরা নিজে তোমার _’
‘এখানেই! এখানেই তো চালে প্রথম এবং মারাত্মক ভুলটা করেছিলেন বাবা।’
‘মানে?’
‘মানে আমার বাবার নাম নুরুল ইসলাম নয়। আর নাতো আমার আসল নাম প্রিয়তা।’
ইকবালের সামনে সবকিছুই ঝাপসা হয়ে এলো। কোনমতে বলল, ‘তবে?’
ইকবালের ক্লান্ত, লালচে চোখে চোখ রাখল প্রিয়তা। ‘সোলার সিস্টেমের সবচেয়ে বড় শত্রু, ডার্ক নাইটের লীডার, শওকত মীর্জার ছোট এবং একমাত্র মেয়ে। রানি মীর্জা।’

কিছুক্ষণের জন্যে কথা বলতে ভুলে গেল ইকবাল। বুঝল, কিছুক্ষণ আগে সে ভুল বলেছে। তার অবাক হওয়ার এখনো অনেক বাকি। মারাত্মক কিছু চমক এখনো সামনে আসেইনি। তবে আরেকটা জিনিস ভাবালো ওকে প্রিয়তার আসল নাম রানি! রুদ্রর ডাকনামওতো রাজা। এটাকি শুধুই কাকতলীয়তা! নাকি কোন সংকেত! সংযোগ! যে যেভাবেই হোক, যেকারণেই হোক, ওপরওয়ালা ওদের দুজনকে একেঅপরের জন্যে সৃষ্টি করেছেন! ইকবালকে হতবাক করতে পেরে বাচ্চাদের মতো মজা পেল প্রিয়তা। দু হাত একত্রিত করে থুতনির নিচে রেখে বলল, ‘চমকাতে পারলাম?’

এখন মোটামুটি বুঝতে পারছে ইকবাল। কেন এই মেয়ে আমের ভিলায় এসেছিল। কীসের শত্রুতা মেটাচ্ছে। সব পরিষ্কার। বাপের দালালি করতে এসেছে এই মেয়ে। নিমেষেই ক্রোধে ফেটে পড়ল। বাঁধা শরীরটা ঝাকি দিয়ে বলল, ‘তোমাকে খু/ন করার ইচ্ছেটা কত কষ্টে দমন করছি, তুমি ভাবতে পারছোনা।’
‘পারছি বোধ হয়।’

মুখ ফিরিয়ে নিল ইকবাল। কিছু বলল না। হঠাৎ চমকটা সামলানোর জন্যে তাকে কিছুটা সময় দিল প্রিয়তা। নীরবতা ভেঙ্গে ইকবাল নিজেই বলল, ‘পরিচয় না হয় জানলাম। কিন্তু তুমি কেন এলে আমের ভিলায়? তাও বাড়ির বউ হয়ে? শুধুমাত্র গোপন তথ্য জানতে?’

ঠোঁটে ঠোঁটে চেপে মাথা দোলালো প্রিয়তা। বলল, ‘আপনাকে তাহলে একদম শুরু থেকেই বলি। আড়াই বছর! হ্যাঁ আড়াই বছরেরও খানিকটা আগের কথা। ব্রিটেনে পড়াশোনা করছিলাম আমি। ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটি, ইকোনোমিকস্ ডিপার্টমেন্ট। আমার সঙ্গে ভাইয়া মানে শান মীর্জাও থাকতো। তবে সবসময় না। বছরের অর্ধেক সময় ও বাংলাদেশের থাকতো। বাকি অর্ধেক ব্রিটেনে। ব্রিটেনে ডার্ক নাইটের অ/স্ত্র ব্যবসার কারবারির দেখাশোনা, ড্রা/গ সেলিং আরও অন্যান্য সব কাজ ভাইয়াই করতো তখন। তাই আসতে হতো। তবে শুধু ভাইয়া না, ডার্ক নাইটের অবৈধ অ/স্ত্র, ড্রা/গসের ব্যবসা কাজের দেখাশোনা আমিও করতাম।’

চকিতে তাকাল ইকবাল। কথাটা হজম হলোনা। ব্যপারটা বুঝতে পেরে প্রিয়তা ঠোঁট চেপে হাসল। বলল, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। খুলে বলছি।’

নিজের শয়নকক্ষে, সিঙ্গেল সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে শওকত মীর্জা। পাশে দামি মদের বোতল। হাতে মদের গ্লাস। মাঝেমাঝে মৃদু চূমুক দিচ্ছে। কপালে গভীর রেখা। বেশ চিন্তিত সে। সব তার প্লান মতো হয়েছে। এখনো হচ্ছে। তার উদ্দেশ্যও সফল হতে চলেছে। রাশেদ আমেরকে ধ্বংস করতে পেরেছে সে। আর এবার খেলাটা যেদিকেই গড়াক। রুদ্র আমেরের ধ্বংস অনিবার্য। যেটা তার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। আর এই সবকিছু তারই একমাত্র কন্যা রানির কারণে সম্ভব হয়েছে সেটাও অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই। ঐ মেয়েটা না থাকলে সোলার সিস্টেমের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করা সম্ভব হতোনা ওদের পক্ষে। মানতে বাধ্য শওকত।

কিন্তু এতো বড় সফলতার পরেও স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারছে না সে। তার কারণও তার মেয়েই। আর কেউ জানুক বা না জানুক। তার মেয়ে ঠিক কতটা নৃ/শংস আর ভয়ংকর সেটা সে জানে।
ছোটবেলা থেকেই বখে যাওয়া মেয়ে ছিল তার। একরোখা, বেপরোয়া, বেয়াদবও। হিসেব ছাড়া টাকা ওড়ানো, যখন-তখন যার-তার সাথে ঝগড়া লেগে যাওয়া নিত্যদিনের ব্যপার ছিল।

সেসব নিয়ে কোনদিন মাথাব্যথা ছিলোনা শওকতের। ওসব ছোটখাটো ব্যপার ছাড়াও দলীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তার। তারওপর সে বাংলাদেশে থাকতো না। নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বিদেশে থাকতো। চট্টগ্রামে নামকরা এক বোর্ডিং স্কুলেই বড় হয়েছে প্রিয়তা। যদিও সেটা প্রিয়তার নিজের ইচ্ছেতেই। শওকত চেষ্টা করেও নিজের সঙ্গে নিতে পারেনি ওকে। বাবা-মা আর মেয়ে একজায়গায় থাকতোনা বলে সেভাবে খেয়াল রাখাও হতোনা।

প্রিয়তা যখন ক্লাস টেইনে ছিল তখন স্ত্রীকে নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসে শওকত। তার কিছুদিন পর প্রিয়তাও এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে আসে। কিন্তু বখে যাওয়া সেই মেয়েটা ফেরে অনেকটা চুপচাপ হয়ে। কারো সঙ্গে কথা বলেনা। সবসময় দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। অদ্ভুত আচরণ! এমনিতেও গত আটমাসে প্রিয়তার কোন অপকর্মের খবর আসেনি তার কানে। শওকত মনে মনে খুশি হয়। ভাবে, মেয়ে সোজা হয়েছে। তবে কিছুদিন যেতে বুঝতে পারে, মদ খাওয়ার নেশা হয়ে গেছে মেয়ের। মাঝেমাঝে হালকাপাতলা সিগারেটও টানে। অতিরিক্ত স্বাধীনতার ফলেই এই হাল। বাবা-মায়ের সামনেই রুমে বসে নেশা করছিল একদিন। শওকতের স্ত্রী সেটা দেখে রেগে গেল। খুব মা/রল প্রিয়তাকে। শওকতও আটকায়নি। মেয়েটার মার খাওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু সে জানতো না কী ভয়ানক ঘটনা ঘটতে চলেছে তার ঠিক পরেরদিনই।
রাত তখন দেড়টা বাজে। বাসায় ফিরতে সেদিন দেরী হয় শওকতের। ফ্ল্যাটে ঢুকে চারপাশ অন্ধকার দেখে একটু অবাক হয় সে। এমনিতে সে দেরী করলে জেগেই থাকতো তার স্ত্রী। শান বিদেশে পড়াশোনা করছিল। বাড়িতে কেবল তার স্ত্রী আর মেয়ে। সারাশব্দ কম থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেদিন একটু বেশিই নিস্তব্ধ মনে হল বাড়িটা। শওকত ভাবল তার স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীর ঠিক নেই হয়তো। সেই ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে রুমে ঢোকে সে।

