অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৭ (২) 

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৭ (২) 
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

মাঝারি আকারের ঘর। মাঝখানে একটা ন/গ্ন বাল্ব ঝোলানো। বাতাসে দুলছে বাল্বটা। দোদুল্যমান বাল্বের কারণে গোটা ঘরজুড়ে অস্থিরভাবে বিচরণ করছে আলোকরশ্নি। বদ্ধ ঘর সাথে এমন বিরক্তিকর আলোর কারণে অসহনীয় হয়ে উঠেছে ঘরের পরিবেশ।

সেই অসহনশীল পরিবেশে, চেয়ারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়েছে ইকবালকে। সারা শরীরে দগদগে ঘা, আঘাতের চিহ্ন। ন/গ্ন বাল্বটা ঠিক মাথার ওপরেই। সেই উত্তাপে ক্ষতগুলো যেন জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। অর্ধচেতন অবস্থাতেও সেই যন্ত্রণা অনুভব করছে সে। তৃষ্ণায় গলা ফেটে যাচ্ছে। ক্ষুধার অনুভূতি অনেক আগেই মরে গেছে। দিনে কেবল একবেলা কোনরকম খেতে দেওয়া হয় তাকে। তাও বেঁচে থাকার জন্যে যতটুকু প্রয়োজন, কেবল ততটুকুই। কিন্তু তৃষ্ণার অনুভূতি এতো সহজে যাওয়ার নয়। তাইতো থেকে থেকে অস্ফুট স্বরে ‘পানি’ ‘পানি’ বলে আকুতি করে চলেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিন্তু তৃষ্ণার্ত সেই গলায় পানি পড়ল না। তার বদলে এক ঝাপটা গরম পানি এসে পড়ল মুখের ওপর। যন্ত্রণায় কলজে ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল ইকবালের। কিন্তু দুর্বলতার জন্যে আর্তনাদও করতে পারল না। চোখ পিটপিট করে আস্তে আস্তে তাকাল। তাকিয়ে দেখতে পেল ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে শওকত মীর্জা, সম্রাট এবং শান। অবাক হয়নি ইকবাল। এদের আনাগোনা প্রায় হয় এখানে। শুকনো ঢোক গিয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসল ইকবাল। দুর্বল গলায় বলল, ‘পালে দুজন শু*র কম কেন?’

তেঁতে উঠল সম্রাট। দাঁত দিয়ে চেপে ধরল নিচের ঠোঁট। তেড়ে দিয়ে বেধড়ক লাথি বসাল ইকবালের পেটে। ফুঁপিয়ে উঠল ইকবাল। সম্রাট রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘কথা বলার শক্তি নেই অথচ ভাষা ঠিক হয়না কুকুরের বাচ্চার! একেতো..’
বলে আরেকটা লাথি বসাতে গেলে বাঁধা দিলেন শওকত, ‘আহা! সবসময় এতো মারামারি করো কেন? এমনিতেই বেচারা আধমরা হয়ে আছে। বাকি দুজনের খবরইতো জানতে চেয়েছে। এতো রেগে যাচ্ছো কেন? এভাবে মারলে মরে যাবেতো। ভুলে যেওনা এখনো পর্যন্ত ওকে জীবিত দরকার আমাদের।’

তীব্র বিরক্তি নিয়ে শান বলল, ‘তা বাঁচিয়ে রেখেই বা কী লাভ হচ্ছে বাবা? কিছুইতো বলছেনা বা/স্টা/র্ডটা।’
শওকত ঠোঁটে ধূর্ত হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘আমাদের এতো তাড়াহুড়োয় কী প্রয়োজন শান? এমনিতেও সারা দুনিয়ার কাছে ও মৃত। আর সোলার সিস্টেমতো ওকে এযুগের মীরজাফর মেনে নিয়ে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে।’
সম্রাট বলল, ‘কিন্তু রুদ্র অনন্ত কাল অপেক্ষা করে থাকবেনা আমাদের জন্যে। ভুলে যাবেন না ওর সবচেয়ে দুর্বল জায়গাগুলোতে আঘাত করেছি আমরা। আর আহত বাঘ সবচেয়ে বেশি ভয়ানক হয়। ওকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে চাইনা আমি। পেনড্রাইভটা ওর হাতে চলে এলে পুরো খেলাটা বিগড়ে যাবে।’

