অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

রুদ্র! নামটার মধ্যেই যেন এক ভয়ংকর তান্ডব লুকিয়ে আছে। যে নামটা শুনলে ক্ষণিকের জন্যে হলেও সবাই শান্ত স্হির হয়ে যায়। ঠিক যেমনটা এখন হল। উপস্থিত সবাই অল্প কিছুক্ষণের জন্যে হলেও চুপ ছিল। এমনটাই বোধ হল তুহিনের। কয়েক সেকেন্ড থম মেরে বসে থেকে মুহূর্তেই আবার নিজেকে একদম স্বাভাবিক করে ফেলল সে। চায়ের কাপে আরও একটা চুমুক দিয়ে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ কে এই রুদ্র?’
ইন্সপেক্টর আজিজ, তমাল ও ফারিয়ার দিকে একবার চোখ বুলাল, তারপর ফারুকের দিকে তাকাল যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চলেছে। অতঃপর লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
‘ রুদ্র? এইসময়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে বড় নাম। দ্যা সোলার সিস্টেম গ্রুপ লিডারের একমাত্র ছেলে। ঐ গ্রুপের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল ও। গুলশানের মোটামুটি সবাই ভয় পায় ওকে। অন্যসব গ্রুপের জন্যেও রুদ্র একটা আতঙ্কের নাম।’
ব্যপারটা তুহিনকে অবাক করল না। এরকম খুনের জন্যে প্রথম সন্দেহই যাকে করা হয়েছিল সেই লোকটা ভয়ংকর কেউ হবে এটাই স্বাভাবিক। কোন সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই পরপর সাতটা খুন এতো নিখুঁত পদ্ধতিতে, কোন প্রমাণ না রেখে এতো সহজেই করতে পারত না। তমাল জিজ্ঞেস করল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ এতো বড় একজন আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী কিন্তু আমাদের ডেটা রেকর্ডে এখনো নাম নেই? এটা কী করে সম্ভব?’
আজিজ খানিকটা হাসল। যেন তমাল খুব বোকা বোকা একটা প্রশ্ন করেছে। কিন্তু সে এটাও জানে প্রশ্নটা যৌক্তিক। কারণ তমাল এটা জানেনা রুদ্র ঠিক কে এবং কী। ইন্সপেক্টরকে হাসতে দেখে তমাল একটু বিরক্ত হল। আশ্চর্য! ও কী হাসার মতো কিছু বলেছে? তুহিন নিজেও ভ্রু কুঁচকে ফেলল আজিজের হাসি দেখে। ইন্সপেক্টর আজিজ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা রেখে বলল,
‘ আজ অবধি ওকে এরেস্ট করার সৌভাগ্য আমাদের হয়ে ওঠেনি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি, প্রাণপণে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছু করতে পারিনি।’

তুহিন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইন্সপেক্টরের দিকে। আজিজ রহমানের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হল। দু হাত একত্রিত করে কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,
‘ ওর শরীরের প্রতিটা শিরায় সন্ত্রাসীর রক্ত বইছে স্যার। প্রত্যেকটা কাজ এতো নিখুঁতভাবে করতো আমরাও হা করে থাকতাম যে ঠান্ডা মাথায় এতো ভয়ংকর অপরাধগুলো অনায়াসেই একটা মানুষ কীকরে করতে পারে!’
তুহিন ঠোঁটের কোণে সামান্য তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ একজন সৎ ইন্সপেক্টরের মুখে একজন জাত সন্ত্রাসীর প্রশংসা? ইন্টারেস্টিং!’
কথাটা বলে তুহিন আবার সেই ফাইলে একবার চোখ বুলালো যে ফাইলে সেই ঘটনার বিস্তারিত লেখা আছে যে ঘটনার পর অশান্ত গুলশান হঠাৎ করেই শান্ত হতে শুরু করল। ফাইলটা বেশ কিছুক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে আবার ইন্সপেক্টরের দিকে চোখ তুলে তাকাল তুহিন। এরপর বলল,

