অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৯+২০+২১

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৯+২০+২১
written by Nurzahan Akter Allo

ছেলেটি ক্রাশ খাওয়ার মত মুচকি একটা হাসি দিলো। এরপর সহজ ও সাবলীল ভাষায় স্পষ্ট করে বললো,
–“আমি হলাম সুদর্শনের শিরোমণি, সবার ক্রাশ বয়।
মেঘ মেহবুব।”
সাফওয়ান হতবাক হয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে চলে গেল। মেঘ পরীর হাত ধরে সামনের দিকে নিয়ে গেল। আর শাসনের সুরে বললো,
–“একদম দুষ্টুমি করবি না। আর অন্য ছেলেদের সাথে খেলা তো দূরে থাক, কথা বললেও তোর খবর আছে। বুঝলি আমার কথা?”
পরী মেঘের কথা শুনে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। মেঘ আর পরী আহানের বেস্টু। এজন্য ওদের এখানে আগমন ঘটেছে। আহান মেঘ আর পরীকে দেখে দৌড়ে আসলো। মেঘ আর আহান কথা বলছে আর পরী ফোন বের করে ওর সেলফি তুলছে। মেঘ পরীর মাথায় ঠুয়া মেরে ওর ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললো,

–“আমি এত হ্যান্ডসাম তবুও সেলফি তুলছি না। তাহলে তুই ফাজিলদের মতো এতো সেলফি তুলছিস কেন?”
মেঘের কথা শুনে পরী অসহায় দৃষ্টিতে আহানের দিকে তাকালো। পরী মেঘকে খুব ভয় পায়। এজন্য সে মেঘের মুখের উপরে কথা বলতে পারে না। আহান মেঘকে বললো,
–“দে না, তুললে সমস্যা কি? ও তো ছোট, একটা সেলফি তুললে কিচ্ছু হবে না।”
মেঘ পরীকে ফোন তো দিলোই না। বরং পরীকে আরেকটা ঠুয়া মেরে রাগি চোখে তাকিয়ে চলে গেল। আহান আর কি করবে, সে পরীর হাত ধরে সামনের দিকে এগোলো। সে জানে মেঘকে এখন কিছু বলা আর না বলা দু’টোই সমান।
তনুকার জন্য পার্লারের একটা মেয়ে ওদের সাথে এসেছে। উনি তনুকাকে সাজাচ্ছে৷ বিভা আর অদ্রিও শাড়ি পড়বে, এজন্য তিতিক্ষা ওদের সাহায্য করছে। তনুকার গায়ে হলুদের খাবারের আইটেমগুলো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়েছে। আর এখানে এক একটা প্লেট একদম ইউনিক ভাবে সাজানো। নক্ষত্র এসব গুলো শেফ দিয়ে করিয়েছে। উনাদের অভিজ্ঞ হাতে করার জন্য দেখতেও অসাধারণ লাগছে। এক সাইডে মিষ্টি, এরপর যথাক্রমে ফল, নোনতা, ঝাল, টক আর তারপাশে বিভিন্ন ধরনের পানীয়। প্লেটে একবিন্দু জায়গাও ফাঁকা নেই।
স্টেজ পরিপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়ে গেছে। এখন শুধু তনুকার আসার অপেক্ষা মাত্র।
সাফওয়ান করুণ দৃষ্টিতে জেসিকার দিকে তাকিয়ে আছে। জেসিকা আজকে শাড়ি পড়েছে। ওকে দেখতে মন্দ লাগছে না। তবে মাইনকা চিপায় পড়েছে সাফওয়ান। জেসিকা শাড়ি পড়ে এক ধাপও হাঁটতে পারছে না। এজন্য জেসিকা ওর সবগুলো দাঁত বের করে শাফওয়ানকে কিউট করে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“বাবু! তুমি আমার শাড়ির কুচি গুলো ধরে হাঁটো না, প্লিজ।”
সাফওয়ান চোখ বড় বড় করে জেসিকার দিকে তাকালো। শাড়ি পড়ে আছে জেসিকা আর শাড়ির কুচি ধরে হাঁটছে সাফওয়ান। এই মর্মান্তিক ঘটনাটা চোখ বন্ধ করে একবার সে কল্পনা করে নিলো। আর কল্পনা করার পর সাফওয়ান ওর চোখে শর্ষেফুল দেখলো। শ্রীপুরের চা বাগানের ওই পিকটার কথা মনে হতেই সাফওয়ান জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো।
নবিনের বন্ধুরা সকাল থেকে নক্ষত্রকে লক্ষ্য করছে। বউয়ের কাজিনের জন্য এভাবে কেউ দৌড়াদৌড়ি করে বলে ওদের জানা ছিলো না। ওরা নক্ষত্রের সাথে কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথাও বলেছে। নক্ষত্রকে দেখে ওরাও ভেবেছিলো, নক্ষত্র যথেষ্ট সুদর্শন আর এজন্য হয়তো নক্ষত্রের মাঝে আলাদা একটা এটিটিউড থাকবে। কারো সাথে হয়তো সে মিশবে না। কিন্তু ওদের ধারণা নক্ষত্র ভুল প্রমান করে দিয়েছে। ওরা সবাই নক্ষত্র কে ছেলে হিসেবে খুব পছন্দ করেছে। নবিনের বন্ধু হিমেল নবিনকে বললো,
–“নক্ষত্র তোর বোনের জন্য এমন ভাবে পুরোটা ইউনিক ভাবে সাজাচ্ছে। তাহলে ওর বোনের বিয়েতে বা ওর অনুষ্ঠানে কি করবে ভাবলেই আমার মাথা হ্যাং করছে।”

নবিন হিমেলের কথায় মুচকি হাসলো। বাম দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। প্রথমে নবিনও ভেবেছিলো নক্ষত্র খুব অহংকারী আর এটিটিউড ওয়ালা হবে। সে এত বড় একজন আর্কিট্রেক্ট আর বাবার তো উচ্চবিত্তদের মধ্যে একজন। ওদের চালচলন হাইফাই লোকদের মত। কিন্তু নক্ষত্রদের পরিবারের মেশার পর বুঝেছে, নক্ষত্রদের পরিবারের কারোর মধ্যেই বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। বরং তারা যথেষ্ট ভালো মনের অধিকারী।
একটু পরে আরো অন্যান্য গেস্টরাও চলে আসলো। এখন জায়গাটা আরো গমগম করছে। সাউন্ড বক্সে গান বাজছে, বাচ্চারা নাচানাচি করছে। গেস্টদের খাবারও সব রেডি। নক্ষত্র লোক সংখ্যা আর খাবারের মেনু এ্যারেঞ্জ কমিটির লোকদের দিয়ে দিয়েছে। আর উনারা সব রেডি করে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাথে পনেরো জন ওয়েটারও এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে; যাতে গেস্টদের কোনো ধরনের সমস্যা না হয়। নক্ষত্র এসব ছোটখাটো দিকগুলো কালকে রাত্রে ম্যানেজ করে রেখেছিলো। আর এখন ডিজিটাল যুগ বলে কথা। এখন কেউ কোনো কিছুতে‌ পিছিয়ে থাকবে না; যদি সেটা ম্যানেজ করার মতো মাথাতে বুদ্ধি থাকে তো।
একটু পর নক্ষত্রের আম্মু আর আব্বুও চলে আসলো। ছেলের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্রের আম্মু মুচকি হাসলো। ঘামার্ত মুখটাতেও অসম্ভব মায়া জড়িয়ে আছে। নক্ষত্রের আম্মু নক্ষত্রের সামনের চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বললো,

