অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৬

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৬
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

অন্ধকার ঘর। ইলেক্ট্রেসিটি নেই। একটা মোমবাতি জ্বলছে।ঘরময় পায়চারী করছে প্রিয়তা। বারান্দার দরজাটা খোলা। ওদিকে তাকালে দূরে ঘন জঙ্গল চোখে পড়ে। মৃদু হিমশীতল বাতাস আসছে ওদিক থেকে। মোমবাতি কেঁপে কেঁপে জ্বলছে। গা’টা কেমন শিরশির করে উঠল প্রিয়তার।

দুচিন্তায় অস্হির হয়ে উঠেছে ও। রুদ্রকে ফোনে পাচ্ছেনা। ঢাকায় ঠিক কী ঘটেছে বুঝতে পারছেনা। কেউ কিছু বলছেনা ওকে। কিন্তু বুঝতে পারছে মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে। রাগে দুঃখে হব ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অপরদিকে ভীষণ চিন্তাও হচ্ছে। এতো মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে থাকা যায়!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দরজায় টোকা পড়তেই চকিতে দরজার দিকে তাকাল প্রিয়তা। রুদ্র এসেছে কি-না ভাবল। আবার টোকা পড়ল। প্রিয়তা কাঁপাকাঁপা গলায় প্রশ্ন করল, ‘কে?’
সঙ্গেসঙ্গেই দরজায় ওপাশ থেকে রঞ্জুর কন্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘ভাবি, দরজা খুলুন। আমি রঞ্জু।’
প্রিয়তা এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে দ্রুত দরজা খুলে দিল। অস্হির গলায় বলল, ‘রুদ্র?’

রঞ্জু হাত দিয়ে নাকের নিচের অংশটা মুছে বলল, ‘ভাই আপনাকে নিয়ে ঢাকা ফিরে যেতে বলেছেন। এক্ষুনি।’
প্রিয়তা বড়সর ধাক্কা খেলো। আতঙ্কে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। কোনরকমে বলল, ‘উনি কোথায়?’
‘আমি জানিনা।’ বলার সময় খানিকটা ইতস্তত করল রঞ্জু।

‘কখন বলেছেন?’
‘আমি ভাইয়ের ফোন পেয়েই ছুটে এসেছি।’
‘কোন বিপদ হয়েছে, রঞ্জু ভাই? সবকিছু কেমন লাগছে।
আর আপনি কক্সবাজার ছিলেন?’ প্রিয়তার কন্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগ।
রঞ্জু মাথা নিচু করে ফেলল। প্রিয়তার প্রশ্নকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিন, ভাবি। আমাদের যেতে হবে।’

প্রিয়তা কিছু ভাবতে পারল না। একহাতে মুখ চেপে ধরে দু পা পিছিয়ে গেল। রুদ্র এভাবে ওকে চলে যেতে বলেছে। তারমানে নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। প্রিয়তা দ্বিধায় ভুগল। মন সায় দিলোনা রুদ্রকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু প্রিয়তা জানে ও রাজি না হলে ওকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হবে।

সেরকম নির্দেশনা অবশ্যই দিয়েছে রুদ্র। আর রুদ্র এখন কোথায়, কীভাবে আছে তার কোন সঠিক উত্তর রঞ্জুর কাছ থেকে পাওয়া যাবেনা। প্রিয়তা কয়েক সেকেন্ড কিছু চিন্তা করল। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আপনি বাইরে দাঁড়ান। আমি দু’মিনিটে চেঞ্জ করে আসছি।’
পাঁচ মিনিট পর তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। রঞ্জু আর অপেক্ষা করল না। প্রিয়তা আর বাকি লোকদের নিয়ে কক্সবাজার ত্যাগ করল।

কুহুর জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হলো। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই বুঝতে পারেনি কুহু। হঠাৎ নিজেকে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় আবিষ্কার করে চমকে উঠল। ধরধরিয়ে উঠে বসতে গিয়ে উপলব্ধি করল ওর হাত বাঁধা। গালে ঠোঁটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করল। ব্যথায় চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেল মেয়েটার।

আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। ভার্সিটির পুকুরপাড়ে কারো নাকে কাপড় চেপে ধরা। জ্ঞান হারানো। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে এখানে আবিষ্কার করা। সেই ভয়ংকর লোকগুলো। ও বের হতে চাইছিল বলে কী জঘন্যভাবে মারল ওকে। চড়গুলোর কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠল কুহু। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছে বেচারী। মারার পর জ্ঞান হারানোর আগে একটুখানি পানি খাইয়েছিল কেবল।

আওয়াজ করেই দুজন ছেলে ঢুকল ভেতরে। কুহুর জ্ঞান ফিরেছে দেখে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হাসি দিল। একজন বলল, ‘খুকির জ্ঞান ফিরেছে। খবর দে ভাইকে।’
কুহু ভয়ে গুটিয়ে আছে। এরা কারা, ওকে কেন ধরে নিয়ে এসেছে, কেন মারছে কিছুই জানেনা। মার খাওয়ার পর ভয়ে আর ছোটাছুটি করার সাহও পাচ্ছেনা। গুটিয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে কেবল। আমের ভিলার সবার কথা মনে পড়ছে। রাশেদের কথা, রুদ্রর কথা, উচ্ছ্বাস, প্রিয়তা, জ্যোতি সবার কথা। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর।

শান কাছেই ছিল। ফোন করার দুই মিনিটের মধ্যেই এসে হাজির হলো। ভেতরে এসে গুটিয়ে বসে থাকা কুহুকে দেখে মৃদু হাসল। জুতোয় আওয়াজ করে এক পা, এক পা করে এগিয়ে এলো। এক হাঁটু ভেঙ্গে বসল কুহুর সামনে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেল কুহুর। এরকম অভিজ্ঞতা এর আগে কোনদিন হয়নি ওর।

জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে কেন ওর সাথে এরকম করছে এরা? কেন আটকে রেখেছে ওকে। কিন্তু ওতো কথা বলতে পারেনা। জানা-অজানা আশঙ্কায় আরও গুটিয়ে বসল। মিশে রইল দেয়ালের সাথে। ইচ্ছে হল দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে। শান বলল, ‘ভয় লাগছে, সুন্দরী?’

কুহু অসহায়, ভীত চোখে তাকাল শানের দিকে। হাত মুচড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। উল্টে ব্যথা পেয়ে কেঁদে ফেলল। শান চুঁ চুঁ আওয়াজ করে কৃত্রিম সহানুভূতি দেখাল। মাথা নেড়ে বলল, ‘তোমার জন্যে সত্যি মায়া হচ্ছে আমার। দিব্যি ছিলে নিজের পড়াশোনা, ভার্সিটি, ফ্যামলি নিয়ে। সহজ, সরল স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু রাশেদ আমেরের মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই তোমার কাল হলো জানো?’

কুহু কিছু বুঝল না। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। শান বলল, ‘তোমার বাবা আমাদের পেটে লাথি মেরে, নিজের সম্রাজ্য তৈরী করেছিল। আর তুমি ছিলে সেই রাজ্যের রাজকুমারী। এখন রাজ্যও আমাদের হাতে আর রাজকুমারীও। তোমার বাবার আসল পরিচয় জানো?’

কুহু বোকার মতো তাকিয়ে রইল কেবল। শান বলল, ‘ক্রিমিনাল। বর্তমানে দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে বড় ক্রিমিনাল। এক্চুয়ালি, ছিল বলা যায়। কারণ এখন ওনার কাছে না কোন পাওয়ার আছে আর না ক্ষমতা। তোমাকে বাঁচাতেই সব ছেড়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক।’

কুহুর প্রচন্ড ঘৃণা লাগল। হঠাৎই পা দিয়ে লাথি মারল শানের পেটে। মাটিতে বসে পড়ল শান। আচমকা আঘাতে হকচকিয়ে গেল। পর মুহূর্তে রাগে কেঁপে উঠল। ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল কুহুর দিকে। এগিয়ে ঠাটিয়ে একটা চড় মারল। কাত হয়ে পড়ে গেল কুহু। চুলের মুঠি টেনে ধরে বসাল শান। অপর হাতে গাল চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘একদম মেরে পুঁতে দেব, শালী! খুব তেজ না? চিনিস আমাকে?’

চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল কুহু। ব্যথায় শ্বাস আটকে এলো। ঝাড়া দিয়ে কুহুকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শান। ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি দুজনকে ডাকল। কুহুর দিকে তাকিয়ে থেকেই শক্ত কন্ঠে বলল, ‘কক্সবাজার থেকে রুদ্রর লোকগুলো ঢাকা এলেই ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ততক্ষণ নজর রাখ। ওদিকের কাজ শেষ হলে আমি এসে একে নিয়ে যাব।’

ওরা মাথা নাড়ল। শান বেরিয়ে যেতেই ছেলেদুটো একটু দূরে গিয়ে বসল। দুজনে দুটো সিগারেট জ্বালাল। মদের বোতল খুলে নিশ্চিন্তে নেশায় মত্ত হলো। কুহু সেদিকে তাকিয়ে আরও গুটিয়ে বসল। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। তেষ্টা পেয়েছে ভীষণ। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে গলা। মাথা ঝাঁকিয়ে, পা নাড়িয়ে কয়েকবার পানির জন্য অনুরোধ করল কুহু। কিন্তু ছেলেদুটো দেখতেই পেলোনা।

জঙ্গলের কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে শীতও বেড়েছে। আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসেছে শওকত, সম্রাট, করিম আল পলাশ। করিম আর পলাশের ভয় পুরোপুরি না হলেও অনেকটা কমে এসেছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে দুজনেরই। নিশ্চিন্তে বসে বসে হুইস্কি খাচ্ছে চারজন।

মাঝেমাঝে সিগারেট টানছে। এখন শুধু রুদ্রর লোকগুলো ঢাকা পৌঁছেছে তার নিশ্চয়তা চাই ওনাদের। তারপর পরবর্তী পরিকল্পনা সাজাবে। মৌনতা ভেঙ্গে পলাশ বলল, ‘বলছিলাম যে রাশেদ আমেরের মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার আগে রুদ্রকে একেবারে পঙ্গু করে ফেললে হতো না? মানে উঠে দাঁড়াবার অযোগ্য আরকি। রিস্ক কম থাকতো।’

সম্রাট মুখ দিয়ে ‘চ্যাহ’ টাইপ একটা শব্দ করল। হুইস্কির গ্লাসটা চোখের সামনে এনে এদিক–ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘একটু বেশিই ভয় পান আপনি।’
হঠাৎই নিষ্ঠুর হাসি ফুটল সম্রাটের ঠোঁটে। এক ঢোকে শেষ করে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘কিন্তু আমার কাজটা করতে ভালোই লাগবে। তবে একেবারে না। একটু একটু করে। কয়েক ধাপে। ওদের কক্সবাজার থেকে ঢাকা পৌঁছতে অনেক দেরী। ততক্ষণে_’

বাক্যটা শেষ না করেই উঠে দাঁড়াল সম্রাট। আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল, ‘যাই। প্রথম ধাপটা সেড়ে আসি। কী বলেন মীর্জা সাহেব?’
শওকত মীর্জা আমোদিত কন্ঠে বললেন, ‘যাও যাও। তবে একটা কথা মনে রেখো কিন্তু। ওর বাঁ পায়ের ওপর অধিকার শুধু আমার। ওটা আমার জন্যে ছেড়ে দাও।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে কৌতুকপূর্ণ হাসি দিল সম্রাট। সাগ্রহে এগিয়ে গেল তাঁবুর দিকে। শওকত মীর্জা হো হো করে হেসে উঠল। করিম আর পলাশও নিঃশব্দে হাসলেন।
রুদ্রর শরীর থেকে শার্ট খুলে নেওয়া হয়েছে আরও আগেই। পরনে শুধুই একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর জিন্স। এদিকে প্রচন্ড শীত। সাথে গালে অযত্নে পড়ে থাকা জখম। কিন্তু শারীরিক কষ্টটা বিন্দুমাত্র গুরুত্ব পাচ্ছেনা রুদ্রর কাছে। ওর মন-মস্তিষ্কে কেবল কুহু, প্রিয়তা, সোলার সিস্টেম ঘুরছে। কীভাবে বের হবে এখান থেকে? কুহুকে কীকরে বাঁচাবে? সবকিছু কীকরে ঠিক করবে? আর প্রিয়তা? প্রিয়তার কথা মনে পড়তেই সকালের ঘটনা ভেসে উঠল রুদ্রর মনে-

