অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২৮+২৯+৩০

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২৮+২৯+৩০
written by Nurzahan Akter Allo

আজকে তিতিক্ষার আকদ হবে। এজন্য বাসায় তোড়জোড় চলছে। কালকে তিতিক্ষা মার খেয়ে এখনো মেঝেতেই শুয়ে আছে। তিতিক্ষার একটাই চাওয়া, সেটা হলো মৃত্যু। আল্লাহকে বার বার ডাকছে, যেন ওকে মৃত্যু দান করে। এই দহন আর সহ্য করতে পারছে না। তিতিক্ষার আব্বু বাসায় নেই। ওর আম্মু, বিভা আর মামনি রান্না ঘরে। আহান চুপিচুপি এসে অতি কষ্টে তিতিক্ষার রুমের লক খুলে রুমে প্রবেশ করলো। তিতিক্ষাকে দেখে আহান কেঁদে দিলো। তার তিতু আপুর এই অবস্থা সে মানতে পারছে না। আহান তিতিক্ষাকে দ্রুত উঠতে বললো। তিতিক্ষা নিচে গিয়ে দেখলো নবিন দাঁড়িয়ে আছে। নবিন তিতিক্ষাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠে বসলো। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা ওদের জন্য ভালো হবে না।
কালকে এতকিছু হওয়ার পর আহান চুপিচুপি নবিনকে ফোন করেছিলো। কাঁদতে কাঁদতে নবিনকে সব ঘটনা জানিয়েছে। নবিনই আহানকে দরজা খুলে দেওয়ার বুদ্ধিটা দিয়েছে। তবে আহানকে বার বার বলে দিয়েছে, যা করবে সাবধানে করতে। যাতে কেউ জানতে না পারে। তিতিক্ষা চলে যাওয়ার পর আহান চোখ মুছে নিলো। সাবধানে রুমের লক আটকে দিয়ে মামনিকে বলে ব্যাট নিয়ে খেলতে চলে গেল। আহান যে তিতিক্ষাকে যেতে সাহায্য করেছে; এটা যাতে কেউ বুঝতে না পারে, তাই আহান আগেই খেলার নাম করে বের হয়ে গেল।

নবিন বোনের এই অবস্থা দেখে তিতিক্ষার হাত ধরে কেঁদে দিলো। তিতিক্ষাও খুব করে কাঁদছে। দু’ভাই বোন কেউই কথা বলতে পারছে না। নবিন তিতিক্ষার মাথাটা ওর বুকের রেখে বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তিতিক্ষা থরথর করে কাঁপছে। কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। কোনরকম কাঁন্না থামিয়ে তিতিক্ষা হেচকি তুলে কেঁদে বললো,
–“ভাইয়া তোমার পায়ে পড়ি। আমাকে নক্ষত্রের বাসা অবধি পৌঁছে দাও। আমাকে দয়া করো ভাইয়া। ভাইয়া! ভাইয়া আমি আর জীবনেও তোমার কাছে কিছু চাইবো না। আমার প্রতি একটু দয়া করো ভাইয়া।”
বোনের এমন আকুতি শুনে নবিনের কলিজা কেঁপে উঠছে। নবিন তিতিক্ষার চোখ মুছে বললো,
–“সোনা বোন আমার! তুই আমার কাছে থাক। আমার কাছে থাকলে তোকে কেউ খুঁজে পাবে না। নক্ষত্রের কাছে গেলে তোকে খুঁজতে সবাই ওখানেই যাবে। লক্ষী বোন আমার আমার কথাটা শুন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তিতিক্ষা শুনলো না। সে নক্ষত্রের কাছেই যাবে। তিতিক্ষা নক্ষত্রের বাসায় একবার এসেছে। এজন্য ভালোভাবে কিছুই চিনে না। তিতিক্ষার আবদারে নবিন রাজি হলো। নবিন তিতিক্ষাকে পানি খাইয়ে একটু শান্ত করে নক্ষত্রের বাসার গেট অবধি পৌঁছে দিলো। তিতিক্ষা নবিনের হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানালো। এরপর দৌড়ে চলে গেল নক্ষত্রের বাসার দিকে। দারোয়ান তিতিক্ষাকে ভালো করেই চেনে, তাই আটকালো না। বিনা বাক্যে গেট খুলে দিলো। তিতিক্ষা বাসার ভেতর দৌড়ে ঢুকে গেলো। ঢুকতে গিয়ে দরজার সাথে খুব জোরে ধাক্কা খেলো। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে যাওয়ার জন্যই ধাক্কাটা খেয়েছে। নক্ষত্রের আম্মু তখন পানি খাচ্ছিলো। পাগলের মত কাউকে ছুটে আসতে দেখে, সেদিকে তাকালো।
তিতিক্ষা পাগলের মত নক্ষত্রকে ডাকছে। তিতিক্ষা নক্ষত্রকে ডাকতে ডাকতে ওখানেই বসে পড়লে। আর আত্ননার্দ করে বললো,
–“নাহিয়ান ! নাহিয়ান ! নাহিয়ান আমার ডাক শুনতে পাচ্ছো? আমার আত্মনার্দ কি তোমার কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। নাহিয়ান কোথায় তুমি? আমার ডাকে সাড়া দাও। প্লিজ! নাহিয়ান তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আমার সামনে এসো। আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখো না। আল্লাহর দোহাই লাগে, আমার ডাকে সাড়া দাও। প্লিজ এসো! আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। নাহিয়ান! প্লিজ আমার ডাকে সাড়া দাও।”

এত ডাকার পরেও নক্ষত্র ওর ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। তিতিক্ষার মনে ভয় ঢুকে গেলো, ‘তাহলে কি নক্ষত্রও ওকে ফিরিয়ে দিবো?’ সে কি তবে নক্ষত্রকে চিরতরে
হারিয়ে ফেললো? এখানেই কি তবে ওদের একসাথে পথচলার সমাপ্ত ঘটবে?
সেদিন নক্ষত্র তিতিক্ষার বাসায় থেকে ফেরার পথে অশ্রুসিদ্ধ ঝাঁপসা চোখে ড্রাইভ করতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছে। মাথা, পা-হাতে ইনজুরি হয়েছে। সে এখনো হসপিটালে আছে। সাফওয়ান আর নক্ষত্রের আম্মু কেবল ফিরেছে হসপিটাল থেকে। নক্ষত্রের এক্সিডেন্টের কথা শুনে নক্ষত্রের আম্মু ছুটে গিয়েছিলো। যতই হোক মা তো। সাফওয়ান এসেছে নক্ষত্রের ড্রেস নেওয়ার জন্য। ড্রয়িংরুম থেকে কারো চিৎকার শুনে সাফওয়ান দৌড়ে আসে।
তিতিক্ষাকে দেখে সাফওয়ান খুব অবাক হলো। তবে
তিতিক্ষার কান্না করা দেখে সাফওয়ানের বুঝতে বাকি রইলো না যে মারাত্মক কিছু ঘটেছে। সাফওয়ান আর দেরী না করে রুহানকে ফোন দিয়ে নক্ষত্রকে ফোনটা দিতে বললো। তিতিক্ষার কথা নক্ষত্রকে সবটা বললো। ফোনেও নক্ষত্র শুনতে পাচ্ছে, তিতিক্ষা ভাঙা গলায় ওর নাম ধরে ডাকছে। সাফওয়ানের কথা আর তিতিক্ষার আত্মনার্দ শুনে, নক্ষত্রকে আর এক মুহূর্তও হসপিটালে কেউ ধরে রাখতে পারলো না। রুহান আর আফান নক্ষত্রের সাথে গেল। আর মিঃ আবরার ফর্মালিটিস পূরণ করে আসছে। নক্ষত্রের আম্মু ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই তিতিক্ষাকে দেখছে। তিতিক্ষার শরীরে মারের দাগ স্পষ্ট৷ ফর্সা শরীর বেল্টের মারের জন্য কালশিটে পড়ে গেছে। ঠোঁটে কেটে ফুলে আছে, কপালে আঘাতে দাগ। তিতিক্ষা মাথা নিচু করে এখনো শব্দ করে কাঁদছে।