–“আব্বু কোনো কিছুর কমতি যেন না থাকে৷ সবটা তুমি নিজে হাতে তুমি সামলে নিবে।”
নক্ষত্র মুচকি হেসে ওর ঘামে ভেজা মুখটা ওর আম্মুর শাড়িতে মুছে নিলো। নক্ষত্রের আম্মু নক্ষত্রের পিঠে হালকা করে একটা থাপ্পড় দিল। আর অভিযোগের সুরে বলল,
–“এই ফাজিল আমার এত সুন্দর শাড়িতে ঘাম মুছবি না। এবার মায়ের আঁচল ছাড়ো আর বউয়ের আঁচল ধরো।”
নক্ষত্র ওর আম্মুর কথা শুনে মুচকি হাসলো। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বলল,
–“আমার বউটাকে তো পুরোপুরি এনে দাও নাই। অর্ধভাবে দিয়েছো। তাহলে কিভাবে আর তার আঁচল ধরে ঘুরবো বলো? যদি পুরোপুরি দিতে তাহলে…।”
নক্ষত্রের কথা শুনে নক্ষত্রের আম্মু ওর পিঠে আরেকটা থাপ্পর দিল। নক্ষত্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে ।
নক্ষত্রের আম্মু নক্ষত্রকে তিতিক্ষার কথা জিজ্ঞাসা করলো। নক্ষত্র ওর আম্মুকে ওই বাংলোতে নিয়ে গেল। নক্ষত্রের আব্বু তিতিক্ষার খালু আর আব্বুর সাথে জমিয়ে গল্প করা শুরু করলো। ওই বাংলোতেই মামনি, তিতিক্ষার আম্মুরা ছিলো।
নক্ষত্রের আম্মুকে দেখে ওনারা সামনে এগিয়ে গেল। নক্ষত্রের আম্মুকে পেয়ে উনারা যেন আরো ডগোমগো হয়ে উঠলো।
তিতিক্ষা কোমরে হাত রেখে বিভার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। বিভা অসহায় বিড়ালছানার মত তাকিয়ে জোরপূর্বক একটা হাসি দিলো। বিভার শাড়ির কুঁচি গুলো ঠিক করে দিলো তিতিক্ষা। এরপর অদ্রিকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। অদ্রির প্রচন্ড কাতুকুতু। তিতিক্ষা ওর কোমরে শাড়ি গুজতেই সে এক লাফ দিয়ে উঠে। তিতিক্ষা এই দুটোকে নিয়ে পড়েছে মহা বিপদে। ওদের শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে ওদের দু’জনকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছে। দু’জনের চোখে আইলাইনার দেওয়ার জন্য দু’জনেই চোখ বন্ধ করে আছে। তিতিক্ষা ওদেরকে গায়ে হলুদের জন্য কেনা গয়নার সেট পড়িয়ে দিলো। নক্ষত্রের আম্মু ওদের কাছে এসে তিতিক্ষাকে বকা দিয়ে বললো,

–“তিতিক্ষা ওদের নিয়ে পড়ে থাকলে তুই কখন রেডি হবি?”
তিতিক্ষা নক্ষত্রের আম্মুকে দেখে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের আম্মুর দিকে তাকালো। উনাকে দেখে বোঝা যায় না উনার এতো বড় বড় ছেলে-মেয়ে আছে। এখনো উনি নিজেকে সেই রকম ভাবেই ফিট রেখেছে।
তিতিক্ষা নক্ষত্রের আম্মুকে বললো,
–“ওয়াও! আম্মু, তোমাকে জাস্ট অসাম লাগছে।”
নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার কথা শুনে হাসলো। ওইদিকে তনুকার সাজ কমপ্লিট হয়ে গেছে। তিতিক্ষা ওর হলুদ আর সবুজ সংমিশ্রণের জামদানি শাড়িটা পড়ে নিলো। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষাকে শাড়ি পড়িয়ে দিলো। তিতিক্ষা কেন জানি খুব লজ্জা পাচ্ছিলো। ওকে শাড়ি পড়ানোর সময় নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার মুখে দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
–“আমি তাই এত লজ্জা পাচ্ছিস। আমার ছেলে হ..।”
নক্ষত্রের আম্মু পুরো কথাটা শেষ করেতে পারেনি। তার আগেই তিতিক্ষা নক্ষত্রের আম্মুর কথা শুনে দুইহাত দিয়ে ওর মুখটা ঢেকে নিলো। অদ্রি, বিভা, নক্ষত্রের আম্মু হো হো করে হেসে দিলে। কোনো শাশুড়ি যে তার ছেলের বউকে এভাবে লজ্জা দিতে পারে; সেটা নক্ষত্রের আম্মুকে না দেখলে জানায় যেতো না। অদ্রি আর নক্ষত্র আগে ওকে লজ্জাতে ফেলতো এখন ওদের আম্মুও যোগ হলো। তিতিক্ষা এখনো লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারেনি।
তিতিক্ষা নক্ষত্রের আম্মুর সাহায্য নিয়ে ওর চুল খোঁপা করে নিলো। চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা চ্যাপস্টিক দিয়ে নিলো। নক্ষত্রের মেলাতে কিনে দেওয়া সবুজ আর হলুদ চুড়ি মিশিয়ে একমুঠো করলো। আর ডানহাতে সেটা পড়ে নিলো। আর কপালে একদম ছোট্ট কালো একটা টিপ দিলো। আপাতত ওর সাজ কমপ্লিট।

নক্ষত্র, রুহান, সাফওয়ান, নবিনসহ ওর সব বন্ধুরা রেডি হয়ে আসলো। তনুকা এখন বের হয়ে স্টেজে বসবে। এজন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ক্যামেরা ম্যান তনুকার কয়েকদফা পিক তুলে ওই বাংলো থেকে বের হলো। সাফওয়ানের পাশে জেসিকা সেলফি তুলতে ব্যস্ত। আর কোনো দিকে ওর ধ্যান জ্ঞান নেই। একটু পর অদ্রি আর তিতিক্ষা একটা লাল নেটের ওড়না ধরে রুম থেকে বের হলো। বিভা আর ওর কাজিন ওড়নার পেছনের দুই কোণা ধরে আছে। তিতিক্ষা বিভাকে সামনে আসতে বলেছে। কিন্তু বিভার শাড়ির অবস্থা খুব করুণ। এজন্য বাধ্য হয়ে তিতিক্ষা আর অদ্রিকে সামনে আসতে হয়েছে। আর তনুকা আছে ওদের ঠিক মাঝখানে।
ওদের বের হতে দেখে সবাই সিটি বাজানো শুরু করলো। সাউন্ড বক্সে তখন গায়ে হলুদের গান গান বাজছে। তবে হাস্যকর ব্যাপার হলো, অদ্রি শাড়ি পড়ে কোনো রকম পা ফেললেও তিতিক্ষা খুব ধীরে পা ফেলছে। তিতিক্ষা সামনের দিকে তাকাতেই সবার প্রথমে চোখাচোখি হলো নক্ষত্রের সাথে। নক্ষত্র চুপ করে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। এতগুলো মানুষের সামনে তিতিক্ষার খুব লজ্জা লাগছিলো। আর ওর লজ্জা পাওয়ার বিশেষ কারণ নাহিয়ান আবরার নক্ষত্রের মারাত্মক দৃষ্টি। যে দৃষ্টির গভীরতায় তিতিক্ষা অনেক আগেই আত্মসমর্পণ করেছে।
শাড়ি পড়ে চলাফেরাতে ওরা সবাই আনাড়ি। এজন্য অদ্রি আর তিতিক্ষা ধীরে পা ফেলছে। কারণ সবার সামনে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাতে তাঁরা চাচ্ছে না। তবে ওদের হাটা দেখে তনুকার বড় ফুপি হাসতে হাসতে বললো,
–“কি রে তিতিক্ষা, নয় মাসের প্রেগনেন্ট মেয়ের মতো হাটছিস কেন মা? একটু জোরে হাঁট, তা না হলে তোদের যেতে যেতেই রাত ১০ টা বেজে যাবে।”

