অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২২+২৩+২৪

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২২+২৩+২৪
written by Nurzahan Akter Allo

আহান কড়াইয়ে তেল দিয়ে ভয়ে ডিমটা ছাড়তে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হলো। মামনি তাকে বকেছে, এজন্য সে কিছুতেই মামনির সাহায্য নিবে না। এদিকে ভয়ে প্যানে ডিমটাও দিতে পারছে না। আহান সাতপাঁচ না ভেবে চুল অন রেখেই তিতিক্ষার রুমে দৌড় দিলো। চুলার উপরে প্যানের তেলটা খুব গরম হয়ে গেছে। আহান তিতিক্ষাকে টেনে-হিঁচড়ে রান্নাঘরে নিয়ে আসছে। প্যান অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ার কারণে প্যানের উপরে দাও দাও করে আগুন জ্বলছে। ওদের গ্যাসের চুলাটা ছিল পুরোটা গ্লাস বডি। প্যান অতিরিক্ত গরম আর গ্যাস আন রাখার জন্য চুলার উপরের কাঁচ গুলো ফেটে গেল। মোটা গ্লাস ফাটার সাথে সাথে চুলাটা ব্লাস্ট হলো। প্যান ছিটকে একটু দূরে গিয়ে পড়লো। তেলে চারপাশটা ছড়িয়ে গেল। এত শব্দে চুলা ব্লাস্ট হতে দেখে তিতিক্ষা আর আহান রান্না ঘরে থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে গেল। মামনি দৌড়ে এসে দেখে চুলার উপরের গ্লাস গুলো খুলে খুলে ছিটকে পড়ছে। গ্লাস গুলো রান্না ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে গেছে। তিতিক্ষা মামনির সাথে আসতে গেলো। মামনি তিতিক্ষা আর আহানকে আসতে নিষেধ করে দিলো। মামনি দৌড়ে গিয়ে সিলিন্ডার অফ করে দিলো। যাতে গ্যাসটা অফ হয়ে যায়। থার্ড কার্ণিশের নিচে গ্যাস সিলিন্ডার ছিলো। রান্নাঘারের দেওয়াল থেকে ফায়ার স্প্রে এনে মামনি স্পে করলো। গ্যাস সিলিন্ডার সেভ জনে ছিলো বলে ব্লাস্ট হয়নি। ফায়ার স্প্রে করায় আগুন নিভে গেল।

আহান ভয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। তিতিক্ষা আহানকে সরিয়ে রান্না ঘরে গেল। একটু অসাবধানতার জন্য মারাত্মক একটা অঘটন ঘটে যাচ্ছিলো। মামনি রেগে আহানকে মারতে যাচ্ছিলো। তিতিক্ষা কোনো রকম ধরে ওর রুমে চলে গেল। রানারঘরের অবস্থা দফারফা হয়ে গেছে। নতুন চুলা আনতে হবে তারপর রান্না হবে। মামনি উনার হাজবেন্ডকে ফোন করে সবটা বললো। উনি দুপুরের খাবার নিয়ে আসবেন। একটু পর বুয়ার সাহায্য নিয়ে মামনি রান্নাঘর পরিষ্কার করে নিলো।
দুপুরের খাবার সেরে তিতিক্ষা একটু রেস্ট নিল। বিকাল চারটার দিকে রেডি হয়ে ওর বুটিক ঘরে‌ গেল। কার কি প্রয়োজন, সেই লিস্টটা নিয়ে নিয়ে শপিংমলে গেল। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বুটিক শপে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরলো। সন্ধ্যার পর হালকা নাস্তা সেরে পড়তে বসলো। দুইদিন পর ওর ইনকোর্স পরীক্ষা। ইকোনোমিক্স সাবজেক্টে তিতিক্ষা অনার্স করছে। একটু পর তিতিক্ষার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে নক্ষত্রের নামটা দেখে ওর মুখে হাসি ফুটলো। সে মুচকি হেসে ফোনটা রিসিভ করলো। নক্ষত্রের আগে তিতিক্ষায় বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“উহুম! উহুম! কে বলছেন?”
–“আমি আমার ম্যানোপ্যাথির অর্ধাঙ্গ বলছি।”
–“ওহ! জ্বি বলুন।”
–“আমি কি আমার মনোপ্যাথির সাথে প্রেমালাপ করতে পারি?”
–“উহুম, মোটেও না।”
–“কেন, কেন?”
–“তাকে এখন ফোন দেওয়া যাবে না। সে এখন অনেক বিজি আছে।”
–“ওহ! আপনি অনুগ্রহপূর্বক আমার একটা বার্তা কি ওকে পৌঁছে দিবেন?”
–“হুম! কি বার্তা শুনি?
–“বলবেন, তার অর্ধাঙ্গ তার মিষ্টি কন্ঠস্বর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে।”
–“হুম! বলতে আমার বয়েই গেছে।”
ফোনের ওপর পাশে নক্ষত্র মিটিমিটি হাসছে। এমন দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি ওদের মধ্যে চলতে থাকলো। দুজনের মুখে প্রশান্তির হাসি। দুজনেই মুচকি মুচকি হাসছে আর কথা বলছে। ব্যস্ততার সময়টুকুকে বিদায় জানিয়ে এই রকম একটু আকটু খুনশুটি ওদের মাঝে চলে। নক্ষত্র ফোন কলেও তিতিক্ষাকে লজ্জাতে ফেলতে মোটেও ভুল করে না। তিতিক্ষাকে লজ্জায় ফেলে সে মুচকি মুচকি হাসে। ওর কথা শুনে তিতিক্ষা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে ওঠে।

তিতিক্ষার পরীক্ষা যথাসময়ে শুরু হয়েছে। ভালোই পরীক্ষা দিয়েছে। কালকে ওর পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
রেজাল্ট দিতে নাকি একটু দেরী হবে। ফ্রি হয়ে নক্ষত্রের সাথে ভালো খুনশুটি, প্রেমালাপ চলছে ওর। নক্ষত্রের আম্মু সাথে তিতিক্ষার রোজ কথা হয়। নক্ষত্রও নিজের কাজে আজকাল একটু ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। অদ্রি দুই বার এসেছিলো তিতিক্ষার সাথে দেখা করতে।
শরীরে মিষ্টি রোদের আদর খাওয়ার সময়টার সমাপ্ত ঘটেছে। শীতের যাত্রা শেষ। শীতের খোলস ভেঙ্গে,
রুক্ষ আর শুষ্কতাকে বিদায় জানিয়ে, বসন্তের আগমন ঘটেছে। শীতের শেষ, তথা মাঘের মাঝামাঝি থেকেই প্রকৃতিতে বইতে থাকে বসন্তের আগমনী হাওয়া। এ যেন জানান দেয় ঋতুরাজ বসন্তের উপস্থিতি। বন বনানী অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। প্রকৃতিতে চলে মধুর বসন্তে সাজ সাজ রব। আজকে পহেলা ফাল্গুন। তিতিক্ষাদের ইউনিভার্সিটিতে বেশ বড় করে বসন্ত বরণের অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়েছে। বসন্ত নিয়ে একাধিক অনুষ্ঠান থাকবে একের পর এক।
তিতিক্ষা সকাল বেলা বেশ দেরী করেই ঘুম থেকে উঠলো। আশে পাশে বসন্তে গানের ধ্বনি ভেসে আসছে। সে উঠে, ফ্রেশ হয়ে, ব্রেকফাস্ট সেরে বসে আছে। নবিন সকাল সকাল বন্ধুদের নিয়ে বের হয়েছে। বিভা সকালে উঠে বান্ধবীদের সাথে কোথাও গেছে। তনুকা ডাক্তার মানুষ। তার খুব ব্যস্ত সময় কাটছে। আলাদা ভাবে বসন্ত বরণের আয়োজনে মেতে উঠার সময় তার নেই। তিতিক্ষা বেলকুণিতে বসে ছিলো। তিতিক্ষার আম্মু তিতিক্ষাকে ফোন দিয়ে বললো,

