অপ্রিয় আশালতা শেষ পর্ব

অপ্রিয় আশালতা শেষ পর্ব
আফিয়া অন্ত্রীশা

সকল মান-অভিমানের পালা চু*কি*য়ে আজ দু’দিন হয়েছে নিজের বাড়িতে ফিরেছে আশালতা। মায়ের অনেক কান্নাকাটি আর মারজানার অবস্থা বেগতিক শুনেই ফ্যাক্টরি থেকে ছুটি নিয়ে মা আর ছেলেকে নিয়ে ছুটে চলে আসে আশালতা। মারজানা কেঁদে কেঁদে নিজের অ*ন্যায়ের জন্য বারবার ক্ষমা চেয়েছে আশালতা আর হাফসা বেগমের নিকট। আশালতা ও হাফসা বেগম হাসি মুখে মারজানাকে কাছে টেনে নেয়। বাড়ি ভর্তি সকলের মনে একজন সদস্য হারানোর তীব্র ভ*য় ক্ষানিক বাদে বাদে হা*না দিয়ে ওঠে।

আশালতার ছোট ভাবি বর্তমানে ছয় মাসের গর্ভবতী। বাড়িতে কিছুক্ষণ বাদে বাদে হয় মারজানাকে নিয়ে শো*ক অথবা নিপাকে নিয়ে আনন্দ ঝলকানি দিয়ে ওঠে। আশালতা এখন স্বাবলম্বী। কেউ আর তাকে ক*টা*ক্ষ করে দুটো কথা বলার বিন্দুমাত্র সাহস করে ওঠেনা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বিকালে উঠানে কো*টা দিয়ে পেয়ারা গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটা হতে পা*কা ডা*সা পেয়ারা পাড়ার চেষ্টা করছিল আশালতা। আচমকা কারো ভেজা কন্ঠে “আশা” ডাকটা শুনে চমকে পেছনে ঘুরে তাকায় সে। মুহূর্তের মাঝে শরীরের মধ্যে কা*রে*ন্টে*র গতিতে শি*হ*র*ণ বয়ে যায়। শরীর যেন হঠাৎ করে অ*ব*শ হয়ে আসছে আশালতার।
আশালতার সামনেই হুইল চেয়ারে বসে আছে সাদ। আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সাজেদা বেগম ও ছবি। প্রত্যেকেরই চোখ হতে জল উপচে পড়ছে। আশালতা কাঁ*পা কন্ঠে বলে ওঠে,

-আপনারা এখানে?
ইতোমধ্যেই আশালতার বাড়ির প্রায় সকলেই উপস্থিত হয়ে গেছে।
-আমাদের ক্ষ*মা করে দাও আশা। আমাদের ছেলেকে নিয়ে আবার ফিরে চলো তুমি। (সাদ)
-হ্যা মা তুমি আমাদের সাথে ফিরে চলো তোমার ছেলেকে নিয়ে। (সাজেদা বেগম)
-এক মিনিট! কার ছেলে বললে তুমি সাদ? (আশালতা)

-আমাদের ছেলে! ওইযে তোমার মায়ের কোলে রয়েছে। (সাদ)
-ওখানেই থেমে যাও সাদ। একদম আমাদের বলবে না। ও আমার শুধুই আমার ছেলে। বা*জ*খা*ই কন্ঠে কথাগুলো বলে ওঠে আশালতা।
মাথা নিচু করে নেয় সাদ।চোখে অথৈ জলরাশির আনাগোনা স্পষ্ট।

-আমাকে ক্ষ*মা করে দাও তুমি আশা। আমি নিজের ভু*ল বুঝতে পেরেছি। খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি। শিক্ষা পেয়েছি আমি আশা। আমি জানি তুমি আর ফিরবেনা। আমি ছেলেকে কখনো তোমার থেকে কে*ড়ে নিতেও চাইবো না। ওর ভরণপষ*ণ বহন করার মতো সামর্থ্যও আমার নেই।

সাদ আজ নিঃ*স্ব। পা*প যে বাপকেও ছাড়েনা আশা। হারে হারে টের পেয়েছি আমি তা। আমার একার কথা বলব না। পুরো পরিবার ধরেই পেয়েছি বলতে পারো। শরীরের য*ন্ত্র*ণা আর মনের য*ন্ত্র*ণা দুটো এক হয়ে আমাকে এখন তিঁলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে আশা। নিজেকে আজ পা*গ*ল পা*গ*ল মনে হয়। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। আমি অনেক ক*ষ্ট দিয়েছি তোমাকে। অনেক অ*ন্যায় করেছি আমি। যার আসলেই ক্ষমা হয় না। (সাদ)

