অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ২২

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ২২
সাবরিন জাহান

পরেরদিন!
“এই ইভা!সীমা কই রে?”
“কক্সবাজারে!”
“মজা নিচ্ছিস কেনো?”
“তো কি করবো?তুই যেখানে ,আমিও তো সেখানে! সেই কখন থেকে দাড়িয়ে আছি ,ওর আসার কোনো খবরই নেই!”
“তোর ফোন দে,কল করি! আমারটায় ব্যালান্স নাই!”
ইভা ওকে নিজের ফোন দিল।আয়ুশী ফোন করলেও সীমা ফোন তুললো না!

“চল ক্লাসে যাই , ও আসুক!”
“আরে ঐতো চলে এসেছে।”
সীমা এসেই কাউকে কিছু না বলেই ইভা আর আয়ুশীর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো!
“আরে,এভাবে টানছিস কেনো?”
সীমা নিরুত্তর।তখনই পিছন থেকে ভেসে আসলো,”ওই কিমা!”
সীমা দাড়াতে না চাইলেও আয়ুশী আর ইভা জোর করে দাড়ালো!
“হাই!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়ুশী আর ইভা সীমার দিকে তাকালে সীমা মুখ ভেংচি দিলো!
“ওহ,আমি কিমা সরি সীমার কাজিন!”
ইভা আর আয়ুশী একসাথে বলে উঠলো,”ওহো!”
“তাহলে আপনি ই সেই যার দুই বাচ্চা আছে!”(ইভা)
নাহিম চোখ বড় বড় করে তাকালো!
“কি?”

“আরে সীমা বলেছিল,আপনি বিবাহিত।আপনার বউ আছে ,সাথে দুইটা বাচ্চাও!তাদের সামলানোর কাজ করেন!”(আয়ুশী)
নাহিম সীমার দিকে তাকাতেই সীমা মুখ ঘুরিয়ে নিলো।এই দুই বা’ন্দ’র সব জেনে শুনে ওকে ইচ্ছে করে ফাসাচ্ছে,সেটা বেশ ভালোই বুঝছে!
নাহিম দাত কির মির করে বললো ,”বাসায় আয় আজ তুই!”
বলেই ওর হাতে ওর টিফিন বক্স দিয়ে চলে গেলো!সীমা মূলত এই টিফিন বক্স নিবে না বলেই ওভাবে চলে যেতে যাচ্ছিলো!কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তখন নিলেই ভালো হতো!এখন যে এই দুই জন ওকে ফাঁসিয়ে দিলো।ক্ষিপ্ত চোখে ওদের দিকে তাকালো ও!

“তোরা তো জানতি ওগুলো মিথ্যে বলছি!তাইলে এগুলো কেনো বললি?”
আয়ুশী আর ইভা বলে উঠলো,”সারপ্রাইজ!”
“এটা আবার কেমন সারপ্রাইজ!”
দুইজন মুখ চেপে হাসলো।
“তবে যাই বলিস ,তোর কাজিনটা কিন্তু খুব কিউট!”(ইভা)
“কি বললি?আবার বল!”(আয়ুশী)
“সীমার কাজিনটা খুব কিউট, ইস যদি আগে দেখা পেতাম!বিয়ে ঠিক না থাকলে ঠিকই লাইন মা’র’তাম!আমি তো ক্রাশিত..”(ইভা)

আয়ুশী বাঁকা হেসে ভয়েস মেসেজটা জুনাইদের মোবাইলে সেন্ড করলো!মূলত এই জন্যই ওকে আবার বলতে বলেছিল ও!তার কিছুর মাঝেই রিপ্লাই এলো,”তোমার ক্রাশ খাওয়া বের করছি,বিকেলে দেখা হচ্ছে!”
মেসেজটা পড়ে মুচকি হেসে ইভার হাতে ফোন দিল।ইভা ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মেসেজ পড়ে চক্ষু চরগাছ!ভয়েস টা শুনতেই রাগী দৃষ্টিতে তাকালো।
“আয়ুর বাচ্চা!”
বলেই তেরে যেতে নিলে আয়ুশী দৌড় দিল!ইভা ওর পিছু পিছু গেলো।সীমাও উপায় না পেলে দৌড়ালো!সুযোগ বুঝে সেও দুই ঘা লাগাবে!