–“আম্মু সাজুগুজু করে ঘুরতে বের হবে না?”
–” না, আম্মু। বিভা নেই বাসায়। একা একা আর কোথায় যাবো?”
–“আচ্ছা, শোনো! তোমার মামনি এখন তোমাকে একটা প্যাকেট দিবে। তার মধ্যে যেগুলো থাকবে, সেগুলো পড়ে সুন্দর করে রেডি হয়ে নাও। আমি ঠিক এক ঘণ্টা পর তোকে ফোন দিবো।”
তিতিক্ষার আম্মু কথাটা বলে ফোনটা কেটে দিলো। তখনই মামনি এসে তিতিক্ষার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। তিতিক্ষা প্যাকেটটা খুলে অবাকই হলো। মুচকি হেসে ওর আম্মুর কথামতো রেডি হয়ে নিল। কোথাও যাবে না, ওর আম্মুকে খুশি করতেই সে সাজলো। বাসন্তী রঙের লং কামিজ, গোলাপি চুরিদার সাথে মেচিং ওড়না। হাতের একমুঠো গোলাপি চুড়ি, কপালে ছোট্ট একটা টিপ, চোখে টানা করে কাজল, ঠোঁটে চ্যাপষ্টিক। চুল গুলোকে ছেড়ে দিলো। রেডি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওর নিজেরই লজ্জা লাগছে। তিতিক্ষার আম্মু ওকে ভিডিও কল দিলো। ওর আব্বু আম্মু দু’জনেই ওর সাথে কথা বললো। ফোনটা কেটে রাখতেই দরজাতে নক পড়লো। তিতিক্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। নক্ষত্র ওর রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। নক্ষত্র সত্যিই এসেছে, নাকি তিতিক্ষা ভুল দেখছে? নক্ষত্র মুচকি হেসে বললো,

–“আসবো?”
তিতিক্ষা হতভম্ব হয়ে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন? এখানে নক্ষত্র? কেমনে কি? নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তিতিক্ষার উত্তরের আশায় আর না দাঁড়িয়ে, সে রুমে প্রবেশ করলো। বাসন্তী রংয়ের পাঞ্জাবী, ব্ল্যাক জিন্স, ব্ল্যাক ওয়াচ, ব্ল্যাক সানগ্লাস। এই ছেলেটা আর কত রুপ নিয়ে হাজির হবে, কে জানে! তিতিক্ষা ড্যাব ড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার নাকটা আলতো করে টেনে দিলো। নক্ষত্র ওর ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বললো,
–“বর পছন্দ হয়েছে? পেট টানটান আছে তো? ভাল করে দেখে নাও।”
তিতিক্ষা কথাটা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। ইস! এই ছেলেটা ওকে লজ্জা দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। পেট টানটান হওয়ার কথাটা আর কতবার ওকে শুনতে হবে, কে জানে! তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। নক্ষত্র বললো,
–“চলো! আমাদের বের হতে হবে।”
তিতিক্ষা আরেক দফ অবাক হলো। কোথায় যাবে? কোথাও যাওয়া জন্য নক্ষত্র ওকে নিতে এসেছে? আচ্ছা! এর জন্যই তাহলে ওর আম্মু ওকে সাজতে বলেছে। তার মানে সবাই জানত আজকের নক্ষত্র আসবে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে গেল। ওকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছে না। মামনি নক্ষত্রকে বসতে বললো। নক্ষত্র আজকে আর বসলো না। মামনির থেকে বিদায় নিয়ে সে তিতিক্ষাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা গাড়িতে গিয়ে বসলো। নক্ষত্র গাড়ি স্টার্ট দিলো। তিতিক্ষা অভিমানি গলায় বললো,

–“আপনি আসবেন আমাকে বললেন না কেন?
নক্ষত্র মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললো,
–“বলে আসলে তো কেউ আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকাতো না।”
ইস! এই ছেলে আসলেই বড্ড ফাজিল। তিতিক্ষা চুপ করে গেল। কিই বা আর বলবে? বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিতিক্ষা বললো,
–“আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
নক্ষত্র মুচকি হেসে। ড্রাইভ করতে করতে তিতিক্ষার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল,
–“আমরা এখন যাচ্ছি আপনার শ্বশুড়বাড়ি।”
তিতিক্ষা চোখ বড় বড় নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে। ওরা নক্ষত্রদের বাসায় যাচ্ছে কথাটা শুনে তিতিক্ষার ভয়ও লাগছে, আবার ভালোও লাগছে।
তিতিক্ষার চুল গুলো অবাধ্য বাতাসে উড়ছে। নক্ষত্র মিটিমিটি হাসছে। তিতিক্ষা বাইরে দিকে নজর দিলো। রাস্তাতে মেয়েরা বাসন্তী রংয়ের শাড়ি পড়ে বের হয়েছে। ছেলেরা পাঞ্জাবী। ছোট বাচ্চারাও আজকে বসন্ত বরণের আয়োজনে উপস্থিত হয়েছে। ছোট মেয়েরা কেউ কেউ শাড়ি পড়েছে। মাথায় তাদের ফুলের ক্রাউন। চারদিকে বসন্তের গান শোনা যাচ্ছে । ফুলের দোকান গুলোতে ভিড় জমেছে। রাস্তায় আলাপনা দেওয়া হয়েছে। হরেক রকমের রং দিয়ে আলাপনার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তিতিক্ষা বাইরে দিকে তাকিয়ে এসব দেখছিলো। হঠাৎ করে নক্ষত্র তিতিক্ষার হাত টেনে ওর আঙ্গুলের ভাজে আঙুল গুঁজে দিলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্র এমন ভাব করছে যেন সে কিছুই করেনি। নক্ষত্র মিটিমিটি হেসে বললো,

–“আগের তুলনায় একটু গোলুমলু হয়েছ। তবে মন্দ লাগছে না।”
তিতিক্ষা লজ্জা পেলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার একটা হাত একহাতে ধরে আছে। আর এক হাতে ড্রাইভ করছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার লজ্জাটাকে আর একটু বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বললো,
–“তোমার লজ্জা মাখা গোলুমলু গাল দু’টো আমার হৃদয় হরণের অস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়ে আমার হৃদয়টাকে আর হরণ করো না। সে পূর্বেই মারাত্মক ভাবে ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে।”
তিতিক্ষা আর নক্ষত্রের দিকে তাকালো না। এই ছেলেটা ভারী দুষ্টু। এতদিন পর দেখা হলো। আর সে বার বার ওকে লজ্জা দিচ্ছে। যথাসময়ে নক্ষত্র ওদের বাসায় পৌঁছে গেল। মেইন গেট দিয়ে ওরা ঢুকে গেল। এপাশে বড় ফুলের বাগান। আর অন্য পাশে বাগানের মাঝখানে সাদা রংয়ের একটা দোলনা। তার একটু দূরে পানির ফোয়ারা; অনবরত পানি পড়ছে। সুন্দর পরিষ্কার পরিছন্ন আর পরিপাটি করে সব সাজানো। বাগানের ফুলের ঘ্রাণে চারপাশটা আরো মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। বাসার ঠিক দরজার সামনে গাড়িটা থামলো।
নক্ষত্র গাড়ি থেকে নেমে একটা ছেলের দিকে গাড়ির চাবিটা ছুঁড়ে দিলো। ছেলেটা হেসে চাবিটা ক্যাচ ধরে নিলো। নক্ষত্র ছেলেটাকে গাড়িটা পার্ক করতে বললো। নক্ষত্রদের বাগানে কোনো কিছুর আয়োজন চলছে। অনেকজন সেখানে সাজানোর কাছে লেগে গেছে। নজরকাড়া সৌন্দর্য নিয়ে বাগানটা সাজানো হচ্ছে।
দু’জনেই একই সাথে বাসায় ঢুকলো। ওদের বাসাটা তিনতলা। পুরোটাই ওরা ব্যবহার করে। বিশাল এড়িয়া নিয়ে বাসাটা তৈরী। তিতিক্ষাকে দেখে নক্ষত্রের আম্মু জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময় করলো। ড্রয়িংরুমে আরো অনেকজন মহিলা বসে ছিলো। এক একজনের সাজ মাথা ঘুরে যাওয়ার মত। উনাদের ড্রেসাআপ দেখে মনে হচ্ছে উনারা হাই সোসাইটি মানুষ। একজন মহিলা নক্ষত্রের আম্মুকে বললো,