তিতিক্ষাকে রুমে না পেয়ে ওদের বাসাতে চেচাঁমেচি লেগে গেলো। তিতিক্ষার আম্মু আর মামনি এই মেয়েকে পেলে শেষ করে ফেলবে। মেয়েটা যে এত বেহায়া হয়ে যাবে, উনারা ভাবতেও পারেনি। তিতিক্ষার আব্বুর মাথা কাজ করছে না। আজকে ছেলে পক্ষ আকদ্ করতে আসবে। উনারা এখন কি জবাব দিবে? তিতিক্ষার এমন কাজে রাগে উনার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। উনাদের মনে হচ্ছে, জন্মের পর পরই কেন ওকে মেরে ফেললো না? মারলে তো আজকে এই দিন দেখতে হতে না। এমন মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।
বাসার দরজার কাছে গাড়ি এসে থামতেই নক্ষত্র দ্রুত নামতে গেল। পায়ের টান লাগতেই ওর চোখ মুখ খিঁচে গেল। রুহান, আফান দ্রুত ওকে ধরে বললো,
–“ভাই এমন করিস না! আমরা তো বাসাতে এসে পড়েছি, আর ছটফট করিস না ভাই। তুই ব্যাথা পাবি। সেলাই কেটে যাবে।”
নক্ষত্র এখন কারো কথা শোনার অবস্থায় নেই। নক্ষত্র খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসায় ঢুকলো। তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে নক্ষত্র শিউরে উঠলো। নক্ষত্র ধীর পায়ে তিতিক্ষার সামনে এসে দাঁড়ালো। নক্ষত্রের আম্মু তখনও একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার সামনে সোজাসুজি বসতেই তিতিক্ষা কান্নাভেজা চোখে মুখ তুলে তাকালো। নক্ষত্রকে দেখে তিতিক্ষা নক্ষত্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এতক্ষণ ওর দু’চোখ তো আকুল হয়ে এই মানুষটাকেই খুঁজছিলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের বুকে মুখ লুকিয়ে শব্দ করে কাঁদছে। নক্ষত্রও তিতিক্ষাকে ওর বুকে আবদ্ধ করে নিলো। ওরা এখন ভয় বা চক্ষুলজ্জার কথা চিন্তা করার পরিস্থিতিতে নেই। তিতিক্ষার এখন মনে হচ্ছে, সে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ একটা স্থানে নিজেকে আড়াল করতে পেরেছে। কেউ আর ওকে নক্ষত্রের থেকে আর আলাদা করতে পারবে না। আর কেউ ওকে কষ্টও দিতে পারবে না।

তিতিক্ষার কান্না দেখে রুহান, আফান, সাফওয়ানের চোখেও পানি এসে গেছে। নক্ষত্র ঠোঁট কামড়ে ওর কান্না আটনোর চেষ্টা করছে। তবুও বেহায়া অশ্রু ওর গাল বেয়ে অঝরে ঝরে যাচ্ছে। তিতিক্ষা কাঁপছে; নক্ষত্র খুব ভালো করে টের পাচ্ছে। নক্ষত্র কি বলবে? সে কোনো কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তিতিক্ষা কাঁদতে কাঁদতে সেন্স হারিয়ে ফেললো।
নক্ষত্র তিতিক্ষাকে পাগলের মত ডাকছে। তিতিক্ষার কোনো হুশ নেই। আফান, রুহান, সাফওয়ান দৌড়ে আসলো৷ নক্ষত্র তিতিক্ষার মাথাটা ওর কোলে তুলে নিয়ে ব্যাকুল হয়ে ডাকছে। রুহান পানি নিয়ে আসলো। মুখে পানির ছিটা দেওয়ার পরও তিতিক্ষার সেন্স ফিরছে না। অজানা ভয়ে সবারই বুক কাঁপছে। নক্ষত্র স্তব্ধ হয়ে তিতিক্ষার মুখ পানে চেয়ে আছে। আফান কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার ধাপ প্রয়োগ করলো। এরপর তিতিক্ষার সেন্স ফিরে আসলো। তখনই তিতিক্ষার আব্বু-আম্মু নক্ষত্রের ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলো। ওদের দেখে ভয়ে তিতিক্ষা নক্ষত্রের শার্ট আঁকড়ে ধরলো। উনারা এসেই চিৎকার চেচাঁমেচি শুরু করে দিলো। মিঃ আবরার এসে সবাইকে থামালো। তিতিক্ষার আব্বু তিতিক্ষার দিকে তেড়ে আসতে গেলে রুহান আর আফান উনাকে থামালো। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ধরে উঠে বসালো। কারো কিছু বলার আগে, নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,

–“তিতিক্ষা তোমার আব্বু-আম্মু তোমাকে নিতে এসেছে। তুমি কি উনাদের সাথে ফিরে যাবে?”
তিতিক্ষা করুণ দৃষ্টিতে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্র আবারও একই প্রশ্ন করলো। নক্ষত্রের এমন কথা শুনে তিতিক্ষার আব্বু শান্ত হলো। যাক মেয়েকে তাহলে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে। নক্ষত্রের একথা শুনে তিতিক্ষা নক্ষত্রের পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
–“আমাকে তোমার কাছে একটু ঠাঁই দাও৷ প্লিজ! আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমি মরে যাবো।”
নক্ষত্র দ্রুত ওর পায়ে থেকে তিতিক্ষার হাত সরিয়ে নিলো। নক্ষত্র আলতো করে তিতিক্ষার চোখের পানি মুছে দিলো। তিতিক্ষার দুই গাল হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বললো,
–“তুমি কি উনাদের সাথে ফিরতে চাও? তুমি যা বলবে, তাই হবে। তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে, আমি বিনাবাক্যেতে তাই মেনে নিবো। তুমি কি উনারদের সাথে ফিরতে চাও, বলো আমাকে? ”
তিতিক্ষা ওর আব্বু-আম্মুর দিকে তাকালো। উনারা ওকে ভষ্ম করে দেওয়ার চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তিতিক্ষা নক্ষত্র শার্ট আঁকড়ে ধরে বললো,
–“আমাকে তোমার সাথে থাকতে চাই। আমার শুধু তোমাকেই চাই। আমি ফিরতে চাই না, কিছুতেই না।”
তিতিক্ষার আম্মু তিতিক্ষার মারতে আসলো। সাফওয়ান উনাকে আটকালো৷ মামনি ফট করে বলে উঠলো,
–“অসভ্য, বেয়াদব মেয়ে! এখানে এসে ঢং শুরু করেছিস? এই বেয়াদবটার জন্য এত ভালবাসা উতলে পড়ছে। পর পরই হয়! এখন কাছে টানলেও, ওদের স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেলে, দাপট দেখিয়ে তোকে ছুঁড়ে ফেলতে এদের একটুও সময় লাগবে না। তাই বলছি, ভালোই ভালোই ফিরে চল।”

নক্ষত্রের আম্মু কিছু বলতে গেলে, মিঃ আবরার উনাকে থামিয়ে দিলো। নক্ষত্র রুহানকে ডেকে কিছু একটা বলে ওর রুমে পাঠালো। রুহান একটা কাগজ এনে নক্ষত্রের হাতে দিলো। নক্ষত্রের শরীরের সাথে তিতিক্ষা ভয়ে লেপ্টে বসে আছে। নক্ষত্র হাঁটু গেড়ে বসার জন্য ওর পায়ের ব্যান্ডেজ থেকে রক্ত ঝরছে। আফান কিছু বলতে যাবে, তার আগে নক্ষত্র তিতিক্ষার আব্বু-আম্মুর দিকে তাকিয়ে কড়া কন্ঠে বললো,
–“এটা আমাদের বিয়ের কাবিন নামা। কাবিন নামা শব্দের মানে বুঝেন তো? এটা আমাদের পবিত্র বন্ধনের শেকল। আমাদের বিয়ের জলজ্যান্ত প্রমান।”
নক্ষত্রের কথা শুনে, সাফওয়ানরা বাদে সবাই চমকে উঠলো। তিতিক্ষার আব্বু-আম্মু কাবিন নামা দেখে থমকে গেলো। নক্ষত্র যে এভাবে উনাদের প্যাচে ফেলবে, উনারা ভাবতেও পারেনি। তিতিক্ষার আব্বু গিয়ে কাবিন নামাটা চেক করলো। উনার হাত থেকে কাবিন নামাটা নিয়ে তিতিক্ষার আম্মু আর মামনিও দেখলো। উনাদের মুখের আর কোনো কথা নেই। উনারা তিতিক্ষার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টির মানে তোকে পেলে টুকরো টুকরো করবো। নক্ষত্র ওর কন্ঠের স্বর আগের চেয়েও কঠিন করে বললো,

