অবিনাশী শেষ পর্ব 

অবিনাশী শেষ পর্ব 
রেজওয়ানা আসিফা

মাথা নিচু করে দুটো মানুষ পাশাপাশি বসা। সামনেই দারানো তিনজন মানুষ,
তিশা নূর বসে মাথা নিচু করে বসে আছে সোফায়। তমা আমান দারিয়ে আছে পাশে জামাল সিকদার। তাদের থেকে কিছু টা দূরে দারিয়ে আছে রাবেয়া বেগম।
চারপাশ কোলাহল শূন্য। সবাই চুপ। নিরবতা বিরাজ করছে সবার মাঝে। সব নিরবতা ভেঙে তমা বলে উঠলো,
-তুমি আমাদের জানাতে পারতে তিশা! আমি নাহয় তোমাকে সাপোর্ট করিনি কখনো। তোমার বাবা তো করেছে। তারপর মান সন্মান নিয়ে কেনো খেললে?

মায়ের ভাড়ি কন্ঠের আওয়াজ পেয়ে তিশা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। তানিয়া সাহস করে বললো,
-মা ও মান সন্মান নিয়ে খেললো কই? যা করেছে আমাদের পরিবার বাদে তো কেউ জানেনা।
তমা অগ্নি চোখে তাকালো তানিয়ার দিকে। ধমকের সূরে বললো,
-ছোট মানুষ চুপ করে থাকো। বাড়ির বউয়ের বেশি কথা পছন্দ না আমার। তার উপর আবার তুমি অনেক বেড়েছো। মাথা গরম করো না আমার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

তমার কথা বলা শুরু করায় জামাল সিকদার যেনো সাহস পেলো এবার কথা বলার, হন হন করে বললো,
– আমার মান ইজ্জত তুমি আর তোমার মা ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছো। তোমাদের দুই জনকেই ত্যাগ করবো আমি।
জামাল সিকদারের এই কথাটা প্রচণ্ড গায়ে লাগলো আমান চৌধুরীর। তিনি কৌতূহলী হলে জিগ্যেস করলো,
– আপনি এটা বলতে পারতেন যে আমাদের বলা উচিত ছিলো। কিন্তু মান ইজ্জতের কথা কীভাবে আসলো! আর আমার মেয়ে দেখতে সুনতে খারাপ না যে ওর জন্য আপনার মান ইজ্জত জাবে।

-আমান তুমি ভুল বুজছো! তিশা মানুষ আমিই করেছি তা তুমি ভালো করে জানো। ও আমার শিক্ষায়ই গড়া। ওর জন্য মান সন্মান যাবে এটা কেনো বলবো আমি।
তানিয়া আবার বলে উঠলো,
– আচ্ছা এটাই কী সত্যি? আপনারা তো জানতেন যে ওরা দুজন দুইজনকে ভালোবাসে তাহলে কেনো অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করেছিলেন।

তানিয়ার কথা শুনে তমা আর আমান চৌধুরী তুমি জনেই অবাক হয়ে তাকালো। আয়ান হিয়া দুই জনেও অবাক হয়ে গেছে। জামাল সিকদার তানিয়ার কথা শুনে চুপ করে দারিয়ে আছে। তানিয়া একটু এগিয়ে এসে বলতে শুরু করলো,
-দেখেন মামা! তিশা কে আপনিই মানুষ করেছেন। আপনিই কিন্তু ওর আরো একটা বাবার মতো। ওরা দুই জন দুই জনকে ভালোবাসে। সব দিক ঠিক কোনো সময়ও নেই। আপনি মেনে নিতে পারছেন না এইজন্য যে, আপনার মনে হচ্ছে আমাদের এই পরিবার টা আর পাচটা সাধারণ পরিবারের মতো ছিলো না এতো দিন। আপনার মনে হচ্ছে আপনার পরিবার আর এই পরিবার টা অনেক টা ভিন্ন। কিন্তু তিশা তো আপনার পরিবারের শিক্ষায় বড়ো হয়েছে। আর ওর ভালোবাসায় তো পরিবার আসবেনা।

সবাই চুপ করে দারিয়ে আছে।
আজকে সকালে কাজী অফিস থেকে তিশা এবং নূর কে বিয়ে করিয়ে চৌধুরী বাড়িতে ওদের নিয়ে উঠেছে রাবেয়া বেগম। নিজের বাড়ি যাবার সাহস হয় নি। ওদের ওই ভাবে বাড়ি ঢুকতে দেখে তানিয়া অবিক হয়ে জায়। কারণ কাল রাতেও দু জন কথা বলেছে। ও সকালে কখন বের হয়েছে বাড়ি থেকে কেউ জানেনা। তমা হা হয়ে তাকিয়ে আছে। তিশা বাড়ির মধ্যে ঢুকতে জাবে তখনই তমা সামনে দারালো। তমার চোখে চোখ রাখতে পারেনী তিশা। সোজা অন্য দিক দিয়ে দৌড় দিয়ে উপরে চলে গেছে। তিশা উপরে জেতেই তানিয়া হিয়া দুই জন পিছু পিছু গেলো। তিশা ভয়ে কাপছে। তানিয়া তিশার পাশে গিয়ে বসে বললো,

-তুমি সকালে বের হয়েছো কখন? আর তোমরা বিয়ে করেছো?
তিশা ভয়ে ভয়ে মাথা নারালো। তানিয়া অবাক হয়ে জিগ্যেস করলো,
-মামি কীভাবে আসলো?
তিশা একটু পানি খেয়ে বললো,

– আয়শার বিয়ে হয়ে জাওয়ার পর মামি নিজের ভুলটা বুঝতে পারে। মামা মানবে না এই ভয়ে সে আমাদের বিয়ে দেয়। অনেক সকালে নূরের ফোন পেয়ে উঠি তারপর ও আমাকে বাড়ির বাইরে থেকে নিয়ে জায়।
তানিয়া তিশার কাধে হাত রাখতেই তিশা তানিয়া কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-আমার খুব ভয় করছে। মামা মা বাবা কতো ভালো বাসতো আমাকে। আজকে থেকে সবাই খারাপ ভাববে। ছি ছি করবে আমাকে।

-চিন্তা করো না তুমি। কিচ্ছু হবে না।
এর পরে, আমান চৌধুরী জামাল সিকদার কে ফোন করে বাড়ি ডাকে। বাড়ি আসার পরেই এতো কিছু হয়ে গেলো।
সবাই আবার চুপচাপ হয়ে আছে। তিশার খুব অস্বস্তি লাগছে এভাবে বসে থাকতে। উপরেই ভালো ছিলো। জামাল সিকদার আসার পর নিচে নামিয়েছে ওকে।