এই কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে দিলো। তিতিক্ষার এখন মন চাচ্ছে একদৌড়ে রুমে চলে যেতে। ইস! কি লজ্জা, কি লজ্জা। তিতিক্ষা আড়াচোখে নক্ষত্রকে দেখে নিলো। সে ওর দিকেই তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। এরপর স্টেজের কাছে ওরা যেতেই দেখলো রায়হান আগে থেকে বসে আছে। তনুকা বাদে সবাই জানতো ওর আর রায়হানের একসাথে গায়ে হলুদ হবে। শুধু তনুকা জানতো না তাই সে অবাক হয়েছে। তিতিক্ষা, বিভা, অদ্রি, ওর সাথের মেয়েদের মুখেও দুষ্টু হাসির রেখা দেখা দিলো। তনুকা দাঁড়িয়ে আছে, বিভারা কিছুতেই রায়হানের পাশে তাকে বসতে দিচ্ছে না। আপাতত শালিকা আর দুলাভাইদের মাঝে দর কষাকষি হচ্ছে। বিভাদের সাথে না পেরে রায়হান ওদের প্রস্তাবে রাজি হলো। তনুকাকে দেখেই রায়হানের মাথা ঘুরে গেছে। তাই আর কথা বাড়ালো না। রায়হান কার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ওহে শালিকাগণ তোমাদের যা নেওয়ার নিয়ে যাও। শুধু আমার বউকে আমার বুকে দিয়ে যাও।”
বিভারা পাক্কা ১০ হাজার তিনশ টাকা নিয়ে তনুকাকে ছাড়লো। এরপর শুরু হলো অনুষ্ঠান। গায়ে হলুদে মেয়েদের সাজ হলুদ আর সবুজ শাড়ি। আর ছেলেদের সবুজ পান্জাবী, সাদা জিন্স আর মাথায় বাঁধা গ্রামীন চেকের গামছা। এটা গ্রামীন টেডিশন আর কি। গামছা বাঁধার আইডিয়াটা নবিন ঠিক করেছে। নক্ষত্র মাথায় গামছা বেঁধেছিলো; পরে খুলে ফেলেছে ওর স্বযত্নে গড়া চুলের কথা ভেবে। তবে খোলার আগে শত শত পিক তুলতে হয়েছে ওখানকার সবার সাথে। ওর আর তিতিক্ষার অনেক কাপল পিকও তোলা হয়েছে।
অদ্রি আর তিতিক্ষা এসে একটু দূরে দাঁড়ালো। নক্ষত্র ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই অদ্রি খুশিতে গদোমদো হয়ে বললো,

–“ভাইয়া শাড়িতে আমাদের কেমন লাগছে দেখতে?”
নক্ষত্র অদ্রির দিকে তাকিয়ে ওর ফোন স্ক্রল করতে লাগলো। অদ্রি আবারও একই কথা বললো। নক্ষত্র অতি শান্ত সুরে বললো,
–“তোকে দেখতে পুরো রানু মন্ডলের মতো লাগছে।”
নক্ষত্রের কথা শুনে অদ্রির মুখটা চুপসে গেল। তিতিক্ষা দুই ভাইবোনের কান্ড দেখছে। অদ্রি বেচারা নক্ষত্রের মুখে এমন প্রশংসা শুনে চলে গেল। নক্ষত্র তিতিক্ষার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নক্ষত্র ওর ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। তিতিক্ষাকে কিছু বলার আগেই নক্ষত্রের আম্মু ওদের দু’জনকে ডাকলো। কয়েকজনের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলো।
তনুকা আর রায়হানের বাবা-মায়ের হলুদ দেওয়া শেষ। স্টেজের কাছে নক্ষত্র গিয়ে রায়হানকে বললো,
–“ভাইয়া এবার আপনি আপিকে হলুদ ছুঁয়ে দেন।”
এই কথাটা ওখানে যেন উপস্থিত সবার কাছে বজ্রপাতের মত ঠেকলো। সবাই কথা বন্ধ করে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র নিজেও বুঝতে পারছে, সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র মুচকি হেসে বললো,
— “আত্মীয়স্বজনসহ পুরো পাড়ার মানুষ এসে বর বউদের হলুদ ছুঁয়ে দিয়ে যায়। সেখানে বর বউ নিজেদের হলুদ ছুঁয়ে দিলে সমস্যাটা কোথায়?”
নক্ষত্রের কথাতে যুক্তি আছে। এজন্য আর কেউ আর কথা বাড়ালো না। সবাই মিটি মিটি হাসছে।
রায়হান তনুকার গালে হলুদ ছুঁয়ে দিলো। আর তনুকা লজ্জামাখা মুখে রায়হানের গালে হলুদ দিলো। রায়হান আর তনুকা দুজনের চোখেই খুশির ঝলক স্পষ্ট। এর মধ্যে মাঝবয়সী একটা লোক এসে নক্ষত্রের দিকে একটা হাঁস এগিয়ে দিলো। নক্ষত্র বুঝতে পারছে না, উনি হঠাৎ ওকে হাঁস দিচ্ছে কেন? লোকটি সব দাঁত বের করে হাসলো আর বললো,

–“স্যার এই যে হাঁস নিয়ে এসেছি।”
নক্ষত্র যতটুকু মনে আছে, সে কাউকে হাঁস আনতে বলেনি। সে কিছু বুঝতে পারছে না। সবাই আপাতত ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে৷ ক্যামেরা ম্যানও বেহুদার মত এই দৃশ্যটাও ভিডিও করছে। নক্ষত্রের হঠাৎ করে একটা কথা মনে পড়ে গেল। লোকটি নক্ষত্রের মুখ পানেই তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র বললো,
–“আংকেল আমি তো সকালে আপনাকে বাঁশ আনতে বলেছিলাম। আর আপনি এখন হাঁস নিয়ে আসলেন।”
নক্ষত্রের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে দিলো। আনতে বলেছে বাঁশ আর উনি আনলেন হাঁস। এবার কারো হাসি থামছে না। লোকটি উনার বোকামির কান্ড বুঝতে পেরে মাথা চুলকে চলে গেল।
তারপর আবার যথারীতি অনুষ্ঠান চলতে থাকলো। বড়রা ওদের গায়ে হলুদ ছুঁয়ে উনারা অন্যদিকে চলে গেছ। আর ছোটরা এখানে উপস্থিত আছে। এদিকে আহান, মেঘ আর পরী এরা বিভাদের মত রায়হানের থেকে টাকা হাতানোর জন্য অনেক যুক্তি, পরামর্শ করে অতি সর্তকতার সাথে রায়হানের পকেট থেকে ফোনটা বের করে নিল। রায়হান অন্য মনস্ক থাকায় বুঝতেই পারেনি। রায়হানের ফোনটা হাতে নিয়ে ওরা বিশ্ব জয় করা হাসি দিল। মেঘ ফোনটা হাতে নিয়ে অন বাটনে চাপ দিতেই সামনের লকস্ক্রিনে একটা পিক ভেসে উঠলো। আর পিকটা দেখেই আহান আর মেঘ দুইহাতে চোখ বন্ধ করে স্বজোরে ফোনটা ছুড়ে মারলো। ফোনটা গিয়ে পড়ল নক্ষত্রের পায়ের কাছে। নক্ষত্র ফোনটা তুলে মেঘেদের দিকে তাকালো। ফোনটা হাতে তুলে নক্ষত্র ওদের জিজ্ঞাসা করলো,

–“আহান, মেঘ কি হয়েছে? এভাবে ফোনটা ছুড়ে মারলে কেন?”
ওরা দুই হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। মেঘ চোখ বন্ধ করেই নক্ষত্রকে ফোনের লক স্ক্রিন এর পিক টা দেখতে বললো। ওদের কথামত নক্ষত্র পিকটা দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার দৃষ্টি এখন ওদের দিকে। তিতিক্ষা ভুরু কুঁচকে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের মতিগতি বুঝতে না পেরে বিভা এসে নক্ষত্রের হাতে থেকে ফোনটা নিলো। আর লকস্ক্রিনের ওয়ালপেপারটা দেখার পর বিভা অবাক অবাকিত সুরে বলে উঠলো,
–“এটা তো রায়হান ভাইয়ার ফোন। ওমা! এটা তো তনুকা আপুর ব্লাউজের পিক।”
নক্ষত্র না পারছে হাসতে না পারছে চুপ থাকতে। ভাইরা ভাইয়ের এমন করুণ অবস্থা, হাসাটা বড্ড বেমানান। তবে উপস্থিত সবাই লুটোপুটি খাচ্ছে। বিভা, তিতিক্ষা, অদ্রি, নবিনের বন্ধুরা, নক্ষত্রের বন্ধুরা তো হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পড়েছে। সাফওয়ান তখন বিশ্বজয় করা হাসি দিয়ে গর্বের সাথে বলল,
–“জিও ব্রো। আপনার মতো আমারও করুণ একটা অবস্থা। আপনি আপনার বউয়ের ব্লাউজের পিক নিয়ে ঘুরছেন। আর আমি আমার গার্লফ্রেন্ডের শাড়ির কুচি ধরে হাঁটছি। কি সোনা বাঁধানো কপাল আমাদের।”
সাফওয়ানের কথা শুনে আরেক দফা হাসির রোল পড়লো।