–“এই পুতুলটা কে গো মৃধা।”
নক্ষত্রের আম্মু হেসে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্র একটু দূরে ফোনে কথা বলছে। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার থুতনি ধরে বললো,
–“এই পুতুলটা হলো আমার রাজকুমারের রাজরাণী।”
নক্ষত্রের আম্মু সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। তিতিক্ষা উনাদের সালাম দিয়ে কথা বললো। অদ্রি এসে তিতিক্ষাকে জড়িয়ে ধরলো৷ হাত ধরে টানতে টানতে তিতিক্ষাকে টেনে নিয়ে চলে গেল। নক্ষত্রদের বাসায় মিঃ আবরারের বিজনেস পাটনার এবং তাদের বউরা এসেছে। অদ্রি তিতিক্ষাকে বাগানে আনলো। বাচ্চারা মজা করছে, একটা লম্বা টেবিলের উপর হরেক রংয়ের আবির রাখা। পাশের টেবিলে মিষ্টি, সন্দেশ এসব রাখা। বাচ্চারা খাচ্ছে আর নাচছে। বাচ্চাদের গায়েও বসন্তের পোশাক। বসন্ত কি, ওরা না জানলেও মজা লুফে নিতে ছাড় দিচ্ছে না।
একটু পর আফান, রুহান, সাফওয়ান, মিষ্টি, সোনালী আসলো। মিষ্টি আর সোনালী নক্ষত্রের ফ্রেন্ড। ওরা এসে আরো হইচই শুরু করে দিলো। ওরা তিতিক্ষাকে ঘিরে ধরেছে। তিতিক্ষা মুচকি হেসে ওদের সাথে কথা বললো। মিষ্টি তিতিক্ষাকে দেখে বললো,
–“বুঝলাম! নক্ষত্র কেন তিতিক্ষার জন্য পাগল। এজন্য হারামিটাকে বারো’টা ভাষায় বারো বার প্রোপোজ করেও মন গলাতে পারিনি।”
একথা শুনে তিতিক্ষা হাসলো। সোনালী হাসতে হাসতে হাসতে বললো,
–“জানো, তিতিক্ষা? মিষ্টি যখন নক্ষত্রকে প্রোপোজ করতে নক্ষত্র তখন কি বলতো?”
রুহান সোনালীর মাথায় টোকা মেরে বললো,

–“তিতিক্ষা জানবে কি করে? তুই বলে আমাদের উদ্ধার কর। আর তুই এত হাসিস তোর মুখ ব্যাথা করে না?”
সোনালী রুহানের পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে দিলো। আফান আর সাফওয়ান চুপ করে আছে। কারন মিষ্টি আর সোনালী কথায় কথায় হাসতে হাসতে দুম করে মেরে দেয়। মার থেকে বাঁচার জন্য ওরা কিছুক্ষণের জন্য মুখটাকে রেস্ট দিচ্ছে। মিষ্টি মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
–“জানো? ফাজিলটাকে আমি প্রোপোজ করলে সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলতো, ওহ! ভালো তো।”
মিষ্টির কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে দিলো। তিতিক্ষাও হাসলো। আসলে ওরা সবাই খুব ভালো বন্ধু। মিষ্টি মজা করে নক্ষত্রকে প্রোপোজ করতো।
এটা ওর কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। একটু পর নক্ষত্র এসে তিতিক্ষাকে বললো,
–“অদ্রি, তিতিক্ষা, আম্মু তোমাদের ডাকছে।”
তিতিক্ষা একবার নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে অদ্রির সাথে চলে গেল। সবাই চেয়ার পেতে বসে আছে।
সোনালী নক্ষত্রকে পিঞ্চ মেরে বললো,
–“নজর কাড়া ফুলকে ফেলে রাখতে নেই। কখন কে এসে তার ঝুলি তুলে নিবে।”
নক্ষত্র সোনালীর কথা শুনে মুচকি হাসলো। বাগানে মেতে রাখা চেয়ারে সেও আরাম করে বসে বললো,
–“ফুলটাকে নক্ষত্রের নামে দলিল করা হয়ে গেছে। নজর কাড়া ফুল বলেই তাকে সবার আগে আমার ঝুলিতে সাজিয়ে রাখার কাজ সমাপ্ত। ”

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_23

নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষাকে একটা রুমে নিয়ে গেল। একটু পর অনুষ্ঠান শুরু হবে। মিঃ আবরার রেডি হয়ে বাগানে উপস্থিত হলেন। উনার বিজনেস পার্টনাররা এখানে উপস্থিত। তাদের সাথে উনি এখন কথা বলছেন। নক্ষত্ররা চেয়ার পেতে বসে আড্ডা দিচ্ছে। একটু পর পর নক্ষত্র বাসার দিকে তাকাচ্ছে। সেই কখন তিতিক্ষা বাসায় ঢুকেছে, এখনো বের হওয়ার নাম নেই। পানি খাওয়ার নাম করে নক্ষত্র এর আগে একবার দেখেও এসেছে। নক্ষত্রের আম্মু, তিতিক্ষা, অদ্রি একটা রুমের মধ্যে ঢুকে কি করছে, আল্লাহ মালুম। তিতিক্ষাকে আজকে এখানে নিয়ে আসার কারণ হলো, তিতিক্ষাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অনেকে মানতেই চায় না, নক্ষত্রের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। নক্ষত্রের আব্বুর কাছে নক্ষত্রের জন্য অহরহ বিয়ের প্রস্তাব আসে। এজন্য আজকে এখানে তিতিক্ষার আগমন ঘটেছে।
নক্ষত্র আর একবার বাসায় ঢুকলো। ওর আম্মুরা যে রুমে আছে। ওই রুমে নক করে বললো,

–“আম্মু কি করছো তোমরা? তারাতাড়ি এসো। আব্বু তোমাকে ডাকছে।”
–“আব্বু একদম মিথ্যা কথা বলবি না। আমরা আসছি একটু পর। তুই যা।”
–“আম্মু তিতিক্ষা কি রুমে আছে?”
–“না নেই। তোর বউকে আমি বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন যা তুই।”
–“আমার বউটাকে আমাকে দিয়ে দাও। আমি চলে যাচ্ছি। ”
–“ফাজিল ছেলে এখন জ্বালাবি না। না হলে তোর বউয়ের সামনে তোর কান মুলে দিবো।”
–“না থাক, লাগবে না। তোমরা তারাতাড়ি এসো, আমি যাচ্ছি।”
অদ্রি আর নক্ষত্রের আম্মু হাসছে। তিতিক্ষা মাথা নিচু করে আছে। এই ছেলেটাকে দেখে মন হয় কথায় জানে না। কিন্তু সে যে এতটা ফাজিল, তা বলার বাইরে। এর মাঝে কি লজ্জার ল ও নাই। ইস! কি লজ্জা। আম্মুর সাথে কেউ এভাবে কথা বলতে পারে? অদ্রি, নক্ষত্রের আম্মু আর তিতিক্ষা বের হলো। বাগানে সবাই বসন্তের ড্রেসে পরিহিত। নক্ষত্রের আম্মু, অদ্রি, তিতিক্ষাও আসলো বসন্তের সাজে নিজেদের সজ্জিত করে।
আজকে বসন্ত উৎসবে মুখোরিত চারপাশ। হিমেল হাওয়া বইছে অথচ তপ্ত নয়। আবার তপ্ত বাতাস অথচ হিমেল নয়। এক অপূর্ব অনুভুতির হাওয়া প্রকৃতিতে বয়ে চলে, পুরো বসন্ত জুড়ে। ফাল্গুনের প্রথম প্রহরে উপস্থিত মানুষ গুলোর নাচে, গানে, বাগানটা মুখরিত করে হয়ে উঠেছে। এত এত আয়োজনে বরণ করে নিচ্ছে বসন্তকে। বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে বৈশাখের পরেই পহেলা ফাল্গুনের জনপ্রিয়তা সবচাইতে বেশি। এজন্য এত আয়োজন।

