অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ৩৪

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ৩৪
সাবরিন জাহান

সময় বহমান! দেখতে দেখতেই কেঁ’টে গেলো আরো কতগুলো দিন! আয়ুশীর ফাইনাল এক্সাম চলছে!ভার্সিটি না গেলেও সীমা আর ইভার থেকে পড়া নিয়ে নিতো ও!এখন এক্সাম দিলেই চলবে!আজকেই লাস্ট এক্সাম…বাড়ি ফিরতেই দেখলো নাহার রান্না করছে!
“কি ব্যাপার ছোট আম্মু?এত এত রান্না যে আজ?”
নাহার মন খারাপ করে বললেন,”ডেইজি চলে যাবে আজ!তাই ওকে শেষবারের মত ওর পছন্দের রান্না করে খাইয়ে দেই!”

“মানে?কোথায় যাবে?”
“কোথায় আবার?লন্ডন ব্যাক করছে ও!”
“আগে তো কিছু বলেনি!”
“আমাকেও বলেনি! আজই বললো,বলে আমরা মন খারাপ করবো তাই আগে বলেনি!”
আয়ুশী কিছু না বলেই উপরে গেলো!ডেইজি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে রাখছিল!
“আরে আয়ু!এসে গেছো?পরীক্ষা কেমন হলো?”
“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“কোথায় আবার?নিজের আসল ঠিকানায়!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়ুশী ডেইজিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,”কেনো যাচ্ছো?”
“আর কত থাকবো?পাসপোর্টের মেয়াদ ও তো শেষ হয়ে যাবে!”
“আপু,আমি জানি তুমি লম্বা সফরে এসেছো! সো এসব অজুহাত বাদ দিয়ে বলো কেনো যাচ্ছো?”
ডেইজি মলিন হেসে বললে,”আর কয়েকদিন পর তোমাদের বিয়ে! আশা করি এটাই যথেষ্ট তোমার বুঝার জন্য!”
আয়ুশী অসহায় হয়ে তাকালো!

“আরে আরে!তুমি মন খারাপ করছো কেনো?এমনটা নয় আমি খুশি না!আমি খুব খুশি তোমাদের বিয়ের জন্য,কিন্তু কি বলোতো?আমি এতটাও না শক্ত নই যে,ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হতে দেখবো!”
বলতে বলতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো ডেইজি!চোখের পানি যেনো বাঁধ মানছে না!চোখ ঝাপটা দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করলো ও!হুট করেই আয়ুশী ওকে জড়িয়ে ধরলো!
“আমি তোমার মত এত সুন্দর মনের অধিকারী হতে পারিনি কেনো আপু?নাহলে আজ আমিও পারতাম ভালোবাসার বিসর্জন দিতে!”

ডেইজি ওর পিঠে আস্তে চর দিয়ে বললো,”পাগলী!তুমি পারোনি কারণ তোমার ভালোবাসা এক তরফা নয়!তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো!তাইতো এত ভুল-বোঝাবুঝি, মান – অভিমান এর পরেও তোমরা একে অপরকে ভালোবেসে গেছো!”
আয়ুশী ডেইজিকে ছেড়ে দাড়ালো!ডেইজি আয়ুশীর গালে হাত রেখে বলল,”আয়ান যেমন তোমার বিরহে কষ্ট পেয়েছে,আমি জানি তুমিও সেই একই কষ্ট পেয়েছো ওর থেকে দূরে থেকে!

তোমাদের মধ্যে একটা জিনিস খুব কম মিললো!সেটা হলো অনুভূতির প্রকাশ…তুমি সরাসরি অনুভূতির প্রকাশ করলেও,কষ্ট গুলো কখনো প্রকাশ করতে পারো না!আয়ানের থেকেও বেশি কঠোর তুমি!কিন্তু ভালোবাসার ক্ষেত্রে সেই কঠোরতা আনতে পারবে না! কারণ আয়ানও তোমাকে পাগলের মত ভালোবাসে! মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে গেলাম আমি!কোনো এক অবেলায় আমিও ভালোবেসেছিলাম !শুধু পূর্ণতা পায়নি…অপূর্ণতায় এক ধরনের মোলায়েম স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্য্য থাকে, যা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না৷ এমনকি পূর্ণতাতেও না।ভালোবাসাই হোক বা অন্য যে কোন অনুভূতি , জোর করে আদায় করার চেয়ে বরং সেটি না পাওয়াই অধিক শ্রেয়।অন্তত মনকে বুঝানো যায়,’ সে আমায় ভালোবাসেনি!’…”

বলেই ডেইজি ব্যাগ গুছাতে লাগলো!
“আপু!”
“হুমম…”
“থেকে যাও না!”
ডেইজি মলিন চোখে তাকালো!আয়ুশী ওর হাত দুটো ধরে বললো,”বলো তো আমায় ছোট বোন ভাবো!তাহলে তাকে ছেড়ে চলে যাবে?”
“ছেড়ে যাচ্ছি কোথায়?ওখানে গেলেও তো কথা হবে!”
“কার কাছে যাবে তুমি?”
“মা বাবা!”