-হ্যা আশা তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। আমি অনেক অ*ন্যায় করেছি। একজন মা হয়ে আমার ওমন অ*ন্যায় করা আসলেই উচিত হয়নি। কোনো মায়ের কাছেই তার সন্তানের য*ন্ত্র*ণা ,ক*ষ্ট সহ্য হয়না। গলার মাঝে কা*টা*র মতো বি*ধে থাকার মতো অনুভূতি হয়। আমার সন্তানদের এত ক*ষ্ট দেখে আজ আমি উপলব্ধি করতে পারছি তুমি ঠিক কতোটা ক*ষ্ট পেয়েছো। আমি তোমার কত বড় ক্ষ*তি করেছি তার প*রি*ণা*ম আমি পদে পদে ভোগ করছি। আমাদের তুমি ক্ষমা করে দাও। তুমি ক্ষমা না করলে হয়ত ম*রেও শান্তি পাব না আমি। (সাজেদা বেগম)

তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে আশালতা বলে ওঠে,
-আশালতা মনে রা*গ,ক্ষো*ভ, ক*ষ্ট কিছুই পুষে রাখেনা। আমি আপনাদের অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। আমার জন্য আর আমার সন্তানের জন্য দোয়া করবেন।

সাদ আর তার মা বোন করুণ দৃষ্টিতে আশালতার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের মাঝে তাদের গত কয়েকমাস হতে যে আফসোস আর অনুতপ্ততার ঝ*ড় বয়ে চলেছে তা হয়তো সারাজীবনে আর থামবার নয়। এই আফসোস,অনুতপ্ততা এবং অ*ন্যায়ের প*রি*ণা*মে*র বো*ঝা হয়তো বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে আজীবন ভর। তাদের কানের মাঝে আজীবন একটা বাক্যই ঝনঝন করে বাজতে থাকবে, “পা*প বাপকেও ছাড়েনা।“
আশালতা বুঝে গেছে লিনা তাকে যা বলেছিল গতবছর তা আসলেই সে ঘটিয়ে গেছে। আশালতা পেছন ঘুরে উঠান হতে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে করতে বলতে আরম্ভ করে,

-আশালতার প্রতি বহু মানুষের বহু ক্ষো*ভ থাকলেও আশালতা কারো প্রতি কোনো ক্ষো**ভ পু*ষে রাখেনা। আমি এই আশালতা একদিন তোমাদের সামনে সমাজের সকল অসহায় মেয়েগুলোকে বি*দ্রো*হী তৈরি করে দাড় করিয়ে দেব। তাদের প্রাপ্য সম্মান,স্বাধীনতা দিতে তোমরা বা*ধ্য হবে। একে একে সকল নারী তাদের সাথে হওয়া অ*ন্যায়,তাদেরকে প্রতিনিয়ত করা অ*ত্যা*চা*রের বি*রু*দ্ধে রু*খে দাঁড়াবে। হ্যা তোমাদেরকেই বলছি হে সমাজের নি*ষ্ঠু*র মানুষগুলো। হ্যা আমিই বলছি, তোমাদের অপ্রিয় আশালতা!

বইয়ের শেষ পাতাটির শেষ লাইন পড়া শেষ করে বইটা ব*ন্ধ করে নেয় আদিব। কিছু মুহূর্তের জন্য চোখ বুঝে নেয় সে।
আদিবের লেখা “অপ্রিয় আশালতা” বইটি প্রকাশিত হয়েছে একমাস হলো। এর মাঝেই সকল সাধারণ মানুষের মনে দা*গ কে*টে গেছে বইয়ের প্রধান চরিত্র “আশালতা।“ সাধারণত লাইব্রেরিতে একটা শুনশান পরিবেশ বজায় থাকলেও আজ সকলে নিয়ম ভ*ঙ্গ করে প্রতিদিনের ন্যায় লাইব্রেরির এককোণের টেবিল চেয়ারে বসে থাকা শা*ন্ত*শি*ষ্ট ছেলেটাকে ধরে বে*ধে নিয়ে গোল হয়ে বসেছে। বায়না ধরেছে তারা, আদিবের আজ সকলকে বইটা পড়ে শোনাতেই হবে। সকলের বায়না মোতাবেক একটু আগে পড়েও শোনালো আদিব।
হঠাৎ কারো প্রশ্নে পুনরায় চোখ খুলে তাকায় আদিব।

-আচ্ছা লেখক সাহেব, ইনি কি আমাদের ঢাকার সেই নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার ও সমাজ সেবিকা মিস আশালতা?
পাঠকের প্রশ্নে মুচকি হেসে জবাব দেয় আদিব,”জ্বী। “
আরেকজন প্রশ্ন করে ওঠে, “আশালতা কি তার লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছিলেন?”