নক্ষত্রের আম্মু, অদ্রি আর তিতিক্ষা বাসন্তি রংয়ের শাড়ি পড়ে বাগানে উপস্থিত হলো। তিনজনেই এক সাথে হেঁটে আসছে। সবার নজর এখন ওদের দিকে।
তিনজনের খোঁপাতে কাঠবেলীর মালা। বাসন্তী রঙের চওড়া সবুজ পাড়ের শাড়ি। সিম্পল সাজেও গর্জিয়াস লাগছে ওদের। সাফওয়ান আর রুহান তো সিটি বাজানো শুরু করলো। নক্ষত্রের আম্মু ওদের দিকে তাকিয়ে মার দেওয়ার ইশারা করলো। মা, বোন, বউকে দেখে নক্ষত্রের মুখে হাসি ফুটলো। তিনজনের সাজ, ড্রেসআপ এখানকার সবার থেকে ভিন্ন। আর্কিট্রেক্ট নাহিয়ান আবরারের মা, বোন, বউ বলে কথা। তাদের একটু ভিন্ন সাজে উপস্থিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
নক্ষত্রের আব্বু তিতিক্ষাকে উনার পাশে দাঁড় করালো। তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে, মুচকি হাসি দিয়ে এনাউন্স করার জন্য মাইক্রোফোন হাতে নিলো।
নক্ষত্রের আব্বু নক্ষত্রকেও ডেকে নিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দু’জনকে দেখে সবার মুখ দিয়ে একটা কথায় বের হলো; সেটা হলো মাশাল্লাহ। তিতিক্ষাকে শাড়ি আর নক্ষত্রকে পাঞ্জাবীতে মনে হচ্ছে, নতুন বর বউ। নক্ষত্রের আব্বু তিতিক্ষার দিকে তাকি বললো,
–“এই হলো তাবিয়া নুজহাত তিতিক্ষা। তিতিক্ষা আগে আমার আম্মু, পরে আমার পুত্রবধূ। আপনারা হয়তো জানতেন না, আমার ছেলে নাহিয়ান এনগেঞ্জড। এজন্য আজকে সবাইকে জানিয়ে দিলাম। সাথে পুত্রবধূকেও দেখিয়ে দিলাম।”
এতকিছু হবে তিতিক্ষা ভাবতেও পারেনি। মৃদুভাবে সে কাঁপছে। আজকে নিজেই অবাক হচ্ছে নিজের সৌভাগ্য দেখে। কতটা ভাগ্যবতী হলে কেউ এমন শ্বশুড়-শাশুড়ি পায়।

তিতিক্ষার চোখে কোণে পানি জমে গেছে। এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো ওর গাল বেয়ে। নক্ষত্র তখন ধীর কন্ঠে বললো,
–“মিসেস নাহিয়ান, আপনি কাঁদছেন কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
তিতিক্ষা মাথা নাড়িয়ে না বলে মুচকি হাসলো। সবাই ওদের অভিনন্দন জানালো। বড়রা একদিকে মজা করছে, ছোটরা আরেকদিকে। আবির দিয়ে সবাই সবাইকে রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে। তবে নক্ষত্র ও নিজে ছাড়া অন্য কাউকে তিতিক্ষাকে আবির লাগাতে দেয়নি। নক্ষত্র সিঁদুর লাল আবির নিয়ে তিতিক্ষার দুই গালে একটু করে লাগিয়ে দিয়েছে। তিতিক্ষা লজ্জায় নক্ষত্রকে দেয়নি। তবে বাকিরা আবির দিয়ে ভূত সেজেছে। সাফওয়ান, রুহান নক্ষত্রের অবস্থা দফারফা করে দিয়েছে।
সন্ধ্যা অবধি অনুষ্ঠান চললো। এরপর সবাই আস্তে আস্তে বিদায় নিলো। তবে যাওয়ার আগে তিতিক্ষাকে প্রায় সবাই কিছু না কিছু উপহার দিয়ে গেছে। নক্ষত্রের আব্বু, আম্মু, অদ্রি, তিতিক্ষা ফ্রেশ হয়ে এসেছে। নক্ষত্র রুহানকে এগিয়ে দিয়ে কেবল বাসায় ফিরলো। রুমে গিয়ে একেবারে শাওয়ার নিয়ে নিচে আসলো। নক্ষত্রকে রান্না ঘরে ঢুকতে দেখে সার্ভেট জিজ্ঞাসা করলো,
–“স্যার কিছু লাগবে?”
–হুম! আমি করে নিচ্ছি। আপনি যান।”
–“ওকে।”

নক্ষত্রের আব্বু আম্মু গল্প করছে। অদ্রি তিতিক্ষাকে ওদের পুরো বাসাটা ঘুরে দেখাতে নিয়ে গেল। অনেক বড় আর অসম্ভব সুন্দর করে বাসাটা সাজানো। নক্ষত্র নাকি নিজে এই বাসাটা সাজিয়েছে। আগে যেটাতে থাকতো, ওটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নিচে পাঁচটা রুম, নিচের রুমগুলোতে সার্ভেন্টরা থাকে। দোতলায় ওরা সবাই থাকে। তিতিক্ষার বার বার চোখ আটকে যাচ্ছে দেয়ালের কালারের উপর বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন গুলোতে। অদ্রি ওর আব্বু আম্মুর রুমটাও ঘুরে দেখালো। সব শেষে ওকে নিয়ে গেল নক্ষত্রের রুমে। তিতিক্ষা বুঝতে পারছে না এটা রুম নাকি গড়ের মাঠ। রুমের মধ্য ঢুকে আরো দুইটা রুম। নক্ষত্রের আর্কিটেকচার সহ আরো বিভিন্ন জিনিস একটা রুমে। ওর পারসোনাল কাজের ঘর আর কি। সেটাও পরিপাটি করে সাজানো। এত বড় বড় রুমে একটু জায়গাও ফাঁকা নেই। রুচিসম্মত, আসবাবপত্র, রং, পেইন্টিং, সোফা থেকে শুরু করে আরো জিনিসে পরিপূর্ণ করা। জানালার পর্দা, বেডশীট থেকে শুরু সব নজর কাড়া। তিতিক্ষা মনে মনে বললো,
–“আর্কিট্রেক্ট সাহেবের পছন্দ আছে বলতে হবে। উনার পছন্দ আর পেশা দুটোই পারফেক্ট। ”
তিতিক্ষার সব চেয়ে মন কেড়েছে রুমের মধ্যে আলাদা করে নামাজের জায়গা দেখে। একদম নিরিবিলি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা নামাজের জায়গাটা। এখানে কোনো প্রকার পেইন্টিং নেই।

