অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৫ 

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৫ 
নন্দিনী নীলা

আজ অনেকদিন পর নিবিড় বাসার সবার সাথে খেতে বসেছে। নিবিড় কে আগে থেকে একটু প্রানোচ্ছল দেখে সবার ভালো লাগছে। নিবিড়ের মা নিলাশা বেগম ছেলেকে খাবার টেবিলে দেখেই তো খুশিতে খাবার বেড়ে দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু নিবিড় এমনভাবে তাকিয়েছিল তিনি ভয় আর কাছে আসে নাই।

সে আবার যদি রাগ করে খাওয়া ছেড়ে চলে যায়। তিনি দূরেই ছিলেন। নিবিড় যতবারই তার দিকে চেয়ে ধমক দেয় ততবার তিনি ছোঁয়া কে অভিশাপ বকাবকি করে। মেয়েটা চলে গিয়েও আমাকে শান্তি দিল না ছেলেটা কতদিন হয় আমাকে মম বলে ডাকে না। ওনার চোখ ভিজে উঠে।
তাহমিনা এগিয়ে এসে তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,”নিজের পায়ে নিজেই তো কুড়াল মেরেছেন। এখন আবার চোখের জল ফেলছেন কেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিলাশা বেগম তাহমিনার দিকে তাকালেন রেগে। তাহমিনা কিছু বলতে যাবে তখনই তিনি বলে উঠে,”বেশি চ্যাটাং চ্যাটাং করো না। না হলে তোমার কীর্তি কাহিনী কিন্তু ফাঁস করে দেবো রাফসান দেবরের কাছে।”
“পারেন শুধু হুমকি দিতে! আমার কথা বললে আমি আবার আপনাকে ছেড়ে দেবো নাকি?”
“আমি খারাপ সেটা সবাই জানেই।”

তাহমিনা নিলাশা বেগমের একদম নিকট এসে ফিসফিস করে বলে,”আপনি কি শুধুই খারাপ? আপনি তার থেকেও ভয়ংকর একজন মহিলা! আমাকে ফাঁসালে আমি আপনাকেও ফাঁসিয়ে দেবো। তাই নিজের মুখটাও চুপ রাখুন। আমিও চুপ থাকবো। না হলে আমি একা বাসা থেকে বের হব না। আপনাকে সাথে নিয়ে বের হব।”

নিলাশা বেগম কটমট চোখে তাকিয়ে র‌ইল। তাহমিনা তার সামনে থেকে চলে এলো। হাতে ডিমের বাটি খাবার টেবিলে এনে সবার প্লেটে তুলে দিল‌। রাফসান নিবিড়ের প্লেটে মুরগীর রান তুলে দিল‌। নিবিড় রানের পিস পছন্দ করে। নিবিড় একটু হাসল তার দিকে তাকিয়ে। আবির সব সময় নিবিড়ের সাথে ঝগড়া করে খেতে বসলে কিন্তু আজ করল না। ভাইয়ের প্লেট থেকে মাছ গোস্ত নিয়ে খাওয়ার অভ্যাস আছে ওর কিন্তু আজকে তেমন কিছুই হলো না উল্টে ভাইয়ের প্লেট দিতে লাগল।

নিবিড় তা দেখে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,”কিরে আমি কি এখন নিজের বাসার মেহমান হয়ে গেলাম নাকি! নতুন জামাইয়ের মত বিহেভ করছিস সবাই।”
নিবিড় কথাটা বলতে বলতে সবার দিকেই তাকাল।

আবির বলল,” ভাই তোমার আজকে স্বাভাবিক ব্যবহার দেখে আমাদের খুব ভালো লাগছে ইমোশনাল হয়ে গেছি। এজন্য খাতির যত্ন করতেছি যাতে আর ওমন না কর! এই আদর ভালোবাসার জন্য হলেও আমাদের সাথে খাও।”
নিবিড় ওর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,” ড্যাড আগামীকাল আমরা ফ্রেন্ডরা মিলে ট্যুরে যাচ্ছি বান্দরবান।”

