আমার আছে জল পর্ব ৩

আমার আছে জল পর্ব ৩
মাহিমা রেহমান

দিন যত বাড়তে থাকে শিথির প্রতি তানিয়া বেগমের অবহেলার মাত্রা তত বাড়তে থাকে।দিন যেতে থাকে।শিথি-রিমি দুজন বড় হতে থাকে। শিথির নজর পড়ে একটা বিষয় তা হলো মা ছোট বোনকে আদর করে।তাকে মোটেও আদর করে না। বরং তার উল্টো খুব খারাপ ব্যবহার করে তার সাথে।তাকে দিয়ে ঘরের সকল কাজ করায়।কিন্তু রিমিকে কাজের আশেপাশেও আসতে দেয় না। তারওপর রিমি সর্বদা তার সকল জিনিসের উপর হামলা দিত।নিজেরটা রেখেও সবসময় তারটায় উপর রিমির নজর থাকত।এতে বাবা রিমিকে বললেও মা সবসময় সাপোর্ট করত। শিথি ও কিছু বলত না,,রিমিকে নিজের পছন্দের জিনিসগুলো দিয়ে দিত।

দিন কাটতে লাগল। দেখতে দেখতে শিথি যখন স্কুলের গল্ডি পেরিয়ে কেবল কলেজে পা দেয়।তখন ঝড়ের বেগে তার জীবনে প্রবেশ ঘটে তাহসিনের।তাহসিন ছিল তাদের এলাকার ধনী বাবার একমাত্র আদরে বাঁদর হওয়া ছেলে।যে প্রতিদিন আসতে যেতে শিথিকে বিরক্ত করতো।তার বিরক্তের মাত্রা এতটাই ছিল যে শিথি সেদিন রাগের বশে তাহসিনের গালে কষে এক চড় মারে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হঠাৎ সেদিনের পর থেকে তাকে আর পাওয়া যায় নি।এতে করে শিথি ধীরে ধীরে তাহসিনের শুন্যতা অনুভব করতে থাকে। কবে যে ভালোবেসে ফেলে বুঝতেই পারেনি।একদিন স্কুলে এসে সহপাঠীদের মুখে শুনতে পায় তাহসিন নাকি আত্নহত্যা করার চেষ্টা করেছে।সেদিন শিথি বুঝতে পারে সে সত্যি তাহসিনের প্রেমে পড়ে গেছে।সেদিন আর শিথি নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে না।ছুটে যায় হসপিটাল।সেদিন থেকে শুরু তাদের প্রণয়।

অতঃপর বিয়ে কিন্তু বিয়ের ছয়মাস যেতে না যেতেই তাহসিন কেমন বদলাতে লাগে।প্রায় রাতে শিথি তাহসিনকে বিছানায় পেত না।দিন যেতে লাগে তেমনই শিথির প্রতি তাহসিনের অবহেলার মাত্রাও বাড়তে লাগে।তাহসিনের এহেন পরিবর্তনে যখন শিথি চিন্তিত।তখন তাহসিনের ফোন বারংবার কল আসতে থাকে।এতে শিথি বিরক্ত হয়ে ফোন তুলতে যায়।তখন একটা নম্বর থেকে আসা মেসেজ দেখে তার মাথা ঘুরে উঠে।হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ আসতেই ত্বরিত মোবাইল ঠিক জায়গায় রেখে দেয়। পুণরায় ফোন এলে তাহসিন ফোন ধরে কেবল একটা কথা উচ্চারণ করে,

-“আসছি।”
তাহসিন তড়িঘড়ি করে শিথিকে না বলেই বেরিয়ে যায়। শিথি সত্বর নিজের পার্স হতে তুলে তাহসিনের পিছু পিছু বেরিয়ে পড়ে।

রাতে তাহসিন বাড়িতে ফেরার সাথে সাথে শিথি প্রশ্ন করে উঠে,
-“সারাদিন কোথায় ছিলে?”
তাহসিন নিজের টাই খুলতে খুলতে উত্তর করে,
_”অফিসেই ছিলাম।আর কোথায় থাকবো?”
স্মিথ হাসল শিথি বলে উঠল,

