অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৫

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৫
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

সকালটা অদ্ভুত শান্ত। বেলা প্রায় দশটা বাজতে চলল। এখনো সূর্যের দেখা মেলেনি। ঘন কুয়াশা আর ধূসর মেঘ আড়াল করে রেখছে সূর্যকে। মনে হচ্ছে আজ কুয়াশা কাটবে না। মেঘ সরবে না। সূর্য যেন নিজেও ভয় পেয়েছে আজ। তার সব তেজ নিভে গেছে। ভয়ে, আতঙ্কে মেঘের পিঠে লুকিয়ে আছে। প্রকৃতিও মুষড়ে পড়েছে। যেন ওরাও বুঝে গেছে, ভয়ংকর কিছু ঘটবে আজ। খুব ভয়ংকর।

আমের ভিলা। সোফায় বসে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন রাশেদ। তবে আজ খবরে মনোযোগ নেই। একটা শব্দও বোধ হয় পড়ে দেখছেন না। জাফর এসে বসল তার পাশে। কিছু বলল না। একটা ম্যাগাজিন মেলে ধরল চোখের সামনে। কিছুক্ষণ সেটাতে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘আপনাকে কেমন লাগছে, ভাইজান। কিছু হয়েছে?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাশেদ জবাব দিলেন না। পরের পৃষ্ঠা ওল্টালেন। জ্যোতি দুজনের জন্যে চা নিয়ে এলো। চায়ের কাপ টি-টেবিলে রাখতে রাখতে তাকাল রাশেদের দিকে। লক্ষ্য করল সত্যিই কেমন লাগছে আজ রাশেদকে। ও নিচু কন্ঠে বলল, ‘ঔষধ খেয়েছেন?’
রাশেদ মুখ তুলে তাকাল। কপাল কুঁচকে ভাবল একটু। তারপর বলল, ‘না। খাওয়া হয়নি। নিয়ে আয় যা।’

জ্যোতি হতাশ শ্বাস ফেলল। পা বাড়াল রাশেদের রুমের দিকে। প্রিয়তা বাড়িতে না থাকলেই এই লোকের রুটিনের বারোটা বেজে যায়। জাফর খানিক হেসে বলল, ‘একটা কথা কিন্তু মানতেই হচ্ছে, ভাইজান। প্রিয়তা মেয়েটা বাড়ির প্রাণ হয়ে গেছে। কয়েকটা দিন বাড়িতে নেই। সব কেমন পানসে লাগে।’

রাশেদ মৃদু হাসলেন। খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে কোন পরিবার পায়নিতো। একটা ভরাট পরিবার পেয়ে সবটা দিয়ে আকড়ে ধরেছে। তারচেয়েও বড় কথা রুদ্র। রুদ্রর প্রতি ও ভয়ানক দুর্বল। আর ভালোবেসে মানুষ সব করতে পারে।’

জাফর হাসল। ততক্ষণে জ্যোতি চলে এলো ঔষধ নিয়ে। পেছন পেছন উচ্ছ্বাসও এলো। রাশেদ আর জাফরকে সালাম দিলো। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বসল সোফায়। জ্যোতি বলল, ‘তোমায় কফি দেব?’
উচ্ছ্বাস লম্বা একটা হাই তুলল। পানসে গলায় বলল, ‘নাহ, চা-ই দে। বউমনির হাতের কফি না খেলে মনেই হয়না কিছু খেয়েছি। সকালটাই পানসে লাগে।’

জ্যোতি কিছু না বলে উচ্ছ্বাসের জন্যে চা আনতে গেল। এরমধ্যে কুহুও একেবারে তৈরী হয়ে নিচে নামল। কুহুকে দেখে মৃদু হাসলেন রাশেদ। হাত বাড়িয়ে ডাকলেন নিজের কাছে। কুহু গিয়ে রাশেদের পাশে বসল। রাশেদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘শুভ জন্মদিন মা।’

জাফরও জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল। কুহু মিষ্টি করে হাসল। হাত দিয়ে লাভ শেপ বানিয়ে দেখাল দুজনকে। তারপর গিয়ে বসল উচ্ছ্বাসের পাশে। উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে হাত পেতে ভ্রু নাচাল। উচ্ছ্বাসের সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে দেখল কুহুকে। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘বার্থডে গিফটের জন্যে ডেসপারেটলি অপেক্ষা করতে জীবনে অনেককে দেখেছি। কিন্তু এতো ডেসপারেটলি বার্থডে গিফট চাইতে শুধু তোকেই দেখি। হ্যাংলা মাইয়া।’

কুহু গাল ফোলালো। অভিমানী চোখে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। হাত ভাঁজ করে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। উচ্ছ্বাস ঠোঁট চেপে হাসল। একটা না, কয়েক রকমের ড্রয়িং সেট কিনে রেখেছে কুহুর জন্যে। আজ বাড়ি ফিরলে ওগুলো দিয়ে চমকে দেবে বোনকে।

চা খেয়ে ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্য উঠে দাঁড়াল কুহু। রাশেদ এতক্ষণে খেয়াল করলেন কুহু ব্যাগ নিয়ে নেমেছে। রাশেদ পেপার নামিয়ে রেখে বললেন, ‘ভার্সিটি যাচ্ছো নাকি?’
কুহু মাথা নাড়ল। রাশেদ জাফরের দিকে একপলক তাকালেন। খানিকটা শক্ত গলায় বললেন, ‘আজ কোথাও যেতে হবেনা। বাড়িতেই থাকো।’

