অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৮

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৮
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

কয়েকদিনের বিরতির পর আজ আমের ফাউন্ডেশনে এসেছেন রাশেদ। অনেকটা বাধ্য হয়েই। দলের যা অবস্থা তাতে এখন আর ঘরে বসে থাকা সাজেনা। নয়তো এ’কদিন প্রয়োজন ছাড়া নিজের ঘর থেকে বের হননি রাশেদ। জাফরই সামলেছে সব। কিন্তু আসার পর থেকেই চুপচাপ বসে আছে নিজের চেয়ারে।

কাজে মন দিতে গেলেই সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই মননিবেশ করতে পারছেন না। রাশেদ আজ প্রথমবারের মতো অনুধাবন করলেন তার বয়স হচ্ছে। দরজায় টোকা পড়তেই হালকা নড়ে উঠলেন রাশেদ। তাকিয়ে দেখলেন ইন্সপেক্টর আজিজ দাঁড়িয়ে আছেন। রাশেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই আজিজ নরম গলায় বলল, ‘আসতে পারি?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাথা ঝাঁকালেন রাশেদ। মুখে কিছু বললেন না। ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে রাশেদের দিকে দেখল আজিজ। গভীরভাবে। আজিজের অনুসন্ধানী চোখজোড়া অনেকক্ষণ খুঁজল সেই তেজস্বী রাশেদ আমেরকে। অ/প/রাধ জগতের সম্রাট জানা সত্ত্বেও যার তেজে আপনাআপনি নুইয়ে যেতো আজিজের চোখজোড়া। না চাইতেও অদ্ভুত শ্রদ্ধা জেগে উঠতো মনে। কোথায় সেই তেজ? অসামান্য ব্যক্তিত্বে ভরপুর সেই চেহারা?

‘বসুন।’
রাশেদের গলার আওয়াজে হুঁশ ফিরল আজিজের। সেই বজ্র দৃঢ় কন্ঠেও কোথাও একটা ভাটা পড়েছে বলে মনে হল তার। সামান্য গলা ঝেড়ে চেয়ার টেনে বসল। চোখ সরায়নি রাশেদের দিক থেকে। রাশেদের দৃষ্টি সামনে রেখে দেওয়া ফাইলে। কিন্তু ফাইলে লেখা একটা শব্দও যে রাশেদ পড়ছেন না, তা অনায়াসে বুঝে ফেলল। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার পরেই লোকটা নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখার, নিজেকে শক্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

আজিজ বলল, ‘রুদ্র কেমন আছে এখন?’
‘ভালো।’
‘কুহুর ব্যপারটা শুনেছি আমি। এতো খারাপ অনুভূতি বহুদিন হয়নি।’

রাশেদ কিছু বললেন না। তাকালেনও না আজিজের দিকে। আজিজ টেবিলের ওপর দুহাত রেখে বলল, ‘আমি আগেই বলেছিলাম আপনাকে। সবকিছু ধসে পড়তে খুব বেশিদিন লাগবেনা। দেখলেন? ফাটল ধরে গেছে। ধসে পড়ল বলে। কিন্তু আফসোস একটাই। আপনাদের এই পাপের যজ্ঞে প্রথম আহুতি একটা নিষ্পাপ মেয়েকে দেওয়া হল।’

রাশেদ ফাইলটা বন্ধ করে চোখ তুলে তাকালেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘আপনি কী আমাকে আমার অবস্থাটা মনে করিয়ে দিতে এসেছেন? যদি তাই এসে থাকেন তাহলে বলব দরকার নেই। আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জ্ঞাত।’

আজিজ হালকা হেসে বলল, ‘সে আমি জানি। আমি এসেছি আপনাকে কিছু কথা বলতে।’
‘শুনছি।’
‘সোলার সিস্টেমের পক্ষে টিকে থাকাটাযে অসম্ভব। সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? ধ্বং/স যখন হতেই চলেছেন তখন একা হয়ে কী লাভ?’

