অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৭

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৭
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল   

কুহুর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের পুকুরঘাটটা বেশ সুন্দর। পুকুরের চারপাশটা জুড়ে বিভিন্ন কাঠগাছ। ইট দিয়ে বাধানো সিঁড়ি। তার চারপাশে চমৎকার সব ফুলগাছ। সবসময় কোন না কোন ফুল ফুটেই আছে। মন ভালো করার জন্যে এমন একটা দৃশ্যপট যথেষ্ট। সিঁড়ির ওপর বসে আছে কুহু। ওর ড্রয়িং খাতাটা উড়ুর ওপর রেখে পেন্সিল দিয়ে ড্রয়িং করছে। মনে মনে নিরবের কথা ভাবছে। নিরব ডেকেছে ওকে এখানে। আজ এখানেই দেখা করার কথা ওদের। বেলা তিনটায়।
ঠিক তিনটা বাজেই নিরব এসে হাজির হলো। প্রায় লাফিয়ে বসল কুহুর পাশে। কুহু চমকে উঠল। কিন্তু নিরবকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। নিরব ভ্রু নাচালো। ঠোঁটে মৃদু হাসি। কুহুও হাসল। দ্রুত মোবাইলটা বের করে হোয়াটস্ অ‍্যাপে চলে গেল। লিখল, ‘আপনি এতো ঠিকঠাক সময় কীকরে আসেন? খুব পাংচুয়াল না?’

নিরব হেসে ফেলল। বলল, ‘পাংচুয়াল? আমি? তুমি জানো ক্লাসে দেরীতে ঢোকার জন্যে কতবার সারা ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে আমাকে? শুধু তোমার বেলাতেই নিয়মটা পাল্টে যায়। ইউ নো, তোমাকে দেখার জন্যে ছটফট করি আমি। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ তোমাকে সামনেই বসিয়ে রাখি।’
কুহু তাকিয়ে রইল নিরবের দিকে। কেমন একটা লাগছে ওর। অদ্ভুত অনুভূতি। ধীর হাতে টাইপ করল, ‘কেনো?’
নিরব একটু এগিয়ে গেল কুহুর দিকে। কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ আগেও কতবার বলেছি। ইউ আর রিয়েল ভেরী কিউট।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কুহুর দুটো লাল হয়ে উঠল। চোখ বন্ধ করে রেখেছে ও। নিরব সোজা হয়ে বসল। কুহু চোখ খুললেও তাকালো না নিরবের দিকে। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। নিরব বুঝলো মেয়ে লজ্জা পেয়েছে। তাই কথাটা ঘোরাতে নিরব বলল, ‘কী ব্যপার? ম্যাডামকে আজ এতো খুশি খুশি লাগছে? চোখমুখ চকচক করছে একদম।’
কুহু চট করে নিরবের দিকে ঘুরে বসল। লজ্জা পালিয়ে গেছে ওর। কথা বলার মতো পছন্দের বিষয় পেয়ে গেছে। ও দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে লিখল, ‘জানেন? ভাইয়া বিয়ে করছে?’
‘ সত্যি! কী সাংঘাতিক! তোমার ঐ দানব ভাইটা রাজি হলো? এই অসম্ভবকে সম্ভব কে করলো বলোতো? মহাযোগীর ধ্যান ভঙ্গ করল কোন অপ্সরা?’
কুহু চোখ ছোট করে কিল মারল নিরবের বাহুতে। নিরব হেসে দিয়ে বলল, ‘জাস্ট কিডিং। তা ঘরোয়াভাবে হচ্ছে নাকি_’
কুহু লিখল, ‘ রুদ্র আমেরের বিয়ে বলে কথা! ধুমধাম করে হবে। আর ভাবিকে আমি দেখিনি এখনো। আজ যাব। বাবা বলেছে বিয়ের আগ পর্যন্ত ভাবির কাছেই থাকতে।’
নিরব ঠোঁট উল্টে মাথা ঝাঁকালো। অর্থাৎ এলাহি ব্যপার স্যাপার। তারপর হঠাৎ উৎসাহি কন্ঠে বলল, ‘আমি ড্রপ করে দেই আজ তাহলে?’

