আমার আছে জল পর্ব ২

আমার আছে জল পর্ব ২
মাহিমা রেহমান

নিজ কক্ষে এসে ব্যাগ গোছাতে আরম্ভ করল শিথি।ব্যাগে বেশ কিছু কাপড় নিল।যেগুলো তার বাবা তাকে এই-ওই অকেশনে গিফট করেছিল। তাহসিনের দেওয়া কোনো কিছুই সে নিল না। শিথি সখের বশে কিছু টাকা জমিয়েছিল।যেগুলো তার বাবা তাকে দিত।সেই জমিয়ে রাখা টাকা কটা ব্যাগে ভরে নিল।তার সহিত নিল তার দেনমোহরের টাকাগুলো,,যেগুলো তাহসিন তাকে বিয়ের রাতেই পরিশোধ করেছিল।

ব্যাগ গোছানো শেষে বাহিরে বের হলো শাশুড়ি মাকে ঔষধ খাওয়ার উদ্দেশ্যে।প্রেশারটা আকলিমা বেগমের আজকাল খুব বেড়েছে।খুব বেশি অহেতুক চিন্তা করে কিনা।শাশুড়ি মায়ের রুমে গিয়ে শিথি দেখতে পেল আকলিমা বেগম মোনাজাত’রত অবস্থায় কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।শাশুড়ি মায়ের এহেন ক্রন্দন দেখে ভিতরটা হু হু করে উঠল শিথির।অধর জোড়া চেপে কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল সে।নির্জীব পায়ে প্রবেশ করল রুমের ভিতর।মোনাজাত শেষ হওয়ার আশায় বসে রইল ক্ষণকাল।আকলিমা বেগমের মোনাজাত পরিসমাপ্তি ঘটতেই তার শিয়রে গিয়ে বসল শিথি। আকলিমা বেগম শিথির মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“আমার ছেলের করা এই ভুলের জন্য দেখবি একদিন সে ঠিক প্রস্তাবে।”
শিথি শাশুড়ি মায়ের দুই হাত আলগোছে পাকড়াও করে বলে উঠল,
-“এসব রাখুন মা।আগে বলুন রাতের ঔষধ খেয়েছেন?”
আকলিমা বেগম মাথা নেড়ে ‘না’ জানালেন।অতঃপর শিথি নিজ হাতে তাকে ঔষধ সেবন করিয়ে নিজ রুমের জন্য প্রস্থান করে।আর আসায় আগে শাশুড়ি মাকে বলে আসে যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়।বেশি রাত না জাগে।

রাত এখন প্রায় দুইটা বেজে পনেরো মিনিট।পাশের রুম থেকেই ভেসে আসছে নব-দাম্পত্যির কিছু সুখকর ধ্বনি।যা তার কর্ণকুহরে পৌঁছনোর সাথে সাথে অন্তঃকরণ পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।আর নেওয়া যাচ্ছে না এসব।তাই বাধ্য হয়েই রুম ত্যাগ করল সে।গিয়ে ড্রইংরুমে বসে রইল।শিথি যেদিন তাহসিন আর রিমির সম্পর্ক সম্পর্কে অবগত হয়।তার পরেরদিনই সে অন্যরুমে শিফট হয়।
তার আর ঘুম হবে না হয়তো!বক্ষপটে এতো যন্ত্রণা হচ্ছে যা প্রকাশ করবার নয়।তাই সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে রয়।আকস্মাৎ চোখ জোড়া লাগে যায়।

আকলিমা বেগম নামাজ পড়ে রুম থেকে বের হলেন একটু বাগানে হাঁটার উদ্দেশ্যে।সহসা উনার চোখ যায় ড্রইংরুমের সোফায় মাথা এলিয়া রাখা শিথির দিকে। আঁতকে উঠে সত্বর পায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে। ব্যগ্র কণ্ঠে ডাকতে লাগে।অল্প অল্প চোখ মেলে তাকায় শিথি।নিজের সমীপে শাশুড়ি মাকে দেখে মৃদু হাসে।আকলিমা বেগম স্বস্থির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে দ্রুত জিজ্ঞেস করে উঠে,

-“তুমি এখানে কি করছিলে বৌমা?রুমে বিছানা রেখে তুমি কেনো এখানে শুয়ে রইলে?”
শিথি স্মিথ হেসে শাশুড়ি মাকে জবাব দিল,
-“আপনি বুঝি হাঁটতে যাচ্ছিলেন? দাঁড়ান মা আমি নানাজ পড়েই আসছি।আজ দুজন একসাথে হাঁটব কিছুক্ষন।বলা যায়না,,আর কনোদিন আমরা একসাথে চলতে পারি কিনা?”

রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করে আকলিমা বেগম মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। শিথির নামজ আদায় শেষ হলে দুজন বের হয় প্রাতঃভ্রমণে।আগে প্রায় সময়ই শিথি শাশুড়ির সহিত হাঁটতে বের হতো।তবে আজকেই হয়তো তার আকলিমা বেগমের সাথে শেষ প্রাতঃভ্রমণে যাওয়া।যেদিন তার সহিত শিথি থাকে সেদিন আর বাগানে না হেঁটে অনেকটা দূর যাওয়া হয় আকলিমা বেগমের।আর যাওয়া হবে না কোনোদিন।কথাগুলো ভেবে এক নিগূঢ় শ্বাস ত্যাগ করে শিথি।

হাঁটা শেষে দুজনে ফিরে আসে তারা।আজকে আর বেশি দূরে যায়নি।শিথি নিজের রুমে এসে গুজগাছ করতে ব্যস্ত হয়ে হয়ে।কিয়ৎ কাল বাদই তার বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে ৭.০০ টায় বাস।শিথি রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়। চোখদুটো ঈষৎ বাঁকিয়ে পাশ্ববর্তী কক্ষের দিক তাকায়। ত্বরান্বিত নয়ন ঘুরিয়ে নিয়ে শাশুড়ির রুমের অগ্রসর হয়।গিয়ে দেখে আকলিমা বেগম ললাটে কর রেখে শুয়ে আছে।শিথি শাশুড়ি মাকে ডাক দেয়।আকলিমা বেগম আঁখি পল্লব মেলে নির্নিমেষ তাকায় শিথির পানে।কিঞ্চিৎ হেসে প্রশ্ন করে উঠে,

-“চলে যাচ্ছিস?তাই বিদেয় নিতে এসেছিস?”
মাথা পতিত হয় শিথির।আকলিমা বেগম শিথির অভিমুখে এসে দাঁড়িয়ে পুনরায় বলে উঠে,
-” কোথায় যাচ্ছিস? কীভাবে যাচ্ছিস? কিছুই জিজ্ঞেস করব না।আর না বলব বাড়ির গাড়ি দিয়ে যা।কারণ আমার ছেলেকে তোর মর্ম বুঝতে হবে।আর শোন (মাথায় হাত বুলিয়ে)যেখানেই থাকিস! এই মাকে ভুলে যাসনা কোনোদিন। এই মা কিন্তু সত্যি অর্থে তোকে নিজের মেয়ে হিসেবে মানে।তুই আমার মেয়ে!তাই যখনই কোনো প্রয়োজন হবে এই মাকে একটা কল করবি শুধু।”

ডুকরে উঠে আকলিমা বেগমেকে জাপটে ধরে শিথি। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে উঠে,
-“আমি আপনাকে মোটেও ছেড়ে যেতে চাইছি না মা!
যার হাত আকড়ে এই বাড়িতে কদম রেখেছি,,সেই আমার নেই।তাই এবাড়িতে থেকে আমারো কোনো কাজ নেই। আমাকে যে যেতেই হবে।ভালো থাকবেন মা, আসি।”

কথাটা বলে শিথি বেরিয়ে গেল।সে দুর্বল হয়ে পড়ছে! কিন্তু তাকে দুর্বল হলে যে চলবে না।নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।
এছাড়া অনেকটা দেরিও হয়ে যাচ্ছে তাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে নিলেই সহসা প্রশস্ত পৌরুষ বক্ষের সহিত ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ে যেতেই কেউ শিথির কটিদেশ চেপে ধরে তাকে পতিত হওয়া থেকে বাঁচিয়ে নেয়।শিথি আঁখি ঊর্ধ্বমুখী করে সম্মুখে অবস্থিত ব্যক্তির চেহারা দর্শন করে। তাহসিনকে দেখে ত্বরিত বেগে ধাক্কা মেরে নিজ হতে দূরে সরিয়ে দেয়।কিছুটা আহত নয়নে শিথির পানে তাকায় তাহসিন।নিজেকে ধাতস্থ করে ব্যগ্রকণ্ঠে শিথিকে জিজ্ঞেস করে উঠে,

-“এই সকাল বেলা কোথাও যাচ্ছো?খুব তাড়া মনে হচ্ছে।”
শিথি মাথা নেড়ে সায় জানাল।তাহসিন পুণরায় জিজ্ঞেস করে উঠে,
-“কিন্তু কোথায়?”
এবার শিথির কিছুটা রাগ হলো।সম্পর্ক থাকাকালীন তাহসিন সবসময় তাকে নজরে নজরে রাখতো।এখন সম্পর্ক শেষের দিকে এসেও তার জেরা করা শেষ হলো না।তাই কিঞ্চিৎ রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠে শিথি,
-“যেখানেই যাই তোমার সমস্যা কি? পথ ছাড়ো!”