জামাল সিকদার কপাল চেপে পাশে থাকা একটা চেয়ার টেনে বসলো। নূহা এখানেই ছিলো। তার মনে হচ্ছে বাবার শরীর খারাপ। এগিয়ে এসে বাবাকে পানি দিলো। জামাল সিকদার পানি টা ঢক ঢক করে খেয়ে রাবেয়া বেগমের দিকে তাকালো। রাবেয়া বেগম স্বামীর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না ভয়ে। নিচু হয়ে দারিয়ে আছে। জামাল সিকদার গম্ভির গলায় বললো,

– মাতব্বরি করে ছেলেকে বিয়ে দিয়েছো এখন বউ তো বাড়ি নিতে হবে। আমরা সিকদার বাড়ির লোক। বউকে পরের বাড়ি রেখে দেইনা। বউ বাড়ি নেবার ব্যবস্থা করো।
তমা ছল ছল চোখে তাকালো ভাইয়ের দিকে। কিন্তু তমার দিকে তাকালো তিশা। তার প্রথম থেকেই চিন্তা হচ্ছিলো তায মাকে নিয়ে। আমান চৌধুরী মেনে নিলেও তার মা মেনে নিবে কিনা এই নিয়ে একটা চিন্তা হচ্ছিলো তার। কিন্তু তার মায়ের চোখ দেখে মনে হচ্ছে মেনে নিয়েছে। তিশা তানিয়ার দিকে ইশারা করলো। তানিয়া বুঝতে পারলো তিশার এখানে বসতে ইচ্ছে করছে না। তানিয়া তমার কাছে গিয়ে বললো,

-মা মেয়েটা সারাদিন কিছু খায় নি। এখন ওকে নিয়ে জাই।
তমা চুপ করে আছে। তানিয়া আর কোনো কথা বললো না। তিশাকে নিয়ে উপরে চলে গেলো।
তিশা শিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললো,
বাচালে আমায়। মরেই জাচ্ছিলাম ওখানে বসে থেকে। কী যে বিরক্তিকর অবস্থা। ঘরে গিয়েই তিশা বিছানায় ধপাস করে সুয়ে পরলো।

সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
-জতোটা চিন্তা করছিলাম জতোটা ঝামেলা হয় নি। বাবাহ্, আমি আজকে একটু শান্তি তে খেতে পারবো।
হিয়া ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-আমাকে না জানিয়ে কতো কিছু করে ফেললে তোমরা, এই আপন ভাবো আমাকে?
তানিয়া হিয়ার কাধে হাত দিয়ে বললো,

-এমনিতেই নতুন বিয়ে করেছো। তাই তোমাকে আর চিন্তা দিতে চাইনি।
-হয়েছে। আর কথা ঘুরাতে হবে না। ভালোই হলো। কিছু দিন পর আবার একটা বিয়ে খেতে পারবো।
তিশা ভ্রু কুচকে বললো,
-কার!
-তোমার।

-আমিতো বিয়ে করে নিয়েছি।
– আরে ওটা তো জাস্ট কাবিন। এখনো তো অনুষ্ঠান বাকি।
তিশা ডয়ার দিকে বাদামের বয়াম বের করে বাদাম খেতে খেতে বললো,
– যেভাবে বিয়ে করেছি মা উষ্ঠা মেরে বের করবে বাড়ি থেকে। তুমি আসছো অনুষ্ঠান নিয়ে।
-আরে নাহ্। মা নিচে বলছিলো বাবাকে, আমি শুনেছি।
তিশা বাদামের বয়াম রেখে বললো,

-আর কী কী বলেছে?
-আরে অতো কিছু কী শুনেছি নাকি।
-ইশশ ! দারিয়ে শুনবে না!
-আচ্ছা তানিয়া ইশান ভাইয়া তো এখনো কিছু জানেনা।
– না। কিছুই তো জানেনা, বলবো কীভাবে সেই সকালে বের হয়েছে। কোথায় গেছে কে জানে।
-যানো আয়ান নিজেকে খুব অপরাধী মনে করছে। ওর একটা বোন কতোটা কষ্ট ভয় পেয়েছে।

দিন দিন তানিয়ার শরীরের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। পেটে বাবু বড়ো আস্তে আস্তে বড়ো হওয়াতে নরতে চরতে কষ্ট হচ্ছে। তানিয়ার এই অবস্থা দেখে আমান চৌধুরী তিশার বিয়ের কোনো আয়োজন করতে চাচ্ছে না। তবে তমা আর জামাল সিকদার বিপরীত। দুই জনেই চাচ্ছে অনুষ্ঠান করবে। তমা বলছে তার একটা মেয়ে আর জামাল সিকদার বলছে তার একটা ছেলে। বাড়িতে ঝামেলা হবে তানিয়ার এতে কোনো অঘটোন ঘটে গেলে অনেক সমস্যা হবে এই ভেবে আমান চৌধুরী বার বার বারন করছে। শেষমেশ তানিয়া বললো,

– না না ওরা দুই জনেই দুই পরিবারের একমাত্র মেয়ে ছেলে। ওদের বিয়ের আয়োজন হবে না তো কার বিয়েতে হবে। অনেক মজা করবো সবাই। বাবা আপনি না করিয়েন না।
ওইদিকে নুহার শশুর বাড়ি থেকে প্রচণ্ড চাপ আসতেছে তারা বাড়ির বউ বাড়ি নিয়ে যাবে। জামাল সিকদার বলেছে তিন বছর তো হয় নি। তারা মানছে না। তাদের এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বাড়ি ফাকা ফাকা লাগে। জামাল সিকদার তারপরও না করেছে কিন্তু নুহার শশুর তারপরও অনেক রিকুয়েস্ট করছে জামাল সিকদার কে। তাদের এতো জোরাজুরি দেখে জামাল সিকদার বলেছে নূরের বিয়ের পর সে ভেবে দেখবে।

ফাতেমা নূহা আর শেহজাদ আজ চলে যাবে এই বাড়ি থেকে। দুদিন পর তাদের বাড়িতেই নানা কাজের ধুম পরে যাবে তাই তাদের খুব শিগ্রই বাড়ি ফিরতে বলেছে জামাল সিকদার। নূর আগেই চলে গেছে।
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। কালকে বিয়ে। আজকে হলুদ করার ইচ্ছে ছিলো সবার। কিন্তু জামাল সিকদার বারন করেছে। তাই করা হবে না।

তিশার সব শপিং করা হয়ে গেছে। নূর নিজে সব শপিং করে দিয়ে গেছে আজকে সকালে। সকালে খুলে দেখার সময় হয় নি কারো। তাই হিয়া আর তানিয়া সব নিয়ে বসেছে। তানিয়া বড়ো লাকেজ থেকে একটা একটা করে সব বের করছে আর হিয়া খুলে খুলে দেখছে। গাড়ো খয়েরি রং এর শাড়ি এনেছে। লেহেঙ্গা ভালো লাগে না তেমন তিশার। তাই নূরকে বলেছিলো শাড়ির কথা। শাড়িটা দেখে হিয়া বললো,