শওকত ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বললেন, ‘খবর পেলাম বাচ্চা হারানোর শোকে ওর বউ নাকি ওকে ছেড়ে চলে গেছে? একাই থাকে এখন। পরবর্তী আঘাতটা সেখানেই করতে পারো। শুনেছি রুদ্র আমের তার বউকে ভীষণ ভালোবাসে।’
শান বোকা দৃষ্টিতে তাকাল শওকতের দিকে। সে কিছু বলবে তার আগেই সম্রাটও একইভাবে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘এতো তাড়া কীসের? সবেতো রঞ্জুকে সরালাম। শালা ইনফরমেশন কালেক্ট করতে এসেছিল। আমার লোকেরা এমনভাবে কু/পি/য়েছে। আগে ঐ ছোকরার যাওয়ার ধাক্কাটাতো সামলাক। তারপর না হয় বউ হারানোর ধাক্কাটা দেওয়া যাবে।’

শান রেগে গিয়ে বলল, ‘মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তোমাদের! আলতু ফালতু না বোকে কাজের কথা বলো। এভাবে ঢিলেমি দিয়ে কাজ করলে চলবে না। রুদ্র যেকোন সময় যা খুশি করে ফেলতে পারে।’
সম্রাট বলল, ‘সহমত। আমারও অপেক্ষা সহ্য হচ্ছেনা। যত দ্রুত সম্ভব রুদ্র আমেরের লা/শ দেখতে চাই আমি।’

শওকত মনে মনে হাসলেন। ওনার পরিকল্পনা যে আরও গভীর। আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে এমনিতেও পটলিপটলা গুটিয়ে ফেলতে হবে তাকে। সেটা সে জানে। যখন থেকে এই নিষ্ঠুর পরিকল্পনার বিজ বপন করেছে তখন থেকেই। তাইতো রাজনীতির পথ বেছে নিয়েছে অনেক আগেই। নেতা হয়েছে। জনগণের মন জয় করেছে। নমিনেশনটাও এবার তার ভাগ্যেই জুটবে। করিম তাজওয়ার কিংবা সম্রাটকে রুদ্র মে/রে ফেললেও তার কিচ্ছু যায় আসেনা। নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেই রেখেছে সে।

দুর্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এতক্ষণ ওদের সব কথা শুনছিল ইকবাল। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিল না। কী হয়েছে ওদিকে? রুদ্রর কোন দুর্বল জায়গায় আঘা/ত করেছে এরা? প্রিয়তা কোথায় গেছে? কার বাচ্চা? রঞ্জু! রজ্ঞু আর নেই! মেরে ফেলেছে ওরা? এতোসব প্রশ্নের ভাড়ে ইকবালের ক্ষতগুলো আরও বেশি জ্বালা করে উঠল। ভাবনায় ছেদ ঘটল যখন শওকত ওর চুলের মুঠি ধরে মাথাটা উঁচু করে ধরল। বিদঘুটে হাসি হেসে বলল, ‘এতোদিন বাইরের কোন খবর তোমাকে জানানো হয়নি ইকবাল। আসলে জানানোর প্রয়োজন মনে করা হয়নি। তবে এখন মনে হচ্ছে তোমার জানা উচিত। যেহুতু তুমি কিছু বলছো না। তোমার জন্যে প্রথম শক। সোলার সিস্টেম অলমোস্ট শেষ হয়ে গেছে। তোমার প্রিয় রাশেদ বাবা, নিজের হাতে সই করে নিজেই সব ডুবিয়েছেন।’

ইকবাল বিশ্বাস করল না। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘অসম্ভব।’
‘সম্ভব। সবই সম্ভব। যখন নিজের একমাত্র মেয়ের জীবনের প্রশ্ন থাকে তখন সবই সম্ভব।’ তারপর আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘তবে শেষ পর্যন্ত মেয়েটার ইজ্জত আর রাখা গেলোনা। যদিও সেটা আমাদের ইচ্ছাকৃত ছিলোনা। সত্যি বলছি। আসলে জোয়ান ছেলেপেলেতো। কন্ট্রোল লেভেলটা একটু কম। তাই আর কী।’

