অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২১

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২১
সাদিয়া মেহরুজ দোলা

আয়ন্তিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে অহর্নিশ কে। বারংবার সে ঘুরেফিরে অহর্নিশের দিকেই দৃষ্টি দিচ্ছে! পড়ার প্রতি আপাতত তার মন নেই। কান্না পাচ্ছে আয়ন্তিকার। রাগে, দুঃখে সে ফ্লোরে পায়ের নখ দ্বারা আঘাত করতে থাকে। ক্ষুদ্র আওয়াজে অহর্নিশ একবার ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতে দৃষ্টি দিয়ে আয়ন্তিকার দিকে তাকায়। ভ্রুকুটি কুঁচকে যায় মূর্হতে। নখ দ্বারা আঘাত এক পর্যায়ে ভেঙে যায় নখ! ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে ‘উহ্ ‘ শব্দ করে পুরোপুরি চুপ হয়ে যায় আয়ন্তিকা।

অহর্নিশ হাতে ঘড়ি পড়ে নিয়ে নিজেকে আরেকবার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখে নিল। যেনো তার আশপাশে কি হচ্ছে তাতে অহর্নিশের কোনো মাথাব্যাথাই নেই! অহর্নিশের ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে আয়ন্তিকা ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে কেঁদে দেয়,
অহর্নিশ এতে বিরক্তি হয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ এই মেয়ে, এই! কি সমস্যা হ্যা?আজ কি শুরু করেছো তুমি? কখনো পাগলের মতো হাসছো, অদ্ভুত বিহেভ করছো! তো কখনো একা একাই কান্না করছো। প্রবলেমটা কি?’
অহর্নিশের কথা কর্ণপাত হতে আয়ন্তিকা মাথা উঁচু করে অভিমানী চাহনিতে তাকায়। সে তার চাহনিতে উপলব্ধি করাতে চাচ্ছে অহর্নিশ কে, যাতে অহর্নিশ একটু তার ভেতরটা বুঝুক! এইযে অহর্নিশ তাকে দুদিন ধরে ইগনোর করছে এতে যে আয়ন্তিকার বেহাল দশা প্রায় তা একটু বুঝুক সে। অহর্নিশ এগোয় সামনে। আয়ন্তিকার সামনে হাটুগেড়ে বসে বলল,

‘ কি হয়েছে আমার না হওয়া বাবুর আম্মু? রাগ কেনো আমার প্রতি? কি করেছি বলবা তো! এভাবে অযথা নিজেকে আঘাত করছো ক্যানো?’
আয়ন্তিকা লজ্জায় নুইয়ে না গিয়ে মাথা উঁচু করে সে অভিমানী কন্ঠে বলল,
‘ পুরোটা দিন বাসায় একা থাকি! একা থাকতে আর কতো ভালো লাগে? আমাকে এখানে আনলেন কেনো? সারাদিন বাসায় আমাকে একা রেখে রেখে পাগল বানানোর ফন্দি আঁটছেন নাতো?’
অহর্নিশ তপ্তশ্বাস ফেলে বলল, ‘ যে নিজেই পাগল, সে আবার অন্যকে কি পাগল বানাবে? ‘

‘ মানে? বুঝিনি আপনার কথা! কি বললেন আবার বলুন। ‘
‘ কিছুনা। তোমাকে এখানে এনেছি কারণ তুমি ওখানে থাকলে একটা না একটা অঘটন ঘটে তোমার সাথে। তাই এখানেই থাকা ভালো! আমি তোমায় টাইম দিতে পারছিনা কেনো? কারণটা তুমি ভালো করেই জানো আয়ন্তিকা। আমায় আরেকটু সময় দাও। নির্বাচন শেষ হলে সারাদিন আমি তোমায় কোলে নিয়ে বসে থাকবো! এন্ড এন্ড এন্ড, আমার না হওয়া বাবুকে পৃথিবীতে আনার জন্য পরিকল্পনা করবো দুজন মিলে ওকে?’

আয়ন্তিকা নতজানু হয়। মেদহীন গালদুটো রক্তিম আকার ধারণ করেছে। এই লোক আস্ত এক বজ্জাত অলওয়েজ তাকে উদ্ভট কথাবার্তা বলে লজ্জায় জর্জরিত করে ফেলে। সেই ক্ষনটায় আয়ন্তিকার ইচ্ছে হয় মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে। এমন এক বেলাজ লোকের সাথে তার বিয়ে হলো কেন?তা ভাবতে গিয়ে আগামাথা উত্তর খুঁজে পায়না সে।