কুহুর সুন্দর মুখটা মলিন হলো। নিরাশ ভঙ্গিতে লিখল, ‘কালো হাতিদুটো ছাড়বেনা আপনার সাথে।’
নিরবও হতাশ হল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ঐ দুটোকে মাঘের রাতে এই পুকুরে পরপর একশ চুবানি দিতে। বিশ বছরের একটা মেয়েকে এতো পাহারা দেওয়ার কী আছে! মাস দুই পরেতো নিরব চলে যাবে ভার্সিটি ছেড়ে। এরকম হলে তখন কীকরে দেখা হবে কুহুর সাথে? এদিকে কুহুর মলিন মুখ দেখেও নিরবের খারাপ লাগল। ব্যপারটা স্বাভাবিক করতে বলল, ‘বড় ভাইর বিয়েতো হয়েই যাচ্ছে। ছোট বোনের বিয়েটা কবে হবে?’
কুহু কিছু বলল না। ঠোঁটে চাঁপা হাসি রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। কুহুর ঠোঁটে হাসি দেখে নিরব স্বস্তি পেল। বলল ‘জানো, আমি ঠিক করেছি অনলাইনে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শিখব।’
কুহু নিরবের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাঁচিয়ে বোঝালো, ‘কেনো?’
নিরব আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসল কুহুর। নিচু কন্ঠে বলল, ‘ফিউচারের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে তো।’

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুল শুকাচ্ছে প্রিয়তা। আজ শরীরটা ভালো লাগছিল না। গা ম্যাচম্যাচ করছিল। তাই অলসতায় গোসল করতে দেরী হয়ে গেল। দরজায় নক পড়ায় দ্রুত পায়ে রুমে এলো প্রিয়তা। দরজা খুলে দেখল দেখল এক সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘিয়ে রঙের শাড়ি, লাল ব্লাউজ, খোলা চুল। কিন্তু চোখে কেমন একটা ফ্যাকাশে ভাব। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। খানিকটা ইতস্তত করে প্রিয়তা বলল, ‘ আপনি?’
জ্যোতি প্রিয়তাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতেই বলল, ‘জ্যোতি। রুদ্রর বাড়ি থেকে এসছি। তুমি প্রিয়তা তো?’
প্রিয়তা সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল, ‘ জ্বি। আসুন না। বসুন।’
জ্যোতি এগিয়ে এসে ভেতরে এসে বসল। প্রিয়তা বলল, ‘লাঞ্চ করেছেন আপু?’
‘ হ্যাঁ করেছি। এতো ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই? বসোনা।’

প্রিয়তা বসল। জ্যোতি বলল, ‘ আমি আমের ভিলারই সদস্য। বাকি পরিচয়টা ঐ বাড়ি গেলেই ধীরে ধীরে জানতে পারবে। আর তোমার ননদ আসছে কিছুক্ষণের মধ্যে। বিয়ের আগ পর্যন্ত ও তোমার কাছেই থাকবে।’
প্রিয়তা মাথা নাড়ল। জ্যোতি প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর আমাকে আপনি না বলে তুমি করেই বলো। কাছেরই লোক।’
উত্তরে মৃদু হাসল প্রিয়তা। জ্যোতি ঘরের বাইরে ইশারা করে বলল, ‘ ঐ দুজন কারা?’
প্রিয়তা নিচু কন্ঠে বলল, ‘ উনি রেখে গেছেন ওদের। আমার হেল্প করার জন্যে।’
‘ ভালোবাসা!’
হালকা হেসে জ্যোতি উঠে দাঁড়ালো। চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে কৌতুকের স্বরে বলল, ‘ এই ফ্লাটেই মাসখানেক একসঙ্গে ছিলে তোমরা তাইনা?’
প্রিয়তার চোখ নামিয়ে খানিক ইতস্তত করে বলল, ‘আমরা নই। শুধু আমি। উনি এখানে থাকতেন না। শুধু এসে দেখা করে যেতেন।’
জ্যোতি প্রিয়তার পাশে বসে বলল, ‘ কিন্তু ঐসময় অনেকদিনই কিন্তু রুদ্র রাতে বাড়ি ফেরেনি।’
‘আমি ঠিক জানিনা।’

