অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২৫+২৬+২৭

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২৫+২৬+২৭
written by Nurzahan Akter Allo

নবিন অদ্রিকে নিয়ে দুই রুমের সেই ফ্ল্যাটে উঠলো। অদ্রি রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। নক্ষত্র আর তিতিক্ষার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অদ্রি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। নবিন হাতের ব্যাগটা রেখে অদ্রিকে ফ্রেস হয়ে নিতে বললো। অদ্রির পেটেও তো কেউ বেড়ে উঠছে। তার জন্য হলেও তো নিজের যত্ন নিতে হবে। নবিন অদ্রিকে জোর করে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো। সে চোখে মুখে পানি দিয়ে আসলো। মাথাটা খুব ঘুরছে। নবিন খাবার বেড়ে অদ্রির মুখের দিকে বাড়িয়ে দিলো। অদ্রি নবিনের হাত ধরে কেঁদে দিলো। নবিন শান্ত কন্ঠে বললো,
–“খেয়ে নাও। ছোট একটা নিষ্পাপ প্রাণের জন্য তোমাকে নিজের প্রতি যত্ন নিতে হবে। কেঁদো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন আর একটা কথাও না, চুপ। হা করো, লক্ষী মেয়ের মত খেয়ে নাও। ”

অদ্রিকে খাইয়ে নবিন ওয়াশরুমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। অঝোরে চোখের পানি ঝরে যাচ্ছে। বোনের অসহায় মুখটার কথা মনে হচ্ছে। নবিন দেওয়ালের সাথে দুই হাত রেখে নিশব্দে কাঁদছে। এতক্ষণ নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও, এখন আর পারছে না। পুরুষ মানুষের অসাধারণ একটা গুন আছে। সেটা হলো, সবার সামনে নিজেকে শান্ত রাখলেও, নির্জন একাকীত্বের সময় তাঁরা নিজের কাছেই নিজে হেরে যায়। আড়ালে তখন তারাও ভেঙ্গে পড়ে। লোকচক্ষুর আড়ালে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। তবে সে কান্নার না আছে শব্দ, আর না আছে সেই সময়টুকুর জন্য নিজেকে গুটিয়ে রাখার ক্ষমতা।
তনুকা সব শুনে বাসায় আসলো। এসব শুনে ওর কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে। এটা কি হলো? নক্ষত্র আর তিতিক্ষার পরিণতি কি হবে? তনুকা তিতিক্ষার রুমে গেল। এলোমেলো অবস্থায় রুমের এক কোণে বসে আছে। ওর দৃষ্টি সিলিং ফ্যানের দিকে। চোখের পানি চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তনুকা তিতিক্ষাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। তনুকা তিতিক্ষার এমন অবস্থা দেখতে পারছে না। ওই দিকে নক্ষত্রের কি অবস্থা কে জানে? তিতিক্ষার মুখে কথা নেই, চুপ করে বসে আছে। তনুকা তিতিক্ষাকে জোর করেও ওখান থেকে উঠাতে পারলো না। তনুকা হার মেনে কাঁদতে কাঁদতে রুমে থেকে চলে গেল। তিতিক্ষার আব্বু-আম্মুর কাছে ব্যাপারটা খুবই দৃষ্টিকটু লাগছে। তিতিক্ষার হাতে থেকে এভাবে রিং খুলে নেওয়াটাতে উনারাও রেগে গেছে। এই বাসার সবাই এখন নক্ষত্রদের কাউকে সহ্য করতে পারছে না। সবার একটাই কথা, যা হয় আমাদের মঙ্গলের জন্যই হয়। তিতিক্ষা যেন নক্ষত্রকে ভুলে নতুন করে আবার শুরু করে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নক্ষত্রের আম্মু এসে রুমে দরজা দিয়েছে। মিঃ আবরার এত ডাকাডাকি পরেও উনি রুম থেকে বের হয়নি। নবিনদের বাসা থেকে ফেরার চার ঘন্টা পর নক্ষত্র বাসায় ফিরলো। বাসায় এসে মিস্টার আবরারকে থমথমে অবস্থায় বসে থাকতে দেখলো। গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখে নক্ষত্রের ভুরু কুঁচকে গেল। অফিসে যত সমস্যাই হোক উনি তো বাসায় কাউকে জানাই না। নক্ষত্র হাতের ফাইলগুলো সোফার উপর রাখলো। চার্জ না থাকায় ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেছে। ফ্লাইটে আসার সময় ওর পাশে একটা বাচ্চা বসেছিলো। তার সাথে নক্ষত্র খুব ভাব জমেছে। সেই বাচ্চাটাই নক্ষত্রের ফোন নিয়ে খেলতে খেলতে চার্জ শেষ করে ফেলেছে। নক্ষত্র ওর বাবার পাশে বসার পরেও মিঃ আবরারের কোনো হেলদোল নেই। উনি গভীর চিন্তায় নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে। নক্ষত্র
নরম কন্ঠে বাবাকে বললো,
–“বাবা।”
বাবা ডাকটা শুনে মিঃ আবরার পাশে তাকালো। নক্ষত্রকে দেখে উনার কলিজা কেঁপে উঠলো। এখন উনি কিভাবে নক্ষত্র সবটা বলবে? নক্ষত্রই বা কি করবে? বাবা হয়ে ছেলের অসহায় চাহনি কিভাবে সহ্য করবে? মিঃ আবরারের চোখে পানি ছলছল করছে। নক্ষত্র ওর আব্বুর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। নক্ষত্রের বাবার চোখের অশান্ত চাহনির কারণ নক্ষত্রের অজানা। নক্ষত্র ওর বাবার হাতটা ধরে মুচকি হেসে বললো,
–“কিছু হয়েছে? বলো আমাকে?”

মিঃ আবরার নক্ষত্রকে জড়িয়ে ধরলো। নক্ষত্রও ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। ওর বাবার এমন করুণ চাহনি নক্ষত্র এর আগে কখনো দেখেনি। মিঃ আবরারের সব কথা ফুরিয়ে গেছে। টেনশনে বুকে খুব ব্যাথা করছে। একদিকে আদরের মেয়ের করুণ অবস্থা আর অন্যদিকে ছেলের মুখের হাসি। এমন একটা পরিস্থিতি যে, না পারছে ছেলেকে কিছু বলতে আর না পারছে মেয়েকে সাপোর্ট করতে। উনার একফোঁটা চোখের পানি নক্ষত্রের কাঁধের গিয়ে পড়লো। নক্ষত্র বুঝতে পারল ওর বাবার কাঁদছে। বাবার চোখের পানি দেখে নক্ষত্রের কলিজা শুকিয়ে গেলো। নক্ষত্র দ্রুত ওর বাবাকে বুক থেকে সরিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
–“কি হয়েছে বাবা? কোনো সমস্যা? বলো আমাকে? কেউ কিছু বলেছে? কথা বলো? তোমার চোখে পানি কেন?”