নিবিড়ের বাবা ছেলের দিকে তাকালেন খাওয়া থামিয়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা ভেবে বললেন,”আচ্ছা যাও।”
থেমে আবার মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,”তুমি যে মুড অন করছো এটা দেখি খুবই ভালো লাগছে। বেস্ট অফ লাক মাই সান। আমি টাকা পাঠিয়ে দেবো তোমার একাউন্টে। ইচ্ছে মতো ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরে এসো। আমার সেই আগের নিবিড় কে চায়।”

নিবিড় হাসল। সবাই নিবিড়ের হাসি দেখে হাসল। রাফসান কাকা জিজ্ঞেস করল, ” টিকিট কাটছিস? না কেটে থাকলে আমি কেটে দেয়।”
” না কাকু। আমরা ট্রেন করে যাব।”
” ট্রেনে কেন? আমি ফ্ল্যাট বুক করে দেই।”
“আমার সব ফ্রেন্ডের পরিবার এতটা সচ্ছল নয়। সবার পক্ষে ফ্লাইটে যাওয়া সম্ভব নয়। ”

“যাওয়া আসার খরচ না হয় কাকা দিলো নিতে সমস্যা কি?”
“এটা বললে ওরা নিজেকে ছোট মনে করবে সবাই মিলে ট্রেনে ভ্রমণ করায় ভালো হবে। আমি আমার ফ্রেন্ডের খুব ভালোবাসি। আমরা সবাই মিলে এক ভাবেই থাকতে চাই।”

আর কথা বাড়াল না কেউ। খাওয়া শেষ করে যে যার মত চলে গেল‌। নিবিড় নিজের রুমে চলে এলো।মাহি দরজার দাড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে ভেতরে যাওয়ার সাহস নাই। ইদানিং নিবিড় ব্রো যে পরিমাণ রেগে থাকে তাই তার কাছে ঘেঁষে না। বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে ও এসেছে গিফট চাওয়ার জন্য। কিন্তু এখন ভেতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। নিবিড় ওকে দেখে ফেলল আর ভেতর থেকে ডেকে উঠলো। এবার ও মাথা নিচু করে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালো।

” কিছু বলবি?”
” ব্রো তুমি বেড়াতে যাচ্ছ?”
” হুম কেন?”
” আমার জন্য গিফট আনিও!”

নিবিড় হেসে উঠে বলল,” এ‌কথা বলতে এতো ভয়। ব্রো কে এতো ভয় পাস ব্রো কি তোকে মারছে কখনো?”
মাহি আমতা আমতা করে বলল,” তুমি তো খুব রেগে থাকো। এর জন্য ভয় পাই। ভাঙচুর করো। মাম্মা বলেছে এই রুমে না আসতে তুমি ধমক দিবে মারতেও পারো।”
নিবিড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। মাহি চলে গেল।

সাদিয়ার মা সাদিয়ার বাবার সাথে তর্ক বিতর্ক করছে‌।
” তুমি মাইয়াটারে ওমন ক‌ইরা না বললেও পারতা। মাইয়াটা খারাপ না। আহিলের কথা শুইনা মাইয়াটারে যা নয় তাই বললা। দুঃখ পাইছে।”

” সত্যতা পেয়েই আমি বলেছি। বাইরের মেয়ের জন্য আমি নিজের বাড়ির দুর্নাম করতে পারব না। আমার ঘরে বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে আছে। তার কথাটা ভাবতে হবে।”
” আমি খারাপ কাউরে বাড়ি আনিনাই তুমি এই ভাবে আমারে অফমান করতে পারো না।”

” দেখো তোমার লগে এই নিয়ে আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। এই মেয়ে চলে গেলে বাঁচা যাবে। আমি নিজ চোখে তারে রাজিবের দোকানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখছি। আর রাজিব নিজে কয়দিন আগে বিয়ে কথা বলছিল আমি তখন বলে দিছি বিবাহিত। রাজিব কি কয় জানো?”

