আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব ৬

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব ৬
নুসাইবা জান্নাত আরহা

অবশেষে ডি*ভোর্সি, এই অ*ভিশপ্ত তকমাটা লেগেই গেল আমার গায়ে। রেস্টুরেন্টে যেদিন গিয়েছিলাম তার ঠিক পরের দিনই ডি*ভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছিল রাশফিন। সত্যিই রাশফিন কথা দিয়ে কথা রাখতে জানে। আমিও মা বাবার কাছ থেকে পরামর্শ নিই সাইন করবো কি করবো না। তাদের উত্তরটা হ্যাঁ ই ছিল।

কয়েক মাসের ব্যবধানেই সব শেষ। বিয়েটা তো কোনো ছেলে খেলা নয়। মেয়েদের জীবনে বিয়েটা একবারই আসে, এটা কি জানতো না রাশফিন। আর আমিও ভেতরে ভেতরে ক্ষ*ত বিক্ষ*ত হয়ে ভে*ঙে চুর*মার হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
সেদিনের পর থেকে আর বের হয়নি নিজের রুম থেকে। নিজেকে গৃহবন্দী করে রেখেছি।মা রোজ এসে চেচায় কিছু খাবার জন্য। কিন্তু আমার গলা দিয়ে যে আর কিছুই নামবে না। তাও জোর করে আম্মু খাইয়ে দিয়েছিল কয়েক লোকমা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেলকনিতে বসে তাকিয়ে থাকি ঐ দূর অন্তরীক্ষের পানে। নিজের জীবনের হিসেব মিলানোর বৃথা চেষ্টা করি। রাশফিন কিভাবে পারল আমায় এতো বা*জে কথা বলতে সেদিন।কিভাবে পারল রেস্টুরেন্টে ওতোগুলো মানুষের সামনে অ*পমান করতে। আমি বুঝতে পারিনা, আমার উপর কেন এতো ক্ষী*প্ত রাশফিন। কি এমন করেছিলাম। আমাদের বিয়ের দিন তো সবই ঠিক ছিল, তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে আমার সাথে এমন আচরণ করতে শুরু করল।

সেদিনের পর থেকে আহনাফের সাথেও আর কোনো যোগাযোগ করিনি আমি। ইচ্ছাও নেই কোনো।
মানুষ এতোটা নি*চ হয় কিভাবে, রাশফিন ভালো করেই জানতো আহনাফ আমার বেস্টফ্রেণ্ড, তাহলে ওর সাথে আমাকে জড়িয়ে এভাবে না বললেও পারত। তার উপর আমাকে ডি*ভোর্স দিয়ে ঐদিনই ফারিহাকে বিয়ে করে ফেলল। ইভেন ফারিহা আমাকে ওদের কিছু ছবি পাঠিয়েছে, যাতে ফারিহা হাসি মুখে বিয়ের বেনারসি পরে বসে আছে, তারপর আমাকে ফারিহা ফোন করেও বলে দিয়েছে ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ওদের বিয়েটা কি সত্যিই হয়েছে? আচ্ছা রাশফিন কি আদৌ মন থেকে করেছে বিয়েটা?

পরক্ষণেই ভাবলাম আমার আর জেনে কি লাভ, সব তো শেষ-ই। এসব ভেবে আমি ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে কান্নাই ভেঙে পড়ি। কোনো দোষ না করেও কেন এমন শা*স্তি পাচ্ছি আমি। কি সুন্দর করে পরিকল্পিত ভাবে একটা ইস্যু ক্রিয়েট করে আমার জীবনটাকে একেবারে ত*ছন*ছ করে দিল। একটুও কি বুক কাপল না রাশফিনের। কেন এমন করল আমার সাথে।

বেলকনিতে বসে সি*গারেট খাচ্ছে রাশফিন। কালকের রা*গটা এখনও মেটেনি ওর। রা*গ আর জে*দের বসেই অরনিশাকে সেদিন ওতো গুলো কথা শুনিয়েছিল। রা*গের মাথায় কি বলেছে, কি না করেছে তা ওর মাথায় নেই এখন। আর ফারিহাও তখন আ*গুনে ঘি ঢালার মতোই উ*ষ্কে দিয়েছিল রাশফিনকে যার কারণেই সাত পাচ না ভেবে অরনিশার সাথে ওমন আচরণ করে।

