আজকে শহর তোমার আমার পর্ব ১৬+১৭+১৮+১৯

আজকে শহর তোমার আমার পর্ব ১৬+১৭+১৮+১৯
জিন্নাত চৌধুরি হাবিবা

রুপ্সিতা আলিফের চারদিকে চরকির মতো ঘুরছে আর গান গাইছে।আলিফ পড়েছে বিপাকে।একহাতে রুপ্সিতা শক্ত করে ধরে এদিক ওদিক নজর দিয়ে তিন্নিকে খুজে চলেছে।তিন্নিকে পেলে একটা ব্যবস্থা করা যাবে।রুপ্সিতা আলিফের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো।হাতের বিয়ারের বোতল অর্ধেক খালি দেখে আলিফের চোখ কপালে উঠে গেলো।সর্বনাশ করেছে বাকিটুকু খেতে দিলে আমার বারোটা বাজবে।এমনিতেই আজকে আমার উপর দিয়ে বহু ঝড় যাবে।

আলিফের কাছে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে।বিরক্ততে কপাল কুচকে তিন্নিকে খুঁজে চলেছে।কোনদিকে গেলো এই মেয়ে।এখন রুপ্সিকে নিয়ে বাসায় যাওয়া ও সম্ভব না।আগে লেবু পানি খাইয়ে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিতে হবে।চারদিকে চোখ বুলিয়ে অবশেষে তিন্নির দেখা পেলো আলিফ।হাত উঁচু করে ডাক দিলো।তিন্নি দেখতে না পেয়ে অন্যদিকে চলে গেছে।আলিফ বিরক্তিতে “চ” শব্দ করে উঠে।রুপ্সিতা আলিফের গাল দুটো জোরে জোরে টানছে আর বলছে আউ কি কিউট বাবু।বাবু তোমাকে আমি আমার বাসায় নিয়ে যাবো প্রতিদিন তোমার গাল দুটো টেনে দেবো কেমন?তুমি কিন্তু আমার সাথে যাবে হ্যাঁ!

আলিফ গালে ব্যাথা পাচ্ছে কিন্তু রুপ্সিতা গাল ছাড়ছেনা।এখন আলিফের অবস্থা ছলছল নয়নে হাসিমাখা বদনে।
রুপ্সিতা আলিফের হাত টেনে বলল,চল বাবু আমরা এখন নাচবো।এই জুস খাবে?এই নাও বলেই বিয়ারের বোতল উঁচু করে আলিফের মুখে ঢুকিয়ে দিতে গেলে আলিফ মুখ সরিয়ে বোতলটা খপ করে ধরে নেয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুপ্সিতা ঢুলুঢুলু চোখে চেয়ে আলিফকে বলল,কি হলো বাবু তুমি জুস খাচ্ছো না কেন?খাবে না?তাহলে আমার জুস দিয়ে দাও আমিই খাই।রুপ্সিতা বিয়ারের বোতল ধরতে গেলেই আলিফ বোতল সমেত হাত সরিয়ে নেয়।চারদিকে মানুষ ব্যস্ত আছে নাচ গান নিয়ে।এদিকে কারো তেমন একটা লক্ষ্য নেই।আলিফ বিয়ারের বোতলটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে রুপ্সিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।রুপ্সিতা ঠোঁট ফুলিয়ে নাকি কান্না করে বলছে,এই বাবু তুমি আমার জুস ফেলেছো কেন?আমার জুস দাও নাহলে কামড়ে দেবো।
আলিফ রুপ্সিতা হাত ধরে রেখেই বলল,পরে তোমাকে অনেকগুলো জুস কিনে দেবো এখন আমার সাথে আসো।
রুপ্সিতা উচ্চস্বরে বলে উঠলো নাহহ!আমার এখনই জুস লাগবে তা নাহলে

“আউচ”আলিফ হাত ঝাঁকাচ্ছে।রুপ্সিতা নিজের দাঁত দিয়ে আলিফের হাতে কুটুস করে কামড় বসিয়ে দিয়েছে।আলিফকে হাত ঝাঁকাতে দেখে রুপ্সিতা চোরের মতো চেয়ে আছে আলিফের দিকে।
আলিফ হাত ঝাঁকানো অফ করে রুপ্সিতার হাত শক্ত করে ধরে একটা রুমে রুপ্সিতাকে রেখে বাইরে দিয়ে দরজা আটকে তিন্নিকে খুঁজতে গেছে।রুপ্সিতা দরজা ধাক্কা দিয়ে বলছে,বাবু তুমি আমাকে এখানে আটকে রেখেছো কেন?তুমি খুব পঁচা বাবু।বাইরে থেকে সাড়া না পেয়ে রুপ্সিতা ধীরে ধীরে খাটে গিয়ে বসেছে।কিছুক্ষণ মুখ গোমড়া করে রেখে আস্তে আস্তে ঠোঁটের কোনের হাসি প্রসারিত করতে লাগলো।একসময় হুহা করে হেসে খাটে গড়াগড়ি খেতে লাগলো।বেটা আলিফ আচ্ছামতো জব্দ হয়েছে।রুপ্সিতা প্রথমে ভেবেছিলো বিয়ার খাবে কিন্তু এক ঢোক মুখে নিতেই চোখমুখ কুচকে গেলো।তাই মুখের অংশ ফেলে দিয়ে বোতলের অর্ধেক পরিমান ফেলে দেয়।যাতে আলিফ মনে করে রুপ্সিতা বোতলের অর্ধেক বিয়ার খেয়ে খালি করে ফেলেছে।রুপ্সিতা শুয়ে শুয়ে হেসে যাচ্ছে।
এদিকে আলিফ তিন্নিকে খুজে পেয়ে বলল,তোমাদের এখানে কি বিয়ারের ব্যবস্থা করেছো আজকে?

তিন্নি ভ্রু কুচকে বলল,কই নাতো?কেন আপনি খাবেন নাকি?তাহলে আমি আমার কাজিনদেরকে বলছি ওরা মনে হয় আজকে এনগেজমেন্ট শেষে পার্টি করবে আর বিয়ারের ব্যবস্থা করবেনা এটা হতে পারেনা।
আলিফ কপালে দু’আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে বলল,রুপ্সি বিয়ার খেয়েছে।নিশ্চয়ই তোমার কাজিনদের কাছ থেকে নিয়েছে।তোমার কাজিনরাও কেমন একটা মেয়ে মানুষকে বিয়ার দিয়ে দিলো?
তিন্নি চোখ কপালে তুলে বলল,কিহ?রুপা ড্রিংক করেছে?দাঁড়ান আমি দেখছি।এই সোহেল এদিকে আয়।
কি হয়েছে আপু?
তোরাকি কোন মেয়েকে বিয়ার দিয়েছিলি?
সোহেল তিন্নির দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,আমি দিতে চাইনি আপু।কিন্তু মেয়েটা আমার হাত থেকে জোর করে নিয়ে গেছে।

তিন্নি বলল,ঠিক আছে যা তুই।তারপর আলিফের দিকে তাকিয়ে বলল,রুপা কই?
আলিফ বলল,তোমাদের এখানে একটা রুমে আটকে রেখে এসেছি এখন একটু লেবুপানির ব্যবস্থা করো।
ঠিক আছে আপনি দাঁড়ান আমি লেবুপানি নিয়ে আসছি বলে তিন্নি চলে গেলো।
একটুপর লেবুপানি নিয়ে তিন্নি এগিয়ে এসে বলল,চলুন কোন রুমে রুপা।
আলিফ এগিয়ে গেলো পেছন পেছন তিন্নি ও গেলো।রুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে রুপ্সিতা আবারো আগের ন্যায় অভিনয় করা শুরু করে।মনে মনে বলে বাহ রুপ্সিতা!বাহ!তুইতো অনেক ভালো অভিনয় করিস।বাংলা সিনেমার নায়িকারাও তোর কাছে হার মানবে।
তিন্নি লেবুপানি নিয়ে রুপ্সিতাকে খাইয়ে দিতে গেলেই রুপ্সিতা বলল,কি এগুলো আমি খাবোনা।
আলিফ বলল,তুমি না জুস চেয়েছিলে?এটা জুস খুব মজা খেয়ে নাও।রুপ্সিতা মনে মনে বলছে হায়রে খোদা কি বিপদে ফেললে এখন নাকি লেবুপানি খেতে হবে।সাথে একটু লবন আর চিনি দিয়ে সরবত বানিয়ে দিলেইতো ঢকঢক করে গিলে ফেলতাম।
রুপ্সিতা নাথা নেড়ে বলল,নাহ এই জুস পঁচা।আমিতো বোতলের জুস খাবো।