আয়ন্তিকা কে মৌনরূপে দেখে অহর্নিশ স্নান হাসে। উঠতে নেয়ার সময় টুপ করে সে আয়ন্তিকার কপালে চুমু খায়! অতঃপর এক মূর্হতও না দাঁড়িয়ে সে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। আজ তার প্রচুর কাজ! কাল নির্বাচন! যাওয়ার আগে অহর্নিশ দরজার কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
‘ রেডি থেকো রাতে! বাহিরে যাচ্ছি আমরা। ঠিক ১২ টার সময় এসে তোমায় নিয়ে যাবো। ‘
আয়ন্তিকা স্বস্তিপূর্ণ শ্বাস ফেলল! পরিশেষে তাহলে বলা যায় এই বন্দী, গুমোট পরিবেশ হতে একটু হলেও তার মুক্তি মিলতে চলেছে। ক’দিন ধরে অহর্নিশ তাকে একটুও টাইম দেয়না। শুধুমাত্র ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর সে অহর্নিশের উষ্ণ আলিঙ্গনে নিজেকে আবিষ্কার করে। ব্যাস! অতটুকুই! তারপরই ক্ষনের মধ্যিতে অহর্নিশ ঘুম থেকে উঠে নিজ কর্ম সম্পূর্ণ করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়তো। যদিও আয়ন্তিকা জানে এমনটাই হওয়ার ছিলো!

হালকা কমলা রঙের শাড়ী! পরিপাটি মতোন নিজেকে তৈরি করে আয়ন্তিকা শেষবারের মতোন নিজেকে দেখে নেয় আরশির মাঝে! পরক্ষণেই লজ্জায় লাজুকলতা রূপ নিয়ে চুপসে যায় সে। ইশ! আজ সে প্রথমবারের মতো অহর্নিশের সাথে একা কোথায় ঘুরতে যাচ্ছে। অনুভূতিটাই আলাদা! চমৎকার এক অনুভূতি।
কলিংবেলের আওয়াজ কর্ণগোচর হতে আয়ন্তিকা দ্রুত পায়ে মেইন দরজার কাছে এগোয়! দরজা খুলতেই আয়ন্তিকার চক্ষুর সম্মুখে দৃশ্যমান হয় অহর্নিশ ক্লান্তিমাখা মুখশ্রী। ললাটে ঘামের ছোট ছোট কণা বিন্দু রূপে জায়গা দখল করে আছে। আয়ন্তিকা অহর্নিশের দিকে পূর্ণরূপে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

‘ আপনাকে এতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেনো?’
অহর্নিশ শুভ্র রঙের পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে ঘাম মুছে নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ কাজ একটু বেশিই ছিলো আজ। কাল নির্বাচন! তাই, ‘
আয়ন্তিকা ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘ ভেতরে আসুন জলদি! খেয়ে রেষ্ট নিন। ভালো লাগবে। ‘
অহর্নিশ সটান হয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণ অমনোযোগী দৃষ্টি এখন মনোযোগীতে পরিপূর্ণ করে। থম মেরে তাকিয়ে আছে সে আয়ন্তিকার দিকে। পা হতে মাথা অব্দি দেখে নিয়ে অহর্নিশ শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে! ‘

আর চার – পাঁচটা মেয়ের মতো আয়ন্তিকার এই মূর্হতে লজ্জা পেতে ইচ্ছে হলো স্বামীর মুখে নিজের প্রশংসা শুনে। কিন্তু নিভৃতে হতে ধিক্কার জানায় সে তার বর্তমান চিন্তাধারা কে। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ এসব কথা পরে হবে। ভেতরে আসুন তো আপনি। আপনার রেষ্ট দরকার। ‘
অহর্নিশ সামনে এগিয়ে এসে একটুখানি ঝুঁকে আয়ন্তিকার দিকে। আয়ন্তি হতভম্ব হয়ে পিছন সরে যেতে নিয়েও পারেনা। ইচ্ছে হলোনা পিছন যেতে। অহর্নিশ ফু দেয় আয়ন্তিকা মুখশ্রীতে। চটজলদি চোখ বন্ধ করে নেয় আয়ন্তি! বুকে ধুকপুক ধ্বনি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নরমাল হওয়ার নামই নেই। যেনো হৃদপিণ্ড এখুনি বেড়িয়ে আসবে এত তুমুল বেগে স্পন্দিত হতে হতে!
অহর্নিশ মিটিমিটি হেঁসে বলল,

‘ তা তো হয়না! বউ আমার এতো কষ্ট করে নিজেকে পরিপাটি মতোন তৈরি করেছে স্বামীর সাথে ঘুরতে যাবে বলে।এখন আমি এই কষ্ট বিফলে যেতে দিই কি করে? ‘
আয়ন্তিকা টেনে চোখ খুলে বলল, ‘ যাওয়া লাগবে না আ..আজ.. ‘
অহর্নিশ আয়ন্তিকার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল,