‘তাই আমাদের কাছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যান্য দলের বিরুদ্ধে যত প্রমাণ আছে, সব আপনার হাতে তুলে দিয়ে যাতে স্যারেন্ডার করি। শাস্তি যথাসম্ভব কম হবে। তাইতো?’ আজিজের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন রাশেদ।
আজিজ উত্তর দিলোনা। রাশেদের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল কেবল। যার অর্থ রাশেদ ঠিক বলছে। রাশেদ আবার বললেন, ‘এ কথাগুলো আমায় বলেছেন, বলেছেন। রুদ্রক‍ে বলবেন না। অযথা অপমানিত হতে হবে। চা-কফি কী খাবেন বলুন। আনিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে চলে যান।’

আজিজ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এখনো এসব বলছেন?’
রাশেদ আজিজের কথার উত্তর না দিয়ে হাঁক ছেড়ে কফি আনতে বললেন। আজিজ বুঝল, এরা ওর কথা শুনবেনা। অনেকটা আন্দাজ করেছিল এমনটাই হবে। শুধু একটা শেষ চেষ্টা করতে এসেছিল। কিন্তু যথারীতি ব্যর্থ হল। আজিজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আজ আসছি। কফি অন্যদিন খাব। তবে আমার কথাগুলো ভেবে দেখলে পারতেন।’

রাশেদ বলল, ‘ঐযে বললেন, পাপের যজ্ঞ। যজ্ঞ যখন শুরু হয়েই গেছে, আর প্রথম আহুতি যখন আমার নিজের মেয়ের হয়েছে তখন যজ্ঞফল না পাওয়া অবধি থামার প্রশ্নই ওঠেনা।’
আজিজ খানিকটা থমকে গেল। রাশেদে কথাগুলো বেশ ভারী ছিল। তবে ভঙ্গিটা দুর্বল। রাশেদ নিজস্ব সেই বজ্র কন্ঠে বললে হয়তো কেঁপে উঠতো আজিজ।

‘আসছি।’ কোনমতে শব্দটা উচ্চারণ করে বেরিয়ে যাচ্ছিল আজিজ। কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছতেই রাশেদ বলে উঠলেন, ‘চিন্তা করবেন না। তথ্যগুলো আজ না হলেও একদিন নিশ্চয়ই পুলিশের হাতে যাবে। যেদিন যাবে সেদিন আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাকি দলগুলোও ধসে পড়বে।

তবে সে সময়টা এখন নয়, আর সে পুলিশটাও আপনি নন। আপনি সৎ সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এতো বিশাল একটা জগতে ধ্বং/স যজ্ঞ ঘটালে হলে সৎ হওয়ার সাথে সাথে ভীষণ জেদি কাউকে প্রয়োজন। যেটা আপনি নন। ভালো থাকবেন।’
আজিজ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে। ফিরে গেল মনে অসংখ্য সংশয় আর প্রশ্ন নিয়ে।

রুদ্র আজ বের হচ্ছে। শরীর এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি ওর। প্রিয়তা বারবার নিষেধ করার সত্ত্বেও শোনেনি। শুধু বলেছে, গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ আছে ওর। বের হওয়া জরুরি। প্রিয়তা জানে এক্ষেত্রে রুদ্র ওর কথা শুনবেনা। তাই আর জোর করেনি। রুদ্রকে জ্যাকেটটা পরিয়ে দিতে দিতে আরেকবার বলল, ‘এ শরীর নিয়ে বের হতেই হবে?’

মাথা ঝাঁকাল রুদ্র। মুখে কিছু বলল না। প্রিয়তা আবার বলল, ‘নীরবের সঙ্গে কিছু করার কথা ভাবছেন নাতো?’
রুদ্র বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘এখনই না। তবে একবার ওকে আমার মুখোমুখি হতেই হবে। জবাব দিতে হবে, যেকোন পরিস্থিতিতে ধরে রাখার সাহস যখন নেই।ছেড়েই যখন দেবে। ভালোবাসার দোহাই দিয়ে সে হাত ধরল কেন?’

