আজকে শহর তোমার আমার পর্ব ১০+১১+১২

আজকে শহর তোমার আমার পর্ব ১০+১১+১২
জিন্নাত চৌধুরি হাবিবা

মনযোগ সহকারে বইয়ে চোখ বুলিয়ে চলেছে রুপ্সিতা।বিয়ের ঝামেলায় মাঝখানে পড়াশোনায় অনেক গ্যাপ দিয়েছে।এই কয়দিনে পড়া অনেকগুলো গিলে হজম ও হয়ে গেছে।এখন পৃষ্ঠা উল্টালেই সব নতুন লাগে।টপিক দেখলে মনে হয় এটাতো স্যার পড়াইছে এটা পারবো।কিন্তু বিস্তারিত পড়তে গেলে দেখা যায় কিছুই মনে নেই।বিরক্তি আসছে পড়ালেখার উপর।রুপ্সিতার এখন পড়ালেখা বাদ দিতেও ইচ্ছে করেনা আবার পড়ালেখা করতেও ইচ্ছে করে না।কি একটা মহা জ্বালায় আছে।

পাঁচদিন হলো চট্টগ্রাম থেকে ফিরেছে আলিফ আর রুপ্সিতা।এইকটা দিন ও পড়তে বসেনি।আজকে আলিফ হুমকি ধমকি দিয়ে অফিসে গেছে।বলেছে,পড়ালেখা না করলে বইপত্র আনার কি দরকার ছিলো?মা বাবাকে কত কষ্ট করে তোমার পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করিয়েছি তুমি জানো?পড়ালেখায় গাফিলতি করলে বাসা থেকে বের করে এমন জায়গায় দিয়ে আসবো যেখান থেকে ফিরতে পারবেনা আর না কোনো মানুষজন পাবে সাহায্যের জন্য।গভীর জঙ্গলে ফেলে আসবো সেখানে হিংস্র প্রাণীদের সাথে বসবাস করবা।হিংস্র প্রাণীগুলো খুব ভালো তোমাকে কিছুই করবেনা তারা।
আলিফের ধমকে এখন একটু পড়তে বসেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বেশিরভাগ সময় রুপ্সিতা দুপুরে ঘুমায়না।তাই এখন ভাতঘুম দেওয়ার বদলে বই নিয়ে বসেছে।
ইরিন বিকালের দিকে রুপ্সিতার রুমে এসেছে কিছুক্ষণ গল্প করবে বলে।এসে দেখলো রুপ্সিতা পড়ার টেবিলে দাঁত দিয়ে কলমের ক্যাপ কামড়াচ্ছে আর একবার এক বইয়ের দিকে তাকাচ্ছে।তিনচারটা বই একেবারে খুলে রেখেছে।
ইরিন হালকা গলা ঝেড়ে বলল,রুপা পড়তেছো?
রুপ্সিতা মাথা কাত করে পেছন ঘুরে কাঁদো কাঁদো হয়ে ইরিনকে বলে,আর বলো না ভাবি যেটাতে চোখ বুলাই মনে হয় এসব পড়া জীবনেও পড়িনাই।একেকটা সাবজেক্ট কি হার্ড।তারপর বিরবির করে বলল,কেন যে উনাকে বললাম আমি পড়তে চাই।এখন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলাম।

ইরিন হেসে দিয়ে বলে,আমি ছিলাম এক নাম্বারের পড়াচোর।যখন আরিফের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয় তখন কি খুশিটাই না হয়েছিলাম।কিন্তু বাসর রাতে আরিফ বলল,সে আমাকে পড়াতে চায়।কত আকুতি-মিনতি করে কেঁদে কেটে ওকে আটকালাম।পড়ালেখা করবোনা বলে বিয়েতে রাজি হলাম এখন বিয়ের পর নাকি আমি পড়ালেখা করবো।আরিফ এখনো আমাকে পড়াচোর বলে ক্ষেপায়।
ইরিনের কথা শুনে রুপ্সিতা হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে।তখনই রুমে আলিফের প্রবেশ ঘটে।ঘরের দরজায় পা রাখতেই রুপ্সিতার হাসির ঝংকার শুনতে পায়।
বাহ!পড়ালেখা বাদ দিয়ে হাসাহাসি করা হচ্ছে দেখি।তা কতক্ষণ ধরে এসব হচ্ছে?সারাদিনে কিছু পড়েছো?নাকি হাসাহাসি নিয়েই ব্যস্ত ছিলে।

রুপ্সিতা চরম বিরক্ত হলো আলিফের কথায়।তাই মুখ ভঙ্গি না পাল্টে একইরেখে বলল,মানুষ কি সারাদিন পড়ালেখা করে নাকি?একটু নিজের মন আর মস্তিষ্ককে ও রিফ্রেশ করা লাগে।
আলিফ কটাক্ষ করে বলল,তা বিয়ের এতোদিন হওয়ার পরেও তোমার মন মস্তিষ্ক ফ্রেশ হয়নি?
ওদের দুজনের ঝগড়া দেখে ইরিন নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
রুপ্সিতা বলল,এতদিনতো ভালোই ছিলেন তাহলে এখন এরকম পড়া পড়া করে জীবন দিয়ে দিচ্ছেন কেন?
আলিফ শান্ত কন্ঠে বলল,এতদিন তোমাকে আমি সবার সাথে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সময় দিয়েছি।এখন আর সেই সময় নেই।মন দিয়ে পড়ালেখা করো।
আলিফ একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।
রুপ্সিতা সেইদিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে থাকে।