ব্যপারটা পেঁচিয়ে যাচ্ছে বুঝেও সরল জবাব দিল প্রিয়তা। জ্যোতি কেমন অদ্ভুতভাবে পর্যবেক্ষণ করছে প্রিয়তাকে। আসার পর থেকেই। হয়তো বিশেষত্ব খুঁজছে। রুদ্র আমের নামক পাষাণকেও গলিয়ে দিল! এমন কী বিশেষ আছে এই মেয়ের মধ্যে? যা জ্যোতির মধ্যে নেই। ওকে জানতেই হবে। এইদিকে জ্যোতির ওরকম দৃষ্টিতে অস্বস্তি হচ্ছে প্রিয়তার। জ্যোতি হঠাৎই শান্ত গলায় বলল, ‘ কী দিয়ে মন গলালে রুদ্রর। এমন কী করলে যে তোমার পেছনে পাগল হয়ে গেল? জাদুটোনা!’
প্রিয়তা এবার সরাসরি তাকাল জ্যোতির দিকে। জ্যোতির চোখেমুখে কৌতুক খেলা করছে। প্রিয়তা বুঝতে পারল না কী বলবে। জ্যোতি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ‘মজা করছিলাম। আসলে আমাদের আয়রন হার্ট রুদ্র আমের হঠাৎই কারো প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে কি-না। সেইজন্য।’
প্রিয়তা স্বস্তি পেল। লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে বলল, ‘ভালোবাসাতো সময় দেখে, জায়গা বেছে, লোক বেছে হয়না আপু। হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই। আর যখন বুঝতে পারে ভালোবেসে ফেলেছে, তখন অনেক দেরী হয়ে যায়। কিছু করার থাকেনা।’

কথাটা শেষ হতেই জ্যোতি জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। প্রিয়তা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। কিন্তু খানিক বাদেই মুখে হাসি ফুটল ওর। আস্তে করে জ্যোতির পিঠে হাত রাখল। জ্যোতি বলল, ‘ভীষণ মিষ্টি মেয়ে তুমি। না দেখলে বিশ্বাস-ই হতোনা এতো মিষ্টি মেয়েও এক্সিস্ট করে।’
প্রিয়তা কিছু বলার আগেই দরজায় টোকা পড়ল। প্রিয়তা আর জ্যোতি একে ওপরকে ছেড়ে তাকাল। প্রিয়তা দেখল সাদা কুর্তি পরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদম বাচ্চাদের মতোই নিষ্পাপ মুখখানা। মুখে মিষ্টি হাসি। জ্যোতি বলল, ‘ এই হল তোমার ননদ। কুহু!’

কুহু দ্রুত পায়ে এসে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। প্রিয়তাও ধরল। কয়েক সেকেন্ড পর ছেড়ে দিয়ে ইশারায় কিছু বলল। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কিছুই বুঝল না। জ্যোতি বলল, ‘ও বলছে তুমি খুব সুন্দরী। একদম পরীর মতো। আর থ্যাংকিউ দিল। ওর বেয়ারা ভাইকে লাইনে আনার জন্যে। আসলে ও জন্ম থেকেই কথা বলতে পারেনা। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজ করে।’
প্রিয়তার খারাপ লাগল। এতো মিষ্টি মেয়েটা কি-না কথা বলতে পারেনা! পরক্ষণেই ভাবল, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ওকে এমন কোন প্রতিভা দিয়েছেন যার কাছে এই অক্ষমতাটুকু নগণ্য। মুখে বলল, ‘ তুমিতো মিষ্টির চেয়েও বেশি মিষ্টি।’
কুহু খুশি হয়ে গেল। ইশারায় বলল, ‘ আমি এই কদিন তোমার কাছে থাকব। জানো?’
কথাটা জ্যোতি বুঝিয়ে দিল প্রিয়তাকে। প্রিয়তা কুহুর গাল টেনে বলল, ‘ না থাকতে চাইলে জোর করে রেখে দিতাম। এতো মিষ্টি মেয়েকে ছাড়া যায়?’
কুহুর খুশি দেখে কে? ঝটপট ওর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কিছু একটা করছে। প্রিয়তা অবাক হয়ে দেখছে মেয়েটার চঞ্চলতা। সত্যিই মিষ্টি একটা মেয়ে। ফোনে কাজ শেষ করে কুহু বলল, ‘পিৎজা অর্ডার করেছি। খেতে খেতে জমিয়ে আড্ডা দেব।’