প্রিয়তা রুদ্রর কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলল, ‘ভালোবাসলেই কী সব পরিস্থিতিতে হাত ধরে থাকা যায়?’
রুদ্র প্রিয়তার দু কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘শুধুমাত্র ভালোবাসলেই সব পরিস্থিতিতে হাত ধরে থাকা যায়। নিজেকেই দেখো।’
প্রিয়তা রুদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। রুদ্র প্রিয়তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘সাবধানে থেকো। আর আমার বাচ্চার খেয়াল রেখো।’

প্রিয়তা মাথা ঝাঁকাল। বরাবরের মতো রুদ্রর গালে চুমু খেয়ে বিদায় দিল তাকে।
রাশেদের কেবিনে ত্রিকোণ ভঙ্গিতে বসে আছেন রাশেদ, রুদ্র এবং জাফর। প্রায় আধঘন্টা যাবত চুপচাপ বসে আছে তিনজনই। পরপর তিনটে সিগারেট শেষ করে ফেলেছেন রাশেদ। চতুর্থ সিগারেট হাতে নিয়ে বললেন, ‘নোটিস পেয়েছো?’
রুদ্র হালকা নড়ে উঠলো। গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল এতক্ষণ। নোটিস টা ওর হাতেই ছিল।

আরেকবার নোটিসটার দিকে চোখ বুলিয়ে তাকাল রাশেদের দিকে। মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝাল, হ্যাঁ দেখেছে। রাশেদ ঠোঁটের মাঝে সিগারেটটা চেপে ধরেই বললেন, ‘এটা তাদের নোটিস যাদের কাছ থেকে আমরা মাল ডেলিভারী নিতাম। যারা আমাদের কাছ থেকে মালগুলো নিতো তারাও নোটিস্ পাঠাবে। খুব দ্রুত। আর টাকাগুলো আমাদের দিতে হবে।’

জাফর কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বলল, ‘কিন্তু ফান্ডে যে টাকাগুলো আছে তাতেতো_’
‘পুরো আমের ফাউন্ডেশন ফাঁকা হয়ে যাবে।’ গম্ভীর কন্ঠে জাফরের অসম্পূর্ণ কথাকে সম্পূর্ণ করল রুদ্র। কাগজগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘শুধু তাই নয়, আমাদের মিলস্ আর ফ্যাক্টরিগুলোও নিলামে তুলতে হবে। তাতেও সবটাকা জোগাড় হবে কি-না যথেষ্ট সন্দেহ আছে তাতে।’

পলকহীন চোখে রইল জাফর। মাথা কাজ করছেনা তার। কোনরকমে বলল, ‘যদি সময়মতো টাকা না দেই?’
‘এই লাইনে এমন ঘটনা ঘটলে কী হয় সেটা তোমার অজানা নয়, কাকা।’

নিমেষেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল জাফরের মুখ। আন্ডারওয়ার্ল্ডের বেশ পুরনো কিন্তু প্রচলিত একটা নিয়ম আছে। এরকম ঘটনা ঘটলে সেসকল কালোবাজারের মালিকরা একত্রে দল গঠন করে। এবং প্রতারণাকারী দলকে সমূলে উপড়ে ফেলে। সমন্বিতভাবে গঠিত দলগুলোর ক্ষমতা প্রচুর। ঐ অবস্থায় পাতালে গিয়ে লুকিয়েও কেউ বাঁচতে পারেনা। মৃ/ত্যু নিশ্চিত। এটাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্য। এক্ষেত্রে কেউ কোনরকম সাহায্য করবে না। কেননা লাভ ছাড়া এখানে কেউ এক পাও ফেলেনা। এক পাও না।

নিজেকে সামলে নিয়ে জাফর বলল, ‘কিন্তু কিছুতো একটা করতে হবে। এভাবে সবটা শেষ হয়ে যেতে দিতে পারিনা আমরা।’
রুদ্র গম্ভীর মুখ করে ভ্রু কুঁচকে বসে রইল কয়েক সেকেন্ড। কিন্তু অবস্থা পরিবর্তনের কোন উপায় নেই। কিছু একটা বলার জন্যে রাশেদের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল ও। অনেক বছর হল এই জগতে আছে। অনেক ওঠানামা হয়েছে।

অনেক সমস্যায় পড়েছে। এমন অনেক মিটিংও হয়েছে। কিন্তু রাশেদকে এভাবে কখনও দেখেনি। কপালে ভ্রুকুটি। অন্যমনস্ক। হাতে জ্ব/লতে থাকা সিগারেট অর্ধেকের বেশি পু/ড়ে লম্বাটে ছাই হয়ে জমে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে একটা কথাও শুনছেন না উনি।