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_20

(নিজে পড়ুন এবং শেয়ার করে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন।)
রায়হান তনুকার ব্লাউজের পিকটা ইচ্ছেকৃত ভাবে ওর ওয়াল পেপার রাখেনি। সঠিক মাপের ব্লাউজটা হচ্ছিলো না। তখন তনুকা রেগে রায়হানকে পানিশমেন্টন দিয়েছিলো যে, আজকে সারাদিন সে ব্লাউজের পিক ওর ফোনে ওয়ালপেপার রাখবে। যদিও বা এটাকে হাবি নির্যাতনই বলে। তবে আহান আর মেঘ এই দুই বিচ্ছু মিলে ব্যাপারটা যে এভাবে ফাঁস করে দিবে তা তো জানা ছিলো না। অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তে এই ঘটনাটার আসল কাহিনী তনুকা নিজে স্বীকার করেছে।
ওরা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করলো। রায়হান, তনুকাও ফ্রেশ হয়ে আসলো। নক্ষত্র ওদের সবাইকে নিয়ে পুরনো নুহাশ পল্লী ঘুরে দেখাচ্ছে। এমন একটা স্থান ঘুরে না দেখালে এখানে আসাটাই বৃথা হয়ে যাবে। পরী বড়দের সাথে হাঁটতে পারছিলো না। পায়ে তাল মিলাতে গিয়ে দুম করে পড়ে গেল। মেঘ দৌড়ে গিয়ে পরীকে টেনে তুললো। আর পরীর মাথায় ঠুয়া মেরে বললো,
–“দুইটা পায়েও ঠিকমত হাঁটতে পারছিস না। আর দুইটা পা লাগবে তোর?”

কথাটা বলে মেঘ পরীকে কোলে তুলে নিলো। সে নিজেও হাঁটতে পারছে না। রুহান পরীকে নিতে চাইলো পরী গেল না। নক্ষত্র এগিয়ে এসে কোনো কথায় ছাড়াই পরীকে কোলে তুলে নিলো। ছোট্ট পরীটা ব্যাথা পেয়েছে তাই সে কাঁদছে। নক্ষত্র অনেক আদর করে ওকে থামিয়েছে। মেঘের থেকে ছয় বছরে ছোট পরী। মেঘ যেখানে যায় পরীও সেখানে যাওয়ার জন্য খুব বায়না ধরে। এজন্য ওকেও মেঘ সাথে করে এনেছে। মেঘদের বাসার দোতলার ফ্ল্যাটে পরীরা থাকে। পরীর বন্ধু মেঘ আর মেঘের বন্ধু আহান। সেক্ষেত্রে তিনজন তিনজনেরই বন্ধু। নক্ষত্র পরীকে কোলে নিয়ে হাঁটছে; সেই সাথে সবটা ওদের ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। পরীও কান্না থামিয়ে নক্ষত্রের গলা জড়িয়ে ধরে সবটা দেখছে।
চল্লিশ বিঘা জমির উপর স্থাপিত নুহাশপল্লীর মূল ফটক পেরোলেই চোখে পড়বে সবুজ ঘাসের গালিচা। নুহাশপল্লীর উদ্যানের পূর্বদিকের খেজুর বাগানের পাশে ‘বৃষ্টিবিলাস’ নামে একটি অত্যাধুনিক ঘর রয়েছে। এর ছাদ টিনের তৈরি। মূলত বৃষ্টির শব্দ শুনতেই এতো আয়োজন। তার একটু ভেতরে রয়েছে আরেকটি বাংলো। যার নাম ‘ভূতবিলাস’। পরী নক্ষত্রের গলা জাপটে ধরে মুখ কাচুমাচু করে বললো,

–“আংকেল এখানে কি ভূত থাকে?”
–“উহুম! এটা এই বাংলোর নাম। কেন আংকেল, তোমার কি এখানে এসে ভয় লাগছে?” (নক্ষত্র)
পরী সাহসিদের মত মাথা নাড়ালো। যার মানে সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না।
দুই কক্ষের আধুনিক বাংলোটির পেছনে রয়েছে ছোট পুকুর। যার চারিদিক সুন্দর ঘাসে মোড়া ঢাল দিয়ে ঘেরা, এই ঢালের চারিদিকে রয়েছে গাছ-গাছালি। ভূতবিলাসের পাশ দিয়ে একটি নড়বড়ে কাঠের সাঁকো রয়েছে। এর ওপর দিয়ে হেঁটে পুকুরের মাঝখানের ছোট্ট এক টুকরো দ্বীপাকারের ভূখণ্ডে যাওয়া যায়। তিতিক্ষা নক্ষত্র আর পরীকে দেখছে। নক্ষত্র কি সুন্দরভাবে পরীকে আগলে রেখেছে। তিতিক্ষা কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসলো।
সবাই চারপাশে ঘুরছে। নক্ষত্র আরো সামনে গিয়ে ওদের দেখালো প্রায় ২৫০ প্রজাতির গাছ, ঔষধি গাছের বাগান, হুমায়ুন আহমেদের কটেজ, ট্রিহাউজ, দাবা খেলার এবং নামাজপড়ার কক্ষ, ডিম্বাকৃতির সুইমিংপুল, কাদামাটি ও টিন দিয়ে তৈরি করা শুটিং স্টুডিও। রয়েছে মৎস্যকন্যার মূর্তিসহ একটি পানির রিজার্ভার। এটির পাশে একটি রাক্ষসের মূর্তিও আছে। এছাড়া আছে কনক্রিট দিয়ে তৈরি ডাইনোসারের মূর্তি, প্রাচীন আমলে নির্মিত কিন্তু আধুনিক ঘাট সমৃদ্ধ দিঘাল দীঘি ও লেকের মাঝে বসার জন্য ছোট একটি দ্বীপ। তাছাড়া শালবন, অর্কিড বাগান সহ আরও তিনটি বাংলো।