জ্যোতি সেটা প্রিয়তাকে বুঝিয়ে বলল। প্রিয়তা গাল ফুলিয়ে আসাম করে বসল। অসহায় মুখ করে জ্যোতি আর কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ঐ বাড়ির তোমরা সবাই কী খাও বলোতো? সবাই এতো সুন্দর আর সুইট কেন?’
প্রিয়তার কথায় জ্যোতি আর কুহু একে ওপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে প্রিয়তাও যোগ দিল সেই হাসিতে।

দেখতে দেখতে তিনটে দিন পাড় হলো। আমের ভিলার সবাই বিয়ের তোড়জোড় করতে ব্যস্ত। সকলেই নিজ নিজ কাজে চরম ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এরমধ্যে প্রিয়তার সাথে সেভাবে কথা বলার সুযোগ হয়নি ওর। মেয়েটা কেমন এড়িয়ে চলে ওকে। কথা বলতে চায়না। মুখ গোমড়া করে থাকে। রুদ্র ঠিক করে নিয়েছে বিয়ের আগে মেয়েটার সাথে কথা বলে নেওয়া দরকার। বিয়ের দিনটাতে যাতে দুজনেই দুজনের কাছে পরিষ্কার থাকে। দ্বিধাহীন মনে বিয়ে করতে পারে।
রাত প্রায় দশটা বাজে। আকাশে ঘন মেঘ করেছে। খানিক বাদে বাদে বিদ্যুতের ঝলকানিতে আলোকিত হয় ওঠছে চারপাশটা। মাঝারি বেগে বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে বছরের প্রথম বর্ষণটা আজকেই হবে। প্রকৃতি তাই বলছে। ছাদের রেলিং ধরে শহরটাকে দেখছে প্রিয়তা। পরনে কুর্তি। খোলা চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে বাতাসের তালে। গভীর এক ভাবনায় ডুবে আছে সে।

প্রিয়তাকে খুঁজতে ছাদে এসে থমকে গেল রুদ্র। আবছা অন্ধকার ছাদে যেন কোন অপরূপা পরী দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে সামলালো রুদ্র। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল প্রিয়তার কাছে। বলল, ‘ঘরে চলো প্রিয়তা। ঝড় আসবে মনে হচ্ছে।’
‘ আপনি এখানে?’ নির্বিকারভাবে জানতে চাইল প্রিয়তা। রুদ্রর দিকে তাকায় নি।
‘ রাতে ঘুমাবো না এখানে। চিন্তা করোনা। তোমার সাথে কিছু কথা ছিল আমার।’
প্রিয়তা কিছু বলল না। তাকালোও না। প্রিয়তাকে চুপ দেখে রুদ্র বলল, ‘দুদিন পরে আমাদের বিয়ে প্রিয়। তুমি এখনো অভিমান করে আছো আমার ওপর? নাকি সত্যিই বিয়ে করতে চাওনা আমাকে?’
প্রিয়তা এবার তাকাল রুদ্রর দিকে। কাঠকাঠ গলায় বলল, ‘যদি বলি বিয়ে করতে চাইনা আমি আপনাকে। তাহলে? ভেঙ্গে দেবেন বিয়েটা? ছেড়ে দেবেন আমাকে? আপনার বাবা মানবেন?’
রুদ্র এবার প্রিয়তার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘আমাকে তুমি চাওনা? কথাটা আমার চোখে চোখ রেখে বলতে পারবে?’

