অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪২

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪২
নন্দিনী নীলা

নিবিড়ের দের বাসা থেকে চলে এসেছি এক মাস হলো। বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে আমি বিকেল বেলা বাসা ছেড়ে বেরিয়ে আসি। সেই সময়টাতে নিবিড় বাসায় ছিল না। রাফসান কাকা আর তাহমিনা আপু আমার সিদ্ধান্ত শুনে খুবই নারাজ হয়।

অনেক কিছু বুঝায় থাকার কথা বলে কিন্তু আমি রাফসান কাকাকে একটা কথাই বলি , ‘আমি কিন্তু এই বাসায় আসার পরে আপনাকে বলছি আপনি একটা বাসা খুঁজে দিবেন। না হলে আমি বাসা খোঁজে পেলে এখানে আর থাকতে পারবো না। এখন আপনি আমাকে বাধা দিতে পারেন না।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমার কথার প্রেক্ষিতে আর তিনি উত্তর দিতে পারে না কিন্তু তাহমিনা আপু বলতে লাগে, ‘আমি বাসায় আসলাম কোথায় ভাবলাম তুই আছিস। এখন তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি। এখানে তো ভাড়া দিয়ে থাকছিস তাহলে এখানে থাকতে সমস্যা কি?’

আমি বললাম, ‘আপু ছাদে আমার একা থাকতে ভয় করে। আর ওই ছোট রুমে আমার হয়না।’
‘নিচে না হয়…
আপুর কথা থামিয়ে দিয়ে কোথা থেকে নিবিড়ের ছোট চাচী চলে আসে। আমি চলে যাব শুনে সেতো মহা খুশিতে বলতে লাগে, ‘আপদ তাহলে বিদায় হচ্ছে। বড় আপা শুনলে খুব খুশি হবে।’

বলেই নিবিড়ের মাকে ডাকতে লাগে তিনিও খুব খুশি আমার যাওয়ার খবরটা শুনে‌। এসব দেখে তাহমিনা আপু মুখটা মলিন করে ফেলে। তিনি বুঝতে পারে আমার এখানে না থাকার কারণটা। তিনি আর আমার সিদ্ধান্তের উপর আপত্তি জানায় না। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ সাবধানে থাকিস।’

লিহান রা সেই রাত থেকে যাবে আমার এভাবে যাওয়া দেখে বলল, ‘ তুমি কোথায় বাসায় নিছো?
আমি লিলিদের বাসার ঠিকানা দিলাম।
লিহান বাসার ঠিকানা পেয়ে চমকে বলল,’আমার বাসায় ওখানে থেকে পাঁচ মিনিটের ব্যবধান। আচ্ছা যাও, দেখা হবে।’
আবির বেরিয়ে বাইরে এসে বলল, ‘ভাইয়া কিন্তু এসে সব জানতে পারলে খুব রাগ করবে। ভাইয়াকে না জানিয়ে তুমি চলে যাবে।’

আমি রাগান্বিত স্বরে বললাম, ‘তোমার ভাইকে আমি জানাতে যাব কেন? আর তার রাগের ধার ধারি নাকি আমি। আমার যা খুশি তাই করব।’
আবির বলল, ‘তুমি কি আমার উপর খুব বেশি রেগে আছো ভাবি?’
‘ আর একবার ভাবি বললে থাপ্পড় খাবে আমার হাতে ।’

আবির বলল, ‘ ভাবিকে কি চাচি বলব?’
আমি কটমট চোখে আবিরের দিকে তাকালাম।
দরজার ধুপধাপ শব্দে আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম। ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে দরজায়। আমি তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলতেই লিলি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দরজা থেকে সরিয়ে হুরমুর করে রুমের ভেতরে ঢুকলো।

লিলি নিচে আমার পাতা বিছানায় বসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে ছোঁয়া।এবার আমার কি হবে?
আমি দরজা আটকে বললাম, ‘ কি হয়েছে? আর একটু হলে তো দরজা ভেঙে যেত!’
লিলি আমার মুখের দিকে অসহায় মুখে তাকিয়ে বলল,’আজকে আমার এংগেজমেন্ট হবে।’

