আমার আছে জল গল্পের লিঙ্ক || মাহিমা রেহমান

আমার আছে জল পর্ব ১
মাহিমা রেহমান

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে নিজ হাতে প্রাণপ্রিয় স্বামী ও নিজ ছোটবোনের বাসর সজ্জিত করছে শিথি।হুমায়রা শিথি ওয়াইফ অফ তাহসিন আহম্মেদ। তবে ক্ষণকাল বাদ সে মিসেস.তাহসিন খেতাব’টি হারিয়ে ফেলবে।কিছুক্ষন বাদ সে হয়ে যাবে,তাহসিনের প্রাক্তন স্ত্রী।চিত্তপটে ধাও ধাও করে অগ্নি বর্ষণ হলেও ওষ্ঠ কার্নিশে রয়েছে মুগ্ধকর হাসি।সে হাসি যেকোনো ব্যক্তি দর্শন করলে ভাববে,,মেয়েটা হয়তো স্বামীর বিয়েতে ভীষন খুশী।

যেচে গিয়ে নিজ ছোট বোনকে সতীন করে নিয়ে আসছে।তবে করো বোঝার সাধ্য নেই এই মেয়েটির অন্তঃকরণে ঠিক কতটুকু বেদনার গিরি সৃষ্টি হয়েছে। সম্পূর্ণ কক্ষ একা হাতে সাজিয়েছে শিথি।অকস্মাৎ নেত্র কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে চিবুক ছুঁলো। ত্বরিত আলগোছে মুছে নিল সেই অশ্রু কণা।এক-এক করে পুরো রুম জুড়ে ক্যান্ডেল জ্বালানো শেষ হতেই রুম ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিল শিথি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিছু একটা স্মরণ হতেই পুনরায় রুমে ফিরে এসে চারদিক একবার চোখ বুলিয়ে নিল।অধর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এক তাচ্ছিল্যের হাসি।ওষ্ঠের কোণে সেই হাসি ঝুলিয়ে রেখে বাইরের দিকে পা বাড়ায় শিথি।ডাইনিংয়ে সামনে চলে গেল বরণ ডালা সাজাতে।আলতো হাতে হাসি মুখে ললিত রূপে সাজিয়ে তুলল বরণ ডালা।ঠিক সেভাবেই সাজালো যেমনটা ভেবেছিল ছোটবোনের বর বরণের সময় সাজাবে।

আজ শিথি গাঢ় লাল রঙের শাড়ি পরে প্রগাঢ় ভাবে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে।এতটাই নমনীয় ও নিখুঁত ভাবে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে,,আজ আহসান যেন নতুন বউ রেখে তার দিক দৃষ্টিপাত করতে বাধ্য হয়।তাহসিন সর্বদা শিথিকে শাড়িতে দেখতে পছন্দ করত।তাই সেও সর্বদা ভালোবাসায় মানুষের পছন্দকে প্রাধান্য দিত।তাই আজ পুনরায় তাহসিনের চিত্তে অগ্নি বর্ষণের জন্য সে নিজেকে শাড়িতে জড়িয়েছে।

তাহসিনকে বুঝতে হবে সে ঠিক কি হারাচ্ছে??কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কিঞ্চিৎ হাসল শিথি। সহসা চিৎকার চেঁচামেচি মুখরিত হলো চারপাশ।সকলের কণ্ঠে একটাই ধ্বনি,
-” বউ এসেছে! নতুন বউ এসেছে!”
শিথি সজ্জিত ডালাটা হাতে তুলে নিল বরণ করবার উদ্দেশ্যে।আকস্মাৎ তার শাশুড়ি আকলিমা বেগম ত্বরান্বিত শিথির হাত পাকড়াও করে আড়ালে নিয়ে এলেন।নির্জীব কণ্ঠে বলে উঠলেন,

-“তুমি এসব করছো’টা কি বউ? তোমার কি এসব করতে বিন্দুমাত্র হাত কাঁপছে না?নিজ হাতে নিজের স্বামীর বিয়ের সকল কাজ কি করে করতে পারছো তুমি?তোমার বুক কি একটুও কাঁপছে না? এতো কঠোর কেনো তুমি শিথি?”
শিথি আলগোছে শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরল।শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
-“মা আপনি অযথাই চিন্তা করছেন!তাছাড়া আমার মোটেই কোনো কষ্ট হচ্ছে না।কারণ আমি তাহসিনকে ভালোবাসি।আর আমার ভালোবাসার মানুষ আমার কাছে এই প্রথম কিছু চেয়েছে’ আমি কি না করতে পারি বলুন মা?”

