অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৭ শেষ অংশ

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৭ শেষ অংশ
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

সাভার। শানের ফ্ল্যাটে একত্রিত হয়েছে ডার্ক নাইট আর ব্ল্যাক হোল গ্রুপের মূখ্যরা। সকলের মুখে একরাশ গাম্ভীর্য। কারো মুখে কোন কথা নেই। থমথমে পরিবেশ। যে যার যার জায়গায় বসে হাঁসফাঁস করছে। দীর্ঘক্ষণের নীরবতার পর মুখ খুললেন শওকত। বিশ্রী এক গা-লি দিয়ে বললেন, ‘এদিকের একটা কাজ সামলাতে দিয়েছিলাম তোমাকে। আর সেটাতেই ব্লান্ডারটা করলে। বলেছিল মেয়েটাকে ঐ শু*রগুলোর কাছে রেখে বের হতে? কে বলেছিল?’

অপমানে কান গরম হয়ে গেল শানের। সকলের সামনে এভাবে না বললেও চলতো। মাথা নিচু করে নিল ও। কোনরকমে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আমি কীকরে জানব আবা*গুলো এমন কাজ করে বসবে? পাহারায় বসিয়ে_’
‘চুপ!’ ধমকে উঠল শওকত। ‘সারাজীবনতো আমার টাকাতেই ফুটানি করে গেলে। কী এমন রাজকার্য ছিল তোমার? যে একটা রাত ওখানে ভালোভাবে থাকা গেলোনা।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল শানের। খানিকটা চেঁচিয়ে বলল, ‘আশ্চর্য! দারোয়ান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি আমি ওখানে। আর ওরা আমার না তোমার হায়ার করা লোক। তোমার লোক যে তোমারই ওর্ডার মানেনা সেটা আমি কীকরে জানবো? পেপারগুলোতে রাশেদ আমেরের সাইনতো পেয়েছো?’

শওকত তেঁতে উঠে বললেন, ‘এক চ’ ড় মেরে সবগুলো দাঁত ফেলে দেব বেয়াদব ছেলে। আমার মুখে মুখে তর্ক করছো আবার! আমার এতোগুলো বছরের সাধনায় জাস্ট জল ঢেলে দিলে তুমি। আমি শুধুমাত্র ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্যে এতোকিছু করিনি। রুদ্র আমেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য মৃ’ ত্যু দেওয়ার আশায় করেছিলাম। কিন্তু হাতের মুঠোয় এসেও ফসকে গেল ছেলেটা।’

‘তো তুমি কী করেছো? ড্রিল মেশিনটা রুদ্রর পায়ের কাছে আমি ফেলে এসেছিলাম? তুমি সেই ব্লান্ডারটা না করলে তো রুদ্র পালাতে পারতো না। আর পাহারাতেও রেখেছিলে কতগুলো গাধাকে। একটা ছেলেকে দেখে রাখতে পারল না। আগে নিজের ভুলগুলো দেখো। তারপর আমার দিকে আঙুল তুলবে।’

শওকত কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে করিম বলল, ‘থামো! এখন একে অপরকে দোষ দিয়ে, নিজেদের মধ্যে কথা কা/টা/কা/টির সময় না-কি? পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া যায় সেটা ভাবতে হবে আমাদের।’
শওকত টেবিলে একটা ঘুষি মেরে বলল, ‘সাজানো গোছানো খেলাটা একটুর জন্যে। জাস্ট একটুর জন্যে বিগড়ে গেল। এই পরিস্থিতিতে শান্ত হওয়ার জ্ঞান অন্যকাউকে দিও।’

করিম বিরক্তি নিয়ে চুপ হয়ে গেল। শান বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে। মেয়েটাকে মে’ রে ফেলা উচিত ছিল। অন্তত ওদের চরম শিক্ষাতো হতো।’
এতক্ষণ চুপচাপ ছিল পলাশ। এবার খানিকটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘তাহলে আমাদের এখানে নিশ্চিন্তে বসে বসে আড্ডা দিতে হতোনা। রুদ্র এতক্ষণে কু’ ত্তার মতো দৌড় করিয়ে বেড়াতো আমাদের। মেয়েটা অসুস্থ বলেই ও এখনো ওখানে ব্যস্ত আছে।’