ব্রেকফাস্ট করে কফির মগ আর একটা জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল রুদ্র। সমুদ্রের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছিল নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। পরিকল্পনায় কোন ফাঁক আছে কি-না, ইত্যাদি। অনেকটা সময় পর যখন প্রিয়তার কোন সাড়া পেলোনা তখন হুশ এলো রুদ্রর। সিগারেট ফেলে ভেতরে এলো। এসে দেখল প্রিয়তা চুপচাপ বসে আছে বিছানায়। রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো। আস্তে করে ডাকল, ‘প্রিয়?’

প্রিয়তা চমকে উঠল। হকচকিয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অদ্ভুত কাজ করে বসল ও। দৌড়ে এসে রুদ্রর বুকে মুখ লুকালো। রুদ্র অবাক হলো। মৃদু হেসে প্রিয়তার পিঠে হাত রেখে বলল, ‘কী হলো?’
প্রিয়তা আরও ভালোভাবে মিশে রইল রুদ্রর সাথে। রুদ্র এবার প্রিয়তার বাহু ধরে ছাড়াল। দুই বাহুতে হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘কী?’

প্রিয়তা রুদ্রর চোখে চোখ রাখল। শুকনো ঢোক গিলল। লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘জুনিয়র রুদ্র আমের আসছে।’
রুদ্র তখনই ধরতে পারল না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্রর ডান হাত ধরল। সেটাকে টেনে নিয়ে রাখল নিজের পেটে। রুদ্র বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘সোজা_’

হঠাৎই ব্যপারটা পরিষ্কার হলো রুদ্রর কাছে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়তার পেটের দিকে। যেখানে প্রিয়তা রুদ্রর হাত চেপে ধরেছে। বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না রুদ্র। নিজেকে সামলে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘সত্যি?’
প্রিয়তার চোখ ছলছল করছে। আবেগে আপ্লুত হয়ে মাথা নাড়ল ও। রুদ্র বলল, ‘বুঝলে কীকরে?’

রুদ্রর কন্ঠে এখনো অবিশ্বাস। যেন ঘোরে আছে ও। চোখের ইশারায় টি-টেবিলে রাখা কিটটা দেখাল প্রিয়তা। নিচু কন্ঠে বলল, ‘পিরিয়ড মিস হওয়া, অসময়ে ঘুম আর কিছু লক্ষণ আগেও টের পেয়েছি। ভেবেছিলাম আগে সোজা ডাক্তার দেখাব। আপনাকে বলেছিলাম। কিন্তু তার আগেই_। এখানে আসার পর বমি ভাব, মাথা ঘোরা দেখে সন্দেহ গাঢ় হল। ঢাকা ফেরার অপেক্ষা করতে মন চাইল না। তাই সার্ভিসের মহিলাক দিয়ে ওটা আনিয়েছিলাম।’

আচমকা প্রিয়তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রুদ্র। কোন আবেগী শব্দ শোনালো না। সিনেম্যাটিক ডায়লগ বলল না। শুধু প্রিয়তার কপালে গভীর চুমু খেয়ে বলল, ‘আমার সমস্ত সুখের চাবিকাঠি তুমি প্রিয়।’
এটুকুতেই রুদ্রর বুকে কপাল ঠেকিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেছিল প্রিয়তা। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী নারী সে।

তাঁবুর ভেতরে কারো আসার আওয়াজে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো রুদ্র। সম্রাট এসেছে। হাতে সেই সিমেন্টের খুঁটি। দুজনের চোখাচোখি হলো। রুদ্রর সামনে দাঁড়িয়ে সম্রাট সকৌতুকে বলল, ‘এখন কেমন বোধ করছো রুদ্র? সব ঠিক?’
রুদ্র কিছু বলল না।