আলিফ গ্লাস হাতে নিয়ে রুপ্সিতার মুখ টিপে মুখের সামনে গ্লাস ধরে রাখলো।অনেকটা লেবুপানি রুপ্সিতার পেটের ভেতর চালান হয়ে গেছে বাকিটা মুখদিয়ে ফুস করে বের করে দিয়েছে।সবগুলো গিয়ে আলিফের শার্টে পড়েছে।আলিফ শার্টের দিকে তাকিয়ে করুন চোখে তাকালো রুপ্সিতার দিকে।রুপ্সিতা দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে গেছে।আরো অনেকবার এই বাড়িতে এসেছে রুপ্সিতা তাই আনাচে কানাচে কিছু চিনতে অসুবিধা হয়নি।ওয়াশরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে রুপ্সিতা ওয়াক ওয়াক করছে।কিরে?আমার বমি আসেনা কেন?আমিতো ভাবছি এই লেবু পানি খেয়ে আমি বমি করে এদের ওয়াশরুম ভাসায় ফেলবো এখন দেখি বমিই আসছেনা।
চোখেমুখে পানি দিয়ে রুপ্সিতা ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আলিফ তিন্নিকে বলল রুপ্সিতার পাশে বসতে ও ওয়াশরুম থেকে শার্ট পরিষ্কার করে আসছে।

রুপ্সিতা এতক্ষণ অভিনয় করে ক্লান্ত হয়ে গেছে তাই এখন চুপচাপ শুয়ে আছে।তিন্নি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
শার্ট পরিষ্কার করে এসে আলিফ বলল,আমাদের এখনই যেতে হবে।তিন্নি বলল,সে কি জিজু?একটু পরই আটটা বাজবে আমাদের এনগেজমেন্ট শুরু হবে আর আপনি বলছেন এখনই চলে যাবেন?
আলিফ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,এখন থাকা সম্ভব নয়।রুপ্সির অবস্থা দেখেছো?এখানে থেকেও লাভ হবেনা।রুমেই বসে থাকা লাগবে বাইরে গেলে ও আবার পাগলামি শুরু করবে।তিন্নি মুখ ছোট করে হালকা মাথা নেড়ে বলল,ঠিক আছে।

এরপর আলিফ রুপ্সিতাকে নিয়ে তিন্নির বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গাড়ির জন্য দাঁড়ায়।সামনে একটা সিএনজি এসে দাঁড়াতেই আলিফ কথা বলে রুপ্সিতাকে উঠতে বলে।রুপ্সিতা উঠে বসতেই ওর পাশে একটা ছেলে এসে বসে পড়ে।ছেলেটি ড্রাইভারকে বলে মামা সামনে নামিয়ে দিবেন।আলিফের ভ্রু কুচকে এলো কিন্তু কিছু বলল না।এখন আরেকটা সিএনজির জন্য দাঁড়িতে হলে বাসায় যেতে দেরি হবে।রুপ্সিতাকে সরিয়ে আলিফ মাঝখানে বসে পড়ে আর রুপ্সিতা কর্নারে বসে।ছেলেটা বারবার আলিফের উপর দিয়ে চোখ নিয়ে রুপ্সিতাকে দেখার চেষ্টা করছে।কয়েকবার এরকম হওয়াতে আলিফ ক্ষেপে গেলো।
সিএনজি থামাতে বলে ছেলেটার কলার চেপে ধরলো।কি সমস্যা?ঐ দিকে কি দেখো?
ছেলেটা মাথা হালকা বেঁকিয়ে রুপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলল,নীলপরি দেখি।

আলিফ ছেলেটার নাক বরাবর একটা ঘুষি মারে।ছেলেটা সিএনজির সাথে বাড়ি খেয়ে হেলে যায়।সিএনজির ড্রাইভার ওদেরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে।ছেলেটা নাক টিপে দাঁড়িয়ে আছে নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে।আলিফ এগিয়ে গিয়ে আরেকটা মারতে গেলেই রুপ্সিতা পেছন থেকে আলিফকে জড়িয়ে ধরে রাখে।প্লিজ এখানে এখন কোনো ঝামেলা করবেন না আমার ভয় করছে।রুপ্সিতার কথায় আলিফ থেমে যায়।আরেকটা সিএনজি থামিয়ে উঠে পড়ে রুপ্সিতাকে নিয়ে।
ছেলেটা নাক চেপে ধরে এবার কেঁদে দিলো।ভেবেছে হালকা একটু গুন্ডামি করবে ওর ভিলেন হওয়ার খুব শখ।কিন্তু আলিফের এক ঘুষিতে ভিলেন হওয়ার শখ ঘুচে গেছে।
পুরো রাস্তা আলিফ আর রুপ্সিতা কেউ কথা বলেনি।বাসায় এসে আলিফ চেঞ্জ করতে চলে গেছে।রুপ্সিতা ও রুমের ভেতর শাড়িটা পাল্টে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়।আলিফ একেবারে শাওয়ার নিয়ে নিয়েছে।

রুপ্সিতা যে ওর সাথে অভিনয় করেছে ব্যাপারটা আলিফের কাছে স্পষ্ট।তখন আলিফকে জড়িয়ে ধরে আটকে দেওয়ায় আলিফ বুঝে যায় কেননা রুপ্সিতা প্রথমে আলিফকে বাবু বলে সম্বোধন করেছে আর তুমি বলেছে।তখন রাস্তায় রুপ্সিতা সজ্ঞানেই ছিলো।
ভেজা চুল গুলো হাত দিয়ে ঝেড়ে আলিফ বারান্দায় রুপ্সিতার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আলিফই আগে কথা বলা শুরু করলো।
তুমি আমার সাথে আজকে অভিনয় করেছো তাইনা?

আচ্ছা আমার দোষটা কোথায় বলতে পারো রুপ্সি?আমি মায়াকে ভালোবেসেছি এটাই কি আমার দোষ?আমার আর মায়ার ভালোবাসা পূর্নতা পায়নি এতে আমি মায়া দুজনেই কষ্ট পেয়েছি।মায়া ধীরে ধীরে আরাফাতকে মানিয়ে নিয়েছে তাদের বিয়ের এখন প্রায় পনেরো মাস।আর আমাদের বিয়ের মাত্র দুই মাস।এই দুইমাস সময় নেওয়াটা কি খুব বেশি হয়ে গেছে?আমার মনেতো মায়া ছিলো আমি চেয়েছিলাম সময় নিয়ে তোমাকে মানিয়ে নিতে।আমি আমাদের বিয়ের প্রথম রাতেও তোমাকে বলেছিলাম দুজনেরই একে অপরকে চেনাজানা প্রয়োজন আছে।আচ্ছা তুমি কি এটা চাইবে যে আমি ভালোনাবেসে তোমাকে ছুয়ে দিই।আমি চেয়েছি তোমাকে যা দেবো মন থেকে দেবো বাধ্য হয়ে নয়।

