আমার আছে জল পর্ব ১৪

আমার আছে জল পর্ব ১৪
মাহিমা রেহমান

আয়নার সমীপে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল শিথি।পরনে তার লাল জামদানি। শাড়ির সাথে মিল রেখে সে আজ নিজেকে সাজিয়েছে।ওষ্ঠে পড়েছে টকটকে লাল রঙ্গা লিপিস্টিক। হাতে মুঠো ভর্তি লাল রঙের কাঁচের চুড়ি।চুলগুলো স্ট্রেট করে,দুইদিকে বিছিয়ে রেখেছে।কানে পড়েছে বিশাল আকারের টানা ঝুমকো।ব্যাস এতটুকুতেই যেন তাকে এক নতুনত্ব দান করেছে।সে নিজেকে তৈরি করেছে শানের বার্থডে পার্টিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।সে মোটেও যেত না।কিন্তু রিধি বেগম আর অমির জোরাজোরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই যেতে হচ্ছে।দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করল শিথি।

নিজেকে পর্যবেক্ষণ করা শেষ হলে পারস ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরল।রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকল রিকশার আশায়।প্রায় পনেরো মিনিট পর হয়ে যাওয়ার পরও যখন কোনো রিকশা মিলল না,,তখন সামনের দিকে কয়েক কদম হেঁটে একদম মেইন রোডে এসে দাঁড়াল শিথি। রিকশা ডাকতে নিবে সহসা তার সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল।ভ্রু কুঁচকে গেল শিথির।আকস্মিক গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে বেরিয়ে এলো তাহসিন।চকিতে তাহসিনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শিথি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শিথির দিকে একদৃষ্টে গভীর নয়নে তাকিয়ে আছে তাহসিন। তাহসিনের এহেন চাহনি দেখে বিরক্ত হল শিথি।কপাল কুঁচকে তাকাল তাহসিনের চোখের দিকে।তাহসিনের চোখে আজ একরাশ মুগ্ধতা দেখতে পাচ্ছে শিথি।হঠাৎ শিথি ও আটকে গেল সেই মুগ্ধতার ভিড়ে।নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকল সেই গভীর দুটি চোখে। হঠাৎ চৈতন্য ফিরতেই নিজেকে ধাতস্থ করে সামলে নিল শিথি।মুখ ঘুরিয়ে তাকায় অন্যথায়।

এবার শিথি বেশ বিরক্ত হল।সেই তখন থেকে কেমন হ্যাংলার মত তাকিয়ে আছে।কেমন লাগে?বেশ অসস্তি হচ্ছে শিথির।আর সইতে না পেরে এবার কিছুটা ধমকের স্বরে তাহসিনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-“কি সমস্যা?তখন থেকে এহেন খাম্বার মত চোখের সামনে দাড়িয়ে,,হ্যাংলার মতো তাকিয়ে আছো কেনো?মেয়ে মানুষ কি জীবনে চোখে দেখো নি? সরো বলছি আমার সামনে থেকে নিজেই মুখটা নিয়ে সরে দাঁড়াও বলছি।
হুশ ফিরল তাহসিনের।শিথির বলা প্রতিটি কটু কথা তাহসিনের কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছালো।কিন্তু সেসব পাত্তা না দিয়ে তাহসিন বলে উঠল,

-“অনেকদিন পর তোমাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখছি তো,,তাই নিজেকে সামলাতে পারিনি।তুমি তো জানোই তোমাকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখলেই আমি বেসামাল হয়ে পড়ি।”
তাহসানের এহেন ন্যাকা টাইপ কথায় আরো বেশি বিরক্ত হলো শিথি। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল,
-“সরো বলছি আমার সামনে থেকে।দেরি হচ্ছে আমার।”
কথাটা কর্ণপাত হতেই সহসা তাহসিন জিজ্ঞেস করে উঠল,
-“এই সন্ধ্যাবেলা একা একটা মেয়ে হয়ে কোথায় যাচ্ছো তুমি?তাও আবার এতো সেজেগুজে,,কোথায় যাচ্ছো?কাকে দেখাতে?”