পলকহীন চোকে একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে রইল সম্রাটের দিকে। খুঁটিটা নাড়াতে নাড়াতে রুদ্রর সামনে দিয়ে হাঁটছে সম্রাট। ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতার পর সম্রাট বলল, ‘এমনিতেতো খুব শক্ত শক্ত ডায়লগ ঝাড়ো। আজ কী হল? কাম অন! রুদ্র আমেরকে এতো শান্ত, চুপচাপ মানায় না।’

রুদ্র চুপ। সম্রাট এবার দাঁড়াল। হালকা ঝুঁকে বলল, ‘শুনলাম তোর বউ নাকি প্রেগনেন্ট। ফোনেতো তাই বললি।’
রুদ্র এবার হিংস্র বাঘের মতো তাকাল সম্রাটের দিকে। সম্রাট আরেকটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তা ঘটনাটা ঘটতে এতো দেরী হলো কেন? দম কম কার ছিল? তোর না তোর বউয়ের?’

শরীর ঝাড়া দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল রুদ্র। শিকলের ঝনঝন আওয়াজ হল। প্রচন্ড রাগে অশ্রাব্য ভাষায় কয়েকটা গালি দিয়ে রুদ্র বলল, ‘যদি বাপের ছেলে হয়ে থাকিস হাত খুলে দিয়ে কথা বল ইউ ব্লাডি বা’স্টা’র্ড।’
এইটুকুই চাইছিল সম্রাট। যে আগুন ও জ্বালাতে চাইছে তার জন্যে একটু বারুদ দরকার ছিল। সেটা সে পেয়ে গেছে।

রুদ্রর গালিতে রেগেও গেছে ভয়ানক। হিংস্র গর্জন করে সিমেন্টের খুঁটিটা দিয়ে রুদ্রর ঘাড়ে আঘাত করল সম্রাট। আঘাতটা সামলে ওঠার আগেই পাঁজরে পরপর দুটো গুতো মারল। সর্বশক্তি দিয়ে। লম্বা একটা শ্বাস ফেলার অবসর পেলো রুদ্র। তারপরই নিষ্ঠুরভাবে আঘাতের পর আঘাত করে চলল সম্রাট।

লাথিও চালালো সমানতালে। শেষ আঘাতটা মাথার ডানপাশে করল সম্রাট। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এলো রুদ্রর। চেষ্টা করেও বসে থাকতে পারল না। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। লম্বা প্রশ্বাসের সঙ্গে খানিকটা ধুলো ঢুকলো নাকে। শুকনো দুটো কাশি বেরিয়ে এলো। শেষ আরেকটা লাথি মেরে রাগে গজগজ করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল সম্রাট। এদিকে জ্ঞান না হারালেও ব্যথায়, ক্লান্তিতে চোখ বুজে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে রইল রুদ্র আমের।
*
ছেলেদুটোর নাম সেন্টু আর বু’লে’ট। শান অনেক্ষণ হলো গেছে। এখনো আসেনি। এদিকে বেশ ভালো নেশা চড়ে গেছে সেন্টু আর বুলেটের। মোটামুটি টলছে দুজন। অলস ভঙ্গিতে মাঝেমাঝে বোতলে চুমুক দিচ্ছে। সিগারেটে ফুঁকতে ফুঁকতে আড়চোখে তাকাচ্ছে কুহুর দিকে।

একপাশে কাত হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে কুহু। চোখ বন্ধ। কার্নিস বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুর দাগ বোঝা যাচ্ছে। ভীষণ ক্লান্ত।

আধঘন্টা যাবত কহুকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ওদের মধ্যে। নারীলোলুপ নেকড়ের দৃষ্টি থেকে তো ছোট্ট শিশুও রেহাই পায়না। সেখানে কুহুর নিষ্পাপ, আহত মুখ ওকে বাঁচাবে সেটা ভাবা বোকামি। এতক্ষণ বসের অর্ডার আর বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক বিষয় বিবেচনা করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখলেও এবার ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ওরা। মদের নেশা, আর লালসার মিশ্রনে ভেতরের পশু পুরোপুরি জেগে উঠছে। কিছুক্ষণ পর সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসল। নেশায় মত্ত সেন্টু বলল, ‘কী বলিস ভাই? যাবি?’