আকলিমা বেগম শিথির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,
-“আমার ছেলে খাঁটি হীরা রেখে, কাঁচকে হীরা ভেবে নিজের জীবনে নিয়ে আসছে? সময় গেলেই বোঝা যাবে,,কে কাঁচ আর কে আসল হীরা?”
কথাগুলো বলে আকলিমা বেগম আকস্মাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন।শিথি আলগোছে শাশুড়ি মায়ের চোখের জলটুকু মুছে দিয়ে বলে উঠে,

-“আহঃ! মা কাঁদছেন কেনো? আজকে বাড়িতে বিয়ে।বিয়ের দিন কেউ কাঁদে?”
আকলিমা বেগমকে নিজ মায়ের চোখে দেখে শিথি।তাহসিন তাকে কিছু দিতে না পারলেও একটা মা দিয়েছে।যা তার কোনো কালেই ছিল না।কারণ সে যে জন্মের পরে বুঝ হওয়ার পর থেকে এটাই জেনে এসেছে’ সে এতিম।আর এই এতিম মেয়েটা শেষে মায়ের সুখ পেয়েছিল।কিন্তু ভাগ্যে বুঝি তার এই সুখ লিখা ছিল না। তাই পেয়ে ও পুনরায় হারাতে হলো।
ঘন ঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ করল শিথি।পা বাড়াল সদর দরজায় দিকে।

নিজ হাতে স্বামী আর ছোটবোনকে বরণ করা শুরু করল।শুরু হলো বরণের পালা।প্রতিটি নিয়ম-কানুন সহিত বরণ করা হলো নতুন দাম্পত্যিকে।বরণের পুরোটা সময় তাহসিন নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল শিথির পানে।আজ সত্যি যেন তার রূপে অগ্নি জ্বলছে। তাহসিনের দৃষ্টি খেয়াল করে অন্তঃকরণে স্মিত হাসল শিথি।বরণ সমাপ্তিতে নতুন বধূকে রেখে তাহসান ভেতরে প্রবেশ করতে নিলে বাধা দেয় শিথি। ত্বরান্বিত বলে উঠে,
-“কোথায় যাচ্ছো তুমি?নতুন বউকে একা রেখে?”

হকচকিয়ে গেল তাহসান। প্রশ্নাত্বক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।শিথি পুনরায় বলে উঠল,
-“বারে! নতুন বউকে কোলে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হয় ভুলে গেলে? আমাদের বিয়ের সময় কিন্তু তুমি আমাকে কোলে তুলে ভিতিরে নিয়ে এসেছিলে।
শিথির ওষ্ঠকোণে মিষ্টি হাসি।নির্নিমেষ সেদিক তাকিয়ে বক্ষঃস্থলে আকস্মিক চিন চিন ব্যথা অনুভব করল তাহসিন।নির্নিমেষ স্ত্রীর পানে তাকিয়ে নিজ চিত্তকে প্রশ্ন করে উঠল,

-“সে কি ভুল করল কিছু?”
পুনরায় শিথি তাড়া দিতেই তাহসিন রিমিকে কোলে তুলে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল।রিমিকে নামিয়ে দিয়ে তাহসিন গেল শিথির পিছন পিছন সেদিক তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে লাগল রিমি।রান্না ঘরে এসে মেহমানদের জন্য রাতের খাবারে আয়োজন করতে লাগল শিথি। কাজের মহিলারা হাতে হাত মিলিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছে।তখনই আগমন ঘটে তাহসিনের।তাহসিনকে দেখে বেরিয়ে যায় কাজের মহিলারা।তাহসিন শিথির অতি সন্নিকট এসে শিথির স্কন্ধ স্পর্শ করে।ত্বরিত পিছু ঘুরে দু’কদম পিছিয়ে যায় সে।শিথির দিকে তাকিয়ে তাহসিন বলে উঠে,

-“ধন্যবাদ শিথি সেদিন আমাকে বোঝার জন্য। দেখো হয়তো তোমার আমার মধ্যে একসময় প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল।ভালোবেসেই বিয়ে করিছিলাম আমরা।কিন্তু পরে আমি বুঝতে পারি আসলে আমি তোমাকে কখনো ভালোই বাসিনি।তুমি শুধু আমার মোহ ছিলে।সত্যি অর্থে আমি যেদিন প্রথম রিমিকে দেখি সেদিন আমার কিছু একটা হয়েছিল যা তোমাকে দেখার পরে হয়নি।হয়তো তুমি অনেক সুন্দরী।এমন কি রিমির চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী।কিন্তু বিশ্বাস করো! রিমির কাছে গেলে আমি যেই প্রশান্তিটা পাই। তা আমি তোমার কাছে কখনো পেতাম না।হয়তো শুনতে তোমার খারাপ লাগছে।কিন্তু এটাই সত্য।তুমি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না।”