কিন্তু ঘরটাও ঘুটঘুটে অন্ধকার। একফোঁটা আলোও নেই। তখন বিরক্ত হয় শওকত। মুখ দিয়ে ‘চ্যাহ্’ টাইপ শব্দ করে বলে, ‘ঘরটা এমন অন্ধকার করে ঘুমিয়েছো কেন, সুমনা?’ কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায়না। দু-তিনবার ডাকতে ডাকতে এগোয় শওকত। একবার হোঁচটও খায়। কিন্তু তবুও সাড়া দেয়না তার স্ত্রী। এবার বিরক্তির পরিমাণ বাড়ে শওকতের। আরও একবার হোঁচট খেয়ে লাইটের কাছে পৌঁছয়। লাইট জ্বা/লায়। আর তখনই জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খায় সে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে বিছানার দিকে।

সাদা বেডশীটা র/ক্তে লাল হয়ে গেছে। সাদা অংশ দেখা যাচ্ছেনা বললেই চলে। সেই র/ক্তা/ক্ত বিছানার ঠিক মাঝখানে পড়ে আছে সুমনা। সুমনাকে দেখে রুহু কেঁপে ওঠে ইকবালের। গলাটা ছু/রি দিয়ে ফালাফালা করে ফেলা হয়েছে। বেরিয়ে আছে টকটকে লাল জিভ। গালি বেয়ে র/ক্ত পড়ছে। চোখদুটোও ছু/রি দিয়ে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে। সারা শরীরে অজস্র ছু/রিঘা/ত করে খুবলে ফেলা হয়েছে।

গলা শুকিয়ে আসে শওকতের। বিছানারই এক কোণে বসে আছে প্রিয়তা। পা ঝুলিয়ে। সাদা টপসটা র/ক্তা/ক্ত হয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে সামনে। যার কারণে মুখ অনেকটাই ঢেকে আছে। হাতে ধরে থাকা ছু/রিটা দিয়ে টপটপ করে র/ক্ত পড়ছে ফ্লোরে। গা শিরশির করে ওঠে শওকতের। আতঙ্কে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতে চায়না। তবুও বহু কষ্টে বলে, ‘র-রানি’। খোলা জানালা দিয়ে হঠাৎই দমকা হাওয়া আসে। সেই হাওয়াতে প্রিয়তার মুখের সামনে থেকে চুল সরে যায়। দম বন্ধ করে ফেলে শওকত।

তার ষোড়শী মেয়ের একি রূপ! সারা মুখে র/ক্ত লেপ্টে আছে। চোখদুটোও ভয়ানক লাল। শওকতের চোখে চোখ পড়তেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে প্রিয়তা। কী হাড়হীম করা রুপ! সাক্ষাৎ পিশাচিনী!
সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও বুক কেঁপে ওঠে শওকতের। যেমন এখন উঠল। হাত দিয়েই মুছে ফেলল কপালের ঘাম। দুঃস্বপ্ন মনে হয় গোটা ব্যপারটা। মেয়ের হাতে মা খু/ন! ব্যপারটা অনেক কষ্টে ধামাচাপা দেয় শওকত। যদি জানাজানি হতো তাহলে তার অবৈ/ধ ব্যবসাসহ ব্যক্তিগত জীবনের ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যেতো।

তাই রটিয়ে দেওয়া হয় যে, কারো সঙ্গে পালিয়ে গেছে সুমনা বেগম। ঐ ঘটনার পর মনে মনে প্রিয়তাকে ভয় পায় শওকত। না চাইতেও ভীষণ ভয় পান। কারণ প্রিয়তার ভয়ঙ্করতম রূপ সে দেখে ফেলেছে। তাই অপ্রয়োজনে কখনই ঘাটায়না মেয়েকে। তবে একটা ব্যপার এখনো শওকতের কাছে রহস্য। সুমনাকে কেন মারল প্রিয়তা? শুধুই মেরেছে বলে? এইটুকু কারণ? শুরুতে জিজ্ঞেস করলেও পরে আর জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি তার। তাই গোটা পৃথিবীর কাছে গুপ্ত এই খু/নের কারণ রানি মীর্জা ছাড়া আজও সবার অজানা।

শওকত ভাবলেন তার পরের কথা। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর প্রিয়তা ব্রিটেন গিয়ে পড়াশোনা করবে বলে হুকুম জারি করল। শানের কাছে থাকবে। মন শায় দিচ্ছিল না শওকতের। কিন্তু ভেতরের সেই সুপ্ত ভয় থেকে রাজি হয়ে যায়। ব্রিটেন যাওয়ার একবছরের মাথায় যখন প্রিয়তা বলে, ও নিজেও দলে যোগ দিতে চায়। চমকে ওঠে শওকত আর শান। প্রিয়তা জানায়, তাদের আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই দল সম্পর্কে সে স্কুল লাইফেই জানতে পেরেছিল। এসএসসি পরীক্ষার পর।

প্রথমে কোনভাবেই ব্যপারটা মানতে না পারলেও একটা বিষয় মাথায় খেলতেই মেনে নেয় শওকত। যে মেয়ে ষোল বছর বয়সেই অমন নৃ/শংস হ/ত্যা করতে পারে। তাও নিজেরই পরিবারের সদস্য। নিজের মাকে। সেই মেয়ে উনিশ বছর বয়সে অনেককিছু করার ক্ষমতা রাখে। এই মেয়ে দলে যোগ দিলে লাভ বৈ ক্ষতি নেই। কিন্তু একটা শর্ত দিয়েছিলেন শওকত। ডার্ক নাইট ছাড়া বাইরের কোন দল প্রিয়তাকে দেখবেনা, চিনবেনা। প্রিয়তা মেনে নেয়।

এভাবেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ানক কালো জগতে প্রবেশ করে রানি মীর্জা। তারপরেই শওকত আর শানকে চমকে দিয়ে নিজের মারাত্মক ধূর্ততা, দূরদর্শীতা আর প্রয়োজনে নৃ/শংসতার পরিচয় দিতে থাকে প্রিয়তা। নিজের চৌকস বুদ্ধি দিয়ে এমনসব ব্যবসায়ীক পন্থা অবলম্বন করতো যে মাঝেমাঝে শওকতও বোকা বনে যেতো। দলের শত্রু, প্রতারক এবং অকেজো সদস্যদের প্রতি ওর মারাত্মক হিং/স্র, নৃ/শংস ব্যবহার কখনও কখনও কাঁপিয়ে তুলতো ডার্ক নাইটকে।

