অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩৭
Mousumi Akter
সন্ধ্যা থেকে ফায়েকের বাড়িতে জেলেপাড়ার লোকজনের ভীষণ ভীড় আজ। সবাই মুখে মুখে জেনে গিয়েছে চৌধুরী বাড়ির মেয়েকে ফায়েকের ছেলে বিয়ে করেছে।রাত দশটা বাজে মানুষের ভীড় কমেনি।পুষ্পকে ঘিরে মানুষের যাতায়াত অনবরত চলছে।পুষ্পের চেহারা দেখেও প্রশংসার ছড়াছড়ি চারদিকে।ফায়েক ভীষণ আনন্দিত পুষ্পকে নিজের ছেলের বউ হিসাবে পেয়ে।ফায়েকের বউ একবার ও পুষ্পর কাছে যায়নি। কোনোভাবেই পুষ্পকে ছেলের বউ হিসাবে মানতে পারছে না।তার কাছে ওয়াসেল চৌধুরীর মেয়ে মানেই খারাপ।রাত দশটা পেরিয়ে ঘড়ির কাটা এগারোতে ছুঁই ছুঁই।ক্লান্তিতে ঘুম চলে এসছে পুষ্পের।কৃষ্ণ তাজা ফুল দিয়ে রাজনের বাসর ঘর সাজিয়েছে।বাসর ঘরে যাওয়ার আগে রাজন পুষ্পকে নিয়ে তার মায়ের ঘরে প্রবেশ করল।পাশাপাশি দু’টো রুম তাদের।রাজন আর পুষ্পকে দেখে রাজনের মা মুখ আরোও গম্ভীর করল।রাজন আস্তে পুষ্পকে বলল, ‘ মা’কে সালাম করো।’
পুষ্প রাজনের মা’কে সালাম করল।
রাজনের মা সাথে সাথে বলল, ‘ থাক, অনেক রাত ঘুমাও গিয়ে তোমরা।’
পুষ্প এ বাড়িতে নতুন।রাজনের মা’কে আগে পরে দেখেনি।বুঝতে পারছে না কেমন হবে।তবে এটুকু রাজনের থেকে জানে সে রেগে আছে।পুষ্প মোলায়েম কণ্ঠ বলল,
‘ আম্মা খেয়েছেন?’
রাজনের মা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ হ্যাঁ। ‘
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাজন মৃদু হেসে বলল, ‘ মা তোমাকে মেয়ে এনে দিয়েছি। আমার মা পৃথিবীর বেষ্ট মা।জানি আর রাগ করে থাকবে না।’
ফায়েক বলল, ‘ তোমরা ঘুমোতে যাও অনেক রাত এখন।’
রাজন পুষ্পকে নিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করল।ঘরের মাঝে পাঠকাটির বেড়া দিয়ে রুম করা।একটা নিঃশ্বাস নিলেও অন্য রুম থেকে শোনা যায়।রাজনের মনে অনেক কথা জমে আছে।কিন্তু পাশের রুমে তার মা-বাবা কীভাবে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।হা করলেই তারা শুনতে পাবে।পুষ্প বুঝতে পারছে না রাজন এমন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
পাশের রুমে ফায়েক বেশ বুদ্ধিমান।সে তার ওয়াইফ কে ইশারা দিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল।বাইরে গিয়ে বলল,
‘ নতুন বিয়ে হয়েছে।ওরা যা ইচ্ছা তাই বলুক।আমাদের ও ঘরে থাকার দরকার নেই।চলো নদীর পাড়ে বসে সুখ, দুঃখের গল্প করি।’
ফায়েক আর ফায়েকের স্ত্রী সাড়াশব্দ না করে বাইরে চলে গেলো।
এইদিকে রাজন জানেনা তার মা-বাবা ঘরে নেই। পুষ্প কেবল ই বলে উঠেছে, ‘ তুমি অমন রোবটের মত দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
কথাটি শোনামাত্র রাজন নিজের দুই ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে চুপ করতে বুঝালো।পুষ্প ভ্রু কুঁচকে তাকাল।রাজন দ্রুত পুষ্পকে কোলে তুলে তার মা-বাবার ঘরের দিকে তাকিয়ে অন্য দিক দিয়ে নদীর দিকে গেল।পুষ্প ফিঁস ফিঁস করে বলল,
‘ কি করছো এসব তুমি?আর ঘর ছেড়ে বাহিরে এলে কেন বুঝলাম না।’
রাজন এদিক-ওদিক তাকিয়ে পুষ্পের গালে চুমু দিয়ে বলল,
‘অনেক সাধনার পরে হালাল চুমুটা দিতে পারলাম।আর কয়েক টা দিতে পারলে শান্তি পাবো।’
পুষ্প লজ্জা পেয়ে বলল, ‘ তুমি নিচ্ছো টা কোথায় আমাকে? এই অচেনা অজানা জায়গায় আমাকে খু’ ন করবা নাকি?’
