অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৩+১৪+১৫

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৩+১৪+১৫
written by Nurzahan Akter Allo

গোধূলি লগ্নে আকাশটা ঘোলাটে রং ধারণ করেছে। বিকেলে সূর্যের তাপ কমে গিয়ে নামে হালকা শীত। ঘোলাটে আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘের ভেলা। আর সূর্য লাল আভা ছড়িয়ে ডুব দেয় পশ্চিমাকাশে। আকাশের গায়ে ছোপ ছোপ মেঘ, সূর্যের পশ্চিমে হেলে পড়ে রক্তিম আলো ছড়ানো আর সেই আলোর প্রতিফলন নদীর পানিতে। এর সৌন্দর্যটাও যেন অনন্য।
সন্ধ্যার পরে নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নিয়ে ঘুরাঘুরির উদ্দেশ্যে বের হলো। তিতিক্ষা লেমন কালার কুর্তি, ব্ল্যাক জিন্স, লেডিস ডিজাইন জ্যাকেট, পায়ে ব্ল্যাক লেডিস কেডস্, ওড়না আর চুলগুলো উচু করে ঝুটি করা। নক্ষত্র লেমন কালার টি-শার্ট, ব্ল্যাক জ্যাকেট, ব্ল্যাক জিন্স আর ব্ল্যাক এ্যান্ড হোয়াইট সংমিশ্রণে কেডস্। দু’জনের এমন লুকে বেশ স্মার্টনেস ফুটে উঠেছে। নক্ষত্র একেবারেই ওই রিসোর্ট ছেড়ে বের হয়ে এসেছে। ওই রিসোর্টে আর ফিরবে না।

আজকে নক্ষত্র তিতিক্ষাকে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করাতে চায়। এজন্য ওরা এসেছে সিলেটের রিভার ক্রুজে। এই রিভার ক্রুজটা হলো ভাসমান রেস্টুরেন্ট এবং ইভেন্ট ভেন্যু। এটা দূর থেকে দেখলে মনে হয়, নদীর বুকে ভেসে আছে মামুলি একটি লঞ্চ। কিন্তু রাতের বেলা এর চেহারা ভিন্ন। বড় আকারের লঞ্চটির নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কারো নজর কাড়ে। সুরমা নদীর তীরে রিভার ক্রুজের সৌন্দর্য দেখে তিতিক্ষা অবাকই হলো। সিলেটে আসার পর থেকে এত এত সৌন্দর্যের সাথে পরিচয় হচ্ছে যে, এসব দেখে মাঝে মাঝে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে। তিতিক্ষা অবাক চাহনি নিয়ে রিভার ক্রুজটা দেখছে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে বললো,
–“এমন আরো সৌন্দর্য তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ”
তিতিক্ষা মুচকি হাসলো। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করলো। হুট করে কোথা থেকে কয়েকজন এসে নক্ষত্রের ওপর হামলে পড়লো। হঠাৎ এমন কান্ডে তিতিক্ষা আহাম্মকের মত তাকিয়ে থাকলো। তবে তিতিক্ষা কিছু বললো না। কারণ সেই চার জন ছেলের মধ্যে একজন হলো সাফওয়ান । আর সাফওয়ানকে দেখেই বুঝতে পারলো ইনারাও নক্ষত্রের ফ্রেন্ডস। নক্ষত্র কোনরকম উনাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিলো। এদের বন্ধুত্বটা যে কতটা গভীর সেটা ওদের খুনশুটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নক্ষত্র ওর সব বন্ধুদের এক এক করে জড়িয়ে ধরলো এবং কুশল বিনিময় করলো। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। পরিচয়পর্ব শেষ হলে নক্ষত্র সাফওয়ানকে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“তুই সিলেট এসেছিস আমাকে জানালি না কেন?
নক্ষত্রের কথা শুনে সাফওয়ান একটা বোকা বোকা হাসি দিল। হাসির মাঝে কিছু একটা তো লুকিয়ে আছে। সাফওয়ানের গার্লফ্রেন্ড জেসিকাকে দেখে নক্ষত্র আর কথা বাড়ালো না। পরে না হয় সব তথ্য বের করা যাবে। সাফওয়ান তিতিক্ষাকে ওর গার্লফ্রেন্ড জেসিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। জেসিকা তখনও ঠোঁটের লিপস্টিক লাগাতে ব্যস্ত। জেসিকা তিতিক্ষার সাথে কথা বললো। জেসিকা মেয়েটা ভালোই কথা বলতে পারে। তিতিক্ষা বসে আছে আর জেসিকা বকবক করছে।
নক্ষত্র সাফওয়ানকে ডেকে কিছু একটা বললো। সাফওয়ান জেসিকাকে বসতে বলে বাইরের গেল। নক্ষত্র এসে তিতিক্ষাকে একটা জায়গায় নিয়ে গেল। রিভার ক্রুজটা বাইরে থেকে যতটা সুন্দর, তার ভেতরটাও অনেক সুন্দর। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ঘুরে ঘুরে সবটা দেখালো। এখানে একসঙ্গে ২৫০ জন মানুষের বসার হল রুম, কনফারেন্স রুম, ভিআইপি রুম এবং ছয়টি অত্যাধুনিক বাথরুম ও দুটি বেডরুমসহ সম্পূর্ণ শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে একদম নিরিবিলি একটা স্থানে নিয়ে গেল। এখানে টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা আছে বসার জন্য। নদীর বাতাস শরীরে লেগে শরীরের মধ্যে শির শির করে উঠছে। একজন ওয়েটার এসে ওদের কফির সাথে হালকা খাবার দিয়ে গেল। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে খেতে বললো। তিতিক্ষা কফির মগে চুমুক দিলো। গরম গরম কফি, রাতের এত সৌন্দর্যের সমাহার সাথে প্রিয় মানুষটা।
নক্ষত্র কফির মগে দুইবার চুমুক দিয়ে রেখে দিলো। নক্ষত্র চুপ করে বসে আছে। ওর দৃষ্টি নদীর পানির দিকে। তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্রকে কেন জানি চিন্তিত দেখাচ্ছে। এত ঘুরাঘুরির পরেও কাল থেকে তিতিক্ষা খেয়াল করেছে, নক্ষত্রের মুখে একটা চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

–“আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।”
তিতিক্ষা মাথা নাড়িয়ে বলার সম্মতি দিলো। নক্ষত্র বললো,
–“তোমার কাছে আমার একটা চাওয়া অপূর্ন রয়ে গেছে। আমি কি পুনরায় সেই চাওয়ার সুযোগটা পেতে পারি?”
–“জ্বি! কি চাই বলুন?”
নক্ষত্র কোন ভণিতা করলো না। একদম সরাসরি তিতিক্ষার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আমরা এই মুহূর্তে বিয়ে করবো।”
তিতিক্ষা অবাক হয়ে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্র তিতিক্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ চোখে ওর শান্ত চাহনি। নক্ষত্রের কথা শুনে তিতিক্ষা থম মেরে আছে। নক্ষত্র নিজে থেকেই আবার বললো,
–“তোমাকে হারানোর ভয়টা আমাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। ভয়টা এমন ভাবে আঁকড়ে ধরছে, যে আমি এই দুইদিনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছি।”
–“এজন্যই বুঝি কালকে সারারাত না ঘুমিয়ে পায়চারি করেছেন?” (তিতিক্ষা)
এটা সত্যি, কালকে সারারাত নক্ষত্র দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। তিতিক্ষার সাথে সময় কাটানো সত্ত্বেও ও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারেনি৷ বার বার মনে হচ্ছে তিতিক্ষাকে হারিয়ে ফেলবে৷ তিতিক্ষা ওর থেকে দূরে সরে যাবে। অদ্ভুত ভাবে ওকে হারানোর ভয়টা ওকে গ্রাস করে নিচ্ছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার এই কথার প্রতি উত্তরে কিছু বললো না। বরং অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
–“বিয়ে হয়ে গেলে আমাকে আর কারো সাথে তোমার উডবি হাজবেন্ড বলেও পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। তখন তুমিও সরাসরি বলতে পারবে আমি তোমার হাজবেন্ড।” (নক্ষত্র)