– তিশা দিখো। শাড়িটা কী সুন্দর হয়েছে।আমার বিয়ের ড্রেস থেকে তোমার টা সুন্দর হয়েছে। কি সুন্দর রং। খুব মানাবে।
তিশা শাড়িটা হাতে নিয়ে হাত বোলালো। তারও খুব পছন্দ হয়েছে। মনে মনে নূরের পছন্দের প্রশংসা করছে। আগে থেকেই নুরের পছন্দ সবার উপরে।

রাত তিনটা বাজে। তিশা মুভি দেখছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। বিরক্ত নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো নূরের আগের নাম্বার। বুঝতে পারলো নূরের আগের ফোন দিয়ে দিয়েছে। কিন্তুু এক সপ্তাহ হয়ে গেছে এতো দিন পর দিলো কেন সেটা বুঝতে পারলো না।ফোনটা ধরেই বললো,
-এত সুন্দর একটা সিন আসলো উমনি তোমার ফোন দিতে ইচ্ছে করলো!
-মানে?

-মুভি দেখছিলাম। নায়ক নাইকার কী সুন্দর একটা রোমান্টিক সিন আসলো অমনি ফোন দিলে।
-তোমার রোমান্টিক সিনের গুষ্ঠি কিলাই। কতো কিছুর পর আমাদের বিয়ে টা হলো। এটা নিয়ে তোমার আনন্দ করা উচিৎ আর তুমি মুভি দেখছো। আর আমি চলে আসার পর নিজ থেকে একটা ফোনও দাও নি। প্রতিদিন আমি ফোন দেই।

-এই ভালো কথা। তোমার এই নাম্বার টা এতোদিন পর কেনো?
-আরে মা সিম হারিয়ে ফেলেছিলো। আজকে পেয়েছে। ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে। শোনো এখন মুভি টুভি রাখো। কালকে তারাতাড়ি উঠে সকালের নামাজ টা আদায় করবে। রাখি। ঘুমাবো।
-কীহ্! আজকের রাত টা কতো স্পেশাল আর তুমি ঘুমাবে!
নূর একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,

-কালকে সারারাত জেগে থাকতে হবে তো আর কালকের রাতটা বেশি স্পেশাল তাই আজকে ঘুমাচ্ছী।
তিশা বুঝতে পারলো নুরের মাথায় শয়তানি কাজ করছে। তাই দুই একটা ধমক দিয়ে ফোন রেখে দিলো।
সকাল ৮ টা যাবে। তমা প্রচণ্ড রেগেছে তিশার উপর। এখনো ঘুম থেকে উঠে নি। উঠেনি বলতে সকালের নামাজ পরতে উঠেছিলো। নামাজ পরে আবার ঘুমিয়েছে।

তমা হিয়াকে উদ্দেশ্য করে কড়া গলায় বলেছে, তিশা যদি এখনো ঘুম থেকে নি উঠে তাহলে সে বাড়িতে যুদ্ধ শুরু করে দিবে। হিয়া ভয় পেয়ে তারাতাড়ি গেলো তিশাকে ডাকতে।
অনেক ক্ষন ডাকার পরেও তিশা উঠে না। ওইদিকে তমা এখনো রাগারাগি করছে। হিয়া হঠাৎ করে একটা দুষ্টু বুদ্ধি বের করে মুচকি হেসে বললো,

-তিশা এই তিশা মামা আবার ঝামেলা করেছে, বিয়ে নাকি আজকে হবে না। উঠো তারাতাড়ি।
কথাটা শুনেই তিশা লাফিয়ে উঠলো। কাসতে কাসতে তিশার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। হীয়া তারাতাড়ি ওকে পানি দিলো। তার অনেক হাসি পাচ্ছে। আর আটকে রাখতে না পেরে ইচ্ছে মতো হাসা শুরু করেছে। হিয়ার এমন হাসি দেখে তিশার বুঝতে বাকি নেই যে সে মজা করেছে।
তিশা গম্ভীর গলায় বললো,

-তুমি মজা করেছো? মজা করার অন্য কোনো বাক্য পেলে না? ভাইরে ভাই ! আরেকটু ধরে ঘুমের মধ্যে মরেই জেতাম।
-কী আর করতাম, তুমি উঠছোই না। অন্য দিকে মা বকেই জাচ্ছে। এখন জাও তারাতাড়ি ভালো মেয়ের মতো উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। খাওয়া দাওয়া করে গোসল করবে। একটু পরেই সাজানোর জন্য লোক আসবে।
-সেকি এতো তারাতাড়ি?
-হ্যারে বাবা! সাজাতে খুব সময় লাগে।
– আচ্ছা তানিয়া কী করে!?

-ওর শরীর টা না একটু খারাপ। তাই এখনো উঠে নি। আর মা উঠতে বারন করেছে।
নিচ থেকে আবার শব্দ এলো তিশা “উঠেছে কিনা” হিয়া শব্দ শুনে তারাতাড়ি তীশাকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে বললো,
-জাও তারাতাড়ি বের হবে। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
নিচে আসতে আসতেই দেখলো তানিয়া উঠে গেছে। রান্না ঘরে কাজ করছে। আর তমা সমানে একেকটা বলে যাচ্ছে। মাংস পানিতে ভেজাতে ভেজাতে বললো,

– কতোবার বলেছি নিচে এসো না। এই কাজে তোমাকে হাত দিতে হবে না। কাল থেকে বলেছি তুমি আজকে আসবে না। তারপরও ওকে আসতেই হবে। কারো কথা শোনে না। প্রচণ্ড ত্যারা মেয়ে কোথাকার। আমরাও তো বাচ্চাদের মানুষ করেছি আমাদের সন্তান এতো ত্যারা না। এই যে প্রথম সন্তান আমার ছেলের। কিছু হয়ে গেলে এর দায় তো তুমি নিবে না।

আরো নানা কথা বলেই জাচ্ছে তমা। হিয়া তমার পেছন দিয়ে তানিয়ার কাছে গিয়ে চোখ ঈশারা করলো। তানিয়া হিয়াকে কিছু বলতে বারন করলো।
-মা এই মাংস কেনো বের করলেন? বাবা ঈশান ভাইয়া আয়ান বাজারে গেছে তো আর সব বাজার রান্নার ওখানে দিয়ে আসবে। এই এইটুকু মাংস দিয়ে কী করবেন?
তমা হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

-দেখছো না আমার মাথা গরম! তাই মাথায় ঢালবো।
হিয়া এই কথা শোনার পর আর কথা বললো না।
তমা শীল পাটা নামাতে নামাতে বললো,
– ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে হোক বা অন্য কারো সাথে, বিয়ের পর মেয়েরা পর হয়ে যায়। ইচ্ছে হয়েছে আজ মেয়েকে নিজের হাতে ওর পছন্দের মাংস কসা করে খায়াবো।
তানিয়া রুটি ভাজতে ভাজতে বললো,