নক্ষত্র দ্রুত এক গ্লাস পানি এনে ওর বাবাকে দিলো। মিঃ আবরার পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করলো। এরপর উনি আস্তে আস্তে পুরো ঘটনাটা নক্ষত্রকে জানালো। মিঃ আবরার চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা হেলান দিয়ে আছে। নক্ষত্র স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। বুকের বা পাশটা চিনচিনে ব্যাথা করছে। অদ্রি এমন করতে পারলো ? আর তিতিক্ষা? নক্ষত্র মাথা কাজ করছে না। শান্ত ভাবে সে চুপ করে করে বসে আছে। মিঃ আবরার আর বসে থাকতে পারলো না। উনি দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। উনি সহ্য করতে পারছে না, উনার ছেলের এমন স্তব্ধতা।
তিতিক্ষার আব্বু আম্মু মামনির বাসায় আসলো। তিতিক্ষার এমন অবস্থায় সবচেয়ে উনাদেরকেই তো দরকার। তিতিক্ষার আম্মু রুমে ঢুকে দেখে তিতিক্ষা চুপ করে বসে আছে। চোখের কোণা বেয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রুকণা। তিতিক্ষার আম্মু তিতিক্ষার পাশে বসে ওর মাথায় হাত রাখলো৷ মাথাতে কারো স্পর্শ পেয়ে তিতিক্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ওর মাকে পাশে দেখে তিতিক্ষার উনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মায়ের বুকের মুখ লুকিয়ে, শাড়ি আঁকড়ে ধরো উচ্চ শব্দে তিতিক্ষা কেঁদে উঠলো। মেয়ের এমন আত্মানার্দে তিতিক্ষার আব্বু আম্মু দু’জনেই কেঁদে দিলো। মেয়ে যে মারাত্মক ভাবে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে, উনারা খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে। তিতিক্ষার মতো ঠান্ডা স্বভাবের স্বল্পভাষী মেয়ে, আজকে প্রিয় মানুষটাকে হারানোর ভয়ে কাঁদছে। বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রনার সৃষ্টি করছে। মাথার মধ্যে একটাই কথা ঘুরছে, ‘নাহিয়ান ছাড়া তিতিক্ষা একেবারে নিঃস্ব। নাহিয়ান যে ওর মুখের হাসির কারণ। মানুষটা দিনে দিনে ওর বেঁচে থাকার অনিবার্য কারণ হয়ে উঠেছে।’

অদ্রি বমি করে একাকার অবস্থা। নবিন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে অদ্রি বমি করছে। বমি করতছ ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। নবিন দৌড়ে যায় অদ্রির কাছে। অদ্রির মাথা চেপে ধরে কুলি করিয়ে পানি খাওয়ায়। অদ্রি বমি করতে করতে হাঁপিয়ে গেছে। মুখটা লাল হয়ে গেছে। মৃদুভাবে কাঁপছে। নবিন অদ্রিকে শুইয়ে দিতে চাইলে অদ্রি নবিনের কোমর জড়িয়ে ধরে। অদ্রি কাঁদছে, শব্দ করে কাঁদছে। নিজের অপরাধবোধ, ভাইয়ের সুখ কেড়ে নেওয়া, বাবা মাকে কষ্ট দেওয়া; সব মিলিয়ে কষ্টে নিঃশ্বাস নেওয়াও যেন কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। অদ্রির কান্না দেখে নবিন আলতো ওর মাথায় হাত রাখলো। ওকে শান্ত করাতে অদ্রির মাথাতে আলতো করে হাত রাখলো।
নক্ষত্র ওর রুমে আসলো। ফোনটা দ্রুত চার্জে দিয়ে শুয়ে পড়লো। নক্ষত্রের দৃষ্টি তিতিক্ষার ছবিটার দিকে। নক্ষত্র উঠে বসে মাথা নিচু করে ভাবলো। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে ওর আম্মুর রুমে গেল। বেশ কয়েকবার ডাকার পরও ওর আম্মু দরজা খুললো না। নক্ষত্র অনেক দাঁড়িয়ে চলে আসার জন্য যখন পা বাড়াবে তখন ওর আম্মু দরজা খুলে দিলো। নক্ষত্র রুমে ঢুকলো। ওর আম্মু ওর দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। নক্ষত্র ওর আম্মু হাত ধরে বললো,

–“তোমার যা ভালো মনে হয় করেছো। আমিও তোমাকে অভিযোগ জানাতে আসিনি৷ তাহলে এখন ঘরবন্দী হয়ে আছো কেন?”
নক্ষত্রের আম্মু নক্ষত্রের দিকে তাকালোও না। পাশের সেন্টার টেবিলের উপরে ওদের এনগেজমেন্টের রিংটা পড়ে আছে। সেটা দেখে নক্ষত্র হৃদপিন্ডটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। নক্ষত্রের হাত থেকে ওর আম্মু হাত সরিয়ে নিলো। উনার রাগ এখনো কমেনি। রিংটার দিকে তাকাতে দেখে নক্ষত্রের আম্মু আরো রেগে গেলেন। উনি ভেবেছেন নক্ষত্র হয়তো তিতিক্ষার কথা বলবে। মামনির কথা গুলো মনে করে নক্ষত্রের আম্মু আরো রেগে গেলেন। নক্ষত্রকে কিছু বলতে না দিয়ে নক্ষত্রের গালে দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। নক্ষত্র টু শব্দ করলো না। নক্ষত্রের আম্মু উচ্চশব্দে কেঁদে কেঁদে বললো,
–“তোর মুখের দিকে তাকিয়ে তিতিক্ষাকে নিয়ে টু শব্দ করিনি। তিতিক্ষাকে ছেলের বউ না করে মেয়ের আসনে বসিয়েছি। ওর পরিববারের সবার মত সাথে আন্তরিকতার সাথে মিশেছি। ওরা কি আমাদের যোগ্য তুই বল? বল আমাকে, ওরা কি আমাদের সাথে যায়? শুধু তোর মুখের হাসিটার জন্য আমি কিছু বলিনি। তোর সব আবদার মেনে নিয়েছি। এজন্য আজকে এই প্রাপ্প, তাই তো? যার বোনের জন্য এত কিছু করলি, নিজের পকেট থেকে এত এত খরচ করে তার বোনের অনুষ্ঠান করলি। ওদের মুরোদ আছে এভাবে অনুষ্ঠান করার? ওরা দেখেছে এসব, ওরা বোঝে কিছু? বিবেকবোধ থাকলে কি ওই বেয়াদবটা এমন করতো? বল করতো? ওই পরিবারের সাথে আমি কোনো সম্পর্ক রাখবো না। আমি যখন না বলেছি, তো না’ই হবে।

নক্ষত্র চুপ করে আছে। কিছু বলার ভাষা ওর জানা নেই। মস্তিষ্কে কাজ করছে না। এখন কার সাপোর্টার হবে, আম্মু, বোনের, বউয়ের নাকি বউয়ের পরিবারের। সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য এত কিছু করা। কিন্তু সাজানো গুজানো সব ইচ্ছ, স্বপ্ন গুলো ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ন হয়ে গেলো। চাইলো হয়তো আর জোড়া লাগানো সম্ভব না। নক্ষত্রের আম্মু আবারো বলতে লাগলো,
–“এসব করে তুই আর তোর বোনের কলিজায় তো পানি নামলো। আমাদের মান সন্মান ধুলোয় মিশিয়ে তোরাই সুখে থাক, তাইলেই হবে। ভালো থাকার জন্যই তো আজকে আমাদের এতটা নিচে নামালি। যে ছেলে মেয়ের জন্য গর্বিত ছিলাম। আজকে সে ছেলে মেয়ের জন্য আঁচলে মুখ লুকিয়ে রুম বন্দী হয়েছি। তোর জন্য এত কিছু। তুই হলি সকল সমস্যা মূল। ওই বাসাতে না গেলে এত কিছু হতো না। তোকে আমি মাফ করবো না। তোর মত বেয়াদব ছেলের জন্য ওইরকম লেইম মেন্টালিটির মানুষদের বাসায় পা রেখেছিলাম। যার জন্য এখন আমাকে মূল্য চুকাতে হচ্ছে। তুইও বেরিয়ে যা এই বাসা থেকে, তোদের মত সন্তান থাকার চেয়ে না থাকায় ভালো। আমাদের কথা না ভেবেই এতটা অপদস্থ করলি, আমাদের কথা তোর আর ভাবাও লাগবে না। তোরা তোদের সুখ খুঁজে নে, ভাল থাক।
নক্ষত্রের আম্মু কথাটা বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নক্ষত্র মুচকি হেসে শান্ত কন্ঠে বললো,

–“হুম! আমি এবার ভালো তো থাকবোই। আম্মুর চোখে পানি ঝরিয়েছে, বোনকে সেভ করতে পারিনি, কারো স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার কারণ হয়েছি। সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছি। আমারই ভালো থাকার দিন। ”
নক্ষত্র কথাটা বলে রুম ত্যাগ করলো। আর কি ই বলার থাকতে পারে। তিতিক্ষার আম্মু তিতিক্ষার কান্না থামাতে পারেনি। এজন্য ওনিও তিতিক্ষার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে। কেন কাঁদবে তিতিক্ষা? কার জন্য কাঁদবে? ওর কি ছেলের অভাব পড়বে যে ও কাঁদছে? এসব যুক্তি দাঁড় করিয়ে উনারা তিতিক্ষার উপর রেগে গেছে। তিতিক্ষা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই শুয়ে পড়ে। রাত প্রায় একটার দিকে তিতিক্ষার ঘুম ভেঙে গেল। ওর ফোনের রিংটোনের শব্দে। তিতিক্ষা দ্রুত উঠতে গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সাথে বারি খেলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে ওর ফোনটা হাতে তুলে নিলো। নক্ষত্রের কল দেখে তিতিক্ষা দেরী না করে ফোনটা রিসিভ করলো। কান্নারত কন্ঠে বলে উঠলো,
–” হ হ্যালো।”
নক্ষত্র শান্ত কন্ঠে বললো,
–“কাঁদছো কেন, মনোপ্যাথি?”