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল ইকবাল। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই নিষ্পাপ মুখটা। মেয়েটার সঙ্গে এতো জঘন্য ঘটনা ঘটে গেছে! কষ্টে বুক ভারী হয়ে এলো ইকবালের। চোখে জল চলে এলো। ঘৃণাভরা চোখে শওকতের দিকে তাকিয়ে অশ্রাব্য এক গালি দিল। তাতে ঠোঁটের জঘন্য হাসি সরল না শওকতের। কিন্তু চুলের মুঠিটা আরও শক্ত করে ধরল। সম্রাট বলল, ‘এটুকুতেই এই অবস্থা? পরবর্তী খবরটা দিন তাকে মীর্জা?’

ইকবাল ভাবছে আর কী শুনতে হবে তাকে! শওকত বলল, ‘নিজের মেয়ের অমন দশা আর সাধের সোলার সিস্টেমের পতন সহ্য হয়নি রাশেদ আমেরের। তাইতো সেই শোকে বেচারা মরেই গেল। যদিও সবাই সেটাই জানে। কিন্তু সত্যিতো এটাই যে তাকে বিষ দিয়ে মারা হয়েছে।’

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইকবাল। রাশেদ আমের আর নেই! কথাটা অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল তার। কিন্তু নিষ্ঠুর শওকত মীর্জা সেই শোক কাটানোর সময়টাও দিলোনা ইকবালকে। বলে চলল, ‘আর কিছুদিন আগে। তোমার আদের ছোটভাইতুল্য রুদ্র আমেরের অনাগত সন্তানটার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। আর তার জন্যে তার বউ তাকেই দায়ী করে আমের ভিলা ছেড়ে চলে গেছে। এবার বলোতো বাছা, কোন খবরটায় বেশি দুঃখ পেলে?’

রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় থরথর করে কেঁপে উঠল ইকবাল। ভুলে গেল শরীরের সব যন্ত্রণা। দাঁতে দাঁত চেপে জঘন্য এক গালি দিয়ে বলল, ‘সেইদিন শুধু তোর পা না। তোর গোটা শরীরটাই ট্রেনের নিচে পড়া উচিত ছিল। পৃথিবী থেকে একটা শু*র বিদেয় হতো।’

চোয়াল শক্ত হল শওকতের। এতক্ষণ ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখা হাসিটা গায়েব হয়ে গেল। হাত চলে গেল কাঠের বাঁ পায়ে। ইকবাল তার দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছে। তাই সেও আর ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকল না। প্রচন্ড জোরে ইকবালের চুল টেনে ধরে বলল, ‘পেনড্রাইভটা কোথায়?’

ইকবালের গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতে চাইছেনা। তবুও কোনরকম ঘরঘরে আওয়াজ করে বলল, ‘এতোদিন বলিনি। আর এখন এসব জানার পরতো প্রশ্নেই ওঠেনা। আমায় মেরে ফেললেও বলব না আমি।’
ইকবাল ঠাটিয়ে একটা চ/ড় বসালো ইকবালের গালে। হাতের আংটির আঘাতে গালের পুরনো ক্ষতে নতুন ক্ষত তৈরী হল। শওকত সম্রাটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাকি কাজটা তুমি করো।’
সম্রাট ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। ঠোঁটে হিংস্র হাসি ফুটিয়ে তুলে এগিয়ে গেল ইকবালের দিকে। সরে দাঁড়ালেন শওকত। সম্রাট ইকবালের দিকে ঝুঁকে চুল ধরে মাথাটা আবার তুলে ধরে বলল, ‘পেনড্রাইভটা কোথায় বলবেনা। তাইতো?’