‘ হুশশ! চলো চলো। এমন সুযোগ বারংবার আসে না ফিরে। আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি। ‘
অহর্নিশ আয়ন্তিকার কোমল মেদহীন হাত শক্ত করে ধরে নেয়। বাসা লক করে নিয়ে আয়ন্তিকা কে নিয়ে সে সামনের দিকে আগায়। মৃদু হাসিটা এখনো বিদ্যমান অহর্নিশের অধর কোণে!
কিন্তু আয়ন্তিকা বিচলিত! কি বলল অহর্নিশ খানিক আগে? ‘ আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি ‘ এটা কেনো বলল অহর্নিশ? চিন্তার বেগ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে আয়ন্তির। উফ! এতো টেনশন দেয় কেন অহর্নিশ? এতো রহস্য নিয়ে ঘোরে নিজের মধ্যিতে! কবে জানি আয়ন্তিকা এর কারণে ঠাস ঠাস থাপ্পড় মেরে বসবে অহর্নিশ কে।

হাতিরঝিল ছেড়ে কিছুটা দূরে নির্জন এক জনশূন্য স্থানে নিয়ে এসেছে অহর্নিশ আয়ন্তিকা কে! আসার পর সেই যে আয়ন্তিকা চারিপাশ দেখতে বেশ ব্যাস্ত হলো, তার খেয়ালই নেই একজোড়া নেশাক্ত আঁখি পল্লব তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। অহর্নিশ অপ্রতিভ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আয়ন্তিকার দিকে।আদুরে ছুঁয়ে দেয়ার তীব্র বাসনা জেগেছে মন গহীনে। কিন্তু সেটা করা কি সম্ভব? তা কি আদও ঠিক হবে? একে তো, বাল্যবিবাহ করে পাপের বোঝা ভারী করেছে তার ওপর এখন যতো বাজে চিন্তা মাথায় এসে ভর হয়েছে তার।

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২০

লম্বা শ্বাস টেনে নেয় অহর্নিশ! আঁখিপল্লব ফের আয়ন্তিকার ওপর নিবদ্ধ করে নিয়ে সে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ এটা কেনো হলো আয়ন্তিকা? কেনো আমি তোমার প্রতি বড্ড বেশি আসক্ত হয়ে গেলাম? এই মেয়ে! কি আছে তোমার মাঝে?নারীজাতির ওপর তীব্র ঘৃণাটা যে তুমি নিমিষেই দূর করে দিলে। তুমি নারী নয়! তুমি প্রেমময়ী, মোহময়ী এক কিশোরী! ‘
অহর্নিশ এলোমেলো পায়ে সামনে চলা শুরু করল। যতটা সামনে সে সেকেন্ড, মিনিটে এগোচ্ছে! ততটা করে বোধহয় তার নিভৃতে গড়ে ওঠা সেই অপরাধ মূলক তীব্র বাসনা গভীরতর হচ্ছে। অহর্নিশ নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যাবধান নিয়ে দাঁড়ায়। ফিচেল কন্ঠে বলে,

‘ আয়ন্তিকা? ‘
আয়ন্তিকা পিছন ফিরে তৎক্ষনাৎ। ঘাড় কাত করে সে বলল,
‘ কিছু বলবেন?’
‘ বাসায় যাবেনা? দুই ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। ‘
‘ যাবো! আরেকটু পর যাই?প্লিজ..!’
অহর্নিশ চোখমুখ ছোট করে বলল, ‘ আচ্ছা! ‘
আকাশে মেঘের গর্জন শুরু হয় মিনিট দুয়েক পর। অহর্নিশ চিন্তিত হয়ে বলল,
‘ বাসায় চলে এখন। আর থাকা লাগবেনা। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। ‘
আয়ন্তিকা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ হোক না! বৃষ্টিতে ভিজবে আমি। ‘
অহর্নিশ কঠিন কন্ঠে বলল, ‘ একদমই না। চলো!’

অতঃপর অহর্নিশের কথা সমাপ্ত হতেই বৃষ্টি নামে ঝমঝম করে! মূর্হতেই সিক্ত হয়ে যায় দু’জন। অহর্নিশ অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ধ্যাত! এখন সে নিজেকে সামাল দিবে কি করে?সিক্ত রূপে রূপান্তর হওয়া আয়ন্তিকার খয়েরী বর্ণের ওষ্ঠাধর বোধহয় অহর্নিশ কে একটু উল্টো পাল্টা করে দেয়। সে চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংযত করার এক পর্যায়ে অনুভব করলো তার বক্ষ পিঞ্জরে কারো ছোঁয়া। তীব্র ব্যাথায় অহর্নিশ চোখ খুলে দেখল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে বুকের বাম পাশ হতে! সামনে তাকাতে দেখে আয়ন্তিকার বাকরুদ্ধ চাহনি। অহর্নিশ মৃদু হাসে। মুখ থুবড়ে সে তৎক্ষনাৎ পড়ে যায় মাটিতে।

অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ২২