একথা শুনে তিতিক্ষা আর নিজেকে আটকাতে পারলো। শব্দ করে হেঁচকি তুলে সে কাঁদছে। নক্ষত্রও আর তিতিক্ষাকে কান্না থামাতে বলছে না। কেন বলবে? তিতিক্ষা কত সুখী, সে তো কান্না করতে পারছে। তার কষ্ট লাগার অনুভূতিটা প্রকাশ করতে পারছে। নক্ষত্র তো সেদিক থেকেও ব্যর্থ। না পারছে কাউকে কিছু বলতে, আর না পারছে ওর অনুভূতির কথা কাউকে শেয়ার করতে৷ কাকেই বা কি বলবে? সবাই তো ওর দিকেই আঙ্গুল তুলছে। এজন্য কি সুন্দর নিখুঁতভাবে নিজেকে স্বাভাবিক করে রেখেছে। কেন রেখেছে? শুধুমাত্র আপন মানুষগুলো জন্য? নাকি সে যে অনুভূতিহীন, এটা প্রকাশ করার জন্য? এই প্রশ্নের উত্তর নক্ষত্রের কাছে আপাতত নেই। তিতিক্ষা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
–“আমাদের সম্পর্কটা কি পূর্ণতা পাবে না। আমি কি আপনাকে হারিয়ে ফেলবো?”
নক্ষত্র নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে, মুচকি হেসে বললো,
–“সব সম্পর্ক পূর্ণতা লাভের আশা করা বোকামি। কিছু কিছু সম্পর্ক না চাইলেও শূন্যের খাতায় জমা পড়ে যায়।”
তিতিক্ষা এই কথার সারমর্ম বুঝতে পেরে নিঃশ্চুপ হয়ে যায়। মাথা ঘুরছে, হৃদপিন্ডটা লাফাচ্ছে। কষ্টে নিঃশ্বাস আটকে আসছে। নক্ষত্র এটা কি বললো? এটা সে বলতে পারলো? তার বুক কাঁপলো না?
ওর সম্পর্ক টা কি সত্যিই শূন্যের খাতায় থাকবে?
সব অনুভূতি গুলো কি দীর্ঘশ্বাসের ভিড়ে চাপা পড়ে যাবে? তাহলে কি এখন নক্ষত্রকে প্রিয় থেকে অপ্রিয় হিসেবে অখ্যায়িত করতে হবে? সব অনুভূতি গুলো অনুভূতির শীর্ষস্থানে পৌঁছে এখন তার এমন নিষ্ঠুর পরিণতি।
তবে এতকিছুর মধ্যে তিতিক্ষার বাবা নক্ষত্রদের উপর মারাত্নক ভাবে রেগে গেছে। নক্ষত্রের আম্মুর ব্যবহার আর তিতিক্ষার চোখের পানি উনি সহ্য করতে পারছে না। উনার কাছে নক্ষত্রের আম্মুর কাজটা মোটেও শোভনীয়ও মনে হয় নি। নক্ষত্র আর তিতিক্ষার তো দোষ ছিলো না। এসব ভেবেই উনি কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলো। উনিও এবার ওদের দেখিয়ে দিতে চান, উনার মেয়েও কোনো ফেলনা নয়। উনি নক্ষত্রের থেকে হাজার গুন ভালো ছেলে সাথে তিতিক্ষার বিয়ে দিবে। আর সেটা যত দ্রুত সম্ভব। তিতিক্ষার বাবা এটাই করবো বলে মনোস্থির করলেন।

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_26

নক্ষত্রের আম্মু কারো সাথে কথা বলে না। নিজের মতো করে থাকে। বাসাটা প্রাণহীন হয়ে উঠেছে। মিঃ আবরারও নেতিয়ে গেছে। মামনি নবিনের চলে যাওয়াতে খুব কষ্ট পেয়েছে। উনিও কাঁদছে।
এভাবেই প্রায় তিনটা দিন কেটে গেল। তবুও দু’বাসাতেই থমথমের পরিবেশ বিরাজ করছে। এই তিনদিনে কিছু তো ঠিক হলোই না, বরং দিন দিন আরো জটিল হয়ে যাচ্ছে। সাফওয়ানরা এসব জানার পর ওদের মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার সম্পর্ক আর ওই দিকে অদ্রি। সাফওয়ানরা অদ্রিকে বোনের মত ভালবাসতো। অদ্রি এমন বোকামি কিভাবে করলো, এটা ওরা বুঝতে পারছে না। এত কিছু মধ্যে, নক্ষত্র আর তিতিক্ষার এখন কি হবে? ওরাই জানে, নক্ষত্রের মনে তিতিক্ষা ঠিক কতটুকু জায়গা জুড়ে আছে। তিতিক্ষাকে পাওয়ার জন্য নক্ষত্র ঠিক কি কি করেছে, এটা শুধু ওরাই জানে। আজকে নিজের বোনের করা একটা ভুলের জন্য এই পরিণতি।
নক্ষত্রের সাথে তিতিক্ষার দুই দিনে তিনবার কথা হয়েছে। তিতিক্ষার বাবা তিতিক্ষার জন্য ছেলে দেখা শুরু করেছে। আজকে সকালে চারটা ছেলের ছবি এনেছিলো তিতিক্ষাকে দেখানোর জন্য। এছাড়া তিতিক্ষার ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষক তিতিক্ষাকে পছন্দ করে। উনি নাকি একসপ্তাহ আগে বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলো। এটা এতদিন তিতিক্ষার কাছে অজানা ছিলো। আজকে জানলো মামনির থেকে। তিতিক্ষার কিছু বলার নেই। যে যা বলছে শুনে যাচ্ছে। এক বুক কষ্ট নিয়ে কিছু বলার ইচ্ছে বা শক্তি, ওর কোনটাই নেই। তিতিক্ষা রুমে এসে নক্ষত্রকে ফোন দিলো। দুইবার দেওয়ার পর নক্ষত্র রিসিভ করলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রকে বললো,