‘ রুদ্রকে এখন কোথায় পাব?’
ইন্সপেক্টর হতাশাপূর্ণ এক নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,
‘ বললাম না। হঠাৎই গুলশান শান্ত হয়ে গেছে। এখন এখানে নেই ও।’
‘ আর ওর গ্রুপের বাকিরা?’
‘ আমার চেনাজানা কাউকে এখন দেখতে পাইনা। য‍দিও দু একজনকে হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাই। কিন্তু ওদের জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। রুদ্র সম্পর্কে ওরা এখন আর কিছুই জানেনা।’
তুহিন কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খানিকটা ভেবে বলল,

‘ ওর নাম্বারও নিশ্চয়ই বন্ধ। আচ্ছা, ওর কোন ছবি হবে আপনার কাছে?’
‘ থাকার কথা। দাঁড়ান দেখছি। ফারুক?’
বলে সে এসআই ফারুকের দিকে তাকাল। ফারুক তার ইশারা বুঝতে পেরে বেরিয়ে চলে গেল। তুহিন বুঝল ফারুক ছবি খুঁজতে যাচ্ছে। সে আবার ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ প্রথম খুনটা পিঙ্ক সিটিতে হয় তাইতো?’
‘ জি।’

ইন্সপেক্টর অপেক্ষা না করে সাথেসাথেই জবাব দেয়। তুহিন আবার প্রশ্ন করে,
‘ এরপর যখন রুদ্রকে সন্দেহ হল তখন ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন নি? বা নজরে রাখেন নি?’
আজিজ রহমান কিছুক্ষণ চুপ রইল। ভেতরে ভেতরে যে অস্হির হয়ে পড়ছে লোকটা বুঝতে পারছে তুহিন। তবুও তাড়া না দিয়ে চুপচাপ বসে রইল ইন্সপেক্টরের উত্তরের অপেক্ষায়। আজিজ রহমান নিজের গোঁফে ডান হাতের বৃদ্ধা আর তর্জনী আঙুল বুলিয়ে বলল,

‘ ওকে আমি খুঁজে পাইনি। ইভেন ওদের বাংলোতে এখনো তালা দেওয়া।’
হেসে ফেলল তুহিন। যেন ইন্সপেক্টর কৌতুক বলেছে। এরপর টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট টা নিজের দিকে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
‘ আর আপনি বলছেন খুনগুলো ও করেনি?’
আজিজ রহমান আবারও অস্হির হয়ে উঠল। কপালের রেখা গভীর হওয়ার সাথেসাথে হালকা ঘামও বের হচ্ছে। যেন ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে সে। তুহিন সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে সেসব। আজিজ চোখ বন্ধ করে লম্বা করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,

‘ হ্যাঁ বলছি। গোটা পুলিশ টিমের ধারণা খুনগুলো কানেক্টেড। দুদিনের তদন্তে আপনারাও বলছেন খুনগুলো কোন না কোনভাবে কানেক্টেড। কিন্তু আমি বলছি দ্বিতীয় এবং মীরপুরে হওয়া খুনটা রুদ্রের পক্ষে করা সম্ভব না। অর্থাৎ খুনগুলো যদি একজনই করে থাকে তাহলে রুদ্র খুন করেনি।’
তমাল এবার খানিকটা রেগে গিয়ে বলল,
‘ বারবার একই কথা বলছেন। সম্ভব না, সম্ভব না। কেন সম্ভব না? ওরা সন্ত্রাসী। স্বার্থের জন্যে নিজের পরিবারকেও খুন করে ফেলতে পারবে। আর আপনি_’

‘ তমাল!’
তমাল কথাটা শেষ করার আগেই তুহিনের নির্দেশে থেমে যেতে হল ওকে। তুহিন এবার পেপার ওয়েটটা হাতে চেপে ধরে বলল,
‘ আচ্ছা ঠিকাছে। কিন্তু খুনটা কে করেছে সেটা জানাও তো জরুরি তাইনা? আমার কাজই সেটা।’
মাথা নাড়ল আজিজ রহমান। এরমধ্যেই ফারুক চলে এলো রুমে। আজিজ রহমানের দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ স্যার রুদ্রের কোন ছবি পেলাম না। অনেক আগে রাখা ছিল। মাঝে কয়েকবার সব জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করা হয়েছে এরমধ্যেই হয়তো_’