আলিফ সারাদিন অফিস করেছে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা তাই শাওয়ার নিয়ে নিলো।উদম গায়ে ঝর্ণা ছেড়ে দেওয়ালে একহাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।পিঠে পানি পড়তেই ছ্যাত করে জ্বলে উঠলো।ঘাড় বেঁকিয়ে আয়নায় নিজের পিঠ দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু আলিফ ব্যর্থ।কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।আজকে অফিস থেকে ফেরার সময় রিকশার সাথে বাড়ি লেগে পিঠে ব্যথা পায়।তখন ব্যথা পেলেও এতো গুরুত্ব দেয়নি।এখন সেই জায়গাটায় পানি লাগায় ভীষণ জ্বালা করছে।শাওয়ার নিয়ে খালি গায়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে আলিফ।উদ্দেশ্য ব্যথা পাওয়া স্থানে মলম লাগানো হাত দিয়ে যা পারে আন্দাজে লাগিয়ে নেবে।
আলিফকে খালি গায়ে ওয়াশরুম থেকে বেরুতে দেখে রুপ্সিতা চমকে উঠে।উনিতো সব সময় ওয়াশরুম থেকেই টিশার্ট পড়ে বের হয়।তাহলে আজকে কেন খালি গায়ে বের হলো?

রুপ্সিতা কাছে এখন লজ্জা লাগছে আলিফের খালি গায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে তবুও বেহায়া চোখ দুটো ঘুরে ঘুরে আলিফের দিকেই নিবদ্ধ হয়।আড়চোখে বারবার আলিফের দিকে তাকায়।
আলিফ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওয়েনমেন্ট হাতে নিয়ে পিঠে লাগানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই কাটা স্থান ঠাওর করতে পারছেনা।
এতক্ষণে রুপ্সিতার নজর পড়লো আলিফের পিঠে।
চমকে উঠে উদ্ধিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,একি!আপনার পিঠ এরকম বাজেভাবে ছিলে গেছে কিভাবে?
আলিফ কিছু না বলে ওয়েনমেন্ট লাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।রুপ্সিতা পড়ার টেবিল ছেড়ে এসে বলল,আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।
আলিফ বলল,লাগবেনা।আমি নিজেই পারবো তুমি তোমার পড়া পড়ো।
রুপ্সিতা রেগে গিয়ে আলিফের হাত থেকে ওয়েনমেন্ট কেঁড়ে নিয়ে বলল,কতটা পারবেন সেটা আমার দেখা হয়ে গেছে।
মেয়েটা আলিফের সব কিছুতে বাড়াবাড়ি করে হলেও নিজের অধিকার বজায় রাখার চেষ্টা করে।কথাটা ভাবতেই আলিফের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসির রেশ দেখা দিলো।

রুপ্সিতা আঙ্গুলের ডগায় ওয়েনমেন্ট নিয়ে নরম হাত দিয়ে আলিফের পিঠ স্পর্শ করে।আলিফ আবেশে চোখ বুঝে নেয়।কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর যা প্রশান্তির।
রুপ্সিতার নিজেরো কেমন একটা লাগছে।নিজের লজ্জাকে দূরে ঠেলে ওয়েনমেন্ট লাগিয়ে আস্তে হাত সরিয়ে নেয়।রুপ্সিতা হাত সরাতেই আলিফ চট করে চোখ মেলে তাকায়।
আলিফের হঠাৎ মনে হলো ইশ এই মুহূর্তটা এত তাড়াতাড়ি শেষ হলো কেন?মুহুর্তটা এখানে থেমে গেলেই পারতো।পরে আবার নিজেই চমকে ওঠে মনে মনে বলে আমি কেন এসব ভাবছি?তাহলে কি আমি মায়ার স্মৃতি গুলো থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছি?কিন্তু আমিতো এটাই চাই মায়ার স্মৃতিগুলো ভুলে নতুন করে পথ চলতে।
ওয়েনমেন্ট লাগানো শেষ হওয়ার পরেও আলিফকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুপ্সিতা গলা ঝেড়ে বলল,কি ব্যাপার আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

রুপ্সিতার কথায় আলিফ ভাবনায় ইতি টেনে দিয়ে খাটের উপর বসলো।
রুপ্সিতা সরু চোখে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,টিশার্ট পড়ছেন না কেন?
আলিফ ভ্রু নাচিয়ে বলল,তোমার সমস্যা?
রুপ্সিতা বলল,আমার আবার কি সমস্যা হবে।আমিতো এমনিই বলেছি।আপনি টিশার্ট পড়ুন নয়তো সারাজীবন উদম গায়ে থাকেন তাতে আমার কি?
আলিফ দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,আমাকে সারাজীবন উদম গায়ে রাখার প্ল্যান করছো।তোমার কি আমাকে এভাবেই ভালো লাগে নাকি?তাহলে বলো আমি সারাজীবন এভাবেই থাকবো।

রুপ্সিতা নাক মুখ কুচকে বলে,ছিঃ!আমি এটা কখন বললাম?অসভ্য লোক একটা।এরপর বইপত্র ঘুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।আলিফকে এক কাপ কফি দিয়ে অন্যকাপ নিয়ে ছাদে চলে যায়।বিকেলে একা একা ছাদে বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা,কফি খেতে আলাদা একটা আনন্দ আছে।এই সময়টা একান্তই নিজের।প্রত্যেক মানুষেরই আলাদা একটা স্পেস দরকার।তখন শুধু সময়টা নিজের মতো করে কাটাবে।এই একা সময় কাটানোতেও এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করে।এটা শুধুমাত্র তারাই বুঝে যারা একা সময় কাটাতে ভালোবাসে।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে অতিতের কিছু স্মৃতি স্মরণ করে রুপ্সিতা।যখন ফ্রি থাকতো দুবোন মিলে এরকম দুকাপ কফি হাতে নিয়ে কতশত আড্ডায় মেতে উঠতো।এখন আর সেসব সম্ভব না।বিয়ে হলেও ওদের দুবোনের সম্পর্কটা ঠিক থাকলে সবকিছুই সম্ভব ছিলো।

