অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৬+১৭+১৮

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৬+১৭+১৮
written by Nurzahan Akter Allo

মেলা থেকে ফেরার পর তিতিক্ষা শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো। হাতের ড্রেসগুলো ক্লোথ স্টানে রেখে চুলের কাটাটা খুলে ফেললো। ওর পরিহিত ড্রেসের উপরের পার্টটা খুলে ফেললো। সে আপাতত একটা ব্ল্যাক টেন টপ পড়ে আছে। শাওয়ার নেওয়ার জন্য সচরাচর যে ভুল গুলো আমরা করে থাকি। তিতিক্ষা মুখটা পানিতে ভিজিয়ে ওর ফেসওয়াস টা হাতে নিলো। তারপর কিছু একটা মনে করে চার সাইডে তাকালো। অদ্ভুত ভাবে ওর কেন জানি মনে হচ্ছে, ওকে কেউ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

আশে পাশে কাউকে না দেখে তিতিক্ষা ওর মনের ভুল ভেবে মুখ ওয়াশ করছে। আসলে মেয়েদের সিক্সসেন্থ এতটাই প্রকট যে, দূর থেকে কোনো ছেলে তার উপরে দৃষ্টি রাখলে সেটা সে অনুভব করতে পারে। তিতিক্ষার সিক্সসেন্থ বলছে, ওর ওপরে কেউ দৃষ্টি রাখছে। তিতিক্ষা চারপাশে আবার তাকালো, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু দেখতে পেলো না। হঠাৎ হুড়োহুড় করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে তিতিক্ষা চমকে উঠলো। শব্দটা আসছে ওয়াশরুমের ওপর পাশ থেকে। তিতিক্ষার হাত থেকে ফেসওয়াশটা পড়ে গেল। একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে গেলো। তাহলে কি কেউ সত্যিই ওকে দেখছিলো? এই ভাবনা ওর মাথাতে আসতেই ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে। একটা মেয়ের কাছে এর থেকে লজ্জা আর কি ই হতে পারে। তিতিক্ষা কোনো রকম ওয়াশরুমে দরজা খুলে রুমের দরজার দিকে পা বাড়ালো। তিতিক্ষা এতটাই ভয় পেয়েছে, যে ওর সেন্সে নেই ও এখন কি ড্রেসআপে আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নক্ষত্র তিতিক্ষার ফোনটা দেওয়ার জন্য তিতিক্ষার রুমে আসছিলো। রুমের দরজার কাছে পা রাখতেই নক্ষত্র তিতিক্ষার সাথে খুব জোরে ধাক্কা খায়। তাতেও তিতিক্ষার কোনো হুশই নেই। নক্ষত্র তিতিক্ষার অবস্থা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তিতিক্ষার পরিহিত ড্রেস দেখে নক্ষত্র ওর চোখ সংযত করে নিলো। তিতিক্ষা অন্য রকম এক ধ্যানে মগ্ন আছে। তার ধারণা কেউ তাকে খারাপ নজরে দেখছে। ওকে সেই নজর থেকে নিজেকে আড়াল করতে হবে। তিতিক্ষা আবার রুমের বাইরে পা বাড়াতেই নক্ষত্র তিতিক্ষার হাত ধরে টান দেয়। জোরে টান দেওয়াতে তিতিক্ষা নক্ষত্রের বুকে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ধরে সাথে সাথে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়।
নক্ষত্র তিতিক্ষাকে কিছু বলতে যাবে। তার আগেই তিতিক্ষা নক্ষত্রের বুকে ঢলে পড়লো। এত দ্রুত এসব হচ্ছিল যে, সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
নক্ষত্র তিতিক্ষাকে যখন ধরেছিলো, তিতিক্ষা তখন কাঁপছিলো। নক্ষত্র বুঝতে পারলো তিতিক্ষা আবার কোনো কিছুতে ভয় পেয়েছে। এখন তো ঘুমায়নি যে খারাপ স্বপ্ন দেখবে। তাহলে এখানে ভয় পাওয়ার কি হলো? ভয় পেলে মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন ও ডোপামিন নামের দুই ধরনের বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ প্রবাহিত হয়। যার কারণে মানুষ সেন্স হারিয়ে ফেলে। যদিও এটা নক্ষত্রের জানা আছে। কিন্তু হঠাৎ করে তিতিক্ষার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নক্ষত্র খুঁজে পেলো না। আপাতত এসব নিয়ে ভাবার কোন সময় নেই। নক্ষত্র দ্রুত তিতিক্ষাকে ধরে বেডে শুইয়ে দিলো। বার বার নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ডাকছে। কিন্তু তিতিক্ষার কোনো সেন্স নেই। নক্ষত্র তিতিক্ষার মুখে পানির ছিটা দিবে এজন্য সে পানি আনতে পা বাড়ালো।

বিভা আর তনুকা বসে পেয়ারা মাখানো খাচ্ছে। আহান দৌড়ে এসে একটা পেয়ারা নিয়ে সোফাতে দুম করে বসে পড়লো। তিনজনের টিভি দেখছে আর পেয়ারা মাখানো খাচ্ছে। আহান হুট করে মন খারাপের সুরে বলে উঠলো,
–“তিতু আপুকে খুব মিস করছি। তিতু আপু ছাড়া বাসাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কবে আসবে তিতু আপু?”
–“কালকে পরশুতে চলে আসবে।” (বিভা)
বিভা আর তনুকাও তিতিক্ষাকে খুব মিস করছে। সত্যিই তিতিক্ষা ছাড়া বাসাটা প্রানহীন লাগছে। মামনি আহানকে ডাকতেই আহান দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেল। বিভা আর তনুকা আবার ওদের মত টিভি দেখাতে মনোযোগ দিলো।
নক্ষত্র পানির ছিটা দেওয়াতে তিতিক্ষা হুড়মুড় করে উঠে বসলো। ওর সামনে নক্ষত্রকে দেখে তিতিক্ষার ডুকরে কেঁদে দিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে পানি খাইয়ে শান্ত করে নক্ষত্র বললো,
–“এত ভয় পাচ্ছো কেন? খারাপ কিছু দেখেছো? ”
তিতিক্ষা নক্ষত্রকে ওর ভয়ের কারণ বললো। নক্ষত্র এই কথাটা শুনে ওর ভ্রু কুঁচকে গেল। এই বাসায় কারো মন-মানসিকতা তো এত লেইম না। নক্ষত্র ছাড়া এখন বাসাতে কোনো ছেলেও নাই। তাহলে কার সাহস এত যে এই নোংরা কাজটা করবে?
তিতিক্ষা ভুল দেখেছে ভেবে নক্ষত্র তিতিক্ষাকে শান্ত করলো। ওয়াশরুমে থেকে ড্রেস এনে নক্ষত্র তিতিক্ষাকে পড়ে নিতে বললো। তিতিক্ষা ড্রেস পড়ে নেওয়ার পর, নক্ষত্র ওকে নিয়ে ওয়াশরুমের অপর পাশে গেল।