আমি চমকে উঠে বললাম, ‘কি সত্যি? বিয়ে কবে ঠিক হলো! আমাকে তো কিছুই বলিস নি। এখন এনগেজমেন্ট তখন আসছিস বলতে। তুই তো দেখি দীপার থেকেও শয়তান।দুটোতেই আমাকে এইভাবে ঠকালি?’
‘ধুর আমি নিজেই তো জানি না তোকে কিভাবে জানাবো? আমি মাত্র শুনলাম আম্মা আমাকে এসে বলল একটু ফেসিয়াল করার জন্য। বিকেলে নাকি পাত্র পক্ষরা আসবে একেবারে রিং পরিয়ে যাবে।’

‘আমাকে আবার মিথ্যা গল্প শোনাচ্ছিস না তো!’
‘তোর কি আমাকে এইরকম মনে হয়। আমি ছেলেকে দেখিনি পর্যন্ত। কবে ছেলে আমাকে দেখেছি কে জানে। আমারে নাকি খুব পছন্দ হয়েছে। আম্মা ছেলেকে দেখে ফেলেছে। সবকিছু দেখা শেষ। শুধু আমি ছেলেটাকে দেখতে পাই নি। আর বিয়ের সম্বন্ধে কিছু জানতাম না।

কিন্তু আমার পরিবার আর ছেলের পরিবার নাকি সবই জানতো। আর এই শয়তান ছেলে নাকি আমাকে সবকিছু জানাতে বারণ করেছিল। তারা ভেতরে ভেতরে বিয়ের পর্যন্ত চলে গেছে আর আমি এখনো এর কিছুই জানিনা। ভাবতে পারিস আমার মনের অবস্থা এখন কেমন? এর জন্য আমি তোর কাছে এসেছি তো সান্তনা নিতে।’

আমি চিন্তিত ভঙ্গিতে লিলির তাকিয়ে বললাম, ‘দোস্ত তুই কি আবার পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিস নাকি? আচ্ছা দোস্ত আমাদের অজান্তে তুই আবার কারো সাথে রিলেশনে জরিয়ে ছিলি না তো। তারপর আবার ব্রেকআপ করে দিছিস এখন সেই ছেলেটা তোর বিয়ে পাত্র হিসেবে তোদের বাড়িতে আসছে।’

আমি সন্ধিহীন চোখে তাকিয়ে আছি লিলির উওরের অপেক্ষায়। কারণ ছেলে যদি ওকে পছন্দ করে আর ওকে না জানিয়ে বিয়ে সব পরিকল্পনা করিয়ে থাকে। তাহলে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা লিলি কোনো পূর্ব পরিচিত মানুষ। তার সাথে লিলি আমাদের অজান্তে রিলেশনও করতে পারে।

অদ্ভুত ব্যাপার আমার কথাটা শুনে লিলি চমকালো ওর মুখটা দেখে মনে হচ্ছে চোর ধরা পড়ে গেছে ঠাস করে। ও আমার দিকে ঢোক গিলে তাকিয়ে আছে। আর কি যেন ভাবছে। তার মানে কি আমার এই বোকা বান্ধবীটাও প্রেম করেছিল। আর সেটা আমি আর দীপা টের পর্যন্ত পাইনি। কি চালাক মেয়ে বাবা।

‘কি হলো বল তোর বয়ফ্রেন্ড ছিল কি? খুব তো বলতি, রিলেশন করবি না। ভালো সেজে থাকতি।ছেলেদের ধারে ঘেঁষতে যেতি না, কথা বলতি না। এখন কি হলো সেই তো বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে রেখেছিলি এখন বাড়িতে এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আচ্ছা তুই এই বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ কেন করেছিলি? আর আমাদের থেকে লুকিয়েই বা কেন রাখছিলি তোর মনের কথাটা বল এবার।’