নক্ষত্রের কথাতে অভিমান স্পষ্ট। কালকে ওই মহিলাকে হবু বলে পরিচয় করাটা নক্ষত্রের পছন্দ হয়নি। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলেনি। তিতিক্ষা এখন বুঝতে পারলো নক্ষত্র টেনশনের কারণ। কালকে এক্সিডেন্টের ঘটনা, আর ওকে হবু হাজবেন্ড বলাটা নিয়ে সে হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে নক্ষত্র কে হার্ট করার জন্য তিতিক্ষা বলেনি। তিতিক্ষা চুপ করে আছে। নক্ষত্র সিরিয়াস ভাবেই বললো,
–“এবার বলো তোমার সিদ্ধান্তটা কি? আমি জোর করবো না। তুমি যেমনভাবে বলবে তেমনভাবেই হবে।”
তিতিক্ষা কিছুক্ষণ ভেবে, ঢোক গিলে সম্মতি দিলো। নক্ষত্র সাফওয়ানকে ফোন করে দ্রুত আসতে বললো। সাফওয়ান আর নিহাদ কাজি আনতেই গিয়েছে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে বসতে বলে কোথাও গেল। তখনই জেসিকা আসলো। তিতিক্ষা সাবধানতার সাথে চোখের কোণের অশ্রুটা মুছে নিলো। জেসিকা তিতিক্ষার সামনের চেয়ারে বসে বললো,
–“তিতিক্ষা নক্ষত্র ভাইয়ার আবদারটা মেনে নাও। কারণ তুমিই হলে ভাইয়ার অনুভূতির শীর্ষবিন্দু। যে অনুভূতিতে এক বিন্দু খাত নেই। সত্য বলতে এমন চিরসঙ্গী পেতেও ভাগ্য লাগে।”
জেসিকার কথা শুনে তিতিক্ষা মুচকি হাসলো। একটু পরে সাফওয়ান কাজি নিয়ে চলে আসলো। সামনাসামনি নক্ষত্র আর তিতিক্ষা বসে আছে। কাজি লেখালেখির পর্ব চুকিয়ে‌‌ নক্ষত্র আর তিতিক্ষার বিয়ে সম্পূর্ন করলো। তিতিক্ষা কেন জানি নক্ষত্রকে ফিরাতে পারেনি। সে পারেনি নক্ষত্রের মুখের উপর না বলতে। তিতিক্ষা পারেনি নক্ষত্রের প্রথম চাওয়াটাকে অপূর্ণ রাখতে। কিভাবেই বা সে পারবে? নক্ষত্র যে তিতিক্ষার মনে ভালবাসা নামক মায়াজালের আস্তরণ সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে নক্ষত্র যে তিতিক্ষার মনে নিজের অনুভূতি দিয়ে পাকাপোক্ত ভাবে জায়গা দখল করে নিয়েছে।

নক্ষত্র তিতিক্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে কবুল বলেছে। আর মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানিয়েছে। সবশেষে আজকে ওর চাওয়াটা পূর্ণ হলো। নক্ষত্রের নামের সাথে পবিত্র ভাবে তিতিক্ষার নাম যুক্ত হলো। নক্ষত্রের চার বন্ধু আর জেসিকা ওদের বিয়ের সাক্ষী হলো। তবে এই বিয়ের কথা ওদের মাঝেই আবদ্ধ থাকবে, বাইরের কেউ জানবে না; যতদিন না ওদের পারিবারিকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানটা না হচ্ছে। নক্ষত্র ওর বন্ধুদের ট্রিট দিলো। সবাই ওদের অভিনন্দন জানালো।
নক্ষত্র তিতিক্ষার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সবার থেকে বিদায় নিয়ে রিভার ক্রুজ থেকে বের হয়ে গেল। ওরা দু’জনেই গেল নূরজাহান গ্র্যান্ড হোটেলে। রিভার ক্রুজ থেকে নূরজাহান গ্র্যান্ডে যেতে ১৪ মিঃ লাগে। নক্ষত্র আগেই রুম বুক করে রেখেছিলো। রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে দাঁড়াতেই নক্ষত্রের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। নক্ষত্র একটু দুরে কথা বলছে আর তিতিক্ষার রিসিপশনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই একটা ভদ্রলোকের আগমন ঘটে আর তিতিক্ষাকে বলে,
–“ম্যম নাহিয়ান স্যার আপনার কে হয়?”
তিতিক্ষা লোকটির দিকে এক নজর তাকিয়ে মৃদু সুরে বললো,
–“হাজবেন্ড।”
ভদ্র লোকটি এই কথা শুনে যেন খুব খুশি হলো। উনি তিতিক্ষাকে আবার বললো,
–“স্যারের বিয়ে হলো অথচ আমরা জানি না! এজন্যই আমরা আপনাকে চিনতে পারিনি ম্যম। তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করলাম। প্লিজ! কিছু মনে করবেন না। আচ্ছা ম্যম কত দিন হচ্ছে আপনাদের বিয়ের?”
তিতিক্ষার এবারও মৃদু স্বরে ছোট্ট করে বললো,
–” ঠিক ১৭ মিনিট ২৩ সেকেন্ড আগে।”

নক্ষত্র এসে তখন তিতিক্ষার পাশে দাঁড়ালো। ভদ্রলোকটি দেখে নক্ষত্র উনাকে সালাম দিয়ে হেসে হেসে কথা বললো। এই ভদ্রলোক নক্ষত্রের পূর্ব পরিচিত। এই ভদ্রলোকের ঢাকার ফ্ল্যাটের ডিজাইন নক্ষত্রই করেছে। উনার থেকে বিদায় নিয়ে তিতিক্ষাকে নিয়ে নক্ষত্র ওদের রুমে গেল। তিতিক্ষা বেডের উপর চুপটি করে বসে আছে। নক্ষত্র রুমে দরজা লক করে তিতিক্ষার সামনে বসলো। তিতিক্ষা তখনও চুপ করে আছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার দুই গালে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বললো,
–“ভালবাসি বলেই তো তোমাকে আমার সাথে পবিত্র ভাবে জড়িয়ে নিলাম। আমার স্পর্শে যাতে তোমার শরীরে কালিমা না লাগে, এজন্যই তো কবুল বলে নিজের করে নিলাম। হারানোর ভয়টা যাতে আমাকে আর কাবু করতে না পারে, এজন্যই তো এমন আবদার রাখলাম তোমার কাছে। তুমি আমার অনুভূতির শীর্ষবিন্দু বলেই সারাজীবনের জন্য তোমাকে আমার সাথে আবদ্ধ করে নিলাম।”