মাঝেমাঝে মনে হতো র/ক্তের ভয়ানক নেশা ওঠে মেয়েটার। যখন সেই নেশা ওঠে তখন সত্যি সত্যিই ডা/ই/নির রূপ ধারণ করে। তার মেয়ে যেন রূপকথার সেই রূপসী পিশাচিনী। যার সর্বাঙ্গে রূপ ঝড়ে পড়ে। কিন্তু যখন র/ক্ত পিপাসা পায় তখনই হয়ে ওঠে ভয়ঙ্করী র/ক্তচোষা। তবে প্রিয়তার এই রূপে শওকতের ক্ষতি হয়নি। বরং ব্রিটিনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ঐসব অবৈ/ধ ব্যবসা প্রিয়তার হাত ধরে যেন আরও একধাপ বিস্তার লাভ করে।

শওকত মীর্জা সেই দিনটার কথা ভাবে। যখন এই মেয়ের কারণেই সে বাধ্য হয়েছিল পুরোনো শত্রু ব্লাক হোল অর্থাৎ করিম তাজওয়ারের সঙ্গে হাত মেলাতে। ব্যপারটা জটিল। বর্তমান থেকে দেড় বছরেরও কিছু আগের ঘটনা। সময় এপ্রিল বা মে ছিল। প্রচন্ড গরম। সেসময় বাংলাদেশে আসে প্রিয়তা। সঙ্গে শানও আসে। তবে প্রিয়তা নিজে আসার সঙ্গেসঙ্গে নিয়ে আসে এক চমক। রাতে খেতে বসে সে শওকতকে বলে ও সম্রাট তাজওয়ারকে বিয়ে করতে চায়। প্রথমে অবাক হয় শওকত। আচমকাই বুঝে উঠতে পারেনা কোন সম্রাটের কথা বলছে তার মেয়ে?

যখন বুঝতে পারে তখন হতবাক হয়। এ কীকরে সম্ভব! প্রিয়তা জানায়, ব্রিটেনেই পরিচয় হয় ওদের। এবং পরস্পরকে ভালোবাসে। দু বছর যাবতই সম্পর্ক চলছে ওদের মধ্যে। কথাটা শুনে শওকত ভাষা হারিয়ে ফেলে। এতো কোনদিনও সম্ভব না। শান মারাত্মক রেগে যায়। তেড়ে গিয়ে মা/রতে চায় প্রিয়তাকে। কিন্তু প্রিয়তার চোখের ভ/স্ম করা দৃষ্টি দেখে থেমে যায়। সেই দৃষ্টি দেখে ঘাবড়ায় শওকত নিজেও। মনে পরে সেই ভয়ানক দৃশ্য।

র/ক্তমাখা মুখ। ঘোর আপত্তি থাকা সত্তেও প্রিয়তাকে সরাসরি না করার সাহস করে উঠতে পারেনা। প্রিয়তা সেসবের ধারও ধারেনা। সরাসরি জানায়, শীঘ্রই সম্রাট আসবে করিম তাজওয়ারকে নিয়ে। কোন রকম গন্ডগোল না করার জন্য ঠান্ডা গলায় হুমকি দেয় প্রিয়তা। মুখে কিছু না বললেও সেবার ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ে শওকত মীর্জা আর শান। মেয়েটাকে মাথায় তোলা যে সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গেছে সেটা সেবার প্রথম উপলব্ধি করতে পারে। এসবের মধ্যে কীকরে সম্রাটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল রানি, সেটা বুঝে উঠতে পারল না তারা।

তার ঠিক দুদিন পর নিজস্ব সমঝোতার মাধ্যমে একত্রে দেখা করতে বসে ডার্ক নাইট আর ব্লাক হোলের দুই লীডার। শওকত মীর্জা আর শান মীর্জা। অনেকটা বাধ্য হয়েই। কোন উপায় না পেয়ে। সঙ্গে ছিল শান, পলাশ মীর্জা এবং অবশ্যই সম্রাট আর প্রিয়তা। জানা যায়, সম্রাটও ওদিকে একই জেদ ধরেছে। এবং হুমকি দিয়েছে, ওর কথা না শোনা হলে দল ত্যাগ করবে সে। সদ্য নিজের বড় ছেলের এ/ন/কা/উন্টারের শোকে ডুবেছেন উনি।

ছোট ছেলেও দল ছেড়ে দিলে অন্ধকার হয়ে যাবে তার ব্লাকহোল। তাই কোন উপায় না পেয়ে ছেলের কথা মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন করিমও। সেদিনের লম্বা আলোচনা আর ছোট দু একটু তর্কের শেষে এক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ডার্ক নাইট বা ব্লাকহোল দুই দলেরই একটা শত্রু। সোলার সিস্টেম। যা দুজনের ওপরের ভারী হয়ে পড়েছে। তারওপর বছর কয়েক আগেই রুদ্র আমেরের কারণে পা হারাতে হয়েছে শওকত মীর্জাকে।

রুদ্রর ওপর তার ব্যক্তিগত আক্রোশ। শত্রুর শত্রু পরম মিত্র। এই নীতিকে মেনে নিয়েই হাত মেলায় তারা। আলাদা আলাদাভাবে ভাঙা সহজ না হলেই একসঙ্গে নিশ্চয়ই ভাঙা যাবে সোলার সিস্টেমকে। পতন হবে রাশেদ আমের আর রুদ্র আমেরের। তবে তাদের মধ্যকার এই সন্ধি ছিল গোপন।

এরপর পারিবারিকভাবে সল্প আয়োজনেই বাগদান হয় সম্রাট আর প্রিয়তার। আর দুই দল গভীরভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কীকরে ধ্বং/স করা যায় সোলার সিস্টেমকে। ডার্ক নাইট আর সোলার সিস্টেম দুদলই খবর পায় নতুন এক প্রজেক্টে হাত দিতে চলেছে। যা তাদের জন্যে ভীষণ ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। সেই নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক মিটিংয়ে বসে দুই দলের শীর্ষ সদস্যরা। সেখানে সম্রাট ঐ বাড়িতে গুপ্তচর পাঠানোর পরিকল্পনা করে। প্রিয়তা বলে এবার একজন না। একাধিক লোক পাঠাতে হবে। ব্লাক হোল থেকে ঠিক করা হয় সবুজ, খোকন, স্বপন যাবে।

ডার্ক নাইট থেকে যাবে জয় ওরফে রাজু আর তপু। প্রিয়তার একনিষ্ঠ ভক্ত বলা যায় জয়কে। প্রিয়তা জানায়, আপাতত কাজ কেবল সবুজ, খোকন, স্বপন আর তপু করবে। জয় একদম স্বাভাবিক, সৎ সদস্যর মতো সোলার সিস্টেমে কাজ করবে। যতদিন প্রিয়তা না বলছে। আলাদা আলাদাভাবে, আলাদা সময় ওরা চারজন ধীরে ধীরে যোগ দেয় সোলার সিস্টেমে। প্রিয়তার নির্দেশে আলাদাভাবে কাজ করছিল ওরা যাতে কোনভাবে একজন ধরা পড়লে অন্যরা কাজ এগিয়ে রাখতে পারে।
কিন্তু রুদ্র এবং রাশেদ আমেরেরও কম ধূর্ত ছিল না। তিনমাসের মাথাতেই ধরা পরে যায় জয় বাদে বাকি চারজনই। খু/ন হয়। জয় ধরা পরেনি কারণ জয় কিছু করেইনি। কিন্তু ভেতরকার তথ্য না পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।আমেরদের নতুন প্রজেক্ট সফল হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে তারা। তাই যেকোন কিছুর মূল্যেই সোলার সিস্টেমের ভেতরকার তথ্য আবশ্যক।