-হ্যা অবশ্যই পেরেছিলেন। যদি না পেরেই থাকেন তবে কেন তার পরিচয় সম্বন্ধে সঠিকভাবে অবগত হবার জন্য তার নামের আগে “নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার ও সমাজ সেবিকা” উচ্চারণ করেছিলেন?
উপস্থিত পাঠক/পাঠিকার মাঝে এক উ*ৎ*ফু*ল্ল*তা ছড়িয়ে পড়ে।

-আচ্ছা আপনি কিভাবে মিস আশালতার সম্পর্কের এতো কিছু জানলেন? তিনি কি আপনার কিছু হন? “
বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করে নেয় আদিব। পরক্ষণেই ঝটপট চোখ খুলে নিয়ে হাসি মুখে বলে ওঠে, “সকলের সেই অপ্রিয় আশালতাই আমার মা।“

উপস্থিত সকলের মন টা*ন*টা*ন উ*ত্তে*জ*না*য় ছেয়ে যায়। সকলের দিকে তাকিয়ে আদিব এক প্রশস্ত হাসি টানে ঠোঁটে। আড়চোখে লাইব্রেরির সদর দরজার দিকে তাকাতেই অতি প্রিয় দুজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠোঁটের কোণের হাসি আরও প্রশস্ত হয়ে যায় সতের বছরের যুবকের। চেয়ার হতে উঠে সদর দরজার দিকে এগোতে নিলেই সকলে এক সাথে আদিবের দিকে একটা প্রশ্নই ছু*ড়ে মারে, “লেখক সাহেব আসল কথা না জানিয়ে কোথায় ছুটছেন? বাস্তবেও কি মিঃ কাব্য আছেন? আশালতার সাথে কি কাব্যের মিল বাস্তবেও ঘটেছে? নাকি কাব্যের অস্তিত্ব শুধু গল্প পর্যন্তই সীমাবদ্ধ?”
আদিব চলার গতি থামিয়ে দিয়ে লাইব্রেরিতে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

-তা নাহয় আপনারা এই মুহূর্তে বাস্তবে স্বচক্ষেই দেখে নিন!
আদিব পুনরায় চলতে আরম্ভ করে। ধীর পায়ে হেটে সদর দরজার সামনে উপস্থিত আশালতা আর কাব্যের দিকে এগিয়ে যায়। উৎসুক পাঠক ও পাঠিকারা বি*স্ফো*রি*ত নয়নে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। কাব্য গলা খা*কা*রি দিয়ে বলে ওঠে,
-বাস্তবেও সকলের অপ্রিয় আশালতা কাব্যের সবচেয়ে প্রিয়। কাব্য অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তার মায়াবতীকেই পেয়েছিল। হ্যা বাস্তবেও মিল ঘটেছে আপনাদের কাব্য ও আশালতার।

আশালতা কাব্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওঠে। সকলে সেই থেকেই নির্নিমেশ এই তিনজন মানুষের দিকেই তাকিয়ে আছে। সবার চোখের সামনে এক দুঃ*খি*নী মেয়ের ল*ড়া*ই ও সং*গ্রা*ম করে সমাজের বু*কে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কাহিনী খানাই ভাসছে। ভাসছে অতি সাধারণ এক মেয়েকে উ*ন্মা*দের মতো ভালোবাসা কাব্যের প্রতিচ্ছবি। ভাসছে আশালতাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠে দাঁড়ানো সকল নারীর বি*দ্রো*হী ও সং*গ্রা*মী প্রতিচ্ছবি।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ১৫

ধীর পায়ে আশালতা,কাব্য ও আদিব লাইব্রেবির সীমানা হতে বেরিয়ে আসে। তাদের গন্তব্য এখন কিছু হাত দূরে অবস্থিত আইসক্রিমের স্টলটা। ছেলের বায়না রাখতেই যে সব দরকারি কাজ ফেলে আশালতা ও কাব্যের এখানে ছুটে আসা! আশালতা সারাটা পথ ছেলের হাতের বইটার মলাটের দিকেই তাকিয়ে থাকে। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা বইয়ের নামটাই তার চোখকে বারবার আকর্ষণ করছে। আশালতা বিড়বিড় করে নামটা পড়ে ওঠে, “অপ্রিয় আশালতা।“

~সমাপ্ত