–“আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। প্লিজ! একটা বার আসুন। প্লিজ।”
নক্ষত্র ধীর কন্ঠে তিতিক্ষাকে বললো,
–“আজকে দেখা করাটা কি জরুরী?”
–“হুম! জরুরী না হলে আপনাকে বলতাম না। আসবেন?”
–“আসছি।”
নক্ষত্রের খুব জ্বর এসেছে। শরীরটাও খুব ব্যাথা করছে। কালকে রাত থেকে ওর জ্বর। কাউকে বলেও নি। ইচ্ছে করেই সে মেডিসিনও নেয়নি। এই জ্বর ওর কাছে কিছুই না। বুকের ভেতরে তোলপাড়, সাথে মস্তিষ্কের হাজারো টেনশনের পাহাড় নিয়ে ওর প্রতিটা সেকেন্ড কাটছে। সব কষ্টগুলোকে সে দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে সমাধি দেওয়ার চেষ্টায় আছে। নক্ষত্র বেড থেকে উঠলো। তিতিক্ষার আবদারটা উপেক্ষা করার ক্ষমতা নক্ষত্রের নেই। ও বেড থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নক্ষত্রের আম্মু বেলকণি থেকে দেখেও কিছু বললো না। কেন বলবে? ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে গেলে বাবা-মায়ের কথায় গুরুত্ব দেওয়ার সময় কই তাদের? তারা যা বলবে তাই ঠিক। তাহলে তারা ভালো থাকুক তাদের ভালো নিয়ে।
তিতিক্ষার আম্মুরা ড্রয়িংরুমে বসে আছে।
তিতিক্ষাকে বের হতে দেখে মামনি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সবাইকে এভাবে তাকাতে দেখে তিতিক্ষা দাঁড়িয়ে গেলো। তিতিক্ষার আম্মু কিছু বলার আগেই তিতিক্ষার বললো,

–“পালাচ্ছি না। তোমরা আমাকে নিয়ে অযথা ভয় পেও না। আমাকে একটু বের হতে দাও। কথা দিচ্ছি, আবার ফিরে আসবো।”
তিতিক্ষা বের হয়ে গেল। কেউ আর কিছু বললো না। ওকে একটু সময় দেওয়া উচিত। মন বলে তো কিছু আছে। ওইদিকে কালকে থেকে অদ্রির শরীরটা খুব খারাপ। নবিন অদ্রিকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। ডক্টর মেডিসিন দিলো আর বেড রেস্টে থাকাতে বললো। অদ্রি শরীরের কনডিশন ভালো না। এমন ভাবে চলতে মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে। নবিন ডক্টরের থেকে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলে নিলো। এরপর ওখান থেকে বের হয়ে, মেডিসিন আর ফল নিয়ে বাসায় ফিরলো। নবিন অদ্রির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“নিজের যত্ন নাও। আল্লাহ না করুক, বেবির কিছু হলে আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বলবো না। বেবিটার জন্যই আমাদের এত লড়াই।”
অদ্রি নবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। নবিন ফল কেটে অদ্রিকে খেতে দিলো। অদ্রিকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে নবিন বকা দিলো। অদ্রি ছলছল চোখে নবিনের দিকে তাকিয়ে এক টুকরো আপেল মুখে নিলো। নবিন অদ্রিকে খেতে বলে রান্না ঘরে চলে গেলো। নবিন মুখে কিছু না বলুক ওর মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে। এটা অদ্রি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। নবিন বাইরে থেকে আসার সময় ইচ্ছে করে বাইরের খাবার আনেনি। অদ্রির এখন বাইরের খাবার খাওয়া ঠিক হবে না। এজন্য নিজেই রান্না করতে গেলো। অদ্রি উঠে নবিনের পাশে এসে দাঁড়ালো। নবিন অদ্রির দিকে তাকালো। অদ্রি আমতা আমতা করে বললো,

–“এখানে একটু থাকি। একা রুমে থাকতে ভালো লাগছে না।”
নবিন কিছু বললো না। একটা চেয়ার এনে অদ্রিকে বসতে দিলো। অদ্রি চেয়ারে বসে নবিনের কাজকর্ম দেখছে। নবিনের চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। মুখটা শুকিয়ে গেছে। নবিনের দিকে তাকালে অদ্রির বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ওর জন্যই এমন জঘন্য একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ওর জন্যই নক্ষত্র আর তিতিক্ষার সম্পর্ক ভাঙ্গতে বসেছে। এসব ভাবলে অদ্রির আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। ওর জন্য নবিন বাসা ছাড়া হলো। সব দোষ অদ্রির। ওর কারণেই সম্পর্কের ভীত গুলো ভেঙে গেল। দুই পরিবারের মাঝে ফাটল ধরলো। কেউ ভালো নেই। কারো মুখে হাসির রেশ টুকু নেই। তবুও সবাই নিজেদের স্বাভাবিক রাখার যুদ্ধে নেমেছে। কিন্তু কেউ না পারছে গিলতে, আর না পারছে উগলাতে।
তিতিক্ষা বটগাছে নিচে এসে চুপটি করে বসে আছে। একটু পর অপর সাইডে নক্ষত্রের গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি লক করে রাস্তা পার হয়ে নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে আসছে। তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখটা শুকিয়ে গেছে। পরিপাটি থাকা ছেলেটাকে আজকে অগোছালো লাগছে। তবুও তিতিক্ষার কাছে মন্দ লাগছে না। নক্ষত্র তিতিক্ষার কাছে এসে দাঁড়ালো। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে, শুকনো একটা হাসি দিলো। প্রাণহীন হাসি যাকে বলে। এই হাসিটা নক্ষত্রের ঠোঁটে বড্ড বেমানান লাগছে তিতিক্ষার কাছে। আগের সেই প্রানবন্ত মুচকি হাসিটা ছিলো তিতিক্ষার মন ভালো করার মতো। তিতিক্ষা ছলছল চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। তিতিক্ষার চোখ ফুলে আছে। কিছুক্ষণ আগেও কাঁদছিলো। এর জন্য চোখ, নাক লাল হয়ে আছে। দাঁড়িয়ে না থেকে তিতিক্ষা নক্ষত্রকে নিয়ে, ক্যাম্পাসের অপর সাইডে গেলো। পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর বসলো ওরা। দু’জনের দৃষ্টি টলটলে ওই পুকুরের পানির দিকে। নক্ষত্র ওর দৃষ্টি সামনের দিকে রেখে বললো,

–“এভাবে কেঁদো না। আমি তো এখনো মারা যায়নি, এখনই হাল ছেড়ে দিচ্ছো কেন?”
তিতিক্ষা মাথা নিচু করে কাঁদছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার চোখের পানি মুছে দিলো। তিতিক্ষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বাসার ঘটনাটা নক্ষত্রকে বললো। তিতিক্ষার বাসায় ওর বিয়ের দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। কালকে ছেলে পক্ষ ওকে দেখতে আসবে। পছন্দ হলে আকদ্ করে যাবে। এসব শুনে নক্ষত্রের মনে হলো, ওর বুকের মধ্যে কেউ আগুনের জ্বলন্ত লাভা ঢেলে দিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার চোখের আড়ালে ওর চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুবিন্দু মুছে নিলো। জীবনে এই প্রথম নক্ষত্রের নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। এত জট কিভাবে খুলবে? কিভাবেই বা সব সমাধান করবে? নক্ষত্র শান্ত কন্ঠে তিতিক্ষাকে বললো,
–“আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলে তুমি ইচ্ছেমত তোমার জীবনটা সাজাতে পারবে? ”
তিতিক্ষা বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। এই প্রথম নক্ষত্রের কথাটা শুনে তিতিক্ষার মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল। ওর মন চাচ্ছে নিজেকে শেষ করে দিতে। তিতিক্ষা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকালো। এটাও বুঝলো, তার মনোপ্যাথি কথাটা‌ শুনে খুব কষ্ট পেয়েছে। এজন্য একরাশ অভিমান নিয়ে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,
–“অভিমানে মুখ ফিরালে, পরিস্থিতিটা বুঝলে না। নিজের কথাটাই ভাবছো, আমার কষ্টটা বুঝলে না।”