ব্রিটেনের কাজ দেখতো বলে, সোলার সিস্টেম বা এদের কাজকর্ম নিয়ে আগে কোন মাথাব্যথা ছিলোনা প্রিয়তার। সেসব শওকত আর পলাশের ওপর ছেড়ে দিতো। সেবার প্রথমবার সোলার সিস্টেমের বিরুদ্ধে কিছু করছিল প্রিয়তা।নিজ পরিকল্পনায়। কিন্তু সবুজ, খোকন, স্বপন, তপুর মৃ/ত্যুতে সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে প্রিয়তার। ব্যর্থ হওয়াতে রেগে যায় ও। মাথায় জেদ চেপে যায়। এর আগেও বহু গুপ্তচর পাঠানো হয়েছিল সোলার সিষ্টেমের মধ্যে। কিন্তু কেউ টিকতে পারেনি। রুদ্রর ধূর্ত চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি কোন শত্রু। কথাটা অহমে লাগে প্রিয়তার। হারার অভ্যেস নেই ওর।

সিদ্ধান্ত নেয়, জয় যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। এবার আর নতুন কাউকে পাঠাবে না। যাবে প্রিয়তা স্বয়ং। সেটাও রুদ্রর মাধ্যমে। কেউই পুরোপুরি একমত হতে না পারলেও সম্রাট ঘোর আপত্তি জানায়। কোনভাবেই, কোনকিছুর মূল্যে প্রিয়তাকে রুদ্রর সংস্পর্শে আসতে দেবেনা ও। কিন্তু ততক্ষণে সোলার সিস্টেমকে পরাজিত করা প্রিয়তার জেদে পরিণত হয়েছে। এবং সে তা করবেই।

প্রিয়তা শুনেছিল রুদ্রর মেয়ের নেশা আছে। নিত্যদিন, নিত্যুনতুন মেয়েকে বিছানাসঙ্গী করা তার অভ্যাস। সেটাকেই কাজে লাগাতে চায় ও। সেটা শুনে শওকত জানায়, ভুল জানে প্রিয়তা। রুদ্রর মেয়েদের নেশা আছে ঠিকই। কিন্তু মুগ্ধতা নেই। মেয়েদের শয্যাসঙ্গী করলেও তাদের কারো প্রতি কোনরকম দুর্বলতা প্রদর্শন করেনা রুদ্র।
কথাটা চিন্তায় ফেলে প্রিয়তাকে। সোলার সিস্টেমের সবচেয়ে বড় শক্তি রাশেদ আমের আর রুদ্র আমের সম্পর্কে আপাদমস্তক রিসার্চ করে।

প্রত্যেক মানুষেরই একটা বোতাম থাকে। যেখানটায় চেপে তাকে মাত দেওয়া যায়। সেই বোতামের খোঁজ করে প্রাণপনে। জানতে পারে রুদ্র আমের এমনিতে হৃদয়হীন নরপিশাচ হলেও কাপুরুষ নয়। আর রাশেদ আমের যত কঠোরই হন। গরীব, অসহায়দের প্রতি দুর্বলতা আছে তার। অনেক চিন্তাভাবনা করার পর এই দুটো বোতামকেই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় প্রিয়তা। জীবনের সঙ্গে মারাত্মক এক জুয়া খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের প্রথম পরাজয়ের অপমান প্রিয়তাকে এতোটাই ঘা/য়েল করেছে যে নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় প্রিয়তা।

দুই দলের মাথাদের আবার ডাকায় ও। জানায় নিজের সিদ্ধান্ত। এই পরিকল্পনায় প্রিয়তার প্রাণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি ছিল। তবুও সকলেই সানন্দে রাজি হয়। কারণ পরিকল্পনা সফল হলে অকল্পনীয় লাভের মুখ দেখবেন তারা। কারো ব্যক্তিগত ক্ষয়-ক্ষতির চিন্তা করার সময় আন্ডারওয়ার্ল্ডের জগতের কারো মধ্যে থাকেনা। এখানে দলের স্বার্থই মুখ্য। শান খানিকটা আপত্তি করতে চাইলেও সেই চিন্তা করেই থেমে যায়।

শওকত মীর্জা মনে মনে মারাত্মক খুশি হয় সেদিন। উনিই একমাত্র জানতেন প্রিয়তা কী। ওনার মন বলছিল সফল হবে প্রিয়তা। না হলেই বা কী? মারাইতো পড়বে। আরতো কিছু না। কিন্তু আপত্তির ঝড় তুলেছিল সম্রাট। কোনভাবেই এমন পরিকল্পনায় সে রাজি না। উত্তেজিত সম্রাটকে টেনে আলাদা ঘরে নিয়ে যায় প্রিয়তা। দরজা আটকে দেয়। বন্ধ দরজার আড়ালে দুজনের মধ্যে কী কথা হয়েছিল জানেনা শওকত। তবে তারপর অসন্তুষ্ট অবস্থায় হলেও এই পরিকল্পনায় হাত মেলায় সম্রাটও।

বাপের বখে যাওয়া মেয়ে রানি মীর্জা থেকে অনাথ, অসহায়, পরিশ্রমী প্রিয়তার জন্ম হয় সেদিন থেকেই।
তপ্ত শ্বাস ফেলল শওকত। তখনও রুদ্রকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়নি প্রিয়তা। কেবল কিছুদিন রুদ্রর আশ্রয়ে কয়েকটা দিন থেকে কৌশলে গোপন তথ্য হাশিল করাই ছিল ওর উদ্দেশ্য। বিয়ের ব্যপারটা হয়েছে আরও পরে। সেটাই ছিল তাদের জন্যে আশ্চর্য চমক। তবে ব্যপারটা খারাপ হয়নি। বিয়েটা হয়েছিল বলেইনা আজ সোলার সিস্টেম, আমের ভিলার এমন করুন অবস্থা। ওদের জন্যে বিন্দুমাত্র দয়া হয়না শওকতের। কেন হবে? চলন্ত ট্রেন থেকে হাত ছেড়ে দেওয়ার সময় রুদ্রতো দয়া দেখায়নি।

কিন্তু এখন আরেক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। উপায় না পেয়ে প্রিয়তাকে এক কথা দিয়ে ফেলেছে সে। সেই কথা সে রাখবেনা সে নিজেও জানে। কিন্তু তার পরিণতি কী হবে?

ডার্ক নাইটে প্রিয়তার যোগ দেওয়া থেকে শুরু করে রুদ্র আশ্রয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা অবধি সংক্ষেপে সবটা বলল প্রিয়তা ইকবালকে। যতটা বললে ব্যপারটা সে বুঝবে, ততটাই। সব শুনে ঘৃণায় কপাল কুঁচকে আসে ইকবালের। কিন্তু ধৈর্য্য ধরে বলে, ‘বুঝলাম। রুদ্রর সঙ্গে তোমার দেখা হওয়াটা তারমানে পূর্বপরিকল্পিত ছিল। কিন্তু কীকরে করলে?’