‘ম/রে যাবো। তবুও বলব না।’
‘তাহলে ম/র।’
কথাটা বলে জ্ব/লন্ত সিগারেটটা ঢুকিয়ে দিল ইকবালের নাকের ফুটোয়। মাথায় যেন ভয়ানক কিছুর বিস্ফোরণ হল ইকবালের। মর্মান্তিক আওয়াজ বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে। শান ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল, ‘নিজের দোষে নিজেরাই ভোগে এরা।’
বলে হনহনে পায়ে বেরিয়ে এলো সে ঘর থেকে। এসব টর্চার, আর্তনাদ তেমন উপভোগ করেনা ও। তবে এসবের বিরোধী, তাও নয়।

দীর্ঘক্ষণ মর্মান্তিক অত্যাচার চালানো হল ইকবালের ওপর। নাকের মাঝে জ্ব/লন্ত সিগারেট ধরা হল, তুলে ফেলা হল বেশ কয়েকটা নখ, তারসঙ্গে বিরতিহীন মা/রতো ছিলোই। কিন্তু কিছুতেই বলল না ইকবাল। অবশেষে বিরক্ত হয়ে বিধ্বস্ত ইকবালকে ওখানে ফেলে রেখেই বেরিয়ে গেল ওরা। অতিরিক্ত যন্ত্রণায় সবকিছু আবছা লাগছে ইকবালের। অতীত, বর্তমান ; পরিস্থিতি সব গুলিয়ে যাচ্ছে। যখন মনে পড়ল রাশেদ আমের আর নেই। তার ‘রাশেদ বাবা’ সত্যিই মৃত। বুকের মাঝে হু হু করে উঠল। টপটপ করে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখ দিয়ে। অসহায় হয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি রাশেদ বাবা। করিনি। আপনি আমাকে ভুল বুঝেই চলে গেলেন!’

সূর্য সবেমাত্র অস্ত গেছে। আকাশে গোধূলির লালচে আলো। আমের ভিলার ছাদে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসে আছে উচ্ছ্বাস আর রুদ্র। দুজনের হাতেই জ্ব/লন্ত সিগারেট। কিন্তু নিয়মমতো টানছেনা ওরা। পু/ড়ে অনেকখানি ছাই জমে আছে বারবার। উচ্ছ্বাস হাতে একটা ফাইল নিয়ে সেসব ব্যবসায়ী নাম আর ইনফরমেশন শোনাচ্ছে যারা সোলার সিস্টেমের শত্রু দলগুলোকে আর্থিক সহায়তা করছে। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনছে রুদ্র। কিছু বলছে না। উচ্ছ্বাসের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে অন্য এক গভীর চিন্তা করছে সে।

কিছুক্ষণ পর ছাদে এসে উপস্থিত হল জাফর। ওখানে তার জন্যে চেয়ার রাখাই ছিল। সেটা টেনে এনে বসল সে। ব্যঘাত ঘটাল না। অপেক্ষা করল উচ্ছ্বাসের কথা শেষ হওয়ার। উচ্ছ্বাস কথা থামাতেই শব্দ করে শ্বাস ফেলল রুদ্র। জাফরের দিকে তাকাতেই জাফর বলতে শুরু করল, ‘প্রিয়তা মাকে ধাক্কা দিয়েছিল যে ছেলেটা তার পরিচয় পাওয়া গেছে। নাম রাতুল। ব্লাক হোলের সদস্য। এমনিতে মোহাম্মদপুর একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকে।’

রুদ্র চোখ অদ্ভুত শান্ত। ঠিক ততটাই অদ্ভুত শীতল গলায় রুদ্র বলল, ‘ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা?’
রুদ্রর উদ্দেশ্য বুঝতে পের‍ে জাফর বলল, ‘গিয়ে লাভ নাই। ওখানে পাওয়া যাবেনা ওকে।’
ভ্রু কুঁচকে গেল রুদ্রর। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জাফরের দিকে তাকাতেই জাফর বলল, ‘ওকে ফ্ল্যাটে আসতে দেখা যাচ্ছেনা এখন। ইভেন ইদানীং কোথাও তেমন দেখা পাওয়া যাচ্ছেনা ওর। এক কথায় সে নিখোঁজ।’
রুদ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ফুলে উঠল কপালের শিরা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আমিও দেখি ও কতদিন লুকিয়ে থাকতে পারে।’