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আজিজ রহমান রেগে গিয়ে বলল,
‘ এতো ইরেস্পন্সিবল কেন তোমরা? এগুলো যেকোনো মুহূর্তে যে কারো প্রয়োজন হতে পারে এটা তোমাদের অজানা?’
ফারুক মুখ কাঁচুমাচু করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তুহিন বলল,
‘ আচ্ছা, কোন সমস্যা নেই। রুদ্রকে আপনারা খুব ভালো করেই চেনেন। এসআই সাহেব একজন প্রফেশনাল আর্টিস্টকে ডাকুন। রুদ্রের একটা স্কেচ বানানোর ব্যবস্থা করুন। যত দ্রুত সম্ভব।’

এসআই মাথা নেড়ে চলে গেল। আজিজ রহমান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুহিনের দিকে। এখানে এসে থেকে কত ঠান্ডা মাথায় কথা বলছে ছেলেটা। এতক্ষণে বিরক্তি ফুটে ওঠার কথা ছিল তার মুখে, রাগের বহিঃপ্রকাশ হওয়াটাও অস্বাভাবিক ছিলোনা। কিন্তু কী শান্ত ভাবেই না সবটা হ্যান্ডেল করছে। এটাই কী তবে চিফ ইনভেস্টিগেটর তুহিনের বিশেষত্ব? আজিজের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে তুহিন বলল,

‘ তো ইন্সপেক্টর? ওনারা রুদ্রের স্কেচটা বানাতে বানাতে বেশ অনেকটা সময় লেগে যাবে। এদিকে আমার হাতে কোন ক্লু ও নেই যেটা ধরে এগোবো। তাই ভাবছি অন্যকিছু করা যাক। আপনি ফ্রি তো?’
আজিজ রহমান কিছু বুঝল না। সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘ আপনাকে সবরকম সাহায্য করাটাও আমার ডিউটির মধ্যে পড়ছে। কিন্তু আপনি কী করতে চাইছেন?’
তুহিন খানিকটা আলসেমি ঝেড়ে বলল,

‘ গল্প শুনতে চাইছি। এই অবসর সময়টা কাটাবো কীকরে? তাই ভাবলাম গল্প শুনে কাটাই?’
বলে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাল তুহিন। ফারিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। তমাল ঠোঁট চেপে হাসছে। কারণ তুহিনের এরকম অদ্ভুত কর্মকাণ্ড ওর কিছুটা হলেও পরিচিত। আজিজ রহমান হালকা গলা ঝেড়ে বলল,
‘ গল্প?’

তুহিন সোজা হয়ে বসে মুখে সুন্দর এক হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
‘ হ্যাঁ গল্প। আমার কেসের মধ্যে আচমকাই ঢুকে পড়া রুদ্র নামক এই নতুন চরিত্রের গল্প শুনতে চাই আমি। তার সাথে দ্যা সোলার সিস্টেম গ্রুপের গল্পও জানা প্রয়োজন। এবার আপনি আমাকে বলবেন,আমাকে একদম শুরু থেকে এই গল্প কে শোনাতে পারবে।’
আজিজ রহমান বলল,

‘ এই কেসের জন্যে আপনি সেই শুরু থেক‍ে গল্প শুনতে চাইছেন। ওয়েস্ট অফ টাইম মনে হচ্ছেনা?’
তুহিন মাথা নুইয়ে হাসল। তারপর চোখ তুলে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে কৌতুকের স্বরে বলল,
‘ মেই বি, ওর মেই বি নট।’
এরপর আবার কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বলল,
‘ আছে এমন কেউ?’