ছোট একটা আলনাতে দুইটা জায়নামাজ, ছোট একটা সেন্টার টেবিলে কুরআন আর তসবিহ্ রাখা। বড় বড় ফ্ল্যাটে এত এত জিনিস থাকলেও, নামাজের জায়গা থাকে না। তিতিক্ষা এর আগে দেখেনি এভাবে আলাদাভাবে নামাজে জায়গা রাখতে। এই ব্যাপারটা তিতিক্ষার খুব মন কেড়েছে। নামাজের প্রতি যত্নশীল না হলে এমন আইডিয়া মাথায় আসার কথা না। নক্ষত্র যতই মর্ডাণ, হাই সোসাইটির মানুষ হোক, সে যে নামাজের প্রতি খুব যত্নশীল, এটা বুঝতে পেরে তিতিক্ষার মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল।
অদ্রির একটা ফোন এসেছে। এজন্য সে ওর রুমে চলে গেল। নক্ষত্রের বেডের সামনে একটা পিকের দিকে তিতিক্ষার নজর আটকে গেল। এটা ওদের এনগেজমেন্টের দিনের পিক। নক্ষত্রের দিকে তিতিক্ষা যখন কান্নাভেজা চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। সেই মুহূর্তে তোলা এই পিকটা। তিতিক্ষা পিকটার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। নক্ষত্র কখন এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে, ওর খেয়ালই নেই। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে কফি এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“উহুম!উহুম! ম্যম আপনার কফি।”
তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে কফিটা নিলো। কফির মগটা নিয়ে তিতিক্ষা চুমুক দিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নিয়ে ওর বারান্দায় গেল। বারান্দাটা আরো সুন্দর করে সাজানো। নক্ষত্র ওর কফির মগটা পাশে রেখে ঝুলানো একটা খাঁচা থেকে একটা ঝুঁটি ওয়ালা পাখি বের করলো। পাখিটার নাম কোকাটিয়েল। পুরো বডি এ্যাশ কালার আর মাথাতে হলুদ রংয়ের বড় একটা ঝুঁটি। অবাক করা ব্যাপার, পাখিটা নক্ষত্রের উপর রেগে আছে। প্রচন্ড রেগে ওর মাথার ঝুঁটিটা খাঁড়া করে রেখেছে। খাঁড়া করা ঝুঁটি দেখে মনে হচ্ছে, কেউ ওর ঝুটিয়ে জেল দিয়ে খাঁড়া করে দিয়েছে। রাগে সে গজগজ শব্দ করছে। নক্ষত্র ধরতে গেলেই সে নক্ষত্রের হাত কামড়াচ্ছে। তিতিক্ষা অবাক হয়ে ওদের কান্ড দেখছে। নক্ষত্র পাখিরার মান ভাঙ্গাতে বলছে,

–“আচ্ছা বাবা, আমি সরি। খুব সরি। আর কোনদিন সারাদিন তোকে বন্দী করে রাখবো না। ”
পাখিটা নক্ষত্র দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ধরতে গেলে নক্ষত্র হাত কামড়ে দিচ্ছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“এর নাম ইতু। আমার উপর সে খুব রেগে আছে। আজকে সারাদিন ওকে বন্দী করে রেখেছি। এজন্য উনার খুব রাগ হয়েছে।”
একটু পর ইতুর রাগ কমলো। তিতিক্ষা পাখিটাতে গলাতে হাত বুলিয়ে দিলো। পাখিটাকে কোলে নিয়ে আদর করলো। তিতিক্ষা ছাড়তেই ইতু নক্ষত্রের হাতের উপর বসলো। নক্ষত্র আর তিতিক্ষা নিচে গেল। ইতুকে দেখে নক্ষত্রের আম্মু বললো,
–“আজকে সারাদিন ইতু একটুও ডাকাডাকি করে নি। এটা এত ভদ্র হলো কি করে?”
নক্ষত্র মুচকি হেসে বললো,
–“সে খুব রেগে ছিলো। এজন্য ডাকাডাকি করেনি।”
নক্ষত্রের আব্বু পর পর নক্ষত্রের পিঠে দুবার শব্দ করে মারলো। ইতু উড়ে গিয়ে নক্ষত্রের আব্বুকে কামড়াতে লাগলো। চি চি শব্দ করছে আর নক্ষত্রের আব্বুকে কামড়াচ্ছে। তিতিক্ষা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছে। ইতু যে নক্ষত্রের অন্ধভক্ত, এটা তিতিক্ষার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না। ইতুর কান্ড দেখে সবাই হো হো করে হেসে দিলো। অদ্রি এসে ইতুকে নিয়ে গেল। ওর ফোনে ওর বান্ধবীর কল এসেছে। এজন্য কথা বলতে বলতে আবার রুমে চলে গেল। তিতিক্ষা নক্ষত্রের আম্মুর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা বললো,
–“আম্মু বলছিলাম, যে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বাসায় যেতে হবে।”
নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। উনার এভাবে তাকানো দেখে তিতিক্ষা ঢোক গিললো। নক্ষত্রের আম্মু বললো,

–“আমাদের সাথে থাকতে তোর ভালো লাগছে না?”
–“আসলে তা না!”
–“তাহলে থাকতে সমস্যা কোথায়? কালকে নক্ষত্র তোকে দিয়ে আসবে। আজকে আর যাওয়ার দরকার নেই। একটা দিন এখানে থাক। কয়েকদিন পর তো এখানে এসেই তো থাকতে হবে।
–“(নিশ্চুপ)
–“শোন! আমি তোর আম্মুর থেকে পারমিশন নিয়েছি।”
–“আম্মু এখানে কয়েকদিন থাকো। তোমার কি খারাপ লাগছে?” (মিঃ আবরার)
–“জ্বি না আব্বু।”
তিতিক্ষা মুচকি হাসলো। নক্ষত্রের আব্বুর ফোনে কল আসলো। উনি কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার সাথে গল্প করছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। তিতিক্ষা না তাকালেও বুঝতে পারছে, নক্ষত্রের দৃষ্টি ওর দিকে। বিভা তিতিক্ষাকে ফোন দিলো। তিতিক্ষা বিভার সাথে কথা বললো। নক্ষত্রের আব্বুর ডাকে নক্ষত্রের আম্মু চলে গেল। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নিয়ে ছাদে গেল। ফুলের মাতোয়ারা ঘ্রাণ চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। আকাশে ইয়া বড় চাঁদ উঠেছে। নক্ষত্র আর তিতিক্ষা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বাগানের মাঝখানে পানির ফোয়ারাটা দেখা যাচ্ছে। পানির মাঝখান থেকে নীল লাইট জ্বলছে। দেখতে আরো আকর্ষণীয় লাগছে। নক্ষত্রকে চুপ থাকতে দেখে তিতিক্ষা বললো,

–“আপনার কি মন খারাপ?”
–“উহুম, না! তবে তোমার আব্বুর উপর খুব রাগ হয় আমার।”
তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্রে দৃষ্টি একটু অন্য রকম। তিতিক্ষা মৃদু হেসে বললো,
–“কেন? আমার আব্বু আপনার কি করেছে শুনি।”
নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নিয়ে ছাদের দোলনাকে বসলো। তিতিক্ষার কাঁধে ওর মাথা রেখে বললো,
–“তোমার আব্বুকে আমি সরাসরি আমাদের বিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। উনি বিয়ে না দিয়ে এনগেজমেন্টটা করে রেখে দিলেন।”
তিতিক্ষা শব্দহীন ভাবে হাসলো। নক্ষত্রের কথার মাঝে অভিমানের সুর স্পষ্ট। তিতিক্ষা চাঁদের দিকে তাকালো। নক্ষত্র তিতিক্ষার হাতের আঙ্গুলের ভাজে নিজের আঙ্গুল রেখে বললো,
–“পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়ে গেলে আমরা তো আর আলাদা থাকতাম না।”
–“ইনশাআল্লাহ! খুব দ্রুত আসবে সেই দিন।”

আকাশের চাঁদটা ওদের সঙ্গ দিচ্ছে। মৃদু বাতাসে নক্ষত্র দুষ্টু চুল নড়ে উঠছে। তখন তিতিক্ষার গলাতে সুড়সুড়ির লাগছে। তবুও তিতিক্ষা চুপ করে থাকে। নক্ষত্র এখনো তিতিক্ষার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার চুলের কাটা টা খুলে দিলো। চুল গুলো দূরন্ত গতিতে তিতিক্ষার পিঠে ছড়িয়ে পড়লো। তিতিক্ষা শুধু নক্ষত্রের কান্ড দেখছে। নক্ষত্র যে ওকে সব সময় পাশে চাই, এটা তিতিক্ষাও বুঝতে পারে। কালকে তিতিক্ষা চলে যাবে, আবার কবে ওদের দেখা হবে, এটা ভেবে তিতিক্ষার মনটাও কেমন জানি করছে। দু’জনের মনে চলেছে একই অনুভূতির ছুটাছুটি। রাতের আঁধারটা আজকে খুব ভালো লাগছে। মৃদু বাতাসে এসে শরীর লাগছে। অনেকক্ষণ ওরা গল্প করলো। আজকে এই মুহূর্তটা ওদের কাছে স্মরনীয় হয়ে থাকবে।
সবটা যে এভাবে লন্ড ভন্ড হয়ে যাবে, নক্ষত্র আর তিতিক্ষা কেউ এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলো না।
তিতিক্ষা ওর রুমের বারান্দায় বসে অঝোরে কাঁদছে। চোখে অবাধ্য পানি গুলো গাল গড়িয়ে পড়ছে। শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গেছে। বাসাটা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। সাজানো গুছানো সম্পর্ক গুলো এভাবে নষ্ট না হলেও তো পারতো। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন ওদের কেন হতে হলো? ওদের এত সুন্দর সম্পর্কের মাঝে এত দ্বিধা দ্বন্দের সৃষ্টি কেন হলো? এত ভাল সময় কাটানো, নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবাটাই কি তাহলে কাল হয়ে দাঁড়ালো? এজন্যই কি এত সুখের পরে নিষ্ঠুর এক কষ্টের আগমন ঘটলো। সবার সাথে সবার এত ভাল সম্পর্ক তৈরী হওয়াটাই কি তাহলে ঝড়ের আগের পূর্বাভাস ছিলো?