-“কিন্তু আমিতো তোমাকে সেরাটন হোটেলে রিমিকে নিয়ে হানিমুন সুইট বুক করতে দেখলাম।”
চমকে উঠল তাহসিন।আকস্মাৎ ঘামতে লাগল। শিথির পানে আতঙ্কিত দৃষ্টি মেলে তাকাল।পুনরায় শিথি বলে উঠল,
-“আমাকে ইগনোর করার কারণ বুঝি রিমি? মনে যা আছে বলে দাও আমি সহজে সব মেনে নিব।”
সাহস পেয়ে তাহসিন। শিথির পানে তাকিয়ে অকপট কণ্ঠে বলে উঠল,

-“ঠিক ধরেছো।আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে না,, রিমিকে ভালোবাসি।আর রিমিকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই।আর শীগ্রই তোমাকে ডিভোর্স দিতে চাই।”
নির্জীব হাসল সে পুনরায়। বলে উঠল,
-“তবে তাই হোক।”
কথাটা বলেই নিজের সকল জিনিসপত্র গোছগাছ করতে লাগল। গোজগাছ শেষে নিজে অন্যরুমে শিফট হলো।

বাসের ঝাঁকুনিতে নিজ ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো শিথি।বাস কন্ডাক্টর তারা দিতেই বাস থেকে নেমে পড়ল সে।আজ প্রথম শিথি ঢাকায় পা রাখল।এখন বিকেল চারটা বেজে পাঁচ মিনিট। শিথি একটা টঙের দোকানে গিয়ে বসল।খুব ক্লান্ত লাগছে তার।ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে কিছুটা পানি পান করে নিল।কিয়ৎ কাল বসে রইল সেখানে। ক্ষাণিক বাদ ফোন করল নিজের কাছের এক বান্ধবী লামিয়াকে।লানিয়ার থেকে পুনরায় ঠিকানা নিয়ে ছুটল সে নিজের গন্তব্যে।একটা রিকশা ডেকে উঠে বসল। রিকশা ওয়ালা কে লামিয়ার দেওয়া ঠিকানায় যেতে বলল।রিকশা চলতে শুরু করল। শিথি নিজের নয়ন জোড়া চারিপাশ ঘোরাতে লাগল।শহরটা বড়ই অচেনা তার।আগে কখনো আশা হয় নি তার। অচেনা শহরে অচেনা মানুষের ভিড়ে শিথির অন্তঃকরণটা বিষিয়ে উঠল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।

শান্তি নিকেতন মহিলা হোস্টেলের সামনে রিকশা এসে থাকল। শিথি লামিয়াকে ফোন করল।লামিয়া বাহিরে বের হয়ে শিথিকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। শিথি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করল,
-“কেমন আছিস?”
লামিয়া চপলা কণ্ঠে জবাব দিল,

-“ভেতরে আয়।আমার রুমেই তুই থাকবি।তোর ভাগ্য ভালো।আমার এক রুমমেট দুইদিন আগেই হোস্টেল ছেড়ে দেশের বাড়িতে চলে গেছে, একেবারের জন্য।আমরা তিনজন থাকতাম।এখন আমি তুই আর ঋতু আছি।”
শিথি মাথা কাৎ করে সায় জানিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।রুমটা মোটামুটি বড়।দেখতে বেশ পরিপাটি। শিথি গিয়ে বিছানার একপাশে বসল।লামিয়া শিথির সম্মুখে পাশে বসে বলে উঠল,

-“আপাদত জব এরিয়াতে তেমন স্পেস নেই। তাছাড়া ভালো কোনো চাকরির খবর পাইনি।তাই তুই বরং কয়েকটা টিউশনি কর।আর এইচএসসি পাশে ও আজকাল ভালো কোনো চাকরি হয় না তেমন।তাছাড়া আর কয়েকদিন পরই অ্যাডমিশন টেস্ট।তাই চাকরি করতে গেলে অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য প্রিপারেশন নিতে পারবি না।তুই ওইদিন আমাকে ফোন করার পর পরই কয়েকটা টিউশনির ব্যবস্থা করেছি। স্টুডেন্টদের বাসা হোস্টেল থেকে কিছুটা দূরে।তুই ম্যানেজ করে নিতে পারবি তো?”