আজিজ রহমান ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কিছুক্ষণ ধরে রেখে বসে রইল। তমাল বিরক্ত হচ্ছে, ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। এই লোক সাথেসাথে কথা বলতে পারেনা? একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার পর এরকম দু-তিনমিনিটের মৌনব্রত রাখার মানে কী? তুহিন স্যার কীকরে এতো ঠান্ডা মাথায় সামলাচ্ছে? কিন্তু ফারিয়া ভাবলেশহীনভাবে বসে আছে। যেন সারাদিন ওকে এভাবে বসিয়ে রাখলেও ওর কোনো সমস্যা নেই। তমাল আড়চোখে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ টিউবলাইট একটা।’

ফারিয়া শুনতে পেলেও কোন প্রতিক্রিয়া করল না। এই মানকি ম্যানকে নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় ওর নেই। এরমধ্যেই তুহিন একবার নিজের হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ লাঞ্চ টাইম হয়ে এসেছে। বড্ড খিদেও পেয়েছে। আশেপাশে কোন রেস্টুরেন্ট নেই ইন্সপেক্টর সাহেব?’
এতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছিলো আজিজ। তুহিনের কথায় ধ্যান ভাঙল তার। ইতস্তত করে বলল,
‘ কিছু বললেন?’

তুহিন আবার বলল,
‘ রেস্টুরেন্ট নেই আশেপাশে? খিদে পেয়েছে।’
আজিজ রহমান একবার ঘড়ি দেখে বলল,
‘ লাঞ্চেরও সময় হয়ে গেছে। আমার খেয়ালই ছিলোনা। সো সরি। আমি আপনাদের খাওয়ার ব্যবস্হা করছি।’
তুহিন ইন্সপেক্টরের ব্যস্ততা দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ ব্যস্ত হবেন না। আমরা থানায় খাবোনা, বাইরেই খাবো। আপনিও আমাদের সাথে আসলে ভালো হয়। সময় নষ্ট না করে খেতে খেতে বাকি কথা হোক?’

আজিজ রহমান কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন তুহিনের দিকে। বারণ করা সম্ভব নয় এখন আর। তাই মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ আপনার গিয়ে গাড়িতে বসুন আমি আসছি।’
তুহিন উঠে দাঁড়াতেই তমাল আর ফারিয়াও উঠে দাঁড়াল। থানা থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির কাছে দাঁড়াল ইন্সপেক্টরের অপেক্ষায়। রোদ পড়েছে তাই রোদচশমাটা চোখে পরে নিল তুহিন। ফারিয়া আড়চোখে একবার লক্ষ্য করল ব্যাপারটা। তমাল বলল,
‘ স্যার, ইন্সপেক্টরের কথাগুলো অদ্ভুত লাগল না? একেতো প্রতিটা উত্তর দিতে এতো সময় নিচ্ছিলেন তারওপর কীরকম অদ্ভুত কথা বলছিলেন।’

তুহিন গাড়ির আয়নায় তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলল,
‘ আমি খেয়াল করেছি ব্যাপারটা। লোকটার পেট থেকে একপ্রকার জোর করেই কথা বের করছি। ফাইন, এটা করতে আমার মন্দ লাগেনা। দেখা যাক পরে কী হয়।’
হঠাৎ তুহিনের ফোন বেজে ওঠে। তুহিন ফোনটা পকেট থেকে বের করে তমাল আর ফারিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে দূরে সরে গেল। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলল,
‘ ইনভেস্টিগেটর মহাশয়? সারাদিন ঘুরে ঘুরে কাজই হচ্ছে নাকি খাওয়া দাওয়াও কিছু হয়েছে?’
তুহিন হেসে দিয়ে বলল,

‘ খাওয়া এখনো হয়নি ইরাবতী। এইতো খেতেই যাচ্ছিলাম আর ম্যাডামের ফোন। তো ম্যাডাম কী খেয়েছে?’
‘ না খায়নি, এখন খাবে। তো স্যার কোথায় আছে এখন?’
‘ গুলশান থানা।’
‘ সাথে কে কে আছে?’
‘ তমাল আর ফারিয়া।’
ফারিয়া নামটা শুনেই ইরার কপাল কুঁচকে গেল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ ঐ ফরেনসিকের মেয়েটা না? তোমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে?’
তুহিন একপ্রকার বিষম খেল যেন। অবাক কন্ঠে বলল,