কুহুর মুখ কালো হয়ে গেল। অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল জ্যোতির দিকে। একমাত্র জ্যোতিকেই বলেছে আজ নীরবের সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যাবে। জ্যোতি কিছু বলবে তার আগেই রাশেদ বললেন, ‘জ্যোতিরও আজ অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে থাক।’

জ্যোতি কিছু বলতেই যাচ্ছিল। কিন্তু রাশেদের কথায় চুপ হয়ে গেল। বুঝতে পারল ব্যপারটা সিরিয়াস। উচ্ছ্বাস নিজেও ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে। রাশেদ বললেন, ‘আজতো নীরব আসছে শুনলাম। ওকে বাড়িতে ডেকে নেব আমি।’
কুহু ঠোঁট উল্টে সবার দিকে একবার তাকাল। রাশেদ নির্বিকারভাবে আবার পেপার পড়ায় মনোযোগ দিয়েছেন। কুহু রাশেদের সামনে গিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসল। রাশেদ পুনরায় চোখ তুলে তাকাল। কুহু ইশারায় বলল, ‘আজ আমার পরীক্ষা আছে।’

রাশেদের কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিলো। পেপারটা কোলের ওপর রেখে বললেন, ‘জরুরী পরীক্ষা?’
মাথা ঝাকাল কুহু। মিথ্যে বলল। না হলে রাশেদ যেতে দেবে না। রাশেদের চোখমুখ গম্ভীর হল। আরও কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর নিজের ফোনটা বের করলেন। কাউকে ফোন করে বললেন, ‘তৈরী হয়ে বাড়ির সামনে এসো। কুহুর সাথে আজ তোমরাও যাবে।’

কুহুসহ বাকি সবাই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাশেদ ফোন রেখে কুহুকে বললেন, ‘বেশ! আজ তাহলে তোমার সাথে চারজন যাবে। আমি বলে দিয়েছি। ওরা এলেই বেরিয়ে পরো। আর গেইট থেকে সোজা ক্লাস। ক্লাস থেকে সোজা গেইটে আসবে। মাঝে অন্যকোথাও যাবেনা। মনে থাকবে?’

কুহু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। রাশেদ জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোকে আজ বের হতে হবেনা। বাড়িতে থাক।’
জ্যোতি ঘাড় কাত করে সম্মতি দিল। কুহু বেশ বিরক্ত হল। এমনিতেই ঐ দুটোকে ওর সহ্য হয়না। আজ আবার আরও দুজন! তবে বের হতে পারছে এই অনেক।

উচ্ছ্বাস বা জাফর কেউই রাশেদের এমন হঠাৎ সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা বুঝল না। দশমিনিট পর লোক এসে পৌঁছলো। কুহু সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। জ্যোতিও সব গুছিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। রাশেদ কুহুর ইউনিভার্সিটিতে কয়েকটা কল করলেন। কয়েকজনের সঙ্গে বেশ গুরুত্ব দিয়ে আলাপ করলেন। রাশেদকে এতো গম্ভীর দেখে আর ধৈর্য্য ধরতে পারল না জাফর। জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যপার ভাইজান? আজ হঠাৎ ওদের বাড়ি রাখতে চাইছেন? কোন বিপদ হতে পারে?’

উচ্ছ্বাসও একই প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে। রাশেদ তখনই উত্তর দিলেন না। সময় নিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। হেলান দিলেন সোফায়। সিগারেটে তিন চারটা টান দেওয়ার পর বললেন, ‘তেমন কিছু না। রুদ্র নেই এখানে। তাই সুরক্ষার ব্যপারটা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।’
রাশেদ উত্তর দিলেন বটে। কিন্তু তার উত্তরে জাফর বা উচ্ছ্বাস কেউ সন্তুষ্ট হতে পারল না। কিন্তু পাল্টা আর কোন প্রশ্ন করার সাহসও হলোনা কারো।

কুহুর ক্লাস শেষ করতে করতে তিনটা বাজল। নীরবকে মেসেজ করে বলে দিয়েছে। সাড়ে তিনটায় ভার্সিটিতে আসবে ও। সেইরকমই কথা হয়েছে দুজনের মধ্যে। ক্যাম্পাসের পুকুরপাড়েই প্রথমে দেখা করবে দুজন। এরপর বের হতে পারবে কি-না সেটা ভাববে।

কুহুর অপেক্ষা করতে ভালোলাগেনা। তাই ক্লাস শেষে আধঘন্টা লাইব্রেরীতে কাটাল। ঠিক সাড়ে তিনটায় বেরিয়ে এলো ক্যাম্পাস থেকে। পুকুরপাড়টায় এইসময় লোকজন কম থাকে। তবে আজ একটু বেশিই ফাঁকা। আজ সারাদিনে সূর্য দেখা যায়নি। তারওপর গাছে ঘেরা জায়গা। কেমন এক থমথমে ভাব।

নীরবকে দেখতে না পেয়ে একটু অবাক হল কুহু। ইতিমধ্যে তিনটা চল্লিশ বেজে গেছে। হিসেব মতো এতক্ষণে ওর চলে আসার কথা। কুহুকে দেখার জন্যে ছটফট করছিল ছেলেটা। কুহুর ভেতরেও ছটফটানি বেড়ে চলেছে। প্রায় দুবছর পর প্রিয় মানুষটাকে দেখবে। ধৈর্য্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হলোনা কুহুর। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে নীরবকে মেসেজ করল, ‘কোথায় আপনি?’