এখন নিজের ভেতরেই কেমন যেনো অ*পরাধবোধ কাজ করছে। ফাকা ফাকা লাগছে সব। নিজেকে বড্ড একা মনে হচ্ছে রাশফিনের। গত এক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে নেই অরনিশা। প্রতিটা মুহূর্তে ভীষণ ভাবে মিস করছে। ও যদি এমন না করত তাহলে কখনোই হয়তো খা*রাপ আচরণ করত না অরনিশার সাথে রাশফিন। এখন নিজের উপরেই রা*গ হচ্ছে রাশফিনের, কেন এমন বা*জে আচরণ করতে গেল অরনিশার সাথে।

সি*গারেট খেতে খেতেই জ্ব*লন্ত সি*গারেটের আ*গুনটা নিজ হাতেই চেপে ধরে রাশফিন। হঠাৎ পেছন থেকে এসে কেউ একজন জড়িয়ে ধরে রাশফিনকে। রাশফিনের হাত থেকে পড়ে যায় সি*গারেটটা। ও ভাবে অরনিশা হয়তো জড়িয়ে ধরেছে ওকে। কিন্তু পেছন ফিরতেই ফারিহাকে দেখে মাথা গ*রম হয়ে যায় রাশফিনের। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাটকাট গলায় বলল

-‘ তুই কাজিন, কাজিনের মতোই থাকবি। এর চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার চেষ্টাও করবি না। সেদিন আমার কোলে বসার কারণে তোকে কি শা*স্তি দিয়েছিলাম যদি মনে থাকে তাহলে আর আমার কাছে ঘেষার চেষ্টাও করবি। আর যদি মনে না থাকে তাহলে আবার যেন তোকে ফেলে দেওয়া না লাগে। আগের বার তো কোমরে ব্যথা পেয়েছিলি এবার যেন হাড় ভাঙা না লাগে। মাইন্ড ইট।
ফারিহা ন্যা*কা কান্না জুড়ে দিল।

-‘ তুমি আমার সাথে এমন কেন করছো? ঐ থার্ড ক্লাস মেয়েটার জন্য এমন করতে…
-‘ শোন, তুই অরনিশাকে সেদিন অ*পমান করেছিলি, আমি কিছু বলিনি বলে এই না যে কিছু বলবো না। সেদিন তো ওকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য কারো সাথে দেখলে ঠিক কেমন লাগে। তাই আমি কোনো প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যাবে তা ভাবতেও পারিনি আমি।

ফারিহার গা জ্ব*লে যায় এসব শুনে। অরনিশার নাম টা শুনলেই গা জ্বলে ফারিহার। আবার শুরু করল রাশফিন। তাই ওকে যে করে হোক থামাতে হবে এখন।
হঠাৎ রাশফিনের হাতের কিছু পু*ড়ে যাওয়া অংশে নজর পড়তেই ফারিহা উত্তেজিত কণ্ঠে দ্রুত বলে উঠল
-‘ এটা কি করেছো কি রাশফিন ? এই সামন্য থার্ড ক্লাস, চরিত্র*হীন মেয়েটার জন্য তুমি এমন করছো? কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো শুধু শুধু?

রাশফিন ফিরে তাকায় ফারিহার দিকে। রাশফিনের ক*ষ্টটা যেন দ্বিগুন বেড়ে যায়।মলিন হেসে বলল
-‘ বল তো কেন হলো আমার সাথে এমন? অরনিশা কেন করল আমার সাথে এমন? আমি যে অরনিশাকে কত্তো ভালোবাসি, এটা কি ও জানেনা? ও আমায় ঠ*কিয়েছে। কিন্তু কেন করল এমন?
রা*গটা কোনোমতে দমিয়ে দাতে দাত পিষে ফারিহা বলল

-‘ এখন ভালোবাসেও কোনো লাভ নেই রাশফিন। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। তুমি এখন মুক্ত। আমি এখন তোমার সব। অরনিশা কেউ নয় তোমার।
বলার সাথে সাথে ফারিহা কিছু একটা পুষ করে রাশফিনের শরীরে। ফলে মৃদু চি*ৎকার করে উঠল রাশফিন। কিছুটা, কেমন একটা ঘোরের মাঝে থাকার পর রাশফিন বলে উঠল

-‘ হ্যাঁ, আমি তো এখন মুক্ত। ওর মতো চরিত্র*হীনের ছায়া আমার জীবন থেকে চলে গেছে। তাহলে আমি কেন এতো কষ্ট পাচ্ছি শুধু শুধু। লাইফ ইস্ ফুল ওফ ইন্জয়এবেল।
ফারিহার মুখে ফুটে উঠল মুচকি হাসি। এটাই তো চাচ্ছিল ফারিহা। এতোদিনের শখ পূরণ হতে চলেছে। খুশি হয়ে ফারিহা জরিয়ে ধরতে গেলো রাশফিনকে, ততক্ষণে ও জ্ঞান হারিয়ে ফারিহার উপর ঢলে পড়ল রাশফিন।