‘ ছিঃ ইরা? এসব কী ধরনের কথা?’
ইরা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
‘ দেখ, একদম সাধু সাজতে আসবে না। ঐ মেয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে সেটা তুমি নিজেও বোঝ। ন্যাকা সাজছো? নাকি ইনজয় করো ব্যাপারটা? হ্যাঁ? সব পুরুষই একরকম। চরিত্রহীন! ওকে কেন এনেছো সাথে?’
তুহিন এতক্ষণ বোকার মতো শুনছিল কথাগুলো। মেয়ে মানুষের মধ্যে জেলাসি নামক বস্তুটা একটু বেশিই কাজ করে। কোন অনুষ্ঠানে পোশাক কারো সাথে মিলে গেলে ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলার জোগাড় হয়। আর ব্যপারটা বয়ফ্রেন্ড বা স্বামী সংক্রান্ত হলেতো কথাই নেই। একটা লম্বা শ্বাস ফেলে তুহিন নরম কন্ঠে বলল,

‘ দেখ, ও এখানে শুধুমাত্র ওর কাজেই এসেছে। আর আমিও কাজ ছাড়া ওর সাথে কোন কথা বলছিনা। ট্রাস্ট মি।’
ইরা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ না বললেই ভালো। আচ্ছা লাঞ্চ কর তুমি। রাখছি, বাই।’
তুহিন নরম কন্ঠে বলল,
‘ বাই।’
ফোনটা কেটে পেছনে ঘুরে দেখে আজিজ রহমান চলে এসেছেন। ওর জন্যেই অপেক্ষা করছেন হয়তো। ও দ্রুত পায়ে গাড়ির কাছে গিয়ে বলল,
‘ সরি ফর দ্যা কল ইন্সপেক্টর। যাওয়া যাক?’
ওরা সবাই মাথা নাড়ল। চারজনেই গাড়িতে ওঠে বসার পর গাড়ি ছুটল তার নিজের গন্তব্যে।

গুলশান শাখার সুলতান’স ডাইন নামক রেস্টুরেন্টের এক কর্ণারের টেবিলটাই বসার জন্যে বেছে নিয়েছে তুহিন। ঐদিকে লোকজন কম। টেবিলের একপাশে তুহিন আর ফারিয়া আরেক পাশে তমাল আর আজিজ রহমান বসেছেন। খাবার অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে আরও আগেই শুধু আসা বাকি। তুহিন, তমাল, আজিজ তিনজনেই মোরগ পোলাও অর্ডার করেছে আর ফারিয়া নিয়েছে মাটন তেহারি। খাবার আসতে বেশি সময় লাগল না। ওয়েটার টেবিলে খাবার রেখে যাওয়ার পর তুহিন কোনদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ খেতে থাকল। বাকিরাও তাই করল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চারজনের জন্যেই কোমলপানীয় অর্ডার করে আজিজ রহমানের দিকে তাকিয়ে তুহিন বলল,

‘ ইন্সপেক্টর সাহেব, বললেন না যে কার কাছ থেকে গল্পটা শুনতে পারব?’
আজিজ রহমান একটু চিন্তা করে বলল,
‘ আসলে এই সোলার সিস্টেম গ্রুপের কাহিনী অনেকটা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। কেউই এই কাহিনী ফার্স্ট টু লাস্ট বলতে পারবেনা। যারাই জানে কোন না কোন অংশ জানে, পুরোটা না। তাই রুদ্রের পুরো গল্পটা আপনি যেকোন একজনের মুখে শুনতে পারবেন না। একমাত্র রুদ্র ছাড়া।’

‘ এই খন্ড খন্ড অংশগুলোই কে কে জানে?’
‘ অনেকেই আছে। তারমধ্যে আমিও একজন।’
অবাক হল তুহিন। চামচটা প্লেটের ওপর রেখে বলল,
‘ আপনি জানেন?’
আজিজ রহমান বলল,