চট্রগ্রাম থেকে ফিরে একদিন রুপ্সিতা আর আলিফ রুপ্সিতার বাবার বাসায় গিয়েছিলো।উনারা অনেকবার করে বলেছেন যাওয়ার জন্য।হয়তো এখন না যেতে বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে রুপ্সিতার শশুর বাড়ির লোকেদের কাছে ছোট হয়ে যাবে।তাই সমাজ রক্ষা করার জন্য ওর বাবা মা যেতে বলেছে এটাই রুপ্সিতার ধারনা।সেদিন বিকালেই আবার দুজনে ফেরত এসেছে পরেরদিন আলিফের অফিস যেতে হবে তাই আর থাকে নি।রুপ্সিতা ও আর জোর করেনি।বরং চলে এসে ভালোই হয়েছে।থেকে গেলে অপবাদ নিয়ে বারবার বাবা মায়ের মুখোমুখি হতে হতো।যেটা রুপ্সিতার জন্য চরম অস্বস্তিকর ব্যাপার।

ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সন্ধ্যা নামলো।চারদিকে মুয়াজ্জিনের মুখে আজানের ধ্বনি মুখরিত হচ্ছে।রুপ্সিতা আর দেরি না করে তড়িঘড়ি করে ছাঁদ থেকে নেমে আসে।এমনিতে এই সময় ছাদে থাকা ঠিকনা নতুন বউদের তো একদমই না।
রুমে এসে ওযু করে আগে মাগরিবের নামায আদায় করে নিলো।আলিফকে মসজিদে পাঠিয়ে দিয়েছে।আলিফ আগে নামাযে গ্যাপ দিলেও এখন রুপ্সিতার সাথে সাথে প্রতি ওয়াক্ত নামায আদায় করে।আলিফ মাঝে মাঝে ভাবে রুপ্সিতা ওর জীবনে এসে অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছে।আগে প্রতিরাতে মায়ার কথা মনে পড়তো।রাত হলে মায়ার ছবি দেখে ঘুমাতে যেতো।এখন সেসবের তেমন একটা প্রয়োজন হয়না।রাতে এখন ঘুম ভাঙলে রুপ্সিতার মায়াভরা মুখটি দেখতে পায়।

আজকে রুপ্সিতা নিজে রান্না করবে।এতদিনে মোটামুটি রান্না নিয়ে একটা ধারনা হয়ে গেছে।বিরিয়ানি রান্না হবে রাতের জন্য।রুপ্সিতা শাশুড়ী আর ইরিনকে বলে দিয়েছে তারা যেন রান্নাঘরে না আসে।আজ সে নিজে নিজেই সব করবে।সব ঠিকঠাক করে এবার পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি।একেতো পেঁয়াজের ঝাঁঝ তার উপর রুপ্সিতার এলার্জি আছে।এলার্জি থাকলে সহজেই চোখে পানি চলে আসে।

আলিফ ডাইনিং এ পানি খেতে এসে রান্নাঘরে উঁকি দিলো।দেখলো রুপ্সিতা কিছু কাটছে আর কাঁদছে।আলিফ রান্নাঘরে গিয়ে রুপ্সিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,তোমাকে কি কেউ রান্না করতে বলেছে?তাহলে কাঁদছো কেন?চলো রান্না করতে হবেনা ভাবি করে নেবে।
রুপ্সিতা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ নাক মুছে বলল,যানতো এখান থেকে।পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে উনি আসছে আমাকে কাঁদার জন্য শান্তনা দিতে।
আলিফ রুপ্সিতার হাত থেকে পেঁয়াজ আর ছুরি টেনে নিয়ে বলল,তুমি দেখো আমি কাটি।
আলিফের হাত কাঁপছে।কোনোদিন রান্না করেনি।করেনি বলতে প্রয়োজন পড়েনি।
রুপ্সিতা বুকে দুহাত গুজে দাঁড়িয়ে আলিফের তামাশা দেখছে।

হঠাৎ আলিফ মা বলে চিৎকার করে উঠে আঙ্গুল ঝাঁকাতে থাকে।আঙ্গুল কেটে বসে আছে।রুপ্সিতা ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে।না পেরে খিলখিল করে হেসে উঠে আলিফের হাত নিয়ে ট্যাপের নিচে ধরলো।পিঞ্চ মেরে বলল,আসছে আমার হিরো পেঁয়াজ কাটতে।আলিফ অসহায়ের মতো রুপ্সিতার দিকে তাকিয়ে আছে।
দুপুরের খাবার খেয়ে উঠতে না উঠতেই রুপ্সিতা ওয়াশরুমে গিয়ে বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছে।ওর অবস্থা দেখে ইরিন পিছু পিছু এসে পেছন থেকে রুপ্সিতার কপাল চেপে ধরে।বমি শেষে ভালো করে কুলি করে চোখেমুখে পানি দিয়ে ক্ষান্ত হয় রুপ্সিতা।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ইরিন তীক্ষ্ণ চোখে রুপ্সিতাকে পরোখ করে চলেছে।যা রুপ্সিতার নজর এড়ায় নি।
রুপ্সিতা ভ্রু কুচকে বলল,কি?