-আমরাও তো মেয়ের মতোই। একটু বেশি করে তৈরি করেন যেনো আমরাও একটু ভাগে পাই। কী বলো হিয়া!
হিয়া চোখ জল জল করে বললো,
– হ্যা হ্যা কসা মাংস আমার খুব পছন্দ। এখনি তো জিভে পানি চলে এসেছে।
তমা মাংস ভেজানো বলটা দিকে তাকিয়ে হিয়া কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-ওইতো বলে রাখা আছে এখনি খেয়ে নাও।

হিয়া আর কথা বললো না কোনো। তানিয়া মিট মিট করে হাসছে।
দুই ছেলে নিয়ে ঝুড়ি ভরে বাজার করে এনেছে আমান চৌধুরী। সব বাজার রান্নার লোকদের বুঝিয়ে তারপর বাড়ি গেলো। তমা নিজ হাতে সবার জন্য কসা মাংস করেছে। তানিয়া রুটি বানিয়েছে। সবাই সকালের নাস্তা করে নিয়ে সবার কাজে চলে গেলো। তিশাকে সাজানোর লোক এসেছে। কিন্তু তিশা এখন বসবে না। তমাও জোর করলো না। কারণ আজ তো আর বিয়ে হবে না শুধু অনুষ্ঠা।

১১ টা বাজে তিশাকে আরেকবার খাবার দিলো এই খাবার খাওয়ার পরেই ওকে সাজানো হবে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সাজতে বসলো।
৩ টা বাজে নূরের বাড়ি থেকে সবাই চলে এসেছে। তিশা সেজেগুজে বসে বসে মুভি দেখছে। হঠাৎ নুহা দৌড়ে রুমে ঢুকলো।নূহাকে দেখে তিশা বললো,

-কীরে কখন এসেছিস? খাওয়া দাওয়া করেছিস?
নূহা মুখটা বকার মতো করে বললো,
– যখন আমার শশুর বাড়ি থেকে এই সময় মহিলারা আমার ঘরে এসেছিলো আমি কতো চুপচাপ ছিলাম। আর তুমি কোনো সন্মানি দিলে না।
তিশা মুখ বাকিয়ে বললো,

– এহহহ! আসছে সন্মান! ছোট থেকে কোলে যারে কোলে নিতে নিতে কোমড় ত্যারা হয়ে গেছে তাকে আবার সন্মান! সর এখান থেকে।
– কেমন যেনো একটা বড়ো বহংয় ফিল হচ্ছে। ননদ ননদ ফিল হচ্ছে।
– ওই ননদ ননদ ফিলটা না খেয়ে ফেল বা ভুলে জাহ্।
-দাম দিলে না তো! থাক দিতে হবে না। বাদ দাও! তোমার সাথে কথা বলে লাভ নেই। পেট টার দিকে একটু নজর দেওয়া উচিৎ এখন আমার। গিয়ে খেয়ে আসি যাই।

নূহা বের হতেই তমা আর দুই পাশে তানিয়া আর হিয়া ঘরে ঢুকলো। তিশা তমার দিকে তাকাতেই দেখলো তমার মুখটা আধার হয়ে আছে। তিশার কাছে এসে বসে তিশার মুখে হাত বুলিয়ে দিলো তমা। তার চোখে পানি টলমল করছে। চোখটা মুছে বললো,

– এখন আর ওটা তোমার মামা মামির বাড়ি নয়। শশুর বাড়ি। আগের মতো উড়ে চলো না। সব সময় সাবধানে কথাবার্তা বলবে। সব কাজৈ সাহায্য করবে। কিছু না পারলে সেটা নিয়ে কেউ কথা শোনালে মুখে মুখে তর্ক করবে না। শেখার চেষ্টা করবে। সবার খাওয়া দাওয়া প্রায় শেষ। ফটোগ্রাফার ছবি তোলা কমপ্লিট করলেই তোমরা বেড়িয়ে পরবে। ঢাকার পথ। অনেকটা পথ। তাই তারাতাড়ি বেরোনো টাই শ্রেয়।
তমা কথা গুলো বলেই চলে গেলো।
তিশার দুই পাশে বসে আছে দুজন। তানিয়া বা পাশে আর হিয়া ডান পাশে। দুজনের চোখেই পানি। তানিয়া নিচে তাকিয়ে বললো,

-যেদিন এই সংসারে এসেছিলাম, এই সংসার ছিলো অন্ধকার। আমি বয়সে ভালোই বড়ো ছিলাম। কিন্তু এই সংসার টা আমার কাছে অনেক টা বোঝা ছিলো। বাচ্চাদের যেমন লেখাপড়া করতে ভালো লাগতো না। আমরাও তেমন এই সংসার ভালো লাগতো না। কিন্তু যেদিন থেকে তুমি পাশে এসে দারালে সেদিন থেকে নিজের মধ্যে শক্তি খুজে পেলাম। তোমার মতো ননদ প্রতিটা মেয়ে যেনো পায়।
হিয়া তিশার দিকে তাকিয়ে বললো,

-ওই বাড়ি গিয়ে আবার আমাদের ভুলে যেনো না।
দুই ভাই ননদ কে দুই টা উপহার দিলো তারপর অনেক অনেক দোয়া দিলো।
তিশা ঘরে বসে আছে। তানিয়া আর হিয়া ঘরটা সুন্দর করে গুছিয়েছে। কারণ এখানেই ছবি তোলা হবে আর নূর এখানেই বসবে। সবাই এক পাশে দারিয়ে আছে। নূর ঘরে প্রবেশ করলো। তিশা চোখ তুলে তাকাতে পারছে না লজ্জায়। নূর পাশে এসে বসার পরে একটু উকি দিয়ে তাকালো নুরের দিকে। ওর শাড়ির সাথে মেলানো নূরের পাঞ্জাবী। দেখতে কী সুন্দর লাগছে। মনে মনে একবার মাশাআল্লাহ বলে মুচকি হাসলো।

সব নিয়ম কানুন পালন করতে করতে ৬ টা বেজে গেলো এবার বের হতে হবে।
কিন্তু তিশার সে কী কান্না। কতোক্ষন তানিয়াকে জড়িয়ে ধরে আবার হিয়াকে জড়িয়ে ধরে। তমা আর আমান চৌধুরী দারিয়ে আছে। তিশা দৌড়ে এসে দুইজনকে জড়িয়ে ধরলো। দুই জনেই মেয়েকে আদর করে কান্না কিছু টা থামিয়ে তারপর তিশার হাত টা নূরের হাতে তুলে দিলো।