তিতিক্ষা কিছু বললো না। ছলছল চোখে নক্ষত্রের মুখ পানে তাকিয়ে আছে। তিতিক্ষার চোখের কোণা বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
নক্ষত্র তিতিক্ষার কপালে আদর দিয়ে চোখের পানিটা মুছে দিলো। তিতিক্ষা নিজেকে আটকাতে পারলো না। নক্ষত্রের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে শব্দ করে কেঁদে দিলো। নক্ষত্রও আজকে তিতিক্ষাকে বুকের সাথে জড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। তিতিক্ষা ওর পরিবারের সবাইকে না জানিয়ে বিয়ে করার জন্য মনে মনে বার বার বলছে।
–“আব্বু, আম্মু, মামনি, ভাইয়া, বিভা, আমি সরি। আমাকে মাফ করে দিও।”
তিতিক্ষা নক্ষত্রের জ্যাকেট আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনি রেখে বললো,
— “কারো অগোচরে প্রেম করবো না বলেই তো পারিবারিকভাবে বিয়ের ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু তুমি নামক মায়াজাল আমাকে এমন ভাবে আঁকড়ে ধরেছে, যে তোমাকে হারানোর ভয়টা কাটাতেই আমাকে এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে।”
তিতিক্ষা নক্ষত্রের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে। তিতিক্ষা নিজেও ফ্রেশ হয়নি। আর নক্ষত্রকেও ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ দেয়নি। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ওর বাহুডোরে আবদ্ধ করেই শুয়ে পড়লো। তিতিক্ষার কপালের একটা আদর দিয়ে মুচকি হেসে বললো,
–“মিসেস নাহিয়ান, সত্যি আপনি আমার মনোপ্যাথি।”
পরেরদিন সকালে____

সাওয়ান আর জেসিকা নূরজাহান গ্র্যান্ডে এসে হাজির হয়েছে। ওরা চারজন মিলে যাবে জাফলং। আর জাফলংয়ের সৌন্দর্যের মাঝে অন্য এক ভালোলাগার আবেশ সৃষ্টি করেছে শ্রীপুর চা বাগান।
নক্ষত্র আর তিতিক্ষা শ্রীপুরের চা বাগানে দাঁড়িয়ে চা বাগানের সৌন্দর্য দেখছে। হঠাৎ নক্ষত্র চায়ের দুইটা পাতার একটা কুড়ি ছিড়ে তিতিক্ষার সামনের হাঁটু গেড়ে বসে মুচকি হেসে বললো,
–“আমি তোমাকে ভাল ফাই মিসেস নাহিয়ান।”
(আমি তোমাকে ভালবাসি মিসেস নাহিয়ান)
তিতিক্ষা লজ্জা পেলো নক্ষত্রের মুখে এমন ভাবে ভালবাসি কথা শুনে। নক্ষত্র তখন দুষ্টু হেসে বললো,
–“আমার দেকিয়া এতো লজ্জা ফাও খেনো? তুমার সরম মাখা মুখ খান আমার খুব বালা লাগে। আ… ।”
নক্ষত্র কথাটা পুরো শেষ করতে পারেনি। অবাক হওয়ার দৃষ্টিতে বাম দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্রের দৃষ্টি অনুসরণ করে তিতিক্ষাও সে দিকে তাকিয়ে থ।
সাফওয়ানের গলাতে জেসিকার হ্যান্ড ব্যাগ ঝুলানো। সাফওয়ানের এক হাতে পানির বোতল আর অন্য হাতে জেসিকার মেকাব বক্স। আর জেসিকা সেলফি তুলতে ব্যস্ত। জেসিকা সেলফি তুলছে আর সাফওয়ান জেসিকার পেছন পেছন ঘুরছে। সাফওয়ানের এমন করুন অবস্থা দেখে নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকালো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকাতেই দুজনেই হো হো করে হেঁসে দিলো।

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_14

–“এই যে, আমার জান পাখিটা কি করে? সে কি ব্রেকফাস্ট করেছে?
–“হুম।”
–“এখনো রাগ করে থাকবে? প্লিজ! কথা বলো। আচ্ছা বাবা আমি কান ধরে বলছি সরি। আর এমন হবে না। প্লিজ! লক্ষী বউ আমার আর রাগ করে না।”
–“হুম”
–“কি তখন থেকে হুম হুম করছো? লক্ষীটি কথা বলো। তোমার গলার ভয়েস না শুনলে আমি মনে হয় এবার হার্ট এ্যার্টাক করব।”
বিভা না হেসে আর থাকতে পারলো না। রায়হানের এমন আদুরে কথা শুনে উচ্চশব্দে হো হো হো করে হেসে দিল। তনুকা ওয়াশরুমে গেছে। এজন্য বিভা তনুকার ফোনটা রিসিভ করেছে। রায়হান বুঝতেই পারেনি ওটা উনার বউ না, আদরের শালিকা। সে তো তার মত করে কথা বলে যাচ্ছিল। তনুকা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিভার কান্ড দেখছিল। বিভা মুখে ওড়না চেপে ধরে হাসছে। তনুকা নিজেও হেসে ফেললো। আর রায়হান ফোনের অপর পাশে জিভে কামড় দিয়ে বসে আছে। ইস! কি লজ্জা। আসলে কালকে রাতে রায়হানের একটা সার্জারির ছিল। এজন্য তনুকার ফোন রিসিভ করতে পারেনি। তনুকা বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিলো। পরে রায়হান ভেবেছে, তনুকা ওর উপর রাগ করে আছে। তাই এমন আদুরে কথাগুলো বলছিলো। কিন্তু সে তো জানে না যে এটা উনার বউ না; এটা আদরের শালিকা। আর দুষ্টু শালিকা ওর কথা শুনে মজা নিচ্ছিলো এতক্ষন।

নক্ষত্র, তিতিক্ষা, জেসিকা আর সাফওয়ান চারজন মিলে চা বাগানে ঘুরতে গেল। চা বাগানে ঢুকে যত দূর চোখ যায় কেবল সবুজের হাতছানি। চা বাগানের সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। চা বাগানের সতেজ সবুজ পাতায় পূর্ণ হয়ে আছে শ্রীপুরের নিসর্গশোভা। ওরা বাগানে ঢুকে চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। তিতিক্ষা এর আগে কখনো চা-বাগান দেখেনি। সে চায়ের পাতাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। নক্ষত্রের পাশে তিতিক্ষা হাঁটছে, আর সাফওয়ানের পাশে জেসিকা। নক্ষত্র তিতিক্ষার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। সবুজের সমারোহেরের মাঝে তিতিক্ষার লাল ড্রেস যেন ফুটে উঠেছে। সাফওয়ান নক্ষত্রের পাশে এসে কানে কানে বললো,
–“তোরা নিজেদের মতো টাইম স্পেন্ড কর। আমরা ওদিক থেকে আসছি।”
সাফওয়ান জেসিকা কে নিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। নক্ষত্র আর তিতিক্ষা পুরো চা বাগানটা ঘুরে দেখল। হঠাৎ করে নক্ষত্র তিতিক্ষার সামনে দুই পাতার এক কুড়ি নিয়ে তিতিক্ষাকে সিলেটি ভাষায় বললো,
–“আমি তোমাকে ভাল ফাই মিসেস নাহিয়ান।”
(আমি তোমাকে ভালবাসি মিসেস নাহিয়ান)
তিতিক্ষা লজ্জা পেলো নক্ষত্রের মুখে এমন ভাবে ভালবাসির কথা শুনে। নক্ষত্র তখন দুষ্টু হেসে বললো,
–“আমার দেকিয়া এতো লজ্জা ফাও খেনো? তুমার সরম মাখা মুখ খান আমার খুব বালা লাগে। আ… ।”
নক্ষত্র কথাটা পুরো শেষ করতে পারেনি। অবাক হওয়ার দৃষ্টিতে বাম দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্রের দৃষ্টি অনুসরণ করে তিতিক্ষাও সে দিকে তাকিয়ে থ।