যদিও এদিকে তেমন কেউ আসে না। ঝোপঝাড়ে ভরা এই দিকটা। তিতিক্ষার মনে ভয় কাটাতেই নক্ষত্র তিতিক্ষাকে দেখাতে এনেছে। যাতে তিতিক্ষা নিজের চোখে দেখলে সহজেই ওর ভয়টা কেটে যায়। কিন্তু এখানে আসার পর নক্ষত্র আর তিতিক্ষা দু’জনেই চমকে উঠলো। এখানে পর পর ইট দিয়ে উঁচু করে রাখা। এই ইটের উপর দাঁড়ালে অনায়াসেই ওয়াশরুমে সবটা দেখতে পারবে। তিতিক্ষা এটা দেখার পর কেঁদে দিলো। নক্ষত্রের তো রাগে শরীর কিড়মিড় করছে। তিতিক্ষার ভাবনাটাই তাহলে সত্যি। নক্ষত্র নিজেকে স্বাভাবিক করে তিতিক্ষাকে বললো,
–“আমাকে ৪ টা ঘন্টা সময় দাও। আমি সেই ব্লাডি বিচকে খুঁজে নিবো। তারপর…।”
নক্ষত্র তিতিক্ষাকে স্বাভাবিক থাকতে বললো। ব্যাপারটা যাতে আপাতত কেউ না জানে, তাই ভেবে। রুমের দরজাতে নক্ষত্র যখন তিতিক্ষাকে টেনে ওর বুকে ফেলে, তখন নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষাকে খেতে ডাকতে আসছিলো। নক্ষত্র রুমে দরজা বন্ধ করে দেওয়াতে উনি রং কিছু ভেবে বসেছে। আর রং কিছু ভাবার মেইন পয়েন্ট তিতিক্ষার ড্রেসআপ।
এজন্যই নক্ষত্র আর তিতিক্ষার সাথে নক্ষত্রের আম্মু রুড ব্যবহার করলো।
নক্ষত্র ওর আম্মুকে এই পুরো ঘটনাটা জানালো। এখন না জানালে উনি তিতিক্ষাকে খারাপ ভাবছে। আর এটা নক্ষত্র মানতে পারছে‌ না। নানু, বড় মামী, ছোট মামী সবাই এই কথা জানলো। উনারাও অবাক হলো কারণ এমন তো এর আগে হয়নি। নক্ষত্র আর কিছু না বলে রুমে থেকে চলে গেল। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সরি বললো। পলক বাসাতে ঢুকতেই সাইফুলের সাথে ধাক্কা খেলো। সাইফুল কোনো রকম সরি বলে দ্রুত পায়ে চলে গেল। পলক বাসাতে ঢুকে ওর আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলো,

–“আম্মু সাইফুল আমাদের বাসায় এসেছিলো কেন?
–“তা তো আমি জানি না?” (আম্মু)
–“ও ছেলে ভালো না। বাসায় মেয়েরা আছে, ওকে যেন আমাদের বাসাতে আর না দেখি। নিষেধ করে দিবা। তা না হলে মেরে পুঁতে দিবো।”
নক্ষত্র পলকের কথাটা শুনতে পেলো আর জিজ্ঞাসা করলো,
–“সাইফুল কে?
পলক বললো ওদের পাশের বাসার ছেলে। নক্ষত্র পলককে জরুরী কাজের কথা বলে দু’ভাই বাসা থেকে বের হলো। দুই ঘন্টা হতে চললো নক্ষত্র বাসার বাইরে। তিতিক্ষার মনটা খুব উশখুশ করছে। নক্ষত্রের আম্মুরও খুব টেনশন হচ্ছে। উনি উনার ছেলেকে খুব ভাল করেই চিনে। এর শেষ দেখে তবেই সে থামবে। ভুল বুঝে নক্ষত্রকে মেরে এখন ওর আম্মু চোখের পানি ফেলছে। তিতিক্ষাকে তো উনি আমানত হিসেবে এনেছে। নক্ষত্রের করা কোনো ভুলের কারণে সবাই তো উনাদের দায়িত্বহীন ভাবতো। তিতিক্ষার বাবা মায়ের কাছেও উনারা দায়িত্বহীনের পরিচয় দিতো। আর উনাদের তখন এই মুখটাই বা দেখাতো কোন বিবেক নিয়ে। এজন্য রাগের মাথায় আর কোন কিছু না ভেবে উনি নক্ষত্রকে মেরেছে। নিজের চোখে যা দেখেছে, সেটাই সত্যি ভেবেছে। সচারচর আমরা যেটা করি আর কি। তবে মা হিসেবে উনার বিবেকের জায়গাতে দাঁড়িয়ে উনি সঠিক বিচারকই ছিলেন।
একটু পরেই পলক একজনের কলার ধরে টেনে আনলো। ছেলেটার নাক মুখ রক্তাক্ত করা। দু’ভাই ইচ্ছে মতো মেরেছে ছেলেটাকে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ছেলেটার কলার ছাড়তেই ধপ করে সে মাটিতে পড়ে গেল। নক্ষত্রের চোখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সে প্রচন্ড রেগে আছে। নক্ষত্র ছেলেটাকে আবার মারতে গেলে পলক আটকালো। এই ছেলেটাই ওয়াশরুমে ভ্যান্টিলিটারের ফুটা দিয়ে তিতিক্ষাকে দেখছিলো। তিতিক্ষা ছেলেটাকে দেখে অবাক হয়ে মনে মনে বললো,

–“উনি তো খেলার সময় আমার পেছনেই
দাঁড়িয়ে ছিলো।”
সাইফুল মেলাতে থেকেই তিতিক্ষার উপরে নজর রাখছিলো। অদ্রিকেও বেশ কয়েকবার চোখ দিয়ে গিলে খেয়েছে। আর সুযোগ বুঝে ঝোপের পাড়ে গিয়ে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলো। তবে তিতিক্ষা বুঝতে পারায় ওর প্ল্যান সাকসেসফুল হয়নি।
নানু তখন রুম থেকে এসে রেগে গিয়ে বললো,
–“অগুরে মারিয়া খমর (কোমর) বাংগিলা। হালা খবিস।”
নক্ষত্র ওরে বাইরে থেকে ইচ্ছেমত ধোলায় করেই এনেছে। পলক না থামালে হয়তো ওকে মেরেই ফেলতো নক্ষত্র। প্রথমে নক্ষত্র ভালো ভাবে কথা বলে সত্যি জানতে চেয়েছিল। কিন্তু সে বলতে রাজি হয় নি। উল্টে সে নক্ষত্রকে এটিটিউড দেখিয়েছে। তাই নক্ষত্রও আর তেল না মেরে ইচ্ছা মত ধোলাই করেছে। মার খেয়ে আধমরা হয়ে, তারপর সবটা বলে দিয়েছে। পলককে নানু আবার বললো,
–“ইগুরে ফুলিশ ও দেওয়ার দরকার নাই। তুই তার বারোটা বাজা। তার অতো বড় সাহস।”
নক্ষত্র উঠে দাঁড়ালো। কারো দিকে তাকালো না। ওর আম্মুর সামনে গিয়ে বললো,
–“এয়ার টিকিট কেটে এনেছি। আর এক ঘন্টা পর ফ্লাইট। তারাতাড়ি রেডি হয়ে নাও।”
নক্ষত্র কথাটা বলে তিতিক্ষার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেল। বড় মামা, ছোট মামা তখন বাসায় আসলো। সবটা জেনে উনারাও রেগে গেছে। নক্ষত্রকে কিছু বলার মত ভাষা তারা খুঁজে পেলো না। তাকে কিছু বলেও এখন আর কোন লাভ হবে না।
নক্ষত্ররা রেডি হয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তিতিক্ষা চুপ করে বসে আছে। কেউ নক্ষত্রের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। তবে নক্ষত্র প্রয়োজনীয় কথা সবার সাথেই বলেছে। যথা সময়ের ওরা পৌঁছে গেল। নক্ষত্র ওর বাবাকে ফোন দিয়ে ওদের দুইটা গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলেছিলো। ওরটা আর বাবার গাড়িটা। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার কপালে আদর দিয়ে বললো,