প্রিয়তার কঠিন দৃষ্টি কোমল, আদ্র হয়ে উঠল। রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ আমি দ্বিধায় ভুগছি।’
রুদ্র অধৈর্য হল। প্রিয়তার দুই বাহুতে হাত রেখে বলল, ‘আমি জানি আমার তোমাকে ছাড়া চলবেনা। তুমি জানো তুমি আমাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাহলে কীসের দ্বিধা প্রিয়? কীসের সংকোচ? কীসের অপূর্ণতা?’
‘ বিশ্বাসের।’
‘ বিশ্বাসের?’

হতবাক হলো রুদ্র। প্রিয়তা ওকে নিয়ে বিশ্বাস করেনা! কথাটা মানতে কষ্ট হচ্ছে ওর। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল, ‘লোকে বলে বিশ্বাস না করলে নাকি ভালোবাসা যায়না। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে ভালোবাসা নেই। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। ভালোবাসতে বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়না। কিন্তু যেকোন সম্পর্কে বিশ্বাস স্তম্ভের মতো কাজ করে। ভালোবাসাতো অল্প সময়ে, অল্প আলাপেও হয়ে যায়। ঐটুকু সময় কাউকে বিশ্বাস করার জন্যে যথেষ্ট নয়। কিন্তু সম্পর্ক! জগতের সব সম্পর্ক শুরুই হয় বিশ্বাস দিয়ে। বন্ধু হোক, স্বামী-স্ত্রী হোক সব সম্পর্কই বিশ্বাস দিয়ে শুরু হয়। ভরসা দিয়ে শুরু হয়। তাই যেকোন সম্পর্কে দৃঢ় রাখার জন্যে একে ওপরের ওপর বিশ্বাস থাকা চাই। ভালোবাসাহীন সম্পর্ক হয়। কিন্তু বিশ্বাসহীন সম্পর্ক তাসের ঘরের চেয়েও দুর্বল। তাই যেকোন সম্পর্ক শুরু করার আগে একে ওপরের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখাটা জরুরি।’

রুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘আর তুমি আমার ওপর সেই বিশ্বাস রাখতে পারছোনা?’
‘ না পারছিনা। আর বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর আগে আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই।’
‘ অবিশ্বাসের কারণ?’
আবার বিদ্যুতের ঝলকানি খেলে গেল আকাশে। তুলনামূলক আলোর মাত্রা বেশি ছিল এবার। সঙ্গে মাঝারি আওয়াজে গর্জন করে উঠল মেঘ। অভিমান, অভিযোগে জর্জরিত কন্ঠে প্রিয়তা বলল, ‘আপনার ইচ্ছে হলো আর আপনি আমাকে চট্টগ্রাম দিয়ে আসলেন। একবার জানতেও চাইলেন না আমি কী চাই। আমার কী ইচ্ছা। অথচ ঐ কয়েকটা দিন প্রতিটা মুহূর্তে প্রেমের, ভালোবাসার তীব্র অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন আপনি আমাকে। কিন্তু আপনার ইচ্ছে হওয়াতে কত সহজেই ছেড়ে দিলেন আমায়। কীকরে ধরে নেব যে আগামীতে আবার আপনার মুড সুইং হবেনা? হয়তো আবার আপনি আমাকে বলে বসবেন যে “প্রিয়তা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাও। বিয়েটা আমি ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছি।” আমার জীবটাতো আপনার মুডের ওপর চলতে পারেনা।’