ভার্সিটির করিডোর দিয়ে দৌড়াতে লাগলো ওরা!কিছু দূর যেতেই আয়ুশী দাড়িয়ে গেলো।ওর থামা দেখে ইভা পায়ে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো!আয়ুশীকে বলার জন্য তাকাতেই দেখলো সামনে আয়ান।এবার ও বুঝতে পারলো আয়ুশীর থামার কারণ!ইভা ব্রেক নিলেও ব্রেক নিতে পারেনি সীমা।দৌড়ের গতি কম করতে না পেরে ঠাস করে বারি খেলো ইভার মাথায়!ইভা মাথার পিছনে হাত চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকালো।

কিছু না বলেই আবার সামনে তাকালো।সীমা মাথার সামনে ডলতে ডলতে সামনে তাকালো!আয়ুশী আর আয়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে!যেই তাকানোতে আছে অনেক না বলা কথা,অনেক চাওয়া পাওয়া!আয়ুশী চোখ সরিয়ে নিলো। যত তাকাবে ততই মায়া বাড়বে ওই চোখের মালিকের উপর!এক পাশ হয়ে দাড়ালো ও!চায় না আয়ানের কাছাকাছি থাকতে! পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই আয়ান বলে উঠলো,”সব সময় এভাবে সাবধানতা অবলম্বন করলেই পারতে!তাহলে হয়তো আজ এমনটা হতো না যে আমাকে দেখেই তুমি নিস্তেজ হয়ে যাও!”

“সব সময় দায়িত্বের নাম করে কাছে না ই আসতে পারতেন!অন্তত এই অবুঝ মন আপনাকে অবেলায় ভালোবাসতো না!”
আয়ুশীর কথা শুনে আয়ান মলিন চোখে তাকালো!সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করেই আয়ুশী এগিয়ে গেলো।তার পিছু পিছু সীমা আর ইভা! আয়ান যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিলো!এখন ভাবছে যা করছে ঠিক করছে তো?

বাড়িতে পা রাখা মাত্রই বুঝে গেলো কিছু নিয়ে তোড়জোড় চলছে।আয়ুশী বসার ঘরটা চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো।নাহার বসে বসে হিসাব করছে আর একটা কাগজে কি সব লেখছে।এক পাশে ফাহিন কিছু লোকদের বাড়িটা দেখিয়ে কি যেনো বলছে!সম্ভবত বাড়ি সাজানোর ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছে।তার কিছু দূরেই সোফায় বসে ইহরা ফাহিনের দিকে তাকিয়ে আছে!চোখের চাহুনি করুন ওর!মনটা ভয়ে কেঁপে উঠলো।খেয়াল হতেই মনে হলো পরশু বেলাল আর নাহারের বিবাহ বার্ষিকী!আর পরশুই আয়ান আর ইহরার বিয়ের ঘোষণা !এর পরেই তারিখ ঠিক হবে।নাহার ওকে দেখেই উঠে এলো।

“যা যা,জলদি ফ্রেশ হ!অনেক কাজ আছে আজ!”
আয়ুশী হেসে উপরে চলে গেলো।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।ছাদে বসে সিগারেট ধরালো ফাহিন!তখনই কেউ বলে উঠলো,
“সিগারেট খাওয়া কবে থেকে শুরু করলেন?”
ফাহিন হাসলো।কিন্তু উত্তর না দিয়েই এক টান দিল। ইহরার রাগ হলো।এগিয়ে গিয়ে ফাহিনের হাত থেকে সিগারেট টান দিয়ে ফেলে দিলো!