শিথি ওষ্ঠ কোণে অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি ফুটিয়ে তুলল।যেদিক মোহিনীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তাহসিন।শিথি তাহসানের উদ্দ্যেশ্য বলে উঠল,
-“ইটস ওকে তাহসিন।আমি কিছু মনে করিনি।
কথাটা শেষ করে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল শিথি।কিয়ৎ কাল ব্যয় হওয়ার পর যখন দেখল তাহসিন এখনো রান্নাঘরে ত্যাগ করেনি।তখন শিথি তাহসানের মুখপানে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠল,

-“আর কিছু বলবে?”
তাহসান কিছুটা অস্বস্থি নিয়ে বলে উঠল,
-“ইয়ে মানে! তুমি ডিভোর্স…”
তাহসিন কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে শিথি বলে উঠল,
-“ডোন্ট ওয়ারি।আমি অনেক আগেই ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছি।”
কথাটা কর্ণগোচর হতেই তাহসিন পুকলিত চিত্তে রান্নাঘর ত্যাগ করল।

রিমিকে তাহসিনের রুমে নিয়ে এলো শিথি।নিচে থাকাকালীন যখন সকলে রিমিকে উপরে পাঠাতে চেয়েছিল কাউকে দিয়ে। তখন সে নাকচ করে বলে উঠে,
-“আমি কেবল শিথি আপুর সাথেই উপরে যাবো।”
যার দরুণ বাধ্য হয়ে শিথিকেই নিয়ে আসতে হলো রিমিকে তাহসানের রুমে।শিথি রিমিকে ফুলে সজ্জিত বিছানায় সুন্দর করে বসিয়ে দিয়ে যেই প্রস্থান করতে যাবে সহসা শুনতে পায় রিমির বলা কিছু কথা,

-“শিথি তোর অনুভূতি কেমন?এইযে আমি তোর ভালোবাসায় মানুষটাকে নিজের করে নিলাম।তোর বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে?কান্না পাচ্ছে? কান্না এলে কাঁদ।আমিতো কেবল তোর চোখের পানি দেখার জন্য এতো কিছু করলাম।”
অদ্ভুতভাবে হাসল শিথি।যেই হাসিতে মিশে ছিল কেবল বিদ্রুপ আর বিদ্রুপ।গা টা জ্বলে উঠল রিমির।শিথি রিমির শিয়রে এসে বসে পড়ল। আলগোছে রিমির চোয়াল দুটো হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলে উঠল,

-“তোর তো আবার আমার এঁটো খাবার আমার ব্যবহার করা সবকিছুতেই বরাবর নজর থাকত।আমার এঁটো করা সকল জিনিসই তুই পুনরায় ব্যবহার করতি আমার থেকে কেড়ে নিয়ে।এমন কি এতো বছর সংসার করা আমার এঁটো-ব্যবহৃত করা স্বামীটাকে ও তুই নিয়ে নিলি।তাই তোর এই নোংরা স্বভাব সম্পর্কে আমি আগেই অবগত ছিলাম।তাই এতে অবাক হওয়ার বা/ভাবার কিছুই নেই।আর রইল কষ্টের কথা! কষ্ট কেনো হবে? কাঁদতে কেনো যাবো?কারণ আমি যার জন্য কাঁদবো সেতো কখনো আমার ছিলই না।

আর যা আমার ছিল না তা হারানোর যন্ত্রনায় আমি কেনো অযথা কেঁদে নিজের চোখকে কষ্ট দিব।বরং কাঁদার দিনতো তোর এসেছে।একবার মাথা খাটিয়ে দেখ।যেই ছেলে আমাকে পাওয়ার জন্য এতো পাগলামি করেছিল।এতো বছরের প্রণয়-সংসার সব কিছু ভুলে তোর মত মেয়েকে বিয়ে করেছে।সেখানে তোর চেয়ে ভালো-সুন্দরী মেয়ে পেয়ে গেলে তোকে ছাড়তেও তাহসিন বেশি সময় নিবে না।তাই আমাকে নিয়ে না ভেবে আগে নিজের চরকায় তেল দে। বলতো যায়না তোর বর আবার কোথায় কোন মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে তোকে লাথি মেরে তার জীবন থেকে সরিয়ে দেয়।এতদিনে নিশ্চয়ই তোর তাহসিনের চরিত্র সম্পর্কে জানা হয়ে গেছে।”

কথাগুলো বলে শিথি কক্ষের বাহিরে বেরিয়ে এলো।তখনই কোনো পুরুষালি দেহের সাথে তার ধাক্কা খেল।নিজেকে সামলে সম্মুখে দৃষ্টিপাত করলেই তাহসিনের মুখটা দৃষ্টিতে এসে ধরা দিল।তাহসিন শিথির দিকেই তাকিয়ে।নয়ন জোড়া পতিত করে শিথি তাহসিনকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

আমার আছে জল পর্ব ২