রুদ্র কিছু বলতে নিলে প্রিয়তা হাত উঁচু করে বলল, ‘আমার কথা শেষ হয়নি। চট্টগ্রাম যে আপনি আমাকে নিজের মর্জিতে আনতে গেছেন তাও কিন্তু না। আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসার পর একটা কল অবধি করেন নি। খোঁজও নেননি মেয়েটা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। বারো দিন। টানা বারোদিন পর গিয়েছিলেন আপনি আমার কাছে। তাও বাবার আদেশে। যদি উনি আদেশ না দিতেন তাহলে? তাহলেতো আজও আমি ঐ চট্টগ্রামেই থাকতাম আর আপনি গুলশান। না এই বিয়ে হতো আর না সম্পর্ক। তাহলে এটাই দাঁড়ালো যে আমার বিয়েটাও বাবার আদেশে হচ্ছে? বাবাকে আমি সম্মান করি। কিন্তু কাল যদি উনি আবার বলেন প্রিয়তাকে ছেড়ে দাও। আপনি নিশ্চয়ই তাই করবেন? বাবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, আমার জীবনটাতো কারো আদেশের ভিত্তিতেও চলতে পারেনা তাইনা? এবার আপনি বলুন এইসবকিছু ভুলে আমি কীকরে আপনাকে বিশ্বাস করব? আমাদের সম্পর্কটা শুরু করব?’

রুদ্র তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। এতক্ষণ বুকের ওপর হাত ভাজ শুনছিল কথাগুলো। কথা শেষ হতেই একটানে প্রিয়তাকে নিজের কাছে টেনে বলল, ‘ইউ নো হোয়াট প্রিয়? বাবার পরে এই প্রথম কেউ আমার সামনে দাঁড়িয়ে এতোগুলো কথা বলল আর আমি চুপচাপ শুনলাম। এর আগে সবসময় আমি বলতাম লোকে শুনতো। আজ অবধি আমার সামনে দাঁড়িয়ে নির্দিধায় এতো কথা বলার সাহসই হয়নি কারো। এই জন্যেই তুমি আমার জন্যে পার্ফেক্ট। আমার যোগ্য সহধর্মিনী।’

প্রিয়তা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। রুদ্র কৌতুক ছেড়ে গম্ভীর হলো এবার। প্রিয়তার দুই বাহুতে ভরসার হাত রেখে বলল, ‘আমার বাবাকে তুমি এখনো চেনোনি প্রিয়। তুমি কীকরে চিনবে? ওনার সন্তান হয়েও এখনো পুরোপুরি চিনে উঠতে পারিনি আমি ওনাকে। চেনার চেষ্টাও করিনা। কিছু মানুষকে পুরোটা বুঝতে ইচ্ছে করেনা। ঐ না বোঝার মধ্যেও আলাদা তৃপ্তি আছে। তবে যেটুকুই চিনেছি তাতে একটা কথা তোমাকে দিতে পারি। উনি তোমাকে নিজের মেয়ে বলেছেন। আর উনি একবার যা বলেন সেই কথা থেকে কেউ কোনদিন ওনাকে টলাতে পারেনা। সুতরাং যেই মুহূর্তে উনি তোমাকে মেয়ে বলেছে সেই মুহূর্ত থেকে যদি পৃথিবীর উল্টেও যায়, তোমার সাথে যদি আমার বিয়ে নাও হয়, তবুও তুমি ওনার মেয়ে। ওনার শেষ নিঃশ্বাস অবধি তাই থাকবে। মানুষ হিসেবে উনি যেমনই হোক, নিজের মেয়ের কোন ক্ষতি উনি করবেন না।’

প্রিয়তা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। রুদ্র একটু থেমে বলল, ‘আর রইল আমার কথা? আমি তোমার সুরক্ষার চিন্তা করেই তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ভালো থাকতে পারিনি। তাই হয়তো বাবা সেই অসম্ভব আদেশটা করেছেন। আমার জীবনযাত্রা কেমন তোমার ধারণা নেই প্রিয়তা। করা সম্ভবও না। আমি একজন ক্রিমিনাল তুমি জানো। কিন্তু এটা জানোনা যে আমি এমন একজন ক্রিমিনাল যাকে বাগে পাওয়ার জন্যে গোটা দেশের প্রশাসন অবধি ওত পেতে রয়েছে। ক্ষমতাধর একাধিক আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক যার লা’শ ফেলার জন্যে ছটফট করছে। এরচেয়ে বেশি কিছু তোমাকে বলতে পারছিনা। এরকম জীবনে তোমাকে জড়াতে চাইনি আমি। কিন্তু এখন আমার তোমাকে চাই। আর আমি চাই মানে সেটা আমার। তুমিও আমার প্রিয়। সরি টু সে, এক্ষেত্রে তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম আমি দিতে পারছিনা। এতোগুলো কথা বললাম কারণ দুদিন পরেই আমাদের বিয়ে। এইটুকু জানার অধিকার তোমার আছে। আমি_’