শিথি আলগোছে লামিয়ার হাত দুটি নিজ হাতের মধ্যিখানে নিয়ে বলে উঠল,
-“তুই আমার জন্য অনেক করেছিস।আপন মানুষেরা ও এতো করে না।তুই আমার জন্য যা করলি।ধন্যবাদ! লামিয়া।”
লামিয়া শিথিকে পুনরায় আলতো জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
-“তুই আমার প্রাণের বান্ধবী।তোর জন্য তো এইটুকু করতেই পারি।”
শিথি ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।ফ্রেশ হয়ে এসে সামান্য কিছু খাবার খেয়ে নিল। কিয়ৎ কাল বাদে শিথি লামিয়াকে বলে উঠে,

-“লামিয়া শোন একটু ব্যাংকে যেতে হবে।কিছু টাকা জমা রাখব।”
লামিয়া সায় জানিয়ে বলে উঠল,
-“ঠিক আছে।চল সন্ধ্যায় বের হবো।সাথে একটু ঘোরাঘুরি হয়ে যাবে।”

ঘড়িতে এখন সন্ধ্যা ৬.০০ বাজে।লামিয়া আর শিথি তৈরি হয়ে বের হতে নিবে তখনই ঋতুর আগমন ঘটে।লামিয়া ঋতুর সাথে শিথির পরিচয় করিয়ে দেয়।অতঃপর ঋতুও তাদের সাথে বেরিয়ে পড়ে।ব্যাংকে এসে শিথি টাকাগুলো জমা দিয়ে দেয়।নিজের প্রয়োজনীয় যতটুকু দরকার ততটুকু রেখে।কাজ শেষে ওরা বেরিয়ে পড়ে।আজকে লামিয়ার ফুচকা খাওয়ার প্ল্যান।মেইন রোডে একপাশে বেশ কিছু স্ট্রিট ফুডের স্টল রয়েছে।তারা ফুচকা স্টলে গিয়ে তিন প্লেট ফুচকা অর্ডার করে। শিথির ও বেশ ভালো লাগছে।কষ্টগুলোর কথা তার মাথায় বারংবার এসে হামাগুড়ি দিচ্ছে না আপাদত।
আকস্মাৎ লামিয়া বলে উঠে,

_”দেখ শিথি বেশ ভালো লাগছে না রাতের শহর?আমাদের কিন্তু বেশ লাগে।তাই আমরা দুজন প্রায় চলে আসি।আর ফুচকাটা কেমন লাগলো?হেব্বি না?”
শিথি মুচকি হেসে মাথা নাড়াল।তারা তিনজন ফুচকা খেতে খেতে বেশ কথা বলে ফেলেছে এতক্ষণ। সহসা শিথি পল্লব ঝাপটে রাস্তার বাঁ পাশে তাকায়।আর এতেই শিথির পুরো গা কাঁটা দিয়ে উঠল।একটা বাচ্চা রোডের মাঝখানে চলে এসেছে।তার সম্মুখে কিছুটা দূরে একটা গাড়ি প্রায় তেড়ে আসছে। শিথি লামিয়ার হাতে ফুচকার প্লেটটা ধরিয়ে দিয়ে এক দৌড় লাগাল। শিথির এহেন দৌড় দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল লামিয়া।শঙ্কিত কণ্ঠে শিথির উদ্দ্যেশ্য হাঁক ছাড়ল,

-“এই শিথি কোথায় যাচ্ছিস এভাবে দৌড়ে?”
শিথি দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে টেনে সাইডে নিয়ে এলো।ততক্ষণে গাড়িটা ও থেমে গেছে। অহরহ লোক জড়ো হয়ে গেছে অলরেডি। শিথি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে রেগে বিভৎস হয়ে গাড়িটার কাছে গেল।ততক্ষণে বাচ্চার মা এসে কান্না জুড়ে দিয়েছে।লামিয়া আর ঋতু তাকে শান্তনা দিচ্ছে। শিথি বাচ্চাটাকে তার মায়ের কোলে দিল।মহিলাটা শিথির একহাত পাকড়াও করে বলে উঠলেন,