মেসেজ পাঠানোর পর দু মিনিট কেটে গেলো। কোন রিপ্লে এলোনা। কুহু ভাবল একটা কল করে দেখবে কি-না। ভাবার মাঝেই পেছন থেকে কেউ হাত রাখল ওর কাঁধে। নীরব এসেছে ভেবে খুশি হয়ে পেছন ঘুরতে যাচ্ছিল কুহু। কিন্তু পেছন ঘুরে কিছু দেখার আগেই কেউ একটা রুমাল চেপে ধরল ওর মুখে। আরেক হাত দিয়ে জাপটে ধরল কুহুর শরীর। যাতে নড়াচড়া করতে না পারে। নাকে উট্কো ঝাঝালো গন্ধ অনুভব করল কুহু। ছটফট করল। সর্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করল মুক্ত হওয়ার। কিন্তু কিছু সেকেন্ডের মধ্যেই কুহুর শরীর ছেড়ে দিল। সবকিছু ঝাপসা লাগল। তলিয়ে গেল গভীর অন্ধকারে।

দিনের আলো ফুরিয়েছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করছে চারপাশ। কুহু নিখোঁজ। চারটার দিকে গার্ডরা নীরবকে ভেতরে ঢুকতে দেখে। নীরব বলেছিল আধঘন্টা অপেক্ষা করতে। সাড়ে চারটার দিকে কুহুকে নিয়ে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু নীরব বেরিয়ে আসে বিশ মিনিটের মধ্যেই। একা। হাপাতে হাপাতে। ভীত কন্ঠে জানায় কুহু সারা ক্যাম্পাসে কোথাও নেই। তারপর থেকেই পাগলের মতো খোঁজা হচ্ছে কুহুকে। কিন্তু কুহুর চিহ্নও পাওয়া গেল না কোথাও। গার্ডরাও কেউ কুহুকে বের হতে দেখেনি। সামনে বা পেছনের কোন গেইট দিয়েই না। প্লশ্ন তাহলে মেয়েটা গেল কোথায়?

আমের ভিলার সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন রাশেদ। গা ছেড়ে দিয়েছেন। কপালে গভীর চিন্তার রেখা। জাফর পায়চারী করছে ঘরময়। ব্যস্ত আছে তার হাতে ধরে রাখা ফোন। এক ঘন্টা যাবত টানা কল যাওয়া আসা চলছে। তারসঙ্গে বাড়ছে উত্তেজনা। এরমধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে এসে ঢুকল উচ্ছ্বাস। সবাই নড়েচড়ে উঠল। কোন ভালো খবরের আশায়। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে উচ্ছ্বাস বলল, ‘সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজা হয়ে গেছে। আমাদের চেনাজানা ওদের সব ডেরায় দেখেছি। সব জায়গায় খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে। কুহু কোথাও নেই।’

রাশেদ কিছু বললেন না। একইভাবে বসে রইলেন চুপচাপ। নীরব দশ মিনিট হল বাইরে থেকে এসেছে। ক্লান্ত, অসহায়তা মানুষের মতো দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। উচ্ছ্বাসের কথা শুনে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কাঁপা গলায় বলল, ‘কা-কারা? কাদের কথা বলছেন আপনারা?’
উচ্ছ্বাস জবাব দিলোনা। এখন এতোকিছু ব্যখ্যা করার সময় নেই। উল্টে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কখন গিয়েছিলে ক্যাম্পাসে?’

‘চারটার সময়।’ কান্নায় ভেঙ্গে আসতে চাইছে নীরবের গলা।
‘ ক’টায় যাওয়ার কথা ছিল?’
‘সাড়ে তিনটায়। যথেষ্ট সময় নিয়ে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ কিছু লোক আমার গাড়ি আটকে দাঁড়ায়। অকারণেই ভাঙচুর করে। অদ্ভুত ব্যপার গাড়িটা চলার অযোগ্য করে দিয়েই ওরা চলে যায়। ওরা কারা ছিল, কেন এসছিল আমি জানিনা।’

রাশেদ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি যে কুহুর ভার্সিটিতে যাবে সেটা কুহু ছাড়া আর কে জানতো?’
‘আমি আর কাউকে বলিনি। কিন্তু কুহু কাউকে বলেছে কি-না জানিনা।’
জ্যোতি রাশেদের পায়ের কাছে বসে ছিল। কাঁদছিল নীরবে। রাশেদের কথা শুনে চোখ মুছে বলল, ‘আমি। আমাকে বলেছিল ও।’

রাশেদ ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললেন। এইমুহূর্তে কেন ওনাকে আগে বলা হয়নি। কুহু কেন মিথ্যে বলে বের হলো। জ্যোতি বা নীরব কেন বলল না। এসব নিয়ে রাগান্বিত হওয়াটা অহেতুক। এখন এসব কথার আর কোন মানে নেই। যা হওয়ার হয়ে গেছে।