প্রিয়তা ঠোঁট খানিকটা উল্টে বলল, ‘প্লটটা সাজাতে একটু খাটটে হয়েছিল বটে। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। দেখা কীকরে করব রুদ্রর সঙ্গে। কীকরে ঢুকবো ওর জীবনে। পথ পেলাম, যখন শওকত মীর্জা মানে বাবা খবর দিল, ইন্ডিয়া থেকে চোরাই পথে একটা পেনড্রাইভ আসছে। প্রচুর টাকার একটা ডিলের চাবি আছে ওটাতে। ওটা যদি কোন দল কোনভাবে হাতিয়ে নেয়। রুদ্রতো সেখানে অবশ্যই যাবে। রাস্তা পেয়ে গেলাম। সম্রাট তখন ব্রিটেনে ফিরে গেছে। নিজের কাজে। করিম তাজওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করি আমরা।

ব্যপারটা বলতেই করিম তাজওয়ার পরিকল্পনা সাজায় রুদ্রকে সেই জঙ্গলে নিয়ে আসার। পেনড্রাইভটা আসার পথে আচমকা, অপ্রত্যাশিত আক্রমণ করে ব্লাক হোল পেনড্রাইভটা নিয়ে চলে যায় চট্টগ্রাম। এরপর রুদ্র কীকরে ওখানে গেল। কীকরে সেই জঙ্গলে পৌঁছলো। সেসবতো আপনার জানা। রুদ্র বলেছে নিশ্চয়ই?’
মাথা ঝাঁকাল ইকবাল। সে জানে। একটু চিন্তা করে বলল, ‘কিন্তু ওখানে রুদ্রর সঙ্গে দেখা হল কীকরে তোমার?’

‘আমাদের সকলের বিশ্বাস ছিল রুদ্র ঐ বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। পেরেছিলেও। তবে ব্লাক হোলের কয়েকজনকে মরতে হয়েছিল এই আরকি। কিছু পেতে গেলতো কিছু হারাতে হয় তাইনা? ডাজেন্ট মেটার। ছাদ থেকে রুদ্রর দিকে নজর রাখছিল একজন। খেয়াল রেখেছিল কোনদিকে ছুটছে। আর জঙ্গলে মশার কামড় খেতে খেতে অপেক্ষা করছিলাম আমি। তখন ও কোন দিক দিয়ে আসছে জানানো হয় আমাকে। আমিও পৌঁছে গেলাম। তারপর তৈরী হল সেই সিনেম্যাটিক মূহুর্ত। তবে মুহূর্তটা নায়ক-নায়িকার না। খলনায়ক, খলনায়িকার ছিল। আর আমাকে জঙ্গলে তুলে আনা ঐ লোকগুলো আমারই লোক ছিল। আমি জানতাম ওরা ম/রবে। কিন্তু ও বেচারারা জানতো না। দাবা খেলা খেলেছেন তো? রাজাকে মাত দিতে নিজের দু একটা সৈন্যতো বিসর্জন দিতেই হয়।’

ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল ইকবাল। প্রিয়তা মৃদু হেসে সামান্য ঝুঁকে বলল, ‘রুদ্রর হাতের ঐ গু/লিটা আমার কথাতেই লাগানো হয়েছিল। আসলে একটু সেবাযত্ন করার সুযোগ চাইতো। নইলে পাথর গলবে কীকরে?’
ইকবাল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, ‘আমার জানামতে তার পরেরদিন সকালে তোমাদের ডার্ক নাইটের লোকেরা অ্যা/টাক করেছিল। সেটা কেন?’

প্রিয়তা কপালে চুলগুলো সরিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘সলিড ব্রেইন আপনার। সেটাও মাথায় আছে? বলছি। সেটাও প্রিপ্লানড ছিল। সেদিন আমি ইচ্ছে করেই রুদ্রকে ভুল রাস্তা বলি। কারণ ঐ জায়গাটাই আমাদের মার্ক করা ছিল। প্লান ছিল রাতেই অ‍্যা/টাকটা হবে। কিন্তু রুদ্র একটা থাকার জায়গার বন্দবস্ত করে ফেলল। তাই রাতের কাজটা সকালে করতে হল।’
‘কিন্তু কেন? ওরাতো তোমারই লোক।’

প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘এইটুকু বুঝলেন না? ধরুন রুদ্র আমাকে বাঁচাল। তারপর কী করবে? নিশ্চয়ই বাড়ি পৌঁছে দেবে? আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে কেন? যাতে ও আমাকে ওর সঙ্গে ঢাকা নিয়ে যায় সেকারণেই এই পরিকল্পনা। ডার্ক নাইটের লোকেরা আমায় দেখে নিয়েছে। তারমানে আমার প্রাণ সংশয়। আমি জানতাম রুদ্র কাপুরুষ নয়। ওর কারণে একটা মেয়ের প্রাণ ঝুঁকিতে আছে সেটা ও মানতে পারবেনা। অবশ্যই নিজের সাথে নিয়ে যাবে আমাকে। তবে তারজন্যে ডার্কনাইটের আরও আটজনকে ম/রতে হল। আর ওরাও জানতোনা ওরা মরবে। আমরা জানতাম।’

ইকবাল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। কী ভয়ংকর এই মেয়ে। মানুষের প্রাণ যেন খেলনা বৈ কিছুইনা ওর কাছে। প্রিয়তা বলে চলেছে, ‘তবে সত্যি বলতে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি, যখন দেখলাম রুদ্র সত্যি সত্যিই আমাকে রেখে চলে যাচ্ছে। মনে হয়েছিল আরও একবার প্লান ফ্লপ হয়ে গেল। কিন্তু তা হয়নি। ও ফিরে এসেছিল।’
কথার মাঝে ইকবাল বলে উঠল, ‘কিন্তু ঐ ভাড়া বাড়ি, তোমার বান্ধবী মীরা, বাড়িওয়ালি? এগুলো ম্যানেজ করলে কীকরে?’
‘ম্যানেজ করতে হয়নি। মীরা বাবারই কর্মচারীর মেয়ে। আমরা বোডিংয়ে একসাথেই পড়েছি। ও এসবের তেমন কিছু জানতোনা। ওকে শুধু এইটুকু বলা হয়েছিল আমি রুদ্র আমের নামক একজন ক্রিমিনালকে ভালোবাসি। ওর কাছে যাওয়ার জন্যে, ওকে পাওয়ার জন্যেই নিজের নাম-ধাম বদলে চট্টগ্রামে একটা বাসা ভাড়া করে থাকব। ওকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে। এমনিতে আমার বান্ধবী হলেও কর্মচারীর মেয়েতো। রাজি হতে হয়েছে। রুদ্রর সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই আমরা ঐ বাসা ভাড়া নিয়ে ছিলাম।’
ইকবাল হতবাক হয়ে কেবল শুনে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘সব বুঝলাম। তোমার প্লান কাজে দিল। রুদ্র নিয়ে এলো তোমাকে ঢাকা। বনানীর ফ্ল্যাটে রাখল। তারপর? বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলে কেন? কী এমন হলো যে তোমাকে রুদ্রকে বিয়ে করতে হলো?’
প্রিয়তা খানিকটা গম্ভীর হল। চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপ থাকল কিছুক্ষণ। অতঃপর লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম রুদ্র আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। তাতেই চিন্তায় পরে যাই আমি। কাজটা কীভাবে করব বুঝতে পারছিলাম না। রুদ্রর সঙ্গে থেকে থেকে বুঝতে পারি কতোটা ধূর্ত সে। এটাও বুঝতে পারি যে বনানী থেকে কাজটা করা কোনভাবেই সম্ভব না। আর আমের ভিলায় ঢোকার কোন পথও খুঁজে পাচ্ছিলামনা।’ একটু থামল প্রিয়তা। আবার শুরু করল, ‘যেমন মেয়েই হই, মেয়েতো আমি। এইটুকু বুঝতে পারছিলাম রুদ্র দুর্বল হয়ে পড়ছে আমার প্রতি। আর একদিন রাতে নেশা করে এসে রুদ্র আমাকে যা যা বলল। তাতে আমার ধারণা বিশ্বাসে পরিণত হল। ঐ রাতটা আমি কোনদিন ভুলব না।’
শেষ বাক্যটা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল প্রিয়তা। হঠাৎই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তারপরেই আমি ঠিক করে নেই। বিয়ে করেই ঐ বাড়িতে যাব আমি। রুদ্র আমেরের বউ হয়ে। সেটাই একমাত্র উপায় ছিল আমের ভিলায় পা রাখার।’
‘শুধুমাত্র প্রজেক্টের বিষয় আর গোপন তথ্য জানার জন্যে নিজের শত্রুকে বিয়ে! ব্যপারটা বিশ্বাসযোগ্য?’
প্রিয়তার চোখমুখ গম্ভীর হল। বলল, ‘আপনার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা। সোলার সিস্টেম ধ্বংস করা আমার জেদ ছিল। নিজের জেদ মেটাতে আমি সব করতে পারি।’
‘বিয়ের ব্যপারটা তোমার বাবা, ভাই, আর তোমার আশিক সম্রাট মেনে নিল?’