ইরিন ভাবুক হয়ে বলল,বমি বমি ভাব,সেদিন আবার মাথা ঘুরানো।হুম হুম হুম!
রুপ্সিতা ইরিনের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কপাল কুচকে বলল,ভাবি তুমিও না।
সেদিন রোদে কিছুক্ষণ থাকার কারণে মাথা ঘুরে উঠেছে।আর আজ একবার বমি হতে না হতেই তুমি বুঝাতে চাইছো আমি প্রেগন্যান্ট?
শোনো এরকম কিচ্ছু না।
ইরিন এক ভ্রু উঁচু করে বলল,তাহলে কিরকম কিছু?
রুপ্সিতা বলে,আজকে বমি হওয়ার কারন ওই মরিচের ভর্তাটা।মা বাসায় বানাতো শুকনো মরিচ,রসুন,পেঁয়াজ,লবন এই চারটি উপাদান দিয়ে।যদিও ঝাল তবুও আমার খেতে ভাল্লাগে।আজ মন চাইলো তাই বানালাম।ঝালটা একটু বেশিই হয়েছে কি-না তাই বমি হয়েছে।
ইরিন কপাল চাপড়ে বলে,আর আমি ভেবেছি কিনা আমাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসতে চলেছে।তবে যাই হোক খুব তাড়াতাড়ি যেন আমাদের পরিবারে একটা ফুটফুটে বাবু আসে।
ইরিনের কথায় রুপ্সিতা লজ্জা পেয়ে যায়।

রুপ্সিতাকে রেস্ট নিতে বলে ইরিন ডাইনিং এ চলে আসে।বউ শাশুড়ী তিনজনে মিলে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলো।বাড়ির পুরুষরা একজনও বাড়িতে নেই।আলিফ আর আরিফ অফিসে।ওদের বাবাও আজ কোনো একটা কাজে বাড়িতে নেই।
ডাইনিং এ আসতেই আলিফের মা ইরিনকে বলে,রুপা হঠাৎ বমি করছে কেন?
ইরিন খাবারের প্লেট হাতে নিতে নিতে বলল,ওই অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ার কারণে এরকম হয়েছে।
আলিফের মা বলল,আমি ভাবলাম ছোট ছেলের ঘরে নাতিপুতির মুখ দেখতে চলেছি।এরপর দুজনের একজনও কোন কথা বলেনি নিশ্চুপভাবে খাবার শেষ করে উঠেছে।

বিকালে সানিকে নিয়ে বাসার বাইরে গেলো রুপ্সিতা।বাসার সামনের খোলা জায়গায় সানির সাথে বল খেলছে।সানি একবার রুপ্সিতার দিকে বল ছুড়ে মারে আবার রুপ্সিতা সানির দিকে ছুড়ে মারে।
সানির সাথে খেলছে আর রুপ্সিতা ভাবছে এরকম একটা বাবু যদি ওর থাকতো তাহলে রুপ্সিতা রোজ তার বাবুর সাথে খেলা করতো।বিয়ের প্রায় দেড়মাস হতে চললো অথচ আলিফ আর ওর মধ্যে তেমন কিছুই হয়নি।রুপ্সিতা যতটুকু কাছে ঘেঁষেছে ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ।আলিফ কখনো নিজ থেকে রুপ্সিতার কাছে ঘেঁষেনি।আবার রুপ্সিতাকেও কখনো না করেনি।

রুপ্সিতা ভাবনায় পড়ে গেলো আচ্ছা উনার কি আমাকে পছন্দ হয়নি?বিয়ের দেড়মাসেও চেনাজানা হয়নি?একটা মানুষকে কাছ থেকে চিনতে হলে কতদিন সময় লাগে?আমিতো অনেক আগেই উনার মায়ায় নিজেকে আবদ্ধ করে নিয়েছি।ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে।আজ আলিফকে প্রশ্ন করবে আর কতদিন এভাবে থাকবে তারা।

রুপ্সিতা ভাবনায় ব্যস্ত।এদিকে সানি বল গড়িয়ে অনেকদূর চলে যাওয়ায় সেটা আনতে ব্যস্ত।সামনে তাকিয়ে সানিকে না দেখে রুপ্সিতা চিন্তিত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই একটু সামনের দিকে সানিকে দেখলো।তারপর ওকে নিয়ে বাসার ভেতরে চলো এসেছে।
বিকালে অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আলিফ শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিলো।ঘুম থেকে উঠলো সন্ধ্যা সাতটায়।আজকে অফিস থেকে ফেরার পর একবারো রুপ্সিতাকে দেখেনি।মেয়েটাকে দেখার জন্য মনটা কেমন হাসফাস করছে।এতোদিনে রুপ্সিতার সাথে অনেকটা জড়িয়ে গেছে।বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো রুপ্সিতা একমনে আকাশ দেখে চলেছে।আলিফ পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।রুপ্সিতার কোনো ভাবাবেগ হলোনা।একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলো।আলিফ তীক্ষ্ণ চোখে রুপ্সিতাকে পর্যবেক্ষণ করে হালকা গলা ঝেড়ে বলল,মন খারাপ?

রুপ্সিতা আরো কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে আলিফের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো।অতঃপর দৃঢ় কন্ঠে আলিফকে জিজ্ঞেস করলো,আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়নি?আমি দেখতে খারাপ?
আলিফ অবাক হয়ে বলল,হঠাৎ এসব প্রশ্ন কেন করছো?
রুপ্সিতা জিব দিয়ে হালকা ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,হঠাৎ নয় এই প্রশ্ন আরো আগে থেকেই আমার মাথায় ঘুরছে।শুধু আপনাকে জিজ্ঞেস করার মতো সুযোগ পাইনি।
আলিফ বলল,তোমাকে আমার অপছন্দ নয় আর না তুমি দেখতে খারাপ।তাহলে এসব প্রশ্ন কেন উঠছে?
রুপ্সিতা পাল্টা প্রশ্ন করে বলে,তাহলে আমাদের মাঝে এই দূরত্বটা কিসের?বিয়ের দেড়মাস হয়ে যাওয়ার পরেও আমার মনে হচ্ছে আমরা ভাইবোনের মতো জীবনযাপন করছি স্বামী-স্ত্রী হিসেবে নয়।
এবার আলিফ দমে গেলো।চোখ নামিয়ে নিয়ে সেটা ফ্লোরে নিবদ্ধ করলো।
রুপ্সিতা আবারো বলল,কি হলো আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন?