সাফওয়ানের গলাতে জেসিকার হ্যান্ড ব্যাগ ঝুলানো। সাফওয়ানের এক হাতে পানির বোতল আর অন্য হাতে জেসিকার মেকাপ বক্স। আর জেসিকা সেলফি তুলতে ব্যস্ত। জেসিকা সেলফি তুলছে আর সাফওয়ান জেসিকার পেছন পেছন ঘুরছে। সাফওয়ানের এমন করুন অবস্থা দেখে নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকালো। তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকাতেই দুজনেই হো হো করে হেসে দিলো। ওদের দু’জনের হাসি দেখে সাফওয়ান মুখ কাচুমাচু করে বললো,
–“কথাতে আছে, কপাল ওয়ালার কপাল। আর মুরগি ওয়ালার ডিম।”
সাফওয়ানের কথার মানেটা জেসিকা বুঝতে পারেনি। এজন্য কিছু বললো না। কিন্তু নক্ষত্র আর তিতিক্ষা বুঝতে পেরে আবার হো হো করে হেসে দিলো। চারপাশটা ঘুরে ওরা জাফলংয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। সিলেট থেকে জাফলং এর দূরত্ব প্রায় ষাট কিলোমিটার। সিলেট থেকে সরাসরি জাফলং যেতে সময় লাগবে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা। বিরতিহীন বাসের টিকিট কেটে চারজনেই উঠে বসলো। বাস ছুটে চললো তার গন্তব্যে। তিতিক্ষা জানালার পাশে বসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার কানে ফিসফিস কানে বললো,
–“তোমার এলোকেশ আমাকে ভদ্র থাকতে দিচ্ছে না। অভদ্র হলে পরে আমাকে দোষ দিও না।”

নক্ষত্রের কথা শুনে তিতিক্ষা এবারও মুচকি হাসলো। এই নিয়ে নক্ষত্র চার বার তিতিক্ষার চুল নিয়ে অভিযোগ জানালো। নক্ষত্র তিতিক্ষার চুল গুলো বাধতেও দিচ্ছে না। কিন্তু ঠিকই অভিযোগের ঝুলি নিয়ে বসেছে। ওরা সারাদিন ঘোরাঘুরি করবে, এজন্য তিতিক্ষা শাওয়ার নিয়েছে। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকানোর পরও চুলের গোড়া একটু একটু ভেজা আছে। তাই ভেজা চুলের জন্য চুল ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে তিতিক্ষার ভেজা চুল দেখে, সাফওয়ান নক্ষত্রকে খোঁচাতে একটুও কার্পণ্যতা করেনি। তখন নক্ষত্র সাফওয়ানের খোঁচা মার্কা কথা শুনে বিড়বিড় করে বললো,
–“একেই বলে বিনা দোষে অপরাধী।”
নক্ষত্র বাসের সিটে হেলান দিয়ে তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কোমর সমান লেয়ার কাটের চুলগুলো অবাধ্য হয়ে বাতাসে উড়ছে। তিতিক্ষার ফেসের সাথে লম্বা চুলের লেয়ার কাট’টা বেশ মানিয়েছে। তিতিক্ষা বাইরের সৌন্দর্য দেখতে বিভোর। আর ওর অবাধ্য চুলগুলো উন্মুক্ত বাতাসে উড়ে নক্ষত্রের চোখ মুখে আছড়ে পড়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। তিতিক্ষা নামক মায়াবতীর বাতাসে উন্মুক্ত এলোকেশের মোহনীয় নৃত্যের ছন্দটা নক্ষত্রের হৃদয়ে ক্ষণে ক্ষণে যেন নামহীন অনুভুতি হয়ে ঢেউ খেলে যায়।
সাফওয়ানরা পেছনের দুই সিট আগে বসেছে। সাফওয়ানের কাঁধে মাথা দিয়ে জেসিকা বাইরে তাকিয়ে আছে। জেসিকার চুল এসে সাফওয়ানের নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। কিছুক্ষণ একই ভাবে সুড়সুড়ি লাগাতে সাফওয়ান হাঁচ্চু বলে হাঁচি দিলো। আর জেসিকা সাফওয়ানের বুকে কিল বসিয়ে দিলো।

প্রায় দুই ঘন্টা পর ওরা জাফলং পৌঁছালো; যেই স্থানটা প্রকৃতির কন্যা হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে একটি হল জাফলং । প্রকৃতির দানে রুপের পসরা সাজিয়ে আছে জাফলং। পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানির ধারা, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, উঁচু উঁচু পাহাড়ে সাদা মেঘের খেলা জাফলংকে করেছে অনন্য। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে জাফলংয়ের সৌন্দর্য্য। সবুজের বুকে নেমে আসা ঝর্ণাধারায় সূর্যের আলোর ঝিলিক‌ আর পাহাড়ে ভেসে বেড়ানো মেঘমালার দৃশ্যটা ও মন্ত্রমূগ্ধ। এক এক ঋতুতে জাফলং এর সৌন্দর্য একেক রকম। তবে এই শীতে অন্য রূপে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয়েছে জাফলং। চারিদেকে সবুজের সমারোহ, পাহাড় চূড়ায় গহীন অরণ্য। জাফলংয়ের বুক চিড়ে বয়ে গেছে দুই নদী। তিতিক্ষা ওর গালে দুই হাত রেখে ধরা গলায় বললো,
–“হে আল্লাহ! তোমার অপার সৌন্দর্যের বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। আল্লাহ তোমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া যে তুমি তোমার মনোহর সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য আমাকে দিয়েছো।”
নক্ষত্র তিতিক্ষার মুখের দিকে তাকালো। তিতিক্ষা বহুদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত কন্ঠে বলল,
–“আমাদের জীবনটা আসলেই খুব সুন্দর। শুধু আমরা আমাদের জীবনটাকে উপভোগ করতে জানি না। নিজেদের লাইফ স্টাইল, ব্যস্ততা, পড়াশোনা, জব, হাজারটা সমস্যা এসব নিয়েই জীবন শেষ করে দিয়ে বলি,’এই জীবনে কি পেলাম?’ ”
তিতিক্ষার কথা শুনে নক্ষত্র মুচকি হাসলো। নক্ষত্র পেছনে তাকিয়ে দেখলো, সাফওয়ান আর জেসিকা এখানে এসেও সেলফি তুলতে ব্যস্ত। নক্ষত্রও কিছু একটা ভেবে ওর ফোনটা বের করে, ওদের দুজনের কয়েকটা পিক তুলে নিল। হঠাৎ নক্ষত্রের এমন করাতে তিতিক্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। নক্ষত্র মিটিমিটি হেসে বললো,

–“এই পিক গুলো অবসর সময়ে আমার এনার্জির কারন হবে।”
নক্ষত্র তিতিক্ষাকে নিয়ে সামনের দিকে এগোলো। ওদের সামনে ধলাই ও পিয়াইন নদী। এই নদী দুইটি অন্যন্যতা এনে দিয়েছে জাফলংকে। ধলাই ও পিয়াইনের স্বচ্ছ জলে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় নানা জাতের ছোট মাছ। তিতিক্ষা নদীর পানিতে পা ডুবালো। নক্ষত্র তিতিক্ষার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। পায়ের নিচে স্বচ্ছ পানি। আর পানির নিচে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট মাছ এসে তিতিক্ষার পায়ে টোকা দিচ্ছে। তখন সুড়সুড়ি লাগলে তিতিক্ষা খিলখিল করে হেসে উঠছে। শব্দ পেয়ে মাছ গুলো ছুটে পালাচ্ছে। আবার একটু পর এসে তিতিক্ষার পায়ে টোকা দিচ্ছে। তিতিক্ষার মাছদের সাথে এমন খেলাতে মেতে থাকতে অদ্ভুত রকমের ভালো লাগছে। নক্ষত্র এক হাত দিয়ে ওর ফোনটা ধরে এমন মুহূর্তটাকে ক্যামেরা বন্দী করে নিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার হাতটা এখনো শক্ত করে ধরে আছে; যেন তিতিক্ষা পা পিছলে পড়ে না যায়।
হঠাৎ নক্ষত্র মুচকি হেসে বললো,
–“গার্লফ্রেন্ডের হাত আর বউয়ের হাত ধরার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তিতিক্ষা তুমি কি বলতে পারবে পার্থক্যটা কি?
–“উমম! গার্লফেন্ডকে যদি বিয়ে করে তাহলে গার্লফেন্ড তো বউ হয়ে গেলো। আর হাত তো হাতই এখানে পার্থক্য কিভাবে আসলো?”
তিতিক্ষার এমন কথা শুনে নক্ষত্র মিটিমিটি হাসছে।
তিতিক্ষা নদী থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল নক্ষত্রের হাসির কারণ। নক্ষত্র তিতিক্ষার হাতটা আলতো করে ধরে হাঁটতে শুরু করল, তারপর বললো,
–“বিয়ের আগে গার্লফ্রেন্ডের হাত ধরলে মনে হয়, কেউ দেখবে? কে কি বলবে? বাসায় বলে দিবে কি না? এরকম একটা অস্বস্তি কাজ করে মনের মধ্যে। কিন্তু বউয়ের হাতটা ধরার পর মনে হয়, আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা অবধি, আল্লাহ! তুমি এই হাতটাকে শক্ত করে ধরে রাখার তৌফিক দান করো।”

