অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১৯

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১৯
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

পুরো ঘরময় পায়চারি করছে অহর্নিশ। মাঝেমধ্যে ব্যাকুলতা নিয়ে আয়ন্তিকার রুমটার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে। কিন্তু প্রতিবারই সে ব্যার্থ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে! অহর্নিশের পায়চারি করা দেখে ইমান রেগে যায়। সে রুষ্ট কন্ঠে বলে,
‘ অযথা পায়চারি করছো কেনো তুমি?আয়ন্তিকার কি হয়েছে? ও ঠিক আছে কিনা, তা নিয়ে কি তোমার একটুও মাথা ব্যাথা নেই? ‘

অহর্নিশের দমন করা রাগ মূর্হতেই তরতাজা হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় সে বাবার দিকে। অহর্নিশ ইমান কে কি বলবে? তার ভিতরে যেই অস্থিরতম ঝড় প্রবাহমান তা তো আর ইমান দেখতে পারছে না। দেখলে বুঝতে পারতো তার অবস্থা। বর্তমান বলা কথাটি তবে কখনোই এ মূর্হতে বলতো না। অহর্নিশ নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
‘ আয়ন্তিকার বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী তো আপনারা আব্বু! মাহিরকে কেনো ওর কাছে পাঠালেন? মাহির যেতে চাইবে দেখেই কি যেতে দিতে হবে আব্বু? একবার তো বোঝা উচিত ছিলো আপনার। আয়ন্তিকা মেয়ে, মাহির অপরিচিত এক ছেলে। যতই হোক আমার বন্ধু। আয়ন্তিকার কাছে ও তো অপরিচিত ব্যাক্তি তাই না? তারপর আবার ওকে একা মাহিরের কাছে পাঠিয়েছেন। ‘

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শেষোক্ত কথাটি চিবিয়ে বলল অহর্নিশ!
ইমান, অহনা দুজনেই চুপসে যায়। অহর্নিশের কথা সত্য! তাদেরই ভুল। মাহির এসেছিলো বাসায়। তাদের দু’জনের সাথে কথা বলার পর আয়ন্তিকা কে দেখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলো সে। অহনা প্রথমে না করেছিলো কিন্তু ইমান তৎক্ষনাৎ মাহির কে আয়ন্তিকার সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দিয়ে দেয়। তাই আর অহনা স্বামীর ওপর আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে পারেননি। মাহির এবং আয়ন্তিকা একান্তগত ভাবে সাক্ষাৎ করেছিলো। পরিশেষে মাহির চলে যাওয়ার পর-পরই আয়ন্তিকা কেমন উগ্র আচরণ শুরু করে! কান্না-কাটি থেকে শুরু করে নিজেকে আঘাত অবধি করেছে। অতঃপর রুমে গিয়ে নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছে। ক্ষনের মাঝে কি থেকে কি হলো তার কিছুই বুঝেনি ইমান, অহনা!অহর্নিশকে ফোন দেয়ার ঘন্টাখানেক বাদেই চলে এসেছিলো সে। আয়ন্তিকা কে দরজা খুলতে শত বার বলার পরও খুলেনি সে।

‘ আমাদের ভুল হয়েছে বাবা! বড্ড বড় ভুল। কিন্তু এখন কিছু একটা কর। মেয়েটা খারাপ কিছু করে ফেললে…, ওর বাবা মার কাছে সারাজীবন আমরা অপরাধী হয়ে থাকবো তবে। ‘
অহর্নিশ চোখমুখ শক্ত করে বলল,
‘ উলটো – পালটা কথা বলা অফ করো আম্মু। আয়ন্তিকা অমন মেয়ে না। যথেষ্ট জ্ঞান আছে ওর মাঝে। উল্টো পাল্টা কিছুই করবে না ও। ‘
পরবর্তীতে অহর্নিশ নিজের বিচক্ষণতার সঙ্গে দরজা খুলে ফেলে।অহনা এবং ইমানকে কড়া নির্দেশ দেয় যাতে তারা রুমে না ঢুকে। অতঃপর সে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। রুমটা খুব বেশি অন্ধকার! কিছুই দেখা যাচ্ছেনা কালো কুচকুচে আঁধার ব্যাতীত। অহর্নিশ অন্ধকারের মাঝেই হেঁটে এগোয় সামনে। শীতল কন্ঠে বলল,
‘ আয়ন্তিকা? ‘

আশপাশ নিস্তব্ধতা আঁটসাঁট! আয়ন্তি রুমের ঠিক কোথায় আছে এবং থাকতে পারে তা নিয়ে সেকেন্ড খানেক ব্যায় করে চিন্তা করল সে। পরিশেষে চোখ খুলে সে কার্বাডের দিকে আগায়। কান্নার শব্দটা তীব্রতর হয়ে তার কানে এসে প্রতিফলিত হয়। তার মানে আয়ন্তিকা কার্বাডের পাশেই আছে। সঠিক জায়গায় দাঁড়াতেই অহর্নিশ অনুভব করে তাকে লেও লতাপাতার মতো আঁকড়ে ধরেছে। সময় অতি বাহিত হলে অহর্নিশ অনুভব করে আয়ন্তিকা কে। লম্বা শ্বাস ফেলল সে। একহাত আয়ন্তিকার চুলে গলিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,