“ওরা তো ব্যাবসা নিয়েই ব্যাস্ত!”
“না এবার ভেবেছে!আমার বিয়ে ঠিক করছে…আর কত ওদের বোঝা হয়ে থাকবো?বয়সতো কম হলো না…আর কেউ কি বিয়ে করতে চাইবে?”
“আমি আয়ানের জীবনে না আসলে হয়তো সবটা অন্যরকম হতো!তুমি কষ্ট পেতে না!”
“কিছু কিছু সময় অপূর্ণতাই ভালো!সব কিছু পূর্ণতা পেয়ে গেলে,আনন্দের ছন্দ টাই হারিয়ে যায়!”
আয়ুশী আর কিছু বললো না!
“রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও,রাতের ফ্লাইট আমার! সন্ধ্যায় বের হবো..”
আয়ুশী চুপচাপ ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো!বাড়ির প্রায় সবার মন খারাপ!

বিকেলে
বসার ঘরে ডেইজি সবার সাথে গল্প করছে!কিন্তু এই আসরে আয়ুশী মিসিং!তাই আয়ান আয়ুশীর খোঁজে ওর রুমে গেলো!বিছানায় উদাস মনে বসে আছে আয়ুশী। আয়ান গিয়ে ওর পাশে বসলো!
“তো মিস ঝামেলার আজকে দেবদাসী হওয়ার শখ উঠলো নাকি?”
“আমি একদম মজার মুডে নেই!”
“আজব,সিরিয়াস কথা বলছি!তাও তোমার মজা লাগছে?”
“আপনার সিরিয়াস কথা আপনার পকেটে রাখুন!”
“আচ্ছা কি হয়েছে এটা তো বলো?”

আয়ুশী আয়ানের এক জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা রাখলো!তারপর মলিন কণ্ঠে বললো,”নিজেকে অপরাধী লাগছে!মনে হচ্ছে আপনার জীবনে না এলে আজ ডেইজি আপু এইভাবে কষ্ট পেতো না!জানেন আপু কেনো যাচ্ছে?শুধু নিজের ভালোবাসার মানুষটার বিয়ে অন্য কারো সাথে দেখতে পারবে না!ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছে!”
আয়ান দীর্ঘশ্বাস নিলো।

“আচ্ছা আমাদের তকদীরের মালিক কে?”
“আল্লাহ!”
“আমাদের সাথে যা যা হয় সব কার ইচ্ছায়?”
“আল্লাহ তায়ালার!”
“তাহলে?”
“কি?”
“তুমি আমার জীবনে আসার মাঝে তোমার কোনো হাত নেই!সব আমাদের সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেতে হয়!তিনি যা চান তাই ই হয়!আমার ভাগ্যে তুমি ছিলে!তাই এসেছো!এখানে নিজের দোষ কেনো খুজছো?”
আয়ুশী নিরুত্তর!

“ডেইজি ভালোবেসেছে,এটা অন্যায় না!তবে ও ভুল মানুষকে ভালোবেসেছে!”
“ডেইজি আপুর বিয়ে নিয়ে কথা বলছে ওর ফ্যামিলি!”
“স্বাভাবিক,আর কত এভাবে চলবে?”
“আপু হয়তো রাজি না!”
আয়ান উত্তর দিলো না!
“আমি না চাই যে আপুর জীবনে নতুন কারোর আগমন হোক,যে আপুর অতীত ভুলিয়ে নতুন ভবিষ্যতের সূচনা করবে!তার বয়স কোনো আওতায় নিবে না!”
আয়ান হাসলো!
“হাসছেন কেনো?”
“ভাবছি!”
“কি?”

“যেই মেয়েটা ডেইজিকে প্রথমে সহ্যই করতে পারতো না,সে এখন তার জন্য কত ভাবছে!”
আয়ুশী আয়ানের থেকে দূরে সরে বললো,”আবার পুরোনো কথা টানেন?”
“আচ্ছা সরি সরি!”
“আপুকে থাকতে বলুন না!”
“বলেছিলাম,শুনলো না!বাট তুমি একটা কাজ করলে পারো!”
“কি কাজ?”
“ডেইজিকে আটকানোর জন্য থিওরি এপ্লাই !”
“কিসের থিওরি?”
“কেনো সীমার প্রপোজের থিওরি!”
সঙ্গে সঙ্গে আয়ুশী ওর দুই গালে হাত দিলো!তাই দেখে জোড়ে জোড়ে হাসলো আয়ান!

