আমার একটাই যে তুই পর্ব ২৭ || সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

আমার একটাই যে তুই পর্ব ২৭
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

যখন জ্ঞান ফিরে, নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করি। পাশেই তিথি আমার হাত চেপে বসে কাঁদচ্ছিল।তার সাথে দাঁড়িয়ে মেজদাক ভাইয়া।আমার জ্ঞান ফিরতে দেখেই তিথি হন্তদন্ত হয়ে জিগ্যেস করলো,,
–” বনু এখন কেমন লাগচ্ছে তোর? ব্যাথা এখনো করছে?”
আমি মলিন হাসলাম। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে কান পর্যন্ত যেতে লাগলো।এত মানুষের ভিড়ে কাউতে তো আপন ভরসার মানুষ পেলাম বলে। তাই ভেবে কান্না আসচ্ছে।তিথি মুছে দিয়ে দিতে দিতে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,,

–” কষ্ট হচ্ছে খুব নারে?”
আমি মাথা নাড়িয়ে ব্যথাতুর কন্ঠে বললাম,,
–” না এখন ঠিক আছি। সবাই কই? ইউসুফ ভাই..!”
তিথি আবার ফুঁপিয়ে উঠলো। মেজদাক পেছন থেকে তিথিকে সামলে বলল,,
–” আঙ্কেলের অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল !তারা ঢাকা নিয়ে গেছেন।ডাক্তার বলেছেন ২৪ ঘন্টার আগে কিছু বলতে পারছেন না। তবে (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) না বাঁচার চান্স বেশি।”
বড় মামার এমন অবস্থার কথা শুনে কান্না বেড়ে গেল আমার। তাড়াতাড়ি উঠে বসে তিথির হাত ধরে কাঁপা গলায় বললাম,,
–” ক…কি হয়েছিল ব….বড় মামার!”
তিথি এবার হু হু করে কেঁদে দিল। নিজেকে সামলে বলল,,

–” ইউসুফ ভাইয়ার একটা মিটিং ছিল। তাকে ফোনে না পেয়ে বড় ফুফা সে মিংটিয়ে যাচ্ছিল এটেন্ড করতে! জানিসতো বড় ফুফা গার্ড পছন্দ করতো না।তাই নিতো না। তা যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো আজ। তার সাথে ডায়মন্ড ভাইয়া ছিল।তারা বাইপাস দিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনি একটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো তাদের বরাবর সামনে! সরছিল না। ডায়মন্ড ভাইয়া বের হতেই তাকে আঘাত করে। তা দেখে চাচু বের হতেই (ওড়নায় মুখে চেপে কাঁদতে লাগলো আবার তিথি..আমি বলতে বললে সে ঢোক গিলে বলতে শুরু করলো) ফুফাকে পিছন থেকে কে যেন চাকু ঢ…ঢুকিয়ে দেয়।তাও এক বার না স….সাত বার!”
জ্যান্ত
বলে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আমি শক্ড হয়ে বসে আছি! মনে হচ্ছে ৪৪০ বোল্ডের শক্ড খেয়েছি। চোখ দিয়ে অঝড়ে জল পড়চ্ছে গড়িয়ে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তিথি আর মেজদাক ভাইয়া মিলে আমায় বাসায় নিয়ে আসলো। বাসা আসার ইচ্ছে আমার ছিল না। কেন যাবো? সে বাসায়? যেখানে তারা আমাকে দোষী ভাবচ্ছে!তা ভেবে আমি বাবাকে কল করলাম। বাবা গা ঝাড়া দিয়ে বললেন,,
–” তোর মত মেয়েকে জ্যান্ত পুতে ফেলেছি আমি সেই কবেই। আর ফোন করবি না তুই! মরলেও আর কল দিবি না।”
বাবার কথায় ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম কি করবো আমি এখন? তখন তিথি আর মেজদাক ভাই বুঝালো,,
–” তোর তো যাওয়ার আর জায়গা নেই! কই যাবি বল? আর চারিদিকে যে হাল অবস্থা। তোর বাবাও তোকে নিবে না। তার থেকে বরং বাসায় চল। কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো।”