থেমে আবার শুরু করল, ” রাজিব কয়, সে নাকি বিশ্বাস করে না বিবাহিত। আর বিবাহিত হলে ও নাকি বিয়ে করব ছোঁয়া নাকি বলছে ডিবোর্স দিবে তার স্বামীরে। তাদের মধ্যে নাকি প্রেম জনিত সম্পর্ক আছে। আমি বিশ্বাস করি নাই কিন্তু আজ সন্ধ্যায় ওর দোকানে দেখে আমি বিশ্বাস করলাম। আহিল না বললে তো এই সব ঘটনা আমাদের চোখের আড়ালে থাকত। পড়ে মাইয়া আকাম কুকাম করে দিত ওর শশুর বাড়ির লোক আইসা আমাদের সাথে ঝামেলা করত। আমি এতো ঝামেলা ঘাড়ে নিতে পালমু না।”

সাদিয়ার মা আর কিছু বলার সাহস করলেন না। কিন্তু মনে মনে স্বামীর উপর তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে রইলেন। কিন্তু তার আর কিছুই করার নাই স্বামী অমতে ছোঁয়াকে বাসায় রাখা যাবে না মনটা খারাপ হয়ে বসে রইলেন।
রাত কোন ভাবে কাটিয়ে ভোরে বের হয়ে এলো বাসা থেকে ছোঁয়া। সাদিয়ার মা অনেক ভোরে উঠেন। তিন ছোঁয়া কে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসতে দেখে সাদিয়াকে ডেকে আনলেন। দুজনে থাকার মত কোন কথাই বলতে পারল না। তাদের থেকে সে আশা করল না ছোঁয়া।

কিন্তু কৃতজ্ঞতা চোখে সাদিয়ার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,” আমি আপনাদের ভুল বুঝিনি আমার সময় এতখানিই ছিল আপনাদের এখানে থেকে। সত্যি আমি খুবই নিশ্চিন্ত ছিলাম ভরসা মানুষ পেয়েছিলাম। আপনার মত একজন মানুষ আমার উপর ছায়ার মত ছিল। আপনাদের জন্য আমি এতদিন নিশ্চিন্তে থাকতে পেরেছি। বাকিটা পথ যেন আমি সহিসালামত কাটিয়ে নিতে পারি। দোয়া করবেন আমার জন্য আর নিজেরাও ভালো থাকবেন।”

সাদিয়ার মা জড়িয়ে ধরল। তার খুব মায়া লাগছে। মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো ভেবেছে মেয়েটার মায়ায় পড়ে গেছে। মেয়েটা এভাবে মনে কষ্ট নিয়ে চলে যাচ্ছে তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে কিন্তু কিছু করার নাই।
সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে আমি একটু হাসলাম সাদিয়া কেঁদে ওঠে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
“আপু তোমাকে খুব মিস করব!”

আমি তাকালাম কলিদের দরজার দিকে। কলির কথা খুব মনে পড়ছে। যতক্ষণ বাসা থাকতাম কলি আমার সাথে থাকত। মেয়েটাকে শেষবারের মতো দেখতে পারলাম না। বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো এই বাড়ি বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে খুব মিস করবো। কিন্তু কিছুই করার নাই একদিন না একদিন চলে যেতে হতো। সেইটা না হয় আগেই হবে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আমি এগিয়ে গেলাম। কিছু দূর আমাকে এগিয়ে দিল সাদিয়ার মা ও সাদিয়া।

আমার সাথে হেঁটে এলো কিছু দূর তারপর আমি তাদের থেকে বিদায় নিয়ে নিজেই হাঁটতে লাগলাম। আলো ফুটে উঠেছে এখন চারপাশ আলোকিত হচ্ছে। আমি খেয়াল করে দেখতে পেলাম দুজনেই খুব অসহায় মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তাদের কষ্টটা আমি ধরতে পারলাম। সাদিয়ার মা আমাকে অনেকবার খাবারের কথা বলেছে।

