অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ১৫

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ১৫
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

আজ বাড়িঘর শান্ত। কোথাও বিন্দুমাত্র অমির শব্দ নেই। বাসায় থেকেও না থাকার মতো ঈশিতার পাশে বসে আছে ভদ্র বাচ্চা হয়ে। খটকা লাগলো ঈশিতার। আগাগোড়া অমিকে পর্যবেক্ষণ করে ভহরু কুঁচকে নিলো। সন্দীহান গলায় বলল,
“কী ব্যাপার অমি? আজ এত ভদ্র কেন?”
অমি নিষ্পাপ মুখশ্রী নিয়ে বলল,
“আমি কি দুষ্টুমি করি, ঈশু আপু?”

ঈশিতার কুঁচকানো ভুরু জোড়া শিথিল হলো। তার আর বুঝতে বাকি নেই অমি দ্যা গ্রেইট ভদ্র বাচ্চা কোন একটা অঘটন ঘটিয়ে এসে বসে আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় সে কখনোই ঈশিতাকে আপু বলে না। বাকিদের মতো ঈশু ডাকে। প্রথম প্রথম দাদু আপুর মুখ থেকে শুনে সবাইকে নাম ধরে ডাকতো। এখন অবশ্য ঠিক হয়েছে। ঈশিতা বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বল কী করেছিস?”
অমি ঈশিতার আরেকটু গা ঘেঁষে বসলো। বলল,
“তুমি আমায় ভালোবাসো না ঈশু আপু?”
ঈশিতা মুখ ভেংচি কে*টে বলল,
“তুই আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলিস? তোকে কেন ভালোবাসবো?”
অমি গাল ফুলিয়ে বলল,
“আমি তোমার একটা মাত্র ভাই। বলো, ভালোবাসো না?”

রান্নাঘরে এলো তরী। মিনিট দশেক পূর্বে এদিক থেকে
ঝনঝন করে কিছু পড়ার শব্দ পেয়েছিল। হাতে কাজ থাকায় উঠে আসতে পারেনি। রান্নাঘর চেক করে বুঝলো শব্দের উৎস রান্নাঘর নয়। বেরিয়ে যেতেই জুতার নিচে উঁচুনিচু কিছু অনুভূত হলো। তাকিয়ে দেখলো ফ্লোরে, আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিন্দু বিন্দু কাঁচের টুকরো। মাথা তুলে ডানদিকে শোকেসের দিকে তাকালো। আশেপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে অমির বল খুঁজে পেল। তরী নিচু হয়ে আগে ভাঙা কাঁচ পরিষ্কার করলো। ছেলেটাই যে এই অকাজ করেছে, তার বুঝতে বাঁকি নেই। সবার আগে ইরার ঘর খুঁজলো। অমি কোন দো*ষ করলেই ইরার কাছে লুকিয়ে পড়ে। ইরাকে ঘুমাতে দেখে চলে এলো তরী। সেখানে অমি নেই। আয়েশা সুলতানার ঘরেও নেই। চুপিচুপি চলে গেল ঈশিতার ঘরে।

ঈশিতার সাথেই কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে অমি। তরী পেছন থেকে আলতো হাতে কান টে*নে ধরলো তার। কপট রা*গ দেখিয়ে বলল,
“শোকেসের গ্লাস কে ভেঙেছে?”
অমি কানে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠলো।
“আমার কান ছিঁড়ে যাচ্ছে, আমি ব্যথা পাচ্ছি।”
সূঁচালো নজরে তাকিয়ে ছেলের নাটকবাজী দেখলো তরী। অরু থেকে কোন অংশে কম নয়। ঢিলে হাত আরেকটু ভিড়িয়ে ধরে বলল,

“খুব ব্যথা পাচ্ছো, না? শোকেসের গ্লাস কেন ভাঙলে?”
অমি অভিনয় বাদ দিয়ে সত্যিই কাঁদোকাঁদো চোখে তাকালো। কান্না মাখা গলায় বলল,
“আমি ভাঙিনি আম্মু। ঈশু ভেঙেছে।”
অতঃপর চোখ দুটোর আকার বড়ো করে বলল,
“এই দেখো, আমি দেখেছি, এই চোখদুটো দিয়ে দেখেছি।”

ঈশিতা হতভম্ব হয়ে গেল। নিজের ঘাড়ে দো*ষ আসতেই নিজের হয়ে সাফাই দিলো তরীকে।
“মামনী আমি ভাঙিনি। মি*থ্যা বলছে অমি। আমি তো স্কুল থেকে ফিরে আর বের হইনি।”
তরী ঈশিতাকে ইশারায় শান্ত হতে বলল। অমিকে বলল,
“ঈশিতা তোমার বল বের করে গ্লাস ভেঙেছে, এটাই বলতে চাইছো?”
তরীর চোখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো অমি। ভয়কাতুরে চোখে তাকিয়ে বলল,
“ঈশু কিছু করেনি, আমিও করিনি। বিড়াল করেছে। আমি দেখেছি।”