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_24

নক্ষত্রের বাসা থেকে ফেরার পর তিতিক্ষার সময়টা ভালোই যাচ্ছিলো। নবিন পড়াশোনা শেষ করে একটা জব পেয়েছে। অফিসের যাতায়াতের সুবিধার জন্য অফিসের পাশেই দুই রুমের একটা বাসা নিয়েছে। তিতিক্ষা আর বিভা নিজে গিয়ে নবিনের রুম সাজিয়ে দিয়ে এসেছে। এজন্য নবিনকে ওদের ট্রিট দিতে হয়েছে। তিতিক্ষার আপাতত পড়াশোনার চাপ নেই। বুটিক ঘরেই সে সময় দিচ্ছে। নক্ষত্রের সাথে খুনশুটি, চুপিচুপি দেখা করা, ঘুরাঘুরি, ভাইবোনদের সাথে আড্ডা দিয়েই ওর দিন কাটছে।
দুই সপ্তাহ পর….!!
সবটা ঠিকই ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে দমকা হাওয়ার মতো শান্তি নামক সুখপাখি ওদের জীবন থেকে উড়ে গেল। কালকে রাতে নক্ষত্রকে অনেক বার ফোন দেওয়ার পরও সে ফোনটা রিসিভ করেনি। কেন রিসিভ করেনি, সেটা তিতিক্ষার অজানা। তিতিক্ষা মনে মনে নক্ষত্রকে এত এত বকা দিলো। মনের মধ্যে এক রাশ অভিমান নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন সকালবেলা নক্ষত্রের আব্বু, আম্মু আর অদ্রি তিতিক্ষাদের বাসায় উপস্থিত হয়েছে। তিতিক্ষা মুচকি হেসে উনাদের সালাম দিলো। নক্ষত্রের আব্বু সালামের উত্তর দিলো। তিতিক্ষা ওদের মুখের দিকে তাকালো। কারো মুখে হাসির ছিটে ফোঁটাও নেই। মামনি এসে উনাদের সাথে কথা বললো। কেন জানি অজানা একটা ভয় এসে তিতিক্ষার মনে হানা দিচ্ছে।
কি হয়েছে? ভয়ংকর কিছু? সবার মুখের এই অবস্থা কেন? অদ্রির চোখের অঝরে অশ্রু ঝরছে। ওর গালে মারের দাগ স্পষ্ট। ঠোঁটের কোণা কেটে ফুলে গেছে। নক্ষত্রের আম্মু চোখ মুখ ফুলে আছে। নক্ষত্রের আব্বু শান্ত কন্ঠে তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,

–“তিতিক্ষা আম্মু নবিন কি বাসায় আছে? ওকে ডেকে দাও । বলো, ওর সাথে আমরা কথা বলতে এসেছি।”
–“জ্বি আব্বু।”
তিতিক্ষা নবিনকে ডাকতে গেল। মামনি কিছু বুঝতে পারছে না। নবিন এসে উনাদের সামনে দাঁড়ালো। নবিনের দৃষ্টি অদ্রির দিকে। নবিন কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। সে মাথা নিচু করে সামনের সোফাতে বসলো। নক্ষত্রের আব্বু আগে কথা বললো,
–“আমরা কেন এসেছি? আশা করি, তুমি ভাল মত বুঝতে পারছো। এসবের কি খুব প্রয়োজন ছিলো?”
নবিন মাথা কিছু বলতে যাবে, তার আগে নক্ষত্রের আম্মু মুখ খুললো,
–“তোমার এত বড় স্পর্ধা কিভাবে হলো যে আমার মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়িয়েছো? লজ্জা করে না তোমার? বিন্দু মাত্র লজ্জাবোধ, বিবেক, বুদ্ধি, শিক্ষা আছে কি তোমার? যে বাসায় তোমার বোন যাবে, সে বাসার মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো। এই তোমার শিক্ষা?”
নক্ষত্রের আব্বু উনার স্ত্রীকে থামতে বললেন। সবাই বসে ব্যাপারটা সামলাতে হবে। নক্ষত্রের আব্বু শান্তভাবেই কথা বলার জন্য উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু যেখানে মেয়েরা আগ বাড়িয়ে কথা বলে। সেখানে সু-শৃঙ্খলভাবে আদও কিছু হয় বলে উনার জানা নেই। অদ্রির পাশে তিতিক্ষা গিয়ে দাঁড়ালো। এদিকে নক্ষত্রের আম্মু থামছে না। নিজের ছেলেকে এমন করে কথা শুনাতে দেখে মামনি নক্ষত্রের আম্মু কথা ধরলো।
–“এভাবে কথা বলছেন কেন? আপনি কোন অধিকারে আমার ছেলের সাথে এভাবে কথা বলছেন?”
নক্ষত্রের আম্মু মামনির কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। উনি আরো কঠিন গলায় বললেন,

–“কেন বলছি? আপনার অসভ্য, বেয়াদব ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন।”
একদিকে নক্ষত্রের আম্মু, অন্যদিকে মামনি দু’জনেই রেগে গেছে। নবিনের বাবা চেচাঁমেচি শুনে ড্রয়িংরুমে আসলো। তিতিক্ষার শরীর থরথর করে কাঁপছে। উনাদের চেচাঁমেচিতে বিভা, আহানও দৌড়ে আসলো। নবিনের আব্বু সোফাতে বসে নক্ষত্রের আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো,
–“ভাই কি হয়েছে? আমাকে খুলে বলুন। বেয়ান আগে আমরা সবটা শুনি। তারপর যা করার করবো।”
নক্ষত্রের আব্বু নবিনের আব্বুর দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবেই বললো,
–“কালকে সন্ধ্যায়, আমাদের এক প্রতিবেশী আমাদের বাসায় এসেছিলো। উনি বললো, কালকে নাকি অদ্রি আর নবিনকে একসাথে দেখেছে।
অদ্রি আর নবিনের মধ্যে যে রিলেশন আছে, আমরা জানতাম না। যদি জানতাম, তাহলে নক্ষত্র আর তিতিক্ষার মত ওদেরও মেনে নিতাম। কিন্তু ওরা ওদের সম্পর্কটাকে আরো কয়েকধাপ এগিয়ে গেছে। কালকে অদ্রি আর নবিন নাকি হসপিটালে গিয়েছিলো।”
নবিনের আব্বু নক্ষত্রের আব্বুর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। উনি ঘামছেন, নিজের মেয়ের অপরাধে কথা নিজেকে বলতে হচ্ছে। উনি যথেষ্ট স্পষ্টবাদী মানুষ। উনার কাছে ভুল মানে ভুলই। সেটা ছেলে করুক বা মেয়ে করুক। মিঃ আবরার পানিটা খেয়ে আবার বললো,
–“কালকে নবিন অদ্রিকে এবোর্শন করাতে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো। ওরা সম্পর্কটা এবোর্শনের মতো জঘন্য ব্যাপার অবধি চলে গেছে। নবিন এসবের তো কোনো দরকার ছিল না। আমাদের ওই প্রতিবেশী এদের সব কথা শুনেছে। প্রমান সহ আমাদের দেখিয়েছে। ভাই আপনার মত অনুযায়ী বলুন, আমরা এখন কি করবো?”