জাফর এতক্ষণে বসল। রাশেদের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল, ‘রুদ্রকে একবার জানানো উচিত এবার।’
রাশেদ স্হির কন্ঠে বললেন, ‘ওকে এখন কলে পাওয়া যাবেনা জাফর। বন্ধ পাবে। দেরী হয়ে গেছে। এখন শুধু একটাই উপায়। কুহু ঢাকার মধ্যেই আছে। দরকারে চিরুনী তল্লাশি চালাও। আমি আমার মেয়েটাকে জীবিত এবং সুস্থ চাই।’
জাফর বলল, ‘তবুও চেষ্টা করে দেখি।’

চেষ্টায় কোন লাভ হলোনা। সত্যিই রুদ্রর ফোন বন্ধ। প্রিয়তাকে ফোন করা হয়েছিল। ও জানালো, রুদ্র হোটেলে নেই। ওকে হোটেল থেকে বের করে একটা বাড়িতে নিয়ে রেখেছে। কড়া নিষেধ করেছে বের হতে। কখন ফিরে আসবে সেটাও বলেনি।
এখানকার অবস্থা প্রিয়তাকে জানায়নি কেউ। শুধু বলেছে রুদ্রকে ফোনে পেলে কিংবা ফিরে এলে যাতে দ্রুত যোগাযোগ করে।

উচ্ছ্বাস দ্রুতপদে আবার বেরিয়ে গেল। এখন নষ্ট করার মতো একটা মিনিটও নেই ওর হাতে। জ্যোতি শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। বারবার কুহুর ছেলেমানুষী, দুষ্টুমি, মিষ্টি হাসি ভেসে উঠল চোখের সামনে। মেয়েটাতো একদম নিষ্পাপ। অন্ধকার জগতের রাজকন্যা হয়েও কখনও অন্ধকারের ছায়া পড়েনি কুহুর গায়ে। রাজা আর রাজপুত্র কখনও পড়তেই দেয়নি। সমস্ত আলো দিয়ে আগলে রেখেছিল মেয়েটাকে। কিন্তু আজ কেন এরকম হল? নিষ্পাপ মেয়েটার সঙ্গে এমন অঘটন কেন ঘটল?

নীরব অসহায়ের মতো চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিচ্ছু জানেনা ও। কুহুকে কারা নিয়ে গেছে? কেন নিয়ে গেছে সবটাই ওর কাছে ধোঁয়াশা। নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ওর। ও যদি দেখা করতে না চাইতো। তাহলে হয়তো এমন কিছু হতোনা। সব ঠিক থাকতো। ফোন স্ক্রিনটা অন করে কুহুর শেষ মেসেজটা দেখল নীরব। “কোথায় আপনি?”। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো নীরবের। দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকালো। মনেপ্রাণে প্রার্থনা করল মেয়েটার যেন কোন ক্ষতি না হয়।

শহুরে জনবহুল অঞ্চলের বাইরে একটা গোডাউনের সামনে গাড়ি থামাল শান মীর্জা। বেশ পুরোনো একটা গোডাউন। পরিত্যক্ত। সবকিছুই পুরোনো। ধসা দেওয়াল। পুরোনো, ধুলোমাখা কিছু মালপত্রে ভর্তি। দরজার কাছে আসতেই দুজন লোক এগিয়ে এসে সালাম দিল। শান গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘মেয়েটা কোথায়?’

‘ভেতরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, ভাই।’
শান ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এখনো জ্ঞান ফেরেনি?’
‘ফিরেছিল। হাত পা ছোড়াছুড়ি করছিল। বিরক্ত করছিল বেশি। তাই দিয়েছি কয়েকটা চড় বসিয়ে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে আবার।’

শান হালকা হাসল। ভেতরে যেতে যেতে বলল, ‘একটা বোবা মেয়েকে সামলাতে পারিস না?’
লোকগুলো কোন জবাব দিলোনা। শান ভেতরে গিয়ে দেখল। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে কুহুকে। ঠোঁটের কোণ ফেঁটে রক্ত ঝড়ছে। ডান গালে দুটো আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। ওমন নিষ্পাপ সরল মুখটার ওপর এরকম অত্যাচার দেখে সাধারণ কোন মানুষের মন খারাপ হয়ে যেত। হৃদয় দুর্বল হলে কেঁদেও ফেলতো। কিন্তু শানের মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। ও কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই ফোন বেজে উঠল। শওকত মীর্জার ফোন। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শওকত বলল, ‘কাজ হয়েছে?’

‘ হ্যাঁ। মেয়েটা এখানেই আছে। কিন্তু এই মেয়ের বাইশ বছর? দেখেতো পনেরো ষোল বছরের মনে হচ্ছে।’
শানের কথা আমলে না নিয়ে শওকত বলল, ‘ জায়গাটা নিরাপদ তো?’
‘আজ রাতের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার কোনরকম সম্ভাবনা নেই।’ মৃদু হেসে বলল শান।
‘এতেই চলবে। ওদিকটা খেয়াল রাখো আমরা এদিকটা দেখছি।’

শান ফোন রেখে ভালোভাবে একবার দেখল কুহুকে। ঠোঁটের মাঝে একটা সিগারেট চেপে ধরল। কুহুর দিকে তাকিয়ে থেকেই লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালালো। পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠল শানের ঠোঁটে। ভীষণ মজার এবং উপভোগ্য কিছু ঘটতে চলেছে যেন।