‘ কিছুটা। কেসের জন্যে জানতে হয়েছিল।’
তুহিন একবার তমাল আর ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে এরপর আজিজ রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমি সেই কিছুটাই শুনতে চাই।’
আজিজ রহমান টেবিলে হাত রেখে নিজের হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ রুদ্র নামক ঐ ছেলেটার স্বভাব অদ্ভুত ছিল। যতটা নির্ভীক ছিল ততটাই হিংস্র। আন্ডারওয়ার্ল্ডেই না এর বাইরেও যারা ওকে চিনতো সবাই ওকে হার্টলেস বলতো। হৃদয়হীন! যদিও ঐ লাইনের সবাই হৃদয়হীনই হয়। কিন্তু ও সম্ভবত একটু বেশিই ছিল। জোয়ান ছেলে রক্ত গরম ছিল। এতো অল্পবয়সে এতো ক্ষমতা হাতে পেলে যা হয় আরকি।’

এরমধ্যে কোমলপানীয় চলে এলো। ওরা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কথাগুলো। ওয়েটার আসায় সেটাতে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটল। ওয়েটার চলে যেতেই তুহিন আবার আজিজের দিকে তাকাল। আজিজ আবার বলতে শুরু করল,
‘ কিন্তু এই বেপরোয়া ছেলেটা একমাত্র একজনেরই বাধ্য ছিল। একজনেরই কথা শুনতো।’
তুহিন অনেকটা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কে সে?’
‘ রুদ্রর জন্মদাতা। রাশেদ আমের।’

প্রায় দুই বছর আগে- গুলশান
গুলশান, যার মানে ফুলের বাগান। রাজধানীর চাকচিক্যপূর্ণ এই আধুনিক শহর একসময় পরিচিত ছিল ‘ভোলা গ্রাম’ নামক একটি গ্রাম হিসেবে। করাচির একটি শহরের অনুকরণে গ্রামটি তৈরি করতে গিয়েই এর নামকরণ হয় গুলশান। শোনা যায় গত শতকের মাঝামাঝি সময়ের দিকেও এই এলাকা ছায়াঘেরা নির্জন ছিল। কিন্তু এখন গুলশান একের পর এক উঁচু উঁচু দালানে পূর্ণ এক চমৎকার শহর। তবে প্রদীপের নিচেও যেমন অন্ধকার আছে তেমনই এই জনবহুল ঝলমলে রাজধানীতেও রয়েছে অন্ধকার বিষাক্ত জগৎ। সেসব জগৎ কারো চেনা, কারো অচেনা।

কারো কাছে কেবলই সিনেম্যাটিক কল্পকথা, কারো কাছে প্রত্যক্ষ দর্শন করা নির্মম বাস্তবতা। এ অন্ধকার জগতের কিছু অংশ প্রকাশিত, কিছু অংশ সুপ্ত। কিছু অংশকে সবাই দেখে, চেনে, ভয়ও পায় কিন্তু সাহস বা উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারেনা। আবার কিছু অংশের শুধুই নাম আর নৃশংসতার কথা কানে শোনা যায় কিন্তু দর্শন পাওয়া যায়না। গুলশানও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও অন্ধকার আছে, অন্ধকার জগৎ আছে, কিংবা আছে অন্ধকারের নামে কোন এক গোপন সৌরজগত।
আমের ভিলা। বাড়ি নয় যেনো এক ছোটখাট সম্রাজ্য। আর এই সম্রাজ্যের একমাত্র রাজা রাশেদ আমের। কিছুক্ষণ আগেই মাগরিবের আযান দিয়েছে। নামাজ পড়ে নিজের ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে। বয়স পঞ্চাশের কিছু ওপরে হবে। পড়নে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় মাঝারি আকারের চুল, গালে চাপ দাড়ি।