–“তিতিক্ষা শুধু আপনাদের মেয়েই না, ও আমার অর্ধাঙ্গিনীও। এখন আমি আপনাদের বলছি! তিতিক্ষা আপনাদের সাথে যাবে না, মানে যাবে না। এতদিন আপনাদের খারাপ ব্যবহার অনেক সহ্য করেছি। তিতিক্ষার গায়ে যাতে ফুলের টোকা না পড়ে। তাই আমি আপনাদের অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছি। কিন্তু আপনারা অমানুষের মত ওর গায়ে হাত তুলেছেন। তিতিক্ষা আমার বিয়ে করা বউ। ও আমার সাথে থাকতে চাই। আমাদের বিয়ে হওয়ার পরও আমি ওকে একবারও বলিনি, আমার কাছে চলে আসতে। আপনাদের জেদের বশে তিতিক্ষা আজকে আমার কাছে নিজে থেকে এসেছে। আর নিজে থেকে যেহেতু এসেই পড়েছে, আমি ওকে আর ফিরতে দিবো না। এবার আপনারা যে যা পারেন, করে নিন। কিছুতেই আমি তিতিক্ষার হাত ছাড়ছি না। আপনাদের ক্ষমতা থাকে তো, ওকে আমার কাছে থেকে আলাদা করে দেখান। আপনাদের চৌদ্দ না, আটচল্লিশ গুষ্ঠী এসেও যদি তিতিক্ষাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারেন, তাহলে আমি নাহিয়ান আবরার কথা দিচ্ছি। এই পৃথিবীতে আমার কোনো অস্তিত্বই রাখবো না। অহংকার, দাপট, বেয়াদবীর কথা বললেন না? হ্যা আমি এখন আপনাদের দাপট দেখাচ্ছি। আমিও দেখতে চাই আপনাদের দম কতো, আপনারা কত নিচে নামতে পারেন, আপনাদের কত জেদ, কত দাম্ভিকতা; আমিও এর শেষটা দেখতে চাই। আপনারা জেদের বশে আমাদের আলাদা করতে চাচ্ছিলেন না? ওকে আমি আমার বাবা-মা সহ, আপনাদের ওপেন চ্যালেঞ্জ করছি। আপনারা আমাদের দু’জনকে আলাদা করে দেখান। আমি দেখি আপনারা কে কতটা দাপট নিয়ে চলেন।”

নক্ষত্র আগুন ঝরা কন্ঠে শুনে সবাই থমকে গেলো। তিতিক্ষার আব্বু আম্মু ভাবতেও পারেনি, নক্ষত্র ওদের মুখ এভাবে লাগাম লাগিয়ে দিবে। নক্ষত্রের আব্বু-আম্মুও ছেলের এমন কথা শুনে দমে গেল। ছেলের এমন রাগ উনারাও এর আগে দেখেনি। উনারা শুধু তিতিক্ষার জন্য নক্ষত্রের আরেক রুপে দেখলো। মামনিও আর কথা বাড়ালো না। কিছু বলার মুখ তো নাই, আর কিই বা বলবে।
তিতিক্ষার আব্বু যাওয়ার আগে বলে গেলো,
–“তুই আজ থেকে আমার কাছে মৃত। আমি তোকে ত্যাজ্য করলাম।”
কথাটা বলে উনি চলে গেল। তিতিক্ষা কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে বললো,
–“আমি তোমাদের কাছে মৃত হলেও, আমার মোনাজাতে তোমরা ছিলে, আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি থাকবেও। আব্বু আমাকে মাফ করে দাও। আব্বু! আমি পারলাম না তোমাদের ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে। পারলাম না আমি তোমাদের অন্যায় আবদার মেনে নিতে।”

উনারা চলে গেল। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে জড়িয়ে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। সাজানো গুছানো সম্পর্কগুলোর ভীত নড়ে গেলো। এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। তাহলে কেন হলো? প্রেম করে এসব ঝামেলার সম্মুখীন হবে না বলে নক্ষত্র শুরু থেকেই সবটা সুন্দর ভাবে সাজাতে চেয়েছিলো। তাহলে কেন ওদের এমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে এসে দাঁড় করালো। প্রেমের গল্প গুলোর সমাপ্ত হয় এমন নিষ্ঠুর ভাবে। যত্নে গড়া ভালবাসার শত শত কলি গুলো ঝরে যায় এমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতির কারণে। তাহলে ওরটা কেন এমন হলো? নক্ষত্র বেকার নয়, খারাপ ছেলে নয়, নেশা গ্রস্ত নয়, বাজে কোনো কাজে লিপ্ত নয়। তবুও আজকে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আবার প্রমান হলো, নিয়তিতে লিখা থাকলে, সাজানো গোছানো সহজলভ্য জিনিসটা পেতে হলেও যুদ্ধের ময়দানে নামতে হয়।”
নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ওর বুক থেকে সরালো। তিতিক্ষার চোখের পানি মুছে দিলো। মাথা নাড়িয়ে কাঁদতে নিষেধ করলো। নক্ষত্র অনেক কষ্টে উঠে ওর আম্মুর সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বললো,

–“মা মায়ের জায়গায়। বউ বউয়ের জায়গায়। একটা ছেলেকে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার জন্য মা-বউ, দু’জনকেই দরকার। তোমরা মায়েরা কেন ছেলের বউকে প্রতিদ্বন্দী ভাবো? কেন ভাবো? কেন? বলবে আমাকে? ওর কি দোষ ছিলো, বলো আমাকে?
তোমার মেয়ের জন্য আমাকে কেন শাস্তি পেতে হবে? আমি কি করেছি? তুমি আমার দিকে কেন আঙ্গুল তুলছো? আমি তো অদ্রিকে বলিনি নবিনের সাথে সম্পর্কে জড়াতে। তাহলে তোমরা আমাকে কেন কাঠগড়ায় দাঁড় করালে? ভালো করে চিন্তা করে দেখো তো, আমাদের দোষটা কোথায়? কেন এই জঘন্য পরিস্থিতিতে আমাদের দাঁড় করালে? নবিনদের ব্যাপারটা ভাল মত মিটমাট করা যেতো। বলো যেতো না করা? ওরা ভুল করে ফেলেছে, দুই পরিবার বসেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তো সমাধান করা যেতো৷ তা তো করলেই না, বরং দুই পারিবার মিলে দ্বন্দ লাগিয়ে দিলে। শেষে তুমি কি করলে, ওদের দোষ আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে আমাদের এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে দিলে। বলো তুমি কি সঠিক পন্থা অবলম্বন করেছো? তুমি সবার প্রথমে আমাকে এই আগুনে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছো। দেখো এখন আমরা দু’জনেই নিখুঁত ভাবে দগ্ধ হচ্ছি।”
সবাই নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্রের আম্মুও অবাক চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র একটু দম নিয়ে চোখ মুছে, ধরা গলায় আবার বললো,

–“আম্মু! একটাবার আমার কথাগুলো ভেবে দেখো তো। আমাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে, এখন ওকে দূরে সরালে আমার গায়ে কাপুরুষ, বেইমান, জানোয়ারের ট্যাগ লাগতো। কাপুরুষ, বেইমানের ট্যাগ নিয়ে আমি কিভাবে বাঁচতাম? আমারও তো বিবেক বলে কিছু আছে। বিয়ের পর বউকে দূরে সরিয়ে দেওয়া কি কোনো বিবেকবান মানুষের কাজ হতো? বলো আম্মু তুমিই বলো? আজকে আমার বিবেকের কথা শুনতে গিয়ে এখন তো আমি তোমার কাছে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম খারাপ ছেলে হয়ে গেলাম। আমার জায়গা তুমি নিজেকে দাঁড় করাও। বলো আম্মু! আমার জায়গা তুমি থাকলে তুমি কি করতে? তোমার কাছে আমি যখন খারাপ যখন হয়েই গেছি। আমি এই অপরাধবোধ নিয়ে আর বাঁচতে চাই না। আমাকে বিষ এনে দাও। তুমি বলছো, তোমার কথা না শুনলে তুমি মারা যাবে। তুমি কেন মরবে? মরবো তো আমি! আমিই তো সব সমস্যার মূল। তোমাদের দু’জনের ভালোর জন্য, আমার কাছে আর কোনো পথ খোলা দেখছি না। আমি বাঁচলে তোমাদের দু’জনইকেই আমার চাই। কিন্তু সেটা তো কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমিই নিজেকে শেষ করবো। আমি না থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সব কষ্টের সমাপ্তি ঘটবে।”
নক্ষত্রের আম্মু, নক্ষত্রের কথার উত্তর দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না। ছেলের এমন কথা শুন উনি যেন বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_29

