অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১৯

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১৯
Mousumi Akter

সাত-সকালে ফায়েক অন্যদিনের ন্যায় মাছ নিয়ে আসছিলো চৌধুরী বাড়ির আঙিনায়।মাথায় মাছের ঝাঁকা নিয়ে ফায়েক বিড়ি টানতে টানতে একটা ভাটিয়ালি গানের সুর তুলে রাস্তা দিয়ে সোজা হেঁটে আসছিলো।ছেলের চাকরি হওয়ার পর থেকে ফায়েকের মনে ভিন্ন মাত্রার আনন্দ। এই আনন্দ সে প্রায় টাইম ধরে রাখতে পারেনা।আনন্দে ভাটিয়ালি গান গায় মনের সুখে।

ছেলের চাকরি হলেও তার পোশাক-আশাক, কর্ম কিছুর ই পরিবর্তন ঘটেনি।শুধু পরিবর্তন ঘটেছে তার মনের দুঃখের।ভীষণ দুঃখ ছিল তার মনে।মাছ মেরে ভাল মাছটা কখনো বউ আর ছেলেকে খাওয়াতে পারেনি।জামার পেছন দিকটা ছিড়ে ত্যানা ত্যানা হয়ে যেত তবুও নিজের জন্য কিছু কিনত না।কত শত কঠিন শীতের রাতে পানিতে ভিজে মাছ ধরেছে।সেই কষ্ট গুলো ছেলেকে কখনো বুঝতে দেয়নি।একটাই ইচ্ছা ছিল তার ছেলে যেন তার মত জেলে না হয়। জেলেদের সন্তানরা বেশীরভাগ জেলে ই হয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফায়েকের বাসা একটা হিন্দু পাড়াতে।ওই হিন্দু পাড়ার সবাই-ই জেলে।আর ওদের সন্তান’রা সবাই-ই জেলে।এইজন্য ফায়েক সব সময় চাইত তার সন্তান যেন অন্তত জেলে না হয়।কারণ ফায়েক জন্মসূত্রে জেলে নয়।পরিবার থেকে ছিটকে গিয়েছিলো অনেক বছর আগে।ফায়েকের ছিল সম্ভ্রান্ত পরিবার।ভালবেসে মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিয়ে করেছিলো একটা নিঁচু জাতের মেয়েকে।সেজন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।সে সময় ফায়েকের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিলনা।নিজের স্ত্রীকে জায়গা দেওয়ার মত আশ্র‍য়স্থল ছিলনা।সে সময়ে অনেকের কাছে গিয়েছিলো কিন্তু কেউ তাকে জায়গা দেয়নি।

ওই সময়ে জেলে পাড়ায় ফায়েকের একজন বন্ধু ফায়েককে থাকার জায়গা দেয়।জীবীকার তাগিদে ফায়েককে মাছ ধরা শেখায়।সেখান থেকে ফায়েক সম্ভ্রান্ত পরিবারের নাম ছেড়ে নাম লেখায় জেলে হিসাবে।পুরুষের সত্যিকারের ভালবাসা কত সুন্দর, কত নিঁখুত। তার জলন্ত উদাহরণ ফায়েক।যে কীনা ভালবাসার টানে রাজপ্রসাদ ছেড়ে জেলে পল্লিতে এসে বসবাস শুরু করে।আর সেখান থেকে একটা সময় পর চৌধুরী পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক হয়।চৌধুরী বাড়িতে মাছ দেওয়া শুরু করে।

প্রায় দুই যুগ সময় ধরে ফায়েক চৌধুরী বাড়িতে মাছ দিচ্ছে।আজ ও অন্যদিনের ন্যায় মাছ নিয়ে যাচ্ছিলো চৌধুরী বাড়িতে। চৌধুরী বাড়ির গেটেই ফায়েক একটা মানুষের কা’ টা মাথা দেখতে পায়।আশে পাশে কোথাও দেহ নেই। দৃশ্যটা দেখে ফায়েক চিৎকার দেয়।তখন ই চৌধুরী বাড়ির ভেতর থেকে সবাই বেরিয়ে আসে।সবাই এসেই কা’ টা মাথা দেখে চিহ্নিত করতে পারে এটা সজলের মাথা।গরুর জ’ বা’ ই দেওয়া মাথার মত ফেলে রাখা আছে সজলের মাথা।

এমন ভায়বহ দৃশ্য দেখে বাড়ির সবাই চিৎকার চেচামেচি শুরু করল।ওয়াসেল, ওয়াজেদ,মেরি, জাহান, জমেলা সবার চোখ কপালে উঠল।কে সজলকে এইভাবে জ’ বা’ ই করে রেখে গিয়েছে।বাড়ির সবার মনে সর্বপ্রথম প্রভাতের কথাই আগে আসে।গতরাতের ঘটনার জন্য প্রভাতের কথা সবার মাথায় আসা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু কেউ সেটা প্রকাশ্য স্বীকার করেনা।