আলিফ এখনো কিছু বলছেনা।যতবারই রুপ্সিতাকে ছুতে চায় ততবার মায়ার কথা মনে পড়ে।কিন্তু মায়াতো এখন দিব্যি আছে।তাহলে মায়ার কথা ভেবে এই মেয়েটাকে কেন কষ্ট দিবে?
আলিফের নিরবতায় রুপ্সিতার চোখ পানিতে টইটম্বুর।ও বুঝে গেছে আলিফের মনে ও কখনো নিজের জায়গা করতে পারবেনা।
আলিফের ভাবনার মাঝে রুপ্সিতা নিজের কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,আপনাকে আর উত্তর দিতে হবেনা।আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেছি।আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে চলে যাবো আপনার জীবন থেকে।পেছন ঘুরে চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই হাতে টান পড়ে রুপ্সিতার।রুপ্সিতা থমকে যায়।
আলিফ রুপ্সিতার হাত পেছন থেকে টেনে রুপ্সিতাকে নিজের সামনে নিয়ে কপালে নিজের ঠোঁটের উষ্ণ ছোয়া দিয়ে বলে কোথাও যাবে না তুমি।সারাজীবন আমার সাথেই তোমাকে থাকতে হবে।
এরপর রুপ্সিতার হাত ছেড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করে।

রুপ্সিতা এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে।মুহূর্তেই কি হয়ে গেলো।আলিফ ওকে ভালোবেসে ছুয়ে দিয়েছে?নাকি রুপ্সিতার কথায় বাধ্য হয়ে ছুয়েছে।সে যাই হোক এটা আলিফের নিজ থেকে দেওয়া প্রথম স্পর্শ।এর আগেও হাত ধরেছে কিন্তু সেটাতে কোনো অনুভূতি জড়ানো ছিলো না।রুপ্সিতার হাতটা কপালে চলে যায় যেখানে আলিফ ঠোঁটের স্পর্শ দিয়েছিলো।ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখাটা ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে থাকলো।লজ্জায় আর রুমে যাওয়ার সাহস পেলোনা।অথচ কিছুক্ষণ আগে এই মেয়েটাই আলিফকে এতগুলো কথা শুনালো কেন ওদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক না।

রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছে।রুপ্সিতা নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছে সামনে তাকাচ্ছেনা।তাকালেই বুঝতে পারতো আলিফ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
আলিফ ভাবছে সামান্য কপালে চুমু দিয়েছি বলে লজ্জায় মাথা তুলছে না।অথচ এই মেয়েটা নাকি আমার কাছে আর দশটা কাপলের মধ্যে যেরকম সম্পর্ক সেরকমটা দাবি করে।

আলিফের আগে খাওয়া শেষ করে রুপ্সিতা রুমে গিয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে।আলিফ আস্তে ধীরে খাওয়া শেষ করে রুমে এসে দেখে রুপ্সিতা আজকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছে।এতদিন নিজেকে কাঁথা দিয়ে পেঁচিয়ে রাখলেও মুড়ি দিতোনা আজকে একেবারে সম্পূর্ণ নিজেকে ঢেকে ফেলেছে।আলিফ ওয়াশরুম থেকে এসে রুপ্সিতার পাশে শুয়ে পড়েছে।রুপ্সিতার দিকে তাকিয়ে শুয়ে রুপ্সিতাকে দেখে চলেছে যদিও রুপ্সিতার একটা চুলও দেখা যাচ্ছে না।
হুট করে আলিফ রুপ্সিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।আচমকা এরকম হওয়াতে রুপ্সিতা হকচকিয়ে যায়।কাঁথার ভেতর থেকেই মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দেয়।আলিফ ছাড়ছেনা কিন্তু রুপ্সিতার ছটফটানি বেড়েই চলেছে।এবার আলিফ এক ঝটকায় রুপ্সিতার গা থেকে কাঁথা সরিয়ে নিজেও সেই কাঁথার নিচে ঢুকে পড়ে পূনরায় রুপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুজে দেয়।

রুপ্সিতার শরীরে হিম ধরে গেছে।আলিফের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে গলায় শুড়শুড়ি লাগছে।একটু পরেই মনে হয় কাঁপুনি ধরে যাবে শরীরে।
রুপ্সিতা মুখ দিয়ে আওয়াজ করছেনা কিন্তু নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আলিফকে সরানোর চেষ্টা করছে।আলিফ ফিসফিস করে রুপ্সিতার কানের কাছে গিয়ে বলল,বেশি ছটফট করোনা।আমি চাইনা আজকে এর চেয়ে বেশি কিছু হয়ে যাক।
আলিফের কথা শুনে রুপ্সিতার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে শ্বাস উঠানামা করছে।
আলিফ আবারো ফিসফিস করে বলল,নিজেকে স্বাভাবিক করো তা নাহলে এখানে বেশি কিছু হয়ে যাবে।
রুপ্সিতা একেবারে শান্ত হয়ে গেছে।চোখমুখ খিঁচে মনে মনে বলছে
ব্যাটা বজ্জাত!এতোদিন প্রেমের প খুজে পাইনি আজ সব প্রেম একসাথে উতলাইয়া পড়তেছে।প্রেমের চাপে একদিনেই আমাকে মেরে ফেলবে।

রাত সাড়ে বারোটা কি একটা রিতার জানা নেই।হয়তো ঘড়ি দেখলে বলতে পারবে।ঘুম ভেঙে বরাবরের মতো আজো শোভনকে পাশে পেলোনা।খাটে হেলান দিয়ে বসে রইলো শোভনের জন্য।
অনেক্ষণ অপেক্ষার পর শোভন চুপিচুপি রুমে ঢুকলো।লাইট অন করতেই চমকে উঠলো।রিতা শোভনের দিকে তাকিয়ে আছে।
শোভন আমতা আমতা করে বলল,তুমি ঘুমাও নি?
রিতা লম্বা শ্বাস টেনে শান্ত স্বরে বলল,ঘুমিয়েছি।কিন্তু জেগে দেখি তুমি নেই।কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
শোভন এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করে বলল,কাজ ছিলো তাই ফিরতে দেরি হয়েছে।
রিতা আবারো শান্ত স্বরে বলল,কোন অফিসে রাত একটা পর্যন্ত কাজ থাকে?সেটা আবার একদিন নয় প্রতিদিন।
শোভন চমকে উঠে বলল,কি বলতে চাইছো তুমি?প্রতিদিন মানে?আমিতো আজ…..