বু’লে’ট লোভাতুর দৃষ্টিতে আগাগোড়া দেখল কুহুকে। বলল, ‘কিন্তু বস?’
‘আরে আমরা ওকে মেরে ফেলছি না-কি? আর বসের কাছে জীবিত দিলেইতো হলো। রাশেদ আমেরের মেয়ের কী হলো না হলো তাতে ওনাদের মনে হয়না কিছু যায় আসবে। এমন চান্স বারবার আসেনা, ভাই।’
‘ঠিক বলেছিস। এমন চান্স বারবার আসবেনা।’ বলে বিশ্রী হাসি দিল বুলেট।

আরও কয়েক চুমুক মদ গিলে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল দুজন। টলমলে পায়েই এগিয়ে গেল কুহুর কাছে। দুজনে দুপাশে বসল। কুহু সজ্ঞানে ছিল। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে চোখ খুলল। ভয়ার্ত চোখে নিজের দুপাশে তাকাল। ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেন্টু ওর দুটো পা একসাথে চেপে ধরল। বু’লে’ট দুই কাঁধ চেপে ধরে জোর করে শুইয়ে দিল।

এক টানে কুহুর ওড়নাটা শরীর থেকে টেনে নিল।সেফটিপিন দিয়ে আটকানো ছিল বিধায় কামিজের অনেকটা অংশ ছিড়ে এলো। মাতাল পশুদুটো পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। নোংরা লালসায় চোখদুটো চকচক করছে। নিজেদের মধ্যকার সর্বোচ্চ পাশবিকতা প্রদর্শন করছে আজ। কুহু প্রাণপনে ছটফট করছে।

হাত বাঁধা থাকার পরেও ওকে কাবু করতে বেগ পেতে হচ্ছে সেন্টু আর বু’লে’টকে। রেগে গিয়ে দু গালে পরপর আরও কয়েকটা চড় মারল বু’লে’ট। চেপে ধরল ফ্লোরের সাথে। ক্ষুদায়, তৃষ্ণায়, ক্লান্তিতে জর্জরিত কুহুর শক্তি বেশিক্ষণ টিকল না। বাধ্য হয়েই আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ল।

ওর চোখে দেখা সুন্দর দুনিয়ার বিষাক্ততা হঠাৎই আজ উপলব্ধি করল। ওর না দেখা জগতের অন্ধকার ঠিক কতটা গভীর সেটা আজ জানল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছা করল কুহুর। কষ্ট যন্ত্রণায় সারা শরীর যেন ঝলসে গেল। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল করুণ আর্তনাদ। বার কয়েক কেঁপে উঠল কুহু। নিঃশ্বাস নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।

তৃষ্ণায় গলা ফেটে যাচ্ছে। একটু পানির জন্যে মুখ ফাঁক করে ঘনঘন শ্বাস নিল। চোখের সামনে সবকিছুই অন্ধকার মনে হলো। রাশেদের বুকে গিয়ে লুকোতে ইচ্ছা হলো ওর। রুদ্রর কাছে ঠোঁট ফুলিয়ে হাজার অভিযোগ করতে ইচ্ছে হলো পৃথিবীর নামে। প্রিয়তা, উচ্ছ্বাস, জ্যোতিকে জানাতে ইচ্ছে হলো ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। নীরব। নীরবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করল, ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। আমি তোমার। শুধুই তোমার।

একসঙ্গেই তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করল শওকত, করিম, পলাশ আর সম্রাট। রুদ্র তখনও উপুড় হয়ে পড়ে আছে। স্যান্ডো গেঞ্জিটার একাংশ ছিড়ে গেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গা রক্ত জমাট বাঁধা লালচে দাগ। কোন কোন জায়গা ফেঁটে র’ক্ত ঝড়ছে। মুখের ডানপাশে কপাল থেকে শুরু করে চিবুক বেয়ে গলার নিচ পর্যন্ত র’ক্তে লাল হয়ে আছে।

গেঞ্জির কিছুটা অংশ ভিজে গেছে রক্তে। মৃদু কাশি দিচ্ছে রুদ্র। সম্রাট এসে রুদ্রর চুলের মুঠি ধরল। মুঠি ধরেই সোজা করে বসালো। রুদ্র চোখ মেলে তাকিয়ে দুটো কাশি দিল। বস্তায় হেলান দিয়ে তাকাল ওদের দিকে। এবার শওকত নিজেই এগিয়ে এলো। রুদ্রর সামনে বসল। রুদ্র ক্লান্ত গলায় বলল, ‘কুহু কোথায়?’