তিতিক্ষা নক্ষত্রের শার্টের কলার আকড়ে ধরেছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকালো। তিতিক্ষাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে ওর প্রাণ খুলে কাঁদতে মন চাচ্ছে। তিতিক্ষা নক্ষত্রের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে। নক্ষত্র চোখ বন্ধ করে আছে। সে তিতিক্ষার চোখে পানি না পারছে সহ্য করতে, আর না পারছে কষ্ট গুলোকে কমিয়ে দিতে। তিতিক্ষা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
–“প্লিজ নাহিয়ান! আমাকে ছেড়ে যেও না। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তোমাকে হারানোর ভয়টা নিয়ে আমি বাঁচতে পারছি না। তোমার মাঝে আমি আমার অনুভূতি গুলোর স্বার্থকতা খুঁজে পেয়েছি। তুমি তোমার অনুভুতি থেকে আমাকে ছিন্ন করো না। আমি এক্কেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবো। তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না। আমি শুধু তোমাকে চাই, আমি তোমার অনুভূতির শীর্ষবিন্দু হয়ে থাকতে চাই।”
তিতিক্ষা আজকে নক্ষত্রকে তুমি করে বললো। অন্য সময় হলে নক্ষত্র কত খুশি হতো, তিতিক্ষাকে লজ্জা দিতো। কিন্তু আজকে পরিস্থিতি আর এই মুহূর্তেটাতে দুটোই বেমানান। নক্ষত্র তিতিক্ষার চোখের পানি মুছে দিলো। মাথা নাড়িয়ে তিতিক্ষাকে কাঁদতে নিষেধ করছে। নক্ষত্রের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। সব কষ্ট এসে গলাতে দলা পাকিয়ে কান্না হয়ে বের হতে চাচ্ছে। নক্ষত্র আলতো করে তিতিক্ষার কপালে একটা আদর দিয়ে, ধরা গলায় বললো,

–“কঠিন পরিস্থিতিতে অসীম ধৈর্য্য নিয়ে আমাদের সবটা সামলাতে হয়। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। আমি আছি তো।”
তিতিক্ষার হঠাৎ করে খেয়াল হলো, নক্ষত্রের শরীর খুব গরম। সে এতক্ষণ অন্য তালে ছিলো। এজন্য খেয়াল করেনি। নক্ষত্রের জ্বর এসেছে। তিতিক্ষা তারাতাড়ি করে ওর চোখ মুছে নিলো। নক্ষত্রের শরীরে প্রচন্ড জ্বর। তবুও সে চুপ করে বসে আছে।
তিতিক্ষা নক্ষত্রকে হাত ধরে টেনে উঠালো। গাড়ির কাছে গিয়ে, গাড়িতে উঠে তিতিক্ষা নক্ষত্রকে সামনে যেতে বললো। তিতিক্ষার কথামতো নক্ষত্র তাই করলো। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে জিজ্ঞেস করলো, ওর কিছু লাগবে কিনা। কিন্তু তিতিক্ষা কিছু বললো না। হঠাৎ ও গাড়ি থামাতে বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। এরপর নক্ষত্রকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, ওকে গাড়িতে রেখেই গাড়ি লক করে চলে গেল। নক্ষত্র পেছন থেকে ডাকলো, তবুও তিতিক্ষা ওর কথা শুনলো না।

নক্ষত্র গাড়ির স্টেয়ারিং-এ মাথা ঠেকালো। চোখটা প্রচন্ড জ্বলছে। নক্ষত্র যতটুকু জানে, নক্ষত্রের আম্মু ওদের আর মেনে নিবে না। উনার সাথে কথা বলে যতটুকু বুঝলো, উনি এই সম্পর্কটাকে আর এগোতে দিবে না। উনার মনে এত এত অভিযোগ এসে জমা হয়েছে৷ নক্ষত্র এসব আর ভাবতে পারছে না, মাথা ঘুরছে, এজন্য চোখ বন্ধ করে নিলো। বুকের বা পাশের শার্টটুকু ভিজে আছে তিতিক্ষার অশ্রুজলে। নক্ষত্র সেখানে একবার হাত বুলিয়ে নিলো। ওর চোখ দিয়েও বেশ কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। নক্ষত্র সে অশ্রুটুকু দ্রুত মুছে নিলো। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। তিতিক্ষা এসে গাড়ির দরজা খুলে বসলো। নক্ষত্রকে গাড়িটা নিরিবিলি স্থানে নিয়ে যেতে বললো। নক্ষত্র একটা নির্জন স্থানে গাড়িটা সাইড করে রাখলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের মুখের সামনে চিকেন স্যান্ডুইচ ধরলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকালো। তিতিক্ষা চোখের ইশারায় খেতে বললো। নক্ষত্র সিটে মাথা ঠেকিয়ে তিতিক্ষার হাতে খাচ্ছে, নক্ষত্র খেতে খেতে তিতিক্ষার হাতে স্যান্ডুইচ টা ওর দিকে ধরলো। তিতিক্ষা মুখে নেওয়ার সাথে সাথে ওর চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তিতিক্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ মুছে নিলো। নক্ষত্র আর খেতে না চাইলে, তিতিক্ষা জোর করে খাইয়ে মেডিসিন খাইয়ে দিলো। গাড়ির সামনের সিট থেকে নেমে দু’জনেই পেছনের সিটে আসলো। নক্ষত্র আজকে কোনো কথা বলছে না, শুধু তিতিক্ষার কাজ গুলো দেখছে। তিতিক্ষা নক্ষত্রকে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তে বললো। নক্ষত্র শুয়ে পড়লো। তিতিক্ষা মেডিসিনের সাথে একটা মুভও এনে ছিলো। সে মুভটাই নক্ষত্রের কপালে লাগিয়ে দিয়ে, আলতো ভাবে টিপে দিচ্ছে। নক্ষত্র কান্নামাখা গলায় বললো,

–“আমাকে দূর্বল করে দিও না। আমার নিরবতার আত্ননার্দ আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকতে দাও। তুমি এমন করলে আমার লড়াইটা আরো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে।”
তিতিক্ষা নক্ষত্র চুল টেনে দিতে দিতে বললো,
–“আমি তোমাকে দূর্বল করছি না। তোমার কষ্টের ভাগ নিতে চাচ্ছি। যার মাঝে আমার ভালো থাকা লুকিয়ে আছে, তাকে সামলে রাখছি। যাতে সে পরবর্তী পদক্ষেপটা সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।”
নক্ষত্রের খুব ঘুম পাচ্ছে। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া নেই। ঘুমায়নি ঠিকমত, শরীরে জ্বর। নক্ষত্রের দু’চোখে নিদ্রা এসে ভীড় জমিয়েছে। তিতিক্ষা গাড়ির জানালা লক করে দিলো। গায়ের ওড়না খুলে নক্ষত্রের শরীরের উপর বিছিয়ে দিলো। নক্ষত্রের শীত লাগছে, ওর শরীরের পশম গুলো কাটা কাটা হয়ে উঠছে। নক্ষত্র ওর সমস্যার কথা একটাও না বললেও, তিতিক্ষা সবটা নিজে থেকে বুঝে নিচ্ছে। এটাও হয়তো নক্ষত্রের প্রতি ওর সুক্ষ ভালবাসার জন্য সম্ভব হচ্ছে। নক্ষত্র কি সুন্দর ভাবে ঘুমাচ্ছে। তিতিক্ষা আলতো ভাবে নক্ষত্র চুল টেনে দিচ্ছে।
মামনি আর তিতিক্ষার আব্বু-আম্মু, বসে আছে। উনারা চাই তিতিক্ষার বিয়ে দিয়ে দিতে। নক্ষত্র তিতিক্ষার আব্বু-আম্মু, মামনিকে অসংখ্যবার ফোন দিয়েছিলো। উনারা কেউ রিসিভ করেনি। নক্ষত্রের সাথে উনারা কিছুতেই কথা বলবে না। তিতিক্ষা চারটা ছেলের মধ্যে একটা ছেলের ছবিও দেখেনি। তাই উনারা বসে ঠিক করছে, কোন ছেলেটা নক্ষত্রের থেকে বেস্ট হবে। তিতিক্ষার মনে উপর দিযে কি ঝড় যাচ্ছে, উনারা বুঝতে পারছে। তবুও জেদের বশে বাবা-মায়েরা সর্বনাশা পথটাকেই বেছে নিচ্ছে। কারণ তাঁরা নক্ষত্রের আম্মুকে দেখিয়ে দিবে। এনারা উনার কাছে কিছুতেও ছোট হবে না। আর এই জেদটাই সবার মাঝে চেপে বসেছে। তবে তাদের জেদের ফলাফল হবে, নক্ষত্র আর তিতিক্ষার অনুভূতিগুলোর দাফন করার মাধ্যমে।