হাতের ইশারায় শোভনকে থামিয়ে দিয়ে রিতা বলল,আর বলতে হবেনা তোমায়।তুমি কখন বাসায় ফিরো না ফিরো সেটা আমি জানি।এখন থেকে নয় আরো অনেক আগে থেকেই তোমাকে আমি ফলো করেছি।কখনো রাত করে বাড়িতে ফিরো কখনো তাড়াতাড়ি ফিরে মাঝরাতে উঠে চলে যাও।
এবার আর শোভনের সহ্য হলোনা।রেগে গিয়ে বলল,আমি কখন কি করবো না করবো তার কৈফিয়ত তোমাকে দেবোনা।বউ বউয়ের মতো থাকো।রিতাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লো শোভন।রিতার চোখে পানি টলমল করছে।শোভন পাল্টে যাচ্ছে দিনদিন।বিয়ের প্রথম প্রথম ওদের সম্পর্ক একরকম ছিলো এখন অন্যরকম।দুদিন আগে রিতা নিজের প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছে।রেজাল্ট পজেটিভ।এই খুশির খবরটা শুনানোর জন্য শোভনকে কাছে পায়নি।তিনমাসের প্রেগন্যান্ট রিতা।পেটে হাত দিয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে অথচ শোভনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেনা।মানুষটাকে বড্ড ভালোবাসে কি-না।

রুপ্সিতা নখে মেহেদী দিচ্ছে বসে বসে।ওর শাশুড়ী পাশের বাসা থেকে মেহেদী পাতা এনেছে চুলে দেওয়ার জন্য।রুপ্সিতা সেখান থেকে কিছু মেহেদী পাতা আলাদা নখে দেওয়ার জন্য বেটে নিয়েছে।এখন সেগুলোই সূক্ষ ভাবে নখে লাগাচ্ছে যেন নখের কিনারায় না লেগে যায়।
আলিফ ওয়াশরুম থেকে এসে রুপ্সিতার গা ঘেঁষে বসে পড়েছে।হাত নড়ে মেহেদী সব এবড়োথেবড়ো হয়ে নখের চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে।রুপ্সিতা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আলিফের দিকে।আলিফ ক্যাবলার মতো বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে থাকে।রুপ্সিতা রেগে গিয়ে সব মেহেদী আলিফের টি-শার্টে মুছে দেয়।আলিফ অসহায়ের মতো তাকিয়ে থেকে বলে এটা কি করলে?আমার এতসুন্দর টি-শার্ট টা নষ্ট করে দিলে?

রুপ্সিতা দাঁত কিড়মিড় করে বলে আপনি যে আমার নখের চারিপাশ নষ্ট করে দিয়েছেন?তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে আসে।নখ গুলো কেমন লাল লাল হয়ে আছে সুন্দর করে কালার আসেনি।নখগুলোর দিকে তাকিয়ে রুপ্সিতার এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে।মন চায় আলিফকে বারান্দা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিই।
এরমাঝে আলিফ ও টিশার্ট চেঞ্জ করে নিয়েছে।রুপ্সিতা মেহেদীর বাটি নিয়ে আবার মেহেদী লাগাতে বসে পড়ে।আলিফ এগিয়ে আসতে নিলেই বলে,খবরদার এদিকে আসবেন না।প্রথমবারে টিশার্টে লাগিয়েছি এবার কিন্তু মুখে লাগিয়ে দেবো।নিজেকে নিজেই চিনতে
পারবেন না।আলিফ আর এক পাও বাড়ায়নি খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

নখের মেহেদী উঠিয়ে রুমে আসতেই রুপ্সিতার ফোন বেজে উঠে।হাতে নিয়ে দেখে তিন্নির নাম্বার থেকে কল এসেছে।রিসিভ করতেই তিন্নি জানালো কাল নাকি ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে।মিস দিলে সমস্যা কাল যেভাবেই হোক যেন ভার্সিটিতে যায়।
রুপ্সিতা কল কেটে ধীরে ধীরে আলিফের দিকে এগোয়।আলিফ চোখের উপর ডান হাত দিয়ে শুয়ে আছে।রুপ্সিতা আলিফের কাছে গিয়ে মিহি কন্ঠে ডাক দেয়,শুনছেন?আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন?

আলিফ চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে বলল,নাহ!কি হয়েছে কিছু বলবে?
রুপ্সিতা মুখটা পানশে করে বলল,কালকে ভার্সিটিতে ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে।যেতেই হবে।
আলিফ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,হুম তো যাও!আমি তো তোমাকে পড়ালেখা করতে না করিনি।
রুপ্সিতা হাত মুচড়া মুচড়ি করি বলল,আসলে মাকে কিভাবে বলব আমি কাল ভার্সিটিতে যাবো?মা যেতে দিবে তো?যদি না করে দেয়?
আলিফ শান্তনা দিয়ে বলল,মাকে আমি ম্যানেজ করবো।তুমি এখন শুয়ে পড়ো।
রুপ্সিতা খুশি হয়ে ওপাশ ঘুরে খাটে উঠতে গিয়ে পায়ে বাড়ি খেয়ে ব্যথা পেয়ে “আহ”করে উঠে।
আলিফ শোয়া থেকে উঠে রুপ্সিতার পা টেনে বলে,সব সময় তোমার লাফালাফি না করলে হয়না।এখন ব্যথা কে পেলো আমি?নাকি তুমি?স্টুপিড কোথাকার।