ন’টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি এখনো। সৈকত পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে গহীন জঙ্গল। ডেলিভারী দেওয়ার জন্যে মালগুলো নিয়ে নিজস্ব পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্লাইন্ট। ওরফে ছদ্মবেশী ডার্ক নাইট এবং ব্লাক হোলের লোক। তীব্র শীত। বেশ কয়েকটা মশাল বেঁধে রাখা হয়েছে গাছের সাথে। অস্বস্তিকর নীরবতা। মাঝেমাঝে পশুপাখিদের অদ্ভুত কিছু আওয়াজ ভেসে আসছে কেবল। লোকগুলো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সঠিক সময় আসার অপেক্ষা। কিন্তু ওরা কেউই জানেনা, ওরা মৃত্যুর অপেক্ষা করছে।

আর মাত্র পাঁচ মিনিট! তারপরেই দুবছর ধরে সাজানো দাবা খেলার শেষ চাল দেখার সৌভাগ্য হবে সকলের। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটতেই চাইছে না। পাঁচ মিনিটকে প্রতিটা সেকেন্ড যেন অতিরিক্ত বেশি সময় নিয়ে পাড় হচ্ছে। মাল ডেলিভারীর নির্ধারিত স্হান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ঘাঁটি গেড়েছে শওকত মীর্জা। সঙ্গে আছে করিম তাজওয়ার, সম্রাট, পলাশ। বাইরে ওদের পাহারায় দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্রধারী প্রহরী। করিম তাজওয়ার মদের গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছ আর ভাবছে। হাত-পা কেঁপে উঠছে তার। দুশ্চিন্তায় অস্হির হয়ে উঠছে। একপর্যায়ে সে অধৈর্য গলায় বলল, ‘কী মনে হয়? রুদ্র এখানে আসবে?’

সম্রাট হাঁটছিল। করিমের কথা শুনে থেমে গেল। নিজের চোয়ালে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ওকে আমি যতটুকু চিনি ও আসবে। আসতে বাধ্য।’
একটা ঢোক গিললেন করিম। পলাশও ঘাবড়ে গেছে। খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘কিন্তু ওকে না আনলে হতোনা? ও ওর কাজ সেরে চলে যেতো। তাতে তো আমাদের উদ্দেশ্য পূরণে কোন বাঁধা সৃষ্টি হতোনা। আরও সহজ হতো।’

রাগে চোখমুখ হিংস্র হয়ে উঠল সম্রাটের। তাবুর গায়ে লাথি দিয়ে বলল, ‘কাপুরুষের দল সবগুলো। এই সাহস নিয়ে সোলার সিস্টেম ধ্বংস করবে? আমার লক্ষ্য শুধুমাত্র সোলার সিস্টেমের ধ্বংস না বুঝলে? রুদ্র! রুদ্র আমেরকে নিজের হাতে খু’ন করব আমি। তিল তিল করে কষ্ট দিয়ে খু’ন করে শান্তি পায় ও তাইনা? আমি ওকে বোঝাবো তিল তিল করে কষ্ট পেয়ে মরতে কেমন লাগে।’

করিম তাজওয়ার বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ওকে সঙ্গেসঙ্গে মেরে ফেলার সুবর্ণ সুযোগ এটা সম্রাট। বোঝ। প্রতিশোধের কিছু নেই। আমরা প্রতিপক্ষ। আমরাও কম কিছু করিনি। এখনো যা করছি আন্ডারগ্রাউন্ডে টিকে থাকতে করছি। সিনেমা নয় এটা যে চোখের বদলে চোখ, পায়ের বদলে পা নিয়ে খেলব।’

সম্রাট কিছু বলার আগেই শওকত বললেন, ‘সেটা তোমার চিন্তাধারা তাজওয়ার। আর কারো কথা জানিনা। কিন্তু আমি অন্তত রুদ্রর সহজ মৃত্যু মেনে নেবনা। অনেক ব্যক্তিগত বোঝাপড়া আছে আমার ওর সঙ্গে।’
বলতে বলতে নিজের কাঠের পা-টা ছুঁয়ে দেখলেন শওকত। করিম আর পলাশ হতাশ হল। ভয়ংকর বিপদ ডাকছে এরা। রুদ্রর প্রতি সম্রাট আর শওকতের ব্যক্তিগত আক্রোশ-ই না ওদের কাল হয়। শওকতের যেমন রুদ্রর প্রতি ভয়ানক আক্রোশ আছে। তেমন সম্রাটেরও আছে। ওদের থামানো অসম্ভব।

অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সময় এসে উপস্থিত হলো। জঙ্গলের পাশের মাটির রাস্তায় দুটো ট্রাক এসে থামল। ট্রাক থেকে নেমে এলো সোলার সিস্টেমের লোক। নিয়মমাফিক মালগুলো ওদের হস্তান্তর করার জন্যে তৈরী হল ছদ্মবেশী দল। দলনেতা এগিয়ে গেলেন অপরপক্ষের দলনেতার কাছে। সোলার সিস্টেমের দলনেতা গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘পাসকোড!’

পাসকোড বলা হল। দলনেতা হাতের ইশারা করতেই মালগুলো তোলার জন্যে এগোলো সোলার সিস্টেম। কিন্তু মাল তুলল না। প্রত্যেকেই চোখের পলকে লুকোনো অস্ত্র বের করে ফায়ারিং শুরু করল। সোলার সিস্টেমের আচমকা আক্রমণে চমকে উঠল ব্লাক হোল আর ডার্ক নাইট। প্রতিহত করার খুব বেশি সুযোগ পেলোনা তারা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবাইকে ঝাঁজরা করে দিল সোলার সিস্টেম।

সাড়ে ন’টা বাজে। অসহ্য নিস্তব্ধতা তাবুতে। রুদ্রর আসার জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা চারজন। করিম আর পলাশ ভয়ে অস্হির হলেও সম্রাট অস্হির হয়ে আছে অপেক্ষায়। রুদ্রকে নিজের সামনে অসহায় অবস্থায় পাবে। সেই স্বর্ণ মুহুর্তের জন্যে এক মিনিটের অপেক্ষাও সহ্য হচ্ছেনা ওর। শওকত মীর্জার মধ্যে কোনরকম অস্হিরতা নেই। নির্বিকার, ভাবলেশহীনভাবে বসে আছে চুপচাপ।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাবুর মধ্যে প্রবেশ করল রুদ্র আমের। হঠাৎ আগমনে চমকে উঠল চারজনই। রুদ্র ওদের চারজনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘হ্যাল্লো গাইস! সবাই দেখছি এক জায়গায়! সবাইকে একসঙ্গে পেয়ে যাব ভাবিনি। হোয়াট আ লাক!’

করিম আর পলাশের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সম্রাট হিংস্র চোখে দেখছে রুদ্রকে। শওকত বরাবরের মতোই ভাবলেশহীন, স্বাভাবিক। কেবল হাতটা চলে গেছে বাঁ পায়ের ওপর। রুদ্র সম্রাটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চট্টগ্রামের ঐ মারের পর কতদিন হাসপাতালে থাকতে হলো?’
সম্রাট জ্বলন্ত চোখে কিছুক্ষণ দেখল রুদ্রকে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘চিন্তা করোনা। তোমাকে হাসপাতালে পাঠাবোনা আমি। সোজা কবরে পাঠাবো।’

রুদ্র হাসল। একটা বস্তা দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল। সেটার ওপর বসল। আরও একবার উপস্থিত সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘বাইরে তোমাদের যত শেয়াল কুকুর দাঁড় করিয়ে রেখেছিলে সবগুলো এখন আমাদের বন্দি। এখনো বাইরে পাহারা আছে। তবে তোমাদের লোকের না আমার লোকের। তাই কোনরকম চালাকি না। আমার একটা ইশারায় তোমাদের লা’শ পড়ে যাবে।’

ওরা একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। রুদ্র আবার বলল, ‘এখন মূল কথায় আসি। প্রথম প্রশ্ন, আসল মালগুলো কোথায়? দ্বিতীয় প্রশ্ন, এতোগুলো দিন আমাদের হয়ে মাল ডেলিভারী নিচ্ছো তোমরা। সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই আর। কিন্তু কীভাবে? মাল নেওয়ার জন্যে আগে ডেলিভারী লোকেশন জানতে হয়। লোক চিনতে হয়। সবগুলো সিক্রেট পয়েন্ট সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হয়। লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, পাসকোড জানতে হয়। এসব ইনফরমেশন কে দিতো তোমাদের? কীকরে দিতো?’

‘যদি না বলি?’ রুদ্রের চোখে চোখ রেখে তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল সম্রাট।
‘তোমাদের একজনও এখান থেকে প্রাণ নিয়ে বের হতে পারবেনা।’ রুদ্রর কন্ঠস্বর নির্দয় নিষ্ঠুর।
কিন্তু সম্রাট মোটেও ঘাবড়ালো না। উল্টে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘আমার জানামতে দাবাটা তুমি ভালোই বোঝ। কিন্তু এটা ভুলে গেছো সবসময় শুধু রাজা, মন্ত্রী, হাতি নৌকার পেছনে ছুটলেই হয়না। ঘোড়ার দিকেও নজর রাখতে হয়। ঘোড়ার দৌড় আড়াই কোট পর্যন্ত ঠিকই। কিন্তু বড় বড় গুটিকে টপকে চলতে পারে। মাথার ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। কেউ কিচ্ছু করতে পারেনা।’

সম্রাটের কথার অর্থ বুঝল না রুদ্র। ভ্রু কুঁচকে ফেলল। শওকত মীর্জা মুখ খুললেন এতক্ষণে। বললেন, ‘সম্রাট! রুদ্র আমের সোজাসাপ্টা কথা পছন্দ করে। শত্রুকে সোজাসাপ্টাভাবে ফেলে মারতেও পছন্দ করে। সরাসরি বল যা বলার।’
রুদ্র গম্ভীর মুখে তাকাল শওকতের দিকে। শক্ত গলায় বলল, ‘ওটা একটা দুর্ঘটনা ছিল মীর্জা। সেদিন বাধ্য না হওয়া অবধি আপনাকে মারার কোন পরিকল্পনা ছিলোনা আমার। দুর্ভাগ্যবশত হাত ফসকে গিয়েছিল। আমি চাইনি সেটা। তবে আপনার সৌভাগ্য কেবল পা টা কা’টা গেছে। প্রাণটা যায়নি। ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ জানান।’

হঠাৎই শওকতের শান্ত ভাব মিলিয়ে গেল। ক্ষীপ্র গলায় বলল, ‘এরচেয়ে আমার প্রাণটা চলে গেলেও ভালো হতো রুদ্র!’
অদ্ভুতভাবে সঙ্গেসঙ্গেই নিজেকে শান্ত করে ফেলল। ঠোঁট হালকা প্রসারিত করে হেসে সম্রাটকে বলল, ‘রুদ্র আমের অনেকক্ষণ হলো অপেক্ষা করছেন। এবার ওকে সুখবরটা দাও।’