আমার মনে যদি মায়া না থাকতো তাহলে হয়তো তোমাকে মেনে নিতে আমার এতটা সময় লাগতো না।
রুপ্সিতা এবার মুখ খুলললো,তাহলে আমার দোষটা কোথায়?আপনি প্রথম থেকে আমাকে সবকিছু বলে দিলোতো আর এত কিছু হতোনা।আমিও আপনার কাছে কিছু এক্সপেক্ট করতাম না।রুপ্সিতার গলাটা ধরে আসছে।আমরা কখনো যদি কোনোভাবে কাছাকাছি আসতাম আপনি মাঝপথে দূরে চলে যেতেন।তখন আমার কষ্ট হতো না?
আলিফ রুপ্সিতার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,আমার ভুলের জন্য তুমি কষ্ট পেয়েছো।আ’ম সরি!কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমার সাথে থাকতে থাকতে কখন যে তেমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি জানিনা।আমি শুধু এটা জানি আমি তোমাকে ভালোবাসি।আমার বৃদ্ধ বয়সটাও তোমার সাথে কাটাতে চাই।মায়া আমার প্রথম ভালোবাসা তাকে আমি ভুলতে পারবোনা ঠিকই কিন্তু তোমাকে ভালোবাসতে কোনো কমতি রাখবোনা।আমার ভুলের জন্য আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?প্লিজ!
রুপ্সিতার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে।ঠোঁট চেপে কান্না সংবরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।ও তো আলিফের মুখে ভালোবাসি কথাটাই শুনতে চেয়েছিলো।হুট করে দুহাত দিয়ে আলিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আটকে যাওয়া কন্ঠে বলল,আমিও আপনাকে ভালোবাসি।

আলিফের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।নিজের বলিষ্ঠ হাতজোড়া দিয়ে আলিফও রুপ্সিতাকে আঁকড়ে ধরে।
আলিফ ঘোরলাগা কন্ঠে বলছে,রুপ্সি!
রুপ্সিতা জবাব দেয়,হুম।
আলিফ ফিসফিসিয়ে বলে,আমি কি রালিফ আর আলিফার আব্বু হওয়ার সুযোগ পাবো না?
রুপ্সিতা ধ্যাত বলে সরে আসতে নিলেই আলিফ রুপ্সিতার হাত শক্ত করে ধরে মুখটা ইনোসেন্ট করে বলল,প্লিজ!
রুপ্সিতা লজ্জায় আলিফের বুকে মুখ লুকালো।
(সবাই এখানেই থেমে যান?)

গভীর রাত সময়টা অজানা।ঘড়ি দেখলে বলা যাবে কটা বাজে।রুপ্সিতা আলিফের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।আলিফ একহাতে রুপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে রুপ্সিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।দৃষ্টি তার রুপ্সিতার মুখপানে আবদ্ধ।অজস্র মায়া জড়িয়ে আছে এই মুখটিতে।আনমনেই আলিফ রুপ্সিতার কপালে গভীর চুমু এঁকে দুহাতে নিজের বুকের সাথে আরেকটু মিশিয়ে নেয়।
প্রতিদিনের ন্যায় ভোরের দিকে রুপ্সিতার ঘুম ভেঙে যায়।ঘুম ভাঙতেই নিজেকে আলিফের বাহুডোরে আবিষ্কার করে।নিজের জায়গায় স্থির থেকেই আলিফের আর নিজের দিকে তাকায়।এতদিন এদের মাঝখানে বর্ডার না থাকলেও দুজন খাটের দু’মাথায় অবস্থান করতো আর এখন একে অপরের একদম কাছাকাছি।এতটাই কাছাকাছি যে আলিফের হার্টের কম্পনরত ধ্বনি রুপ্সিতার কানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।আলিফের উন্মুক্ত বুকের দিকে তাকিয়ে কালরাতের কথা মনে পড়ে গেলো রুপ্সিতার।ভালোলাগা আর লজ্জা মিশ্রিত হাসি ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠতেই দুহাতে মুখ ঢেকে নেয় রুপ্সিতা।

কিছু একটা মনে পড়তেই রুপ্সিতা চট করে মুখ থেকে হাত সরিয়ে খুব সাবধানে আলিফের হাতের বাধন থেকে সরে আসে।আযান হয়ে গেছে অনেক আগেই তাই রুপ্সিতা দেরি করতে চাইছেনা।দ্রুত গোসল সেরে নামায আদায় করতে হবে।চটজলদি গোসল সেরে আলিফকে ডাকতে গিয়ে বাধলো বিপত্তি।আলিফকে ডাকতে কেমন লজ্জা লাগছে আজ।লজ্জাকে একপাশে ঠেলে রেখে মৃদুস্বরে আলিফকে ডাকতে লাগলো নামাযতো পড়তে হবে।
এই যে শুনছেন?আলিফ উঠুন!
আলিফ নড়েচড়ে উঠে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,উমম!ঘুমোতে দাও না।
রুপ্সিতা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,আগে উঠে নামায পড়ে নিন।নামাযের সময় চলে যাচ্ছে।না উঠলে কিন্তু গায়ে জগের পানি ঢেলে দেবো।

আলিফ লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে নামে।ওয়াশরুম যেতে যেতে বলে তোমার খবর আছে আগে নামায পড়ে নিই।
রুপ্সিতা নামায শেষ করে খাটে হেলান দিয়ে বসলো।আলিফও গোসল সেরে নামায পড়ে নিলো।খাটে গিয়ে রুপ্সিতাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে রুপ্সিতার দুহাত চেপে ধরে বলল,কি বলেছিলে যেন?আমার গায়ে পানি ঢেলে দিবে?আচ্ছা চলো পানি ঢালতে হবেনা দুজনের যাতে আবার শাওয়ার নেওয়া লাগে সেই ব্যবস্থাই করি।রুপ্সিতা চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে বলল,একদম না।উঠুন আমার উপর থেকে অসভ্য লোক কোথাকার!

আলিফ সরে না গিয়ে রুপ্সিতার উপর আরেকটু ভর ছেড়ে দিয়ে ঘোরলাগা কন্ঠে বলে উঠে,তাহলে একটু অসভ্যতামি করাই যায় নাকি?রুপ্সিতার জান যায় যায় অবস্থা।আলিফ রুপ্সিতার গলায় মুখ গুঁজে আছে।আলিফের শ্বাস-প্রশ্বাস গিয়ে রুপ্সিতার ঘাড়ে পড়ছে।রুপ্সিতা আলিফকে সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে।আলিফ রুপ্সিতার ঘাড়ের দিকে কামড়ে ধরতেই রুপ্সিতা মৃদু চিৎকার করে উঠে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,কালরাত থেকেই আমাকে কামড়ে শেষ করেছেন এখনইও কামড়াচ্ছেন রাক্ষস কোথাকার।
আলিফ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,আর আমার শরীরে যে অজস্র নখের আচড় আছে সেগুলো কে দিয়েছে?
রুপ্সিতা আমতা আমতা করে বলছে,আব আমি আমি কিজানি?