এটা শুনে তিতিক্ষার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। অদ্রি আর নবিন এমনটা করতে পারলো। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে খারাপ ভাবে স্পর্শ করবে না। তাই বিয়ে করে ফেলছে। আর সেখানে নক্ষত্রের বোন বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট। এমন জঘন্য কাজ ওরা কিভাবে করতে পারলো? নবিন মাথা নিচু করে বসে আছে। নক্ষত্র এখানে উপস্থিত নেই। নক্ষত্র এখানে থাকলে কি বলতো? সে কার দিকে আঙ্গুল তুলতো, বোনের দিকে নাকি বউয়ের ভাইয়ের দিকে? বোনকে কি বলতে পারতো, তুই প্রেগন্যান্ট হয়েছিস কেন? নাকি ভাই হয়ে বলবে, বোন তুই রুম ডেট করেছিস কেন? নাকি বলবে, আর ছেলে পাস নি, নবিনকেই বা কেন? আসলেই কি বোনকে কি এসব বলা যায়? নক্ষত্র তাহলে কি করতো? নবিনের আব্বু এসব শুনে নবিনের গালে দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। অদ্রি এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। মামনি উনার হাজবেন্ডকে বলে উঠলো,
–“তুমি কেন আমার ছেলেকে মারলে? উনাদের কথা পরখ না করে কেন উনাদের সাপোর্ট করছো? উনি তো আমার ছেলের দোষ দিচ্ছে, এক হাতে তো তালি বাজে না।” (মামনি)

–“তুমি চুপ করো!”
–“কেন চুপ করবো? উনাদের মেয়ে কি ধোঁয়া তুলসি পাতা। আমার ছেলের কাছে কেন এসেছিলো? কে আসতে বলেছিলো? নিজেদের মেয়ের দোষ না দেখে কেন শুধু আমার উপর দোষ দিচ্ছে?”
নক্ষত্রের আম্মু উঠে দাঁড়ালো। মামনির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আমার মেয়ের দোষ আছে বলেই কালকে থেকে ও আমাদের কাছে মৃত। আপনার ছেলের দোষ আছে বলে, আপনাদের জানিয়ে দিলাম। এছাড়া আপনাদের বাসায় আমরা পা ও রাখতাম না।”
মামনি একথার প্রতি উত্তরে বলে উঠলো,
–“আমরাই মানুষ চিনতে ভুল করেছি। না হলে আপনাদের মত মানুষের সাথে আত্মীয়তা করি? আর আপনারা পা না রাখলে আমরা না খেয়ে মরবো না।”
নক্ষত্রের আব্বু উনার স্ত্রীকে থামতে বলছেন। উনি কিছুতেই থামছে না। উনার মধ্যে যেন রাগের ফুলকি দাউদাউ করে জ্বলছে। উনি এবার বললো,

–“আপনাদের কোনো যোগ্যতায় নেই আমাদের সাথে আত্মীয়তা করার। আমার ছেলে আপনাদের ঘরে পা রেখেছে, আপনাদের সৌভাগ্য। এছাড়া কোনো দিক দিয়ে আপনাদের সাথে আমাদের যায় না। আজকে যদি আপনাদের সাথে আত্মীয়তা না করতাম, তাহলে হয়তো এসব ঘটতো না। খাল কেটে কুমির তো আমরাই ডেকেছি।”
তিতিক্ষা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। দুই পরিবারের ভাঙ্গনের শুরু। আচ্ছা, নক্ষত্র আর তিতিক্ষার বিচ্ছেদই কি এর চূড়ান্ত ফলাফল?
নবিন আর অদ্রির ভুলের জন্য আজকে নক্ষত্র আর তিতিক্ষা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। নক্ষত্রের আম্মু শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে নক্ষত্রের আব্বুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“তোমার ছেলের জন্য আজকে এই অঘটন ঘটলো। এবার তোমার ছেলে খুশি তো? আর কোনো পরিবার সে খুজে পেলো না? এই পরিবারের মেয়েকেই তার পছন্দ করতে হলো? আজকে পরের মেয়ের জন্য নিজেদের সন্মানটাই হারাতে বসেছি। এসব শুনে ওর কলিজাটা ঠান্ডা হলো তো? যার বোনের জন্য এত কিছু করলো। সেই তার বোনের গায়ে কংঙ্কের কালি লাগিয়ে দিলো। এরপরও কি সে এই বাসার মেয়েকে বিয়ে করবে? এই বাসার ছেলের জন্য আমার মেয়েদের গায়ে কালি লেগেছে। আমি আর এদের সাথে কোনভাবেই সম্পর্ক রাখবো না। আমি যেহেতু বলেছি না, তো না’ই। আমি এই বাসার মেয়েকে আমার ছেলের বউ করতে পারবো না। আমি নিজে ভেঙে দিলাম এদের সাথে সম্পর্কটা। আর নক্ষত্রকেও আমি ক্ষমা করবো না।
মিঃ আবরার উনার মিসেসকে ধমকে বললো,

–“এখানে নক্ষত্র আর তিতিক্ষার কি দোষ? ওদের টানছো কেন? মৃধা রাগের মাথায় বোকামি করো না, যার জন্য পরে তোমাকে পস্তাতে হয়। নক্ষত্র এখানে নেই, ওকে না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত তুমি নিতে পারো না।”
নক্ষত্রের আম্মু চোখের পানি মুছে তিতিক্ষার দিকে তাকালো। উনার বুক ফেটে যাচ্ছে; তবুও কিছু করার নেই। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার হাত রেখে ওদের এনগেজমেন্টের রিংটা খুলে নিলো। তিতিক্ষা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এই রিংটা দিয়েই নক্ষত্রের নামের সাথে তিতিক্ষার নামটা বেঁধে দিয়েছিলো। তিতিক্ষার চোখের পানিতে ওর ওড়না ভিজে যাচ্ছে। ওর কান্নার কোনো শব্দ নেই। কিন্তু অবাধ্য বেহায়া চোখের পানি ঝরতেই আছে। বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে। সবার চোখে পানি। কিন্তু কিছু করার নেই, পরিস্থিতি উল্টো দিকে মোড় নিয়েছে। নক্ষত্রের আম্মু মিঃ আবরারের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আমি জানি আমার ছেলে আমার অবাধ্য হবে না। যদি হয়েও থাকে, তাহলে এদের মত অকৃতজ্ঞ বেইমান ছেলে মেয়েদের জন্ম দেওয়ার অপরাধে আমি এই পৃথিবীর বুকে নিজের অস্তিত্ব রাখবো না।”
মামনি তিতিক্ষার চোখ মুছে দিলো। সোজা ভাবে দাঁড় করিয়ে বললো,
–“তুই কেন কাঁদছিস? তোর জন্য কি ছেলের অভাব হবে নাকি? তুই কাঁদবিনা, নক্ষত্রের থেকে ভালো ছেলে খুঁজে দিবো। জীবন কারো জন্য পড়ে থাকে না।”

এই কথা শুনে তিতিক্ষা আবার দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িলো। বেইমান শরীরটাও আর চলছে না। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে। নক্ষত্রের হাসি হাসি মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। এই ঝড়টাতে সব লন্ড ভন্ড করে দিলো। ওর সব অনুভুতি এক নিমেষেই চূর্ণ বিচূর্ন হয়ে গেছে। মাথা ঘুরছে, চোখের পানির ঝাপসা দেখছে সবকিছু। আহান আর বিভা কাঁদছে। নবিন নিজেও কাঁদছে তিতিক্ষার অবস্থা দেখে। নবিন চোখের পানি মুছে মাথা নিচু করে বললো,
–“বাচ্চা যেহেতু আমার। আমিই অদ্রিকে বিয়ে করবো।”
মামনি নবিনের মুখে এই কথা শুনে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
–“না! যে মেয়ে বিয়ের আগে পেট বাঁধাতে পারে। সে মেয়েকে আমি আমার সংসারে ঢুকতে দিবো না। কতটা বেহায়া হলে এমন কান্ড ঘটাতে পারে। এই মেয়েকে কিছুতেই আমি আমার বাসায় থাকতে দিবো না।”
–“তাহলে আমাকেই বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। ভুল যখন করেছি, ভুলটা শুধরানোর দায়িত্বটাও আমার। আমি অদ্রিকে ভালবাসি, তাকে মাঝ পথে ছাড়তে আমি পারবো না।” (নবিন)