নূর তিশাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে তুলে গাড়ি আটকে দিলো। ওই বাড়ি থেকে যারা এসেছিলো সবাই গাড়িতে উঠে পরলো। জামাল সিকদার তমা আর আমান চৌধুরীর থেকে বিদায় নিয়ে তারপর বের হয়ে গেলো।
১০ টা বাজে এসে গাড়ি থামলো। সবাই চলে এসেছে বউ দেখতে। ভিড় ঠেলে নূর তিশাকে কোলে নিয়ে বাড়ির দরজায় রাখলো। রাবেয়া বেগম এসে তিশার হাত ধরে বাড়ির মধ্যে নিলো। তিশাকে তার নিজের ঘরে নিয়ে গেলো।

সব মহিলা এসে তিশাকে দেখে জাচ্ছে। এদিকে তিশার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। মনে মনে গালাগালি করে মহিলাদের গুষ্ঠি উদ্ধার করছে সে। ছোট থেকে দেখে আসছে। এখন আবার দেখার কী আছে! নূহাকে পাশে দারিয়ে থাকতে দেখে, চোখের ঈশারায় ডেকে কানে কানে বললো,
-এই ভাবে কতোক্ষন বসে থাকতো! মামিকে বল এদের এখান থেকে বের করতে আর আমাকে লাকেজ থেকে একটা থ্রি পিস দে।

-নাহ্! এভাবে বসে থাকা কতোটা কষ্টকর তুমিও একটু টের পাও।
-দিবো ধরে একটা। জা বলছি তারাতাড়ি কর। নাহলে কিন্তু আমিই উঠবো।
– না না তুমি উঠলে মা আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। আমিই জাচ্ছি।
– এইতো লক্ষি মেয়ে! জাহ্। তারাতাড়ি বল।
নূহা রাবেয়া বেগম কে গিয়ে সব বলতেই রাবেয়া বেগম ঘরে আসলো। সব মহিলাদের বের করে দিলো। তিশা কাপড় চেঞ্জ করে একটা থ্রি পিস পরলো। হাত মুখ ধুয়ে সব মেকআপ তুলে বাইরে এসে দেখলো নূহা খাবার নিয়ে এসেছে। তিশা হাত মুখ মুছতে মুছতে বললো,

-কীরে মামি এই খানে আজকে এতো কিছু রান্না করতে গেছে কেনো?
-মায়ের রান্না করতে বয়েই গেছে। ফুপি সব পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি তো কান্নার জন্য দেখতেই পাও নি।
তিশা খাবার তুলে খেতে খেতে বললো,
-আমার বাড়ির খাবার দিয়েই আমাকে আদর করা হচ্ছে।
-তুমি যে এভাবে খাচ্ছো ভাইয়া খেয়েছে কিনা জিগ্যেস করলে না?
-এইরে! ভুলেই গেছি? ও খেয়েছে?

– কত্তো আগে খেয়েছে!
-তাহলে জিগ্যেস করতে বললি কেন?
-এমনি তোমাকে ঘাটানোর জন্য ! খেয়ে ঘুমিয়ে পরো! আমি এখন আসছি!
-ঘুমিয়ে পরবো মানে?
– ঘুমিয়ে পরবে মানে, ঘুমিয়ে পরবে!
-মানে আমি বলতে চাচ্ছি এই ঘরে ঘুমাবো নাকি?
-হ্যা ওই ঘরের জন্য টাকা লাগবে ১০ হাজার। জেটা দিতে তোমার বর নারাজ। তাই তোমাকে এই ঘরেই ঘুমাতে হবে।

– এতো কেনো? বাজেট কমা!
-এটা আমার হাতে নেই। আমার ননদ দেবররা সাজিয়েছে আমি তো একটু দরদাম করে দিচ্ছি।
-আরেকটু কমা !
– সম্ভব না! ২০ হাজার টাকা চেয়েছিলো কমিয়ে ১০ করেছে।
-ঘর কী সোনা দিয়ে সাজিয়েছে নাকি! এতো দাম!

-নাহ্। ফুল দিয়েই সাজীয়েছে। আর ফুল তো ভাইয়া কিনে দিয়েছে ফুলের দাম বাদেই ১০ হাজার।
-কীহ্! ফুলের দাম বাদেই এতো টাকা? মাথা ঠিক আছে?
-একদম ঠিক আছে। ভাইয়াকে পাঠাচ্ছী। বুঝিয়ে বলো টাকা টি যেনো দিয়ে দেয়।
-লাগবে না ঘর তোরাই ঘুমা। আমি এখানেই ঘুমাই।
-এখানে বাবা মা ঘুমাবে।
– সমস্যা কী আমার ঘর আছে না ওখানে ঘুমাবো।

-ওখানে আমার শশুর বাড়ির মানুষ রা অলরেডী সুয়ে পরেছে। শুধু শুধু কিপটামো না করে ভাইয়াকে বলো টাকা টা দিয়ে দিতে আমি গিয়ে ওকে পাঠাচ্ছী।
নূর ঘরে এসে দেখলো তিশা গব গব করে খাচ্ছে। পাশে বসে বললো,
-আমি খেয়েছি কিনা জিগ্যেস ও তো করলে না!
তিশা খাবারের দিকে সম্পূর্ণ মনযোগ নিয়ে বললো,

-খেয়েছো আমি জানি!
-কীভাবে?
-নূহাকে জিগ্যেস করেছিলাম!
-এখন কী করবো টাকা দিবো?
– টাকা না দিয়ে কী গাছ তলায় থাকবো?
-এইতো ভালো কথা মনে করেছো! বিয়ের আগে বলেছিলে না আমার সাথে গাছ তলায় থাকতেও যাজি। এখন চলো!
তিশা ধুম করে খাওয়া থামিয়ে বললো,

-আমি বলেছি আর তুমি সেটাই করবে? এতো শুনতে হবে না আমার কথা!
-তাহলে এখন কী আমি নিজের ঘরে ঢোকার জন্য এতো টাকা দিবো?
– আজকেই তো নিবে। নিয়ে দাও।
-বলছো?