সেদিন তিতিক্ষা বাসা থেকে বের হওয়ার পর বিভা তিতিক্ষাকে ফলো করেছিলো। বিভার মনে তিতিক্ষার জন্য রাগের সৃষ্টি হয়েছে। তিতিক্ষা আর নক্ষত্রের জন্য ওর ভাই নবিনকে বাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে। নিজের আপন ভাইয়ের থেকে কাজিন কখনোই বড় হয় না। ও মনে করে, সব দোষ তিতিক্ষার। ওর জন্যই ওর ভাই বাসা ছাড়া। তিতিক্ষাকে নক্ষত্রের সাথে দেখে বিভা এসে তিতিক্ষার আম্মু আর মামনিকে সবটা বলেছে। গাড়ির পেছনের সিটে বসা থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টে যাওয়া অবধি সবটা৷ ব্যাপারটা মাখো মাখো করতে বিভা নিখুঁতভাবে আরো জোড়াতালিও দিয়েছে। যার কারণে তিতিক্ষার আম্মু আর মামনি প্রচন্ড রেগে গেছে। আর রাগের বশে উনারা তিতিক্ষাকে বাজে কথা বলতেও ছাড়েনি। বিভা ওর মনের ক্ষোভ মিটাতে এমন করেছে। কিন্তু এই ব্যাপারটা এতটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, কে জানতো! তবে কাঠখড় পুড়িয়ে লাভ হলো, সে তিতিক্ষাকে মার খাওয়াতে পেরেছে।
নক্ষত্রের আম্মু নক্ষত্রের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি। উনার এবার টনক নড়লো যে, উনি মেয়ের রাগ ছেলের উপর চাপিয়ে বড্ড ভুল করেছেন। এনগেজমেন্ট ভেঙে না দিলে হয়তো এত কিছু ঘটতো না। নক্ষত্র ওর আম্মুকে চুপ করে থাকতে দেখে আর কথা বাড়ালো না। তিতিক্ষাকে মেঝে থেকে তুলে দাঁড় করালো। এখানে থেকে আর কি হবে? সবাইকে নিয়েই তো ভাল থাকতে চেয়েছিলো। কিন্তু হলো আর কই। কারো অভিযোগের কারণ ওরা আর হতে চাচ্ছে না। মিঃ আবরার নক্ষত্রকে বললো,
–“নক্ষত্র আব্বু, আমার এমন করো না। এভাবে রাগের মাথায় বাসা থেকে যেও না। একটু সময় দাও, সবটা ঠিক হয়ে যাবে। ”
নক্ষত্র তিতিক্ষার মুখের দিকে তাকালো। তিতিক্ষা ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র ওর
আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো,

–“আব্বু বিশাল অট্টালিকাতে অস্বত্বি নিয়ে থাকার চেয়ে, কুড়ে ঘরে শান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে থাকাটাই শ্রেয়। তুমি চিন্তা করো না। তোমার ছেলে তার বউয়ের দায়িত্ব নিতে সক্ষম। আল্লাহ আমাকে সেই সার্মথ্য দান করেছে। ইনশাল্লাহ! আমি তিতিক্ষার প্রতি আমার দায়িত্বটা সঠিক ভাবে পালন করতে পারবো।”
মিঃ আবরার আর কিছু বললো না। সব সময় অজুহাত দেখিয়ে ছেলে-মেয়েকে বেঁধে রাখতে নেই। পৃথিবীর বুকে সবাইকে নিজের শক্তি, সাহস, বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা দিয়ে চলতে দেওয়া উচিত। এক বার মুখ থুবকে পড়ে যাতে পরের বার ইচ্ছে শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। যদিও নক্ষত্র মুখ থুবড়ে পড়ার মত ছেলে না। আজকে সে শুধু পরিস্থিতির স্বীকার। অনেক কাহিনী তো হলো। ওরাও এবার ভালো থাকুক। নক্ষত্রের ওর আম্মুর দিকে তাকালো। এরপর তিতিক্ষাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। নক্ষত্রের আম্মু গম্ভীর কন্ঠে বললো,
–“যেতে হলে তুমি যাও। আমার ছেলের বউ কোথাও যাবে না। তুমি খুব বড় হয়ে গেছো, তাই না? আমাদেরকে এখন দায়িত্ব কি, এটা শিখাচ্ছো? দু’জনের কেউ বাসার বাইরে পা রাখলে, এর ফল ভালো হবে না।”
নক্ষত্রের আম্মু কথাটা বলে উনার রুমে চলে গেলো। নক্ষত্র কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে গেল। ওর আম্মুর কথার মানে বুঝতে ওর সময় লাগলো না। নক্ষত্র আর মিঃ আবরার এটাই চেয়েছিলো। নক্ষত্রের ফাঁদে ওর আম্মু পা দিয়েছে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে ওর আম্মুকেও বাগে আনলো। মিঃ আবরার আর নক্ষত্র দু’জন দু’জনার দিকে তাকালো। দু’জনের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। যার মানে বাবা ছেলে বাদে কেউ বুঝলো না।
তিতিক্ষা ছলছল চোখে নক্ষত্রের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদা ব্যান্ডেজ রক্ত ভিজে লাল হয়ে গেছে। তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললো,

–“তোমার পায়ে রক্ত বের হচ্ছে। প্লিজ তুমি থামো।”
নক্ষত্রের ঠোঁটে মুচকি হাসি। তিতিক্ষার মুখ দেখে মনে হচ্ছে নক্ষত্রের বদলে ও নিজে কষ্ট পাচ্ছে।
আফান দ্রুত পায়ে এসে নক্ষত্রকে সোফাতে বসিয়ে দিলো। মিঃ আবরার ফাস্ট এইডের বক্স নিয়ে আসলো। আফান নক্ষত্রের পা নতুন করে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। রুহান কাবিন নামার কাগজটা নক্ষত্রের হাতে দিয়ে, নক্ষত্রকে ইশারা করলে তিতিক্ষাকে নিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য। মিঃ আবরারও ইশারাতে তাই বললো। নক্ষত্র তিতিক্ষার হাতটা শক্ত করে ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে রুমে গেল।
তিতিক্ষার আব্বু-আম্মু মামনি বাসায় গিয়ে কেউ কোন কথা বললো না। একটু পর তিতিক্ষার আব্বু-আম্মু উনাদের বাসাতে যাওয়ার জন্য বের হয়ে গেলো। যে ছেলের সাথে তিতিক্ষার আকদ্ হওয়ার কথা ছিলো, তাকে মেসেজ করে না করে দিয়ে ফোনটা বন্ধ রাখলো। মামনিও আর আটকালো না। কি বলেই বা আটকাবে? তিতিক্ষা না ফেরাতে আহান আর তনুকা মনে মনে খুশিই হলো।
নবিনকে সকালে তাড়াহুড়ো করে বের হতে দেখে অদ্রি কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পায়নি। তখন নবিনের মুখে স্পষ্ট রাগ ছিলো। কারো প্রতি সে খুব রেগে ছিলো। নবিন ইচ্ছে করেই অদ্রিকে কিছু বলেনি। ওকে বললে টেনশন করবে, কান্নাকাটি করবে। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে, অদ্রিকে সাবধানে থাকতে বলে দ্রুত বের হয়ে গিয়েছিলো। নবিন কেবল অদ্রিদের ওখান থেকে ফিরলো। এতক্ষণ সে ওখানেই ছিলো। তিতিক্ষার আব্বু-আম্মুকে তিতিক্ষাকে ছাড়া যেতে দেখেছে। এরপর হাসি হাসি মুখ নিয়ে বাসায় ফিরেছে। তিতিক্ষা নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাস রেখেই নক্ষত্রের কাছে গিয়েছিলো। ওর আশা ভরসা, ভালবাসা, বিশ্বাস, অনুভূতির সবকিছুর জয় হলো। নবিন এসব ঘটনা এখন অদ্রিকে সবটা জানালো । অদ্রি সবটা শুনে কাঁদতে কাঁদতে বলো,