–“আম্মু আমার উপরে আর রাগ করে থাকিস না।”
–“না আম্মু, আমি মোটেও তোমার উপরে রেগে নেই। তুমি মারলেও আমি রাগ করবো না। তুমি না বলেছো আমি আগে তোমার মেয়ে। পরে তোমার পুত্রবধু।”
তিতিক্ষা কথাটা বলে মুচকি হেসে নক্ষত্রের আম্মুকে জড়িয়ে ধরলো। এরপর অদ্রিকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলো। নক্ষত্র একটা গাড়িতে অদ্রি আর ওর আম্মুকে চলে যেতে বললো। আর একটা গাড়িতে নক্ষত্র তিতিক্ষাকে বাসায় পৌঁছে দিতে গেল। নক্ষত্র চুপ করে ড্রাইভ করছে। কিছুক্ষণ পর তিতিক্ষা আমতা আমতা করে বললো,
–“র রেগে আছেন এখনো?”
নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তিতিক্ষার এক হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙ্গুল রেখে বললো,
–“নিজের খেয়াল রাখবে আর সাবধানে থাকবে। আমার তিতিক্ষা নামক মনোপ্যাথিকে তোমার কাছে আমানত রেখে যাচ্ছি। অযত্ন যেন না হয়।”
বাসার সামনে আসতেই গাড়িটা থেমে গেলো। তিতিক্ষার কেন জানি যেতে ইচ্ছে করছে না। নক্ষত্রের সঙ্গ ছাড়তে বেহায়া মনটা যে বড্ড নারাজ।
তিতিক্ষাকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে নক্ষত্র গাড়ির গ্লাসটা তুলে দিলো। এরপর তিতিক্ষাকে জড়িয়ে ধরলো। তিতিক্ষাও আজকে নক্ষত্রকে জড়িয়ে ধরলো। কয়েক মিনিট এভাবে থাকার পর,
নক্ষত্র শান্ত সুরে বললো,
–“বাসায় যাও।”
তিতিক্ষা নক্ষত্রকে ছেড়ে কান্নামাখা সুরে বললো,
–“সাবধানে যাবেন। আর অবশ্যই নিজের খেয়াল রাখবেন।”
নক্ষত্র মুচকি হেসে তিতিক্ষার কপালে আদর দিলো।

তিতিক্ষা গাড়ি থেকে নেমে গেল। নক্ষত্র এখন আর তিতিক্ষাদের বাসায় গেলো না। তিতিক্ষা বাসাতে ঢুকে গেলে নক্ষত্রও চলে গেল। নক্ষত্র একটানে অনেক দূরে এসে এক সাইডে গাড়ি থামিয়ে দিলো। স্টিয়ারিংয়ে মাথা রাখলো। তিতিক্ষাকে ছাড়া বুকটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যাওয়ার সময় তিতিক্ষার কান্না মাখা মুখটা বার বার ভেসে উঠছে। নক্ষত্র বেশ কিছুক্ষন ওভাবেই বসে রইলো।
তিতিক্ষা বাসায় ঢুকে সবার সাথে কথা বললো। সবাই ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা করছে। তিতিক্ষা উত্তর দিচ্ছে। একটু পর সোফা থেকে উঠে মাথা ব্যথার অজুহাত দিয়ে ওর রুমে চলে গেল। আর মামনিকে বলে গেলো রাতে আর খাবে না; জার্নি করে এসেছে এখন সে ঘুমাবে। তিতিক্ষা ফ্রেশ না হয়ে শুয়ে আছে। ওর চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। রুমটা পরিপূর্ণ করে সাজানোর পরও খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। হয়তো নক্ষত্রের উপস্থিতটাকে সে খুব মিস করছে। আচ্ছা এটা কেমন অদ্ভুত অনুভুতি, যে অনুভূতির অন্তরালে অবাধ্য মনটা বেহায়া হয়ে উঠলেও খারাপ লাগছে না? আগে তো কারো অনুপস্থিতিতে এতোটা খারাপ লাগেনি। মনটা তো কারো জন্য এতটা উতলা হয়নি। তাহলে এখন কেন বেপরোয়া নিষ্ঠুর মনটা নক্ষত্রের অনুপস্থিতির কথা বার জানান দিচ্ছে। কেন এত কষ্ট হচ্ছে? কেন মনটা নক্ষত্রের বাহুডোরেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছে? কেন মন বলছে নক্ষত্রের শার্ট আঁকড়ে ধরে খুব কাঁদতে? তিতিক্ষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠলো,
–“আপনি মানুষটা খুব খুব খারাপ। আর কোনো দিন আমি আপনার সাথে কথা বলবো না। নিষ্ঠুর, পাষাণ, লোক একটা। কি দরকার ছিলো আপনার অনুভূতি গুলোর সাথে আমার অনুভূতির পরিচয় করানোর। আপনার অনুপস্থিতিতে এখন যে আমি এতটা কষ্ট পাচ্ছি, এর দায়ভার কে নিবে? খুব খুব দুষ্টু লোক আপনি।”

তিতিক্ষা বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে দিলো। নক্ষত্র বাসাতে পৌঁছানোর পর তিতিক্ষার কাছে ভয়েজ মেসেজ করলো। তিতিক্ষার মেসেজটি ওপেন করে ওর মুখে হাসির রেখা ফুটলো। গানের ভয়েজের টোন টা চিনতে তিতিক্ষার একটুও সময় লাগেনি। কারণ এটা নক্ষত্রের কন্ঠ,
“ওহ তোর মন খারাপের দেশে,
যাবো প্রেমের খেয়ায় ভেসে।
তোর মনটা ভালো করে
দেবো অনেক ভালোবেসে।
ডাকলে কাছে আসিস,
পারলে একটু হাসিস।
বুকটা রাখিস পেতে,
ভালবাসা নিতে।
সব অভিমান ভেঙ্গে দিবো
তোর কাছে এসে।”
গানের প্রতিটা কথা নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ডেডিকেট করেছে। এতটা আদুরে সুরে নক্ষত্র গাইছে যে, তিতিক্ষার মনটা জুড়িয়ে গেছে। গানের প্রতিটা লাইন যেন শুধু তিতিক্ষার জন্য তৈরী। নক্ষত্র যেন এই গানের মাধ্যমেই তিতিক্ষাকে অনেক কথা বুঝিয়ে দিলো। এই মুহূর্তটার জন্য এটা পারফেক্ট একটা গান। তিতিক্ষা ওর কানে ইয়ারফোন গুঁজে নিলো। নক্ষত্রের ছবির দিকে সারারাত নক্ষত্রের গাওয়া গানটা শুনেছে। তিতিক্ষা এই পুরো রাতে এক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারেনি। নক্ষত্রকে এখন কাছে না পাক, নক্ষত্রের জন্য জমিয়ে রাখা অনূভূতিরা তো ওর সাথে আছে। সেই অনুভূতি আর নক্ষত্রের আদুরে কন্ঠে গাওয়া গান তো ওর সাথে আছে। তাহলে ওর আর কি বা চাই? এই মুহূর্তের জন্য এটাই তিতিক্ষার কাছে এক পৃথিবী সুখের সমান।

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_17

ভোরের আজান দিচ্ছে। তিতিক্ষা ওর কান থেকে ইয়ারফোন খুলে রাখলো। আর আজানের সুরটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। আজান শেষ হয়ে গেলো। তিতিক্ষা এখনো চুপ করে শুয়ে আছে। নক্ষত্রের মুচকি হাসি, আদুরে কথা, ওকে রাগানো, লজ্জা দেওয়া, এসব কথা আবার মনে পড়ে গেল। তিতিক্ষা মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললো,
–“আল্লাহ! আমার পাগলটাকে সব বিপদের হাত থেকে রক্ষা করো। পৃথিবীর সব সুখ দিয়ে ভরিয়ে দিও ওর জীবন। আর সব সময় ওর মুখের হাসিটা বজায় রেখো।”
তিতিক্ষা বেড থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিলো। তিতিক্ষা ওর মোনাজাতে নক্ষত্রের জন্য মন থেকে দোয়া করলো। নামাজ পড়ে, ফোনটা চার্জে দিয়ে, দরজা হালকা করে লাগিয়ে তিতিক্ষা শুয়ে পড়লো। সকাল সাড়ে আটটার দিকে বিভার ডাকে তিতিক্ষার ঘুম ভাংলো। আহান দৌড়ে এসে তিতিক্ষার ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে ঢুকে গেল। বিভাও আর না দাঁড়িয়ে সেও শুয়ে পড়লো। শীতটাও বেড়েছে আর সকাল বেলা ব্ল্যাঙ্কেট ছেড়ে উঠাটাও যেন কষ্টসাধ্য। শীতকালে ব্ল্যাঙ্কেটই যেন জীবন-মরন। এটাই সবার নিত্য সঙ্গী। তিতিক্ষা আহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ইস! কত দিন পর তিতিক্ষা আহানকে দেখছে। বাসার সবচেয়ে ছোট সদস্য। এজন্য ওর ভাগে ভালবাসাটাও একটু বেশি। তিতিক্ষা আহানের গালে আদর দিলো। আহানও তিতিক্ষার গলা জড়িয়ে ধরলো।