‘খু’ ন তো আমি তোমার হাতে চাই। প্লিজ কি’ল মি!’
কথা বলতে বলতে দু’জনে নদীর কিনারায় গেল।চাঁদনি রাত।চাঁদের সোনালি আলো নদীর পানিতে পড়েছে।নদী একদম শান্ত হয়ে আছে।দুই একটা কচুরিপানা ভেষে যাচ্ছে।শীতল বাতাস বইসে
পুষ্প বলল, ‘ কাহিনী কি বলোতো?’
রাজন পুষ্পকে নিয়ে নদীর কিনারায় বসল।পুষ্পর মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ এই বিশেষ রাত টি ঘুমিয়ে নষ্ট করতে চাইনা পুষ্প।স্বপ্নের মত তোমাকে পেয়েছি আমি।বড় সাধানার ফল তুমি আমার।’
‘ রুমে থাকলেই তো পারতাম।’
‘ পাশের রুমে মা-বাবা আছেন।ঠিক ভাবে প্রেম করতে পারতাম না।’
‘ তাই খোলা জায়গা এসছো?’
‘ হ্যাঁ, উন্মুক্ত আকাশের নিচে,বহবান নদীর শীতল হাওয়া প্রেম করার মত উপযুক্ত।’
পুষ্প এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল,
‘ কিন্তু রাজন আমার কেমন যেন ভ’য় করছে।তোমাদের বাড়ি,নদীর পাড় সব ভুতুড়ে। এমন অদ্ভুত কেন জায়গা গুলো।’
‘আগে পরে এমন জায়গা আসোনিতো তাই এমন লাগছে।’
পুষ্প চুপ রইলো। সে আশে -পাশে তাকিয়ে দেখছে।রাজন পুষ্পকে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে বলল,
‘ এখানে, এই পরিবেশে নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নিবে তুমি।দুঃচিন্তা হচ্ছে আমার।’
পুষ্প একটু জড় সড় হয়ে রাজনের বুকে মাথা গুজে বলল,
‘ আমি তোমার অর্ধাঙ্গী।যেখানে তুমি থাকবে সেখানেই আমার জন্য জান্নাত।’
‘পুষ্প, মা-বাবাকে প্রেসার দিতে পারছি না এখনি আমি।এইযে নদী দেখতে পাচ্ছো। এই নদী থেকে শীত -রোদে, রাতে-সকালে মাছ ধরে বাবা – মা আমাকে মানুষ করেছে।বাবা কখনো ভালো পোশাক পরেনি,ভালো খাবার খায়নি, শুধু পরিশ্রম করেছে আমাকে মানুষ করতে।মাও সেইম কাজ করেছে।এখন বলো পুষ্প আমি সেই মা-বাবাকে কীভাবে কষ্ট দিই।’
‘ তুমি এসব কেন বলছো বলোতো?’
‘এইযে তোমার কষ্ট হবে ভেবে।জাস্ট দুইটা মাস একটু মানিয়ে নেও।আমার মা-বাবা পৃথিবীর বেষ্ট মা-বাবা।দেখবা রাগ পড়ে যাবে মায়ের।তোমাকে আমি শহরে নিয়ে যাবো।একটা পুষ্পভিলা বানাব বুঝলে।’
পুষ্প রাজনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এত কিছু তো লাগবে না আমার।এমন নদীর কুল,খোলা আকাশ ই আমার পছন্দ।’
দূর থেকে ফায়েকের স্ত্রী ফায়েক কে বলল,
‘শুনছো, মনে হচ্ছে ওপাশে কারা মাছ চু’রি করছে।’
ফায়েক গলা উঁচিয়ে তাকিয়ে বলল,
‘কই?’