রুদ্র স্হির চোখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এতক্ষণে সম্রাট মুচকি হাসল। রুদ্রকে অনুকরণ করে নিজেও বসল বস্তার ওপর। রুদ্রর মুখোমুখি। বলল, ‘প্রথম প্রশ্নের উত্তর, যে আসল মালগুলো তুমি চাইছো। সেগুলো এখন আর তোমার নয়। কারণ, ঠিক এক ঘন্টা আগে রাশেদ আমের বাইরের কম্পানিগুলোর সঙ্গে সব চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে।’

রুদ্র চমকে উঠল। কথাটা মানতে একটু সময় লাগল। কিন্তু অযথাই এতবড় ঢপ সম্রাট দেবে বলে মনে হচ্ছেনা ওর। কিন্তু রাশেদ আমের হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন নেবেন? তাও রুদ্রকে না জানিয়ে? রুদ্রর মুখভঙ্গি দেখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল শওকতের ঠোঁটে। সে সকৌতুকে বলল, ‘বিশ্বাস হচ্ছেনা? নিজের ফোনটা বের কর। অন করে কথা বলো ওনার সাথে। সব বুঝতে পারবে।’

রুদ্র একবার তাকাল সম্রাটের দিকে। চোখে হিংস্রতা কিন্তু ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। রুদ্র সময় নষ্ট করল না। দ্রুত নিজের ফোনটা বের করল। রাশেদ আমেরের নাম্বারে কল করল। জীবনে প্রথমবার ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেছে রুদ্র। যদি ওদের কথা সত্যি হয়, নিশ্চয়ই ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে ঢাকায়। বেশ অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করলেন রাশেদ। রুদ্র দ্রুত বলল, ‘বাবা..’

কিন্তু রুদ্রকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই রাশেদ শান্ত, গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ওরা যা বলছে তা সত্যি বলছে। কুহু এখন ওদের কাছে আছে। কোথায় আছে এখনো জানিনা আমরা। যা করবে কুহুর কথা চিন্তা করে করো।’

বলে কল কেটে দিলেন রাশেদ। রুদ্র পাল্টা কোন প্রশ্ন করার সুযোগ পেলোনা। এই মুহুর্তে কিছু জিজ্ঞেস করার মতো ছিলোও না। আস্তে করে ফোনটা নামিয়ে রাখল রুদ্র। শান্ত চোখে তাকাল ওদের দিকে। রুদ্রর চাহনী দেখে কিছুটা কেঁপে উঠল তাজওয়ার এবং পলাশ। রুদ্র বলল, ‘চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে। বাবা সইও করেছে। এবার কী চাই? আমাকে?’
শব্দ করে হাসলেন শওকত। উল্লাসে ভরপুর কন্ঠে বললেন, ‘এইজন্যই তোমাকে আমার এতো পছন্দ রুদ্র। শত্রু হিসেবে। সবসময় পয়েন্টে কথা বলো। ঠিকই ধরেছো। তোমাকেই চাই।’

সম্রাট উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আর যদি চাও তোমার বোন জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরুক। তাহলে চুপচাপ বাইরে থাকা “তোমার” শেয়াল কুকুরদের চলে যেতে বলো। আর নিজের পি’স্ত’লটা চুপচাপ আমাদের হাতে দিয়ে দাও।’
রুদ্র স্হির চোখে তাকিয়ে রইল। রুদ্রকে শান্ত দেখে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলো করিম আর পলাশ। রুদ্র ওদের দিকে তাকিয়ে থেকেই আবার কল করল। জঙ্গল ফিরে যেতে বলল সবাইকে।

তারপর রঞ্জুকে ফোন করে বলল, ‘তোর ভাবিকে যেখানে রেখেছি সেখানে চলে যা। এক্ষুনি। ওকে নিয়ে চুপচাপ ঢাকা ফিরে যা। প্রেগনেন্ট ও। সাবধানে যাবি।’
বলে ফোনটা রেখে দিল। সম্রাট হাত বাড়িয়ে চাইল ফোনটা। রুদ্র প্রিয়তা আর রঞ্জুর নাম্বারটা ডিলিট করল। তারপর সুইচড অফ করে ফোনটা দিল সম্রাটের হাতে। সম্রাট ফোনটা নিয়ে বলল, ‘বউয়ের কাছ থেকে শেষ বিদায়টা নিয়ে নিতে পারতি।’
রুদ্র অদ্ভুত শান্ত গলায় বলল, ‘কুহুকে কখন ছাড়বে?’

শওকত কন্ঠে অতিরিক্ত ভদ্রতা মিশিয়ে বলল, ‘যখন তোমার সব লোক কক্সবাজার ছাড়বে।’
রুদ্রর চোখ লালচে হয়ে গেছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ রেখে নিয়ন্ত্রণ করছে নিজেকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘এসবের মধ্যে কুহু ছিলোনা। মুখোমুখি লড়ার সাহস নেই বলে ওকে ব্যবহার করাটা ঠিক হয়নি। এখন ডিল তোদের হাতে আর আমিও। এরপরেও ওর কোনো ক্ষতি হলে তোদের সবগুলোকে কুত্তার মতো দৌড় করিয়ে মারব। শু*রের বাচ্চা।’

সঙ্গেসঙ্গে সিমেন্টের খুঁটি দিয়ে সজোরে রুদ্রর পায়ে আঘাত করল সম্রাট। রুদ্র এক হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল। সম্রাট রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘এখনো এতো গলার জোর! কুত্তার মতো তো তোকে মারব। চাইলেতো এখনই এক গু’লিতে খুলি ফুটো করে দিতে পারতাম তোর। কিন্তু তোর শরীরের প্রত্যেকটা হাড় গুড়ো করে তারপর তোকে মারব। শালা!’