আলিফ আবারও রুপ্সিতার গলায় বাইট দিতেই রুপ্সিতা চেঁচিয়ে বলে উঠে,আমি আমি দিয়েছি।
আলিফ মুচকি হেসে বাইট দেওয়া স্থানে আলতো ঠোঁট ছোঁয়ায়।রুপ্সিতা চোখজোড়া বন্ধ করে নিতেই আলিফ আরো গাঢ় চুম্বনে লিপ্ত হয়।
সকালের নাস্তা সেরে আলিফ আর আরিফ নিজেদের অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে।ইরিন সানিকে খাবার খাওয়াচ্ছে রুপ্সিতা টিভি দেখছে বসে বসে।
বিকেলে আলিফ বাসায় এসে দেখে রুপ্সিতা নিজের পায়ের দিকে তাকাচ্ছে আবার মোবাইলের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে।আলিফ অফিসের ব্যাগ রেখে জিজ্ঞেস করলো,এভাবে কি দেখতেছো?
রুপ্সিতা ঠোঁট উল্টে বলল,পায়ে তিল থাকলে নাকি বিদেশে যায় আমার পায়েতো একটা নয় দুটো তিল আছে তাহলে আমি বিদেশে গেলাম কখন?
আলিফ রুপ্সিতার ঠোঁট উল্টানো দেখে হেসে দিয়ে বলে,ঠিক আছে আমরাও বিদেশে যাবো যখন আমাদের ব্যাটেলিয়নরা পৃথিবীতে আসবে।

রুপ্সিতা চোখ বড় বড় করে বলল,ব্যাটেলিয়নরা মানে?আপনি কয়টার কথা বলতেছেন ডজন খানেক নয়তো?
আলিফ চোখ ছোট ছোট করে বলল,তুমিইতো বললে দুজনের কথা।একজন রালিফ একজন আলিফা তাহলে ব্যাটেলিয়নরা হলো না?
রুপ্সিতা বলল,ওহ আচ্ছা!আমিতো ভেবেছিলাম আপনি ডজন খানেকের কথা বলছেন।আলিফ দাঁত কেলিয়ে বলল,ডজন খানেক হলেও আমার সমস্যা নেই।
রুপ্সিতা একটা বালিস নিয়ে আলিফের দিকে ছুড়ে মারে।আলিফ ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।

মাঝখানে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন।রুপ্সিতার ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা চলে এসেছে।কিছুদিন বাদেই পরীক্ষা শুরু হবে।এখন পুরোদমে পড়ালেখা করছে ওর পড়ালেখার ব্যাপারে আলিফ ও বেশ জোরদার দিচ্ছে।
রিতার চেহারার রং দিন দিন কমেই চলেছে।অথচ প্রেগন্যান্সির সময়টাতে মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় কিন্তু রিতার ক্ষেত্রে ঠিক তার বিপরীত।খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করেনা সারাদিন চাুপচাপ থাকে।শোভনের সাথেও ঠিক করে কথা বলেনা শোভন ও নিজের প্রয়োজন ছাড়া কথা বলার চেষ্টা করেনা।মাঝে মাঝেই রিতা ঢুকরে কেঁদে ওঠে রুপ্সিতার সাথে করা অন্যায়ের কথা মনে করে।ইচ্ছে করে একবার বোনটার সাথে কথা বলতে কিন্তু কোন মুখে কথা বলবে?শোভনের বিষয়টা কাউকেই জানাতে পারছেনা সে রুপ্সিতার সংসার ভাঙার ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে।একবার বোনের সাথে অন্যায় করে দ্বিতীয় বার তার সংসার ভাঙার কারণ হতে চায় না রিতা।
শোভন!শোভন!

শোভন বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো নিচ থেকে মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে শোভনের পিলে চমকে উঠে।তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,সাথী!তুমি এখানে কি করছো?বাবা মা কি মনে করবে তাদের পুত্রবধূ বিয়ের আগে বাসায় এসে এরকম চিল্লাচিল্লি করলে।আসো আমার সাথে বেরিয়ে আসো বাবা মা কেউ এখনো দেখেনি।সাথী শোভনের হাত ঝাড়া দিয়ে বলল,কোথাও যাবো না আমি।আজ তোর মুখোশ খুলে দিয়ে তারপর আমি এখান থেকে যাবো।ডাক কোথায় আছে তোর বাবা,মা,বউ।
সাথীর কথা শুনে আলিফ চমকে উঠে বলে,বউ?আর তুমি কিসের মুখোশ খোলার কথা বলছো?
সাথী দাঁতে দাঁত পিষে বলল,একদম ন্যাকামি করবেনা।আমি সবকিছু জেনে গিয়েছি তোমার কয়টা মেয়ের সাথে এরকম রিলেশন আছে।বাড়িতে বউ রেখে এসব করতে লজ্জা লাগেনা?
এতক্ষণে শোভনের বাবা মা,রিতা নিচে নেমে এসেছে।

তাদেরকে দেখে শোভন সাথীকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।সাথী চিৎকার করে বলছে আমি আজ তোমার মুখোশ উন্মোচন করা ছাড়া কোথাও যাবোনা।রিতা সাথীকে দেখে চমকে উঠে ওর যতদূর মনে হয় শোভনের সাথে দুই মিনিটের ভিডিও ক্লিপে এই মেয়েটাই ছিলো।শোভনের বাবা মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন তাদের কিছুই বোধগম্য হচ্ছেনা।সাথী শোভনের বাবা মায়ের সামনে গিয়ে বলে,ছেলে জন্ম দিয়েছেন অথচ ছেলে কি কি করে বেড়াচ্ছে সে খবর রাখছেন না।রিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে আর তুমি!তোমার স্বামী যে তোমাকে রেখে বাইরে মেয়েদেরকে নিয়ে ফূর্তি করে যাচ্ছে,দিনের পর দিন তোমাকে ঠকিয়ে যাচ্ছে সেখবর রাখো তুমি?
স্টপ সাথী!আই সেইড স্টপ!চিল্লিয়ে বলে উঠলো শোভন।তারচেয়ে দ্বিগুন জোরে চিল্লিয়ে সাথী বলল,তুমি চুপ থাকো।
তারপর একেরপর এক ঘটনা গুলো বলতে থাকে।

এই ছেলে একটা মেয়েবাজ।মেয়েদেরকে ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে বিয়ে করবে বলে বেড পর্যন্ত নিয়ে যায়।নিজের ঘরে বউ রেখে অন্যনারীতে আসক্ত হয় শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য।আমাকেও বিয়ে করবে বলে আমার সব কিছু কেঁড়ে নিয়েছে।কথাটা বলতেই সাথীর চোখ পানিতে টলমল করে উঠে।আমি কিছুই জানতাম না প্রথমে যখন আমার ফ্রেন্ড ইশান আমাকে এগুলো বলেছিলো তখন আমি কিছু বিশ্বাস করিনি।উল্টো ইশানকে যা ইচ্ছে তাই বলে অপমান করেছি।তারপরেও ইশান থেমে থাকেনি যেসকল মেয়েদের সাথে শোভনের সম্পর্ক ছিলো ওদেরকে একসাথ করে আমাকেও সেখানে নিয়ে যায়।সবার বলা ইনফরমেশনে ইশানের কথাগুলো মিলে যায়।পরে আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি শোভন বিবাহিত তার উপর ওর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা।মেয়েগুলো দ্বিতীয়বার শোভনের সামনে আসতে চায় না তাই আমি একাই এসেছি।

শোভন ওর মা বাবার কাছে গিয়ে বলে এই মেয়ে সব মিথ্যা বলতেছে।তোমারা কিছু বিশ্বাস করবেনা।শোভানের বাবা মার মাথা হ্যাং হয়ে আছে কি শুনছে নিজের ছেলের নামে এগুলো।তাদের এসব কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছেনা।তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছেনা।
এবার রিতা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,কিছুই মিথ্যা না সব সত্যি কথা।ওই জানোয়ার আমার বোনের সাথেও একই কাজ করার চেষ্টা করেছিলো।আমার বোন রাজি না হওয়ায় আমার বোনকে সবার চোখে নিচ আর ছোট করেছে।এতদিন আমি চুপ ছিলাম কারণ ওই জানোয়ার আমার মুখ বন্ধ রেখেছিলো।আমি মুখ খুললে আমার বোনের সংসার ভাঙতেও দু’বার ভাবতোনা।
এবার ওই জানোয়ারের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করবো।

শোভন আর কাউকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলো না।ডাইনিং থেকে ফল কাটার ছুরি হাতে নিয়ে পেছন থেকে সাথীর গলায় চেপে ধরলো।আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই শেষ করে দেবো।রিতার দিকে তাকিয়ে বলল,তোকেতো আমি পরে দেখে নেবো দেখি এবার কিকরে নিজের বোনের সম্মান আর সংসার দুইটাই টেকাতে পারিস।