আহান শুয়েছে ওদের দু’জনের মাঝখানে। বিভা তিতিক্ষাকে ওখানে কি করলো, না করলো এসব জিজ্ঞাসা করছে। তিতিক্ষা হেসে হেসে সে গুলো বলছে। বিভা আর আহান তিতিক্ষার ফোনটা নিয়ে নক্ষত্রের সাথে ওদের বেড়ানোর পিক গুলো দেখছে। তিতিক্ষার মুখে এত কিছু শুনে বিভা তো নক্ষত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ওদের কথার মাঝখানে হঠাৎ আহান উঠে দৌড়ে চলে গেল। আহান যাওয়ার ৫ সেকেন্ডের মধ্যে তিতিক্ষার আর বিভাও নাক চেপে ধরে বেডে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফাজিল আজকেও একই কাজ করেছে। বিভা তো পারছে না আহানকে গিলে খেতে। এই ফাজিলটার জন্য শান্তিমত শুয়ে বসে থাকাও যায় না। বিভা আর তিতিক্ষা অসহায় চোখে দু’জন দুজনের দিকে তাকালো। আহান ওদের শুয়ে থাকার ইচ্ছেটাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলো। আর বিভা আর তিতিক্ষার এভাবে উঠে দাঁড়ানোর কারণ আহান ব্ল্যাঙ্কেটের ভেতরে সর্তকতার সাথে বায়ু দূষণ করে পলায়ন করেছে। আর বায়ু দূষণের সাইড ইফেক্ট পুরো ব্ল্যাঙ্কেটে ছড়িয়ে গিয়েছে।
এজন্যই আর শুয়ে থাকার চিন্তা বিভা বা তিতিক্ষার কেউই করতে পারছে না।
অদ্রি কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। এই কয়েকদিন নোট গুলো ওর কালেক্ট করতে হবে। নক্ষত্রের আব্বু-আম্মু ড্রয়িংরুমে বসে আছে। নক্ষত্র কালকে রাতে বাসায় ফিরেনি। তবে রাতেই ওর আব্বুকে ফোন দিয়ে বলেছে, ও কোনো একটা কাজে যাচ্ছে। ওর সাথে রুহান আর সাফওয়ানও যাচ্ছে। মিঃ আবরার আর কিছু বলেনি। কারণ মাঝে মাঝে বন্ধুদের নিয়ে গায়েব হওয়া ওর পুরনো অভ্যাস। নক্ষত্র ওর ফোনটা ইচ্ছে করেই সুইচ অফ করে রেখেছে। এখানেও হয়তো কোন কারণ আছে।

নক্ষত্র আপাতত ওদের বাংলো বাড়িতে আছে। এই কথাটা কাউকেই সে জানায় নি। মন খারাপের দিনগুলোতে মাঝে মাঝে নিজেকে সময় দিতে ও এখানে আসে। তিনজন মিলে এখানে কয়েকদিন থাকবে বলে ঠিক করে। সাফওয়ান, রুহান আর নক্ষত্র বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এখন বাজে সকালে ১১ টা ২৩; তবুও এদের উঠার নাম নাই। ১২ টার দিকে নক্ষত্র আর রুহান উঠে খাবার অর্ডার করে খেয়ে নিলো। রুহান এতবার ডেকেও সাফওয়ানকে তুলতে পারলো না। অবশেষে রুহান সাফওয়ানের প্যান্ট ধরে টানাটানি করতে লাগলো। এতেও সাফওয়ানের কোন বোধগম্য হলো না। বরং সে শান্ত সুরে বললো,
—“তুই কি আমার ইজ্জত লুটতে চাচ্ছিস? তাহলে ভালো করেই লুট। এই প্যারাময় জীবন নিয়ে আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।”
এই কথা বলে সে আবার ঘুমিয়ে গেল। রুহান অসহায় চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্র চুপ করে ওদের কান্ড দেখছে। রুহান আবার সাওয়ানকে গুঁতো দিয়ে বললো,
–“তোর লজ্জা করছে না আমাকে তোর ইজ্জত লুটতে বলছিস? শালা তুই আসলেই নির্লজ্জ।”
সাফওয়ান এবারও চোখ বন্ধ করে বললো,
–“লজ্জা? সেটা আবার কি? খায় নাকি মাথায় দেয়। আচ্ছা শোন, আমার প্যান্টটা তোর পছন্দ হলে খুলে নে। শুধু শুধু এভাবে টানানটানি করে আমাকে বিরক্ত করিস না। আমাকে একটু ঘুমোতে দে ভাই।”
রুহান হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লো। নক্ষত্র উঠে ফ্রীজ খুলে আইস কিউব নিয়ে আসলো। এরপর রুহানকে ইশারা করতেই রুহান সবটা বুঝে গেলো। নক্ষত্র মিটিমিটি হেসে আবার সোফাতে গিয়ে বসলো। এমন ভাব করলো যেন সে কিছুই জানেনা।
একটু পরেই সাফওয়ান হুড়োহুড়ি করে বেড থেকে উঠে দাঁড়ালো। রুহান আর নক্ষত্র সাফওয়ানের কান্ড দেখে হো হো করে হেসে দিলো। রুহান সাফওয়ানের প্যান্টের ভেতর আইস কিউব ঢুকিয়ে দিয়েছে। শীতের মধ্যে প্যান্টের ভেতর তো আর আইস কিউব নিয়ে শুয়ে থাকা যায় না। এজন্য সাফওয়ানকে অগত্য বেডে ছেড়ে উঠতেই হলো। সাফওয়ান রেগে ওদের গালি দিয়ে বললো,
–“শালা হারামিরা তোরা কি মানুষ হবি না? আমার সাদের ঘুমটার সাথে তোদের এত শত্রুতা কিসের বলবি?”
নক্ষত্র আর রুহান চুপ করে আছে। ওরা এমন ভাব ধরে আছে, যে ওরা এসববের কিছু জানেই না। সাফওয়ান রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললো,

–“শালা তোদের বদদোয়া দিলাম। তোদের বাসর রাতে তোদের বউ তোদের মান ইজ্জত লুটে নিবে।”
সাফওয়ানের কথা শুনে নক্ষত্র আর রুহান হাসতে হাসতে একসাথে বলে উঠলো,
–“আমিন।”
সাফওয়ান ওদের সাথে না পেরে গালি দিতে দিতে ওয়াশরুমে চলে গেল। রুহান আর নক্ষত্র হাসতে থাকলো। ওরা বেচারাটাকে একটু শান্তি মত ঘুমোতেও দিলো না। সাফওয়ান ফ্রেস হয়ে খেয়ে নিলো। নক্ষত্র আর রুহান দুজনেই ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর সাফওয়ানের কাছে ফোনের পর ফোন আসতেই থাকলো। সাফওয়ানের ফ্রেন্ড সার্কেলের ফ্রেন্ডরা সাফওয়ানকে ফোন দিতেই আছে। সাফওয়ান তো খুব ভাব নিয়ে কলটা রিসিভ করলো। এরপর যা শুনলো ওর পিলে চমকে উঠলো। সাফওয়ানের তাকানো দেখে নক্ষত্র আর রুহান আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। এরপর দু’জনেই দৌড় দিলো। এখন ওদের ধরতে পারলে সাফওয়ান গিলে খাবে। কারণ শ্রী-পুর চা বাগানে জেসিকার হ্যান্ড ব্যাগ ঝুলানো সাফওয়ানের সেই পিকটা নক্ষত্রের কথা মত রুহান ফেসবুকে আপলোড করেছে। তাও আবার ওদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাইকে ট্যাগ করে। বেচারা সাফওয়ানের এখন ইজ্জতের দফারফা। সে পারছে না চিৎকার দিয়ে কাঁদতে।