ওরা ঘুরে ফিরে ওখান থেকে বের হয়ে গেল। শুধু তনুকার গায়ের হলুদের জন্য ওরা এসেছিলো। মেঘ আর পরী সবার থেকে বিদায় নিয়ে ওরা ওদের বাসায় চলে গেল। ওদের সাথে আজকে একজন কেয়ার টেকার এসেছিলো। উনিই সারাদিন ওদের দেখে রেখেছিলো। মেঘ ওর দাভাইয়ের সাথে আজকে রাতে সুইজারল্যান্ড যাবো। এজন্য সে বিয়েতে আর আসতে পারবে না। আহানের যেন মন খারাপ না হয়; তাই মেঘ আজকে এসেছিলো। তবে ফোনের ওয়ালপেপার জন্য মেঘ রায়হানকে সরি বলেছে। রায়হানও হেসে মেঘকে জড়িয়ে ধরেছিলো। মেঘ তনুকাকে একটা গোল্ডের রিং উপহার দিয়েছে। এটা মেঘের আর পরীর তরফ থেকে মেঘের বউমনি পাঠিয়েছে।
ওরা সবাই বের হয়ে এবার ‘নক্ষত্র বাড়ি’র দিকে রওনা হলো। ‘নক্ষত্র বাড়ি’ হলো একটা রিসোর্ট। ওখানে সব যাবতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। নুহাশ পল্লি থেকে ওখানে যাওয়া দুরত্ব প্রায় দেড় ঘন্টা।
নক্ষত্রবাড়িটির প্রতিটি স্থান ব্যবহার করা হয়েছে নান্দনিকভাবে। আঙিনার এক পাশে ছোট্ট ঝরনা, যেখানে পদ্ম আর শাপলা ফুলের মিতালি গড়ে উঠেছে। পুকুরে মাছধরা বা নৌকায় চড়েও ঘোরাও সুযোগ আছে। খেলাধুলার জন্য রয়েছে ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, বিলিয়ার্ড ইত্যাদির ব্যবস্থা। জোড়া দুটি পুকুরের মাঝে কাঠের সাঁকোতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করার জন্য ঝিলের জলে ফোটা শত শত লাল শাপলা। ওরা রিসোর্টে এসে আরো একটা বার সবাই অবাক হলো এখানকার সৌন্দর্য দেখে। সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলো। যেহেতু এটা রিসোর্ট তাই অন্য সব গেস্টরাও আছে। নক্ষত্র ওদের সবার জন্য এক সাইডের পুরোটাই নিয়েছে। সন্ধ্যার পর তনুকা সহ সব মেয়েদের জন্য মেহেদীর অনুষ্ঠান করা হয়েছে। রায়হানরা চলে গেছে; কালকে বর সেজে আসবে। সারারাতে ওরা আড্ডা দিয়েছে, অনেক মজা করেছে। সাফওয়ানের ফানি গান শুনে এক এক জন হেঁসে লুটোলুটি খেয়েছে।

বিয়ের দিন সকালে___!!
নক্ষত্র, সাফওয়ান আর রুহান খেতে বসেছে। তিতিক্ষারা সব বোনরা মিলে ওপর সাইডে। সাফওয়ান আর রুহান কথা বলতে বলতে থেমে গেল। নক্ষত্র ওর থেমে যাওয়া দেখে ওদের দিকে তাকালে। তখনই একজন এসে ওদের সামনের চেয়ারে বসে গেল। তিনজনের দৃষ্টি সামনের ব্যাক্তির দিকে। নক্ষত্র, রুহান, সাফওয়ান সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গিয়ে সামনের জনকে জড়িয়ে ধরলো। আফান আজকে এখন এভাবে উপস্থিত হবে ওরা কেউ জানতো না। চারজন ওরা খুব ভাল বন্ধু; যাকে বলে কলিজার বন্ধু। আফান ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তোরা খাচ্ছিস? আমার প্রচন্ড খুধা লেগেছে। কিন্তু আমার হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না।”
এটা নতুন কিছু না। চারজনের এটা একটা খুব পুরোনো অসুখ। আফানের কথার মানে ওরা তিনজন বুঝলো। তাই আর কথা না বাড়িয়ে আফানের মুখে নক্ষত্র খাবার তুলে ধরলো। এরপর রুহান দিলো। তারপর দিলো সাফওয়ান। তিন বন্ধুর থেকেই পর পর খাচ্ছে আফান। খেতে খেতে আফানের চোখ গেল বাম সাইডের টেবিলে। ওখানে তিতিক্ষারা বসে আছে। সবাই ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আফান খাওয়া থামিয়ে বললো,

–“তিতিক্ষা জানো তো? নক্ষত্র খুব ভাল করে খাইয়ে দিতে পারে। আমি কি ওখানে নক্ষত্রকে যেতে বলবো? আই মিন তুমি কি ওর হাতে খাবে?”
তিতিক্ষা মাথা নিচু করে নিলো। আফান নক্ষত্রকে বললো,
–“নক্ষত্র দ্রুত যা। নিরাবতা সম্মত্তির লক্ষণ। তিতিক্ষা তোর হাতে খাবে মেবি।”
নক্ষত্র মুচকি হেসে তিতিক্ষার দিকে না তাকিয়ে বললো,
–“সে লজ্জায় রাঙা হয়ে মাথা নিচু করে নিয়েছে । আর ভুলেও এদিকে তাকাবে না। একটুপর দৌড়ে পালাবে এখান থেকে।”
রুহান, আফান, সাফওয়ান খাওয়া থামিয়ে তিতিক্ষাদের দিকেই তাকালো। নক্ষত্র বলা কথা একদম ঠিক। ওখানকার মেয়েরা সবাই হাসছে আর তিতিক্ষা উঠে চলে গেল। এবার এরা তিনজন নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্র ওদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির মানে বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললো,
–“সে আমার মনোপ্যাথি। আমি ওর চোখের ভাষা, মৌনতা, পরিপূর্ণভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছি।”
আজকে বিয়ে, তাই অনেক কাজ আছে। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। সাফওয়ানকে একটা কাজ দেওয়া হয়েছে। ও সেটা না করে বাচ্চাদের সাথে নাচানাচি করছে। গান বাজনা, হইচই, আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠেছে রিসোর্টটি। তনুকা ১১ টার দিকে গোসল সেড়ে সাজতে বসে গেছে। পার্লার থেকে দুইজন এসেছে ওকে সাজাতে। অদ্রি, বিভা আর তিতিক্ষা বরের থেকে টাকা হাতানোর জন্য খাবারের প্লেট সাজানোর কাজে লেগে গেছে। নক্ষত্র, নবিনরা একটু ব্যস্ত। মামনি কোন শাড়িটা পড়বে, এটা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। তিতিক্ষার আম্মু আর নক্ষত্রের আম্মু হাঁটছে আর গল্প করছে।

দুপুর একটার দিকে সবাই যে যার কাজ সমাপ্ত করে রেডি হয়ে নিলো। গেস্টরাও চলে এসেছে । একসাইডে খাবারের প্রতিটা আইটেম আছে। আর প্রতিটা আইটেমের সাথে একজন করে ওয়েটার দাঁড়িয়ে। যার যে মেন্যুটা পছন্দ, সে তুলে নিতে পারে। বর-কনের বসার জায়গাটা সুন্দর করে সাজানো। দুপুর ১ঃ৫৬ মিনিটে রায়হানরা এসে এখানে পৌঁছালো। বর এসেছে শুনে ছেলেরা গিয়ে বর নামালো। ওখানে কোনো মেয়ে যায়নি। রায়হান বরের আসনে বসলো। নক্ষত্র আর ওর বন্ধুরা এসে রায়হানের সাথে কথা বললো। আজকে সবাই ব্লেজার পড়েছে যার যার পছন্দমত। একটু পর তনুকাকে এনে রায়হানের পাশে বসানো হলো। আর তখনই শুরু হলো ক্যামেরা ম্যানের অত্যাচার। তনুকার আব্বু কাজিকে নিয়ে আসলো। বড়রা সবাই ওদের সামনে দাঁড়ালো আর ছোটরা সবাই উঠে উনাদের বসার জায়গা করে দিলো। নক্ষত্র এসে তিতিক্ষার পাশে দাঁড়ালো। তিতিক্ষা নক্ষত্রকে দেখেও চুপ করে আছে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ধীর কন্ঠে বললো,
–“মিসেস নাহিয়ান! এই রুপে আপনি আর কতবার আমাকে ঘায়েল করবেন?”
তিতিক্ষা আড়চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্র ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। তিতিক্ষা নক্ষত্রের কথার প্রতি উত্তরে মাথানিচু করে বললো,