মেডিসিন নেওয়ার পর নক্ষত্রের কপাল ঘামছে। তিতিক্ষা ওর ওড়নাটা সরিয়ে নিলো। সর্তকতার সাথে নক্ষত্রের শার্টের চারটা বোতাম খুলে দিলো। আস্তে করে ওর ওড়না দিয়ে ঘাম মুছে দিলো। নাহলে এই ঘাম বসে গেলে ঠান্ডা লেগে যাবে। এ্যাশ কালার শার্টের নিচে, সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপাল ঢেকে যাচ্ছে। পারিপাটি থাকা ছেলেটা, আজকে নিজেকে সজ্জিত করেছে অগোছালো রুপে। যে তিতিক্ষা নক্ষত্রের আশে-পাশে সহজে যেতে চাইতো না৷ নক্ষত্রের উপস্থিতিতে ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতো। আজকে সেই তিতিক্ষা নক্ষত্রের শার্ট খুলে ঘাম মুছে দিচ্ছে। যদিও বা পরিস্থিতি ওকে বাধ্য করেছে। নক্ষত্র এখনো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। তিতিক্ষা ছলছল চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
–“আমাদের দু’জনেরই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন কি করবো আমরা? কিভাবে এত এত সমস্যার জট খুলবো? বড়দের এই জেদটাই আমাদের সম্পর্কটার বিচ্ছেদ আনবে না তো?

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_27

নক্ষত্রের ঘুম ভেঙে যায়। টিপটিপ করে চোখ খুলে দেখে তিতিক্ষা বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র বুঝতে পারে, সে এখনো তিতিক্ষার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। নক্ষত্র দ্রুত উঠে বসলো৷ তিতিক্ষা নক্ষত্রকে দেখে মুচকি হাসলো। ঘুম থেকে উঠার ফলে নক্ষত্রের চোখ ফুলে আছে। তবে ওকে দেখতে এখন একটু ফ্রেশ লাগছে। পানির বোতলটা নিয়ে নক্ষত্র ওর চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো। শান্ত দৃষ্টিতে তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আমাকে ডাকোনি কেন? এতক্ষণ এভাবে বসে ছিলে, এখন নিশ্চয়ই পায়ে ব্যাথা করছে, তাই না?”
তিতিক্ষা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। তবে ওর পায়ে খুব ঝি ঝি লাগছে। এজন্য তিতিক্ষা ওভাবেই বসে থাকলো। নক্ষত্র নিচু হয়ে তিতিক্ষার পায়ে হাত দিতে গেলো। তিতিক্ষার সাথে সাথে নক্ষত্রের হাতটা ধরে নিলো। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝালো পায়ে হাত না দিতে। নক্ষত্র আর কিছু বললো না। কি বা বলবে, ওর জন্যই তো এখন তিতিক্ষা কষ্ট পাচ্ছে। আচ্ছা! ঘুরে ফিরে সবার কষ্টের কারণ নক্ষত্রই হচ্ছে কেন? নক্ষত্রকে চুপ করে থাকতে দেখে তিতিক্ষা বললো,

–“আমার খুব খুদা লাগছে। কেউ যদি আমাকে খেতে নিয়ে যেতো, তাহলে আমি কিছু খাওয়ার সুযোগ পেতাম। এতক্ষন তো কেউ আমার কোলে মাথা রেখে খুব আরামে ঘুমালো। আমার কোলে ঘুমানোর জন্য এখন আমার ট্রিট চাই।”
নক্ষত্র তিতিক্ষার কথা শুনে মুচকি হাসলো। আজকে নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নতুন রুপে দেখছে। নক্ষত্রের কাছে মোটেও মন্দ লাগছে না। কেন জানি তিতিক্ষার এমন রুপ নক্ষত্রকে এনার্জির যোগান দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, সব ঠিক করার জন্য একবার চেষ্টা করে দেখতে। এই পাগলিটাকে যে সে কিছুতেই হারাতে পারবে না। তিতিক্ষার পায়ে ঝি ঝি ছুটলে, দু’জনে সামনের সিটে গিয়ে বসলো। নক্ষত্র গাড়ি স্টার্ট দিলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের কপালে হাত দিয়ে আর একবার চেক দেখলো। এখন আর জ্বর নেই। দুপুরে আর একবার মেডিসিন খাইয়ে দিলে ইনশাআল্লাহ আর জ্বর আসবে না। নক্ষত্র নিজে থেকে মেডিসিন নিবে না। এজন্য তিতিক্ষা চালাকি করে ওর খাওয়ার কথা বললো। যাতে সুযোগ বুঝে নক্ষত্রকেও মেডিসিনটা খাইয়ে দিতে পারে। তিতিক্ষা জানালার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“কারো শার্টের বোতাম খোলা৷ অনুগ্রহপূর্বক সে যেন শার্টের বোতাম আটকে নেয়।”

নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকালো। তিতিক্ষা যে ওর
উপরে অভিমান করে এমন ভাবে কথা বলছে, নক্ষত্র সেটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে। ঘুম থেকে উঠার পর পরই নক্ষত্র খেয়াল করেছে ওর শার্টের বোতাম খোলা। তবুও ইচ্ছা করে লাগায় নি। নক্ষত্র সামনের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
–“যে আমার শার্টের বোতাম খুলেছে। সে যেন লাগিয়ে দেয়। সে না লাগালে এভাবেই থাকুক। আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না।”
তিতিক্ষা আর কথা না বাড়িয়ে শার্টের বোতাম আটকে দিলো। নক্ষত্রের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা গেল। তিতিক্ষা বাইরে তাকালো।
নক্ষত্র তিতিক্ষার হাতের আঙ্গুলে আঙুল রেখে শান্ত কন্ঠে বললো,
–“আমাদের দু’জনের পথ যতই আলাদা হোক। আমাদের আত্মার মিল অদৃশ্য ভাবে অনেক আগেই হয়ে গেছে। আমি আমার বউয়ের দায়িত্ব নিতে সর্বদা প্রস্তুত। শুধু তোমার আসার অপেক্ষা।”

তিতিক্ষার ছলছলে চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্র মুচকি হেসে তিতিক্ষার হাতটা শক্ত করে ধরলো। একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দু’জনে খেয়ে নিলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রকে মেডিসিন খাইয়ে দিলো। এরপর ওখানে থেকে বের হয়ে নক্ষত্র তিতিক্ষার বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। তিতিক্ষা বাসার গেটে ঢুকার পর নক্ষত্র চলে গেল। নক্ষত্রের কথা শুনে তিতিক্ষার এখন ভালো লাগছে৷ মনে একটু জোর পাচ্ছে। সে জানে, যত যাই হোক নক্ষত্র ওর হাত ছাড়বে না, যতোক্ষণ না তিতিক্ষা নক্ষত্রকে নিজে থেকে ফিরিয়ে দেয়। আর তিতিক্ষার প্রাণ থাকা অবধি সে কিছুতেই নক্ষত্রের হাত ছাড়বে না। এটা ওর নিজের কাছে নিজের ওয়াদা।
তিতিক্ষা বাসায় ঢুকতেই, ওর আম্মু ওর গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। তিতিক্ষা গালে হাত দিয়ে ওর আম্মুর দিকে তাকাতেই‌ উনি পরপর আরো তিনটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। উনি উনার সর্বশক্তি দিয়ে তিতিক্ষাকে থাপ্পড়টা মেরেছে। যার কারনে তিতিক্ষা ছিটকে গিয়ে সোফার কোণাতে ধাক্কা লেগে দেওয়ালে বারি খেলো। আচানক ভাবে প্রচন্ড জোরে আঘাত পাওয়ার কারণে তিতিক্ষা ‘ও মা গো’ বলে সাথে সাথে সেন্স হারিয়ে ফেললো। সোফার কাঠের হাতলে লেগে কপাল কেটে টপটপ করে রক্ত ঝরছে। বিভা, আহান, মামনি দৌড়ে গেল তিতিক্ষার কাছে। চোখে মুখে পানির ছিটা দেওয়া পর ধীরে ধীরে তিতিক্ষার সেন্স ফিরলো। তিতিক্ষা ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছে। নড়াচড়া শক্তিটুকুও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। বিভা তিতিক্ষাকে উঠে বসালো। বিভা তিতিক্ষার কপাল চেপে ধরে কাঁদছে। আহানও তিতিক্ষার রক্ত দেখে কাঁদছে। তখনই দরজায় দাঁড়িয়ে নক্ষত্র ধরা গলায় বলে উঠলো,