অামি ছলছল চোখে তাকাতেই তিথি তার সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–” ঠিক হয়ে যাবে সব কুহু! ইউসুফ ভাই তোর হলে যে কোনো মূল্য পাবি। যদি তোর ভাগ্য না থাকে হাজার কাতরালেও পাবি না।”
আমি তখন শক্ত করে তিথিকে ধরে কেঁদেই চলেছিলাম।
বাসার পরিবেশটা থমথম। কেমন গুমাটে ভাব! সে প্রাণ ছল বাড়িটির মানুষ গুলো কাঁদচ্ছে মুখ চেঁপে। কেউ কেউ তবজি পরচ্ছে। আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো তারা। কষ্ট লাগলো খুব। এক দিনের ব্যবধানে কাছের মানুষ পর হয়ে গেল আমার। তিথি আমাকে রুমে এলে শুয়ে দিল বেডে। ব্যথায় দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। এর কেউ আর আসলো না রুমে। তিথি মাঝে খাবার এনে খাইয়ে দিয়ে গেছে। বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে যাই বুঝতে পারিনি।
মধ্যরাত হতেই বাড়িতে জোরে জোরে কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এত রাতা কান্নার শব্দ ধক করে উঠলো মনে। সাথে সাথে বাহিরে আসতেই তিথি দৌঁড়ে এলো আমার কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলল,,

–” বনুরে বড় ফুফা..!”
তিথি চুপ হয়ে গেলে। কান্নার জন্য কথা যেন বলতে পারছেনা। আর দিতে আমার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসচ্ছে। তিথিকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললাম,,
–“কি হয়েছে মামার। বল। বল না। ভয় লাগচ্ছে আমার।”
তিথি হেচকি তুলে কাঁদচ্ছে। বুঝতে বাকি নেই বড় মামা হয়তো..!আমি কাঁপা কন্ঠে বললাম,,
–” বড় ম..মামা আর..!”

তিথি এবার আমাকে জড়িয়ে কেঁদে দিল। আমি সেখানই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়চ্ছে। মুখ দিয়ে একটি কথাও বলতে পাড়লাম না
তিথিকে ছেড়ে দিয়ে, খাটে বসে দু হাটুতে মুখ চেঁপে কাঁদতে লাগলাম। নিজেকে আজ দিশেহারা লাগছে। কোনো না কোনো ভাবে না চাইতেও আমিও জড়িত বড় মামার মৃত্যুর। নিজের প্রতি ঘৃণা লাগচ্ছে। এত ঘৃণা যে সারা শরীর চাকু দিয়ে খুবলে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বাবা সমতুল্য ব্যক্তিটির হাসি মুখ খানি ভেসে উঠচ্ছে বার বার। কানে আসচ্ছে সেদিন শেষবার তার বলা কথা গুলো,,

–“আম্মু শেষ পরীক্ষাটা ভাল করে দিও কিন্তু। মনে রেখ শেষ ভাল যার! সব ভাল তার। আর হে পড়াশুনাটা কখনো অবহেলা করো না।কারণ যখন কেউ তোমার পাশে না থাকবে এ পড়াশুনা টাই কাজে দিবে!”
বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিছিলেন তিনি পরম যত্নে। আর সেই মানুষটি আজ নেই! না আর ফিরবে? না বলবে,
–“কুহু আম্মু এক কাপ চা, নিউজ পেপারটা দে! ইশ! চশমাটা ফেলে এসেছি এনে দে মা!”
কেউ বলবে না। কেউনা না। এসব ভেবে কাঁদচ্ছিলাম তখনি মিশুপি ঘরে ঢোকে। তাকে দেখে কোনো কিছু বললাম না। সে এসে বাবা হারাবার ঝাল আমার উপর মিটিয়ে গেল। কিছু বললাম না। তার লাষ্ট কথায় বুকটা চিড়ে গেল। আমার বাবা নেই তাই বাবার মর্ম কখনো বুঝবো না। বুঝলে হয়তো বড় মামা জীবিত হতো। তাও রিয়েক্ট করলাম না। চুপ করে কান্না করে গেলাম। কারণ পৃথিবী মানুষ আর কিছু পাড়ুক না পাড়ুক দোষারোপ করতে ঠিক পারে।