চিন্তায় ওয়াসেলের চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। প্রভাত বদ মেজাজি, রাগি।পূর্ণতা নিজের চেয়েও বেশী ভালবাসে।গতরাতে প্রভাত যখন বার বার বলছিলো সারপ্রাইজ আছে ঠিক তখন ই ওয়াসেল এর চিন্তা হচ্ছিলো।এমন একটা ভ’য়ে’র আশংকা করছিলো।আর সকালে তাই সত্যি হল।একমাত্র ছেলের জীবনে এমন বিপদ ঘনিয়ে আসবে ওয়াসেল কখনো কল্পনাও করেনি।এসবের জন্য পূর্ণতাকে দায়ী মনে হচ্ছে তার।

মনে হচ্ছে পূর্ণতাকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে।পূর্ণতা না থাকলে তার ছেলে এমন বাড়াবাড়ি করত না।ওয়াজেদ ও চিন্তিত।চিন্তিত মুখে ওয়াসেল কে বলল, ” ভাই এই ঘটনা কীভাবে ঘটল? আমি যা ভাবছি তাই কি সত্যি।”
“যা ভাবছিস তা মুখেও আনিস না।এখনি পুলিশ চলে আসবে।”

“শায়লা ও তো চলে আসবে এখনি।শায়লাকে কি উত্তর দিবো আমরা।”
“আমি এই মুহুর্তে শায়লার চেয়ে বেশী ভাবছি আমাদের পরিবার নিয়ে।পুলিশ এলে কি উত্তর দিবো।রাজন অনেক চালাক অফিসার।সব বুঝে যাবে।”
“প্রভাত কি সত্যি এ কাজ করেছে।”

“সব তোর মেয়ের জন্য। তোর মেয়ের জন্য যে আমার ছেলে ধ্বংস হবে তাতে কোনো ভুল নেই।”
তখনই রাজন উপস্থিত হল। রাজন এসে সজলের কা’টা মাথা দেখে শকড হল। চারদিকে কোথাও সজলের দেহ নেই।কেউ মাথা রেখে দেহ নিয়ে গিয়েছে।সজল কনস্টেবল দিয়ে চারদিকে সজলের দেহের খোজ করতে দিল।
বাইরে সবার চিৎকার চেচামেচিতে সজলের মৃত্যু খবর পূর্ণতার কানে আসতেই পূর্ণতা দৌঁড়ে রুমে প্রবেশ করল।আচমকা এমন নিউজে পূর্ণতার বুক কেঁপে উঠল।ভয়ার্ত কন্ঠে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

“শুনেছেন নিচে নাকি সজল ভাইকে কেউ মে’ রে ফেলে চলে গিয়েছে?”
পূর্ণতার কথা শুনে প্রভাত ভীষণ অবাক হল।ভীষণ অবাক হয়ে বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি করে উঠে বলল,
“হোয়াট? সজল ডেড?”
“হ্যাঁ, নিচে সবাই তাই বলাবলি করছে।”
প্রভাত লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠল। কোর্ট স্ট্যান্ড থেকে একটা শার্ট নিয়ে হাতা ভরে বোতাম লাগাতে লাগাতে নিচে নামল।পূর্ণতাও প্রভাতের পিছ পিছ নিচে নামল।

এমন সময় সজলের মা এসে উপস্থিত হল।একমাত্র ছেলের কা’টা মাথা দেখে শায়লা কেমন উ’ন্মা’দে’র মত ব্যবহার শুরু করল। মায়ের সামনে সন্তানের মৃত্যুর মত হৃদয় বিদারক ঘটনা আর দ্বিতীয়টা নেই।তারপর ও এটা কোনো স্বাভাবিক মৃ’ত্যু নয়।রাজন আর প্রভাত দু’জন কথা বলছে।সাথে ওয়াসেল এবং ওয়াজেদ ও আছে। রাজন প্রভাতকে বলল,

“ভাই উনার সাথে কি কারো কোনো শ’ত্রু’ তা আছে।”
প্রভাত কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলো।গতরাতের ঘটনা কি বলা ঠিক হবে।তার বিপদ হয় হোক কিন্তু পূর্ণতার উপর এর কোনো প্রভাব না পড়ে।প্রভাত কনুই ভাজ করে থুতনিতে হাত বুলাল।দেখে বোঝা যাচ্ছে সে চিন্তুত।চিন্তিত কন্ঠে বলল,

“আমার বউকে ও পছন্দ করত। সে দিক দিয়ে আমি ওর শত্রু ছিলাম। ও আমার শত্রু ছিলনা। তবে আমি ওকে পছন্দ করতাম না।”
রাজন মৃদু হেসে বলল,
“জেলাসি?”
“অনেক খানি। তাদের আমি সহ্য করতে পারিনা যারা আমার বউ এর দিকে নজর দেয়।ও হ্যাঁ গতরাতে আমার আর পূর্ণতার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”
“কনগ্রাচুলেশন।”

এমন সময় পূর্ণতাকে দেখেই শায়লা পূর্ণতার গলা চে’ পে ধরে বলল,
“এই ডা’য়’নির জন্য সব হয়েছে।এই ডা’য়’ নির জন্য সজল এখানে এসেছিলো।কাল রাতে এই ডা’য়’নি আমার ছেলেকে বাগানে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো।এর জন্য প্রভাত আমার ছেলেকে মে’ রে ফেলেছে।প্রভাত ই কাল রাতে ওকে জোর করে এখানে রেখে দিয়েছিল।”