তনুকা আর রায়হানের বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে। এই নিয়ে বাসাতে হৈচৈ হচ্ছে। বিভা আর তিতিক্ষার তো সব প্ল্যান করা শেষ। মামনি বিয়ের কার্ড অলরেডি বিলানো শুরু করে দিয়েছে। নবিন বাসায় এসেছে ছুটি নিয়ে। মামনির মেয়ের বিয়ে বলে কথা; এজন্য উনি পার্লারে গিয়ে রুপচর্চাও করছে। মেয়ের মা একটু বেশি চকচক না করলে হয়! আহান বিয়ের পাঁচটা কার্ড নিলো। ওর বন্ধুদের ইনভাইট করবে তাই। মামনি নক্ষত্রকে ফোন দিলো, কিন্তু সুইচ অফ দেখাচ্ছে। উনি নক্ষত্রের আম্মুকে ফোন দিয়ে বিয়ের কথা জানালো। আজকে সকালে তিতিক্ষার ফোনে নক্ষত্রের কোনো মেসেজ আসেনি। তিতিক্ষা রেডি হয়ে ইউনিভার্সিটিতে গেল। একটা ক্লাস করে বিভা আর তিতিক্ষা শপিংমলে গেল। প্রয়োজনীয় কিছু কেনা কাটা করে দু’বোন বাসায় ফিরলো। সন্ধ্যার দিকে সবাই মিলে আড্ডাতে বসেছে। নবিন বললো,

–“তনুকা রায়হানরা কি কমিউনিটি সেন্টার বুক করেছে? সব কিছু কি ওদের এ্যারেঞ্জ করা শেষ?”
–“জ্বি ভাইয়া।”
আহান বিভার কাছে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরঘুর করছে। কারণ সে এখন বিভার ফোনটা নিবে। বিভার আজকে সকালের কথা মনে করে আহানের পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে দিলো। আহান বিভার চুল ধরে মারামারি শুরু করে দিলো। নবিন এসে আহান থামালো। বিভা নবিনকে বলে দিলো আহান সকালে কি করেছে? এমন বেয়াদবি করার জন্য নবিন আহানকে বকলো। আর এমন করলে মার খাবে এটাও বললো। এই কথা শুনে আহান চিৎকার করে নবিনকে বলে উঠলো,
–“ভাইয়া আমাকে একদম বকবে না। আমি তো ছোট ছোট দুইটা দিয়েছি। আর তুমি যে ইয়া বড় বড় দাও। পুরাই এক একটা নদীর সমান।”
আহানের কথাটা ড্রয়িংরুমের যেন বিষ্ফোরিত হলো। কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপ হয়ে গেল। এরপর নবিন বাদে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বিভা আর তিতিক্ষা হাসতে হাসতে ফ্লোরে বসে পড়লো। নবিন অগ্নি দৃষ্টিতে আহানের দিকে তাকিয়ে আছে। তনুকা মুখে ওড়না দিয়ে না হাসার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তার চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। আহান নবিনের তাকানো দেখে সে চুপটি করে সোফাতে বসলো। বিভা আর তিতিক্ষার হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বড় ভাইবোনের ইজ্জতের ফালুদা করতে বাসার কনিষ্ঠ সদস্যরাই যথেষ্ট। নবিনের বকুনিতে দু’জনেই কোনমতে হাসা থামালো। তখনই মামনি বিয়ের কার্ড এনে যার যার ফ্রেন্ডকে ইনভাইট করতে বললো। মামনি তিতিক্ষাকে বললো,
–“তিতিক্ষা সকাল থেকে নক্ষত্রের ফোন বন্ধ কেন? নক্ষত্র এখন আমাদের বাসার জামাই,ওকে আগে থেকে না বললে হয়। তোকে ফোন দিলে বলিস আমি ওর সাথে কথা বলবো।”

তিতিক্ষা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। নক্ষত্রের ফোনটা বন্ধ তিতিক্ষার জানা ছিলো না। কারণ তিতিক্ষা নক্ষত্রকে ফোন দেয়নি। সকাল থেকে নক্ষত্র ফোন বন্ধ? ব্যাপারটা নিয়ে তিতিক্ষাকে অন্যমনস্ত দেখে, নবিন তিতিক্ষার মাথায় ঠুয়া মারলো। তিতিক্ষা মাথায় হাত বুলাতে বুলতে নবিনের দিকে তাকালো। নবিন হাসতে হাসতে বললো,
–“বরের ফোন বন্ধের কথা শুনে মুখটা চুপসে গেলো।তুই তে দেখছি বরপাগল হয়ে গেছিস। যদিও হওয়ার কথায় ছিলো।”
বিভা ফট করে বলে উঠলো,
–“কেন ভাইয়া? হওয়ার কথা ছিলো বললে কেন?”
নবিন তিতিক্ষার দিকে তাকালো। বিভা, তনুকা আর আহান নবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। নবিন ভাব নিয়ে বসে অভিজ্ঞদের মতো করে বললো,
–“যে ছেলের নাক ঘামে তার বউ নাকি বর পাগলী হয়। আমি নাহিয়ানের নাক ঘামতে দেখেছি। এখন কথা হচ্ছে, বউয়ের ভালবাসার চোটে সে পাবনার মেন্টাল হসপিটালের বাসিন্দা না হলেই হয়।”
নবিন কথাটা শেষ করেই ওখান থেকে স্থান ত্যাগ করলো। তিতিক্ষা নবিনের কথা শুনে চুপ করেই আছে। বড় ভাইকে তো কিছু বলাও যাচ্ছে না। তবে নবিনের কথা শুনে খুব লজ্জা পেলো তিতিক্ষা। নক্ষত্রের যে খুব নাক ঘামে এটা তিতিক্ষাও খেয়াল করেছে। সিলেটে ঘুরাঘুরির সময় তাকে বার বার টিস্যু দিয়ে নাক মুছতেও দেখেছে। তাই বলে সে নাকি বর পাগলী? এই ব্যাপারটা ভাবলেই ওর খুব লজ্জা লাগছে। নক্ষত্রের নাক ঘামে তো কি হয়েছে ? তাই বলে অবশেষে কি না বরপাগলীর খেতাব।
বিভা, আহান আর তনুকা হো হো করে উচ্চ শব্দে হাসছে। তিতিক্ষার মুখটা লজ্জাতে লাল হয়ে গেছে। বিভা তো হাসির চোটে কথাও বলতে পারছে না।
তিতিক্ষা ওখানে আর না থেকে ওর রুমে চলে গেলো। এখানে থাকলে এরা ওকে লজ্জা দিয়েই যাবে। রাতের খাবার খেয়ে তিতিক্ষা নক্ষত্রকে নিজে থেকেই ফোন দিলো। কিন্তু নক্ষত্রের ফোনটা এখনো সুইচ অফ বলছে। তিতিক্ষা বেশ কয়েকবার ট্রাই করলো কিন্তু লাভ হলো না। মন খারাপ করে নক্ষত্রের গানটা শুনছে আর ওর পিক গুলো দেখছে। নক্ষত্রকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে একটা সময় ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
দুই দিন পর…….!!