রুপ্সিতা কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
সকালে নাস্তা করে আলিফ অফিসে চলে যায়।ওর মাকে রুপ্সিতার ভার্সিটিতে যাওয়ার কথা বলে মেনেজ করে নেয়।যাওয়ার সময় বলে গেছে আজ ফিরতে সন্ধ্যা হতে পারে।নাস্তা শেষে রুপ্সিতা আর ইরিন সব কিছু ঘুছিয়ে নেয়।রেডি হয়ে ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে পড়ে রুপ্সিতা।ক্লাস শেষে তিন্নির সাথে অনেক্ষণ আড্ডা দেয়।বেষ্টু বলে কথা আবার অনেকদিন পর দেখা।আড্ডা না দিলে কি চলে?
তিন্নি বলে,তোর বিয়ের এতদিন হলো অথচ দুলাভাইকে এখনো দেখলামনা।
রুপ্সিতা বলল,তোকে না ছবি পাঠালাম?

তিন্নি বলল,আরে আমি ছবির কথা বলিনি বাস্তবে দেখার কথা বলেছি।
রুপ্সিতা বলল,তাহলে একদিন তোকে আর উনাকে মিট করিয়ে দেবো।যেদিন উনার অফিস থাকবেনা।
তিন্নির সাথে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রুপ্সিতা বাসায় চলে আসে।
গোসল করে পড়ার জন্য জামা নিতে গিয়ে দেখে কাবার্ড এলোমেলো হয়ে আছে।রুপ্সিতা ভাবলো গোসল পরে করা যাবে আগে কাবার্ড গুছিয়ে নিই।জামাকাপড় সব গুছিয়ে এক কোনায় রুপ্সিতা একটি চাবি পায়।হাতে নিয়ে ভাবে এটা কিসের চাবি হতে পারে?

পরোক্ষনে নজর পড়ে ভেতরে একটা ছোট ড্রয়ার আছে।রুপ্সিতা চাবি দিয়ে ঘুরাতেই ড্রয়ার খুলে গেলো।সেখানে কিছু ছবি আর একটা ডায়েরি ছিলো।ছবিগুলো ডায়েরির ভিতরে না বাইরেই একপাশে ছিলো।রুপ্সিতা ছবিগুলো হাতে নিয়ে দেখলো সবগুলোই একটা মেয়ের ছবি।নিঃসন্দেহে বলা চলে মেয়েটা সুন্দরী।কিন্তু এই মেয়ের ছবি আলিফের ড্রয়ারে কি করছে ভাবতেই একটা অজানা আতঙ্ক এসে রুপ্সিতার মনে গ্রাস করে।সেই আতঙ্কের তোড়ে রুপ্সিতা বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ডায়েরিটা খুলে ফেলে।ডায়েরির মলাটে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা”আলিফ আহসান”।কারো পারমিশন ছাড়া তার পার্সোনাল জিনিসে হাত দেওয়া ব্যাড ম্যানার্স জেনেও রুপ্সিতা ডায়েরিটা খুলে ফেলে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ভেতরে পৃষ্ঠা গুলো ফাঁকা আর ঝকঝকে।যেন কেউ একটা নতুন ডায়েরি এখানে এনে রেখে গেছে।রুপ্সিতার ডায়েরিটা রেখে দিতে গিয়েও কি মনে করে ডায়েরিটা আবার ভালো করে দেখলো।
মাঝখানের দুই তিনটা পৃষ্ঠায় কিছু লিখা আছে।রুপ্সিতা দেরি না করে পড়া শুরু করে।

“প্রেয়সী”
আমি কখনো ডায়েরি লিখিনি।বলতে গেলে এসব লেখালেখি আমার ভালো লাগেনা।কিন্তু আজ লিখছি তোমার জন্য লিখছি আমার ভালোবাসার মানুষের জন্য লিখছি।তুমি কি জানো?তোমার নামের মতো তোমার চোখে মুখেও অঢ়েল মায়া উপছে পড়ে।আমি প্রথম তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করেছি।আর সেটি হলো মায়া।পরে জানতে পারলাম তোমার নামটাই মায়া।তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি সেটা বর্ণনা করার সাধ্য আমার নাই।

এতটুকু পড়েই রুপ্সিতা ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলে।চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে।ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে।চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।আলিফ অন্যকাউকে ভালোবাসে কথাটা ভাবতেই রুপ্সিতার গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।ও বিশ্বাস করতে পারছেনা আলিফের জীবনে অন্যকেউ আছে।এজন্যই বুঝি আলিফ ওর কাছে ঘেঁষতো না।কিন্তু এ কদিন যাবত এসব কি ছিলো?কেন রুপ্সিতাকে বারবার ছুয়ে দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে।আলিফ ওকে বলে দিলেই পারতো সে অন্যকাউকে ভালোবাসে।তাহলেতো রুপ্সিতা নিজের অনুভূতি গুলোকে চাপা দিয়ে রাখতো।কখনো আলিফের কাছে নিজের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতো না।আলিফ কেন করলো এমন?
রুপ্সিতা দুহাতে মুখ চেপে কাঁদছে যেন আওয়াজ বের না হয়।

দরজা আটকিয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ট্যাপ ছেড়ে নিচে বসে পড়ে।চিৎকার করে কাঁদছে রুপ্সিতা।
কেন?কেন আমার সাথেই এরকম হয়?আমি যাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তারাই আমাকে ছেড়ে দূরে চলে যায়।আমি মানুষটাই খারাপ যে কারণে কেউ আমাকে ভালোবাসেনা।
উপর দিয়ে পানি পড়ছে আর রুপ্সিতা নিচে গুটিসুটি মেরে বসে কাঁদছে।চোখমুখ ফুলে গেছে।চোখ দুটো ফুলে লাল টকটকে রক্ত জবার রং ধারন করেছে।যেন ঠোকা দিলেই রক্ত পড়বে।ঘন্টাখানেক ওভাবে থাকার পর আস্তে আস্তে উঠে ভেজা কাপড়ে রুমে এসে একটা জামা নিয়ে পড়ে নেয়।