শায়লার গলা টি’ পে ধরায় পূর্ণতার জিভ বের হয়ে এল।পূর্ণতা শুকনো কাশল।গলা দিয়ে আ, আ শব্দ হচ্ছে শুধু।পুষ্প, প্রভাত আর রাজন দ্রুত শায়লার দিকে এগিয়ে গেল।তড়িঘড়ি করে যেতেই রাজনের জুতার পা’ ড়া লেগে গেল পুষ্পের নরম পায়ে।পুষ্প ব্যাথায় কুকিয়ে উঠল।রাজন পুষ্পের ব্যাথা দেখে নিচে দিকে তাকাল।পুষ্প পা ঝাড়াঝাড়ি করছি।রাজন সাথে সাথে পুষ্পের পায়ের কাছে বসে পড়ল।পায়ের পাতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ” সরি, সরি।”

প্রভাত শায়লার হাত জোর পূর্বক ছাড়িয়ে বলল,
” ছাড়ো পূর্ণতাকে একদম স্পর্শ করবে না।”
শায়লা কাঁন্নাজড়িত কন্ঠে বলল,
“তাহলে কি করবি তুই? সজলের মত আমাকে মে’ রে ফেলবি।”
” কি বললে ফুফু আমি তোমার ছেলেকে মে’ রে’ ছি। আমি কেন তোমার ছেলেকে মা’র’ব।আমি কি প্রফেশনাল খু’নী।এইভাবে মা’থা কেটে রেখে যাব।”

“হ্যাঁ তুই, তুই ছাড়া কে মা’র’বে আমার ছেলেকে।এই বাড়িতে আমার ছেলের শত্রু কে? তুই ছাড়া আর কে?তুই তো সব রকম হুমকি দিয়েছিস আমার ছেলেকে।”
জমেলা বলল,
“পূর্ণতা ও হতে পারে। আসল শত্রুতা তো পূর্ণতার সাথে।আমার মন বলছে এই কাজ পূর্ণতার।এই খু’ ন পূর্ণতা করেছে।”
জাহান বলল,

“আপনার কি মাথা খারাপ মা।আমার ওইটুক মেয়ের ঘাড়ে এই দো’ষ চাপিয়ে দিচ্ছেন।”
“পূর্ণতা ছাড়া প্রভাতকে কে মা’র ‘বে?কাল রাতের ঘটনার পর সজল মারা গিয়েছে। এতেই তো স্পষ্ট সব কিছু।”
শায়লা রাজনের পায়ের নিচে পড়ে পূর্ণতার দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলল,
” স্যার স্যার এই পূর্ণতার জন্য আমার ছেলে মা’রা গিয়েছে।ওদের নিয়ে যান থানায়।আমার ছেলের খু’ নি দের ফাঁ’ সি দিন।”

রাজন প্রভাত কে বলল,
“প্রভাত ভাই আপনার ফুফু কি বলছেন? সত্যি কি আপনার স্ত্রী?”
প্রভাত খুব স্ট্রং ভাবে সবার মাঝে বলে উঠল,
” এই ঘটনার সাথে ভুলেও কেউ পূর্ণতার নাম জড়াবে না।পূর্ণতা পবিত্র।ওর সাথে পাপের কলঙ্গ কেউ জড়াবেনা।পূর্ণতা এসবের কিছুই করেনি।”
রাজন বলল,

“আপনি কীভাবে সিওর?”
“কারন কাল সারারাত ও আমার সাথে আমার বেডরুমে আমার চোখের সামনে ছিল।আমি সারারাত ঘুমোয়নি।ও বাইরেই আসেনি।তাহলে খু’ ন কীভাবে করবে।”
শায়লা বলল,

“তাহলে তুই? তুই করেছিস।”
পূর্ণতা প্রভাতের দিকে দোষ যেতে দেখেই বলল,
“না উনিও খু’ন করেন নি।”
রাজন বলল,
” আপনি কীভাবে জানেন।”

“কারণ আমরা দু’জনেই সারারাত জেগে ছিলাম। কেউ ঘুমোয় নি। প্রভাত যে নির্দোষ তার সাক্ষী আমি।”
এত ঝামেলার ভীড়ে প্রভাতের মুখটা উজ্জ্বল হল।চকচক করে উঠল।খুশিতে আত্মহারা হল।যে মেয়েটা তাকে সহ্য করতে পারেনা সেই মেয়েটা তার জন্য মিথ্যা বলছে।প্রভাতের চোখের তারা দু’টো আনমনে তাকিয়ে আছে পূর্ণতার দিকে।
তখন ই রাজন বলল,

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১৮

” প্রভাত চৌধুরী যে খু’ন করেনি তা আমি নিশ্চিত। কেননা খু’ ন করার হলে চুপ চাপ করে দিত। সজলের নামে ধর্ষনের মামলা দিত না।”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here