তরী বেশিক্ষণ হাসি চেপে রাখতে পারলোনা। আড়ালে মুখ লুকিয়ে হেসে অমির দিকে ফিরলো। গম্ভীর হয়ে বলল,
“বিড়ালের নাম কি অমি?”
অমি গাল ফুলিয়ে রেখেই উপরনিচ মাথা দুলিয়ে স্বীকারোক্তি দিল বিড়ালের নাম অমি।

দু-দিন ধরে পড়াশোনার ঝামেলায় কারো সাথেই কথা বলা হয়নি অরুর। রামিকেও পুরোদস্তুর ইগনোর করে গিয়েছে। আজ আর ইগনোর করা গেল না। কল রিসিভ করতেই রামির উৎকণ্ঠিত স্বর শোনা গেল,
“গত দুদিন তোকে কত কল, মেসেজ করেছি, তুই দেখিস নি?”
অরু শান্ত গলায় জবাব দিল,
“গত দুদিন একটু বেশিই প্রেশার ছিলো।”
ধমকের সুর শোনা গেল,
“তাই বলে তুই আমাকে জানাবি না? আমি টেনশনে আধ পাগল হয়ে গিয়েছি।”
অরু মিটিমিটি হেসে বলল,
“পাবনায় একটা সিট বুকিং দেব?”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দ পেল অরু। রামি নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখলো। মন্থর স্বরে বলল,
“দুটো সিট বুকিং দিবি, প্লিজ! আমার বউ না থাকলে ডাক্তাররাও আমাকে সামলাতে পারবে না।”
অরুর নিকট কথা খানা অতিরিক্ত ঠান্ডা শোনালো। জমাট বাঁধার মতো ঠান্ডা। রামির সাথে ওই হুটহাট ধমক আর ঝগড়াঝাটিতেই সে কম্ফোর্ট ফিল করে। এতটা কোমলতা তার সয় না। অরু তখন ভিন্ন জগতে চলে যায়। লজ্জারা তার নিকট ভয়ঙ্কর নিমন্ত্রণ প্রত্যাশা করে। নিজের সত্তা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বেই অরু নিজেকে আঁকড়ে ধরে। লজ্জা থেকে বাঁচতে মুহূর্তেই ফিরে যায় নিজের রণচণ্ডী রূপে। তেতে উঠে বলল,

“আমি তোমার সাথে যাবো কোন সুখে? পা*গ*ল তো আমি নই, তুমি।”
রামি বলল,
“সে কি অরু। তুই এমন ছ্যাৎ করে উঠছিস কেন? আমি তো আমার বউয়ের কথা বলেছি। তুই কি আমার বউ, বল?”
অরু নিজের জালে নিজেই ফেঁসে গেল। চুপসে যাওয়া গলায় ইতিউতি করে বলল,
“তো? আমাকে ছাড়া আর কয়টা বিয়ে করেছো?”

“তুই আমার বউ? তাহলে আমায় প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছিস কোথায়? পুরোপুরি আমাকে ইগনোর করে যাচ্ছিস। যেন আমি কোন ব*খা*টে, তোকে দিনরাত বিরক্ত করি!”
অরু উঁচু গলা করে বলল,
“ব*খা*টে থেকে কম কীসে? নিজে সম্মান খোঁজো, আমাকে সম্মান দাও তুমি?”
“তোকে আমি কীভাবে অসম্মান করলাম?”
“এই যে, আমাকে তুই করে ডাকছো। এটা কি অসম্মান নয়?”
রামি অবাক হয়ে বলল,

“তো তোকে কী বলে ডাকবো?”
“আপনি ডাকবে। আমি ছোটো থেকেই তোমাকে বড়ো হতে দেখেছি।”
রামি ভেবে পেল না, কথাটা কি তার বলা উচিত ছিল না-কি অরুর! নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো। সে তো ভুলেই গিয়েছে তার বউ অরু। আর কেউ নয়। সরকার যেখানে নারী, সেখানে তার কথার দুই টাকা মূল্য পাবে ধারণা করাও বোকামি। একে বিয়ে করার উচিলায় মিঠু তার কাছ থেকে মোবাইল হাতানোর অভিযানে নেমেছে। যু*দ্ধ ক্ষেত্রে অ*স্ত্র হিসেবে থাকছে ফোনকল। কন্ট্রাক করার সুযোগ হলেই ফোনের কথা মনে করিয়ে দেয় মিঠু। কেবল তরী আপু ছাড়া বাকি দুটোই ধান্ধা*বাজ । সে ফোন চেয়ে যাচ্ছে, অথচ তার বোনের পাত্তা দেওয়ার খবর নেই। অতিষ্ঠ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“বড়ো আপা, আপনি আমায় ছোটো থেকে বড়ো হতে দেখে বড়োই উপকার করেছেন। কিন্তু আপনাকে তুই বলার অপ*রাধ*বোধে আমি মোটেই অনুতপ্ত নই।”
অরু গম্ভীর স্বরে বলল,
“বাড়ি এলে তোমার গর্দান নেওয়া হবে।”
রামির রাগি স্বর পাল্টে গেল। অনুনয় করে বলল,
“প্লিজ, গর্দানটা তোমার হাতেই নিও!”
অরু যেন কানে ভুল শুনলো। রামি তাকে একটু আগে কী বলে ডেকেছে! তুমি!