রুদ্র থামতেই উচ্ছ্বাস অনেকটা উৎসাহি হয়ে বলল, ‘রঞ্জু কোন ইনফরমেশন নিয়ে এলো? সে বিষয়েতো কিছুই বললি না আমাদের। কীভাবে এগোবো আমরা?’
চুপ হয়ে গেল রুদ্র। কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর থমথমে গলায় বলল, ‘দিয়েছে। যতটুকু ইনফরমেশন দেওয়ার দিয়েছে ও। আপাতত ওকে অন্য একটা কাজে পাঠিয়েছি আমি। আগে আমি বিজনেসম্যানদের লিস্টটা দেখব। কিছূটা রিসার্চ করব। তারপর যা হওয়ার হবে।’

উচ্ছ্বাস বা জাফর কিছু বলল না। মেনে নিল রুদ্রর কথা। রঞ্জুর ব্যপারটা অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করতে চাইছেনা রুদ্র। গতরাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর এটা একেবারে নিশ্চিত যে সোলার সিস্টেমের মধ্যেই কেউ একজন এখনো ওদের পেছন থেকে ছু/রি। সমস্ত ইনফরমেশন লিক করছে। রঞ্জু ইনফরমেশন আনতে গিয়েছিল সেটা রুদ্র কেবল উচ্ছ্বাস আর জাফরকেই বলেছে। আর কারো পক্ষে সেটা জানা সম্ভব না। যদি না সে কোনভাবে আড়ি পাতে। তাই এই মুহূর্তে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেনা রুদ্র। উচ্ছ্বাস বা জাফরকেও না।

তখনকার মতো আলোচনা ছেড়ে একে একে নিচে বসার ঘরে নেমে এলো ওরা।
জ্যোতি চা নাস্তা এনে দিল ওদের। সকলেই চুপচাপ নিজের নিজের কাপ আর প্লেট নিয়ে বসে পড়লেন চুপচাপ। কোন আনন্দ নেই। নেই কোন আড্ডা। সবটাই কেমন দমবন্ধকর।
সকলকে বলে কুহুর চা-নাস্তা নিয়ে ওপরে চলে গেল নীরব।

বসার ঘরটার দিকে তাকালে অজান্তেই ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সকলের। ভাবতেও অবাক লাগে, একসময় সন্ধ্যা হলে কতটা রমরমে হয়ে উঠত আমের ভিলার বসার ঘর। প্রিয়তা; উচ্ছ্বাস, কুহু জ্যোতি মিলে মাতিয়ে রাখতো সবটা। প্রিয়তার হাতের তৈরী গরম গরম তেলে ভাজা হালকা খাবারের সঙ্গে চা না হলে আমের ভিলার সন্ধ্যা শুরুই হতোনা। প্রিয়তার বদৌলতে মাঝেমাঝে রুদ্রও বসতো সেই আড্ডায়। জাফর কম যেতয় না। হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মশগুল হয়ে যেতো আড্ডায়। আর ভয় পেতো, কখন রাশেদ আমের ধমকে ওঠেন।
সেসব এখন কেবল স্মৃতি। যা মনে পড়লে অদ্ভুত যন্ত্রণায় বুক জ্বালা করে ওঠে ওদের।

নিজের ঘরের কাউচটাতে হেলান দিয়ে বসে আছে রুদ্র। কানে তার ইয়ারফোন। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে কিছু রেকর্ডিং। দলের সমস্ত সদস্যদের হোলস্টারে যেই মাইক্রোফোন রেখেছিল। সেগুলোর আজকের রেকর্ডিং শুনছে। কিন্তু এতো মনোযোগ দিয়ে সবারটা শুনেও কোন বিশেষ তথ্য পেলোনা আজও। কেউ কোন সন্দেহজনক কথাবার্তা বা কল করেনি। কিন্তু কীভাবে সম্ভব এটা? কেউতো অবশ্যই আছে যে তথ্যগুলো পাচার করছে। তাহলে এই রেকর্ডিং গুলোতে কিছুতো পাওয়া উচিৎ ছিল ওর। পেতে বাধ্য। কারণ সবার হোলস্টারেই নিয়মিত মাইক্রোফোন লাগায় ও। তারমানে যে কাজটা করছে সে খুব ভালো করেই জানে যে হোলস্টারে মাইক্রোফোন আছে। আর তাই সে যখন ব্লাক হোল বা ডার্ক নাইটের সঙ্গে যোগাযোগ করছে তখন হোলস্টার সরিয়ে রাখতে। কিন্তু রুদ্র ছাড়া একথাতো অন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব না। কেউ কীকরে জানবে?

হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল রুদ্রর। একমাত্র উচ্ছ্বাস টের পেয়ে গিয়েছিল মাইক্রোফোনটার কথা। কেবল উচ্ছ্বাস-ই জানতো মাইক্রোফোনটা কোথায় এবং কীভাবে আছে। তার মানে উচ্ছ্বাস!
জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে বার করল রুদ্র। না, এটা হতে পারেনা। উচ্ছ্বাসতো নিজে থেকেই টের পেয়েছিল মাইক্রোফোনের অস্তিত্ব। এমনও তো হতে পারে অন্যকেউও একইভাবে টের পেয়েছে। হ্যাঁ, হতেই পারে। কিন্তু নাওতো হতে পারে। মাথা ধরে এলো রুদ্রর। সবদিক থেকে এতোরকমের ধাধা আর দুশ্চিন্তায় সবকিছু অসহ্য লাগছে ওর। কান থেকে ইয়ারফোনটা খুলে চার আঙুলে মাথা চেপে ধরল রুদ্র। বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘প্রিয়! এককাপ কফি নিয়ে এসোতো!’
কথাটা বলার পরেও কোন সাড়া পা পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্র। সারা রুমে চোখ বুলাল। ফাঁকা রুমটা নজরে আসতেই মনে পড়ল, প্রিয়তা নেই ওর কাছে। চলে গেছে মেয়েটা। ওকে ছেড়ে। তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠতে নিলেই দরজার কাছ থেকে কেউ বলে উঠল, ‘আসব?’

রুদ্র তাকিয়ে দেখল জ্যোতি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কফির মগ। রুদ্র অবাক হল। আজও মেয়েটা কত অনায়াসে ওর প্রয়োজন বুঝতে পারে! গম্ভীর কন্ঠে আসার অনুমতি দিল রুদ্র। জ্যোতি চুপচাপ ভেতরে এলো। কফির মগটা টেবিলে রেখে নীরবেই চলে যেতে নিলে রুদ্র বলল, ‘এতো রাতে জেগে আছিস কেন? কফি চেয়েছি আমি?’
‘আমি জানি এইসময় নানান চিন্তা করে মাথা ধরিয়ে ফেলছো তুমি। কফিটা খাও ভালো লাগবে।’

‘কেন করিস এসব? কী লাভ?’
জ্যোতি মৃদু হেসে বলল, ‘লাভ লোকসান দেখে ভালোবাসা যায় বুঝি?’
রুদ্র বলল, ‘অযথা নিজেকে পোড়াচ্ছিস জ্যোতি। সময় আছে এখনো। আমার গন্ডি থেকে বেরিয়ে নতুন করে সব শুরু কর।’
জ্যোতির হাসি প্রসারিত হল। রুদ্র দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘রুদ্র নামক অনলে জ্যোতি সারাজীবন পু/ড়তে রাজি আছে।