–“সব আপনার জন্য। আমি বলেছিলাম আপনাকে এসব না করতে। আমার পাপ কাজের সাথে নিজেকে না জড়াতে। আমার জন্য ভাইয়া আর ভাবিমণি এতটা কষ্ট পাচ্ছে। সব আমার দোষ। আমার জন্যই এত অশান্তি সৃষ্টি। ”
নবিন অদ্রির চোখ মুছে ওকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলে। অদ্রি নবিনের শার্ট আকড়ে ধরে কাঁদতে থাকলো। অদ্রির পেটের বাচ্চা নবিনের না। অদ্রি ওর একটা ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টিতে গিয়েছিল। কেউ একজন অদ্রির জুসে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। অদ্রি অবচেতন হয়ে গেলে, ওকে অন্ধকার স্টোর রুমে নিয়ে গিয়ে রেপ করে। সকালবেলা নিজেকে এমন বিধস্ত অবস্থায় দেখে ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কে করছে বা কারা করেছে অদ্রি জানে না। কারণ সে সময় কড়া মেডিসিনের প্রভাবে সে পুরোপুরি অবচেতন।এখানকার কাউকে তো ভালো মতো চেনেই না। এখন কাকেই বা দোষ দিবে। লজ্জা আর ভয়ে সে নিজের ফ্রেন্ডকেও জানায় নি। সেদিনের পার্টিতে তো অনেকজন ছেলে ছিলো। তাঁরা তো ড্রিংক্সও করছিলো। কে ওর সাথে এমন জঘন্য কাজটা করলো? চোর ধরতে পারলে না হয় তাকে শাস্তি দিবে। কিন্তু চোর না ধরতে পারলে তাকে কিভাবে কি করবে? অদ্রি তো জানে না সে কে, এজন্য আর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সবটা হজম করে নিতে হয়েছে। অদ্রির মত মেয়েদের সাথে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনা গুলো অপ্রকাশিতই রয়ে যায়। শুধুমাত্র চক্ষুলজ্জা, অপমান, অসহায়ত্ব আর কলঙ্কিত ট্যাগ লাগার ভয়ে।

তনুকার বিয়ের দিনে অদ্রি জানতে পারে ও প্রেগনেন্ট। একটা নিরিবিলি জায়গাতে সবার থেকে নিজেকে আড়াল করে অদ্রি কান্নাতে ভেঙে পড়েছিলো, আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছিলো। নবিন সিগারেট খেতে ওখানেই গিয়েছিলো। তখনই অদ্রির সব কথা শুনে ফেলে। নবিন অদ্রির থেকে পুরো কাহিনীটা শুনে। আর বলে সে অদ্রিকে সাহায্য করবে৷ কারণ নবিনের মনে করে, যে নিজ ইচ্ছায় রেপ হয়, তাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী করা তো দূর সাপোর্ট করারও প্রশ্নই আসে না। কিন্তু যে পরিস্থিতির স্বীকার হয়, তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে বেঁচে থাকার একটা সুযোগ দেওয়াই যায়।
এটা ভেবেই নবিন অদ্রির পাশে দাঁড়িয়েছিলো। অদ্রির বয়স কম, ওর ভবিষ্যত বলে কিছু আছে। বেবিটা ছিলো এক মাসের। তাই নবিন এবোর্শন করাতে অদ্রিকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো। এবোর্শন করতে অভিভাবকের সাক্ষর লাগে৷ তাছাড়া ডক্টর এবোর্শন করাতে রাজি হচ্ছিলো না।
নবিন অদ্রির হাজবেন্ড হয়ে সাক্ষরটা করেছিলো।

আর ওখানে গিয়ে কোন প্রতিবেশী ওদের দেখে অদ্রিদের বাসায় জানিয়ে দিয়েছিলো। তারপর থেকেই তো এসব সমস্যার উৎপত্তি হলো।
আমাদের সমাজে নবিনের মত বিবেকবান ছেলের বড্ড অভাব। অদ্রির উপকার করলো বলে ওকে এত কিছুর সম্মুখীন হতে হলো। বাড়ি ছাড়া হলো, সবার কাছে খারাপ প্রমাণিত হলো, বোনের কষ্টের কারণ হলো। তবুও হার মেনে অদ্রির হাত ছাড়লো না। আসল কথাটা জানলে হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই খারাপ ভাবে অদ্রির দিকেই আঙুল তুলবে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। পিছন ফিরে সবাইকে সত্যিটা জানিয়ে আর জল ঘোলা করার মানেই হয় না। পরিস্থিতি তো সব সময় এক থাকে না। আল্লাহ ভরসা! একদিন পরিস্থিতি বদলে সবটা ঠিক হয়ে যেতেও পারে। তবে এতকিছুর পরেও, নবিনের মনে অদ্রির জন্য অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে৷ যে অনুভূতি কোনদিন নিঃশেষ হওয়ার মতো না।
নক্ষত্র রুমে ঢুকে তিতিক্ষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এতটা শক্ত করে ধরলো, যেন সে তিতিক্ষাকে ওর বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নিতে পারলে শান্ত হতো। আচ্ছা! প্রিয় মানুষটা কেন বুকের বা পাশটাতে লুকিয়ে রাখা যায় না? কেন নিজের শরীরের প্রতিটা রক্ত বিন্দুর সাথে মিশিয়ে নেওয়া যায় না? কেন মনের গহীনে বন্দী করে সবার থেকে আড়াল করা যায় না? কেন অদৃশ্য ভাবে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে রাখা যায়? অদৃশ্য ভাবে সবার থেকে আড়াল করতে পারলে ওকে তো এত কষ্ট পেতে কখনোই দিতো না।

নক্ষত্র এতটা কল্পনা করেনি যে, তার মনোপ্যাথি তার জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করবে। লজ্জায় নতজানু হওয়া মেয়েটা প্রতিবাদী হয়ে উঠবে। ওর প্রতি অসীম বিশ্বাস নিয়ে এতটা পথ ছুটে আসবে। বাবা-মা শারীরিক, মানসিক অত্যাচার করার পরেও, হার না মেনে আত্মাবিশ্বাসী হয়ে ওকেই বেছে নিবে। যেখানে অন্য কেউ হলে এতদিনে হার মেনে যেতো। ওদের সব অনুভূতিরা চূর্ণ বিচূর্ন হয়ে নিঃশেষ হয়ে যেত।
আমাদের দেশে তো এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। মেয়ে প্রেম করছে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। ছেলে ভালো হোক বা মন্দ দেখার সময় নেই। নিজের পছন্দ মতো কারো সাথে বিয়ে ঠিক করে৷ মেয়ে যখন বিয়ে করতে রাজি না। তখন তাকে ইচ্ছে মত পিটিয়ে, বাবা-মা কসম দিয়ে মেয়েটার পথ আটকে দেয়। যাতে সে পালাতে না পারে। তারপর মেয়ের অমতে বিয়ে দিয়ে অন্যের ঘরে পাঠিয়ে বাবা-মা তাদের দায়িত্ব পালন করে। মেয়েটা যখন এসবের স্বীকার হয়ে সবটা মেনে নেয়, তখন ভালবাসার মানুষটা তাকে অতি ভালবাসার অধিকার নিয়ে ছলনাময়ী, বে*, নিষ্ঠুর, পাষাণ, বারো*, একটাতে হয় না, লোভী বলে তাদের মন মতো ট্যাগ লাগিয়ে দেয়। এটাই হয়ে আসছে, আর এটা হচ্ছে আরেকটা বাস্তবতা।
নক্ষত্র আর তিতিক্ষার মতো শত শত ছেলে-মেয়ের ভাগ্য এত ভালো নয়। সবার ভালবাসাতে পূর্ণতা আসে না। এই গল্পে ওরা এক না হলে আমাকে তো ইচ্ছেমত ধুয়ে দিবেন। যা মুখে আসে তাই বলে চলে যাবেন। আমারও মাঝে মাঝে আপনাদের বলতে ইচ্ছে করে,