“আপনি জানেন না?সিগারেটের গন্ধ আমার সহ্য হয় না?”
“তোমার সহ্য হাওয়া নিয়ে আমি করবো?”
ইহরা অসহায় কণ্ঠে বলল,”আগে তো আমার অপছন্দের কাজ গুলো করতেন না!আজ বলছেন আপনি কি করবেন?”
ফাহিন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,”কারণ একটা সময় ভাবতাম এই মানুষটাই আমার জীবনসঙ্গী!তার যেনো কোনো প্রকার কষ্ট না পেতে হয়!কিন্তু সে তো আমার নয়!”
ইহরা কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না।

“তুমি নিজেও আমাকে ভালোবাসো ইহরা!তাহলে কেনো করছো এমনটা ?”
“আপনি তো কখনো বাসেন নি ভালো!তাহলে?!”
“স্কুল লাইফ থেকে তুমি আমায় পছন্দ করো।তুমি না বললেও আমি জানি!কিন্তু আমি অপেক্ষা করেছিলাম নিজেকে তোমার জন্য সঠিক মানুষ করে তারপর আপন করে নিবো!কিন্তু এতটা দেরি হয়ে যাবে ভাবিনি ইহরা!একদমই না!”
ইহরা কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই ফাহিন বলে উঠলো,
“নতুন করে সবটা শুরু করা যায় না ইহরা!”

ইহরা মলিন হেসে বললো,”নিজেই তো বললেন দেরি হয়ে গেছে!সময় একবার গেলে ফিরে আসে না!আর প্রসঙ্গ যখন আমার ,মামনি বাবাই এর ক্ষেত্রে আমি কখনো স্বার্থপর হতে পারবো না!নিজের জীবন নতুন করে শুরু করার শুভকামনা রইলো!”
“আমার আর জীবন!তোমার নতুন জীবনের শুভেচ্ছা রইলো!”
বলেই আরেকবার সিগারেট ধরালো! ইহরা কিছু বলতে গিয়েও বললো না।নিচে নামতে গেলেই এক পাশে আয়ুশীকে দেখতে পেলো!আয়ুশী অসহায় চোখে তাকালো! ইহরা কিছু না বলে চল গেলো!আয়ুশী ফাহিনের কাছে গেলো।

“ভাইয়া!”
“আরে আয়ু তুমি?বসো!”
বলেই সিগারেট নিভিয়ে দিল।
“ডাক্তার হয়ে সিগারেট খান!”
ফাহিন হাসলো!
“হাসছেন কেনো?ডাক্তার মানুষ উপদেশ দেন সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয়,আর নিজেই মানেন ন?”
“কি হবে মেনে?”
“বেঁচে থাকবেন!”
“বাদ দেও,এই সন্ধ্যায় ছাদে কেনো?”
“এমনি মন ভালো না!”
“ইহরা আপুর জন্য?”
ফাহিন নিরুত্তর!চমকালেও পর মুহূর্তে ভাবলো ইহরা হয়তো বলেছে!
“সবাইকে সবটা বললেই তো পারেন!”
“কি বলবো?”
“আপনারা একে অপরকে ভালবাসেন ”

ফাহিন হেসে বললো,”আসলে কি জানো?খুব ছোটবেলায় ওর বাবা মা মা’রা যাওয়ার পর আঙ্কেল আন্টি ওকে মেয়ের মত করে বড় করেছে!সেই হিসেবে ওকে যখন আন্টি আহ্লাদী হয়ে বলেছিল,’ তোকে আমার ছেলের বউ করে সারাজীবন কাছে রেখে দিতে চাই,থাকবি?তাহলে তোকে আর পরের বাড়ি পাঠাতে হবে না!’, তাদের চোখে মুখে থাকা খুশিটা দেখে ও না করতে পারেনি!ওর বড় হওয়ার মাঝে এই প্রথম ওরা ওর কাছে কিছু আবদার করলো।না করবে কিভাবে?আমাকেও মানা করেছে!”

“মাইন্ড না করলে আপনাদের গল্পটা বলবেন?”
“আমাদের গল্প তো শুরুই হলো না!”
“তাহলে অনুভূতি গুলো?”