নক্ষত্রের কথা শুনে তিতিক্ষা মনে মনে বললো, –“আমিন।”
তিতিক্ষা মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়। নক্ষত্র এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে কিভাবে? এটা ও কিছুতেই ভেবে পায় না। নক্ষত্রের সাধারণ একটা কথার মাঝেও অসাধারণ কিছু যুক্তি লুকিয়ে থাকে। নক্ষত্র স্বল্পভাষী হলেও ওর কথার মাঝে অসাধারণ একটা ব্যাক্তিত্বের পরিচয় ফুটে ওঠে। নক্ষত্র আর তিতিক্ষা তখন পাশাপাশি হাঁটছিলো। হঠাৎ সাফওয়ান হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো,
–“সারাদিন অনেক ঘুরাঘুরি করেছি। এবার চল আমরা ফিরে যায়। ব্রো আমার খুব টায়ার্ড লাগছে।
আমি আর এই প্যারা থুক্কু জেসিকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করতে পারছি না। সে আমার জান জীবন পুরোটাই ন্যাতা ন্যাতা করে দিয়েছে।”
সাফওয়ানের এরকম কথা শুনে জেসিকা পিছন থেকে এসে সাফওয়ানের পিঠে কিল বসিয়ে দিলো। সাফওয়ান পেছনে তাকিয়ে জেসিকাকে দেখে অসহায় চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। ওদের কান্ড দেখে তিতিক্ষা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তবে নক্ষত্র মোটেও অবাক হলো না। কারণ সে এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত। চারজন মিলে ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে এরপর বাসে ওঠে বসলো। নক্ষত্র আর তিতিক্ষা আপাতত নূরজাহান গ্র্যান্ড হোটেলে উঠবে। ওখানে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর নানুর বাসার উদ্দেশ্যে যাবে । বাসে থেকে নেমে নক্ষত্র সাফওয়ানকে বললো,

–“আমরা ফ্রেশ হয়ে তো নানুর বাসায় যাব। তুইও চল আমাদের সাথে। কয়েকদিন ওখানে থেকে আমাদের সাথে ব্যাক করিস।”
–“না রে ভাই! ওইদিকে আপাতত আর যাচ্ছি না। আমার কাজ পড়ে গেছে। আজকেই আমাদের রওনা দিতে হবে। তোরা আস্তে ধীরে ঘুরে ফিরে তারপরে ফিরিস।”
এরপর তিতিক্ষা আর নক্ষত্র ওদের থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে গেল। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে, হালকা নাস্তা করে বাসার দিকে রওনা হলো। আর যাওয়ার আগে সবার জন্য অনেক কিছু সাথে নিলো। বিশেষ করে পাতা আর অদ্রির জন্য। সিনএনজিতে দু’জন চুপ করে বসে আছে। জানা নেই, আবার কবে এভাবে একে অপরকে সময় দিতে পারবে। এত এত ভাল লাগার মুহূর্ত গুলোর পেছনে দু’জনই মন খারাপের ভাবটা আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে। কেউ কাউকে বুঝতে না দিলেও, ওদের মনে একই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে বললো,
–“তিতিক্ষা, আপাতত আমাদের বিয়ের কথাটা কাউকে জানিও না। সবাই ভালভাবে ব্যাপারটা নাও নিতে পারে।”

তিতিক্ষার মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। বাসার সামনে সিএনজি এসে থামলো। সিএনজি থেকে নেমে বিল মিটিয়ে নক্ষত্র আর তিতিক্ষা বাসায় ঢুকলো। তখন সবাই একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। দুজনকে দেখে সবাই অনেক খুশি হল। চারদিন পর ওরা বাসায় ফিরেছে। এই চারদিনে বাসাটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। এখন যেন শূন্য বাসাটা ওদের আগমনে পূর্ণ হলো। তিতিক্ষা সবাইকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। হঠাৎ অদ্রি একটু জোরেই বলে উঠলো,
–“ভাবিমণি এই চার দিনে তুমি তো অনেক সুন্দর হয়ে গেছো? আমি তো নিজেই তোমার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না।”
অদ্রি কথাটা বলতেই নক্ষত্র ওর দুই হাত উপরে তুলে বললো,
–“আমি নির্দোষ! এর পিছনে আমার কোনো হাত নেই।”
নক্ষত্রের বলা কথাটা শুনে বড়রা হো হো করে হাসতে লাগলো। নক্ষত্রের আম্মুও মিটিমিটি হাসলো। উনি নক্ষত্রের মুখের দিকে তাকালো। নক্ষত্রের মুখে অদ্ভুত একটা সুখের ছাপ স্পষ্ট। উনি মা হয়ে জানে, যে নক্ষত্র যখন খুব ভালো মুডে থাকে, তখন একটু দুষ্টু কথাবার্তা বলে। আজকে অনেকদিন পর নক্ষত্রকে উনি এই রুপে দেখলো। তবে নক্ষত্রের বলা কথাটাতে এরকম হয়ে গেল,’ ঠাকুর ঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি।’ সবাই হাসছে আর তিতিক্ষা মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্রের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা স্পষ্ট। নক্ষত্র তিতিক্ষার পাশে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে বললো,

–“লজ্জা পেলে? একটু লজ্জা পাও তো। তোমার লজ্জা মাখা মুখশ্রীটা আমি দু’চোখ ভরে দর্শন করি।”
নক্ষত্রের কথার প্রতি উত্তরে তিতিক্ষা লজ্জা মাখা কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো,
–“আপনি কি জানেন? আপনার চোখ বলে আপনি খুব ভদ্র। কিন্তু আপনার ঠোঁট বলে আপনি মারাত্মক দুষ্টু।”
এমন কথা শুনে নক্ষত্র ওর হাসিটা কোনো রকমে কন্ট্রোল করে নিলো। বাসার সবাই ওদের আনা জিনিস গুলো দেখছে। আর ওরা নিজেরা নিজেদের কথা বলায় ব্যস্ত। নক্ষত্র সবার দিকে একবার তাকিয়ে আবারও বিড়বিড় করে বলল,
–“এই রে! বিয়ের পরে দেখি আমার বউটা একটু বেশি চালাক হয়ে গেছে।”
নক্ষত্রের কথা শুনে তিতিক্ষা আর কিছু বললো না। সে বুঝে গেছে, এই ছেলেটার সাথে ও কথাতে পেরে উঠবে না। তিতিক্ষাকে চুপ করে থাকতে দেখে, নক্ষত্র মুচকি হাসলো। আর যাওয়ার আগে তিতিক্ষাকে মৃদু একটা ধাক্কা মেরে রুমের দিকে এগোলো।

#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু ??
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_15