–“আরো শত, শতবার।”
নক্ষত্র আলতো করে তিতিক্ষার হাতের আঙুল টার্চ করে আদুরে সুরে বললো,
–“আমার প্রতি তোমার কি একটুও মায়া দয়া হয় না?
তিতিক্ষা দুষ্টু হেসে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। নক্ষত্রও হেসে দিলো। ওইদিকে সবাই রায়হান তনুকাকে নিয়ে ব্যস্ত। আর এইদিকে নক্ষত্র আর তিতিক্ষা প্রেমালাপে ব্যস্ত। নক্ষত্র আশেপাশে আর একবার চোখ বুলিয়ে দুষ্টু হেসে বললো,
–“ইস! এমন একটা শুভোক্ষণ আমার যে কবে আসবে?”
এখানে থাকলে এই ছেলে ওকে লজ্জা দিবে। এটা ভেবে তিতিক্ষা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে, নক্ষত্র তখন তিতিক্ষার হাত ধরে ওকে আটকে দিলো। আর আদুরে সুরে বললো,
–“আমি যে মারাত্মকভাবে তোমাতে আসক্ত হয়ে গেছি। তোমাকে ছাড়া এখন আমার নিজেকে শূন্য মনে হয়। ”
তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্রের চোখ বলে দিচ্ছে ওর অনুভুতির কথা। রুহান ওর ক্যামেরা নিয়ে নক্ষত্রদের ফটাফট কয়েকটা পিক তুলে নিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে একটা ম্যাঙ্গোবার এগিয়ে দিলে। তিতিক্ষার নক্ষত্র দিকে হাত বাড়াবে এমন সময় রুহান ওর ক্যামেরা ক্লিক করলো। তিতিক্ষা যাওয়ার আগে ওর হাতের আঙ্গুলে জিভ ঠেকালো। আশেপাশে তাকিয়ে ওর নক্ষত্রের শার্টের কলার বরাবর রাখলো। নক্ষত্র বাম দিকে তাকিয়ে ছিলো, তিতিক্ষা স্পর্শে চমকে উঠেছে। এই প্রথম তিতিক্ষা নিজে থেকে ওকে টার্চ করেছে। তবে এভাবে টার্চ করার মানে নক্ষত্র বুঝতে পারেনি।

নক্ষত্র কিছু বলার আগে তিতিক্ষা বললো,
–“একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে তাই।”
তিতিক্ষা আর এক মুহূর্ত ওখানে দাঁড়ায়নি। দ্রুত পায়ে সে অন্য দিকে চলে গেছে। তখন রুহান হাসতে হাসতে এসে নক্ষত্রের পাশে দাঁড়ালো। এইদিকে যথাযথ নিয়মকানুন মেনে ওদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। সবাই মোনাজাতে ওদের জন্য দোয়া করলো। এরপর বরের খাওয়া দাওয়ার পর্বও চুকে গেল। খাওয়া শেষ করতেই তনুকার এটো হাত রায়হানের এটো হাতের এক ধরে গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে তিতিক্ষা বেঁধে দিলো। রায়হানের বুঝতে বাকি নেই এখন ওর সাথে কি হতে যাচ্ছে? তনুকা নিজেই বললো,
–“তারাতাড়ি পনেরো হাজার টাকা ফেলো।”
রায়হান তনুকার দিকে তাকালো। কোথায় বরকে বাঁচাবে তা না করে আরো ফাসাচ্ছে। তিতিক্ষা, বিভা, অদ্রি সহ আরো কয়েকজন মিটিমিটি হাসছে। নক্ষত্ররা ওদের এক সাইডে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড দেখছে। তনুকা নিজে থেকে তিতিক্ষাদের টাকা আদায় করতে সাহায্য করার কথা না। নিশ্চয়ই এখানে রহস্য আছে। রায়হান তনুকার দিকে মুখ কাচুমাচু করলো তাও তনুকা শুনলো না। ১৫ হাজার নিয়েই রায়হানকে ছাড়লো। বিভা আচানক ভাবে তিতিক্ষাকে ধাক্কা মারলো। নক্ষত্র পাশে থাকায়
তিতিক্ষার নক্ষত্রের বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। ওর নাকে খুব লেগেছে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ধরে নিলো। বিভা ইচ্ছা করেই এমন করেছে। বিভা এদের নক্ষত্র আর তিতিক্ষার হাত বেঁধে দিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার নাকে হাত বুলিয়ে বললো,

–“খুব ব্যাথা পেয়েছো? পানি আনবো?”
তিতিক্ষা মাথা নাড়িয়ে না বললো। তবে ওর খুব লেগেছে নাকে সাথে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেছে। বিভা নক্ষত্রকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“ডক্টর দিলে ১৫ হাজার। আর আর্কিট্রেক্ট এর পালা।”
নক্ষত্র তিতিক্ষা চোখে পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
–“রায়হান ভাই চাঁদ নিয়ে যাচ্ছে। তাই ১৫ হাজার দিলো। আমার চাঁদ আমাকে দিলে আমিও..।”
নক্ষত্রের কথা শুনে বিভা বললো,
–“না না ভাইয়া! আমি জানি আপনি খুব টাউট। এখন কোনো যুক্তি দেখাবেন না। আমরা কিছুতেই শুনবো না।”
নক্ষত্রও তিতিক্ষাকে আস্তে করে বললো ওর পকেট থেকে নিয়ে ওদের দিতে। তিতিক্ষা অনেক সাহস করে নক্ষত্র প্যান্টের বাম পকেটে হাত ঢুকালো। তিতিক্ষা লজ্জা নক্ষত্রের দিকে তাকাচ্ছে না। বিভারা তর্ক করছে এটা নিয়ে। তিতিক্ষার শাড়ির আঁচলের জন্য কেউ দেখতে পায়নি, নক্ষত্রের পকেটে হাত ঢুকিয়েছে। নক্ষত্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যত টাকা ছিলো তিতিক্ষা এক মুঠো করে বের করলো। তিতিক্ষা বিভা দিকে এক মুঠো টাকা এগিয়ে দিলো। বিভা টাকা গুলো নিয়ে গুনছে। তিতিক্ষার নক্ষত্রের দিকে ভুলেও আর তাকায়নি। নক্ষত্রের বাম পকেটে তখন ৮ হাজার তিনশ বিশ টাকা ছিলো। ৮ হাজার পেয়ে বিভা নক্ষত্র আর তিতিক্ষার হাত খুলে দিলো। বিভা হাসতে হাসতে বললো,
–“আমার দুই জিজুই অনেএএক ভালো।”

বিভার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। তনুকা আর রায়হানের বিদায় দেওয়ার সময় কান্না কাটির পালা। রায়হানরা তনুকাকে নিয়ে চলে গেল। সবাই কাঁদছে।তনুকা বাড়ির বড় মেয়ে। এজন্য আদরও একটু বেশি। তিতিক্ষাও আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বার বার বোনদের খুনশুটির কথা মনে পড়ছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার পাশে এসে দাঁড়ালো। নক্ষত্র তিতিক্ষার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। আর বললো,
–“আমাদের বিয়ের দিনেও কি এভাবে কাঁদবে? উহুম আমি কাঁদতেই দিবো না।
তিতিক্ষা ফুঁপিয়ে কেঁদে বললো,
–“কেন?
নক্ষত্র মুচকি হেসে শান্ত সুরে বললো,
–“কারণ তুমি কাঁদলে আমার নিজেকে অপরাধী ফিল করবো। বার বার মনে হবে যে আমি সবার থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছি।”

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_21

–“কারণ তুমি কাঁদলে, আমি নিজেকে অপরাধী ফিল করবো। আমার বার বার এটাই মনে হবে যে, আমি সবার থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
নক্ষত্র তিতিক্ষাকে অনেক কিছু বোঝালো, এরপর তিতিক্ষা ওর কান্না থামালো। তনুকাকে বিদায় দিয়ে সবার মধ্যে খারাপ লাগা বিরাজ করছে। যতই ঝগড়াঝাটি, মারামারি, হাজারো খুনসুটি করে থাকুক, ভাই বোনের ভালোবাসাটা একটু অন্যরকম। দিনের শুরুতে মারামারি আর রাতের শেষে ভাই-বোনদের ভালোবাসার জয়। ভাই বোন কেউ কাউকে দেখতে পারে না। আবার অর্ধবেলা বাসায় না থাকলে তার কথায় বার বার জিজ্ঞাসা করা। তনুকা যাওয়ার সময় আহানও খুব কেঁদেছে। নবিন তো কান্নার জন্য কথা বলতে পারেনি। বিভা, তিতিক্ষা ওরা চোখের পানি আটকাতে পারছিলো না। একটা মেয়ে হলো বাসার প্রাণ। একটা মেয়ে ছাড়া কোনো বাসায় পরিপূর্ণ সৌন্দর্য আসে না। মেয়ে ছাড়া বাসাটা কেমন শূন্যতায় গ্রাস করে। তার একমাত্র উদাহরণ আমাদের মা, বোন। মা আর বোন তো মেয়ে। তারা একটা ঘন্টা বাসায় না থাকলেই বোঝা যায়। মেয়ে হলো আল্লাহর রহমতের একটা বিশেষ উপহার। এজন্য একটা মেয়েকে দিয়ে আল্লাহ তার রহমতের মাধ্যমে একটা বাসাকে পরিপূর্ণ সুখ, শান্তি, দান করেন।