‘কাকে কীভাবে মানাতে হয় সেটা রানি মীর্জা খুব ভালোকরেই জানে। তবে কী জানেন? রুদ্র যখন আমাকে আবার চট্টগ্রাম রেখে এলো। ঐসময় চিন্তিত হলেও পরে আমি কনফিডেন্ট ছিলাম। জানতাম ও আসবে। আবার আসবে। কারণ রুদ্র আমেরের কঠোর হৃদয় ততদিনে প্রিয়তার প্রেমে গলে জল হয়ে গিয়েছিল।’

ইকবাল ভ্রু কুঁচকে আবার কিছু ভাবল। তারপর বলল, ‘সব বোঝা গেল। কিন্তু বিয়ের ঠিক করার আগে, রাশেদ বাবা নিজে গিয়ে তোমার খোঁজ নিয়েছিল। কোথায় জন্মেছো, কোথায় বড় হয়েছো, বাবা-মার নাম সব। সেগুলো কীকরে সম্ভব হল।’
‘রাশেদ আমের আর রুদ্র আমেরের সঙ্গে খেলতে নেমেছিলাম। তাই একটাও লূপহোল রাখিনি। করিম তাজওয়ারের মাধ্যমে খোঁজ করে একটা মেয়ের পরিচয় বার করা হয়। নাম প্রিয়তা। বাবার নাম নূরুল ইসলাম। মায়ের নাম আসমা। মা ছোটবেলায় মারা যায়। বাবা আরেকটা বিয়ে করে মেয়েটাকে অনাথ আশ্রমে রেখে চলে যায় বিদেশে। আশ্রমেই বড় হয়েছে। আর আমার মতো ইকোনমিকস্ নিয়েই পড়াশোনা করেছে। ঠিক আমার বলা গল্পের মতো। তবে পার্থক্য হল। মেয়েটা আরও তিনবছর আগে মারা গেছে। ব্লা/ড ক্যান্সারে। ঐ মেয়েটার পরিচয়ই নিজের করে নেই আমি।’

‘কীকরে?’
‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন ইকবাল ভাই শওকত মীর্জা একজন পলিটিশিয়ান। আর বাবা, মানে রাশেদ আমেরের যা রেকর্ড, ওনার শত্রুওতো কম নেই। অনেক নামকরা নেতা, মন্ত্রী তার শেষ দেখতে চাইতো। আবার অনেক নামকরা ব্যবসায়ীকে ঘাটিয়ে দিয়েছিল রুদ্র। যেমন রিপন চৌধুরী। এগুলোই ওদের কাল হলো। তাছাড়াও কাজটা না করলে অনেকেরই কুকীর্তি ফাঁস করে দিতো বাবা।

নেতা, মন্ত্রী আর নামকরা বিজনেসম্যাম যদি পকেটে থাকে। একটা ফেইক আইডি কার্ড আর বার্থ সার্টিফিকেট তৈরী করা। একটা সাধারণ আশ্রমের রেজিস্ট্রার থেকে ফটো পাল্টে দেওয়া, আর ঐখানকার লোকেদের দিয়ে তোতাপাখির মতো নিজের কথা বলিয়ে নেওয়া কী খুব কঠিন ইকবাল ভাই? আর বাকিসব ডকুমেন্টতো ঐ প্রিয়তা নামের মেয়েটারটা দিয়েই চালানো গেছে। ওগুলোতে তো আর ছবি প্রয়োজন হয়না।’

ইকবাল হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। চারপাশটা ঝিমঝিম করে উঠল। কতটা নিঁখুত, গভীর আর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল এদের! কেউ ভাবতেও পারবেনা এমধ পরিকল্পনা!
প্রিয়তা বলল, ‘যদিও এগুলো করতে বিশাল সময় লেগেছে। আর আমি? ছ’মাস টানা ছ’মাস পরিশ্রম করে নিজেকে প্রিয়তা হিসেবে গড়ে তুলেছি ইকবাল ভাই। চুল, গেটআপ সব বদলেছি। মদে নেশা কাটিয়েছি। সিগারেটের নেশা কাটিয়েছি। ভয়েজ টোন বদলেছি। এমন একবিন্দু জায়গা ফাঁকা রাখিনি যেটা দিয়ে রুদ্র বা রাশেদ বাবা কিচ্ছু টের পায়। আমরা জানতাম ওনারা কী কী করতে পারেন। সেভাবেই সাজিয়েছি সব।’

ইকবাল শরীর কেমন লাগছে। কী ভয়ানক ঘটনাই না ঘটেছে আড়ালে আবডালে। আরেকটু ভাবল ও। আর কী প্রশ্ন করা যায়? কিছুক্ষণ ভাবার পর বলল, ‘তোমার আর রুদ্রর হলুদের দিন রাতে আমের ভিলার একজন সার্ভেন্টকে মা/রা হয়েছিল। কেন? কেন মা/রা হয়েছিল তাকে? কে মেরেছিল?’
‘আমি।’
চকিতে তাকাল ইকবাল। প্রিয়তা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘আরে! চমকাচ্ছেন? এখনো চমকানোর ক্ষমতা আছে আপনার মধ্যে? যাই হোক, কী যেন বলছিলাম?’