প্রিয়তা হঠাৎই জাপটে ধরলো রুদ্রকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।রুদ্র অবাক হলো। বাতাসের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। শো শো আওয়াজ কানে লাগছে। প্রিয়তা কান্নামাখা গলায় বলল, ‘আমি যাদেরকে ভালোবাসি সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমার বাবা-মাকে খুব ভালো বাসতাম আমি, খুব। কিন্তু মা চলে গেল। শুধুই বাবাই ছিল। কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর বাবাটাও কেমন পর হয়ে গেল। আরেকজনকে বিয়ে করে নিয়ে এলো। আমার চেনা বাবা হারিয়ে গেল। অচেনা হয়ে গেল। যেই বাবা আমার গায়ে ফুলের টোকাও দেয়নি সে আমার গায়ে হাতও তুলতে শুরু করল। আমি হতবাক হয়ে দেখলাম আমার চেনা পৃথিবীটা কেমন অচেনা হয়ে গেল। চোখে পরে রাখা রঙিন চশমাটা ভেঙ্গে গেল। ভেবেছিলাম নতুন মায়ের কাছে হয়তো ভালোবাসা পাব। কিন্তু, কিন্তু সে তো আমার বাবাকেই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল। আমাকে ফেলে রেখে চলে গেল ওরা। একবার ভাবলোও না আমার কী হবে। তখন বুঝেছিলাম এই বিশাল পৃথিবীতে আমি কতটা একা।’
প্রিয়তার হিঁচকি উঠল। রুদ্র প্রিয়তার পিঠে হাত রেখে বলল, ‘প্রিয়?’

প্রিয়তা থামল না। বলে চলেছে ও, ‘স্কুলে থাকাকালীন একজনকে ভালো লেগেছিল। আমার সাথে বন্ধুর মতো থাকতো। আমার সব আবদার পূরণ করতো। আমার নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সঙ্গী ছিল সে। কিন্তু একদিন শুনলাম রাস্তা পাড় হতে গিয়ে বাসের নিচে পড়ে_’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৬

প্রিয়তার কান্নার বেগ বাড়ল। পুরোনো ক্ষত তাজা হয়ে উঠল। তবুও থামল না ও। বলল, ‘ওও চলে গেল আমাকে ছেড়ে। তারপর কোনদিন কাউকে ভালোবাসার সাহস হয়নি। আপনাকে ভালোবেসে ফেললাম। না চাইতেও। কিন্তু আপনিও আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আর যাবেন না প্লিজ। আপনি কে, কী, আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা। কিচ্ছু জানতে চাইনা। আমার শুধু আপনাকেই চাই। কথা দিন ওদের মতো আমাকে কোনদিন ছেড়ে যাবেন না? আবার একা করে দেবেন না আমাকে।’
মেঘ জোরে গর্জন করে উঠতেই প্রিয়তার আরও শক্ত করে আকড়ে ধরল রুদ্রকে। এবার রুদ্রও দুহাতে আগলে নিল ওর প্রিয়কে। নরম কন্ঠে বলল, ‘মৃত্যু ছাড়া তোমাকে আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা, প্রিয়। কথা দিচ্ছি।’
প্রিয়তা শান্ত হলো। ভয়ানক এক বজ্রপাতের সঙ্গে শুরু হলো আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। বছরের প্রথম বর্ষণে সিক্ত হলো দুটো শরীর, মন।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৮