–“বাস্তবতা সুমধুর নয়। বাস্তবতার হলো নিষ্ঠুর মায়াজাল। কারো জীবন এত সুন্দর করে সাজানো হয় না। বাস্তবের এই পরিস্থিতির সমাপ্ত এত সহজে হয় না। বাস্তবে এই পরিস্থিতির সমাপ্ত হয় সারাটা জীবন দহনে দগ্ধ হতে হতে। এটা শুধু গল্পে তুলে ধরেছি। তাই মানতে পারছেন না। এমনটা বাস্তবেও ঘটে আর কারো না কারো সাথে প্রতিনিয়ত ঘটছেও। তাদের কি বলবেন? তাদের কিভাবে শান্তনা দিবেন? কিছু বাক্য দিয়ে একটা গল্প তৈরী করে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করেছি। তাই আপনারা মানতে পারছেন না। তাহলে সেই সব জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার মানুষের কি অবস্থা? একটা বার ভেবে দেখেছেন? আমাদের ব্যবহারে আমরা বুঝিয়ে দেই, আমরা সবাই সুখের মাঝে সুখ খুঁজে নিতে সক্ষম। কিন্তু কষ্টের মাঝে কারো কষ্টের ভাগ নিতে আমরা বড্ড বেশি অক্ষম।
তিতিক্ষা এখনো নক্ষত্রের বুকে আবদ্ধ হয়ে আছে। মার খেয়ে শরীরটা ব্যাথাতে নড়ানো যাচ্ছে না। তবুও নক্ষত্রের এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকাতে ঠিক কতটা শান্তি পাচ্ছে, সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পাচ্ছে না। নক্ষত্র তিতিক্ষার কপালে আলতো ভাবে একটা আদর দিলো। তিতিক্ষার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে গেল। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে বেডের উপর বসিয়ে দিয়ে ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইডের বক্স বের করলো৷ তিতিক্ষা কপালের কাটা স্থানে এখনো কিছু লাগায়নি। নক্ষত্র অতি যত্নে কপালের রক্ত পরিষ্কার করে দিয়ে কপালে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। ঠোঁটেও নাজেহাল অবস্থা। নক্ষত্রের হাত কাঁপছে। তিতিক্ষার শরীরে বেল্টের মার গুলো দেখে নক্ষত্র চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে৷ তিতিক্ষা একদৃষ্টিতে নক্ষত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র মাথা নিচু করে মারের দাগ গুলোতে এন্টিসেপটিক ক্রিম লাগাতে লাগাতে ধরা গলায় বললো,

–“ইস! এভাবে কেউ মারে? ব্যাথা করছে খুব? অনেক কষ্ট হচ্ছে, তাই না?”
তিতিক্ষা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। নক্ষত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ক্রিম লাগাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। সে জানে তিতিক্ষা এটাই বলবে। তিতিক্ষার চোখে পানি ছলছল করছে। এই ছেলেটার জন্য আজকে বাবা-মায়ের অবাধ্য মেয়ে হলো। বাবা-মায়ের জেদের কাছে ওর অনুভূতিগুলো মাটিতে চাপা পড়ে যাচ্ছিলো। বাবা-মা ওর ভাঊল করতে গিয়ে, ওর প্রাণটাই কেড়ে নিচ্ছিলো। কোথাও তো বলা নেই, বাবা-মা ভুল করলে স্বীকার করা তাদের জন্য নিষিদ্ধ। তাহলে তারা কেন ভুল স্বীকার করে না? বরং তারা ভাবে ভুল হলে ভুল হোক। তবুও কিছুতেই আমাদের সিদ্ধান্ত থেকে নড়চড় হবো না। যেমনটা তিতিক্ষার আব্বু-আম্মু করলো। মেয়েকে মেরে ফেলবে তাও ভুল স্বীকার করবে না। তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
–“আজকে আমাদের অনুভূতির গুলো পরিপূর্ণ ভাবে স্বার্থক হলো।”
নক্ষত্র তিতিক্ষার মুখের দিকে তাকালো। গলায় স্বরটাকে গম্ভীর করে বললো,
–“তুমি তো মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্তে নিজেকে লিপ্ত করলে। এজন্য পরে আবার আফসোস করবে না তো?”
তিতিক্ষা ভ্রু কুচকে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। হঠাৎ এমন কথা কেন? তিতিক্ষা নক্ষত্রের কথার মানে বুঝতে পারলো না। তিতিক্ষা ভয়ার্ত গলায় বললো,
–“কি ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম?”
নক্ষত্র দুষ্টু হেসে তিতিক্ষার কানে কানে মৃদুভাবে আদুরে কন্ঠে বললো,
–“নক্ষত্র নামক নেশাতে পরিপূর্ণ ভাবে নিজের অস্তিত্বকে ডুবানোর ভুল।?”
নক্ষত্রের কথা শুনে তিতিক্ষা লজ্জা পেলো। কথাটা শুনে সে সাথে সাথে মাথা নিচু করে নিলো। তিতিক্ষার ঠোঁটের কোণে লজ্জামাখা হাসি। ইস! এই ছেলেটা ওকে আবার লজ্জাতে ফেলার বুদ্ধি আটছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার লজ্জামাখা মুখ দেখে হো হো করে হেসে দিলো।

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_30

নক্ষত্ররা ওদের রুমে যাওয়ার পর সাফওয়ানদের মুখেও হাসি ফুটলো। তাঁরা আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জানালো। এরপর রুহান, আফান, সাফওয়ান আর মিঃ আবরার নক্ষত্রের আম্মুর কাছে গেলো। নক্ষত্রের আম্মু কাঁদছিলো। ছেলে-মেয়েকে কিছু বলার পরে উনি এভাবেই পাগলের মতো কান্না করে। সাফওয়ান, রুহান, আফান উনাকে ঘিরে বসলো। সাফওয়ান নক্ষত্রের আম্মুর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
–“কাঁদছো কেন আন্টি? একদম কাঁদবে না। আন্টি তুমি আর নক্ষত্রের উপর অভিমান করে থেকো না। একটা বছর ধরে নিজেকে আড়াল করে ও তিতিক্ষাকে ভালবেসে এসেছে। তিতিক্ষার প্রতি একটু একটু ভাললাগা থেকে দিন দিন সর্বনাশা অনুভূতিরা এসে ওকে গ্রাস করেছে। নক্ষত্র তিতিক্ষাদের পাশের নতুন বাসাটা দেখতে গিয়েছিলো। আংকেলের পরিচিতি কারো ওই বিল্ডিংটা। উনি নক্ষত্রকে দিয়েই আর্কিট্রেচারের কাজ করাবে বলে বিল্ডিংটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলো। আমি তখন ওর সঙ্গে ছিলাম। কারো হাসির শব্দে নক্ষত্রের চোখ যায় পাশের বিল্ডিং এর বেলকনিতে। একটা বাচ্চা ছেলে একটা মেয়ের চুলের খোঁপাতে প্লাস্টিকের গোলাপ গুঁজে দিচ্ছে। কিন্তু ভালো ভাবে গুজতে পারছিলো না। তখন মেয়েটা হেসে উঠছিলো। মেয়েটা আর কেউ না, সে তিতিক্ষা আর বাচ্চাটা ছিলো আহান। আন্টি বুঝোই তো একটা ছেলের মনে একটা মেয়ের প্রতি ভালো লাগার বিভিন্ন দিক থাকে। তিতিক্ষার চোখ আর খোঁপা দেখে নক্ষত্রের মনে একটা সূক্ষ অনূভূতি এসে জমা হয়। দিন দিন সেটা প্রখর হতে থাকে। এমনকি নক্ষত্র তিতিক্ষার সেফটির জন্য একজন ছেলেকেও ওর জন্য রেখেছিলো। সেই তিতিক্ষার সব খবর নক্ষত্রকে দিতো। প্রতি সপ্তাহে তিনদিন নক্ষত্র তিতিক্ষার ইউনিভার্সিটিতে যেতো। শুধু তিতিক্ষাকে দেখে তৃষ্ণার্ত চোখের পিপাসা মিটাতে। ঠিক কতটা ভালবাসলে কেউ এমনটা করে! আন্টি তুমি একটাবার ভেবে দেখো। আন্টি তোমার ছেলে দিন দিন এই মেয়েটার প্রতি মারাত্মক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছিলো। সে তোমাদের সরাসরি বলতে পারছিলো না। তাই আমি তোমাদের বলেছি। তোমরা রাজি হলে, আর গিয়ে এনগেজমেন্টও করে রাখলো।”
সাফওয়ানের কথা শুনে সবার চোখে অশ্রু ঝরছে। নক্ষত্র এসব করেছে তিতিক্ষার জন্য। এগুলো তো সবার অজানা। আড়াই ঘন্টার পথ অতিক্রম করে সে যেতো তিতিক্ষাকে একটা বার দেখতে। রুহান ওর চোখের পানি মুছে নিয়ে বলতে শুরু করলে।