শোভনের বাবা মায়ের এতক্ষণেও ছেলের প্রতি যে বিশ্বাস ছিলো তা শোভনের এই মুহূর্তে করা কাজে ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেছে।শোভনের বাবা এগিয়ে আসতে নিলেই শোভন জবাব দিলো,একদম না কেউ জায়গা থেকে নড়বেনা।আমার কথার হেরফের হলে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবো সবগুলোকে।সবাই আতঙ্কিত হয়ে আছে।শোভনের বাবা মায়ের নিজেদের প্রতি ঘৃনা হচ্ছে এই ছেলেকে দুনিয়ার মুখ দেখিয়ে।
সাথীর ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি।শোভন সাথীকে হাসতে দেখে বলল,মরার ভয়ে পাগল হয়ে গেলি নাকি?
সাথী ঠোঁটেের কোনে আগের মতোই হাসি স্থির রেখে বলল তোর জন্য সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে সেজন্যই হাসছি।
শোভন ভড়কে গেলো সাথীর কথায়।সারপ্রাইজ মানেতো নিশ্চয়ই সাথী কিছু একটা প্ল্যান করে রেখেছে।
শোভন সাথীর গলায় ছুরিটা আরেকটু চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,কি প্ল্যান করেছিস বল নয়তো আর এক সেকেন্ডও বাঁচার সুযোগ পাবিনা।

সাথী শান্ত স্বরে জবাব দেয়,রিল্যাক্স!এতো তাড়া কিসের?আরেকটু অপেক্ষা কর দেখবি সারপ্রাইজ তোর সামনে।
সাথী বয়েজ ভেতরে এসো তোমরা বলতেই ইশান কতগুলো ছেলেপুলে নিয়ে শোভনের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।
এতগুলো ছেলেকে একসাথে দেখে সেদিকে আতঙ্কিত চোখে একবার তাকিয়ে শোভন সাথীর দিকে তাকায়।
সাথী ঠোঁট বাঁকা করে হেসে বলল,পুলিশে দিলেতো একদিন না একদিন বেরিয়ে যাবি তার আগে একটু আদর যত্ন করে নিই যাতে জীবনের চলন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলিস।তারপর নাহয় পুলিশের হেফাজতে রাখা যাবে তোকে।
শোভন রুপ্সিতার গলায় ছুরি চেপে ধরে রেখে নিজের ফোন বের করে কাউকে কল দিতে দিতে সাথীকে উদ্দেশ্য করে বলল,তুই কাজটা ভালো করলিনা সাথী।

রিতা,শোভনের বাবা মা সবাই নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
ইশান সাবধানে পেছন থেকে শোভনের হাত চেপে ধরে ছুরিটা ফেলে দিতেই সাথী সরে আসে।তারপর শোভনের নাক বরাবর ঘুষি মেরে বলল,কাকে কল দিতে যাচ্ছিলি?শোভন সিটকে দু’পা সরে যায়।
ইশান ছেলেগুলোকে ইশারা করতেই সবাই মিলে শোভনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে মারতে থাকে।
ইশান দাঁতে দাঁত পিষে বলল,এমন ভাবে মারবে যাতে ভেতরে যখম হবে কিন্তু উপর দিয়ে দেখলে তেমনটা বোঝাই যাবেনা।সালার মেশিনের এমন অবস্থা করবি যাতে দ্বিতীয়বার কোনো মেয়ের কাছাকাছি যাওয়ার কথাও না ভাবতে পারে।নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে ফিরে আসে।

একসাথে এতগুলো ছেলের মার সহ্য করতে না পেরে শোভন চিৎকার করছে।একজন দুপায়ের মাঝ বরাবর লাথি মারতেই শোভন এক গগনবিধারী চিৎকার করে উঠে মা বলে।
শোভনের বাবা মা,রিতা সবার চোখে পানি কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছেনা।শোভন চিৎকার করে বলছে,বাবা-মা আমি মরে যাচ্ছি আমাকে এদের হাত থেকে বাঁচাও।আমি আর কখনো এসব খারাপ কাজ করবোনা একেবারে ভালো হয়ে যাবো।শোভনের বাবা মা ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।ছেলের এই অবস্থা দেখে কষ্ট হচ্ছে তারচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে এমন একটা নরপিশাচকে জন্ম দিয়েছে বলে।
শোভন আর্তনাদ করে বলছে,মা তোমার আল্লাহর দোহাই লাগে এদেরকে থামাও।আমি ভালো হয়ে যাবো।শোভনের মা কটাক্ষ করে বললেন,কুকুরের লেজ যেমন সোজা হয়না তেমনি তোর মতো কিছু পশুও কোনদিন ভালো হবেনা।
একই জায়গায় অন্যজন পা দিয়ে আঘাত করতে শোভনের চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম।গলার স্বর বের হচ্ছেনা অতি কষ্ট রিতার দিকে তাকিয়ে বলল,রিতা আমি তোমার স্বামী তোমার সন্তানের বাবা।আমার কিছু হলে তুমি বিধবা হয়ে যাবে আমাদের সন্তান এতিম হয়ে যাবে।

রিতা চিৎকার করে বলছে,লাগবেনা আমার তোর মতো স্বামী,আমার সন্তানের ও এমন বাবার দরকার নেই।আমার সন্তানের জীবনে যাতে কোনদিন তোর মতো জানোয়ারের ছায়াও না পড়ে সেই চেষ্টাই করবো আমি।
অবশেষে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে শোভনের দেহ।হালকা একটু শ্বাস উঠা নামা করছে।ইশান সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে এবার এটাকে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে একটু রিকভার হলেই পুলিশের হেফাজতে দিয়ে দেবো।এমন অবস্থা হয়েছে জেল থেকে ছাড়া পেলেও কোনদিন সচলভাবে চলাফেরা করতে পারবেনা।ইশান ছেলেগুলোকে নিয়ে চলে যায় সাথে শোভনকেও নিয়ে যায়।
শোভনের বাবা মা,রিতা ফ্লোরে বসে কাঁদছে।সাথী রিতার কাঁধে হাত দিতেই রিতা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।সাথীর চোখেও পানি।রিতা কাঁদছে স্বামীর কাছ থেকে প্রতারিত হয়ে আর সাথী কাঁদছে প্রেমিকের কাছে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে।

আমাদের সমাজে কিছু মেয়ের এরকম ভুলের কারণে পরে তাদেরকে পস্তাতে হয়।সমাজের চোখে নিজেতো ছোট হয় সাথে বাবা মায়ের মুখও ছোট করে।যে মানুষটা তোমাকে ভালোবাসবে সে কোনোদিন তোমার শরীরের দিকে নজর দিবেনা।সে তোমাকে হালালভাবে গ্রহন করতে চাইবে।আফসোস এই ছোট্ট কথাটা মেয়েরা বুঝেনা।মিথ্যা ভালোবাসার বশবর্তী হয়ে বিলিয়ে দেয় নিজেকে।
রুপ্সি আমার নীল রঙের টিশার্ট টা কি করেছো?
রুপ্সিতা সানিকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকেছে মাত্র তখনই আলিফ টিশার্টের কথা জিজ্ঞেস করে উঠলো।রুপ্সিতা আমতা আমতা করে বলল,আব আমি কি জানি আপনার নীল টিশার্ট কোথায়?
আলিফ বিরক্তি নিয়ে বলে তুমিইতো টিশার্ট টা দিনে একশবার জামার উপর দিয়ে পড়ো।