তোমার গণ্ডিতে আমি নিজের ইচ্ছায় ঢুকিনি রুদ্র। তাই নিজের ইচ্ছায় বের হতেও পারব না। তবে চিন্তা করোনা। তোমার ঘরোনী হওয়ার লোভ আমার আর নেই। সবার মতো এখন আমিও মানি। রুদ্র প্রিয়তাতেই সুন্দর।’
বলে আর অপেক্ষা করল না জ্যোতি। বেরিয়ে গেল রুদ্রর ঘর থেকে। জ্যোতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস চাপে রুদ্র। একতরফা ভালোবাসা এতোটাও গভীর হতে পারে! মাঝেমাঝে মেয়েটার জন্যে মায়া হয় ওর। কিন্তু কী করবে? অনুভূতির ওপর কারো হাত থাকেনা।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে কফি নিয়ে বারান্দায় যায় রুদ্র। সাময়িকভাবে সব চিন্তা বাদ দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে চুমুক দেয় ধোঁয়া ওঠা কফির মগে। প্রিয়তার কথা মনে পরে। কত রাত একসঙ্গে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আকাশ দেখেছে দুজন। অথচ আজ ও একা। বড্ড একা। কেমন আছে প্রিয়? রঞ্জু বলেছিল ওর বিপদ। কেমন বিপদ? কী হতে চলেছে ভবিষ্যতে?

অদ্ভুত একটা বিষয় লক্ষ্য করে ভাবনার সুতো ছেড়ে রুদ্রর। আমের ভিলার একটা ঘরের লাইট জ্বলে আবার বন্ধ হয়ে গেল। সেই ঘরটার জানালা রুদ্রর বারান্দা থেকে দেখা যায়। কিন্তু ঘরটায় কেউ থাকেনা। সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রাখা হয় ওখানে। অনেকটা স্টোররুম। ঐ ঘরে কেউ যায়না বললেই চলে। এতো রাতে ওখানে কে গেল?
ব্যপারটা দেখার জন্যে সঙ্গেসঙ্গেই বের হয় রুদ্র। ঘরটার কাছে গিয়ে দেখতে পায় ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে করিডর দিয়ে চলে যাচ্ছে নীরব। রুদ্রর কোঁচকানো ভ্রু আরও কোঁচকায়। নীরব কী করতে এসেছিল এই ঘরে? তাও এতো রাতে? রুদ্র এগিয়ে যায় ঘরটার দিকে। দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ধুলোমাখা আসবাবপত্র আর কিছু পরিত্যক্ত জিনিস ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়না।

রুদ্র ফিরে যেতে নিয়েও থেমে যায়। আরেকটু ভালোভাবে খোঁজার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় দুমিনিটের মতো চারপাশে ভালোভাবে চোখ বোলানোর পর টেবিলের নিচে চোখ আটকে যায় রুদ্রর। একটা পলিথিনের ব্যাগ। ব্যাগটা তোলে রুদ্র। ভেতর হাত দিতেই বেরিয়ে আসে একটা কালো জ্যাকেট আর বেরেটা পি/স্তল। রুদ্রর অবাক হওয়ার মাত্রা বাড়ে। জ্যাকেটটা চেনা মনে হয় রুদ্রর। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মস্তিষ্কে চাপ দিতেই মনে পড়ে পারভেজকে যখন ও খু/ন করতে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন পারভেজ মুখ খোলার আগেই ওকে দূর থেকে গু/লি করে একজন। বাইকে এরকম একটা জ্যাকেট পড়েই ছিল সেই খু/নি। আর সেই গুলিটা বেরেটা থেকেই বেরিয়েছিল। সেটা রুদ্র জানে। তারমানে নীরব! নীরব করছে এসব? নয়তো এতো রাতে সে এই ঘরে আসবে কেন? তাও এমন চুপিচুপি?

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৭

কথাটা ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। কিন্তু টেবিলের ওপর চোখ পড়তেই ওর ধারণায় ঢিল পড়ল। কারণ ওখানে কুহুর নষ্ট হয়ে যাওয়া ড্রয়িং বোর্ড আর কিছু তুলি আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সদ্যই রাখা হয়েছে এখানে। নীরব তবে এগুলো রাখতে এসেছিল? তবে এই জ্যাকেট, ব/ন্দু/ক, এগুলো কার? নীরব যদি না রেখে থাকে তবে কে রেখেছে? মনে মনে আরেকবার ধাক্কা খেল রুদ্র যখন মনে পড়ল, পাশের ঘরটা উচ্ছ্বাসের।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৬৮

1 COMMENT

Comments are closed.