-হ্যা! তারাতাড়ি করোতো। ঘুম পাচ্ছে আমার।
-মানেহ্! এখন তুমি ঘরে গিয়ে ঘুমাবে?
-তাহলে কী তোমার চেহারা দেখবো নাকি আজব।
-১২ টা বাজে। ভাই প্লিজ জাও ওদের কে সরাও।
নূর মুখটা ফেকাসে করে বললো,
-ভাই!
তিশা নূরকে খানিকটা ঠেলে বললো,

-যাও তো!
নূর দরজার কাছে গেলো। দেখলো সেখানে মাদুর পেতে বসে আসে নূহার দেবররা। আর পাশের ঘরে নূহা আর ওর ননদ রা উকি দিয়ে আছে। নূরকে দেখেও সবাই না দেখার অভিনয় করে আগের মতোই মোবাইল টিপছে। নূর আমতা আমতা করে বললো,
-যাও! এখন সবাই উঠো। টাকা দিচ্ছি।
শেহজাদ বলে উঠলো,
-আমরা কতো বলেছিলাম মনে আছে তো?
নূর মুখটা শুকনো করে বললো,

-হ্যা মনে আছে। মনে থাকবে না কেনো!
শেহজাদ তার ছোট ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আমার ম্যানেজার! যাও বুঝে আনো।
-নূর আমতা আমতা করে বললো,
-বলছি কিছু কমানো যায় না!
শেহজাদ আবার বলল,
-ম্যানেজার বসে যাও!
নূর একটু ভয় পেয়ে বললো,
– না না দিচ্ছি দিচ্ছি।

তারপর ১০ হাজার টাকা পকেট থেকে বের করে একটু কষ্টদায়ক চোখে তাকিয়ে তুলে দিলো শেহজাদের ছোট ভাইয়ের হাতে।
টাকা টা শেহজাদের হাতে পৌছাতেই শেহজাদ টাকার ঘ্রাণ শুকে একবার নূরের দিকে তাকালো। নূরের মুখটা দেখার মতো ছিলো। এই সময় যে কেউ ওকে দেখলে হাসি আটকাতে পারবে না।
শেহজাদ পাঞ্জাবি ঝেড়ে উঠে বললো,

-ভাইয়া আপনি জান ভাবি সাহেবা কে নিয়ে আসেন। এই দিকের সব ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ময়লা আবর্জনা কথাটা শুনতেই ঘর থেকে নূহা সহ ওর ননদ রা আর বাইরে বসে থাকা শেহজাদের ভাইয়া রাগী চোখে তাকালো শেহজাদের দিকে। একজন তো বলেই উঠলো, যেই টাকা পেয়েছে ওমনি ওদের আবর্জনা বানিয়ে ফেলেছে।
তিশা খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে বসে আছে। নূর ঘরে ঢুকতেই তিশা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে ফেললো।

নূর সামনে এগোতে এগোতে বললো,
-এভাবে হেসো না তো! তোমার জন্য এতো গুলো টাকা দিতে হলো। নাহলে আমি তো বসার ঘরেই সুয়ে পরতাম। এখন তারাতাড়ি চলো। মা আর বাবা সেই কখন থেকে শোয়ার জন্য বসে আছে।

তিশাকে নিয়ে ঘরের সামনে যেতেই দেখলো এতোক্ষনে ওরা মাদুর উঠিয়ে জায়গা টা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে ফেলেছে। তিশা সামনে যেতেই নূহা একটা কাচি এগিয়ে দিলো। তার তিশা লাল ফিতা কেটে ঘরে ঢুকলো। ঘরটা অন্ধকার। নূর দারিয়ে ছিলো। নূরের কানের কাছে শেহজাদ এর এক বড়ো ভাই এসে বললো বেস্ট অফ লাক। কথাটা বলেই দিলো দৌড়। শেহজাদের বড়ো হলেও নূরের ছোট। নূর কথাটা শুনেই চোখ বড়ো করে তাকালো। নূর চেচিয়ে বললো,

-দেখিশ ! ভালো হবে না। ধরে দেবো কানের গোড়ায়!
নূর ঘরে গিয়ে লাইট অন করতে গিয়ে দেখলো হারামি গুলো লাইটটা খুলে নিয়ে গেছে।মোবাইলের আলো জালিয়ে দেখলো, আর একটা নীল ছোট লাইট লাগানো সেখানে। নূর সুইচ অন করে নীল টাইটা জালারো। তিশা চারপাশ অবাক হয়ে দেখছে। তার কাছে এই ঘরটা অচেনা লাগছে। অথচ এই ঘরে সে বার বার এসেছে। কিন্তু আজ এই ঘরের সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ। তিশা বড়ো বড়ো চোখ করে চার পাশ দেখে বললো,

– এতো টাকা তাহলে বিফলে যাইনি। কি সুন্দর দেখতে লাগছে। খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে ঘরটা। চার পাশ বড়ো বড়ো লাল গোলাপ দিয়ে ঘেরা। ঘরটা সাজানোর ক্ষেত্রে লাল গোলাপ ছাড়া মনে হয় আর কিছু ব্যবহার করেনি।
হঠাৎ নূর তিশাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– শুধু শুধু টাকা নষ্ট ! এই ঘর না সাজালে কী বাসর করতাম না নাকি! আর যে ঘরে বাসর হয় ওটাই বাসর ঘর। এই সাজানোর জন্য এটার নাম বাসর ঘর না!

-বলেছে তোমাকে ! সব সময় উল্টা পাল্টা কথা। আর এভাবে ধরবে না। ছাড়ো!
-ছাড়ার জন্য ধরেছি নাকি! ধরবোই তত আজকে। এইযে ধরেছি মৃত্যুর আগে আর ছাড়ছি না।
সকালে নূহার ডাকে ঘুম ভাঙলো তিশার। ধর ফরিয়ে উঠতে যাবে দেখলো নূর আসঠে পিসঠে জড়িয়ে আছে ওকে। কোনো মতে ওকে ছাড়িয়ে ধরনা টা নিয়ে দরজা খুললো।
নূহা একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,

-হুমম হুমমম এতোক্ষন লাগে দরজা খুলতে?
-কানের গোড়ায় দিবো একটা!
-আমার কানের গোড়ায় দিতে হবে না। ৮ টা বাজে। মা ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতে বলেছে। শাড়ি পড়ে এসো। এলাকার মহিলাদের তো চেনোই। সব এসে বসে আছে।

– এদের উপর কীযে মেজাজ গরম লাগছে! ছোট থেকে তো দেখছে। আজকে আবার কেন দেখতে হবে।
-এরা এমনি। তুমি আসো তো। আমি গেলাম। হ্যা শাড়ি পরেই এসো। মা শাড়ি পরে আসতে বলেছে।
তিশা দরজা টা বন্ধ করে হামি তুলতে তুলতে গেলো বিছানায় গিয়ে নূরকে ডাকলো। নূরের হাবভাব দেখে মনে হলো না যে সে উঠবে। তাই হিয়া লাকেজ থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। নূরের রুমে আগে থেকেই আলাদা ওয়াশ রুম ছিলো। আর নূর অনেক টা গোছানো। তাই তিশার সব সময় ওর রুম টা পছন্দ ছিলো।

তিশা ফ্রেশ হয়ে বের হলো। নূর এখনো ঘুমাচ্ছে। তিশা ভেজা চুল গুলো তোয়ালে দিয়ে বেধে নূরকে টেনে তুলে পাঠালো ফ্রেশ হতে। নূর চোখ ডলতে ডলতে ফ্রেশ হতে গেলো। এই দিকে তিশা শাড়িটা পরে নিলো।
নূর বের হয়ে দেখলো তিশা শাড়ি পরে আয়নার সামনে চুল বাধছে।
নূর তোয়ালেটা বিছানায় ফেলে বললো,

-মাত্র ৮ টা বাজে। এতো তারাতাড়ি উঠালে কেন!
-আমার উঠতে হয়েছে তাই!
-তোমার উঠতে হলো বলে আমাকেও তুলবে নাকি!
-রাতে নিজেও ঘুমাও নি আমাকেও দাও নি। এখন আমি সকাল সকাল একা উঠবো আর তুমি আরামে ঘুমাবে! এটা আমি কী করে হতে দিতে !
– সমস্যা নেই। এটার ফল রাতে তুলবো!
-দেখা যাবে!