তনুকার আব্বু আম্মুও সব গোছানো শুরু করলো। উনারা এখন বাসায় ফিরবে। গেস্ট অনেক আগে চলে গেছে। তনুকা চলে যাওয়াতে সবার মনটা খুব খারাপ। সবকিছু গুছানোর পর তিতিক্ষার মামনিরা নক্ষত্রের আম্মুর থেকে বিদায় নিলো। মিঃ আবরার তিতিক্ষার আব্বুর সাথে কোলাকুলি করলো। আর উনাদের সাবধানে যেতে বললো। তিতিক্ষার আব্বুরা গাড়িতে উঠে বসলো। তিতিক্ষার আব্বু, আম্মু, মামনি নক্ষত্রের সাথে কথা বললো। বাসাতে বেড়াতে যাওয়ার কথা বললো। নক্ষত্র মুচকি হেসে কথা বলে উনাদের থেকে বিদায় নিলো। তিতিক্ষারা যাবে অন্য গাড়িতে। এজন্য তিতিক্ষাদের সাবধানে আসতে বলে, উনারা গাড়ি চলে গেলো।
নক্ষত্রের আব্বু, আম্মু, তিতিক্ষার সাথে কথা বলে সবার থেকে বিদায় নিলো। উনারাও চলে গেল। এবার শুধু নক্ষত্ররা আর তিতিক্ষারা বাকি আছে। নবিন ওর বন্ধুদের সামনে এগোতে বললো। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে একটা মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্রের চোখের ভাষা তিতিক্ষার কাছে আজকে অচেনা নয়। রুহান আর আফান বুঝতে পেরে ওদের কথা বলার সুযোগ করে দিলো। আর নবিনকে কথার মাঝে ব্যস্ত রাখলো।

তিতিক্ষা চুপ করে আছে দাঁড়িয়ে আছে। নক্ষত্র ওকে নিরিবিলি একটা স্থানে নিয়ে এসেছে। ওর বুকের ভেতর কেমন জানি করছে। কিছুতেই নক্ষত্রের সঙ্গ ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। তিতিক্ষার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। অসহ্য এত কষ্ট এসে বুকে ভিড় করেছে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ওর দিকে ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে দিলো। সাথে সাথে আবার আরেক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। নক্ষত্র তিতিক্ষার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
–“তুমি কাঁদলে আমার কি হবে, হুম? তোমার চোখে অশ্রু দেখে গেলে আমি যে একমুহূর্তও স্থির থাকতে পারবো না।”
তিতিক্ষা আর পারলো না; ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সব লাজ লজ্জা ভুলে,্ সে নক্ষত্রের সামনে কেঁদে দিলো। এই নিষ্ঠুর অনুভূতি ওকে বেহায়া হতে বাধ্য করেছে। নক্ষত্র নামক অনুভূতির শীর্ষে সে পৌঁছে গেছে। এই ছেলেটাই ওকে নিষ্ঠুর অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়েছে। কই আগে তো সে এরকম ছিল না? আগে তো কারো জন্য মনটা কাঁদেনি। কারো অনুপুস্থিতিতে এত কষ্ট লাগে নি। এই পঁচা, নিষ্ঠুর মানুষটাই ওকে এই কষ্টের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সে হয়তো ওর অনুভূতির কথা মুখে বলেনি, তাই বলে কি সে এভাবে কষ্ট দিবে? সে কি বুঝে না তার বিরহটা তিতিক্ষার কাছে মারাত্মক কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নক্ষত্র এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিতিক্ষার কান্না দেখছিলো। সে তো অনেক আগেই তিতিক্ষার মায়াতে জড়িয়ে গেছে। কিন্তু তিতিক্ষাও যে নক্ষত্রের মায়াতে মারাত্মক ভাবে জড়িয়ে গেছে। এটা তিতিক্ষার কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট বোঝা যায়। এই পাগলীটা যে নক্ষত্রকে এখন প্রচন্ড ভালোবাসে, সেটা নক্ষত্রের বুঝতে বাকি নেই। তিতিক্ষা এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নক্ষত্র মুচকি হেসে তিতিক্ষার চোখে পানি মুছে দিলো। তিতিক্ষার নাক লাল হয়ে গেছে, চোখের পাপড়ি গুলো ভেজা ভেজা, কান্নারত অবস্থায় কম্পিত ঠোঁটটা বার বার কেঁপে উঠছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার দুই গালে হাত রেখে ওর মুখটা উঁচু করে ধরে আদুরে কন্ঠে বললো,
–“আপনি কি জানেন? আপনি মারাত্মক বরপাগল একটা মেয়ে।”
তিতিক্ষা চুপ করে আছে। কারণ এই উপাধি সে অনেক আগেই পেয়েছে। তিতিক্ষার আজকে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে ইচ্ছে করছে,
–“হ্যা আমি প্রচন্ড বর পাগল। আপনি নামক দুষ্টু ছেলেটা, আমার সব অনুভূতির শীর্ষবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। আপনি আমাকে বাধ্য করেছেন বরপাগলী উপাধিটা সাদরে গ্রহন করতে।”

তিতিক্ষা কান্নাভেজা চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে যত যাই বলুক। তিতিক্ষার কান্না দেখে ওর কেমন লাগছে, সেটাই ও নিজেই জানে। নক্ষত্রের মনে হয়, সব নিয়ম কানুন অমান্য করে তিতিক্ষাকে ওর কাছে রেখে দিক। এত নিয়ম কানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে ওর ইচ্ছে করে না। তিতিক্ষা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভুলেও আর একটা বার সে চোখ তুলে নক্ষত্রের দিকে তাকায়নি, তাকালেই আবার অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়বে। নক্ষত্র আলতো ভাবে তিতিক্ষাকে ওর বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। নক্ষত্রের শার্টে উপর থেকে দুই বোতামের ঠিক মাঝখানে, তিতিক্ষা ওর মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে। আজকে ওর এত কান্না পাচ্ছে কেন, এটা সেও বুঝতে পারছে না। শুধু মনে হচ্ছে, নক্ষত্র ওর খুব কাছে থাকুক, পাশে থাকুক। নক্ষত্র তিতিক্ষার মুখ তুলে চোখ মুছে দিয়ে বললো,
–“উহুম! আর কাঁদে না মিষ্টি বউটা। ফোনে তো আমাদের কথা হবেই। আমি আপনার আছি, আপনারই থাকবো। আপনি সাবধানে থাকবেন আর অবশ্যই নিজের খেয়াল রাখবেন।”
তিতিক্ষা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। ওড়না দিয়ে চোখ মুখ মুছে নিলো। ওরা এসে গাড়ির কাছে দাঁড়ালো। নক্ষত্র একটু পর বড় একটা পার্সেল গাড়িতে তুলে দিয়ে তিতিক্ষাকে বললো,