‘ কি হয়েছে তোমার? দরজা বন্ধ করে বসে আছো যে? কান্নাকাটি করছিলে মা বলল। কেও কি তোমায় কিছু বলেছে আয়ন্তিকা? হু?’
অহর্নিশ নম্রতা আয়ন্তিকার বরফ গলিয়ে দেয়। সে খানিক শান্ত হয়। আস্তেধীরে অহর্নিশের থেকে সরে আসতে নিলেই অহর্নিশ তাকে চেপে ধরে নিজের সাথে। মাথা নিচু করে থুতনি তার ঘাড়ে স্থাপন করে, অতি সন্তপর্ণে ক্ষুদ্র করে ওষ্ঠাধর ছোঁয়ায় আয়ন্তির কাঁধে। অতঃপর নম্র কন্ঠে বলল,

‘ যেতে দিচ্ছিনা তো। সো ছাড়াছাড়ি, ছোটাছুটি অফ করো। নিতে এসেছি তোমায়। ‘
আয়ন্তিকা খুশিতে গদগদ প্রায়! মাথা এলিয়ে দিয়ে সে গমগম সুরে বলল,
‘ সত্যিই…? আমাকে এখান হতে নিয়ে যাবেন?’
অহর্নিশ একটু অপ্রসন্ন কন্ঠে বলল, ‘ হ্যা। নিয়ে যাবো। আজই! তৈরি হও। ‘
আয়ন্তিকা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘ আগে ছাড়ুন তো! বাসায় গিয়ে আপনি কোলে নিয়ে বসে থাকলেও আমি আর কিচ্ছুই বলব না প্রমিস। ‘

আয়ন্তিকার উত্তেজনা দেখে অহর্নিশ খুশি হওয়া দেখে কেমন মনমরা হয়ে যায়। তবুও সে বাহিরে নিজের হাস্যরত মুখটা বহমান রাখে! অহর্নিশের মন মরা হওয়ার কারণ তার কেনো জানি মনে হচ্ছে তার বাবা, মা কেও না কেও তো আছে যে আয়ন্তিকা কে কষ্ট দেয়! সহ্য করতে পারেনা। অথবা অন্যকিছু!
নয়তোবা আয়ন্তিকা যেতে এতো উদ্যক্তি হবে কেনো? আগে তো এ বাসায় আসার কতো বাহানা করতো। হটাৎ মধ্যিখানে কি হলো?আর্নিয়া দায়ী নয়তো এরজন্য?

অহর্নিশ ঘাড় বাকিয়ে পিছন ফিরে দেখলো আয়ন্তিকা অতি প্রফুল্লতা নিয়ে নিজের জামা, কাপড় প্যাক করেছে। কান্না করার পর অদ্ভুত এক মোহনীয় স্নিগ্ধতা যেনো তাকে গ্রাস করেছে। ওষ্ঠ কোণের হাসিটা চমৎকার লাগছে। একদম জীবন্ত। অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অহর্নিশ। আয়ন্তিকা কে এখান থেকে নিয়ে গেলেই যে বিপদ! সাংঘাতিক বিপদ! সে বিপদ অহর্নিশ সামাল দিবে কি করে এবার? এখানেও কিছুতেই রেখে যেতে পারছেনা সে আয়ন্তিকা কে।
অহর্নিশ হটাৎ উৎকন্ঠিত দৃষ্টি মেলে বলল,

‘ কাঁদছিলে কেনো বললে না তো! কি হয়েছিলো আয়ন্তিকা? ‘
আয়ন্তিকা সঙ্গে সঙ্গে কেমন উদ্ভট হয়ে যায়। মুখ পাংশুটে করে তুললো সে। উগ্র দৃষ্টিতে তাকালো সে অহর্নিশের দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে অহর্নিশ দু-কদম পিছিয়ে যায়। তার হটাৎ করেই কেমন করে উঠলো বুকের ব্যাথা। আয়ন্তিকার হয়েছেটা কি?
আয়ন্তিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ ঐটা সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাইনা। আপনিও আমায় জোর করবেন না। একদমই না! ‘
অহর্নিশ ভড়কপ গিয়ে বলল, ‘ আচ্ছা, কিন্তু! ‘
‘ কিন্তু ‘ এর পরবর্তীতে শব্দটা কর্ণধারে আসতে দিলো না আয়ন্তিকা। চটজলদি সে ওয়াশরুমে চলে যায় হাতে একটা ড্রেস নিয়ে। আয়ন্তিকার বর্তমান ব্যাবহার খুবই অপরিচিত লাগল অহর্নিশের নিকট। এ কেমন আয়ন্তিকে দেখলো সে?এতো একদম অচেনা এক নারী। কিশোরী নয়! এমন চাহনি কিশোরীরা দিতে পারে বুঝি? এমন ভয়ংকর, সুচালো দৃষ্টি। আঘাতপ্রাপ্ত লাগে নিজেকে অহর্নিশের। দৃষ্টি আহত সে।