এখনো একটা চুল বা দাড়িও সাদা হয়নি, কিংবা সাদা হতে দেননি। চোখ বন্ধ করেই কিছু একটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছিল সে। বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর কাপের ওপর চামচ দিয়ে মৃদু ভাবে আঘাত করার শব্দ এলো। পরপর তিনবার। সেই আওয়াজ শুনে চোখ বন্ধ রেখেই হাসলেন রাশেদ। আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে তার পায়ের কাছে হাঁটু ভেঙ্গে বসে আছে তার একমাত্র মেয়ে কুহু। মুখে ঝুলে আছে এক দারুণ মিষ্টি হাসি। এই হাসির মতো মেয়েটার মুখটাও ভীষণ মিষ্টি। বয়স বিশ হলেও দেখতে একদম বাচ্চা বাচ্চা। জন্মের পর শখ করে রাশেদের স্ত্রী মেয়ের নাম কুহু রেখেছিল। তার দুদিন পরেই ইহকালের মায়া ত্যাগ করে সে। নাম কুহু হলেও কোনদিন কথা বলার ক্ষমতা হয়ে ওঠেনি কুহুর। কানে শুনতে পেলেও কথা বলতে পারেনা সে। তবে এটা নিয়ে মেয়েটার কোন আফসোস নেই। যেটুকু পেয়েছে তা নিয়েই ভীষণ খুশি সে। ওর হাসিখুশি মুখ আর চঞ্চলতা তারই প্রমাণ। রাশেদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘ কী ব্যপার কুহু মা? আজ তুমি চা নিয়ে এলে যে? তোমার জ্যোতি আপু কোথায়?’
কুহু হাতের ইশারায় বোঝালো যে, জ্যোতি এখন ব্যস্ত আছে। রাশেদ বুঝতে পেরে বলল,
‘ আচ্ছা, যাও নিজের ঘরে যাও। রাতের খাওয়ার সময় দেখা হবে।’
কুহু ঠোঁট ফুলিয়ে না বোধক মাথা নাড়ল। এরপর আবার ইশারায় কিছু বলল। রাশেদ হেসে বলল,
‘ ভাইয়া কোথায়?’

কুহু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। রাশেদ স্নেহমাখা হাতে মেয়ের গাল ছুঁয়ে বলল,
‘ ও যখন আসবে তখন তোমার ঘরে পাঠিয়ে দেব। এখন যাও।’
কুহু আবার সেই মিষ্টি হাসি দিল। এরপর উঠে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। কুহু সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলে। রাশেদ ছাড়া আর দুজন এ বাড়িতে এই ভাষা পুরোপুরি বুঝতে পারে। রাশেদ চায়ের কাপ হাতে তুলে নিতেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কেউ বলল,
‘ ভাইজান আসব?’

রাশেদ তাকিয়ে দেখল তার ছোট ভাই জাফর আমের দাঁড়িয়ে আছেন। রাশেদ চায়ের চাপে চুমুক দিয়ে বলল,
‘ আয়।’
জাফর দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে রাশেদের সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসল। রাশেদ কাপটা টি-টেবিলে রেখে বলল,
‘ কী খবর?’
জাফর একটু ইতস্তত কন্ঠে বলল,
‘ খবর ভালো না ভাইজান।’
রাশেদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কেনো? কী হয়েছে?’
জাফর এবার উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

‘ তিনজনের মধ্যে দু-জন টাকা দিতে রাজি হলেও একজন বেঁকে বসে আছে ভাইজান। সে কিছুতেই টাকা বের করছেনা। ঐ কোম্পানি থেকে টাকা না পেলে নেক্সট ডিলটা করতে সমস্যা হয়ে যাবে।’
জাফরকে যতটা চিন্তিত হয়ে কথাটা বলতে দেখা গেল রাশেদের মুখ ততটা চিন্তিত মোটেই মনে হলো না। সে বেশ আয়েশ করেই আবার চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বলল,

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪

‘ কোন কোম্পানি?’
‘ রিপন গ্রুপ।’
‘ রুদ্র জানে?’
নির্বিকারভাবে জানতে চাইল রাশেদ। জাফর হতাশ হয়ে বলল,
‘ আমিতো বলতে পারিনি ওকে। কিন্তু দুপুর থেকে ছেলের খবর নেই। ফোনটাও লাগছেনা।’
ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে এবার আরামে চেয়ালে হেলান দিলেন রাশেদ। রাশেদকে এমন নির্বিকার দেখে জাফর অবাক হল। কিন্তু রাশেদের সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সে জানে তার আর মাথাব্যথার প্রয়োজন নেই।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