‘ওইতো সামনেই।’
‘চলোতো দেখি।’
ফায়েক আর ফায়েকের স্ত্রী দু’জনে এগিয়ে গেল।পুষ্প আর রাজন পা মেলে দু’জন বসে আছে।রাজনের কাঁধে পুষ্পর মাথা।ফায়েক এর স্ত্রী রাজন দের কাছাকাছি না এসে খানিকটা দূর থেকেই চেঁচিয়ে উঠল কারা ওখানে।
রাজন আর পুষ্প দ্রুত উঠে দাঁড়াল।উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাতেই মুখোমুখি হলো তার মা-বাবার।এইভাবে যে চারজন ঘর ছেড়ে বের হয়ে মুখোমুখি হবে তা কি ওরা জানত।চারজন ই ভীষণ লজ্জা পেল।ফায়েকের স্ত্রী বলল,
‘তোমরা এখানে কেন?’
ফায়েক দ্রুত বলল,
‘ পুষ্প মায়ের মনে হয় গরম লাগতাছে।এইজন্য নদীর হাওয়া খাইয়ে আইছে।’
রাজন বলল, ‘ জি বাবা।’
ফায়েক বলল, ‘ যাও ঘরে যাও। ঠান্ডা লেগে যাবে।’
রাজন পুষ্পকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো।
ফায়েকের স্ত্রী বলল, ‘ ছেলে -বউমা কি মনে করবো।আমরা এই গভীর রাইতে প্রেম করতে আইছি।’
‘ তা ভাবুক। প্রেম তো দো’ষ না। তাইনা রাজনের মা।’
পরের দিন ভোরে পুষ্পর ঘুম ভাঙল।রাজন ঘুমিয়ে আছে।পুষ্প একটা গোলাপি রঙের থ্রি পিছ পরে বের হল।ফায়েকের স্ত্রী বারান্দার খাটে বসে আছে।পুষ্প বলল,
‘ আম্মা কি নাস্তা বানাব কি দিয়ে।’
ফায়েকের স্ত্রী গরম চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ এডা বড়লোকের বাড়ি না।এইখানে কেউ নাস্তা খায়না।সকালে ফেনা ভাত আর ভর্তা খায়।’
পুষ্প মিহি কণ্ঠে বলল,
‘ তাহলে কি ভাত রান্না করব।’
একটা ঝাড়ু পুষ্পের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আগে উঠান ঝাড়ু দেও।’
পুষ্প ঝাড়ু হাতে নিলো।সে আগে পরে কখনো উঠান ঝাড়ু দেয়নি।দেওয়ার অভ্যাস ও নেই।তাছাড়া কোমরে একটু ব্যাথা আছে।সে অনেক্ষণ যাবত ঝুঁকে ঝাড়ু দিতে পারবে না।তাও পুষ্প ঝাড়ু নিলো।নিজের মত করে চেষ্টা করছে।জীবনের প্রথম উঠান ঝাড়ু তাই ঠিকভাবে পারছে না।আধাঘন্টা ধরে উঠান ঝাড়ু দিয়েই যাচ্ছে।ফায়েকের স্ত্রী বলল,
‘ এক উঠান ঝা’ড়ু দিতে গিয়েই তো দিন পার হইয়া যাইবো।বাকি কাজ কি পরশু করবা।এইজন্য কইছিলাম বড়লোকের বেটি দিয়া কাম নাই।’
পুষ্প ঘেমে একেবারে একাকার হয়ে গিয়েছে।হাঁপাচ্ছে।
শ্বাশুড়ির কাছে এসে বলল,
‘ আম্মা এইবার কি করব।’
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩৬
‘ চুলার ছাঁই খুলে, থালা, বাটি ছাঁই দিয়ে মাজতে হবে।’.
পুষ্প বলল,
‘ এটা তো আমি পারিনা আম্মা।’
‘ না পারলে শিখতে হবে,তাও করতে হবে।’
পুষ্পর কেমন যেন কান্না পাচ্ছে।সম্পুর্ন নতুন পরিবেশে একটুও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না।