-“আপনি আমার এতো বড় উপকার করেছেন আজ।যা প্রকাশ করবার নয়।আপনি আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছেন।আপনার এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবার নয়। কোনোদিন যদি আপনার কাজে আসতে পারি!তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব।”
শিথি মুচকি হেসে বলল,
-“জি আপু অবশ্যই।তবে সব আল্লাহর ইচ্ছা।আমি কেবল উসিলা মাত্র।”
-“ভালো থাকবেন! আশা করছি আমাদের পুনরায় দেখা হচ্ছে।”

কথাটা বলে মহিলাটি বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে গেল।সেই গাড়িটা এখনও একই জায়গায় দাড়িয়ে। শিথি এবার একপ্রকার তেড়ে গেল গাড়ির দিকে।গিয়ে গ্লাসে কয়েকটা টোকা দিল।তখনই গাড়ির ভিতর থেকে ড্রাইভার বের হয়ে এলো, এসেই পিছনের গাড়ির দরজা খুলে দিল। সত্বর গাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে এলো একজন সুঠাম দেহী সুদর্শন যুবক। ঋতু-লামিয়ার চোয়াল ঝুঁকে গেছে অলরেডি চোখের সামনে এহেন সুপুরুষ দেখে।যুবকটা একহাতের সাহায্যে নিজের চুলগুলো কে পিছন দিক ঠেলে নিজের অ্যাটিটিউড অচল রেখে শিথির পানে তাকাল।ছেলেটার এতো ন্যাকামো আর ভাব দেখে গা’টা জ্বলে উঠল শিথির।কিছুটা রেগে বলে উঠল,

-“আপনার ড্রাইভার কি চোখে দেখে না নাকি? একটু আগেই তো একটা জান কেড়ে নিচ্ছিল।এমন অকর্মের ঢেঁকি কাজে রেখে কী লাভ যারা কিনা কাজ ছাড়া অকাজ করে বেশি!”
ড্রাইভার অলরেডি ভয়ে কাঁচুমাচু করতে লাগল। যুবকটি পুনরায় নিজের সিল্কি চুলগুলো হাত দিয়ে একসাইড করে শিথির দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে গেল।কারণ যুবকের থেকে শিথি অনেকটা খাটো। শিথি ভ্রু কুঁচকে সমীপে ঝুঁকে থাকা ব্যক্তির পানে তাকিয়ে রইল।যুবক কিছু বলতে নিবে তখনই তার চুলগুলো পুনরায় সামনে এসে গেল।সে আবারও হাত নেড়ে চুলগুলো ঠিক করে শিথির পানে বলে উঠল,

-“ম্যাডাম আপনি চাইলে আপনার কারের ড্রাইভার হতে পারেন। এমন সুন্দরী রমণী আমার কারের ড্রাইভার হলে নিজেকে ধন্য মনে হবে ম্যাডাম। (বক্ষঃস্থলে হাত চেপে)”
শিথি কিছুটা দূরে সরে বলে উঠল,
-“আশা করছি নেক্সট বার থেকে এই ভুল আর হবে না।”

আমার আছে জল পর্ব ২

রাত এখন বারোটা বেজে বিশ মিনিট।লামিয়া আকস্মাৎ শিথিকে গদগদ কণ্ঠে বলে উঠল,
-“শিথিরে ছেলেটা কিন্তু সেই ছিল। আহাঃ! কি সুন্দর চাপদাঁড়ি।দেখতে যেমন জীবন্ত পুতুল।”
লামিয়ার সহিত ঋতু ও সায় মিলালো। শিথি একপাশে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। চুপচাপ তাদের দুজনের কথা শুনতে লাগল

আমার আছে জল পর্ব ৪

1 COMMENT

Comments are closed.