তিশা নিচে এসে দেখলো বাড়ি ভরা তার চেনা পরিচিত মুখ। এদের সবাইকেই চেনে। অনেক পরিচিত তার। এলাকার মহিলারা সবাই। তিশা কারো সাথে কোনো কথা না বলে রান্না ঘরে চলে গেলো। তিশা রাবেয়া বেগমের পাশে দারিয়ে রুটি ভিজছে। আর মহিলা একেক জন একেক কথা বলছে রাবেয়া বেগমের সাথে। কথায় কথায় পাশের বাসার এক মধ্যবয়ষ্ক মহিলা বলে উঠলো,

– ছোট থেকে তিশা তো এই বাড়িই ছিলো। এই বাড়ির মেয়ের মতো। এতো আদরে থেকে যে এই বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করলো না। তাই এই বাড়িতেই থেকে গেলো। ভালোই! যতোই হোক! নূর একমাত্র ছেলে।
কথাটা খুব গায়ে লাগলো তিশার। মহিলার কথাটায় সবাই সম্মতি দিচ্ছিলো। তিশা রাবেয়া বেগমের কিছু বলার অপেক্ষা করলো না। রুটি ভাজতে ভাজতে বললো,

– আমিও আমার বাবার একটাই মেয়ে! আর আদর! আমার বাড়িতে আমার কম আদর হয় না। আর টাকা পয়সার কথা বললে সেটা আমার বাবা ভাইদের কমও নেই। এটা আগে মামা বাড়ি ছিলো আর এখন মামা বাড়িও সাথে শশুর বাড়িও এখন এটা আমার কাছে বেশি আপন।

রাবেয়া বেগম সব শুনছে কোনো কথা বলছে না। তিশার এমন জবাবে মহিলারা সব উধাও।
১০ টা বাজে। বউ শাশুড়ি সবার জন্য সকালের খাবার তৈরি করেছে। সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে বসেছে তিশার বাবার বাড়ির শপিং এর লিস্ট করতে। ওই বাড়ির সবার জন্য শপিং করতে হবে আজকের মধ্যে। কালকে তিশা আর নূর ওই বাড়ি যাবে।

তিশা সহ সবাই মিলে বেড়িয়ে পরলো শপিং করতে। নূরের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। তিশা নূর শেহজাদ নূহা আর নূহার এক দেবর।
সব কেনাকাটা করে সবাই মিলে আইসক্রিম খেয়ে বাসায় ফিরলো। টানা আট ঘন্টা বাইরে ছিলো ওটা। শপিং করে পার্কে ঘুরেছে। দুপুরে লান্স বাইরে করেছে। নূর রাতের খাবার কিনে নিয়ে এসেছে। বাড়িতে মানুষ তেমন নেই। তাই বাসায় রান্না করতে বারন করেছে ও।

সবাই এসেই বসে পরলো ওই বাড়িতে যা পাঠাবে সব সুন্দর করে সাজাতে। এইসব কাজ তিশাই সব সময় করে। তাই বাধ্য হয়ে নিজের বাড়ির শপিং নিজেই সাজাতে বসলো।
১০ টা পযর্ন্ত হাতে হাতে সবাই মিলে সব সাজানো শেষ করে ঘরের এক পাশে সুন্দর করে রেখে দিলো। রাবেয়া বেগম এসে নূর কে আর তিশাকে কড়া ভাবে বলেছে এখন আর আড্ডা দেওয়া চলবনা । কাল খুব সকালে উঠতে হবে তাদের! মায়ের সামনে খুব ভদ্র নূর। মায়ের বাধ্য ছেলের মতো খাবার খেয়ে ঘরে চলে গেলো। কিন্তু তিশা তো জানে সে বাইরেই এতো ভালো ! ঘরে গেলেই তার দুষ্টুমি শুরু হবে।

রাতে এর্লাম দিয়ে রেখেছিলো তিশা। ৬ টার এর্লাম বাজতেই উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো। দেখলো রাবেয়া বেগমের সব রান্না বান্না শেষ। নূহা টেবিলে বসে পাটিসাপটা পিঠা খাচ্ছে। তিশা পাশে গিয়ে বসে বাটি থেকে নিয়ে একটা খেতে খেতে বললো,

– এতো সকালে মামি পিঠা বানিয়েছে?
নূহা খাওয়ায় মন দিয়ে বললো,
-মা বানাতে জাবে কেন! পাশের বাসার আন্টি দিয়ে গেছে।
– বাটি চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলো নাকি? এটা তো আমাদেরি বাড়ির বাটি।
রাবেয়া বেগম পানির জগ টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,
-এটা আমাদেরি বাটি! পরশু মাংস পাঠিয়েছিলাম এই বাটি করে।

তিশা হঠাৎ বলে উঠলো! পিঠা টা কী মজা হয়েছে। আরেকটু বড়ো বাটি পাঠালে ভালো হতো।
তিশার এমন কথায় রাবেয়া বেগম চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো তিশার দিকে। নূহাও খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছে তিশার দিকে। তিশার মুখে ঠাই ঠাই ভরা পিঠা। ননদ আর শাশুড়ির সামনে এভাবে কথাটা বলা কী ঠিক হলো কীনা সে এটাই বুঝতে পারছে না।
রাবেয়া বেগম চুপচাপ চলে গেলো রান্না ঘরে। নূহা আবার খাওয়া শুরু করলো। তিশাই শুধু বুঝতে পারলো না কী হলো!