নক্ষত্রের কথা শুনে তিতিক্ষা আর কিছু বললো না। ও বুঝে গেছে, এই ছেলেটার সাথে ও কথাতে পেরে উঠবে না। তিতিক্ষাকে চুপ করে থাকতে দেখে নক্ষত্র মুচকি হাসলো। আর যাওয়ার আগে তিতিক্ষাকে মৃদু একটা ধাক্কা মেরে রুমের দিকে এগোলো।
পলক ওর গার্লফ্রেন্ড সারার সাথে কথা বলছে; একটা নিরিবিলি জায়গাতে বসে। ও নিজের মতো প্রেমালাপে ব্যস্ত। অদ্রি আর পাতা ধীর পায়ে পলকের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পলকের কথাগুলো নিখুঁতভাবে ভিডিও করলো। পলক সারার সাথে কথা বলায় এতটাই বিভোর যে, ওর পেছনে দাঁড়িয়ে অদ্রি আর পাতা ওর জন্যই আইক্কা ওয়ালা বাঁশ রেডি করছে, এতে ওর কোনো ধারণাই নেই। কথা বলা শেষ করে পলক ওর ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। অদ্রি আর পাতা গালে হাত দিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু পরে পলক বামে তাকিয়ে অদ্রি আর পাতাকে দেখে চমকে উঠে চিৎকার করে বললো,
–“ওমা গো! ওই শাকচুন্নিরা তোরা এখানে কি করছিস? ও বাবারে! আর একটু হলেই হার্ট অ্যাটাক করতাম আমি।”
পলকের চিৎকারে অদ্রি আর পাতার কোনো ভাবান্তর হলো না। তারা এখনো গালে হাত দিয়ে পলকের দিকে তাকিয়ে আছে। পলক ওদের মতিগতি কিছু বুঝতে পারছে না। অদ্রি ফোনটা বের করে ভিডিওটা পলক কে দেখালো আর ভিডিওটা দেখে পলকের পিলে চমকে উঠলো। মনে মনে এই দুটোকে ইচ্ছেমত বকা দিয়ে মুখ কাচুমাচু করে হেসে বললো,

–“বোন তোরা এত রাতে এখানে কি করছিস? যা বাসায় যা। ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
–“হুম বাসাতেই তো যাবো। এই বাঁশটা
সবাইকে দেখাতে হবে না ” (অদ্রি)
–“বোন হয়ে ভাইয়ের এত বড় ক্ষতি করতে তোদের বুক কাঁপছে না? এমন করে না আমার মিষ্টি বোনরা। কি লাগবে তোদের বল?”
–“কালকে আমাদের শপিং করতে নিয়ে যাবে। আর আমরা যা যা পছন্দ করবো, আমাদের সবটা কিনে দিতে হবে। তা না হলে এই ভিডিওটা বড় মামার কাছে পৌঁছে যাবে।”
কথাটা বলে অদ্রি আর পাতা হনহন করে চলে গেল। আর পলক মাথাতে হাত দিয়ে বসে থাকলো। এরা দু’জন যে কালকে ওর ওয়ালেটের অবস্থা দফারফা করে ছাড়বে; এটা খুব ভালো করে ও বুঝতে পারছে। কালকে মুভি দেখার সময় পলকের জন্য ওরা বকা খেয়েছে। আজকে সেই রাগটা দু’জন মিলে তুললো।
তিতিক্ষা ফ্রেশ হয়ে এসে চুল আঁচড়ে কাঁটা দিয়ে চুল গুলো উঁচু করে বাঁধল। রুমে এখন আপাতত কেউ নেই। এজন্য ওড়নাটা বেডের উপর রাখলো। আর ওর হাতের টাওয়াল টা চেয়ারের উপর মেলে দিলো। অদ্রি এসে বেডের উপর দুই পা তুলে গালে হাত দিয়ে তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,

–“ভাবি মনি তুমি কি ভাইয়ার সাথে খামচা খামচি খেলছিলে?”
তিতিক্ষা অদ্রির কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকালো। অদ্রি হাতের ইশারায় আয়নাতে তিতিক্ষাকে ওর ঘাড়ের দিকে তাকাতে বললো। অদ্রির কথা অনুযায়ী তিতিক্ষা আয়নায় ওর ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। কারণ ওর ঘাড়ে খামচানোর দাগ স্পষ্ট। অদ্রি মিটিমিটি হাসছে। নক্ষত্রের আম্মু তখন ওদের রুমে আসলো। তাই তিতিক্ষাও এই নিয়ে আর কথা বাড়ালো না। এটা নিয়ে যত কথা বাড়াবে, অদ্রি তত মজা নিবে। এরা দুই ভাইবোন দু’জনই খুব দুষ্টু। শুধু ওকে লজ্জা তে ফেলে।
রাতে সবাই একসাথে খেতে বসলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে দু’একবার তাকালো। কিন্তু তিতিক্ষা একবারও তাকায়নি। যদিও এর কোনো কারণ নেই। সে এমনিতেই তাকায়নি আর এখানে বড়রাও আছে। সবাই অনেক কথা বললেও তিতিক্ষা চুপ করে খাচ্ছিল। খাওয়া শেষ করে যে যার রুমে চলে গেল। আপাতত বড়রা এখানে কেউ নেই। তিতিক্ষা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“কেউ কি আমার উপর রেগে আছে?

এই কথাটা শুনে তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। মিটিমিটি হাসতে হাসতে তিতিক্ষা ওর রুমে চলে গেল। নক্ষত্র কিছুই বুঝলো না। রাতটা প্রায় ১ টা বেজে ১৫ মিনিটে নক্ষত্রের ফোনে একটা মেসেজ আসলো। নক্ষত্র তখন লেপটপে ওর ই-মেইল চেক করছিলো। মেসেজের টোনে ফোনের দিকে তাকালো। ম্যানোপ্যাথি নাম দেখে নক্ষত্র ফোনটা হাতে নিলো। তিতিক্ষার মেসেজ এত রাতে। নক্ষত্র মেসেজাটা সিন করলো। মেসেজ দেখে নক্ষত্র অবাক হলো। মেসেজটি ছিলো,
–“আপনি আপনার রুমে বাইরে। প্লিজ দরজাটা খুলুন।”
নক্ষত্র দ্রুত উঠে ওর রুমের দরজা খুলে দিলো। তিতিক্ষা রুমে ঢুকে গেলো, নক্ষত্র দরজা আটকে দিলো। তিতিক্ষা এখন এভাবে ওর রুমে আসাতে নক্ষত্র অবাকই হলো। তিতিক্ষার চোখে পানি, মুখে ভয়ের ছাপ। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো,
–“তিতিক্ষা কি হয়েছে? কোনো সমস্যা? তুমি ঠিক আছো তো?”
তিতিক্ষা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। আর দুই হাত দিয়ে ওর মুখটা মুছে নিলো। ওর শরীর মৃদু ভাবে কাঁপছে। মনে হচ্ছে এখনই ধপ করে পড়ে যাবে।

নক্ষত্র তিতিক্ষাকে বেডে বসিয়ে ওর সামনে বসলো।
পানি খাইয়ে নক্ষত্র তিতিক্ষাকে শান্ত করলো। এরপর ওর দুই গালে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বললো,
–“কি হয়েছে? বলো আমাকে?”
তিতিক্ষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আবার কেঁদে দিলো। তিতিক্ষার চোখে পানি দেখে নক্ষত্রের কলিজাটা যেন কেঁপে উঠলো। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে এভাবে কাঁদতে দেখে বুঝলো কিছু একটা তো ওর হয়েছেই। তা না হলে তিতিক্ষা এত রাতে এখানে আসার মত মেয়ে না। তিতিক্ষা ওর মাথা নিচু করে নিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার কপালে একটা আদর দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে নরম সুরে বললো,
–“তোমাকে বলেছি না, তোমার চোখের অশ্রু আমার হৃদকম্পনের কারন। এভাবে কাঁদছো কেন? বলো আমাকে কি হয়েছে?”
তিতিক্ষা ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠলো,