রুপ্সিতা চোরের মতো মুখ এদিক ওদিক করে বলল,তো?তাই বলেকি আমাকে জানতে হবে নাকি টিশার্ট এখন কোথায় আছে?
আসলে রুপ্সিতা টিশার্ট টা পড়ে খাটের উপর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হাটুর নিচে পড়ে টিশার্টের বুক পকেটের জায়গায় অনেক খানি ছিঁড়ে গেছে।আলিফের গায়ের মাপের টিশার্ট রুপ্সিতার গায়েতো বড় হবেই তার উপর গেছে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে।
রুপ্সিতার মুখের ভাবগতি বুঝার চেষ্টা করে আলিফ বলল,কি করেছো টিশার্ট বলো!আমি কিছু বলবোনা।
রুপ্সিতা হাসার চেষ্টা করে বলল,আমি সত্যিই জানিনা টিশার্ট টা কোথায় তাহলে বলবো কিভাবে?
সানি একবার আলিফের মুখের দিকে তাকাচ্ছে আবার রুপ্সিতার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
এরপর রুপ্সিতার কোল থেকে নেমে রুপ্সিতার পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে বইয়ের চিপা থেকে আলিফের টি-শার্ট বের করে আনে।রুপ্সিতা বইয়ের চিপায় রেখেছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত টিশার্টের কিছু অংশ বেরিয়েছিলো।আলিফ সানির হাত থেকে টিশার্ট নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখে বুকপকেটের জায়গায় অনেকখানি ছিঁড়ে আছে।রুপ্সিতার দিকে তাকতেই রুপ্সিতা একটা কেবলাহাসি দিয়ে বলে,সত্যি বলছি আমি কিছু জানিনা।

আলিফ মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলল,আমার টিশার্ট ছিঁড়ে ফেলার অপরাধে আজ তোমাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে।রুপ্সিতা সানিকে নিয়ে রুম থেকে কেটে পড়তে চাইলে আলিফ রুপ্সিতার হাত চেপে ধরে সানিকে বলে,বাবা দেখে আসোতো তোমার আম্মু তোমাকে কেন ডাকছে?
সানি ভ্রু কুচকে বলল,কই আমিতো শুনলাম না?সাথে রুপ্সিতা ও তাল মিলিয়ে বলল,একদম!আমিওতো শুনলাম না।
আলিফ মুখটাকে ইনোসেন্ট করে সানিকে বলল,কিন্তু চাচ্চু তো স্পষ্ট শুনলাম।তুমিই বলো চাচ্চু কি তোমাকে মিথ্যে বলছে?
সানি মাথা নেড়ে না জানিয়ে ভাবুকের মতো গালে আঙ্গুল দিয়ে ভাবতে ভাবতে চলে গেলো।
আলিফ দরজা আটকে দিয়ে রুপ্সিতাকে খপ করে দুহাতে চেপে ধরলো।রুপ্সিতা ছটপট করে নাক টেনে বলল,একটা টিশার্টের জন্য আপনি আমাকে এখন শাস্তি দিবেন?

আলিফ ঠোঁট টিপে হেসে বলল,হুম!ভুল যখন করেছো শাস্তিতো পেতেই হবে।আলিফ রুপ্সিতার দিকে এগিয়ে আসছে রুপ্সিতা পিছিয়ে যেতে যেতে ভাবছে না জানি আজকে আমার গাল দুটো ঠাটিয়ে চড় মেরে ফাটিয়ে দেয়।আলিফ রুপ্সিতার একেবারে সামনে আসতেই রুপ্সিতা চোখদুটো বন্ধ করে নিয়ে মিনমিন করে বলে আস্তে মারবেন প্লিজ।
আলিফ রুপ্সিতার বন্ধ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে তারপর হুট করে রুপ্সিতার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে আস্তে করে কামড়ে ধরে।রুপ্সিতা চমকে উঠে চোখ মেলে তাকায়।তখনই রুপ্সিতার মুঠোফোন তীব্রগতিতে আওয়াজ করে উঠে।আচমকা এরকম আওয়াজে আলিফ রুপ্সিতাকে ছেড়ে সিটকে সরে যায়।অতঃপর ফোনের দিকে তাকাতেই রাজ্যের বিরক্তি এসে আলিফের চোখে মুখে ভর করে।এই ফোন আওয়াজ তোলার আর সময় পেলোনা এখনই কল আসতে হলো?

রুপ্সিতা মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় রিতা কল করেছে।কেননা ওই ঘটনার পর থেকে রিতা কখনো রুপ্সিতাকে কল দেয়নি।কল ধরবে কি ধরবেনা ভাবছে রুপ্সিতা।এরমাঝে একবার কল কেটে গিয়ে আবার কল আসে।রুপ্সিতার আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝে আলিফ বলে উঠে,কল ধরছো না কেন?
রুপ্সিতা হ্যাঁ ধরছি বলে কল রিসিভ করে বারান্দায় চলে যায়।এখন কল রিসিভ না করলে আলিফ নানান প্রশ্ন শুরু করতো।
ফোন কানে ধরতেই ওপাশ থেকে রিতার ভাঙা ভাঙা কন্ঠস্বর শুনতে পায় রুপ্সিতা।
রুপা!

রুপ্সিতা চোখ বন্ধ করে নেয়।কতদিন পর নিজের বোনের মুখে এই ডাকটি শুনলো।
রিতা আবারো বলে উঠে,রুপা একটু শোভনের বাসায় আসতে পারবি কালকে?তোর আসাটা খুব জরুরী।আমি বাবা মাকেও আসতে বলেছি প্লিজ তুই আসিস।
রুপ্সিতা কেন জিজ্ঞেস করতেই রিতা কেঁদে উঠে বলে,আসলেই সব জানতে পারবি প্লিজ আয়না একবার।
রুপ্সিতা হকচকিয়ে গিয়ে বলল,তুই কাঁদছিস কেন?কি হয়েছে সব ঠিকঠাক আছেতো?
কিচ্ছু ঠিক নেই তুই একবার আয় প্লিজ।আসলে সব জানতে পারবি বলেই রিতা কল কেটে দিলো।নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টায় আছে রিতা।
রুপ্সিতা হ্যালো,হ্যালো করে যাচ্ছে যখন বুঝতে পারলো কল কেটে গেছে তখন ফোন সামনে এনে আনমনেই বলল,আজব তো!এভাবে কল কেটে দিলো কেন?
কিছুতেই রুপ্সিতার মন শান্ত হচ্ছেনা তাই বার কয়েক রিতার নাম্বারে ডায়েল করতেই প্রতিবার কল বেজে কেটে যাচ্ছে।ওপাশ থেকে কেউ তুলছেনা।

শেষে ব্যর্থ হয়ে রুপ্সিতা রুমে ফিরে আসে।ওর মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে রিতা কেন ওকে কাল যেতে বলল আর কাঁদছেইবা কেন?এসব ভাবতে ভাবতে রুপ্সিতা খাটের সাথে বাড়ি খাওয়ার আগেই আলিফ ধরে ফেলে।রুপ্সিতাকে ধমকে বলে,কি ভাবো সারাদিন?এক্ষুনিতো পায়ে লেগে যেতো।রুপ্সিতা সামনে তাকিয়ে আবার আলিফের দিকে তাকায়।
আপু কল করেছে।আমাকে কাল একবার যেতে বলেছে ওদের বাসায়।ও কাঁদছেও কিন্তু কারণ বলছেনা।বলেছে কালকে আমি গেলেই নাকি সব বলবে।আলিফ রুপ্সিতাকে খাটে বসিয়ে বলল,আচ্ছা ঠিক আছে এত চিন্তা করতে হবেনা।আমি তোমাকে কাল তোমার আপুর বাসায় দিয়ে তারপর অফিসে যাবো।এখন ঘুমিয়ে পড়ো।
শুয়ে শুয়ে ও রুপ্সিতা রিতার কথা নিয়ে চিন্তা করছে।আলিফ পেছন থেকে রুপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরে কোমল কন্ঠে বলল,রুপ্সি!
রুপ্সিতা জবাব দিলো,হুহ!