পলাশ থেমে যেতেই শওকত কপালে চিন্তার রেখা ফেলে বললেন, ‘রুদ্রকে খুব ভালোভাবে চিনি আমি। বেশিক্ষণ চুপ থাকবেনা ও। আহত বাঘ আরও বেশি ভয়ংকর হয়। তাড়াতাড়ি কিছু একটা না করলে_’
‘আমি আগেই বলেছিলাম এই পরিকল্পনাটা খুব রিস্কি। একটু ভুলচুক হলে ওদের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ম’ রবো।’ করিম তাজওয়ার সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেছে এবার।

এতক্ষণ চুপচাপ সবটা শুনছিল সম্রাট। ওর চোখে-মুখে কোনরকমের উদ্বিগ্নতা নেই। ঠোঁটে ঝুলে আছে রহস্যময় হাসি। সকলে চুপ হতেই সম্রাট বলল, ‘তোমাদের ধরে ধরে দলের মাথা কে বানাল সেটাই ভাবছি আমি।’
পলাশ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সম্রাটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কী বুঝতে পারছো অবস্থাটা কতোটা জটিল?’
‘পারছি।’ সম্রাটের এখনো হাসছে।

‘আমার তো মনে হচ্ছেনা। আর এভাবে হাসছো কেন আমি সেটাও বুঝতে পারছিনা।’
হাসি থামালো সম্রাট। তখনই জবাব দিলোনা। একটা সিগারেট বের করে ধীরে সুস্থে জ্বা’ লালো। মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আর আপনারাও এতো বেশি চিন্তা কেন করছেন আমি সেটা বুঝতে পারছিনা। সবকিছু ততটাও হাতের বাইরে যায়নি যতটা আপনারা ভাবছেন।’

শওকত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তাই নাকি? একটা কথা মাথায় রেখো, ওখানকার পরিবেশ একটু ঠান্ডা হলেই রুদ্র ভয়ং’ কর রূপ নেবে। ওকে হালকা করে দেখার কারণ নেই।’
সম্রাট অ‍্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘আবারও বলব বেশি চিন্তা করছেন। আপনাকে এভাবে মানায় না। হাঁটুর বয়সী এক ছেলেকে এতো ভয় পেলে চলবে? খেলাটা আমাদের হাতেই আছে এখনো।’

উপস্থিত সবাই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সম্রাটের দিকে। কিছুই বোঝেনি তারা। সম্রাটকে সিগারেট জ্বা’ লাতে দেখে তাদেরও সিগারেটের পিপাসা পেল। নিজের নিজের সিগারেট জ্বা’ লালেন তারা। শান বলল, ‘আমি হয়তো বুঝতে পারছি তুমি ঠিক কী বলতে চাইছো।’

সম্রাট শানের দিকে তাকিয়ে চোখে হাসল। বাকিরা এখনো চোখভর্তি প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে সম্রাটের দিকে। সম্রাট আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘দেখো, লোহা গরম থাকতেই আ/ঘা/ত করতে হয়। রাশেদ আমের চুক্তি বাতিলের কাগজগুলোতে সই করে দিয়েছেন। আর দ্রুতই কাগজগুলো ক্লাইন্টদের হাতে পৌঁছে যাবে। আর চুক্তিভঙ্গের সেই টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে আমেরদের নিঃস্ব হতেই হবে। আর একটা কথা আমরা সবাই জানি। এই লাইনের সবাই স্বার্থপর। যখন তারা জানবে যে আমেররা নিঃস্ব হয়ে গেছে। দু’বার না ভেবে দল ছেড়ে দেবে।’

সম্রাট থামল। সম্রাটের কথাটাকে সম্পূর্ণ করে শান বলল, ‘আর পাওয়ার ছাড়া, টাকা ছাড়া, লোক ছাড়া রাশেদ আমের আর রুদ্র আমের কতক্ষণ লড়বে?’
সকলের কিছুক্ষণের জন্যে থমকে গেল। সত্যিই তো! এভাবে তারা চিন্তা করে দেখেনি। করিম কিছু একটা ভেবে বলল, ‘কিন্তু এই ব্যপারটা যতদিন না ঘটছে ততদিনতো ওদের আটকে রাখতে হবে। সেটা কীকরে করব?’
সম্রাট গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘প্লান বি চলবে।’

ঘরে যেন বাজ পড়ল। হতভম্ব দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সবাই। পলাশ একপ্রকার চিৎকার করেই বলল, ‘পাগল হয়ে গেছে। এ সত্যিই পাগল হয়ে গেছে।’
শওকত হাত নাকের নিচে ঘামটা মুছে বললেন, ‘অসম্ভব এটা। প্লানটা যখন করেছিলাম সে অনুযায়ী রুদ্রর আমাদের কাছে বন্দি থাকার কথা ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কিছুতেই আর ‘প্লান বি’ চালিয়ে নেওয়া যাবেনা। যা হয়ে গেছে তাও কম নয়। পাগল ক্ষেপিও না তুমি এখন।’