রেগে গেল শিথি। তিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
-“তোমার মত নিম্ন প্রকৃতির মানুষকে তা বলতে বাধ্য নই।আমার পথ ছাড়ো বলছি।”
রাগান্বিত স্বরে তাহসিন বলে উঠল,
-“বলতে তুমি বাধ্য।”
তাচ্ছিল্য হাসলো শিথি।থমথমে কণ্ঠে বলে উঠল,

-“সেই বাধ্যবাধকতা থেকে তুমি নিজে আমাকে মুক্তি দিয়েছো তাহসিন।অতীত এতো সহজে ভুললে চলে?”
ব্যথিত নয়নে শিথির দিকে তাকাল তাহসিন।অসহায় কণ্ঠে বলে উঠল,
-“ঠিক আছে ভুললাম না অতীত।এই অতীত আমাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।আচ্ছা চল, তুমি যেখানেই যাচ্ছো আমি তোমাকে সেখানেই ড্রপ করে দেই।”
-“কোনো দরকার নেই।”
কথাটুকু বলেই শিথি একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসল।

শানের বাড়ির সম্মুখে রিকশা থামতেই নেমে,, ভিতরে প্রবেশ করল শিথি। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে চারিপাশ।বাগানের সম্মুখে বিশাল আয়োজন করা হয়েছে।সেখানেই চলছে পার্টি।নানা গান বাজনা আর শোরগোলের শব্দে বিরক্ত হয়ে ভিতরে প্রবেশ করল শিথি।আকস্মাৎ শিথির দিকে একপ্রকার দৌড়ে এলো রিধি বেগম।চোখের কার্নিশ থেকে কাজল নিয়ে শিথির কানের পিছন নজর টিকা দিয়ে দিল।চপলা কণ্ঠে বলে উঠল,
-“তোমাকে কিন্তু বেশ লাগছে বৌমা! ধ্যাত শিথি মা।কি সুন্দর লাগছে।একদম নতুন বউ বউ!”
কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল শিথি।এগিয়ে গেল অমির কাছে।সে আপাদত কাজে ব্যস্ত।অমি শিথিকে শানের সহিত বসিয়ে দিয়ে ছুটল রান্না ঘরে। শিথির জন্য কিছু হালকা খাবার আনতে।”

সন্ধ্যা সাতটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।বাগানে অহরহ রমণীদের ঝাঁক।মূলত এটা বার্থডে পার্টি কম সুন্দরীদের মিলন মেলা বললেও ভুল হবে না।যদিও সকল কারসাজি রিধি বেগমের।বার্থডে পার্টি উসীলা মাত্র,,তিনি তো তার একমাত্র পুত্র আরিয়ান নুসাইব চৌধুরীর পাত্রী খোঁজার জন্য এহেন সুন্দরীদের হাট বসিয়েছে।ছেলের হাত ধরে তিনি এক এক করে মেয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে নুসাইবকে।তবে দুঃখের বিষয় তার ছেলের কোনো মেয়েকেই পছন্দ হচ্ছে না।

আকস্মাৎ শিথিকে দৃষ্টির সম্মুখে দেখে চোখদুটো চকচক করে উঠল রিধি বেগমের।সত্বর নুসাইবকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন সামনের দিকে।মায়ের এহেন পাগলামিতে বেশ বিরক্ত বটে নুসাইব।আকস্মাৎ নুসাইবের ফোনে কল আসায় সে মাকে বলে পুল সাইডে চলে গেল কথা বলতে।রিধি বেগম ছেলের কাজে বেশ বিরক্ত হল।ছেলেটাকে নিয়ে তিনি আর পারেন না।সারাক্ষণ খালি মোবাইল আর ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তার ছেলে।শিথির সন্মুখে এসে দাঁড়িয়ে সহসা হাত ধরে পুল সাইডে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগেন রিধি বেগম।অবাক হলো শিথি।বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠল,