লিলি বলল, ‘দোস্ত আমাকে ভুল বুঝিস না। ব্রেকআপ কিভাবে হবে? আমি তো ওই ছেলের সাথে রিলেশন করিনি। রিলেশন করলে না ব্রেকআপ হবে।’
‘আবার মিথ্যে? এখন আবার ওই ছেলেটা তারমানে চিনে ফেলেছিস। আবার বলছিস রিলেশন করিস নি? রিলেশন না করলেই ছেলে কেন তোর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেবে? বোকা পেয়েছিস আমাকে?’

‘আমার সম্পূর্ণ কথা তো শোন তারপরে না হয় মন্তব্য করিস।’
‘আচ্ছা আচ্ছা বল।’
‘এই ছেলেটা ওই ছেলেটা কিনা জানিনা। আমার এখন একটা ছেলের কথা মনে পড়ছে। আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগের কথা। তখন আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। তখন তোদের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল না। তোদের সাথে তো পরিচয় হয়েছে অনার্সে উঠে। ছেলেটা নাম সম্ভবত ‘ রায়ান ‘

আমি যে গার্লস কলেজে পড়তাম তার পাশে ছিল পলিটেকনিক কোর্স কলেজ। ওই ছেলেটা সেখানেই পড়তো। ছেলেটা কয়েকদিন শুধু আমাদের কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো ছুটি হলেই বাইরে বেরিয়ে দেখতাম ওই ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি খুব একটা পাত্তা দিতাম না। আমি মাথা নিচু করে চলে যেতাম।

আর ছেলেটা কখনো আমার সাথে কথা বলতে আসেনি। আমিও যাইনি। ওই ছেলেটা ওই ভাবে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে মায়া হতো আবার মাঝে মাঝে খুব রাগ লাগতো। আমি চলে যেতেই হয়তো চলে যেত কিন্তু আমি যতক্ষণ এখানে থাকতাম ওই ছেলে ওইভাবেই দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে নির্লজ্জের মত।

এভাবে পনেরো দিনের মত চলে যায়। ওই ছেলের ভাব দেখে আমাদের কলেজের প্রায় অনেকেই বুঝে ফেলেছিল ওই ছেলেটা আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। আমার ফ্রেন্ডরা তো আমাকে ওই ছেলেটাকে নিয়ে
টিজ করতে শুরু করে দেয়। পরের দিক দিয়ে ওই ছেলেকে দেখলে আমার বান্ধবীদের মুখ দিয়ে একটা কথায় বের হতো তা হলো, ‘ লিলি ওই দেখ এমন ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কি কষ্ট করে তোর আশিক দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্য। যা বেচারার সাথে একটু কথা বলে আয়। আর কতকাল দাঁড় করিয়ে রাখবি।’

ওদের এসব কথা শুনতে শুনতে আমার কানটা জাস্ট পচে যাচ্ছিল। ওদের এমন টিস করা নিয়ে আমি খুব লজ্জা লাগত। কারণ আমি খুবই লজ্জাবতী একটা মেয়ে। কি করবো এই ছেলেটা না আসছে আমার কাছে একটা কথা বলতে আর না ছেলেটাকে পারছিলাম আমি মন ইচ্ছামত একটু অপমান করতে। দিন দিন সবাই যখন বুঝে যাচ্ছিল ক্যাম্পাসের সবাই প্রায় সব মেয়েরা আমাকে নিয়ে আর ওই ছেলেটাকে নিয়ে গুঞ্জন করত।

তারপর আমি এটাও শুনতে পেয়েছি, আমার সাথে নাকি ওই ছেলের গভীর সম্পর্ক আছে। কিন্তু কলেজে সবাই জেনে যাবে এজন্য নাকি আমি ছেলেটাকে সাথে কলেজে কথা বলি না। কলেজের বাইরে নাকি তার সাথে গভীর প্রেম আমার। ছেলেটাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিচ্ছি। বেচারা কেন আমার পেছনে এখনো পড়ে আছে। আমি তাকে অবহেলা করছি।’