একটু ভাবল প্রিয়তা। মনে পড়তেই বলল, ‘হ্যাঁ। ঐ সার্ভেন্ট। আসলে সম্রাট ফোন করেছিল আমাকে। আমি কর্ণারে রুমটাতে গিয়ে কথা বলছিলাম। খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল ও। ও কিছুতেই মানতে পারছিল না বিয়েটা। বারবার নিষেধ করছিল আমাকে। চলে আসার হুমকি দিচ্ছিল। আমি ওকে বোঝাচ্ছিলাম। যে এখন এরকম ভুল করলে আমাদের এতোদিনকার পরিকল্পনা সব ভেস্তে যাবে। শেষ হয়ে যাবে সব। এসবই।

ঐ মহিলার দুর্ভাগ্য যে আমাকে ডাকতে এসে শুনে ফেলল সব। কী করতাম বলুন? সবাইকে সব বলে দিতে যাচ্ছিল। ম/রতেতো হতোই ওকে। তারওপর হাতে করে পেঁয়াজ কা/টার ছু/রি নিয়ে এসেছিল। আমি শাড়ির আচলটা হাতে ভালোভাবে পেঁচিয়ে ঐ হাতে মহিলারই হাত থেকে ছু/রিটা কেড়ে নিলাম। ঐ মহিলাকে আটকে রেখে পারভেজকে কল করে বললাম মেইন সুইচ কিছুক্ষণের জন্যে অফ করে দিতে। ও তাই দিল। আর আমি ছু/রিটা বসিয়ে দিলাম মহিলাটার গ/লায়। সহজ মৃত্যু। বেশি কষ্ট পায়নি।’

ইকবাল এবার আর অবাক হলোনা। এতক্ষণে সে বুঝেছে এই মেয়ে কী জিনিস। প্রিয়তা বলে যাচ্ছে, ‘তখনই সিঁড়ি দিয়ে কারো বেরিয়ে আসার আওয়াজ পেলাম। দ্রুত বেরিয়ে করিডর দিয়ে নিজের রুমে চলে যাই। পরে অবশ্য জেনেছিলাম রুদ্র এসেছে।’
‘আর পারভেজ? পারভেজকেও কী তুমিই মেরেছো?’

প্রিয়তা আবার ঠোঁট চেপে একটু ভাবার ভান করে বলল, ‘হ্যাঁ, আসলে ও আপনাদেরই লোক। টাকার লোভে আমাদের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেছে আমাদের হয়ে। আসলে আমি জানতাম আমের ভিলায় উল্টাপাল্টা কিছু ঘটলে রুদ্র একদম তলিয়ে না দেখে ছাড়বেনা। তাই রুদ্রর সন্দেহটা এক্কেবারে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যেই পারভেজকে ব্যবহার করা। ওকে আমিই বলেছিলাম বৈঠকঘরের টেবিলের নিচে মাইক্রোফোন লাগাতে। আমি জানতাম ও ধরা পড়বে। সেইজন্যই বলেছি। যাতে রুদ্র ভাবে কাজগুলো সব ওই করছে।

আর কেউনা। আর সেদিন যখন আমাকে পৌঁছে দিয়েই রুদ্র বেরিয়ে গেল। আমি বুঝে গিয়েছিলাম রুদ্র পারভেজকে মা/রতে যাচ্ছে। কিন্তু ম/রার আগে ইডেয়েটটা মুখ খুললেতো আমি রুদ্রর কাছে ধরা পরে যেতাম। তাই আমিও বেরিয়ে যাই। আমার লোককে কল করে বাইক আর পোষাক নিয়ে আসতে বলি। ওগুলো পরে অনেক দূর থেকে ফলো করতে করতে পৌঁছাই সেই জায়গায়। আর ও কিছু বলার আগেই ওপরে পাঠিয়ে দেই ওকে। দিতে হয় আরকি। তবে দ্রুত বাড়ি ফিরতে গিয়ে গা/ন আর পোশাক ফেরত দিতে মনে ছিলোনা। তাই আমের ভিলার স্টোর রুমে লুকিয়ে রেখেছিলাম। কেউ দেখলেও সন্দেহ করতোনা। কারণ ওটা ছেলেদের জ্যাকেট ছিল।’

ইকবাল এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা করল, ‘কিন্তু আমের ভিলার সমস্ত আলোচনা বৈঠক ঘরে হতো। যেখানে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ। আর আমের ফাউন্ডেশনে তুমি কখনও যাওনি। কীকরে জানলে সব তথ্য? মা/লগুলোকে বদলে ফেলা হচ্ছিল। সেটা কীকরে? কীকরে জানলে কোথায়, কখন, কীভাবে মা/ল আসবে? রিসিভিং কোডটা সবচেয়ে গোপনীয়। সেটা আমরা পাঁচজন ছাড়া কারোপক্ষে জানা সম্ভব না। তুমি কীকরে জানলে?’

প্রিয়তা রহস্যময়ী এক হাসি দিয়ে বলল, ‘রুদ্রকে একটা ব্রেসলেট গিফট করেছিলাম আমি। সেটা ও কখনও খোলেনা। সবসময় ওর হাতেই থাকে। তবে রাতে ঘুমোনোর আগে খুলে ড্রেসিংটেবিলের ওপর রাখে। আপনি বুদ্ধিমান ইকবাল ভাই। আর কিছু বলতে হবে?’
‘ছিহ!’ ঘৃণায়, বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নেয় ইকবাল।

প্রিয়তা অদ্ভুত একটু হাসে। আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করে ইকবালের পরবর্তী প্রশ্নের। ইকবাল লম্বা কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে, ‘তোমার সেই বান্ধবী মীরা? ওকেও কী তুমি মে/রেছো? ওটা যে আ/ত্মহ/ত্যা না, সেটা আমি এখন নিশ্চিত।’
‘না।’
‘তবে?’

‘সম্রাট মে/রেছে। আসলে মীরার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব হচ্ছিলো না। আর ও আমার সত্যিটা জানে। তবে অর্ধেক। ব্যপারটা রিস্কি। তাই ওদের বলেছিলাম এখান থেকে সরিয়ে দাও ওকে। অর্থাৎ দেশের বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দাও। ওরা দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিয়েছে।’
‘তাতে তোমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই নিশ্চয়ই?’

প্রিয়তা জবাব দিলোনা। ইকবাল নাক কোঁচকালো। একটা ঢোক গিলে বলল, ‘সব মানলাম। সব আমাদের পাপের জগতের নিজস্ব রেষারেষির ফল। ঠিক আছে। কিন্তু কুহু? ঐ নিষ্পাপ মেয়েটার এতোবড় ক্ষতি কেন করল‍ে? কী করেছিল ঐ মেয়েটা তোমার? ওর জিবনটাকে নরক করে দিলে! তুমিও তো একটা মেয়ে তাইনা? বুক কাঁপলোনা।’
মুহূর্তেই প্রিয়তার চোখমুখ সব কৌতুক হারালো। একটু চুপ থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ ওটা দুর্ঘটনা ছিল।’

মুখ বিকৃত হল ইকবালের। একটা মেয়ে হয়ে কি-না বলছে দুর্ঘটনা ছিল! এতো সহজে! বলল, ‘লজ্জা হওয়া উচিত তোমার।’
প্রিয়তা এবারেও নিরুত্তর। ইকবাল ক্রোধিত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রাশেদ বাবাকে কেন মা/রলে? মেয়ের মতো স্নেহ করতো তোমাকে। আর তুমি? খুব কী দরকার ছিল?’
‘ছিল।’ অত্যাধিক ঠান্ডা গলায় বলল প্রিয়তা।

ইকবাল কিছু বলবে তার আগেই জয় এলো গরম খাবার নিয়ে। প্রিয়তা প্রথমে কিছু ইশারা করল। জয় মাথা নাড়তেই প্রিয়তা রাগী গলায় বলল, ‘এতো দেরী হলো কেন?’
জয় বলল, ‘গ্যাসে সমস্যা হয়েছিল ম্যাম, সরি।’
প্রিয়তা কিছু বলল না। জয়কে দিয়ে একটা ছোট টেবিল এনে রাখল ইকবালের সামনে। ডান হাত খুলে দিল। জয় পি/স্ত/ল তাক করে আছে ইকবালের মাথার দিকে। কোনরকম চালাকি করলে গু/লি করতে দ্বিধা করবেনা সে। জানে ইকবাল। প্রিয়তা গম্ভীর গলায় বলল, ‘খেয়ে নিন।’