–“তি তিতিক্ষা।”
তিতিক্ষা ওর ফোনটা নক্ষত্রের গাড়িতে ফেলে এসেছিলো। নক্ষত্র ফোনটা দিতে এসে এই ঘটনার সম্মুখীন হলো। নক্ষত্র আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিতিক্ষার কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার কাছে আসতে গেলে তিতিক্ষার আম্মু নক্ষত্রকে সরিয়ে দিলো। মামনি তো রাগে গজগজ করছে। বিভা তিতিক্ষার কপালে ব্যান্ডেজ করতে গেলে মামনি এসে বিভার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। নক্ষত্র অবাক হয়ে দেখছে, আর বোঝার চেষ্টা করছে এসব কি হচ্ছে! এই মানুষগুলোর এমন রুপ নক্ষত্র মানতে পারছে না। তিতিক্ষাকে এভাবে আঘাত করতেও এদের বুক কাঁপলো না! নক্ষত্রের নিজেকে জ্ঞান শূন্য মানব বলে মনে হচ্ছে। তিতিক্ষার রক্ত দেখে ওর মস্তিষ্কে কাজ করছে না। নক্ষত্র আবার তিতিক্ষার কাছে আসতে গেলে মামনি পথ আটকে নক্ষত্রকে বললো,
–“নবিন তোমার বোনকে প্রেগনেন্ট করেছে। এজন্য তুমি এখন তিতিক্ষার পেছনে উঠে পড়ে লেগেছো? প্রতিশোধ নেওয়া জন্য এসব ছলাকলা শুরু করেছো? এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার পরও ওকে নিয়ে গাড়িতে ঘুরে এখানে ওখানে যাচ্ছে। ভেবেছো, তোমার মতলব আমরা বুঝবো না। ছিঃ! তোমার কাছে আমরা এসব আশা করিনি। তুমি এসব নোংরা চিন্তা নিয়ে বোনের প্রতিশোধের খেলায় মেতেছো।”
মামনির কথা শুনে নক্ষত্রের মাথাতে যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। যার গায়ে খারাপ স্পর্শ লাগতে দিবে না বলে সবার অজান্তে বিয়ে করেছে। আজকে কিনা ওর নামে এমন নোংরা অভিযোগ। নক্ষত্রের মনে হচ্ছে এখনই ধপ করে মাটিতে পড়ে যাবে। তিতিক্ষার আম্মু আরো তিক্ততা নিয়ে বললো,

–“আমি ভেবেছিলাম, তোমরা ভদ্র ঘরের ভদ্র মানুষ। কিন্তু এখন দেখছি তোমরা এক একজন একেক রুপের মানুষ । গিরগিটিরও মনে হয় এত রুপ ধরতে পারে না। ভালো করে বলে দিচ্ছি, তুমি তিতিক্ষার আশে পাশে আর আসবে না। তোমাকে জামাই হিসেবে আমি আর কখনই মেনে নিবো না। তুমি তোমার পথ বেছে নাও। আমার মেয়েকে মুক্তি দাও। লজ্জা থাকলে এই বাসাতে আর পা দিবে না। ”
নক্ষত্র মাথা নিচু করে আছে। নাহিয়ান আবরার তার ভালবাসার মানুষটার জন্য আজকে মাথা নিচু করে আছে। যে ছেলে সামান্য কটু কথা শুনলে দফারফা করে দিতো। আজকে সে ছেলে চুপ করে সব সহ্য করছে, যাতে ও চলে যাওয়ার পর উনারা তিতিক্ষাকে আর না মারে। খারাপ ভাবে ওর মনোপ্যাথির রক্ত না ঝড়ায়। নক্ষত্রের চোখ লাল হয়ে আছে। এই প্রথম নক্ষত্র কারো কাছে এভাবে অপমানিত হচ্ছে। সে আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারছে না। নক্ষত্র ঢোক গিলে, তিতিক্ষার আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আমাদের দোষটা কোথায়, আমাকে একটু বলবেন? আমরা কি করেছি? আমাদেরকে কেন শাস্তি পেতে হচ্ছে?”
মামনি দাঁতে দাঁত চেপে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে
বললো,

–“সেটা তোমার আম্মুকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো। আমরা আর কথা বাড়াতে চাচ্ছি না। তোমাকে যতটুকু বলা হলো, তুমি ততটুকু করবা। এবার তুমি এখান থেকে যাও।”
নক্ষত্র একবার তিতিক্ষার দিকে তাকালো। কপালে রক্তের স্রোত আর কান্না ভেজা চোখে তিতিক্ষা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তিতিক্ষার এমন অবস্থা দেখে নক্ষত্রের বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। নক্ষত্রের দৃষ্টির বলে দিচ্ছে, সে ব্যর্থ। নক্ষত্র আর দাঁড়ালো না। এক প্রকার দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। তিতিক্ষা অসহায় দৃষ্টিতে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্রকে চলে যেতে দেখে তিতিক্ষা উঠে দাঁড়ালো নক্ষত্রকে আটকানোর জন্য। তিতিক্ষার আম্মু তিতিক্ষার চুলের মুঠি ধরলো। মামনি ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো। তিতিক্ষার আম্মু ওর গাল চেপে ধরে বললো,

–“ওর বোনের মত তুইও পেট বাধাবি? এজন্য ওর প্রতি তোর এত ভালবাসা উতলে পড়ছে? আমাদের মান সন্মান খাওয়ার জন্য তুই উঠে পড়ে লেগেছিস। ওই বেয়াদব ছেলের পেছনে তোর ঘুরতে হবে কেন? তোকে কিছু বলা হয় না এজন্য তুই সাপের পাঁচ পা দেখেছিস। ওর বোনের মত তুইও কলঙ্কিত হবি? কলঙ্কিত হয়ে ঘুরে বেড়ানোর শখ জেগেছে তোর?
বেয়াদব মেয়ে তোকে মেরে পুঁতে দিবো। তাও তোকে ওই বাসার বউ হতে দিবো না। ওর বেয়াদবটা জন্য তুইও থার্ড ক্লাস হয়ে গেছিস।”
তিতিক্ষা ওর আম্মুর ভাষা শুনে অবাক হলো। এই মানুষ গুলো এতটা পরিবর্তন হলো কিভাবে? আজকে এদের এতটা অচেনা লাগছে কেন?
তিতিক্ষা ওর গাল থেকে, ওর আম্মুর হাত সরিয়ে দিলো। তিতিক্ষাও কাঁদতে কাঁদতে বললো,
–“নক্ষত্রের আম্মু ঠিকই বলেছে, তোমরা লেইম মেন্টালিটির মানুষ। জেদের বশে তোমরা অমানুষে পরিণত হয়েছো। ওই ছেলেটা তোমাদের জন্য কত কিছু করেছে। আর আজকে তাকে এত কথা শুনালে, এত অপমান করলে। তোমরা কি মানুষ? ও ভদ্র ঘরের ছেলে, ওর শরীরে ভদ্র পরিবারের রক্ত আছে। এজন্য টু শব্দ করেনি। মুখ বুঝে সব সহ্য করে চলে গেল। তোমরাই হলে অভদ্র, অমানুষ, থার্ড ক্লাস। এজন্য তোমাদের ব্যবহার এতো নিচু মনের। আর পেট বাঁধানোর কথা বললে না? হ্যাঁ বাধাবো! আমিও দেখি তোমরা কি করো। কিসের এত অহংকার, কিসের জেদ তোমাদের? তোমাদের অহংকারের পতন দরকার। আমিও এবার এর শেষটা দেখতে চাই। দেখি তোমরা আর কত নিচে নামতে পারো।”
মামনি তিতিক্ষাকে থাপ্পড় মারলো। তিতিক্ষার দাঁতের সাথে লেগে ওর ঠোঁট কেটে গেলো। তিতিক্ষা মার খেয়েও দমলো না। মামনি ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