‘ক্ষেপা পাগলকে দিয়ে নিজের কাজ আদায় করে নিতে জানি আমি। আপনি ডাকুন ওকে। বাকিটা আমি বুঝে নেব।’
পলাশ একটা ঢোক গিলে বলল, ‘এরপরেও? আমারতো ভয় করছে। ও এসে না আমা_’
সম্রাট ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপ করুন। যেটা বলছি সেটাই হবে। যোগাযোগ করুন ওর সাথে। লোহা গরম থাকতেই আ/ঘা/ত করতে হবে। এক সপ্তাহ। জাস্ট এক সপ্তাহের মধ্যে আমি আমের পরিবারের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়তে দেখতে চাই।’

বিষাদময় তিনটে দিন কেটে গেল। কুহুকে আজ বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। প্রথম দুটো দিন কিছুতেই সামলে রাখা যাচ্ছিল না ওকে। ক্যানেল টেনে খুলে ফেলতো। কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিতে চাইতো না। নিজের সারা শরীর ঘষে কিছু একটা মুছে ফেলার চেষ্টা করতো। পাগলের মতো ছটফট করতো। কাউকেই যেন চিনতে পারতো না।

নীরব, প্রিয়তা, কুহু, জ্যোতি কেউ কিছুতেই ওকে সামলাতে পারছিল না। বাড়ির সবচেয়ে শান্ত, হাসিখুশি মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে দিশেহারা বোধ করে ওরা। তখন বাধ্য হয়ে রুদ্রকে আসতে হয়। কিন্তু তাতেও যখন কোন লাভ হয়না। কুহুর দুই বাহু শক্ত করে ধরে রুদ্র। নিজের দিকে ঘুরিয়ে প্রচন্ড জোরে ধমক দেয়।

সেই ধমকেই থমকে যায় কুহু। অবুঝ, অসহায় শিশুর মতো ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ভাইয়ের দিকে। আচমকাই রুদ্রর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘসময় নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে রুদ্রর বুকেই জ্ঞান হারায় মেয়ঙেটা। সেদিন প্রথম প্রিয়তা রুদ্রর চোখের কোণে পানি দেখেছিল। দীর্ঘ দুই বছরের বিবাহিত জীবনে যা কোনদিন দেখেনি। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই কুহু অতিরিক্ত শান্ত হয়ে গেল। কোনরকম কোন প্রতিক্রিয়া নেই ওর মধ্যে। জ্যান্ত লা’ শের মতো পড়ে থাকে চুপচাপ। সবাই মিলে চেষ্টা করছে কুহুর সঙ্গে একদম স্বাভাবিক থাকার। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছেনা।

বিগত কয়েকদিনের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ব্যালকনিতে ভেজা কাপড়গুলো মেলছিল প্রিয়তা। রুদ্রর হাসপাতালে পরে রাখা জামাগুলোই ধুয়ে দিয়েছে আজ। প্রিয়তা গর্ভবতী সেটা এখন বাড়ির সকলেই জানে। কিন্তু নীরব ছিল সকলেই। এমন পরিস্থিতিতে কী বলা যায়? রুমে আসতেই রুদ্রকে দেখতে পেল।

বিছানায় হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে বসে আছে চুপচাপ। এখন মোটামুটি সুস্থ ও। শুধু বাঁ পায়ে এখনো ব্যথা আছে। রেস্টে থাকতে বলেছেন ডক্টর। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজের কান্না আটকালো প্রিয়তা। কোনদিন রুদ্রকে এভাবে দেখতে হবে কল্পনাও করেনি ও। মানুষটার ভেতরে কী চলছে ভাবলেও বুক কেঁপে উঠছে। রুদ্র বলল, ‘এগুলো অন্যকাউকে দিয়ে করিয়ে নিও। এই সময় এগুলো করতে হবেনা।’

প্রিয়তা রুদ্রর পাশে বসে বলল, ‘অল্প ছিল। তাই নিজেই করলাম। বেশি হলে করতাম না।’
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে থেকে বলল, ‘আ’ম সরি প্রিয়।’

প্রিয়তা তাকাল রুদ্রর মুখের দিকে। রুদ্র এখনো ওর দিকে তাকায় নি। প্রিয়তা রুদ্রর একটা হাত ধরে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আপনার স্ত্রী আমি। আপনার সমস্যাগুলো কী আমার নয়? আমাকে নিজের থেকে আলাদা মনে করেন আপনি?’
রুদ্র প্রিয়তার দিকে তাকাল। এক হাতে টেনে নিয়ে প্রিয়তার মাথা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলল, ‘নিজেকে নিজের থেকে আলাদা কীকরে ভাবব?’