ঈষৎ ললাট কুঁচকে গেল তাহসিনের।অকপট কণ্ঠে পুনরায় বলে উঠল,
-“এতো রেগে যাচ্ছো কেনো?আর কোথায় যাচ্ছো বললেই হয়।”
শিথি রাগান্বিত স্বরে বলল,
-“তোমাকে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই।এবার নিজের মুখটা নিয়ে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।”
আকস্মাৎ তাহসিন খেয়াল করল শিথির হাতে ট্রলি ব্যাগ।চমকে উঠল তাহসিন।শঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠল,
-“কোথায় যাচ্ছো তুমি শিথি? এহেন ব্যাগ-প্যাক নিয়ে?তাও আমাকে না জানিয়ে?”
শিথি দৃঢ়কন্ঠে বলে উঠল,

-“তুমি কি ভুলে গেছো?কাল আমাদের ডিভোর্স হয়েছে।আর তুমি কাল নতুন বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছো! আই থিঙ্ক তুমি বোধয় সব ভুলে গেছো।যাক এখন সব মনে পড়লে সামনে থেকে সরে দাঁড়াও।আর তোমার কাবার্ডের ড্রয়ারে ডিভোর্স পেপারটি রাখা আছে।সাইন করে নিও।”
তাহসিন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠে,
-“তুমি চাইলে এবাড়িতে থাকতে পারো শিথি।”
এবার রাগে একপ্রকার ফেঁটে পড়ল শিথি।জুতা মেরে আবার গরু দান করা হচ্ছে তাকে?শক্ত কণ্ঠে কেবল একটি শব্দ’ই উচ্চারণ করল,
-“না।”

দ্রুত পায়ে সদর দ্বার পেরিয়ে বেরিয়ে পড়ল মেইন গেটের উদ্দেশ্যে।হয়তো আর কোনোদিন এই বাড়িতে পা রাখা হবে না তার।আজই শেষদিন তার এখানে।দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সামনের দিকে এগোতে লাগল সে।
শিথির যাওয়ার পানে নির্জীব দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল তাহসিন।তখনই তার কাঁধে হাত রাখে আকলিমা বেগম।মাকে দেখে কিছু বলতে নেয় সত্বর আকলিমা বেগম ছেলের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
-“নারীর অন্তঃকরণে একবার যে পুরুষের জন্য বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়! সর্বকালেও তার রেশ নিষ্পত্তি হয় না।তুই বড়ই দুর্ভাগা!নিজের দুঃখ নিজেই টেনে আনলি।”

বাস ছাড়তে আর কিছুক্ষন।এরপরই তার চেনা শহর চিরকালের জন্য অচেনা রূপে ধরা দিবে তার কাছে।আর কখনোই চেনা মানুষগুলোর দেখা মিলবে না। সিটের কার্নিশে মাথা এলিয়ে দিল শিথি।আর ভাবতে লাগল নিজের অতীত সম্পর্কে।
____অতীত____

ছোট্ট শিথির যখন সবে তিনবছরের বাচ্চা তখন তাকে আগ্রাবাদের এক এতিমখানা থেকে দত্তক নিয়ে যায় ইকবাল সাহেব।কারণ তাদের তেরো বছরের সংসার জীবনে কোনো সন্তান ছিল না।তাই তিনি প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখপানে তাকিয়ে একটা বাচ্চা দত্তক নিয়ে আসে।প্রথমে শিথিকে পেয়ে তানিয়া বেগম বেশ খুশি ছিলেন।

আমার আছে জল পর্ব ১

শিথিকে নিয়ে আসার একবছর পরই পৃথিবীতে আগমন ঘটে রিমির।তারপর থেকে তানিয়া বেগম কেমন বদলে যায়।
[পরবর্তী পর্বতে সম্পূর্ণ অতীত বর্ণনা করা হবে]

আমার আছে জল পর্ব ৩