–“আপনাকে নিয়ে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি। প্লিজ! আপনি সাবধানে থাকবেন। আপনাকে নিয়ে আমার খুব ভয় হচ্ছে।”
নক্ষত্র তিতিক্ষার মুখের দিকে তাকালো। কেঁদে কেঁদে মুখটা একদম লাল করে ফেলেছে। নক্ষত্র মুচকি হেসে তিতিক্ষার চোখের পানি মুছে দিলো। তিতিক্ষার চোখে অশ্রু থামার নামই নেই। চোখ মোছার সাথে সাথে আবার গাল বেয়ে ঝরে যাচ্ছে অশ্রুবিন্দু। তিতিক্ষা ওর ঠোঁটে কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হলে। নক্ষত্র তিতিক্ষার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। তিতিক্ষা অশ্রুু ভেজা চোখে ওর দিকে তাকালো। এরপর ঝাঁপিয়ে পড়লো নক্ষত্রের বুকে আর ওর গলাতে মুখ লুকিয়ে উচ্চশব্দে কেঁদে দিলো। নক্ষত্রও তিতিক্ষাকে স্বযত্নে জড়িয়ে নিলো ওর বাহুডোরে। তিতিক্ষাও যে নক্ষত্রের শীর্ষ অনুভুতির মায়াজালে মারাত্মক ভাবে আটকে গেছে। এখনকার এই মুহূর্ত টুকু এটাই তার প্রমান। এজন্যই এত রাতে তিতিক্ষা নক্ষত্রের রুমে পর্যন্ত ছুটে এসেছে। শুধু মাত্র নক্ষত্র ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য।
নক্ষত্রের চোখে দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু ও দ্রুত সেই অশ্রুটুকু আড়াল করে নিলো।
নক্ষত্র কখনো ভাবেনি তিতিক্ষা এত তারাতাড়ি ওর মায়াজালে আটকে যাবে। নক্ষত্রের বুকটা যেন খুশিতে ছেয়ে গেল। নক্ষত্র মনে মনে বললো,

–“প্রিয়মানুষটাকে নিজের জন্য কাঁদতে দেখাই হলো অনুভূতির শীর্ষবিন্দুর চূড়ান্ত ফলাফল। আজকে এই মুহূর্তটুকু থেকে আমার সব অনুভূতিরা স্বার্থক।”
অতিরিক্ত কান্নার ফলে তিতিক্ষা নক্ষত্রের গায়ে বমি করে দিলো। নক্ষত্র তিতিক্ষার মাথার দু’পাশে চেপে ধরলো। তিতিক্ষা নক্ষত্রকে ছাড়তে চাইলো। কিন্তু সে ছাড়লো না। বরং ওয়াশরুমে গিয়ে নক্ষত্র নিজে হাতে তিতিক্ষার মুখ ধুয়ে দিলো। নক্ষত্র অদ্রিকে ফোন করে তিতিক্ষার একটা ড্রেস নিয়ে এই রুমে আসতে বললো। অদ্রি তিতিক্ষাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। নক্ষত্রের সাথে অদ্রি থাকতে চাইলো। কিন্তু নক্ষত্র ওকে চলে বললো,
–“অনেক রাত হয়েছে। তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি আছি সমস্যা নেই।”
অদ্রি আর কথা বাড়ালো না, সে চলে গেল।
নক্ষত্র তিতিক্ষার ড্রেস বদলে নেওয়ার জন্য ওয়াশরুমে রেখে আসলো। তিতিক্ষার যতটুকু শক্তি ছিলো, বমি করাতে সেইটুকুও যেন চলে গেছে।
নক্ষত্র আলমারি খুলে বেডশীট বের করে বেডে বিছিয়ে দিলো। তিতিক্ষা ড্রেস বদলে আসলে নক্ষত্র গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। তিতিক্ষা চুপ করে বেডে শুয়ে আছে। ওর প্রচন্ড মাথা ঘুরছে। নক্ষত্র এসে তিতিক্ষার পাশে শুয়ে ওকে বাহুডোরে জড়িয়ে নিলো। তিতিক্ষা কিছু বললো না। বরং ওর চোখের কোণা বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে নক্ষত্রের বুকে পড়লো। নক্ষত্র বুঝতে পেরে বললো,
–“আমার বউটা যে এত বরপাগল এই তথ্যটা তো জানা ছিলো না।”

তিতিক্ষা চুপ করে আছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। প্রশান্তিতে তিতিক্ষার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ভয়, কান্না আর বমির করার জন্য শরীরটা খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে। নক্ষত্র তিতিক্ষার কপালে উষ্ণতার পরশ একে দিয়ে শান্ত সুরে মিষ্টি করে বললো,
–“পাগলি বউ আমি শুধু তোমাতেই আবদ্ধ। ভয় পেও না। আমি সর্বক্ষণ তোমার পাশে আছি।”
বেশ কিছুক্ষণ হলো তিতিক্ষা ঘুমিয়ে গেছে। নক্ষত্রের চোখের পাতাতে একটুও ঘুম নেই। নক্ষত্রের মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে। এখন যদি তিতিক্ষা ওর প্রতি এত দূর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে নক্ষত্রের পক্ষে তিতিক্ষাকে দূরে রাখা সম্ভব হবে না। আর তিতিক্ষার বাবা বলেছে, তিতিক্ষার অনার্স কমপ্লিট করার পর অনুষ্ঠান করবেন। নক্ষত্র এসব ভেবে তিতিক্ষার আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। এ কেমন অনুভুতি? এটা কেমন ভালবাসা? যেটা প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে মারাত্মক ভাবে একে অপরকে গ্রাস করে নিচ্ছে। কষ্ট সাধ্য হয়ে যাচ্ছে একে অপরকে ছেড়ে দূরে সরে থাকাটা।
পরেরদিন সকালে…!!

আজকে নাকি একটা মেলা বসবে। সেই মেলাতেই আজকে ওরা ঘুরতে যাবে। যথাসময়ে পলক, নক্ষত্র, তিতিক্ষা, পাতা আর অদ্রি বেড়িয়ে পড়েছে মেলার উদ্দেশ্যে। সবাই মিলে গল্প করছে আর গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছে। পাঁচ মিনিট হাঁটার পর ওরা মেলাতে গিয়ে পৌঁছালো। কোথায় কি বসেছে ওরা ঘুরে ঘুরে দেখছে। অদ্রি আর পাতা পলককে টেনে কসমেটিকসের দোকানে নিয়ে গেল। নক্ষত্র তিতিক্ষার হাত ধরে টেনে অন্য দিকে নিয়ে গেল। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে ১০ ডজন চুড়ি কিনে দিলো। আর একটু সামনে এগোতেই নক্ষত্রের একটা শাড়ি খুব পছন্দ হলো। শাড়িটা কালো কালার আর লাল পাড়ের। নক্ষত্র শাড়িটাও কিনে নিলো। তিতিক্ষা না করলেও শুনলো না। মেলা ঘুরে ঘুরে অনেক জিনিসই দেখলো, কিনলো, মেলার খাবার খেলো। অদ্রি আর পাতা প্রথমে পলকের থেকে অনেক কিছু কিনে নিলো। এরপর নক্ষত্রের থেকে নিবে বলে বায়না ধরলো। নক্ষত্র অবাক হওয়ার সুরে বললো,
–“এত কিছু কেনার পরও তোদের হয়নি? আরো কিনে দিতে হবে?
অদ্রি মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,

–“একজন আর্কিট্রেক্টের অনেক টাকা পয়সা৷ কম সে কম প্রতি মাসে ওনারা ১লাখ টাকা আয় করে৷ আর তাছাড়া তোর তো আরো আয়ের সোর্স আছে। তাই বলছি ভাই একদম কিপ্টামি করবি না।”
নক্ষত্র আর কথা বাড়ালো না। কারণ এখন কিছু বললে ওর সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দিবে। তিতিক্ষা ওদের ভাই-বোনের ঝগড়া দেখে হাসছে।
পলক সবার আড়ালে সারার জন্য নুপূর কিনে পকেটে নিয়েছে। পলক নুপূরটা পকেটে ঢুকিয়ে তাকাতেই তিতিক্ষা ফিসফিস করে বললো,
–“উহুম! উহুম! স্পেশাল কারো জন্য বুঝি?”