প্রিয়তা চুপচাপ মিশে রইল রুদ্রর বুকের সঙ্গে। কিছু বলল না। কিছুক্ষণের নীরবতার পর রুদ্র বলল, ‘কুহুর কাছে গিয়েছিলে?’
‘ঘুমোচ্ছে এখন। জ্যোতি আপু আছে ওখানে।’
‘বাবা?’

‘নিজের ঘরেই কাটাচ্ছেন বেশিরভাগ সময়। এতোবার বলেও কুহুর সাথে এখনো দেখা করাতে পারিনি। কুহুর মুখোমুখি হতেই চাইছেন না উনি। মানুষটাকে এর আগে এরকম কক্ষণো দেখিনি আমি। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। এদিকে কাল থেকে নীরবেরও কোন খোঁজ নেই। ছেলেটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না জানেন।’
রুদ্র আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘উচ্ছ্বাসকে একটু আমার রুমে পাঠিয়ে দিও। কথা আছে ওর সঙ্গে।’

‘ওতো বাড়িতে নেই।’
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘কোথায় গেছে?’
‘জানিনা। হুটহাটই কোথাও একটা বেরিয়ে যাচ্ছে। মেজাজও ভালো নেই বুঝলাম।’
রুদ্র কিছু বলল না। প্রিয়তাকে বুকে জড়িয়ে রেখেই গভীর চিন্তার সমুদ্রে ডুব দিল। বুকে উষ্ণ তরল কিছু অনুভব করতেই ভাবনায় ছেদ ঘটল রুদ্রর। বুঝল প্রিয়তা কাঁদছে। রুদ্র প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘কেঁদোনা। সব ঠিক করে দেব আমি। কিচ্ছু হবেনা।’

প্রিয়তা ভাঙা গলায় বলল, ‘আমার ভীষণ ভয় করছে। আমার মনে হচ্ছে ওরা এখানেই থেমে থাকবেনা। আরও ভয়ানক কিছু হতে চলেছে রুদ্র। সব শেষ হয়ে যাবে, সব।’

বলতে বলতে শব্দ করে কেঁদে ফেলল প্রিয়তা। রুদ্র কিছু বলতে পারল না। প্রিয়তার পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিল কেবল। ও নিজেও জানে ওরা এখানে থেমে থাকবেনা। আরও ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে আমের পরিবারের জন্যে। খুব ভয়ংকর।
বিকেলবেলা নীরবের বাবা আর মা এলেন আমের ভিলায়। সঙ্গে নীরবও।

নীরবের বাবা-মা বসার ঘরে বসলেন। নীরব ধীরপায়ে চলে গেল ওপরে। কুহুর কাছে। যখনই কুহুর সঙ্গে দেখা করতে যেতো ছুটে যেতো নীরব। কতক্ষণে পথ শেষ হবে সেই চিন্তায় ছটফট করতো। কিন্তু আজ পা কাঁপছে নীরবের। প্রতিটা পদক্ষেপ ভীষণ কঠিন মনে হচ্ছে। নিজের সঙ্গে যু’ দ্ধ করে কোনমতে কুহুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল নীরব। কুহু হেলান দিয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। প্রিয়তা আর জ্যোতি বসে আছে ওর পাশে। নীরবকে দেখে ওরা দুজনেই উঠে দাঁড়াল। নীরবের শুকনো, অসহায় মুখটা দেখে দীর্ঘশ্বাস চাপল। প্রিয়তা বলল, ‘কখন এলে?’