–“এখানে খাবার পার্সেল করা আছে । মামনিকে বলবে বাসায় ফিরে রান্নার প্রয়োজন নেই। এটাই তোমাদের সবার জন্য যথেষ্ট।”
অদ্রি ওর আব্বু আম্মুর সাথে চলে গেছে। তিতিক্ষারা চলে গেলে নক্ষত্ররা যাবে। বিভা, আহান, নবিন, তিতিক্ষা এক গাড়িতে উঠে বসলো। নক্ষত্রের সব বন্ধুরা এসে তিতিক্ষার সাথে কথা বললো। নবিন সবাইকে জড়িয়ে ধরে হেসে হেসে কথা বলে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের মুখপানে চেয়ে আছে। তিতিক্ষা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নক্ষত্রের চোখ ছলছল করছে। তবুও সে হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলছে। তিতিক্ষাদের গাড়ি যত দূর দেখা যায়, নক্ষত্র সে দিকেই তাকিয়ে আছে।
নক্ষত্র, আফান, রুহান, সাফওয়ান রিসোর্টের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে গাড়িতে উঠে বসলো।
তাঁরাও চললো তাদের বাসার উদ্দেশ্যে। রুহান ড্রাইভ করছে। নক্ষত্র চুপ করে বসে আছে। এখন হয়তো ওর খুব কষ্ট লাগছে। দুইদিন গেলে দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তারপর এতটা খারাপ হয়তো কারোরই থাকবে না।
নবিন গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। বিভা আর আহান বকবক করছে, তিতিক্ষা শুধু ছোট্ট করে উত্তর দিচ্ছে। এরপর ওরা বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে নিলো। বিভা, আহান আর তিতিক্ষা একসাথে ঘুমাবে। বিভা আর আহানের সাথে থেকে ওদের কথা শুনে না চাইলেও হাসতে হয়। এটা ওটা বলে ওরা তিতিক্ষাকে হাসিয়ে তবেই ছাড়বে।
নক্ষত্রও বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিলো। সার্ভেন্টকে এক মগ ব্ল্যাক কফি দিতে বললো। কফির মগ হাতে নিয়ে ডিভানে বসে নক্ষত্র তিতিক্ষার সাথে ফোনে কথা বললো। দু’জন দু’জনকে খুব মিস করছে। তবুও কেউ কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না।
প্রায় দুই সপ্তাহ পর….!!

তিতিক্ষার ইউনিভার্সিটি আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত খুব সময় যাচ্ছে। তিতিক্ষার নিজের একটা বুটিক ঘর আছে। সেখানে ১৫ জন মেয়ে কাজ করে। সেখানে ওই মেয়ে গুলো অর্ডারী কাজ করে। তিতিক্ষা তাদেরকে কাপড়, সুতা সহ যাবতীয় জিনিস এনে দেয়। তখন উনারা মনের মাধুরী মিশিয়ে কাপড়ে নকশা ফুটিয়ে তোলে। এসব বিক্রি করার তিতিক্ষার বাইরে ঘুরা লাগে না। দোকানদাররা এসে নিয়ে যায়। আর উনাদের পছন্দমত অর্ডার দিয়ে যায়। এটাতে তিতিক্ষারও কিছু আয় হচ্ছে, আবার এই মেয়ে গুলোরও নিজের হাত খরচ নিজেরাই বহন করতে পারছে। এটা তিতিক্ষার শখের কাজের একটি। তিতিক্ষার ওর জমানো টাকা দিয়ে চার জন মহিলাকে দিয়ে এই কাজটা শুরু করেছিলো। আল্লাহর রহমতে সদস্য সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এই কাজে অংশগ্রহন করতে চাইলে তিতিক্ষা তাকে কখনোই ফেরায় না। তিতিক্ষা নিজে হাতে বিভা, তনুকার জামা করেছে। সে নিজেও অনেক সেলাই পারে। তিতিক্ষা ওর আব্বু, খালু, আহান আর নবিনকে পাঞ্জাবী বানিয়ে, সেটাতে রুচিসম্মত নকশাও করে দিয়েছে।
সকালে নক্ষত্রের মেসেজ, ফোনে কথা, ভিডিও কলে দেখা, ভাইবোনের সাথে দুষ্টুমি, এসবের সাথে তিতিক্ষার ভালোই সময় কাটছে। তনুকা এসে দুইবার বেড়িয়ে গেছে। রায়হান আর তনুকা দুজনেই ডাক্তার। ওরা একই হসপিটালে জয়েন করেছে। প্রতিদিন তনুকার সাথে ওদের কথা হয়। নক্ষত্রের আব্বু আম্মুর সাথেও কথা বলে। অদ্রি তো ফোন করে নক্ষত্রের বিচার গুলো দেয়। নক্ষত্র তিন দিন হলো লন্ডনে গেছে ওর কাজের জন্য।
আজকে সকালে নক্ষত্র তিতিক্ষার সাথে ভিডিও কলে কথা বললো। নক্ষত্রের অর্ডার তিতিক্ষা ঘুম থেকে উঠেই, যেন তাকে ভিডিও কল দেয়। সে তিতিক্ষার মিষ্টি মুখটা দেখে তার সকাল শুরু করতে চাই। নক্ষত্র ঘুমঘুম চোখে তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“শুভ সকাল, মনোপ্যাথি।”

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৬+১৭+১৮

–“শুভ সকাল। আপনি কখন উঠবেন, শুনি?”
–“এখনই উঠবো। তোমাকে মায়াবতীর মত লাগছে দেখতে।” (মুচকি হেসে)
–“আর আপনাকে মায়াবতার মত লাগছে।”
–“তাই নাকি? আজকে ইউনিভার্সিটি যাবে?”
–“হুম!”
–“ওকে! সাবধানে যাবে আর সাবধানে ফিরবে। তুমি কিন্তু আর তোমার নেই। তুমি এখন পুরোটাই আমার। বুঝলে?”
–“হুম, আমার বয়েই গেছে কারো হতে।”
–“কারো হতে হবে না। আপনি শুধু আমারই থাকবেন, বুঝলেন? মিসেস নাহিয়ান আবরার।” (মিটিমিটি হেসে)
দুই জন বেশ কিছুক্ষণ কথা বলো। ওদের মাঝে একটু একটু জড়তা কাটছে। তিতিক্ষা এখন নক্ষত্রের সাথে ভালোই কথা বলে। মন্দ যাচ্ছে না ওদের দু’জনের সময়, দিন, কাল আর মুহূর্ত ।
দুপুরে তিতিক্ষা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে শাওয়ার নিলো। আহান ডিমপোচ খাবে। এজন্য মামনির কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে। মামনি অনেক গুলো কাপড় ধুয়ে, ছাদে মেলে দিয়ে কেবল আসলো। এজন্য বলছে, একটু পর করে দিচ্ছে। কিন্তু আহান কিছুতেই শুনছে না। আহান রেগে একা একাই রান্নাঘরে চলে গেলো। ডিম ফাটিয়ে একটা বাটিতে নিলো, একটু লবণ, একটু হলুদ, একটু মরিচ, আদা বাটা, রসুন বাটা, জিরা বাটা, কাবাব মশলা দিলো। ওখানে যা ছিলো সবগুলোই দিয়েছে। আহান আজকে আনকমন রেসিপি দিয়ে ডিম ভেজে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে। ডিমের সাথে ময়লা গুলো একটা চামচ দিয়ে গুলে নিলো। কাঁচা পেয়াজ কাটতে পারে না। তাই পেঁয়াজ দিলো না। চুলার উপর
প্যান বসিয়ে, তেল দিয়ে, গ্যাস অন করলো।

মামনি রাগে গজগজ করছে। আহান আজকাল একটু বেশি অত্যাচার করে। তাই আহানকে বকছে। হঠাৎ সেল ফোনটা বেজে উঠলো। উনি কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। তনুকা ফোন দিয়েছে মামনি তনুকার সাথেই কথা বলছে। কিছুক্ষণ পরে অনেক জোরে কিছু একটা ব্লাস্ট হওয়ার শব্দ হলো। মনে হলো ওনাদের বাসাতে বোম পড়েছে। আচানক এমন শব্দে মামনিও চমকে উঠলো। হাতের ফোনটাও ফ্লোরে ছিটকে পড়লো। এটা কিসের শব্দ?
আহান তো রান্নাঘরে। এই কথা ভাবতেই মামনির কলিজা কেঁপে উঠলো। উনি দ্রুত পায়ে ছুটলো রান্নাঘরের দিকে। আর ওখানে গিয়ে যা দেখলো তাতে মামনির অন্তত আত্মা কেঁপে উঠলো।

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ২২+২৩+২৪