অশ্রাব্য ভাষার এক গালি দিয়ে খুঁটিটা দিয়ে তীব্র গতিতে রুদ্র পেটে গুতো মারল সম্রাট। ব্যথায় কিছুক্ষণের জন্য চোখে অন্ধকার দেখল রুদ্র। উবু হয়ে মাটি আকড়ে ধরল। আরেকটা আঘাত করতে এলে বাঁধা দিল শওকত। বলল, ‘আহা! এতো অধৈর্য হচ্ছো কেন? একেবারে মেরে ফেললে হবে? রসিয়ে রসিয়ে মজা নিতে হবে। তাছাড়া ওর ঐ বাঁ পা’টার ওপর আমার ভীষণ লোভ। ওটা আমার জন্যে ছেড়ে দাও। এখন ফেলো ওটা।

সম্রাট খুঁটিটা ফেলার আগে রুদ্র মুখের ডানপাশে আঘাত করে নিজের আক্রোশ মেটালো। উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ল রুদ্র। গাল ফেঁটে র’ক্ত বেরিয়ে এলো। চোয়াল শক্ত করে হজম করে নিল আঘাতের যন্ত্রণা।
পেছন মোড়া করে ওর হাত বেঁধে দিল সম্রাট। এবার দড়ি নয় শেকল দিয়ে বাঁধল। বাঁধার সময় কয়েকটা লাথি মারতেও ভুলল না। চুপচাপ মারগুলো সহ্য করে নিতে হলো রুদ্রকে। কথায় আছে হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। ব্যপারটা খানিকটা সেরকমই ছিল।

রুদ্রকে তাঁবুতে ফেলে রেখে বেরিয়ে এলো ওরা চারজন। মনে মনে চারজনই প্রসন্ন। অবশেষে খেলাটা ওদের অনুকূলে। দীর্ঘ কয়েক বছর পর। সবটা স্বপ্নের মতোই লাগছে। পলাশ খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘ওকে এভাবে জীবিত ফেলে রাখাটা উচিত হলো? ঝামেলা চুকিয়ে নিলে হতোনা?’

সম্রাট ধমকে উঠল, ‘বারবার এক ঘ্যানঘ্যান করবেন নাতো। বিষাক্ত সাপের ছোবলকে ততক্ষণই ভয় পেতে হয় যতক্ষণ বিষদাঁত থাকে। ওর বিষদাঁতই ভাঙা হয়ে গেছে। ওকে আর ভয় পেতে হবেনা।’
করিম গভীর চিন্তা করতে করতে অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘রুদ্র শুধু বিষ দাঁতে ছোবল মারেনা। লেজে পেঁচিয়ে ধরে দম বন্ধ করে, একটু একটু করে শরীর গুড়িয়ে দিয়ে তবেই মারে। যা করছো ভেবে করো।’

শওকত পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, ‘অযথাই ভয় পাচ্ছো। সোলার সিস্টেম ইজ ফিনিশড। এখন শুধু আমাদের সুরক্ষা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ওরা আর উঠে দাঁড়াতে না পারে।’

এদিকে আস্তে আস্তে উঠে বস্তুার গায়ে হেলান দিয়ে বসল রুদ্র। বাঁধনটা পরখ করল একবার। শেকল দিয়ে বাঁধা। মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব। ডান গালে অসহনীয় ব্যথা। গাল থেকে র’ক্ত গড়িয়ে গলায় নেমে এসেছে। ওদের চারজনকে সামলানোর জন্যে রুদ্র একাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু যতক্ষণ কুহু নিরাপদে বাড়ি না ফিরবে, ততক্ষণ চাইলেও রুদ্র কিছু করতে পারবেনা।

কয়েকটা চিন্তা দ্রুত গতিতে চলছে রুদ্রর মস্তিষ্কে। রাশেদ পেপারগুলোতে সই কেন করল? চুক্তিভঙ্গ মানে বিশাল অঙ্কের টাকা দিতে হবে ক্লাইন্টকে। সেই টাকা দিতে গেলে আমের ফাউন্ডেশন, মিলস্, ফ্যাক্টরি সব দেউলিয়া হয়ে যাবে। যার অর্থ একটাই। সোলার সিস্টেম শেষ!

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৪

তারচেয়েও বেশি চিন্তা হচ্ছে কুহু আর প্রিয়তার জন্যে। আজ সকালেই রুদ্রকে বাবা হতে যাওয়ার সুসংবাদ দিয়েছিল মেয়েটা। রঞ্জু প্রিয়তাকে নিয়ে ঠিকভাবে ঢাকা পৌঁছতে পারবে তো? কুহুকেতো আজ বের হতে দিতে নিষেধ করেছিল রুদ্র। তাহলে? কেন বের হল? কুহু কোথায় আছে? কেমন আছে? ঠিকভাবে বাড়ি ফিরবেতো?

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৬