‘আছে। নিরাপদেই আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার লোক ঢাকা প‍ৌঁছে যাবে। আর কুহুকেও ছেড়ে দেওয়া হবে।’
রুদ্র কিছু বলল না। শওকতও কোনরকম কথা না বাড়িয়ে রুদ্রর বাঁ পায়ে হাত বুলালো। চোখে ব্যঙ্গ, কৌতুক ঝিলিক দিচ্ছে তার। মুখে হাসি ধরে রেখে পা টা খানিকটা শূণ্যে তুলে নিলেন। রুদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শওকত সস্নেহে পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে নরম গলায় বলল, ‘লোহার ধারাল চাকাগুলো যখন ঘ্যাচঘ্যাচ করে পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায় তখন কেমন লাগে জানো রুদ্র?’

রুদ্র জবাব দিলোনা। তাকিয়ে রইল কেবল। হঠাৎই স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে রুদ্রর পায়ে আঘাত করল শওকত। ড্রাইভারটা ঢুকে পুরো হাড়ে গিয়ে ঠেকল। চেঁচিয়ে উঠল রুদ্র। ব্যথায় নীল হয়ে গেল চেহারা। আকস্মিক এই আঘাতটা আশা করেনি ও। শওকতের মুখে হিংস্র হাসি।

রুদ্র হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ড্রাইভার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নির্মমভাবে পা থেকে বের করল শওকত। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা সহ্য করল রুদ্র। কিন্তু চোখ-মুখ লালচে রঙ ধারণ করেছে। এভাবে পরপর তিনবার আঘাত করল।

পরেরবারগুলোতে রুদ্র চেঁচাল না। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে সহ্য করল। বাচ্চা ছেলের খেলে মন ভরে গেলে যেভাবে খেলনা ফেলে দেয়। সেভাবেই স্ক্রু ড্রাইভার ফেলে দিল শওকত। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুধু মাংস ফুটো হলে কী আর মন ভরে? হাড় ফুটো হলে তবেই না শান্তি।’

ইশারা করতে একটা ব্যাটরি নিয়ন্ত্রিত ড্রিল মেশিন আনা হলো। শওকত মেশিনটা হাতে নিয়ে বলল, ‘এবার খেলাটা জমবে। তাইনা রুদ্র?’

রুদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেশিনটার দিকে। একটুও যে ভয় লাগছেনা তা নয়। কিন্তু এখন ওর কিছু করারও নেই। উপায় না পেয়ে চুপচাপ বসে রইল। ইতিমধ্যে বাঁ পাটা র’ক্তে ভিজে গেছে। রুদ্রর পায়ের পাতা টেনে ধরল শওকত। দেঁতো হেসে বলল, ‘এখান থেকে শুরু করি। কী বল?’

বলে মেশিনটা চালু করল। রুদ্র নিজের সমস্ত ইচ্ছাশক্তি একত্রিত করে নিজেকে প্রস্তুত করল এই ভয়ানক যন্ত্রণা সহ্য করার জন্যে। কিন্তু মেশিনটা রুদ্রর পায়ে ছোঁয়ানোর আগেই শওকতের ফোন বেজে উঠল। আনন্দ উৎসবে ব্যঘাত ঘটায় বিরক্ত হলো শওকত। মেশিনটা রেখে ফোন বের করে দেখলেন শানের ফোন। দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। একটু সরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে বললেন, ‘ হ্যাঁ বল।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৫

যা শুনলো তাতে চমকে উঠল শওকত। কথা না বাড়িয়ে সবাইকে ইশারা করে বেরিয়ে গেলেন তাঁবু থেকে। বাকিরাও কিছু বুঝতে পা পেরে দ্রুত বেরিয়ে গেল জঘন্যভাবে আহত, রুদ্রকে তাঁবুকে একা ফেলে। চোখ বন্ধ করে শরীর ছেড়ে দিল রুদ্র। আপাতত কিছু চিন্তা করার মতো অবস্থা ওর নেই।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৭