–“সেদিন এনগেজমেন্টের পর নক্ষত্র খুশিতে আমাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো। ওর খুশিটা ও ভাষাতে প্রকাশ করতে পারছিলো না। এজন্য খুব কেঁদেছিলো। আমি নিজেও অবাক হয়েছিলাম নক্ষত্রকে দেখে। সেদিন সে কেঁদেছিলো তিতিক্ষাকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দে। আর রইলো ওদের বিয়ের কথা। তোমার ছেলেকে তো তুমি চিনো। তুমি তো জানো ওর চিন্তা ভাবনা কেমন। আসল সত্যি হলো, নক্ষত্র তিতিক্ষার অপবিত্র ভাবে স্পর্শ করবে না। নক্ষত্রের মনে একটা ভয় কাজ করছিলো, এজন্য ওরা বিয়েটা করেছিলো। কে জানতে এই বিয়েটাই পরবর্তীতে ওর সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে কাজে দিবে। বিয়ের পর নক্ষত্র তিতিক্ষাকেও এই কথাটা কাউকে জানাতে নিষেধ করেছিলো। কারণ তোমরা বড়রা শুনলে কষ্ট পাবে । অনুষ্ঠান তো হতোই। তাই ওরা কাউকে জানাইনি।
মিঃ আবরারও সবটা শুনছে। উনার চোখেও পানি। বাবা হয়ে ছেলেকে নিয়ে বড্ড বেশি গর্ব হচ্ছে। বিশেষ করে উনার ছেলের চিন্তা ধারা দেখে। রুমের মধ্যে নিরাবতা চলছে। এবার আফান বললো,

–“তিতিক্ষার ব্যাপারে আর কি বলবো? ওর ব্যাপারে আমার বেশি কিছু বলার নেই আন্টি। নক্ষত্রের জীবনসঙ্গী হিসেবে তিতিক্ষার থেকে পারফেক্ট কাউকে তুমি পাবে না। এতকিছুর পরেও, এত মার খাওয়ার পরও সে নক্ষত্রের হাতটা আঁকড়ে ধরেছে। বিশ্বাস, আস্থা, ভালবাসা নিয়ে এতদূর অবধি ছুটে এসেছে। ওই পাগলিটা তোমার ছেলেকে খুব ভালোবাসে। তবে সত্য কথা কি জানো আন্টি? এক স্থানে দাঁড়িয়ে ভালবাসি-ভালবাসি করলে হয় না! কঠিন পরিস্থিতিতেও সাহস নিয়ে একটা ধাপ এগোতে হয়। তাহলে সামনের ব্যাক্তিটাও হাতটি শক্ত করে ধরার সুযোগ পাই। তুমিই দেখো, তিতিক্ষাকে কতটা খারাপ ভাবে মেরেছে ওর পরিবার। তবুও দেখো, ও হার স্বীকার করেনি। ওদের শরীর আলাদা হলেও ওরা এক আত্মাতে পরিণত হয়েছে।”
এভাবে চলতে থাকলো ওদের কথোপকথন। উনি রুহানদের সব কথা শুনলো। নক্ষত্রের প্রতি এদের ভালবাসা দেখেও নক্ষত্রের আম্মু খুশি হলো। তিন বন্ধু নক্ষত্রকে আর কষ্ট পেতে দেখতে চায় না। তাই নক্ষত্রের আম্মুর অভিমান ভাঙ্গাতে সবটা জানালো। সাফওয়ান সিরিয়াস মুহূর্তেটাকে কাটানোর জন্য বললো,
–“আমার এত লড়াই করার শক্তি নেই। শ্বশুড়ের মেয়ে নিয়ে আগে ভাগে পালাবো। এক বছর পর বাচ্চা নিয়ে ফিরে শ্বশুড়ের সামনে বলবো, আব্বাজান নাতি-নাতনি তো হয়েই গেছে। আর রাগ করে কি করবেন?”

সাফওয়ানের কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতেও সবাই হেসে দিলো। এরপর তিন বন্ধু গেল নক্ষত্রের রুমের দিকে। সাফওয়ান নক্ষত্রের রুমের দরজাতে নক করলো৷ নক্ষত্র ওদের আসতে বলে, তিতিক্ষার হাতে ক্রিম লাগাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। রুহান মুচকি হেসে বললো,
–“উহুম! উহুম! বউয়ের সেবা করা হচ্ছে? বিয়ে তো হয়ে গেল। রুমটা তো সাজাতে হবে, তাই না? অফটার অল ফাস্ট নাইট বলে কথা।”
তিতিক্ষা মাথা নিচু করে নিলো। আফান রুহানের পিঠে থাবড় মেরে চেপে যেতে বললো। সাফওয়ান বললো,
–“রুমটা কি সাজিয়ে দিবো? নাকি বিনা ফুলে ফুলশয্যা সেরে ফেলবি।”
নক্ষত্র খুব ভালো করে বুঝতে পারছে, ওরা ওকে খোঁচাবো। এজন্য সে শান্ত গলায় বললো,
–“ভাবছি! তুই তোর গার্লফ্রেন্ডের শাড়ির কুচি ধরে হেঁটেছিস, ওই পিকটা আপলোড দিবো।”
কথাটা শুনে সাফওয়ান করুণ চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। বাকি সবাই হো হো করে হেসে দিলো। বেচারা সাফওয়ান আর কথা না বাড়িয়ে সোফাতে দুম করে বসে পড়লো। ওর ইচ্ছে ছিলো তিতিক্ষার সামনে নক্ষত্রকে খোঁচানো। কিন্তু নক্ষত্র একটা কথা বলেই ওর মুখ বন্ধ করে দিলো। একজন সার্ভেন্ট এসে দরজা নক করে তিতিক্ষাকে ডাকলো। নক্ষত্রের আম্মু নাকি তিতিক্ষাকে ডাকছে। তিতিক্ষা উঠে দাঁড়ালো। নক্ষত্র ওকে সাবধানে পা ফেলে যেতে বললো। নক্ষত্র বেডে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে বললো,
–“আমাকে ফ্রেশ হতে সাহায্য কর। পা’টা ব্যাথাতে নড়ানো যাচ্ছে না।”
সাফওয়ান সোফাতে সাহেবী স্টাইলে বসে সব দাঁত বের করে বললো,
–“শালা এতক্ষণ বউয়ের সামনে তো ঠিকই হিরোর মত বসে ছিলে। আমরা আসলাম আর এখন ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। পরীক্ষা দেওয়ার আগেই এই অবস্থা।”

আফান ভ্রু কুঁচকে সাফওয়ানকে বললো,
–“আজকে তো কম পরীক্ষা দিলো না। তুই আবার কোন পরীক্ষা দেওয়ার কথা বলছিস?”
নক্ষত্র সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। সাফওয়ানের মুখে শয়তানি হাসি। রুহান আর আফান মিটিমিটি হাসছে। সাফওয়ান চোখ টিপ মেরে বললো,
–“ওই যে ওই পরীক্ষা। যে পরীক্ষাটা দেওয়ার সময় কেউ কাউকে শিখিয়েও দেয় না, বলেও দেয় না। নিজে থেকে যা পারো সবটা লিখো।”
সাফওয়ানের কথা শুনে রুহান সাফওয়ান আর আফান হো হো করে হেসে হাইফাইফ করলো। নক্ষত্র ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তুই দিন দিন শেমলেস হয়ে যাচ্ছিস। আমারও দিন আসবে ওয়েট কর।”
আরেকদফা হেসে আফান আর রুহান নক্ষত্রকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করলো। আরেকটা সার্ভেন্ট এসে ওদের কফির সাথে নাস্তা দিয়ে গেল। নক্ষত্র পা টান টান করে শুয়ে আছে। আফান নক্ষত্রকে পেইন কিলার দিলো। তিনজনে মিলে নক্ষত্রকে খুব পচালো। এরপর নিজের খেয়াল রাখতে বলে ওরা চলে গেল। তবে যাওয়ার আগে নক্ষত্রকে চোখ মেরে বেস্ট অফ লাক বলে গেল। নক্ষত্র বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। তিতিক্ষা সে যে গেছে এখনো আসেনি। এতক্ষণ কি করছে কে জানে?