আলিফ রুপ্সিতাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,এখনো চিন্তা করছো তুমি?
রুপ্সিতা বলল,নাহ মানে আমি
আলিফ রুপ্সিতাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,কালকে তো যাচ্ছোই তাহলে এত চিন্তা কিসের?যত চিন্তা তুমি সবাইকে নিয়ে করো তার এক পার্সেন্ট তোমার এই বরটাকে নিয়ে করলেই পারো।আলিফের কথা শুনে রুপ্সিতা হেসে দেয়।আলিফ রুপ্সিতার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বলল,এখন ঘুমাও।রুপ্সিতাও আলিফের পিঠে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।
আলিফ অফিসে যাওয়ার আগে রুপ্সিতাকে রিতার শশুর বাড়িতে পৌঁছে দিতে এসেছে।দরজার কলিংবেলে চাপ দিতেই রিতা এসে দরজা খুলে দিলো।রুপ্সিতার সাথে আলিফকে দেখে প্রথমে ভড়কে গেলো রিতা।কারণ শোভন রুপ্সিতাকে নিয়ে যে সিনক্রিয়েট করেছে সেসবের কিছুই আলিফ জানেনা।রিতা তবুও মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে আলিফকে ভেতরে আসতে বলল।

আলিফ মাথা নাড়িয়ে হাসিমুখে বলল,না আপু এখন ভেতরে যাবোনা রুপ্সিকে পৌঁছে দিতেই এসেছিলাম।আমার অফিসে যেতে হবে।রিতাও আর জোর করেনি।আলিফ এখানে থাকলে কাহিনী আরো বহুদূর গড়াবে।
আলিফ পেছন ঘুরে চলে যেতেই রুপ্সিতা সেদিকে একবার তাকিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে।বসার ঘরে ওর বাবা মাকে বসে থাকতে দেখে মাথা নিচু করে নেয়।রুপ্সিতার বাবা-মা রুপ্সিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।কতদিন পর ছোট মেয়ের মুখ দেখলো।রিতা রুপ্সিতাকে বসতে বললে রুপ্সিতা প্রশ্ন করে ওঠে আমাকে এখানে কেন ডেকেছিস সেটা বল।আমাকে আবার বাসায় ফিরতে হবে।
রিতা লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল,তুই আগে বস আমি বলছি।আমি এখন যেই কথাগুলো বলবো সেগুলো শুধু তুই না এখানে বসে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের শোনা জরুরী।

সবাই মনযোগ দিয়ে রিতার কথাগুলো শোনার চেষ্টায় আছে।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে রিতা বলা শুরু করলো।
রুপার বিয়ের আগেরদিন আমাদের বাসায় যে সিনক্রিয়েটটা হয়েছিলো সেটার জন্য সম্পূর্ণ দোষী শোভন।সেদিনের ঘটনাটা ছিলো সম্পূর্ণ মিথ্যে।তাতে রুপার বিন্দুমাত্র দোষ ছিলোনা।রুপ্সিতার বাবা মায়ের রিতার কথায় পিলে চমকে উঠে।
রিতা কাল রাতেই তার শশুর শাশুড়ীকে শোভনের করা কুকর্মের কথা বলে দেওয়ায় সবকিছু বুঝতে তাদের এখন কষ্ট হচ্ছেনা।রুপ্সিতা কোনো প্রতি উত্তর করেনি।ওর চোখমুখ বেশ শক্ত হয়ে উঠেছে।এতক্ষণ বোধগম্য না হলেও এখন যখন বুঝতে পেরেছে ও শোভনের বাড়িতে অবস্থান করছে ঘৃণায় এই জায়গা থেকে একছুটে পালাতে ইচ্ছে করতেছে।রুপ্সিতা চোয়াল শক্ত রেখেই ভাবছে এখন এই কথাগুলো কেন উঠছে আর শোভনই বা কোথায়?

রিতা তার বাবা মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে নড়েচড়ে বসে বলল,আমি এখন যা বলছি এগুলোই সত্যি।শোভন একটা মেয়েবাজ।ঘরে আমাকে রেখে বাইরে অন্য মেয়েদের নিয়ে ফূর্তি করে বেড়ায়।চেয়েছিলো রুপাকেও নিজের নোংরা ফাঁদে ফেলবে।রুপাকে একরাত কাটানোর প্রস্তাব দিয়েছে।সেদিন রাতে আমি যখন শোভনকে পাশে না পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম তখন দেখি শোভন রুপার ঘর থেকে বের হচ্ছে।অজানা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে।নানান ভাবনা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।আমি শোভনকে এতরাতে রুপার ঘরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই ও আমাকে মিথ্যে বলে কয়েকটা কথা বলেছিলো।যাতে আমি সারারাত এসব নিয়ে ভেবে ওর কথাটাই বিশ্বাস করি।আর হলোও তাই আমি রুপাকে বিশ্বাস না করে মায়ের কাছে গেলাম।মা বাবা ও তখন যাচাই-বাছাই না করে রুপার কথা না শুনে ওর গায়ে হাত তোলে।

এরপর রিতা এতদিনের সব ঘটনা সবাইকে খুলে বলে।কালকে কি হয়েছিলো সেগুলোও বলে।
সব শুনে রুপ্সিতার বাবা মা স্থির হয়ে গেলেন।জল ভর্তি চোখে রুপ্সিতার দিকে তাকাতেই রুপ্সিতা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।শোভনের বাবা মা নিরবে চোখের জল ফেলছেন ছেলের কুকর্মের কথা শুনে।এছাড়া তাদের আর কিইবা করার আছে?
রুপ্সিতার বাবা চোখের পানি ছেড়ে হুহু করে কেঁদে উঠলেন।নিজের মেয়েকে বিশ্বাস না করে তার সাথে কতবড় অন্যায় করে ফেলেছেন।রুপ্সিতার বাবা মা দুজনেই এগিয়ে এসে রুপ্সিতার সামনে দাঁড়ালেন।রিতা সহ রুপ্সিতার বাবা মা রুপ্সিতার কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলো।

রুপ্সিতার মা কেঁদে দিয়ে দুই হাত জোর করে বললেন,তুই আমাদেরকে ক্ষমা করে দে মা।আমরা তখন ঠিক ভুল বিচার না করেই তোর প্রতি অন্যায় করে ফেলেছি।
রুপ্সিতার বাবা বললেন,আমরা জানি আমরা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না।তারপরও তোর কাছে আমরা ক্ষমা চাইছি।আমাদেরকে তুই ক্ষমা করে দিস।
রিতা ও কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাইছে রুপ্সিতার কাছে কিন্তু রুপ্সিতা চুপ করে আছে।সেদিন রুপ্সিতা কেঁদে কেঁদে বলেছিলো আমি নির্দোষ সবাই চুপ ছিলো।কেউ ওর কথা শুনতে চায়নি আর আজ সবাই কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চাইছে কিন্তু রুপ্সিতা চুপ করে আছে।
রুপ্সিতার বাবা কাতর কন্ঠে বললেন,কি হলো আমাদের ক্ষমা করবিনা?আমরা যে তোর সাথে বড় অন্যায় করে ফেলেছি আমাদেরকে তুই ক্ষমা কর মা।

শোভনের বাবা মা বলে উঠলো,আমাদের চরিত্রহীন ছেলের জন্য তোমাকে কত কি সহ্য করতে হয়েছে।আমরা খুবই লজ্জিত আমাদেরকেও ক্ষমা করে দিও মা।
রুপ্সিতা বলল,আপনারা কেন ক্ষমা চাইছেন?আপনাদেরতো কোনো দোষ নেই।আপনারা কিছুই জানতেন না।তাই আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না প্লিজ।আপনাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
রিতা ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,আর আমাদের ক্ষমা করা যায় না তাইনা?