নীরব মৃদু গলায় বলল, ‘মাত্রই। বাবা-মাও এসেছে।’
প্রিয়তা আর জ্যোতি একে অপরের দিকে তাকাল। কুহুর দিকে তাকিয়ে দেখল ওভাবেই শুয়ে আছে। কোনদিকে তাকাচ্ছে না। নীরবকে ওখানে রেখে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা আর জ্যোতি। ওদের একটু আলাদা ছেড়ে দেওয়া উচিত।
নীরব আস্তে আস্তে গিয়ে বসল কুহুর পাশে। কুহু অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। নীরব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল কুহুকে। শরীরের ক্ষতগুলো শুকিয়ে এসছে। তিনদিনেই কেমন অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটেছে কুহুর চেহারায়। বাচ্চা মেয়েটা যেন হঠাৎই বড় হয়ে গেছে। নীরব কিছুক্ষণ ইতস্তত করে আস্তে করে ডাকল, ‘কুহু?’

কুহু মাথা ঘুরিয়ে তাকাল নীরবের দিকে। নীরবের ভেতরটা কেঁপে উঠল। মাথা ঝিম ধরে গেল যেন। কিছুতেই কুহুর চোখে চোখ রাখতে পারল না। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। কুহুর চোখের কার্নিশ বেয়ে দিয়ে ধীর গতিতে এক ফোটা জল গড়িয়ে নামল। নীরব কুহুর হাত ধরতে গিয়ে কী মনে করে আটকে গেল। হঠাৎই হাত কাঁপছে ওর। কুহু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই কম্পমান হাতের দিকে। নীরব ধৈর্য হারালো। কুহুর সামনেই কেঁদে ফেলল।

ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। এক মুহূর্তও ওখানে না দাঁড়িয়ে হনহনে পায়ে বেরিয়ে গেল কুহুর ঘর থেকে। কুহু পলকহীন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নীরবের যাওয়ার দিকে। হঠাৎ বালিশে নিজের মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠল। কোন শব্দ হলোনা। কিন্তু বারবার ঝাকি খেয়ে উঠল ওর শরীরটা। আজ প্রথমবার কথা বলতে না পারার জন্যে আফসোস হচ্ছে কুহুর। ও কাঁদতে চায়। আকাশ, বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে চায়। চিৎকার করে পৃথিবীর নামে হাজারটা অভিযোগ করতে চায়। জানতে চায় কেন ওর সাথেই এরকম হলো? কেনো?’

তিনদিন যাবত নিজের ঘর থেকে খুব একটা বের হন না রাশেদ। গর্জে ওঠা সেই সিংহ হঠাৎই কেমন শান্ত হয়ে গেছে। নিজের মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে তার পা কাঁপছে। তাইতো এখনো কুহুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি সে। নীরবের বাবা-মা আসায় বাধ্য হয়ে এসেছে দেখা করতে। রুদ্রর নিচে নেমেছে। জাফর বসে আছে রাশেদদের পাশে। প্রিয়তা, উচ্ছ্বাস, জ্যোতি পাশে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। নীরবতা ভেঙ্গে নাঈমুর বললেন, ‘আমের সাহেব হিসেবমতো তিনদিন পর নীরব আর কুহুর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি_’

রাশেদ গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘এই পরিস্থিতিতে এখন যে বিয়েটা হওয়া সম্ভব নয় সেটা আমিও জানি।’
নীরবের মা বলে উঠল, ‘শুধু এই পরিস্থিতি না। কোন পরিস্থিতিতেই হয়তো আর এই বিয়েটা সম্ভব নয় ভাইজান। দেখুন, মেয়ে বোবা ছিল আমরা মেনে নিয়েছি। শুধুমাত্র আমার ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু এবার যেটা হয়েছে তারপর আর বিয়ে নিয়ে ভাবাটা সম্ভব না। একটামাত্র ছেলে আমার। ওকেতো এভাবে জলে ফেলে দিতে পারিনা।’

রুদ্র তেড়ে উঠতে যাচ্ছিল। প্রিয়তা দ্রুত হাত চেপে ধরে ওকে সামলে নিল। নাঈমুর বলল, ‘জানি আপনাদের ওপর দিয়ে এখন অনেকরকম ঝামেলা যাচ্ছে। যেকোন দরকারে আমরা পাশে আছি। কিন্তু এই সম্বন্ধটা আর হতে পারেনা। আমাদের এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে হচ্ছে।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৭

রাশেদ একটা কথাও বললেন না। জাফর কয়েকবার তাদের মিনতি করল বিষয়টা ভেবে দেখার জন্যে। রুদ্র আর উচ্ছ্বাসকে প্রিয়তা আর জ্যোতি মিলে বহু কষ্টে সামলালো কোন অঘটন ঘটানো থেকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা। নীরব আর কুহুর বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েই প্রস্থান করলেন নাইমূর এবং তার স্ত্রী।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৮