জানালার গ্রিলের ধারে রকিং চেয়ারে বসে আছে আহনাফ। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে আছে, অরনিশার ফোনের আশায়, কিন্তু না অরনিশা ওকে একবারের জন্য ফোন দেয়নি। তবে কি আবারও হারিয়ে ফেলল অরনিশাকে। মেয়েটাকে যে ছোটবেলা থেকেই বড্ড বেশি ভালোবাসত সে। তবে সাহস করে আর বলাটা হয়ে উঠেনি। ফোনের গ্যালারীতে গিয়ে একটা হাস্যজ্জ্বল মেয়ের ছবি বের করল আহনাফ। মেয়েটা আর কেউ নয়, এটা অরনিশা। আহনাফের সেই পুরনো স্মৃতি গুলো মনে পড়তে লাগল। ওর এখনো মনে আছে একদিন মজার ছলে আহনাফ অরনিশাকে বলেছিল

-‘ অরনিশা, তোকে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি রে।
অরনিশা সেদিন মজার ছলে উড়িয়ে দিয়েছিল ব্যাপারটা। বেস্টফ্রেণ্ড তো এমন বলতেই পারে। তেমন একটা পাত্তাও অরনিশা দিয়েছিল না সেদিন। তবে মজার ছলে সেদিন আহনাফ বললেও কথাটা সত্যিই ছিল। সাহস করে বলেই ফেলেছিল নিজের মনের কথাটা।

তবে অরনিশা তা বুঝতে পারেনি। আহনাফ সেদিন চোখ দিয়ে অনেক কিছুই বোঝাতে চেয়েছিল। কিন্তু লাভ হয়নি কোনো। সেদিনই আহনাফ বুঝে গিয়েছিল যদি সত্যিটা অরনিশা জানতে পারে তাহলে হয়তো আর কোনোদিনও আরহনাফের সাথে কথা বলবে না। তাই ও আর সাহস করে কখনোই বলেনি। আর কখনো এই দুস্সাহস করেনি। তাইতো ভালোবাসাকে ভুলতে অরনিশা থেকে অনেক দূরে চলে যায় আহনাফ।

এতো কিছু ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আহনাফের। ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল
-‘ ভালোবাসার মানুষটা যখন কষ্ট পায়, তাকে যে ভালোবাসে সে-ও ভীষণ কষ্ট পায়। কারণ সে কখনোই চায় না, তার ভালোবাসার মানুষটা কষ্ট পাক। আমি যে তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি, অরনিশা। কিন্তু তুমি বুঝলেও না, আর বুঝবেই বা কি করে আমি তো তোমাকে কখনোই বুঝতে দিইনি আর দিবোও না। তুমি তো এখন অন্যের বউ। তোমাকে পাওয়ার আশা করাটাও যে নিষিদ্ধ আমার কাছে। খুব ভালো থেকে প্রিয়। আহনাফ গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে।

” দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহডোরে বাধিব।”
মুচকি হেসে নিজেকেই আবার সান্ত্বনা দিল।

-‘ সবার কপালে সবকিছু থাকেও না। আমি না হয় দূর হতেই ভালোবেসে যাব তোমায়। কিছু কথা না হয় না বলাই থাক। থাক না, কিছু কিছু ভালোবাসাটা একপাক্ষিক ই হোক। আমার ভালোবাসাটা আড়ালেই থাকুক না হয়। #আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়, প্রেয়সী। সারাজীবন না হয় তোমায় আড়ালেই ভালোবেসে যাব আমি, সমস্যা কি তাতে।
হঠাৎ ফোনের রিং টোনে চমকে তাকালো আহনাফ। ফোনটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই মুখে ফুটে উঠল তার রহস্য ময় হাসি।

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব ৫

পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলি,
পাঠক সমাজ বর্তমানে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল চায় নায়ক রাশফিন হোক, আরেকদল চায় আহনাফ হোক। কোন দিকে যাব আমি? আমি নিজেই তো কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। আস্তে আস্তে রহস্য গুলা ক্লিয়ার করি। তারপর দেখা যাক কে হয় নায়ক? আর হ্যাঁ এই ডি*ভোর্স ওয়ার্ডটা দেখে চেচামেচি করবেন না কারণ আমি তো ঠিকমতো ক্লিয়ারই করিনি, আদৌ ওদের মধ্যে ভি*ভোর্স হয়েছে কি হয়নি।
পরিশেষে সবার সুন্দর মন্তব্য দেখতে চাই। আপনাদের রেসপন্স আমার গল্প লেখার অনুপ্রেরণা।
হ্যাপি রিডিং~

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব ৭+৮