রুপ্সিতা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,সেদিন চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম আমি কিছু করিনি আমার কোনো দোষ নেই।কিন্তু আমার সেদিনের কান্না, আর্তনাদ তোমাদের হৃদয় কাঁপাতে পারেনি।একটা বাইরের ছেলের কথা বিশ্বাস করলে অথচ যাকে সেই ছোট থেকে বড় করেছো তাকে বিশ্বাস করতে পারলেনা।বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,যাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছো।নিজেদের আদর্শে গড়ে তুলেছো সেই আদর্শের কথা কিভাবে ভুলে গেলে?কিভাবে ভাবতে পারলে আমি এরকম একটা জঘন্য,নোংরা কাজ করতে পারি?
আজ কথাগুলো বলতে রুপ্সিতার একটুও গলা কাঁপছেনা চোখে পানি আসাতো দূর।অথচ এতদিন বাবা মায়ের কথা ভাবলেই সেদিনের মারের কথা মনে পড়ে যেতো।চোখে অশ্রুর ঢল নেমে আসতো।কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো,
একটা সম্পর্কের মূল খুঁটি হলো বিশ্বাস।সম্পর্ক গড়ার জন্য বিশ্বাস অতিব জরুরি।কিন্তু আফসোস সম্পর্কের খুঁটি হিসেবে বিশ্বাসটাই তোমাদের মাঝে নেই।ক্ষমা করার কথা বলছো?তাহলে শুনে রাখো আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করতে পারিনি।ভবিষ্যতে পারবো কিনা সেটা ও জানিনা।

রুপ্সিতার বাবা ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লেন।রুপ্সিতার মা উনাকে ধরে পাশেই বসে রইলেন।রিতা এগিয়ে এসে বলল,প্লিজ একটা সুযোগ দে আমাদেরকে।এবারের মতো ক্ষমা করে দে।ক্ষমা করা মহৎগুন।
রুপ্সিতা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
এখন আমি মহান হওয়ার জন্য তোমাদেরকে বলবো আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।কিন্তু আদেও আমি মন থেকে তোমাদেরকে ক্ষমা করতে পারবো তো?তাহলে মুখে ক্ষমা করেছি বলে মহান সাজার কি দরকার?হঠাৎ করে তোমাদের করা অন্যায়ের কথা মনে পড়লে তোমাদের প্রতি একধরনের ক্ষোভ জন্ম নেবে আমার মনে।তাহলে আমি কিভাবে বলবো যে আমি তোমাদের ক্ষমা করেছি?
তবে যখন দেখবো তোমাদের করা অন্যায়ের কথা আমার মনে পড়ছেনা,যদি কখনো তোমাদের কাছে ফিরে আসি তাহলে ধরে নেবে আমি তোমাদের ক্ষমা করতে পেরেছি।

এখন আমাকে যেতে হবে বলেই সোফা থেকে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুপ্সিতা দরজার দিকে পা বাড়ায়।সবাই জলভরা চোখে তাকিয়ে আছে।পেছন ফিরেই রুপ্সিতার পা দুটো থেমে যায়।
আলিফ দাঁড়িয়ে আছে।কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে?এখানে যেহেতু দাঁড়িয়ে ছিলো তারমানে সবকিছুই শুনেছে।রুপ্সিতা চোখমুখ শক্ত করে আলিফকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়।
সবাই আলিফকে দেখে থমকে যায়।আলিফ সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে রুপ্সিতার পিছু পিছু বেরিয়ে আসে।
রিতা আনমনে বলে ওঠে আমার বোনের সংসারটা টিকবে তো?

রাগে আলিফের মাথা ফেটে যাচ্ছে।এরা এতটা জঘন্য যে কিনা নিজের মেয়েকে বিশ্বাস না করে গায়ে হাত তুলেছে।তারমানে রুপ্সির গায়ে বিয়ের প্রথমে যে দাগ গুলো ছিলো সেগুলো ওর পরিবারের দেওয়া?এদের সাথে কথা বলতেও আলিফের রুচিতে বাঁধছে তাইতো ওখানে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে।আলিফ এসেছিলো রুপ্সিতার ফোন দিয়ে যেতে।আসার সময় সিএনজিতে ফেলে এসেছিলো।কিন্তু এখানে এসে সবার কথা শুনেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।
রুপ্সিতা একটা সিএনজি ডেকে উঠে পড়তেই আলিফ হুড়মুড়িয়ে এসে রুপ্সিতার পাশে এসে বসে।রুপ্সিতার চোখে পানি চিকচিক করছে।আলিফ কি ওকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দেবে?আলিফ সন্তর্পণে রুপ্সিতার দিকে ওর ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,তোমার ফোন সিএনজিতে ফেলে গিয়েছিলে।একেবারে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে রুপ্সিতার সাথে।রুপ্সিতা চোখের পলক ঝাপটাতেই টুপ করে দুফোঁটা জল কপল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।থুতনি বেয়ে জলগুলো নিচে গড়িয়ে পড়ার আগেই আলিফ সযত্নে সেগুলো মুছে দিয়ে বলে,কাঁদছো কেন?ওয়েট তোমার চোখে কি কিছু পড়েছে?

আজকে শহর তোমার আমার পর্ব ১৩+১৪+১৫

আলিফ এমন ব্যবহার করছে যেন একটু আগের কথাগুলো কিছুই শুনেনি।
রুপ্সিতা আলিফের কথাকে উপেক্ষা করে বলল,সবার মতো আপনি ও কি আমাকে দূরে সরিয়ে দিবেন?
আলিফ রুপ্সিতার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,ভালোবাসি আমি তোমায় আর সেটা সারাজীবনের জন্য।তোমার অতীত আমাদের বর্তমান জীবনে কোনো প্রভাব ফেলবেনা।এখানে তোমার কোনো দোষই নেই তাহলে তুমি শুধু শুধু কেন কেঁদে কেটে নিজের চোখের পানি ঝরাচ্ছো?মনে রেখো তোমার এই চোখের পানি কোনো একজনের কাছে অমূল্য রত্ন।তাই এই রত্নকে না ঝরিয়ে যত্ন করে রাখো।রুপ্সিতা নিজের দুহাত দিয়ে আলিফের পিঠ আঁকড়ে ধরে প্রশান্তির হাসি দিলো।ও ভুল মানুষকে ভালোবাসেনি।
সিএনজির ড্রাইভার সামনে থেকে বলছে ভাই পার্কে গিয়ে প্রেম করেন এটা প্রেম করার জায়গা না।
আলিফ ড্রাইভারকে বলল,সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালান নয়তো এক্সিডেন্ট হবে।আর আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা না স্বামী-স্ত্রী।ড্রাইভার আর কিছু না বলে গাড়ি চালাতে থাকে।রুপ্সিতা সরে আসতে নিলেই আলিফ আটকে দেয়।

সিএনজি পাঁচ মিনিটের পথ অতিক্রম না করতেই একটা ছেলে সিএনজি থামিয়ে দিয়ে পেছনে উঠতে নিলেই আলিফের চোখে চোখ পড়ে।ছেলেটা আর কিছু না ভেবেই ভোঁ দৌড় দেয় উল্টো দিকে।
এটা সেই ছেলেটা যাকে কিছুদিন আগে রাতে রুপ্সিতার দিকে তাকানোর কারণে আলিফ ঘুষি মেরেছিলো।রুপ্সিতা ভ্যবলার মতো তাকিয়ে থেকে বলল,ছেলেটা এভাবে দৌড় দিলো কেন?
আলিফ শার্টের কলার ঠিক করতে গিয়ে বলল,এরা ছোটখাটো বখাটে পোলাপান।হালকা একটু গুন্ডামী করতে পারলে নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে করে।মনে হয় সেদিনের ঘুষিটা এখনো ভুলতে পারেনি তাই দৌড়ে পালিয়েছে।
ছেলেটা কিছুদূর গিয়ে হাটুতে হাত রেখে হাঁপাচ্ছে।নাকে হাত দিয়ে বলে,সেদিন আমার নাক ফাটিয়েছে নাজানি আজ কি ফাটিয়ে দিতো?আর জীবনে গুন্ডামী করতে যাবোনা।

আজকে শহর তোমার আমার শেষ পর্ব