সারা অতিমাত্রায় বিরক্তি নিয়ে বসে আছে! সামনে তার বসে অয়ন। অসহায় চাহনি তার। বারবার কিছু বলার জন্য অয়ন ঠোঁট যুগল প্রসারিত করতে নিলেই সারা আঙুল উঁচু করে তাকিয়ে শাসিয়ে বলে,
‘ একদম কথা বলবানা তুমি! ‘
অয়ন আর ধৈর্য রাখতে পারে না। ধৈর্যহারা হয়ে সে সারার হাতদুটো চেপে ধরে অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ সারা, মেরি জান! এমন করছো কেনো জান?আমি কি কোনো ভুল করেছি?ভুল করলে বলো! শাস্তি দাও! তবুও এমন চুপ করে থাকিও না। ‘

সারা এক ঝটকায় তার ঝাড়ি মেরে সরিয়ে নেয়। ফের সে তার ডান হাতের আঙুল উঁচু করে নিয়ে বলল,
‘ একদম ‘ জান ‘, ‘জান ‘ করবানা অয়ন। তাহলে ডির্ভোস দিবো আমি তোমাকে। ‘
অয়ন সারার কথা শুনে শুষ্ক ঢোক গিলে। চোখদুটো ছোট্ট করে নিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা জা..! থুক্কু জান বলবো না আর। তাহলে কি ডাকব তোমায়?বাবু, সোনা, কলিজা, ফুসফুস কোনটা? কোনটা ডাকবো বলো তুমি! আমি সেটা বলেই তোমায় ডাকবো। ‘

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ১৮

সারা তেতে উঠে বলল, ‘ এই ন্যাকামি করবানা মেয়েদের মতো আমার সামনে বলছিনা?হ্যা? ‘
‘ করবো না ন্যাকামি। ওকে?এবার বলো তো আমার সাথে কথা বলছ না কেনো তুমি? ‘
‘ আজকে যে আমি এতো অসুস্থ ছিলাম। সারাদিনে একবারও আমার খোঁজ নিয়েছো তুমি?বাবা হতে যাচ্ছো তুমি অয়ন। এখন এমন খাপছাড়া চলাফেরা করলে কিভাবে হয়? আজ যদি আমি মারা যেতাম তাহলে আমার বাচ্চাটাও দুনিয়া দেখার আগেই চলে যেতো। আমাকে তুমি পছন্দ করে বিয়ে করোনি। না কখনো আমায় ভালোবেসেছো তাই হয়তো আমার প্রতি তোমার কোনোরকম চিন্তা ভাবনা নেই। আমি মারা গেলেও তোমার কিছু যায় আসবে না। কিন্তু একটিবার তো নিজের সন্তানের কথা চিন্তা করো। আমাকে না পছন্দ করো নিজের সন্তানকে নিয়ে তোমার এতো হেলাফেলা করো তুমি?’

অয়ন স্তব্ধ! সারা কাঁদছে ফুপিয়ে। অয়ন যে তাকে এখনো মেনে নিতে পারেনি এটা গহীনে জাগ্রত হলেই ইচ্ছে করে সারার মরে যেতে! এই ৩ বছরে কি একটুও অনুভূতি জাগ্রত করতে পারেনি সে অয়নের মনে?
অয়ন নম্র কন্ঠে বলল,
‘ তুমি আমার কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ এটা হয়ত আমি তোমায় বর্ণনা করতে পারবো না সারা। আর না বর্ণনা করলে তুমি বিশ্বাস করবে। তাই কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না আপাতত! আমি তোমার অসুস্থতার সময় পাশে ছিলাম ঠিকি। কিন্তু অপরপ্রান্তে থেকে আমি যে ছটফট করে মরেছি তা হয়ত তুমি দেখোনি, জানোনা! নেক্সট এরূপ কোনো কথা তুলবে না সারা। আমি টলারেট করবো না! ‘

অয়ন গটগট পায়ে বেড়িয়ে যায় রুম হতে। সারার কথা সত্যি সে আজকাল বড্ড বেশি কেয়ারলেস হয়ে গেছে। সারার যে সময়টাতে তার সবচেয়ে বেশি দরকার সেই সময়টাতেই সে বেখেয়ালি পূর্ণ আচরণ শুরু করেছে। কিন্তু এতে ওর দোষটা কোথায়?সবটা দোষ তো অহর্নিশের। অহর্নিশ কে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সে আজকাল বড্ড এলোমেলো হয়ে পড়েছে। অহর্নিশ তার রক্তের সম্পর্কহীন ভাই। তার এই বিপদের সময় অয়ন কি বাসায় হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে?
ফোন দেখে অয়ন! অহর্নিশের একটা কলও এখন অব্দি আসেনি। কি হলো কে জানে? আয়ন্তিকা ঠিক আছে তো?

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২০