অর্থাৎ, রাশেদ পরিস্থিতিকে হাতের বাইরে মনে করছেন? বুঝে গেছেন এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই! সবকিছু শেষ! ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল রুদ্র। রাশেদ আমের হাল ছেড়ে দিয়েছেন! এর অর্থ জানে ও। কিন্তু মানতে পারছেনা। এভাবে সব শেষ হয়ে যেতে পারেনা। কিছু একটা করতে হবে। জীভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘বাবা।’

রাশেদ জবাব দিলেন না। নড়লেনও না। একই ভঙ্গিতে বসে আছেন। ব্যপারটা জাফরও খেয়াল করল। অবাকও হলো। রুদ্র আরেকটু জোরে ডাকল, ‘বাবা?’

অদ্ভুত ভঙ্গিতে চমকে উঠলেন রাশেদ। নির্বোধের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন রুদ্রর দিকে। পু/ড়তে থাকা সিগারেটটার দিকে একবার তাকিয়ে অ‍্যাশট্রেতে গুঁজে রাখলেন। শিরদাঁড়া সোজা করে বসে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘বলো, শুনছি।’
রুদ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে। যা বলতে চাইছিল তা আর বলল না। কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কিছু করা যায় কি-না।’

রাশেদ জবাব দিলেন না। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘উচ্ছ্বাস কোথায়?’
জাফর বলল, ‘জানিনা, ভাইজান। ইদানিং বাড়িতে খুব একটা পাওয়া যায়না ওকে। কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে ও-ই জানে। আমি একটা ফোন করে দেখছি।’

রাশেদ কিছু বললেন না। জাফর কল করল উচ্ছ্বাসকে। কিন্তু লাইন পেলো না। রুদ্র গম্ভীরমুখ করে ভাবছে কিছু একটা। তারমধ্যেই রাশেদ বললেন, ‘ফান্ডে কত আছে, আর কার কার কাছ থেকে কত টাকা পাওনা আছে চেক করে দেখো। মোট এমাউন্ট টা বলো আমাকে।’
রুদ্র বলল, ‘আমি ইকবা_ মানে আমরা দেখে নিচ্ছি।’

ইকবালের নাম নিতে গিয়েও থেমে গেল রুদ্র। আগে টাকা পয়সার হিসেব, দেখাশোনা ইকবাল করতো। লোকটা যেন হঠাৎ কর্পূরের মতোই উবে গেল। সোলার সিস্টেমের সঙ্গে বহু বছরের সম্পর্ক ছিল তার। হঠাৎ কেন এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। কেন তথ্যপাচার করেছিল।

আর হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল। আদোও বেঁচে আছে কি-না। সবটাই রহস্য।
রাশেদ আবার বলল, ‘পাশের ঘরে তিন নম্বর আলমারির প্রথম ড্রয়ারে কিছু কাগজ আছে। সেখানে আরও কিছু ফাইল আছে। ওগুলো বের করে দেখে নিও। ওখানে বেশ কিছু টাকা আর লেনদেনের হিসেব রাখা আছে। ওগুলোর কথা আমি ছাড়া আর কেউ জানতোনা।’

জাফর বলল, ‘আপনি তো আছেনই ভাইজান। আমাদের দেখার কী দরকার? ‘
‘কোন কিছুই শাশ্বত নয়। সেটা এখনো বুঝিস নি? কখনও ভেবেছিলি এই দিন আসবে? এসেছেতো! এখন এমন অনেক কিছুই হবে যা কেউ কখনও ভাবেনি। তাই শারীরিক এবং মানসিক দুইভাবেই সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে হবে। যেকোনো ঘটনাকে মেনে নেওয়ার জন্যে।’

রুদ্র কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। কারো দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল চুপচাপ।

সদা প্রাণোচ্ছল আমের ভিলা হঠাৎ কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমের পরিবারের বাইরের জগতটা যতই অন্ধকারাচ্ছন্ন হোক, অন্দরমহল সবসময়ই ঝলমলে আলো ছিল। কিছুদিন আগেও বাড়িটা কতো হাসিখুশি ছিল। বিয়ের আনন্দ, কেনাকাটা, দুষ্টুমি। কিন্তু সেই আনন্দের উজ্জ্বল সূর্যে গ্রহন লেগে গেল।