এয়ারপোর্ট এ বসে আছে ডেইজি!ওরা কেউ আসেনি ওর সাথে। ব্যাপারটায় অবাক হলেও পাত্তা দেয় নি!মোবাইলে আয়ান আর আয়ুশীর হাস্যজ্বল ছবি ভেসে আছে!আয়ানের ছবিটা জুম করে দেখলো ও!মনে মনে আওরালো,
“না পাওয়ার জ্বালা যে কী ভীষণ; তা যে বোঝে কেবল সে-ই তা জানে । পাবোনা তোমায় জেনেও ভালোবেসেছি অফুরান ;দেখেছি তোমায় দূর থেকে, চাইনি কখনো ভালোবাসার প্রতিদান।আজও ভালোবেসে যাবো! নীরবে, নিভৃতে!”
চোখ মুছে নিলো ও!বেশ কয়েকজন ওকে দেখছে।উঠে ভিতরে যাবে তখনই ফোন বেজে উঠলো। আয়ুশীর ফোন দেখে রিসিভ করলো!কিছু বলবে তার আগেই আয়ুশী ভীত কণ্ঠে বলল,” আপু হেল্প…”

ডেইজি বিচলিত হয়ে বললো,”কি হয়েছে আয়ু?”
আয়ুশী কিছু বললো না!লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে।
“আপু…”
“আয়ু,কি হয়েছে?তুমি কোথায়?”
“বাসায়…আপু…”
আর কিছু বললো না!চুপ করে গেলো।ডেইজি বেশ কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করলো!কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না…কোনমতে হাত ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে সিএনজি নিলো!ভীষণ চিন্তা হচ্ছে তার…কি হলো আয়ুর?
বাড়িতে ফিরেই অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো ও! আয়ুশী বসে বসে চিপস খাচ্ছে আর মুভি দেখছে।

“আয়ু?”
“ওহ এসে গেছো!দেখো দেখো মুভির এই সিনটা কত কষ্টের!”
“তুমি যে ফোনে বললে হেল্প?”
আয়ুশী আমতা আমতা করতে লাগলো!অতঃপর আবার দাত কেলিয়ে বললো,”সারপ্রাইজ!”
ডেইজি এবার অবাক হওয়ার সীমা পার করে ফেললো।প্রচন্ড রাগ উঠলো ওর।এই মেয়ে ওর সাথে মশকরা করছিল,আর ও ভাবলো কি না কি হয়েছে!
“তুমি আমার সাথে মজা নিচ্ছিলে?”
“ঐরকমই!”

বলতে না বলতেই চর পড়লো ওর গালে!ডান গালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় তাকিয়ে রইলো ও!
“তোমার কোনো ধারণা আছে আমি কতটা চিন্তিত ছিলাম?”
“সীমার প্রপোজাল থিওরিতে আগের বারও থা’প্পড় পড়েছিল!সেইটা পরিমাণে দ্বিগুণ ছিল!বাট ব্যাথা ভাগে ভাগে পেয়েছি!এইবার এক থা’প্পড়েই গাল জ্বলছে!”
তখনই আয়ান আর ইহরার হাসির আওয়াজ পাওয়া গেলো!আড়াল থেকে ওরা বেরিয়ে এলো!এতক্ষণ ডেইজির অপেক্ষাই করছিল ওরা!ডেইজি কোমরে হাত দিয়ে বললো,”মানে তোরাও যুক্ত ছিলি?”
“শুধু ওরা না ,আমিও!”

বলতে বলতেই নাহার রুম থেকে বেরিয়ে এলেন!সাথে বেলালও!ডেইজি আফসোসের সুরে বলল,”শেষ মেষ তুমিও?”
“কি করবো?তুমি থাকতে রাজি ই হচ্ছিলে না!”
ডেইজি আয়ুশীর পাশে বসে বললো,”তোমাদের জন্য আমার জামা কাপড়ের ব্যাগ এয়ারপোর্টেই ফেলে এসেছি!”
তখনই ফাহিন ঢুকতে ঢুকতে বললো,”যাব ফাহিন হো সাথ,তো ডারনে কি কেয়া বাত?নে তোর ব্যাগ!”
“কোথায় পেলি?”

“আমি তো তোর সাথেই ছিলাম!শুধু এসেছি আলাদা আলাদা!তুই ব্যাগ ফেলে দৌড়াচ্ছিলি,তাই ভাগ উঠিয়ে আমি আসলাম!রাস্তায় জ্যাম থাকায় একটু দেরিতে এসেছি আরকি!”
ডেইজি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,”সব পা’গল!”
বেলাল সাহেব বলে উঠলেন,”এটা একদম ঠিক বলেছো!কিন্তু আমি বাদে!”
নাহার ফুঁসে উঠে বললেন,”তুমি তো পা’গলেরও পা’গল!”

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ৩৩

মুহূর্তেই হাসির রোল পড়ে গেলো! ডেইজিও হাসলো…মনে মনে চিন্তা করলো,”দরকার কি একজনের জন্য কষ্ট পেয়ে এদের থেকে দূরে যাওয়ার?থাকি ই না এখানে…অন্তত সুন্দর একটা পরিবার পাবো!”

অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ৩৫