সকালের খাওয়া দাওয়া শেষ করে তিশা ব্যাগ ঘুছিয়ে নিলো। নূর আর শেহজাদ হাতে হাতে ওই বাড়ির জন্য কেনা আর তৈরি করা সব গিফট গাড়িতে তুললো। সাথে ফাতেমা যাবে তাই তিশা ফাতেমার ব্যাগটাও গুছিয়ে নিলো।
৮ টা বাজে মাত্র কিন্তু রাবেয়া বেগমের তারা দেওয়ার কারণে এখনি বের হতে হচ্ছে ওদের।
গাড়ির মধ্যে থাকা অবস্থায় তানিয়া অনেক বার ফোন করেছে। কখন আসবে কখন আসবে বার বার জিগ্যেস করেছে!
আমান চৌধুরী একমাত্র জামাইয়ের জন্য মহা আয়োজন করে। বাবুর্চি এনে রান্না করাচ্ছে।

বাইরে গাড়ির আওয়াজ পেতেই সবাই বেড়িয়ে পরলো। তিশাকে দেখে তানিয়া আর হিয়া তো মহা খুশি।
টানা তিন দিন থাকার পর আবার নূরের বাড়ি এসেছে তিশা। রাবেয়া বেগম কড়া ভাবে বলে দিয়েছে এবার আর বাদরামো না করে যেনো সংসারে মন দেয়। তার এখন আর ভালো লাগে না এই সংসার নিয়ে চিন্তা করতে। এমনিতেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনেক সাহস করে ওদের বিয়ে দিয়েছে সে। এটা নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তার। সে আর পারবে না এই সংসার সামলাতে।

তিশা আর নূরের বিয়ের ৭ মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে তিশা চার পাচ বার নিজের বাড়ি গেছে। তিশা চেয়েছিলো একবার কোথাও ঘুরে আসতে। নূর বলেছে তিশার পাসপোর্ট টা হলে বাইরে কোথাও যাবে এই নিয়ে আর যাওয়া হয় নি। নূহার শশুর বাড়ি থেকে ইদানিং অনেক আকুতি মিনতি আসছে নূহাকে নেওয়ার জন্য। জামাল সিকদার ও শেষমেশ রাজী হয়ে গেছে। মেয়েকে আজ হলেও শশুর বাড়ি পাঠাতে হবে। কাল হলেও পাঠাতে হবে। তাই দেরী করে আর কী লাভ। তাই আজকে কিছু মানুষ এসে নূহাকে নিয়ে যাবে।

তিশা নিজ হাতে আজ ননদের শশুর বাড়ির লোকদের সব খাবার বানিয়েছে। বেচারা খুব চিন্তায় ছিলো। রাবেয়া বেগম সব খাবার চেস্ট করে যখন বলেছে ঠিক আছে। তখন একটু চিন্তা মুক্ত হয়েছে।
দুপুরে নিজ হাতে সবাইকে বেড়ে খায়িয়ে রিভিউ নিয়েছে।
নূহা এখন বেড়িয়ে যাবে। সারাদিন মেয়েটার খুব মন খারাপ ছিলো। এখন আবার সবাইকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না। তিশা খুব বুঝিয়ে শুনিয়ে তারপর গাড়িতে তুলে দিয়েছে।

সারাদিন খাটাখাটুনির পর ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় সুয়ে মোবাইল টার দিকে তাকাতেই দেখলো হিয়ার ২০ টা কল দেওয়া। এতো গুলো কল দেখে তিশা আতকে উঠলো। বুকটা ধরফর করছে। কোনো বিপদ হলো না তো! তারাতাড়ি কল ব্যাক করলো। দুই বার রিং হতেই হিয়া ফোন রাসিভ করে ব্যাস্ত স্বরে বললো,
-তিশা আমরা ঢাকা আসছি। তানিয়া ভাবির অবস্থা বেশি একটা ভালো না। কাল রাত থেকে বেথা উঠেছে। এখন অবস্থা খুবি ক্রিটিকাল।

কথাটা শুনে তিশা কান্না আটকে রাখতে পারলো না। ব্যাস্ত কন্ঠে বললো,
-কোন হাসপাতালে উঠবে!
হিয় হাসপাতালের নাম বলতেই তানিয়া ফোন কেটে নূর কে ডাকলো। সব শুনে নূর রাবেয়া বেগম কে বললো। রাবেয়া বেগম তিশা কে তারাতাড়ি তৈরি হতে বললো আর নিজেও তৈরি হলো। তারপর ওরা আসার আগেই কিন্তু দরকারি জিনিস নিয়ে হাসপাতালে পৌছে গেলো।

ওরা আসতেই তানিয়াকে তারাতাড়ি সিজারের জন্য ডক্টররা নিয়ে গেলো। ইশান পাগলের মতো ছটফট করছে। ওর দিকে তাকালে যে কারো মায়া হবে। আয়ান বার বার ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। ঈশান বার বার পাইচারি করছে। একবারের জন্যও বসতে পারে নি।

তিশা নূহাকে ফোন করে বলেছিলো। এমন খবর শুনে ওই বাড়ি গিয়ে ব্যাগটা রেখেই শেহজাদ আর নূহা হাসপাতালে চলে এসেছে। সবাই গলিতেই ছিলো। এক সুন্দরী নার্স হঠাৎ এক বাচ্চা নিয়ে বের হলো। অতিরিক্ত চিন্তার ফলে কেউ খেয়াল করেনি। নার্স এসে হাসি মুখে বললো,

-আপনাদের মেয়ে হয়েছে।
কথাটা শুনেই সবাই এগিয়ে গেলো নার্সের কাছে।
ওরা আগে থেকেই জানতো মেয়ে হবে। কয়েকবার তানিয়ার চেকাআপ করানো হয়েছে।
নার্স বললো,

– বখসিস দিয়েই কিন্তু বাচ্চাকে নিতে হবে।
আভান চৌধুরী দুই হাজার টাকা বের করে নার্স কে দিলো। নার্স বাবুকে ইশানের কোলে দিলো। খুশিতে ঈশানের হাত কাপছে। তার চোখ থেকে পানি পরছে। ইশান ওকে ধরে রাখতে পারছে না। তমার কাছে গিয়ে তমার কোলে দিয়ে দিলো। ঈশান গিয়ে ডক্টর কে জিগ্যেস করলো তানিয়ার অবস্থা এখন কেমন। ডাক্তার আলহামদুলিল্লাহ বলে বললো, ভালো আছে।

তানিয়ার জ্ঞান ফিরতে ফিরতে বাবুকে তিশা হিয়া আর নূহা কোলে নিতে নিতে বাবুর অবস্থা খারাপ করে নিয়েছে। কেউ বলছে বাবার মতো দেখত হয়েছে কেউ বলছে মায়ের মতো। আবার কেউ বলতে দুই জনের মতো। আর তিশা বলতে ওর মতো দেখতে হয়েছে।

অবিনাশী পর্ব ৩৬

তানিয়ার জ্ঞান ফিরার পর সবাই একসাথে তানিয়ার সাথে দেখা করলো। সবাই মিলে বাবুর নাম রাখলো,” তৃষ্ণা”
হাসপাতালের কেবিনেই সবাই মিলে একটা ছবি তুললো। এক ফ্রেমে সব প্রিয়জনকে বেধে তারপর সেটা তানিয়া ঈশান, তিশা নূর আর নূহা শেহজাদ সবার রুমে একটা করে রাখলো।!

সমাপ্ত