মিঠুর দৈনিক রুটিনে নতুন আরেকটি কাজ যুক্ত হয়েছে। রাতে সব কাজ গুছিয়ে সুহার বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। মেয়েটা বড্ড পা*ষা*ণ। কিছুতেই তার মন গলে না। মিঠুর মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে সুহার মুখ দিয়ে “হ্যাঁ” শব্দটি বের করা। সেই কখন থেকে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ একটিবার জানালায় পর্যন্ত আসছেনা।
কানে মুঠোফোন চেপে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বসে আছে। ব্যাকুল দৃষ্টি ঘুরেফিরে সুহার জানালায় গিয়েই নিবদ্ধ হচ্ছে।
অনেকক্ষণ যাবত সুহার ফোনে রিং হচ্ছে। সে ফোন তুলছেনা।

কল কে*টে গিয়ে আবার রিং হচ্ছে। রাত গভীর হলেও শহরের মানুষগুলোর জন্য তেমন একটা সময় নয়। কয়েকদিন যাবত ইবতেসাম তার বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে কতদিন? বাড়িওয়ালা যদি জানতে পারে, রাত-বিরেতে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি তার জন্য আসছে, তবে বাসা ছাড়তে বাধ্য করবেন। এমনিতেই সবাই জানে সে বিবাহিত, হাসবেন্ড দেশে নেই। এখন না আবার প*র*কী*য়া*র অভিযোগ উঠে তাকে বাসা ছাড়তে হয়! এতক্ষণের চঞ্চল মুঠোফোনটি নির্জীব হয়ে পড়ে রইলো। এখন আর কল আসছে না।

পাঁচমিনিট এভাবেই অতিবাহিত হলো। সুহা ধীর পায়ে জানালার পাশে আড়াল হয়ে দাঁড়ালো। দেখতে চাইলো ইবতেসাম আছে কিনা? মানুষটি এখনও যায় নি। ঘরে মৃদু আলো জ্বালানো। জানালার পাশটা বলতে গেলে অন্ধকার। সেখানটায় খুব একটা আলো নেই। ওখানে দাঁড়িয়ে ইবতেসামকে দেখলো পলকহীন। ফোনেই কিছু একটা করছে। সুহার ফোন হাতেই ফোন ছিল। টুংটাং শব্দে নোটিফিকেশন আসতেই তার চমক কাটলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো সেই নাম্বার থেকে বার্তা এসেছে।

“দূর থেকে দেখছেন কেন, সুহা? আমি চাই আপনি খুব কাছ থেকে আমায় দেখুন। আপনি সেটা মানতে পারবেন না, অথচ আড়াল থেকে চোখের তৃষ্ণা মেটাবেন। তা তো হয়না, সুহা।”
সুহা থমকে গেল। ভেবেছিল প্রায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা জায়গায় তার অবয়ব বোঝা যাবে না। সে বুঝতেই পারলো না অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইবতেসামের চোখ সয়ে এসেছে। স্বল্প আলোয় সুহার ছায়া স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। জানালার পাশ থেকে সরে গেল না সুহা। ফোন কানে চেপে স্পষ্ট রাগ নিয়ে নিচে তাকিয়ে রইলো।
সুহার ফোন পেয়ে মিঠুর হাসি প্রশস্ত হলো। গভীর স্বরে বলল,

“বলুন সুহা।”
সুহা তেজী গলায় বলল,
“আপনার সমস্যা কোথায়?”
মিঠু বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে চোখ বুজে হাসলো। ছোটো করে বলল,
“হৃদয়ে।”
“তবে আপনার ডাক্তার দেখানো উচিত। ”

“আমি তো ডাক্তার দেখাতেই চাই। তবে কিছুতেই ডাক্তরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাচ্ছি না।”
সুহা রাগে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলো। শান্ত গলায় বলল,
“আপনি জানেন,আমি অন্য কাউকে ভালোবেসেছি।”
মিঠু চোয়াল শক্ত করে নিলো। কঠিন গলায় বলল,
“সে আপনার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ আমি হতে চাই, এবং হবো।”
সুহা বলল,

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ১৪

“আমি যদি আপনার না হয়ে অন্যকারো হয়ে যাই?”
মিঠুর স্বরে দৃঢ়তা, পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
“আমি হীন অন্য কোন পুরুষ আপনার না হোক। কেবল আমার বুকেই আপনার ঠাঁই হোক। ”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ১৬