-“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে অ্যান্টি?”
রিধি বেগম জবাব দেয়,
-“চলো মা।গেলেই দেখতে পাবে।”

কথা শেষ হতেই কেবল মাত্র মোবাইলটা পকেটে পুরল নুসাইব।সহসা সম্মুখে নিজের মাকে দেখে কিঞ্চিৎ বিরক্ত অনুভব করল সে।যা বুঝলো তার মা তাকে এবার বিয়ে না দিকে শান্ত হবে না।তাই চোখ তুলে তাকালো মায়ের পাশে দাড়িয়ে থাকা সুন্দরী রমণীর উদ্দেশ্যে।

দুনিয়া ঘুরে উঠল যেমন।চোখদুটো আটকে গেল সেই তরুণীর মুখপানে।তার সমীপে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর নেশায় নেশাক্ত হলো চক্ষু জোড়া।বক্ষঃস্থলে আকস্মাৎ হাত চেপে ধরল সে।তার হৃদযন্ত্র আজ তার সাথে নাফরমানী করে বের হয়ে আসতে চাইছে।তাকে রেখে চলে যেতে চাইছে সেই রমণীর কাছে।
নিশ্বাস ভারী হলো নুসাইবের।আকস্মাৎ মায়ের ডাকে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসল সে। তবে তার দৃষ্টি পূর্বের মতোই আটকে রইল শিথির দিকে।প্রথমে নুসাইবকে এখানে দেখে বেশ অবাক হলে ও তার এহেন অদ্ভুত দৃষ্টি দেখে অসস্তিতে পড়ে গেল শিথি।কেমন একধ্যানে তাকিয়ে আছে?অসস্তিতে হাসফাঁস করতে লাগল শিথি।সহসা রিধি বেগমের এহেন আজব কথা শুনে চমকে উঠল সে।রিধি বেগম ছেলের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে উঠল,

-“কেমন লাগল আব্বা?”
নুসাইব বুকের বা পাশে হাত রেখেই বলে উঠল,
-“সুন্দর!খুব বেশি সুন্দর।”
অকস্মাৎ একজন ওয়েটারের সহিত ধাক্কা লেগে পানিতে পরে গেল নুসাইব, সাথে সেই ওয়েটারো।হেসে উঠল রিধি বেগম।চিৎকার করে বলে উঠল,

-“আব্বা প্রেমের জলে ডুবলা নাকি?”
পুলের ধারে দাঁড়িয়ে গালে হাত দিয়ে শিথির দিকে তাকিয়ে নুসাইব উত্তর দিল,
-“মা সত্যি সত্যি প্রেমের জলে ডুবে গিয়েছি আমি।”
সেখানে আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে সত্বর পা চালিয়ে স্থান ত্যাগ করল শিথি।
তখনকার সেই ঘটনার পরে নুসাইবকে আর আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলো না শিথি। সস্থির নিশ্বাস ত্যাগ করল সে। নয়টার সময়ই চৌধুরী বাড়ি প্রস্থান করল শিথি।অনেক জোরাজুরির পরেও যখন শিথি আর থাকতে চাইল না তখন বাধ্য হয়ে ড্রাইভার দিয়ে শিথিকে পাঠিয়ে দিল তার ঠিকানায়।