শরীরটাও খুব ব্যাথা করছে। নক্ষত্র চোখের উপর একহাত দিয়ে শুয়ে আছে। এভাবে থাকতে থাকতে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
মামনি বিভাকে বারবার করে নিষেধ করে দিয়েছে; প্রেম-ভালবাসা যেন না করে। উনি কোনদিনও বিভার এনগেজমেন্ট করে রাখবেনা না। সরাসরি বিয়ে দিবে বলে ভেবে রেখেছেন। নবিন নেই, তনুকা নেই, তিতিক্ষাও নেই; বাসাটা কেমন যেন লাগছে। নবিনের আব্বু মামনির সাথেও ঠিকমত কথা বলে না। বিভা, আহান আগের মত ঝগড়া করে না। সবটা শান্ত হয়ে গেছে। তবুও কিছু ভালো লাগছে না, শান্তি পাচ্ছে না। তিতিক্ষার আব্বু-আম্মুও মামনির ফোন ধরে না। পরিস্থিতি আস্তে আস্তে ঠান্ডা হবে। এক এক করে দিন কাটতে থাকে। হয়তোবা কোনো একদিন নিজেদের কাজের জন্য সবার মাঝেই অপরাধ বোধ কাজ করবে। তবুও হয়তো কেউ কাউকে ধরা দিবে না। ইগোর কাছে হার মেনে সেটা প্রকাশও করবে না।
প্রায় এক সপ্তাহ পর…..!!

নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার সাথে আগের মতো করে কথা বলে। দু’জনে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, শপিং করা, সিরিয়াল দেখা, ছাদে গল্প করা এসব করেই ওদের সময় কাটায়। উনি আর তিতিক্ষার মন খারাপের সুযোগ দেয় না। সময় না কাটলে দু’জনে বসে রুপচর্চা করে। এই নিয়ে নক্ষত্র আর মিঃ আবরার ওদের কম পচায়নি। অদ্রি ওর আম্মুকে দুই বার ফোন দিয়েছে। উনি কোন কথা বলেনি। ধীরে ধীরে বরফ গলবে, তবে সময় লাগবে। নবিনের আর অদ্রির সাথে তিতিক্ষার কথা হয়। নক্ষত্র দেখছে ওদের সাথে বলতে তাও কিছু বলেনি। তিতিক্ষার অনুরোধে নক্ষত্র অদ্রির সাথে কথা বলেছে। বোনের কান্না দেখে সে অভিমান করে থাকেনি। নক্ষত্র এখন সুস্থ হয়ে গেছে। নক্ষত্রও ওর আম্মুর সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে। বাসাটা দিন দিন প্রাণের অস্তিত্ব ফিরে পাচ্ছে। তনুকা, আহান একবার এসে তিতিক্ষার সাথে দেখা করে গেছে। মাঝে মাঝে রুহান, সাফওয়ান জেসিকা, সোনালী চলে আসে আড্ডা দিতে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। এভাবেই দিন গুলো কাটছে। তিতিক্ষা আলাদা একটা নম্বর থেকে ওর আব্বু-আম্মুকে ফোন দিয়েছিলো। তিতিক্ষা চুপ করে ছিলো। তবুও ওর আব্বু বুঝে গেয়েছিলো এটা তিতিক্ষা। হয়তো এটাকেই বলে বাবা-মেয়ের টান। তিতিক্ষার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেয়ে উনি শান্ত কন্ঠে বলেছিলো,

–“যার কাছে ভালো থাকবে বলে আমাদেরকে ত্যাগ করেছো, তাকে নিয়েই ভালো থেকো। আমাদেরকে আর ফোন কোনো দরকার নেই।”
নক্ষত্র কেবল বাসায় ফিরলো। বাসায় ঢুকে ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতলটা নিয়ে পানি খেলো। ওর আব্বু-আম্মু সোফাতে বসে ছিলো। নক্ষত্রও উনাদের কাছে গিয়ে বসলো। নক্ষত্রের আব্বু বললো,
–“আব্বু তিতিক্ষাকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে এসো। অন্য পরিবেশ গেলে ওর মনটা ভালো হবে।”
–“কিন্তু আমার তো হাতে অনেক কাজ। কালকে আমাকে ঢাকাতে যেতে হবে। দুই সপ্তাহের মত খুব বিজি থাকবো।” (নক্ষত্র)
–“বেঁচে থাকলে জীবনে অনেক কাজ করার সময় পাবে। এখন কাজটাকে সাইডে রেখে তিতিক্ষাকে সময় দাও।” (আব্বু)
–“তাহলে তোমরাও চলো আমাদের সাথে। চারজনে মিলে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”
–“ছেলে আর ছেলের বউ যাবে ঘুরতে, আমরা নাকি ওদের সাথে যাবো। আব্বু তোর বুদ্ধি গুলো কি হাঁটুর নিচে চলে গেছে নাকি? তোরা যা, পরের বার একসাথে যাবো।” (আম্মু)
–“ওকে।”

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২৫+২৬+২৭

নক্ষত্র আর কথা বাড়ালো না। ড্রায়নিং থেকে একটা আপেল তুলে নিয়ে খেতে খেতে রুমে চলে গেল। নক্ষত্রের বলা কথাটাতে ওর আব্বু-আম্মুও খুশি হলো। যাক বা না যাক, ছেলে যে মুখ ফুটে বলেছে তাতেই খুশি। সত্যি বলতে নক্ষত্রের হাতে আপাতত কোনো কাজ নেই। যেগুলো আছে সেগুলো পরে করলেও চলবে। আব্বু-আম্মু বউকে নিয়ে একবার ঘুরতে যাওয়ার কথা বলাতেই তো আর সাথে সাথে রাজি হওয়া যায় না। উনারা ভাববে ছেলে বউ পাগল হয়ে গেছে। এজন্য একটু অজুহাত দেখালো। সাথে উনাদের যাওয়ার কথাও বললো। বুদ্ধিমান ছেলে তো, এজন্য এক ঢিলে দুই পাখি মেরে দিলো। আব্বু-আম্মুও খুশি, ঘুরতেও যাওয়ার কথা শুনে বউও খুশি।
তিতিক্ষা রুমে বসে নক্ষত্রের শার্ট আইরণ করলো। শার্টগুলো ওয়্যার্ডড্রপে তুলে রাখলো। আইরণটা ঠিক জায়গায় রেখে রুমে থেকে বের হতেই নক্ষত্রের সাথে ধাক্কা খেলো। নক্ষত্র ইচ্ছে করে ধাক্কা লাগালো। আগে বাসায় আসলে শুন্য রুমে ঢুকতো। আর এখন পুন্য রুমে ঢুকে। কারো সিগ্ধ মায়াবী মুখটা দেখে সব কষ্ট, ক্লান্তি এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়। একথা ভেবে নক্ষত্র মুচকি হাসলো। আপাতত হাসিটা কনট্রোল করে ধাক্কা খেয়ে তিতিক্ষাকে বললো,

–“তা গঙ্গাফড়িংয়ের মত লাফাতে লাফাতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”
–“আব্বু-আম্মু নিচে আছে। আমিও এখন নিচেই যাচ্ছিলাম।”
–“আমি বাসায় আসলাম। আর ওমনি আপনার অজুহাত শুরু হয়ে গেলো। আমি থাকাকালীন রুম থেকে বের হলে আপনার তো আর দেখাও মিলে না। এখন নিচে যেতে হবে না। আমার জামা কাপড় গুছিয়ে রাখুন। আমি দুই সপ্তাহের জন্য বাইরে যাচ্ছি।”
বাইরে যাওয়ার কথা শুনে তিতিক্ষার মুখটা চুপসে গেল। নক্ষত্র চলে গেলে ও কিভাবে থাকবে? তিতিক্ষার চোখে পানি ছলছল করছে। কথাটা শুনে ওর মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে। সত্যি সত্যি ওকে রেখে গেলে একা রুমে থাকবে কিভাবে? তিতিক্ষার এখন হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
নক্ষত্র ওয়্যার্ডড্রপের কাছে গিয়ে মনে মনে বললো,
–“এমন ভাবে বউকে জ্বালাতন করাও মাঝেও অসীম সুখ বিদ্যামান আছে। বাহ্! দারুণ এক সুখানুভূতি তো।”
নক্ষত্র কোন কোন ড্রেস নিবে, সেগুলো বের করে তিতিক্ষার হাতে দিচ্ছে। আর তিতিক্ষা সেগুলো একটা ট্রলিতে গুছিয়ে রাখছে। মাঝে মাঝে নাক টানার শব্দ হচ্ছে। তিতিক্ষার অবস্থা দেখে নক্ষত্র মিটিমিটি হাসছে।

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু শেষ পর্ব