‘আগে বলো নিজের অনাগত সন্তানটাকে কেন মা/রলে? কী করেছিল নিষ্পাপ বাচ্চাটা? কী হতো ওকে পৃথিবীর আলো দেখতে দিলে? শুধু রুদ্রর অংশ বলে? ও কিন্তু তোমারও অংশ ছিল প্রিয়তা।’
প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। জয়কে বলল, ‘খেয়াল রাখবে। খাওয়া শেষে হাত বাঁধতে ভুলোনা। সকালেও যেন উনি গরম খাবারটা পায়। কেউ কিছু বললে বলবে রানি ম্যাম বলেছেন দিতে। মনে থাকবে?’
আনুগত্যের সাথে মাথা ঝাঁকালো জয়। প্রিয়তা বেরিয়ে গেল রুমটা থেকে। ইকবাল ডাকল। কয়েকবার ডাকল। কিন্তু পেছন ফিরে তাকালোনা প্রিয়তা।

এখানো অবধি আমের ফাউন্ডেশনের অফিসেই আছে রুদ্র। কিছু ভাবছে গভীরভাবে। অপরপাশে বসে আছে উচ্ছ্বাস। কিছু কাগজপত্র দেখছে ও। কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে ইন্সপেক্টর আজিজ। সেই এসেছিল। সেই একই কথা বলেছে রুদ্রকে, ‘শেষতো হয়েই যাচ্ছো। স্যারেন্ডার করো। আইনকে সহযোগিতা করো। সবাইকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করো।’ বরাবরের মতো রুদ্রেরও একই উত্তর ছিল, ‘আমি শেষ হলে সবকিছু নিয়েই শেষ হব। কথা দিচ্ছি।’
রুদ্রর ধ্যান ভাঙে উচ্ছ্বাসের কথায়। উচ্ছ্বাস বলছে, ‘আফ্রিকান চারটা কম্পানির দুটো অলরেডি নোটিস্ পাঠিয়েছে। একসপ্তাহের মধ্যে টাকা চাইছে। বাকিগুলোও চলে আসলে?’

‘আসবে।’ থমথমে গলায় বলল রুদ্র।
‘কীকরে দেব? ফান্ডে টাকা নেই। বাকিদের টাকা শোধ করতে দিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। মিলস্ আর ছাপাখানাগুলো বিক্রি করলেও সম্ভব না। তাতে বড়জোর দুটো কম্পানিকে ঠান্ডা করা যাবে। আর তাতেও ফকির হয়ে যাব আমরা। আমের ভিলা ছাড়া আর কিচ্ছু থাকবেনা।’

‘জানি। আর ওরাও এটাই চাইছে। কারণ ওরা জানে, ঠিক সময়ে টাকা দিতে না পারলে কী হবে।’
উচ্ছ্বাস চুপ থাকল। ও জানে কী হবে। সেই কম্পানিগুলো থেকে লোক পাঠানো হবে। তারা কুকুরের মতো খুঁজে খুঁজে খু/ন করবে ওদের সবাইকে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। আফ্রিকার খুবই নৃ/শংস ও শক্তিশালী দল ওরা। রুদ্র লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ‘কাকা কোথায়?’

‘মিলসে গেছে। কী অবস্থা দেখতে। প্রচুর খাটছে মানুষটা।’
রুদ্র কিছু বলল না। লম্বা শ্বাস ফেলে উচ্ছ্বাস বলল, ‘এবার কী করবি?’
রুদ্র চেয়ারে হেলান দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাবছি। কীকরে ওদের মা/ল ডেলিভারীর সময় অস্ত্রগুলো ছিনিয়ে নেওয়া যায়। ওটাই একমাত্র উপায়। টাকা আর পজিশন দুটোই ফিরে পাওয়ার।’

‘কিন্তু তারজন্যে ওদের ভেতরের খবর জানতে হবে আমাদের। প্লেস, টাইম, রিসিভিং কোড। কিন্তু কীকরে হবে?’
রুদ্র কিছু বলল না। ও নিজেও জানেনা কীকরে কী হবে। উচ্ছ্বাস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দীর্ঘসময়ের নীরবতার চলল ঘরটাতে। পিনপতন নীরবতা। এইটুকু সময়ে কতকিছু ভাবল দুজন। কত হিসেব, সমীকরণ মেলালো। জীবনের হিসেব। বরাবরের মতোই অমীমাংসিত সমীকরণ ছাড়া কিচ্ছু পেলোনা দুজন। হঠাৎ রুদ্র নিজেই বলল, ‘সন্ধ্যায় কোথায় ছিলি?’

‘নাজিফার কাছে। ওকে ডাক্তার দেখালাম। আর ওর মা জোর করে রাতের খাবার খাইয়ে পাঠালো। ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলেন মহিলা। কীসব বলছিল।’
‘কী বলছিল?’
‘ছাড় ওসব।’
‘বলবি নাকি ব্যালকনি দিয়ে ফেলে দিয়ে আসব?’

মুখ দিয়ে চ্যাহ্ টাইপ শব্দ করল উচ্ছ্বাস। বলল, ‘বিয়ে করার অনুরোধ করল নাজিফাকে। তুই বল এটা হয়?’
‘কেন হয়না? ও গর্ভবতী আর বিধবা বলে?’ ভ্রু কুঁচকে বলল রুদ্র।
‘কীসব বলছিস? ওসব কিছু না। কিন্তু আমিতো_ সব ঠিক থাকতে যে কারণে বিয়েটা হয়নি। এখন তো সেই কারণটা উধাও হয়ে যায়নি।’
‘থাকবেনা।’

চকিতে তাকাল উচ্ছ্বাস। বোকা কন্ঠে বলল, ‘মানে?’
রুদ্র নির্বিকারভাবে বলল, ‘মানে এই লেনদেন, পাওনা সব মিটিয়ে। ঐ জানোয়ারগুলোকে শেষ করার পর আমি এই জগতে থাকছি না। আর না তুই থাকবি। সুতরাং তুই নাজিফাকে বিয়ে করছিস। সব মিটে যাওয়ার পর।’
‘কী বলছিস তুই, নিজে জানিস?’
‘জানি।’
‘কিন্তু..’

‘কোন কিন্তু নেই। মেয়েটা প্রচুর কষ্ট পেয়েছে জীবনে। ভাই বলে ডাকে আমাকে। আর কোনরকম কষ্ট দিবিনা আমার বোনকে । যদি দিস, সত্যি সত্যিই আমি তোকে খু/ন করব।’
উচ্ছ্বাস বোকা বনে গেল। বলতে পারল না কিছুই। রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঘুম পাচ্ছে আমার। বাড়ি যাব। চল।’
বলে চলে গেল রুদ্র। উচ্ছ্বাস বোকার মতো বসে রইল ওখানেই। আন্ডারওয়ার্ল্ড ছাড়বে ওরা? স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাঁচবে? ও, নাজিফা, নাজিফার বাচ্চা একসঙ্গে! এটা আদোও হওয়ার? সত্যি! ভাগ্যবিধাতা কী সত্যিই এতো সরল জীবনযাপন লিখে রেখেছেন ওদের ভাগ্যে? নাকি মৃ/ত্যুর আগ অবধি এই কালকূটময় জীবনই ওদের নিয়তি?

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭১ (২)

[ বিশাল বড় পর্বটা। তাই রিচেইক করার ধৈর্য্য হয়নি। টাইপিং এবং অন্যান্য ভুলগুলো একটু কষ্ট করে বুঝে নেওয়ার অনুরোধ। ]

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৭৩