নক্ষত্রের আম্মু অদ্রির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কালকে অদ্রি উনি অনেক মেরেছে। এই প্রথম উনি অদ্রির গায়ে হাত তুলেছে। মারতে মারতে অদ্রিকে অঙ্গান করে তবেই উনি ছেড়েছে। রুমের দরজা আটকে থাকার জন্য মিঃ আবরার ধরতেও পারেনি। উনি ছেলে-মেয়েকে ভালোও বাসেন আবার শাসণও করেন। মা বলে যে অদ্রিকে ছাড় দিবে, তিনি এটা করেনি। নক্ষত্রের আম্মুর প্রচুর জেদ। যখন যা বলে, সেটা করেই ছাড়ে। উনি যখন ভালো মুডে থাকেন, তখন মনে হয় উনার মত মানুষ পৃথিবীতে নাই। কিন্তু যখন রেগে যান তখন উনি কাউকে ছাড় দেয় না। নিজের স্বামী-সন্তানকেও না। নক্ষত্র ওর মায়ের এই গুনটা খুব ভাল মতই পেয়েছে। এত কিছু নক্ষত্র জানে না। পরশু রাতে সে ঢাকাতে গেছে। ওকে এসবের কিছু জানানো হয়নি। নক্ষত্রের আম্মু অদ্রির দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
–“রাস্তা পথে তোর সাথে আমার দেখা যেন না হয়। এমন বিবেক, বোধহীন, নিলজ্জ, বেহায়া, আমার মেয়ে হতেই পারে না। তুই আমার কাছে মৃত। কাল সন্ধ্যায় থেকে তুই আমার কাছে মৃত হয়ে গেছিস, আর এখন তোকে মনে মনেই দাফন করে দিলাম।”

কথাটা বলে উনি মিঃ আবরারকে নিয়ে চলে গেল। অদ্রি মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। একদিকে অদ্রি আরেক দিকে তিতিক্ষা কাঁদছে। কে কাকে কিভাবে শান্তনা দিবে? ড্রয়িংরুম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। এই ড্রয়িংরুমেই নক্ষত্রের সাথে ওর পথচলা শুরু হয়েছিলো। তাহলে আজকে এখন এই স্থানেই কি সব সমাপ্ত ঘটবে। উপস্থিত কারো মুখে কোন কথা নেই। বোনের এমন করুণ অবস্থার জন্য নবিনের মরে যেতে ইচ্ছা করছে। সে তো এমনটা চাইনি। তাহলে কেন এমনটা হলো? ভাইয়ের জন্য বোনের স্বপ্ন, ইচ্ছা, শখ, আহ্লাদ সব শেষ। পরবর্তীতে কিভাবে বোনের সামনে সে দাঁড়াবে? কোন বিবেক নিয়ে বোনের সাথে কথা বলবে? তিতিক্ষাই বা এমন ভাইকে আগের মত সন্মান করতে পারবে কি না কে জানে।
নবিনের আব্বু কাজি ডেকে আনলো। উনার উপস্থিতিতে বিয়ে অদ্রি আর নবিনের বিয়ে সম্পূর্ণ করলো। অদ্রির গলা ভেঙে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। নক্ষত্রের আদরের বোনটা কি অবস্থা? নবিন সোফা থেকে উঠতেই, মামনি নবিনকে কড়া কন্ঠে বললো,
–“তুমি এই মেয়েকে নিয়ে এক্ষুণি এই বাসা থেকে বেরিয়ে যাও। এই বাসায় আর ভুলেও এসো না। আমি আগে তোমাকে মানুষ ভাবতাম। কিন্তু তুমি অমানুষে পরিণত হয়েছে। মানুষ হলে এসব করার আগে বোনের কথাটা একটাবার হলেও ভাবতে। এমন নোংরা কাজে লিপ্ত হওয়ার আগে তোমার বুকটা কেঁপে উঠতো।”

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৯+২০+২১

নবিন মাথা নিচু করে ওর রুমে চলে গেল। ওর দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে অদ্রিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তিতিক্ষা ওখানেই হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো। আচ্ছা! এটা কি খারাপ স্বপ্ন হতে পারে না? তিতিক্ষা মনে প্রাণে চাচ্ছে, এটা দুঃস্বপ্ন হোক। ঘুম থেকে উঠে যেন সব আগের মত পরিপাটি পায়। কিন্তু সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছে। আজকে যা ঘটে গেলে কোনটাই মিথ্যা গল্প বা দুঃস্বপ্ন নয়। তিতিক্ষার চোখে ফুলে গেছে। ফর্সা মুখে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে, বড় বড় টানা টানা চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
বিভা আর আহান তিতিক্ষার পাশে বসলে। ওদের চোখেও পানি। ওরা জানে নক্ষত্র তিতিক্ষাকে কতটা ভালবাসে। আচ্ছা! পবিত্র ভালবাসার পরিণতি এত ভয়াবহ হয় কেন? ভালবাসা এত কষ্ট পেতে হয় কেন? কষ্ট যদি পেতেই হবে তাহলে ভালবাসা নামক অদৃশ্য বিষ সবাই পান করে কেন? কেন ভালবাসার আগুনে দগ্ধ হতে হয়? আহান তিতিক্ষার মাথাতে হাত রাখলো। তিতিক্ষা কাঁদতে কাঁদতে ওর রুমে চলে গেল। রুমে দরজা আঁটকে বারান্দায় চলে গেল। দূরে একটা কোকিল ডাকছে। অন্য সময় হলে তিতিক্ষা মন দিয়ে কোকিলের ডাক শুনতো। কিন্তু এখন এসব বিষাদের মত লাগছে। সবকিছু তিক্ততায় ভরপুর।

তিতিক্ষার বারান্দায় বসে উচ্চ শব্দে কাঁদছে। বুকের ভেতরে মনে হচ্ছে, কেউ আগুনের লাভা ঢেলে দিয়েছে। নক্ষত্রকে ছাড়া তিতিক্ষা থাকবে কি করে? ওই ছেলেটা যে ও সব অনূভূতিতে গভীর ভাবে আবদ্ধ হয়ে আছে। সে কিভাবে থাকবে, ওই মানুষটাকে ছাড়া? এই কঠিন পরিস্থিতি কিভাবেই ওরা সামলে উঠবে? মাথা কাজ করছেনা, এসব সমাধান সে পাচ্ছেনা। তিতিক্ষা উচ্চ শব্দ কেদেই যাচ্ছে। এই কান্নার মাঝে নক্ষত্রকে চিরতরে হারানোর ভয়টা লুকিয়ে আছে। এই প্রতিটা অশ্রুর মাঝে, নক্ষত্রকে জন্য তিল তিল করে গড়ে তোলা, অনুভূতিরা লুকিয়ে আছে। নক্ষত্রের আম্মু তো ওদের এনগেজমেন্টটাও ভেঙে দিলো। এবার কি হবে? কি করে, সে নক্ষত্রকে পাশে পাবে? কিভাবে এক সাথে ওদের পথ চলা শুরু হবে? তিতিক্ষাই বা কিভাবে বাঁচবে নক্ষত্রকে ছাড়া? তিতিক্ষা ওর চুল গুলো টেনে কেঁদে বলে উঠলো,
–“হে আল্লাহ! এমনভাবে নিরবে জীবন্ত লাশে পরিণত না করে, আমাকে তুমি সরাসরি মৃত্যু দান করো। আমি আর নিতে পারছিনা। আমার মৃত্যুর মাঝেই সব কষ্টের সমাধান লুকিয়ে আছে।”

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২৫+২৬+২৭