তিতিক্ষার এখন খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি, পড়াশোনা, তনুকার বিয়ের শপিং, বিয়ে উপলক্ষে করা নিজেদের করা প্ল্যান; এসব নিয়েই দিন কাটছে। এতকিছুর মাঝেও তিতিক্ষা মন খুলে হাসতে পারেনি। অজানা এক কারণে নক্ষত্র এই দুই দিন তিতিক্ষার সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি। তিতিক্ষা প্রতিটা সেকেন্ড ফোন চেক করেছে। কিন্তু নক্ষত্রের না এসেছে একটা কল, আর না এসেছে কোনো মেসেজ। এই দুইদিন তিতিক্ষা অস্থির হয়ে আছে। শুধু একটাবার নক্ষত্রের সাথে একটু বলার জন্য। তিতিক্ষা অদ্রিকেও ফোন করেছিলো, নক্ষত্রের খোঁজ জানার জন্য। কিন্তু লজ্জাতে তাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেনি। অদ্রি তিতিক্ষার অবস্থা বুঝতে পেরে নিজেই বলেছে, নক্ষত্র দুইদিন ধরে বাসায় ফিরেনি। এটা শুনে তিতিক্ষার মাথাতে হাজার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। রাতে কোনো রকম একটু খেয়ে এসে শুয়ে পড়েছে। নক্ষত্রের চিন্তায় সর্বক্ষণ ওর মাথাতে ঘুরছে।
রাত প্রায় ১ টার দিকে নবিন তিতিক্ষার দরজাতে নক করলো। তিতিক্ষার শুয়ে থেকেই জিজ্ঞাসা করলো।
–“কে?”
নবিন বললো,
–“তিতু তুই কি শুয়ে পড়েছিস?”
–“জ্বি ভাইয়া। কিছু লাগবে তোমার?
–“ওহ আচ্ছা। না থাক, তুই ঘুমা।”
–“আচ্ছা।”

নবিন চলে যাওয়া পর তিতিক্ষা আবার বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো। আবার ওর বেহায়া চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কেন জানি ওর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। নক্ষত্রের এমন করার পেছনে কি কারন থাকতে পারে? তিতিক্ষার এবার নক্ষত্রের উপর বড্ড অভিমান হচ্ছে। এমন লুকোচুরি করার মানে কি?
তিতিক্ষা ওর চোখের পানি মুছে কান্নামাখা সুরে বললো,
–“একটাবার কি আমার কথা মনে পড়ে না? একটা বার কি আমাকে ফোন দেওয়া যায় না? এত নিষ্ঠুর কেন আপনি?”
পরেরদিন সকালে…….!!
আজকে তনুকার গায়ে হলুদ। তিতিক্ষা ওর মন খারাপের অধ্যায়টাকে আড়ালে লুকিয়ে ফেললো। বাসায় কাউকেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে, ও বরের বিরহে গভীর শোকে আছে। এমনিতেই বরপাগলের খেতাব পেয়েছে। আর এটা কাউকে জানলে তো তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
সকালবেলা বিভা আর আহানের অত্যাচারে ওর ঘুমের দফারফা হয়ে গেছে। তবে ষএকটা অঘটন ঘটে গেছে। রায়হানরা ওদের গায়ের হলুদ আর বিয়ের জন্য যে কমিউনিটি সেন্টার বুক করেছিলো, সেই সেন্টারের কতৃপক্ষ সব বুকিং ক্যাসেল করে দিয়েছে। এই নিয়ে বাসার সবার মুখে চিন্তার ছাপ। এমন কথা শুনে তিতিক্ষার এই সকাল বেলাতে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মামনি আইস ব্যাগ মাথাতে নিয়ে বসে আছে। টেনশনের উনার মাথায় আগুন জ্বলে যাচ্ছে।

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_18

আজকে তনুকার গায়ে হলুদ। কিন্তু কারো মন ভালো নেই। এতগুলো গেস্ট কিভাবে ম্যানেজ করবে; এই চিন্তাই সবাই মাথায় ঘুরছে। কালকে রাতে নবিন মামনিকে বলেছে বাসায় তিনজন গেস্ট এসেছে। এজন্য মামনি আর বসে না থেকে রান্নাঘরে চলে গেলো। বিভা আর তিতিক্ষাও সাথে গেল। মামনি খাবার গুলো ওদের হাতে দিচ্ছে আর ওরা ডায়নিং টেবিলে সাজিয়ে রাখছে। ওইদিকে রায়হানদেরও টেনশনে কাল ঘাম ছুটে গেছে। কে জানতো এমন অশোভনীয় একটা ব্যাপার ঘটে যাবে। বাসাতে দুই একজন কাছের গেস্টরাও এসে হাজির হয়েছে। তারা ফুসুর ফুসুর করা শুরু করে দিয়েছে। রায়হান আর তনুকার টেনশনে মাথা কাজ করছে না। অন্য সব সেন্টারে খোঁজ নিচ্ছে কিন্তু ফাঁকা পাচ্ছে না।
আগে থেকে বুকিং না দিলে যা হয়।
তিতিক্ষার আব্বু আম্মু আজকে ১০ টার মধ্যেই এসে পৌঁছাবে। রায়হান আর তনুকার একসাথে গায়ে হলুদ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি; কি হবে কে জানে! নবিন কারো সাথে কথা বলতে বলতে ওর রুম থেকে বের হলো। তিতিক্ষা পানির জগটা রেখে ঘুরে দাঁড়াতে নবিনের সাথে সাফওয়ান আর রুহানকে দেখতে পেলো। ওদের এখন এখানে দেখে তিতিক্ষা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রুহান আর সাফওয়ান হেসে তিতিক্ষার সাথে কথা বললো,

–“মিসেস নাহিয়ান আপু কেমন আছো?”
-“আলহামদুলিল্লাহ! আপনারা কেমন আছেন ভাইয়া।”
–“আমি ভালো নেই আপু। তোমার বর আমার সাথে থাকলে ভালোর ‘ভ’ ও আমার কাছে আসে না।” (সাফওয়ান মুখ কাচুমাচু করে)
তিতিক্ষা সাফওয়ানের কথা কিছু বুঝলো না। রুহান সাফওয়ানকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। মামনি তো ওদের দেখে খুশিতে আটখানা। তিতিক্ষা কিছু বুঝতে পারছে না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুধু দেখছে। সাফওয়ান আর রুহান এখানে, তাহলে নক্ষত্র কই? নবিন রুহানদের ব্রেকফার্স্ট সার্ভ করে দিতে বলে, নিজেও চেয়ার টেনে বসে গেল।
তিতিক্ষার মন বলছে নক্ষত্র এখানে উপস্থিত আছে। তবে এমনটা মনে হওয়ার কারণ তিতিক্ষার জানা নেই। হঠাৎ আপনের থেকেও আপনতর কারো কন্ঠ শুনে তিতিক্ষা পেছনে তাকালো। নক্ষত্র ফোনে কথা বলতে বলতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। এখন এখানে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নক্ষত্রকে দেখে তিতিক্ষার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে দ্রুত তার চোখের অশ্রু বিন্দু মুছে নিলো। তিতিক্ষা ওর মনের বিরুদ্ধেই নক্ষত্রের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। যার জন্য সারারাত ঘুমাতে পারেনি; সে কিনা ওর বাসাতেই উপস্থিত ছিলো। তবুও একটা বার জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। নক্ষত্রের প্রতি তিতিক্ষার মনে খুব অভিমানের জন্ম নিলো। তিতিক্ষা অভিমানী চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,