পলকে মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। তিতিক্ষা পলকের কথাতে মুচকি হাসলো। মেলা ঘুরতে ঘুরতে দেখলো এক স্থানে মেয়েদের খেলার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। অনেক মেয়ে সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই জলে ডাঙ্গা খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। জলে ডাঙা খেলার আরেক নাম ঘরে বাইরে। একেক জেলাতে একেক নামে পরিচিত আর কি। অদ্রি আর পাতা তিতিক্ষার হাত ধরে টানছে খেলাতে নাম দেওয়ার জন্য। তিতিক্ষা নক্ষত্রের দিকে তাকালো। নক্ষত্র যাওয়ার পারমিশন দিলো। তিতিক্ষা ওর হাতের ফোনটা নক্ষত্রের হাতে ধরিয়ে দিলো। পাতা অদ্রি আর তিতিক্ষার খেলার জন্য দাঁড়িয়ে গেল। সামনে একটা লম্বা রেখা টানা। কেউ একজন জলে বললে লাফিয়ে রেখার ওপাশে যেতে হবে। আর ডাঙ্গা বললে আগের স্থানে৷ পলক নক্ষত্রকে চেয়ার এনে বসতে বললো। আর ও ফোনে কথা বলতে অন্যদিকে চলে গেল। নক্ষত্র তিতিক্ষার ফোনটা নিয়ে ওর বেশ কয়েকটা পিক তুললো। তিতিক্ষারও পিক তুললো। নক্ষত্র ওর ফোনটা আনেনি; চার্জ ছিল না তাই। নক্ষত্র কি মনে করে তিতিক্ষার ফোনে ওর নাম্বারটা ভিজিট করলো। তখনই সেইভ করা পুরো নামটা ভেসে উঠলো। নক্ষত্র হাসবে নাকি কাঁদবে ঠিক বুঝতে পারছে না। কারণ নক্ষত্রের নাম্বারটা এই ফোনে সেভ করা আছে ‘অর্ধ সোয়ামি’ লিখে।

নক্ষত্র শব্দ করে না হাসলেও মুচকি হাসলো। তিতিক্ষা, অদ্রি আর পাতা তিনজনেই সিরিয়াস ভাবে খেলছে। তিনজনের এ সিরিয়াস ভাব দেখে মনে হচ্ছে, এই প্রতিযোগিতার প্রথম পুরষ্কার ওরা নিয়েই যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পাতা আর অদ্রি দুইজন পরপর আউট হয়ে গেল। এখন শুধু তিতিক্ষা রইলো। যখন আর তিন জন বাকি ছিলো, তখন তিতিক্ষাও আউট হয়ে গেল। তিন জনেরই মন খারাপ। নক্ষত্র তখন ওদের উদ্দেশ্য করে বললো,
–“খেলাতে হার-জিত থাকবেই। এটা নিয়ে মন করে থাকাটা বোকামি।”
ওদের মন ভালো করার জন্য নক্ষত্র ওদের ফুচকা খাওয়ালো। নক্ষত্র ওদের নিয়ে একটা শপিংমলে গেল। বড় মামি, ছোট মামী, ওর আম্মু, আর নানুর জন্য শাড়ি কিনলো। বড় মামা, ছোট মামা, আর পলকের জন্য পাঞ্জাবি কিনে ফেলল। পলক যদিও নিতে চাচ্ছিলো না। নক্ষত্রের তবুও ওর কোনো কথা শোনেনি। এখানে আবার কবে আসবে তার তো ঠিক নেই। তাই সবাইকে ছোটখাটো উপহার দিলো।
অনেক ঘুরাঘুরি শেষে ওরা সবাই বাসায় ফিরে গেল। নক্ষত্র ওর রুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। তিতিক্ষা ওর ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। সবাই দুপুরে খেয়ে যে যার রুমে চলে গেছে। বড় মামা, ছোট মামা বাসায় নেই আর পলক বেরিয়েছে সারার সাথে দেখা করতে। তিতিক্ষা খেয়ে এসে বেডে বসতেই নক্ষত্রের আম্মু রুমে আসলো।
নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষাকে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১০+১১+১২

–“কালকে আমরা চলে যাবো। তোমার জিনিস পত্র গুছিয়ে নাও। আমাকে যেন আর বলতে না হয়।”
নক্ষত্রের আম্মু এর আগে তিতিক্ষার সাথে এমনভাবে কথা বলেনি। তিতিক্ষা কিছু বলল না, মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। উনি অদ্রিকেও বললো,
–“তুই বসে আছিস কেন? তোকে কি আলাদা ভাবে বলতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব চলে যাব এখান থেকে। আর এখানে থেকে পাপ বাড়াতে চাচ্ছি না।”
তিতিক্ষা আর অদ্রি অবাক হলো নক্ষত্রের আম্মু এমন ব্যবহারে। নক্ষত্রও তখন ওই রুমেই বসে ছিলো। নক্ষত্রের আম্মু চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে, আবার ফিরে এসে নক্ষত্র কে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“আজকাল একটু বেশিই বড় হয়ে গেছো। এজন্য মনে হয়‌ বাবা মায়ের প্রতি আর ভরসা রাখতে পারছো না।”
উনি কথাটা বলে আর একদন্ডও দাঁড়ালো না। যত দ্রুত সম্ভব রুম ত্যাগ করলো। এদিকে নক্ষত্র, তিতিক্ষা আর পাতা উনার এমন রুড ব্যবহারের কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছে না। নক্ষত্র তিতিক্ষার মুখের দিকে তাকালো। ওর চোখে পানি ছলছল করছে। কিছু একটা ভেবে নক্ষত্র উচ্চশব্দের ওর আম্মুকে ডাকলো। ওর আম্মু রেগেই আবার রুমে হাজির হলো। নক্ষত্র তখন শান্ত কন্ঠে বললো,
–“পুরোটা কাহিনী তোমার উপস্থাপন করতে হবে না। শুধু তোমার রাগের মেইন পয়েন্টটুকু তুমি আমাকে বলবা।”
নক্ষত্রের আম্মু ঠাস করে নক্ষত্রগুলো একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো। কোনো এক কারণে উনি খুব রেগে আছে। নক্ষত্র এই প্রথম ওর আম্মুর হাতে মার খেলো। নক্ষত্রের যা বোঝার এবার ক্লিয়ারলি নক্ষত্র বুঝে গেছে। অদ্রি আর তিতিক্ষা হয়ে অবাক দেখছে। নক্ষত্রকে মার খেতে দেখে তিতিক্ষার চোখে থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। নক্ষত্র এখনও নিজেকে স্বাভাবিক করে শান্ত সুরে বলল,
–“আম্মু তুমি যা ভাবছো, সেটা নয়। দৃশ্যমান অংশে অদৃশ্য ভাবে কিছু লুকিয়ে আছে।”

অনুভূতির শীর্ষবিন্দু পর্ব ১৬+১৭+১৮

2 COMMENTS

  1. অনুভূতির শীর্ষবিন্দু ১৬+১৭+১৮ পর্ব কই আপু?

Comments are closed.