“খুব ছোট থাকতে আমি, আয়ান আর ইহরা বিদেশ যাই। ইহরা আমাদের থেকে বয়সে তিন বছরের ছোট!আমরা চারজন ছিলাম।আমি, আয়ান , ডেইজি, এই তিনজন ছিলাম বেস্ট ফ্রেন্ড আর ইহরা ছোট হলেও আমাদের ভালো বন্ধু হিসেবেই ছিল।ওর সাথে বেশিরভাগ সময় ই আমি থেকেছি!একটা সময় বুঝতে পারতাম ও আমাকে পছন্দ করে।আমিও করতাম..কিন্তু তখন ছিলাম স্টুডেন্ট!এভাবে মেয়েটাকে পাত্তা দেয়া ঠিক হবে না। পরে দেখা যাবে ওর বিয়ে ঠিক হচ্ছে আর ও আমার জন্য মানতে পারছে না!

তাই…কিন্তু মাঝে ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে যখন আমরা ছুটিতে বাড়ি এলাম ভেবেছিলাম মাকে বলে যাবো ইহরার কথা।এরপর আপনাআপনিই সব হবে!কিন্তু দেরি করে ফেলেছি!তার আগেই আন্টি ইহরার সামনে এই প্রস্তাব রাখে।আমরা একে অপরকে না বললেও কাজে কর্মে বুঝাতাম!কিন্তু হুট করেই সব পাল্টে গেলো। ইহরা তুমি থেকে আপনি চলে এলো।ইগনোর করা শুরু করলো।আমি সব বুঝতাম! ইহরার সম্মতি দেয়ার কারণ বুঝতে পারলেও আয়ানের টা বুঝে উঠতে পারিনি! ও সবসময় ইহরাকে একজন ভালো বন্ধু আর বোনের মত কেয়ার করতো!সেখানে ও কিভাবে রাজি হলো বুঝলাম না!”

“স্যার কি জানে আপনাদের ব্যাপারে?”
“না,জানলে এই বিয়ে কখনোই করতো না!”
“তাহলে স্যারকে বললেই হয়!”
“তুমি বুঝবে না!”
“কি বুঝবো না?”
“ঠাণ্ডা লাগবে তোমার,রুমে যাও!”
“কিন্তু…”
“আমি যেতে বলেছি!”

আয়ুশী কিছু না বলে নেমে গেলো। ইহরার রুমে গেলো সোজা!
“স্যার কে বললে কি সমস্যা আপু?”
“মানে?”
“কেনো বলছো না স্যারকে তোমাদের ভালোবাসার কথা?স্যার তো চাইলেই না করতে পারবেন!”
“যা জানো না,তাই নিয়ে কথা বলো না আয়ু!”
“কি জানি না?কেনো এমন করছো?আরে দুইজন মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে এটা শুনে কি স্যার স্বার্থপরের মত নিজের কথা ভাববেন?”

“আয়ু,প্লিজ!”
“সবসময় প্লিজ বলে আমাকে দমিয়ে কেনো রাখো আপু!”
“কিছু জানা লাগবে না তোমার,তবে এটা বলি!আমাদের থেকেও বেশি অসহায় আয়ান!”
“কি এমন অসহায়ত্ব?”
“এত কৌতূহল ভালো নয়!তবে জানতে পারবে !এই বাড়িতে যখন আছো!সত্য বেশিদিন চাপা থাকে না!”
আয়ুশী চুপ করে গেলো।ব্যালকনি থেকে গানের আওয়াজ পেয়ে ব্যালকনিতে উকি দিল।পাশের বারান্দায় আয়ান ইজি চেয়ারে বসে গুন গুন করে গাইছে,

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ২১

“তাকে ছোঁবো ছোঁবো ভাবছি
আর ছুঁয়েই পালাচ্ছি,
ফের তাকেই ছুঁতে যাচ্ছি আবার। ”
আয়ুশী ব্যালকনির দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইলো।জীবন ঠিক কার কোন দিকে ঘুরছে উপর আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না!কেউ না…

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ২৩