–“এই নিষ্ঠুর মানুষটার জন্য আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছিলাম না। আর উনি এখন আমাকেই ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। একটা বার আমার দিকে তাকালোও না অবধি। ঠিক আছে! বলবো না আর কথা। আর কোনদিনও বলবো না। আমার কি রাগ নেই? আমিও দেখবো, মহারাজের আমাকে মনে পড়ছে কিনা।”
নক্ষত্র বাসার পরিহিত ড্রেস পড়ে আছে। রুহান, সাফওয়ান আর নক্ষত্র ওদের বাংলো বাড়ি থেকে এখানে এসেছে। কালকে রাতে নক্ষত্র ওর ফোনটা অন করতেই নবিনের ফোন আসে। আর নবিন নক্ষত্রকে তনুকার বিয়ের ডেট ঠিক হওয়ার কথা জানায়। সাথে ওদের বুকিং ক্যানসেলের কথাও জানায়। নক্ষত্র নবিনকে টেনশন করতে নিষেধ করে। নক্ষত্র এসব শুনে নবিনকে কিছু প্রস্তাব দেয়। আর নবিনেরও সে প্রস্তাবটা পছন্দ হয়। ফোন লাউডস্পিকারে দিয়ে নক্ষত্র, রুহান, সাফওয়ানও নবিনকে আরো ভাল কিছু আইডিয়া দেয়। তবে ফোনে সব আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই নবিন নক্ষত্রদের ওদের বাসায় চলে আসতে হবে। নক্ষত্র আসতে না চাইলে নবিন জোর করে। তিতিক্ষাকেও সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। এটা ভেবে নক্ষত্র কালকে রাতে এখানে এসেছে। যেটা তিতিক্ষার কাছে একেবারেই অজানা ছিলো।
নক্ষত্র এখনো ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। এক হাতে ফোন কানে ধরে কারো সাথে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছে। মাঝে মাঝে হাঁটছে, আবার ভ্রু কুচকে কি কি বলছে। মাঝে মাঝে নিচের ঠোঁট কামড়ে অভিজ্ঞদের মত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলছে। আবার কথা বলতে বলতে মুচকি হাসছে। সোফাতে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনে, আবার সেই কথার আনসার করছে। তবে এত কথার মাঝে সে শব্দ করে হাসছে না। তবে ওর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা স্পষ্ট। ফোনে কথা বলার মাঝেও একটা অন্য রকম স্মার্টনেস ফুটে উঠেছে ওর মধ্যে। আর তিতিক্ষা দাঁড়িয়ে সবটাই পর্যবেক্ষণ করছিলো। নক্ষত্র ফোনে কথা বলা শেষ করে চেয়ার টেনে বসলো। মামনি নক্ষত্রকে খাবার সার্ভ করে দিলো। তিতিক্ষা ওখান থেকে চলে গেল। নক্ষত্র নবিনের দিকে তাকিয়ে বললো,

–“ভাইয়া টেনশনের কিছু নেই। সবকিছু ম্যানেজ হয়ে গেছে। ইনশাআল্লাহ! আজকেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটা হবে। আর রায়হান ভাইয়াদের সাথে আমি নিজে কথা বলে নিচ্ছি।”
–“তুমি আমাকে বাঁচালে নাহিয়ান। উফ! কি যে একটা টেনশনে ছিলাম।” (নবিন)
নক্ষত্র মুচকি হাসলো। নবিনের থেকে রায়হানের ফোন নাম্বারটা নিয়ে নক্ষত্র নিজে রায়হানকে সবটা বুঝিয়ে বললো। রায়হান নক্ষত্রের কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। নক্ষত্রের কথা বলা আর এমন ইউনিক চিন্তা ধারার জন্য রায়হান খুব খুশি হলো। বিশেষ করে নক্ষত্রের কথা বলার বচন ভঙ্গি দেখে। তবে রায়হানও কোনো দিক থেকে কম না। সে একজন ডাক্তার হলেও নক্ষত্রের মত এত স্মার্টলি সবটা ম্যানেজ করতে অক্ষম হয়েছে। এটা রায়হানের স্বীকার করতে আপত্তি নেই। যাক অবশেষে সবটা ঠিক হলো।
রুহান, সাফওয়ান, নক্ষত্র আর নবিন খেতে খেতে জরুরী আলোচনা গুলো করে নিলো। মামনির থেকে লোক সংখ্যা আর খাবারের মেন্যুর লিষ্ট নক্ষত্র নিয়ে নিলো। মামনি, নবিনের আব্বু সহ সবাই মিলে আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করলো। বিভা আর তিতিক্ষা এখানে নেই। এজন্য ওরা কেউ কিছুই শুনলো না। নক্ষত্র কাউকে ফোন দিয়ে আবার কিছুক্ষণ কথা বললো। কথা বলা শেষ করে নক্ষত্র নবিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ওর হাসির মানে বুঝতে পেরে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

মামনি নক্ষত্রকে এমনভাবে দায়িত্ব নিতে দেখে খুব খুশি হয়েছে। নক্ষত্র এই ব্যাপারটা যে এতো সহজে হ্যান্ডেল করবে; এটা কেউ ভাবতে পারেনি। সত্যি বলতেই হয়, নক্ষত্র প্রশংসা পাওয়া যোগ্য। এর বিশেষ কারণ ওর চিন্তা ধারা আর উপস্থিত বুদ্ধি। মামনি খুশি হয়ে নক্ষত্রকে একটা পাঞ্জাবী উপহার দিবে বলে মনে মনে ঠিক করলেন। মামনি নক্ষত্রকে বেশ কয়েকটা বিয়ের কার্ড দিয়ে ওর সব বন্ধুদের ইনভাইট করতে বললো। মামনি রুহান আর সাফওয়ানকেও বার বার বলে দিলো বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া অবধি কোথাও যেন না যায়। যদি যায় তো পরে ওদের বিচার করা হবে। এই কথা শুনে সবাই হাসলো। এরপর ওরা চারজন ব্রেকফাস্ট করে, রেডি হয়ে, বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
তিতিক্ষা ওর রুমে এসে বসে আছে। বিভা বসে বসে তিতিক্ষার মতি গতি ফলো করছে। আহান ফোনে ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। মামনি এসে বললো,

–“সবকিছু গোছগাছ করে নাও। যার যার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র একেবারেই নিয়ে যাবে। কারণ গায়ে হলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে তবেই আমরা বাসায় ফিরবো।”
মামনির কথা মত তিতিক্ষা আর বিভা গোছগাছ শুরু করে দিলো। মামনির কাছে থেকে তিতিক্ষা শুনলো নক্ষত্র বাসায় নেই, কেবল ওরা বের হয়ে গেলো। এই কথা শুনে তিতিক্ষার তখন রাগে দুঃখে কেঁদে দিতে মন চাইলো। একটু পর কলিং বেলের শব্দ পেয়ে তিতিক্ষা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। অদ্রি তিতিক্ষাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। নক্ষত্র আব্বু আম্মু সন্ধ্যায় আসবে। তিতিক্ষা অদ্রিকে এখন এখানে চলে আসতে বলেছে। অদ্রি তিতিক্ষার কথা ফেললে পারেনি। তাই সে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। বিভা, তনুকা, অদ্রি আর তিতিক্ষা বেডের উপর বসে গোছগাছ করছে। তিতিক্ষা তনুকার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আপু ব্লাউজ গুলো চেক করে নাও।”
তনুকা উঠে ব্লাউজটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলো গেলো।
তনুকা ব্লাউজ পড়তে পড়তে ওয়াশরুমে থেকেই বলে উঠলো,
–“কি রে তিতু, এটা কি? একদিকে টানলে অন্য দিকে ছোট হয়ে যাচ্ছে। ইয়া আল্লাহ টেইলার্স ওয়ালা এটা কি বানালো?”
তিতিক্ষা তনুকার কাছে গিয়ে দেখলো সত্যি সত্যি ব্লাউজ তনুকার হচ্ছে না। প্রচন্ড টাইট হচ্ছে ব্লাউজটা। তিতিক্ষা তনুকাকে ব্লাউজটা খুলে ওকে দিতে বললো। ব্লাউজের সাইডে অনেক কাপড় আছে, এজন্য তিতিক্ষা ওর সেলাই মেশিনে বসে পড়লো। তনুকার মাপ মত তিতিক্ষা ব্লাউজটা ঠিক করছে। আজকের গায়ের হলুদের ড্রেস এসেছে রায়হানের বাসায় থেকে। তনুকা ওয়াশরুম থেকে এসে বেডে বসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–“হাবলুটা একটা কাজ যদি ঠিকমত করে!”
তনুকার কথা শুনে ওরা তিনজন হাসছে। তিতিক্ষা সেলাই মেশিনে বসে সেলাই করছে। আর ওদের কথা শুনছে। অদ্রি বালিশ নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। বিভা টান টান হয়ে শুয়ে ফট করে বললো,
–“রায়হান ভাইয়াকে তাও রোমান্টিক ভাবে আদুরে কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু নক্ষত্র ভাইয়াকে একদিনও বলতে শুনলাম না। তিতু আপু নক্ষত্র ভাইয়া যে টাইপের ছেলে, তোদের বিয়ের দশ বছরেও আমাদেরকে খালামনি হওয়ার সুযোগ দিবে কি না, এটা নিয়ে আমি খুব চিন্তিত।”
বিভার কথা শুনে তিতিক্ষা বাদে সবাই হো হো করে হেসে দিলো। অদ্রি তো হাসতে হাসতে বলেই দিলো,
–“আমার ভাইয়া বলবে আদুরে কথা। তাহলে তো হয়েই যেতো। ভাইয়া তো আস্ত একটা নিরামিষের ঢেঁকি। ”
অদ্রির কথা শুনে বিভা উঠে বসলো। তিনজন দাঁত বের হাসছে। তিতিক্ষা কিছু বললো না। তবে মনে মনে বললো,
–“রায়হান ভাইয়া যদি আদুরে কথার হাঁড়ি হয়। নক্ষত্র তাহলে আদুরে কথার গোডাউন। বোন তোরা না জানলেও আমি খুব ভালো করে জানি।”
অদ্রি আর বিভা হাসছে৷ তনুকা বিভা আর অদ্রিকে তিতিক্ষার দিকে তাকাতে বললো। তিতিক্ষা লজ্জা পাচ্ছে দেখে, তনুকা তিতিক্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে খোঁচা মেরে বললো,
–“নক্ষত্র আমিষ নাকি নিরামিষ? এটা যার জানার সে জানলেই হলো। শুধু শুধু নক্ষত্রকে নিয়ে আমাদের গবেষণা করে কি হবে? উহুম! উহুম! তাই না রে তিতু?”