আমি খাইনি আসলে কালকের ওইসব শোনার পরে এই বাসায় একটা খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না। সেটা তো আর বলতে পারি না আমি শুধু খিদে নেই বলে চলে এসেছি। পেটে চাপা ব্যথার অনুভব করলাম কাল দুপুরের পর থেকে খাওয়া হয়নি রাতেও ঘুম হয়নি। চোখটা ব্যথা করছে। সামনে দোকান পেলে খেয়ে নেব কিছু।

এখান থেকে ২০ মিনিটের মতো রাস্তায় হেঁটে এরপরে পাকা সড়ক পাওয়া যাবে। সেখান থেকে একটা অটো নিয়ে শহরে পৌঁছাতে হবে তারপর টিকেট কেটে ট্রেন ধরতে হবে কিন্তু যাব কোথায়? মস্তিষ্ক কাজ করল না। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে লাগলো ওর মনে হলো ওকে কেউ ফলো করছে। বার কয়েক সন্দেহীন চোখে পিছনে তাকিয়েছে কিন্তু আশানুরূপ ফল পায়নি। বরাবরই ব্যর্থ হয়ে সামনে তাকাতে হয়েছে। কিন্তু বারবার কেন মনে হচ্ছে ওকে কেউ নজরে রাখছে ফলো করছে। হাত-পা ঘামতে লাগলো ভয়ে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল।

পাকা সড়কে আসতে আর পাঁচ মিনিটের রাস্তা তখন একটা দোকান দেখতে পেলাম। ছোটখাটো একটা দোকান কলা ও পাউরুটি পাওয়া গেল। সেখান থেকে আমি একটা কলা আর একটা রুটি কিনে খেলাম দোকান থেকেই পানি খেয়ে বেরিয়ে এলাম। অতঃপর এসে পৌছালাম শহরে ভাড়া মিটিয়ে ঘুরতেই আমার চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। মুহূর্তে রাগটা মাথা নাড়া দিয়ে উঠল। আমার সামনে দু হাত দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে রাজিব তাকে দেখে গতকালে সব কথা মনে পড়ে গেল। রাগে আমি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পরলাম। ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বসলাম রাজিবের গালে।

এই লোকটার জন্য এতগুলো মানুষের সামনে আমি চরিত্রহীনা উপাধি পেয়েছি। আমাকে নোংরা চরিত্রের মেয়ে বলেছে। সবগুলো মানুষের চোখে আমি এটা খারাপ জঘন্যতম খারাপ হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। শুধুমাত্র এই লোকটার জন্য।

রাজিব বিষ্ময়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে ও বিশ্বাস করতে পারছে না ছোঁয়ার মত ঠান্ডা মেজাজে মেয়েটা ওকে থাপ্পড় মেরেছে। অথচ রাজিব তো জানেন যে ছোঁয়া কেমন জানি ধানিলঙ্কা ও কখনই অন্যায় অপমান সহ্য করেনা নিজে শিক্ষা দিয়ে ছাড়ে। নতুন পরিবেশে এসে নিজের সেই রাগি চঞ্চল রূপটা লুকিয়ে রেখেছিল। শান্ত স্বভাবের নরম মনের মেয়ে হয়ে গেছিল। তাই বলে অপমান সহ্য করার মতো মেয়ে তো ও না। নিজের উপর অন্যায় কখনোই সহ্য করে না সেখানেই রাজিবের অপমানও কিভাবে সহ্য করবে?

“তুমি আমাকে মারলে? ওই বাসার লোক তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে বলে সে রাগ তুমি আমার উপর দেখাচ্ছে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার সাথে ফিরে চলো। আমি আজকে তোমাকে বিয়ে করব।”

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৪

“তুই আমার পিছে নিয়েছিস? এতক্ষণ তাহলে তুই আমাকে ফলো করতে ছিলি? অনেক সহ্য করেছি তোকে আর না। তোর জন্য অপমানিত হয়ে আমাকে বাসা থেকে বের হতে হয়েছে। এখন এসেছে আমার সাথে ভাব জমাতে? থাপরে তোর বিয়ে করার শখ যদি না মিটিয়েছি তো আমার নাম ছোঁয়া না।”

অবাধ্য প্রেম দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৫ শেষ অংশ