যে কাজটা আমি করি নি সে কাজটা নিয়ে যখন সবাই আমার দিকে আঙ্গুল তুলছিল নিজেদের মাঝে। আবার মাঝে মাঝে তো আমার কে বড় আপুরা অনেক কথা বলতো। আমি তখন ভাবলাম এসব যদি স্যাররা জেনে যায় আর যদি আমার মা-বাবাকে বলে দেয়। আব্বা আম্মা এসব ব্যাপারে কিছু জানতে পারলে তো আমাকে মেরেই ফেলবে।

উপায় না পেয়ে ওই ছেলেটার নির্লজ্জ পানা করার কথাটা জানার জন্য আমি কথা বলার সিদ্ধান্ত আমি নিলাম।
কিন্তু সে কথা বলাটা আমাদের কলেজের সামনে বলবো না কারণ কলেজ সামনে বললে সবাই আমাকে জেঁকে ধরবে আমি জানি। এর জন্য কিভাবে ছেলেটাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাব এটাই ভাবছিলাম।

পরে ভাবার ছেলেটা যেহেতু আমাদের কলেজের সামনে কলেজটাতে পড়ে তাহলে ওইখানেই যাব আমি। তার পরের দিনে আমি ওই কলেজ কয়টা থেকে ক্লাস শুরু হয়ে জেনে আধাঘন্টা আগেই ওই কলেজের ভেতরে গিয়ে বসি। ওইটা যেহেতু কোন বয়েজ কলেজ না এজন্য ওই কলেজে ভেতরে ঢুকতে আমার সমস্যা হয়নি। ওই কলেজে ভেতরে একটি শিমুল গাছ আছে আমি সেই শিমুল গাছটার নিচে বসে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকি কখন ছেলেটা ঢুকবে?

তখন আমি ধরব।
অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ছেলেটাকে কলেজে আসতে দেখি না এদিকে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ছেলেটা হয়তো আজকে আসবে না কি আর করব এদিকে আমার ক্লাস আছে আর আধা ঘণ্টা পরে এজন্য আমি নিজের কলেজে চলে আসি আমি নিজের কলেজের সামনে এসে চমকে উঠি ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে আমার কলেজের সামনে।

উদ্বিগ্ন হয়ে দরজা দিকে চেয়ে আছে হয়তো আমাকে খুঁজছে। আমিও আজ ছেলেটাকে বোকা বানাব ভাবলাম। ছেলেটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে একটা গাছ আছে আমি সেই গাছের পিছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। দেখি ছেলেটা আমার জন্য কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকে।

আমি গাছের আড়াল থেকে সরে কিছুটা দূরে থাকা ছোট একটা হোটেল সেটার ভেতরে গিয়ে বসে র‌ইলাম। একটু পর পর বের হয়ে দেখছি ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে কিনা। ঠিক আমার ক্লাসটা শুরু হওয়ার ঘন্টা দিল সেই মুহূর্তে ছেলেটা নিজের কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

ছেলেটার মুখ মলিন করে আছে আমাকে দেখতে পায়নি এজন্য কি? তারমানে ছেলেটা সকাল বিকাল দুবার আমাকে ফলো করে। আমি তো যাওয়ার সময় কখন এদিকে তাকাই না।
ছেলেটা হোটেলের কাছাকাছি এসে চলে যেতেই আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এসে ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আচমকা সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে ছেলেটা হকচকিয়ে গেল। সামনে কদম ফেলা পা সামনে না ফেলে পেছনে ফেলে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪১

আমি উনার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বললাম, ‘আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছি। চলেন ওই হোটেল গিয়ে বসি।’
বিনা বাক্যে ছেলেটা রাজি হয়ে গেল আমার সাথে হোটেলে গিয়ে বসল।

অবাধ্য প্রেম পর্ব ৪৩