কথাটা বলে আবার তিনজন হো হো করে হেসে দিলো। তিতিক্ষা লজ্জামাখা মুখে মুচকি হাসলো। মামনি এসে ওদের রেডি হওয়া জন্য তাড়া দিলো। সবার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয় রাতে। আর তনুকারটা হবে দিনে। আর যেখানে গায়ে হলুদ হবে সেখান গিয়ে তো পৌঁছাতে হবে। অদ্রি রেডি হয়ে এসেছে। তাই তনুকা, বিভা আর তিতিক্ষা শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে নিলো। সবাই নরমাল ভাবে রেডি হয়ে নিলো। ওখানে গিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য রেডি হবে। তিতিক্ষার আব্বু আম্মুও চলে এসেছে। তনুকার দাদু বাড়ির সবাই একেবারে ওখানে চলে যাবে; সাথে সব গেস্টরাও। তিতিক্ষারা সব কিছু ভালো মতো গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো।
ওই দিকে রুহান, সাফওয়ান, নবিন সবাই গায়ে হলুদের স্টেজ বানাচ্ছে। নক্ষত্র অন্য কাজে ব্যস্ত। শীতের দিনেও কাজ করে গিয়ে শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। নবিনের বন্ধুরাও এসে কাজে হাত লাগিয়েছে। নক্ষত্র বলে দিয়েছে কিভাবে সাজাতে ভালো হবে; সে মতো সাজানো হচ্ছে। একটু পরে নক্ষত্র নবিনকে এসে বললো,
–“ভাইয়া মামনিরা কি রওনা দিয়েছে?”
–“হ্যা! আম্মু কেবল ফোন দিয়েছিলো।”
–“আচ্ছা।”
নবিন নক্ষত্রের দিকে তাকালো। সকাল থেকে সে ও খুব ছুটাছুটি করছে। নক্ষত্রও ঘেমে একাকার অবস্থা হয়ে গেছে। তবুও ওকে অগোছালো লাগছে না।
নক্ষত্র মুচকি হেসে অন্য কাজে চলে গেল। নবিন ওর কাজে লেগে গেল। যদিও আজকে সকাল থেকে কোনো কুয়াশা নেই, রোদের তাপও আছে। সাজগোজ, খাবার দাবার সবটা নক্ষত্রকে দেখতে হচ্ছে। একদিনে এতকিছু এ্যারেন্জ করে ঠিকঠাক ভাবে ম্যানেজ করা মোটেও চারটেখানি কথা না। সাফওয়ান, রুহানও নক্ষত্রকে খুব সাহায্য করেছে। গায়ের হলুদের স্টেজটা পাশে একটা বাঁশ দিয়ে পুঁতে দিলে ভাল হয়। এখানে অনেকজনই কাজ করছে। এদেরকে যদিও টাকা দিয়ে ভাড়া করতে হয়েছে। তাদেরই মধ্যে একজন মধ্যে বয়স্ক লোককে ডেকে নক্ষত্র বললো,

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৩+১৪+১৫

–“আংকেল এখানে একটা বাঁশ পুতে উঁচু করে দেন। যাতে কারো মাথায় বারি না লাগে।”
নক্ষত্র উনাকে কথাটা বলে ফোনে কথা বলতে চলে গেল। লোকটি নক্ষত্রের কথা মত বাঁশ আনতে চলে গেল। তিতিক্ষারা দেড় ঘন্টা পর গন্তব্যে এসে পৌঁছাল। তনুকা, অদ্রি, বিভা আর তিতিক্ষার গাড়ি থেকে নেমে এক জন আরেক জনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। হঠাৎ করে চারজনই অবাক হয়ে একসাথে বলে উঠলো,
–“হুমায়ুন স্যারের নুহাশ পল্লি!”
নক্ষত্র তনুকার গায়ের হলুদের সব আয়োজন নুহাশ পল্লিতে করেছে। নুহাশ পল্লি হচ্ছে বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাগানবাড়ী। কার্যত এটি নুহাশ চলচিত্রের শুটিংস্পট ও পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র। তিতিক্ষারা অবাক চোখে আশে পাশে চোখ বুলাচ্ছে। মামনি সবাইকে ভেতরে প্রবেশ করতে বললো। অদ্রি তিতিক্ষার ডান হাত আর বিভা তিতিক্ষার বাম হাত ধরে হাঁটছে। নক্ষত্রের সাথে তিতিক্ষার চোখাচোখি হলো। নক্ষত্র ওদের দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে আসলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের ঘামার্ত মুখটা দেখে নিলো। তবে কিছু বললো না। নক্ষত্র ওদেরকে বৃষ্টিবিলাশ নামে একটা বাংলোতে নিয়ে গেল। আর দ্রুত সবাইকে রেডি হয়ে নিতে বললো। আর কিছুক্ষণ পরেই অনুষ্ঠান শুরু হবে। ওদের সবটা বুঝিয়ে নক্ষত্র চলে যাওয়ার সময় তিতিক্ষাকে মৃদু স্বরে বললো,

–“হ্যালো অভিমানিনী। কিতা খয়রায়?”
ওইদিকে সাফওয়ানে জেসিকাকে নিয়ে মারাত্মক প্যারাতে আছে। সে নাকি এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। তিতিক্ষা জেসিকাকে পারসোনালী ইনভাইট করেছে। এজন্য সে এখানে এসেছে। যদিও এই তথ্য সাফওয়ান জানে না। সাফওয়ান দ্রুত পায়ে হন্তদন্দ হয়ে যাওয়ার সময় একটা বাচ্চার সাথে ধাক্কা খেলো। সাফওয়ান কিছু বলার আগেই সে বললো,
–“আংকেল আপনি চোখের মধ্যে বল্টু নিয়ে হাটেন নাকি? আর একটু হলেই তো আমার স্পাইক করা চুল গুলো নষ্ট হয়ে যেতো।”
সাফওয়ান বাচ্চাটির মুখে এমন কথা শুনে অবাক হলো। শেষে কি না একটা বাচ্চার কাছেও ওর এমন অপদস্থ হতে হচ্ছে। স্মার্টলি কথাটা বলে ছেলেটি হাইফাই একটা এটিটিউড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাফওয়ান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে অবাকের সুরে বললো,
–“ভাই রে ভাই কে তুমি? তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
ছেলেটি ক্রাশ খাওয়ার মত মুচকি একটা হাসি দিলো। এরপর সহজ ও সাবলীল ভাষায় স্পষ্ট করে বললো,
–“আমি হলাম সুদর্শনের শিরোমণি, সবার ক্রাশ বয়।
মেঘ মেহবুব।”

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৯+২০+২১