ভয়ানক গ্রহন। এই গ্রহন কবে কা/টবে, আদোও কা/টবে কি-না। কারো জানা নেই। ভেতরে ভেতরে এক দীর্ঘশ্বাস চেপে কুহুর ঘরের ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। কুহু বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। খোলা জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে।

নীরবের বাবা-মা বিয়েটা ভেঙ্গে চলে যাওয়ার পর নীরবেরও আর দেখা পাওয়া যায়নি। ওরা ভেবেছিল নীরব আসবে। আর যাই হোক নীরব কুহুর কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবেনা। কিন্তু এতকিছুর পরেও নীরবের কোন দেখা না পেয়ে বুঝল হয়তো নীরবও চায়না বিয়েটা করতে।

সেটা আরও নিশ্চিত হলো যখন দেখল, ফোনেও কোনরকম যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা ওর সাথে। বাস্তব দৃষ্টিতে দেখলে বেশিরভাগ ছেলের সিদ্ধান্ত হয়তো এমনই হতো। কিন্তু নীরবকে সত্যিই অন্যরকম মনে হয়েছিল। কিন্তু ওও যে এরকমভাবে মাঝপথে কুহুর হাত ছেড়ে দেবে সেটা কেউ কল্পনাও করেনি।

দুটো দিন কাটতেই কুহুও কীভাবে যেন ব্যপারটা বুঝে গেল। ছটফট করতে করতে ভীষণ কেঁদেছিল মেয়েটা সেদিন। প্রিয়তা, জ্যোতি, উচ্ছ্বাস মিলে সারাক্ষণ চেষ্টা করে যাচ্ছে মেয়েটাকে স্বাভাবিক রাখার। ওর জীবনের তিক্ত সত্যগুলোকে ভুলিয়ে রাখার। কিন্তু বিশেষ কোন লাভ হচ্ছেনা।

যত দিন যাচ্ছে ততই ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ছে মেয়েটা। সেই শিশুসুলভ চোখদুটোর নিচে কালি পড়ে গেছে, চুপসে গেছে সুন্দর মুখটা। কদিনেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেন। রুদ্র খুব একটা আসেনা কুহুর সামনে। কুহুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয় ওর। ভাই হিসেবে চরম ব্যর্থ মপে হয়। তাইতো মনে মনে এক ভ/য়ানক প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে। যতদিন না সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে পারছে, কুহুর সামনে আগের মতো মাথা উঁচু কর‍ে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াবেনা সে।

প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই উচ্ছ্বাস এসে ঘরে ঢুকল। কুহুকে ভালোভাবে একবার দেখে নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাঁচাল। অর্থাৎ, কী অবস্থা? প্রিয়তা কাঁধ ঝাকাল। উচ্ছ্বাস আস্তে আস্তে গিয়ে বসল কুহুর পাশে। প্রিয়তাও বসল। কুহুর কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা তাতে। ও এখনো তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। উচ্ছ্বাস বলল, ‘জন্মদিনে ড্রয়িং সেট চাই, ড্রয়িং সেট চাই করেতো মা/থা খাচ্ছিলি। এইযে এতোগুলো ড্রয়িংসেট এনে রেখে দিলাম। সেগুলোর দিকেতো ফিরেও তাকাচ্ছিস না। আমার টাকাগুলো জলে গেল!’

কুহু কিছুই বলল না। উচ্ছ্বাস খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘কথা বলবিনা? একদিকে ভালোই হয়েছে, বুঝলে বউমণি। এমনিতেও ওর ঐ ডান্সিং ল্যাঙ্গুয়েজের এক লাইন বুঝতে আমার পাঁচ মিনিট লেগে যেতো।’
প্রিয়তা কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আচ্ছা। ওর ড্রয়িং সেটগুলো না হয় পছন্দ হয়নি। কিন্তু আমি যে এতো কষ্ট করে কক্সবাজারে রোদে ঘুরে ঘুরে এতোগুলো ঝিনুকের মালা কিনে আনলাম। পরে দেখাবেনা আমায়?’