আজকাল শিথিকে কেমন চোখে হারায় নুসাইব।কেমন চোখে চোখে রাখে শিথিকে সর্বদা।সারাক্ষণ নিজের চোখের সামনে বসিয়ে কাজ করায়।কখনো কখনো কাজ না করিয়েই অযথা নিজের সামনে বসিয়ে রাখে আর নিজে গালে হাত রেখে একধ্যানে শিথিকে দেখতে থাকে। এ নিয়ে শিথির সমস্যার অন্ত নেই।আজকাল কাজ কম নুসাইবের যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ সে।তার মধ্যে আছে সেই তাহসিন নামক মাথা ব্যাথা!যা আঠার মত লেগে থাকে সারাক্ষণ তার আশেপাশে।সব মিলিয়ে অতিষ্ঠ সে।ভাবনায় বিভোর শিথি আকস্মাৎ করো ডাকে চেতনা ফিরে তার।পিয়ন এসে বলে যায় স্যার তাকে ডাকছে।নিজেকে ঠিকঠাক করে নুসাইবের রুমের দিকে অগ্রসর হলো শিথি।নক করে রুমে প্রবেশ করলো।নুসাইব শিথিকে কিছু ফাইল দিয়ে বলে উঠল,

-“এখানে বসে ফাইল গুলো চেক করে দিন।”
শিথি মাথা নেড়ে কাজে মন দিল।অপরদিকে গভীর দৃষ্টিকে শিথিকে একধ্যানে পর্যবেক্ষণ করে চলছে নুসাইব।বেশ অসস্তি হচ্ছে শিথির।কিন্তু কিছু বলতে ও পড়ছে না।তাই আর মাথা না ঘামিয়ে কাজে মন দিল শিথি।বেশ কিছুক্ষন অতিক্রম হওয়ার পর হঠাৎ কেশে উঠল নুসাইব।তার কাশি থামবার নয়।ঘাবড়ে গেল শিথি। ব্যস্ত হাতে পানি এগিয়ে দিল নুসাইবকে।সহসা নুসাইবের বলা কয়েকটা বাক্য কর্নগোচর হতেই লজ্জায় মিইয়ে গেল সে।নুসাইব নিজের কাশি থামিয়ে অন্যথায় চোখ ঘুরিয়ে শিথির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

-“মিস. নিজের ওড়না সামলান আগে।আপনার পরিহিত ড্রেসের সামনের নেক যে বেশ বড় সেদিক খেয়াল আছে তো আপনার নাকি?দ্রুত নিজেকে ঠিক করে নিন।
আর এক মুহুর্ত সেখানে অবস্থান করতে পারল না শিথি।লজ্জায় সবকিছু ভুলে আগে নিজের রুমের দিকে ছুটল।শিথির এহেন দৌড় দেখে মৃদ হাসল নুসাইব।
কাল অফিসে একটা পার্টি আছে সেই সুবাদে সকলকে অফিস শেষে ডাকা হয়েছে।নুসাইব সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

-“কাল সন্ধ্যা ৭ টা থেকে হোটেল সেরাটনে আমাদের কোম্পানির ২৫ বছর পূর্তিতে একটা বিশেষ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে।তাই আপনারা সকলে সেখানে উপস্থিত থাকবেন।আর এগুলো(একজন স্টাফতে ইশারা করে)সকলের হাতে দিয়ে দিন।”
একজন স্টাফ এক এক করে সকলের হাতে একটা করে প্যাকেট ধরিয়ে দিল।সকলে যখন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে নুসাইবের দিকে তাকিয়ে,,, নুসাইব তখন সকলের প্রশ্নের উত্তরে বলে উঠল,

আমার আছে জল পর্ব ১৩

-“এগুলো কোম্পানির পক্ষ থেকে আপনাদের সকলের জন্য উপহার। সো দেখা হচ্ছে কাল।”
সকলে মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে যে যার মত চলে গেল। আর শিথিকে টেনে হেঁচড়ে নিজের সহিত নিয়ে যেতে লাগল নুসাইব।আজ প্রায় দশ থেকে পনেরো দিন হবে নুসাইব তাকে জোর করে নিজের সাথে গাড়িতে করে নিয়ে হোস্টেলে গিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসে।এসব আর শিথির ভালো না।না যেতে চাইলে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যায়

আমার আছে জল শেষ পর্ব