–“দরকার হলে তোকে বেশ্যা গিরি করতে পাঠাবো। তাও ওই ছেলের কাছে যেতে দিবো না। দেখি তুই কি করিস। আমরাও দেখবো তোর এত জেদ কতক্ষণ থাকে। কত ভালবাসা জমিয়েছিস ওই রাস্কেল বেয়াদবটার জন্য। ”
তিতিক্ষা আর সহ্য করতে পারছে না। হিংস্র বাঘিনীর মত সেইও এবার গর্জে উঠে, মামনির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তোমার প্রয়োজন হলে তুমি বেশ্যাগিরি করতে যাও। আমার বেশ্যাগিরি করার প্রয়োজন পড়বে না। তোমার ছেলের মত বিয়ের আগে নাহিয়ান কোনো মেয়ের পেট বাঁধায়নি । তাহলে তোমার বিবেকে বাঁধছে না তাকে নিয়ে এসব বলতে। আমাকে এসব নোংরা কথা বলতে তোমার বুক কাঁপছে না? তোমরা না আমার মা? নিজের ছেলে দোষ করেছে। আর আঙ্গুল তুলছো অন্য ছেলের দিকে। আমি ধিক্কার জানাই তোমাদের বিবেককে। ধিক্কার জানাই তোমাদের নোংরা মানসিকতায়।”

তিতিক্ষার আম্মু আর মামনির এখন ইচ্ছে হচ্ছে তিতিক্ষাকে জীবন্ত দাফন করতে। এই মেয়ের বড্ড তেজ বেড়েছে। মামনি বিভা আর আহানকে রুমে দরজা আটকে রেখেছে। মামনির মন চাচ্ছে এই মেয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। তিতিক্ষা ওর চোখের পানিতে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। প্রচন্ড ব্যাথায় মাথা ঝিমঝিম করছে। তিতিক্ষা ওর চোখ মুছে ওর আম্মু আর মামনির দিকে কড়া ভাবে বললে তাকিয়ে বললো,
–“নক্ষত্রকে বেয়াদব বললে, কেন বললে? আজকে তোমার মেয়ের সাথে ঘুরতে দেখেছো, তাই? তাহলে একটা স্পষ্ট কথা শুনে নাও। সে যদি আমার সাথে সঙ্গমেও লিপ্ত হয়, তাহলে সেটাও বৈধ ভাবে গণ্য করা হবে। তার প্রতিটা স্পর্শ আমার জন্য বৈধ। কারণ আমরা দু’জন বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ। আমাদের বিয়ে অনেক আগে হয়ে গেছে। তাই খবরদার! ওকে নিয়ে তোমরা নোংরা কথা উচ্চারণ করবে না। মা হয়ে তোমরা যদি মেয়েকে নোংরা কথা বলতো পারে, তাহলে আমিও মেয়ে হয়ে আর তোমাদের ছেড়ে কথা বলবো না। আমিও ভুলে যাবো তোমরা আমার মা। আমি বিবাহিত, তোমরা শুনতে পেয়েছো? ওই রাস্কেলটাই আমার স্বামী।”

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২২+২৩+২৪

তিতিক্ষার কথা শুনে তিতিক্ষার আম্মু আর মামনির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ওদের বিয়ে হয়ে গেছে? কথাটা যেন উনাদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতে লাগলো। তিতিক্ষার আম্মু সোফাতে বসে পড়লো। মামনি মেঝে বসে আহাজারিতে ভেঙ্গে পড়লো। আজকে তিতিক্ষার এমন ধারালো কথা শুনে ওনারাও খুব অবাক হয়েছে। উনারা তিতিক্ষাকে আর কিছু বলার খুঁজে পেলো না।
তিতিক্ষার ওর ফোনটা নিয়ে দেওয়াল ধরে ধরে ওর রুমে গেল। দরজা আটকে দিয়ে সেখানেই বসে পড়লো।্যআর কত কাঁদলে সব ঠিক হবে? আর কত কষ্ট পাওয়া বাকি আছে? নক্ষত্র চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেছে। এটা দেখে তিতিক্ষার পাগল হয়ে গেছে। নক্ষত্রের চোখে পানি তিতিক্ষা সহ্য করতে পারেনি। আজকে তিতিক্ষার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে৷ একটা মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে, তার কাছে দুইটা অপশন খোলা থাকে। প্রথমটা হলো, তাকে লাশ হতে হবে। সেটা জীবন্ত অথবা মৃত। দ্বিতীয় অপশন, রুখে দাঁড়াতে হবে৷ নিজের আত্মরক্ষার স্বার্থে অপর ব্যাক্তিকে প্রতিঘাত করতে হবে। তিতিক্ষা দ্বিতীয় অপশন বেছে নিয়েছে। এদের অত্যাচার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এদের জেদের বশে ভাল-মন্দ বোঝার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এজন্যই আজকে তিতিক্ষা বাঘিনীর রুপ ধারণ করেছে। এছাড়া ওর কাছে আর কোন পথ খোলা নেই। ভালবাসার মানুষটাকে পাশে পাওয়ার জন্য ভদ্র, শান্ত-শিষ্ট মেয়েটা রুখে দাঁড়াতে শিখে গেছে। যত যাই হয়ে যাক। তিতিক্ষা নক্ষত্রকে হারাতে দিবে না। এজন্য যা করা দরকার, ও করবে।

তিতিক্ষার কান্না থামছে না। নক্ষত্রের চিন্তা ওর মাথায় ঘুর ঘুর করছে। নক্ষত্র ঠিক আছে তো? ওর কিছু করে বসবে না তো? নক্ষত্র আজকে খুব কষ্ট পেয়েছে। এটা ভেবেই তিতিক্ষার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। তিতিক্ষা নক্ষত্রকে ফোন দিলো। কল যাচ্ছে না বার বার সুইচ অফ বলছে। তিতিক্ষা নক্ষত্রের সাথে কথা বলতে না পেরে আবার কান্না ভেঙে পড়লো।
সন্ধ্যার দিকে তিতিক্ষার আব্বু বাসায় আসলো। মামনির থেকে এসব কাহিনী শুনে উনি আরো রেগে গেছে। তিতিক্ষার রুমে গিয়ে ওদের বিয়ের প্রমান দেখাতে বললো। তিতিক্ষার কাছে কোনো প্রমান নেই, তাই দেখাতেও পারলো না। তিতিক্ষাল আব্বু-আম্মু, তিতিক্ষার কথা বিশ্বাস করলো না। মিথ্যা বলার জন্য তিতিক্ষাকে আরেক দফা মারলো। এমন বেয়াদব মেয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। তিতিক্ষা মার খেয়ে রুমের মেঝেতেই পড়ে রইলো। তিতিক্ষার আব্বু তিতিক্ষাকে রুমে আটকে রেখে ওর ফোনটা কেড়ে নিয়ে চলে গেল, যাতে তিতিক্ষা কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারে। ওই বেয়াদব ছেলেটা তিতিক্ষার মাথাটা ভালো মতোই খেয়েছে। তাই তিতিক্ষার আব্বু আর দেরী না করে, কালকেই তিতিক্ষার বিয়ে আয়োজন করতে লাগলো।

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২৮+২৯+৩০