কুহুর কোন সাড়া পাওয়া গেলোনা। হাল ছাড়ল প্রিয়তা আর উচ্ছ্বাস। এরমধ্যেই কুহুর জন্যে খাবার নিয়ে এলো জ্যোতি। চোখের ইশারায় জানতে চাইল কোন উন্নতি হলো কি-না। প্রিয়তা চোখের ইশারাতেই নিরাশ করল জ্যোতিকে। জ্যোতি একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে খাবারের ট্রে টি-টেবিলে রাখল।

কুহুকে খাওয়ানোর প্রস্তুতি নেবে তখনই ওদের সবাইকে চমকে দিয়ে কুহুর ঘরে এসে উপস্থিত হলেন রাশেদ। ওনাকে দেখে কুহু বাদে ওরা সবাই দাঁড়িয়ে গেল। তিনজনই যে ভীষণ অবাক হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ’কদিন মেয়ের সামনে ভুল করেও আসেন নি সে। ঘরে ভেতরে খানিকটা এগিয়ে এলেন রাশেদ। টি-টেবিলে রাখা খাবারের দিকে একবার তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘ওক আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তোমাদের এখানে থাকতে হবেনা। যাও।’

আরেকদফা অবাক হল প্রিয়তা, উচ্ছ্বাস আর জ্যোতি। এমন কিছু আশা করেনি মোটেই। কিন্তু রাশেদের আদেশ মেনে মাথা নিচু করে চুপচাপ বেরিয়ে গেল রুম থেকে। রাশেদ কুহুর দিকে তাকিয়ে দেখল কুহু এখনো সেভাবেই বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। যে মেয়ে রাশেদের কাছ থেকে সামান্য সময় পেলে খুশিতে লাফিয়ে উঠতো।

রাশেদ নিজে ওর রুমে এসেছে অথচ মেয়েটা নড়ছেও না। বুকের মধ্যে ভীষণ ভারী কষ্ট অনুভব করল রাশেদ। মনে হলো যেন এতোদিন দূরে সরে থাকা সব বার্ধক্য একসঙ্গে তার শরীরে এসে বাসা বেঁধেছে। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে সামলে নিয়ে বসল কুহুর পাশে। আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকল, ‘কুহু, মা?’

নিজের কন্ঠস্বর নিজের কাছেই কেমন অদ্ভুত লাগল রাশেদের। কুহুও কেমন হালকা নড়ে উঠল। কিন্তু ফিরে তাকাল না রাশেদের দিকে। রাশেদ বুকে ব্যথা বাড়ছে। ইদানিং বেশ ঘনঘনই ব্যথা হচ্ছে বুকে। কাউকে বুঝতে দিচ্ছেনা সে। নিজেকে স্বাভাবিক করে সে আবার বলল, ‘বাবার সাথে কথা বলবিনা, মা? এতো অভিমান?’

বাবার ভাঙা কন্ঠের করুণ আহ্বান উপেক্ষা করতে পারল না কুহু। ফিরে তাকাল রাশেদের দিকে। মুহূর্তেই চোখভর্তি জল এসে জমা। বহু আকাঙ্ক্ষিত বাবার কোমল স্নেহ পেয়ে ট
ঠোঁট ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলল কুহু। রাশেদ বলল, ‘বাবাকে ক্ষমা করে দিও, মা। তোমার বাবাই তোমার সবচেয়ে বড় অপরাধী।’

বিছানায় ভর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে রাশেদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুহু। নিঃশব্দ কান্নায় নিজের সকল কষ্ট, দুঃখ, অভিযোগ, অভিমান ঢেলে দিল বাবার বুকে। জানল না ওর বিলিয়ে দেওয়া দুঃখ, কষ্ট, অভিযোগ, অভিমানের ভারে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এক অনুতপ্ত পিতার বৃদ্ধ বক্ষ। কিন্তু নীরবে তা মেনে নিলেন রাশেদ।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৭ শেষ অংশ

সন্তানের সমস্ত যন্ত্রণার ভার বয়ে বেড়ানোতেও যেন বাবারা অদ্ভুত সুখ খুঁজে পান। সে সুখের মাপদন্ড হয়না। আজ বহুবছর পর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলেন সোলার সিস্টেমের সেই দৃঢ়, গম্ভীর, বজ্রকন্ঠী কর্ণধার।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৯