কেমন রোবটের মতো হয়ে গেছে রুপ্সিতা।চুপচাপ কাবার্ড গুছিয়ে ডায়েরি আর ছবিগুলো জায়গা মতো রেখে দিয়েছে।
বাইরে থেকে ওর শাশুড়ী ডাকছে খাবার খাওয়ার জন্য।রুপ্সিতা মাথা ব্যথা বলে কাটিয়ে দিয়েছে।বলেছে পরে খেয়ে নেবে।এই মুহুর্তে খাবার গলা দিয়ে নামবেনা।তাছাড়া এখন চোখমুখ দেখলে সবাই নানা রকম প্রশ্ন করবে।রুপ্সিতা এই মুহুর্তে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছে না।বিছানার সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আবারো কান্না শুরু করে দেয় রুপ্সিতা।ওর একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে আলিফ অন্যকাউকে ভালোবাসে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো।রুপ্সিতা ওভাবেই বসে রইলো।এখন আর চিৎকার করে কান্না আসেনা।নিরবে চোখ দুটো দিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।

ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে রুপ্সিতা।ওর কি চেহারা খারাপ?নাকি ভাগ্যটাই খারাপ।কি করলে আলিফ মায়াকে নয় ওকে ভালোবাসবে।নিজের এই শরীরটাকে পাল্টে মায়ার মতো হয়ে গেলে মনে হয় আলিফ ওকে ভালোবাসবে।নিজেকে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে।চোখেমুখে আবারো পানি দিতে গিয়ে দেখে বেসিনের ট্যাপ থেকে পানি বের হচ্ছেনা।গোসলেরটা ছেড়ে দিয়ে চোখেমুখে পানি দেয়।এদিকে পানির ছিটায় অনেকটা ভিজে গেছে সেই খেয়াল রুপ্সিতার নেই।

শরীরটা কেমন অসাড় হয়ে আসছে।পানিতে অনেক্ষণ ভিজা তার উপর সকালর পর থেকে না খাওয়া,কান্নায় মাথা ব্যথা সব মিলিয়ে রুপ্সিতা নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারলোনা।চোখ দুটো ঝিমিয়ে আসছে।ধপ করে নিচে পড়ে গেলো রুপ্সিতা।ট্যাপের পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে রুপ্সিতার সমস্ত শরীর।
সন্ধ্যার আগেই আলিফ বাসায় ফেরে কাজ শেষ করে।রুমের সামনে এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে কিন্তু দরজা ভেতর থেকে লক করা।আলিফ রুপ্সি বলে অনেকবার ডেকেছেও কিন্তু কোনো সাড়া পায়নি।ইরিনের রুমে গিয়ে বলল,ভাবি রুপ্সি কোথায়?আর রুমের দরজা দেখি ভেতর থেকে বন্ধ।

আজকে শহর তোমার আমার পর্ব ৭+৮+৯

ইরিন বলল,ওর মাথা ব্যথা।দুপুরে না খেয়েই শুয়ে পড়েছে।তুমি ডাকো উঠে যাবে।
আলিফ কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল,ওতো আর এরকম দরজা নক করেনি।আর আমি অনেকবার ডেকেছি কিন্তু সাড়া দিচ্ছেনা।
ইরিন বলল,হয়তো শুনতে পায়নি।চলো আমি সহ যাচ্ছি।এরপর দুজন মিলে রুপ্সিতাকে অনেক ডাকাডাকি করলো কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না।ওদের ডাকাডাকিতে আলিফের বাবা মা দুজনই বেরিয়ে এলেন।
আলিফের মা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই ইরিন সব খুলে বলে।চিন্তিত হয়ে উনিও কয়েকবার ডাকেন।এরপর আলিফের বাবা বলল,এতো ডাকার পরও শুনলোনা।আশ্চর্যের ব্যাপার!মেয়েটা ঠিক আছেতো?
উনার কথায় আলিফের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে।সামনে থেকে সবাইকে সরিয়ে কয়েকবার দরজায় লাথি দেয় উদ্দেশ্য দরজা ভাঙা।কিন্তু একার শক্তিতে পেরে উঠছেনা।এমন সময় আরিফ ও বাসায় আসে।সবাইকে একজায়গায় দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?আলিফ বলল,সেসব পরে শুনবে আগে দরজাটা ভাঙো।

এরপর দুই ভাই মিলে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে।রুম খালি ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে দরজাটাও খোলা।আলিফ সেদিকে দৌঁড়ে গিয়ে রুপ্সিতাকে ওয়াশরুমে পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে।সারা শরীর ভিজে চুপেচুপে হয়ে আছে।কাছে গিয়ে হাত স্পর্শ করতেই আরেক দফা চমকে যায়।হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গেছে।আলিফ ট্যাপ অফ করে রুপ্সিতাকে কোলে তুলে নেয়।ভেজা কাপড়েই খাটে শুইয়ে দেয়।ইরিনকে ওর ড্রেস চেঞ্জ করতে বলে সবাই বেরিয়ে যায়।ড্রেস পাল্টে ইরিন সবাইকে ডাক দেয়।আরিফ ডাক্তারকে কল করে দিয়েছে।সবাই রুপ্সিতাকে নিয়ে চিন্তিত।আলিফ ওর পায়ের কাছে বসে পা দুটো অনবরত ঘষে চলেছে।ইরিন হাত ঘষছে।

আজকে শহর তোমার আমার পর্ব ১৩+১৪+১৫