বড় মামার লাশ আনা হলো। সবাই কাঁদচ্ছে বড় মামী মামার বুকে পড়ে কাঁদচ্ছে। মিশুপিও কাঁদচ্ছে সাথে। নানু মা মুখের আঁচল চেপে কাঁদচ্ছে আর বলছে,,
–“আর শাফিনরে কেন নিলা! আমারে নিতা বেকার মানুষ ছিলাম। ওর কি বয়স হইছিল। কেন নিলা।আল্লাহ্”
এসব বলে বিলাপ করছে। পাশেই ইউসুফ ভাই দাঁড়িয়ে আছে। সে কাঁদচ্ছে না। মুখ টা ফ্যাকাসে লাগচ্ছে গত পরশু এই মুখটিতে প্রাণোচ্ছল হাসি ছিল। আজ তা নেই। কালো মেঘের ভিড়ে যেন হারিয়ে গেছে। তাকে দেখে আরো বুক ফেঁটে যাচ্ছে আমার।
ময়মনসিংহের সব মানুষের ভিড় জমছে একবার মামাকে এক পলক দেখবে বলে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে তারাও। করবেই বা না কেন? ১০ টা বছর এক টানা তিনি ময়মনসিংহের মেয়র পদে ছিলেন। মানুষের ভাল-মন্দ এগিয়ে আসতেন। সেই মানুষটি আর নেই।

আমার একটাই যে তুই পর্ব ২৬

বড় মামাকে শেষ গোসল দিয়ে নেওয়া হল বড় মসজিদ। জানাযা পড়ানো হলো কবর দেওয়া হলো কবরখানায় কালীবাড়িতেই। একে একে সবাই চলে যেতে লাগলেন। এক সময় পুড়ো বাড়ি খালি হয়ে গেল। হাসি খুশি মানুষ গুলো শোকে মুঁর্ছে গেল। সবাই হাসতে ভুলে গেল যেন।ধীরে ধীরে সব পরিবর্তন হতে লাগলো। সে দিনের পর থেকে ইউসুফ ভাইয়া সব থেকে বেশী পরিবর্তন হতে লাগেন। সে একদিনো কাঁদে নি। না হেসেছে। কেমন যেন গম্ভীরতায় ছেয়ে গেছেন তিনি। তার সাথে তেমন আর একটা কথা হতো না। তিনি বড় নেতা হলেন। রাহুল ভাইকে দিলেন বড় মামার জায়গা দিলেন।এর মাঝে বাড়ি ছেড়ে ছিলাম তিথির সাহায্য। সেদিন ধরে ফেলন ইউসুফ ভাই বাসস্ট্যান্ডে সকলের সামনে থাপড় মেরেছিলেন। থাপরের জোড় এতটা ছিল যে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেছিলাম। চারিদিকে মানুষের ভীর জমে গেছিল।তারপর টানতে টানতে গাড়িতে ঢুকালো। বাসায় এসে ধাক্কিয়ে রুমে ফেললো।আর চেঁচিয়ে সেদিন বলেছিল,,

–“আমার অনুমিত ছাড়া যদি এবাসা থেকে বের হোস! ঠেঙ্গ ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে দিব।”
সেদিন ইউসুফ ভাইয়ের আরেকটি রূপ আমি দেখেছিলাম “হিংস্রতার রূপ” যা মনে হলেও পিলে চমকে যায় আমার।সেদিন ফুঁপিয়ে কেঁদে কাঁটিয়েছিলাম রাত দিন। সবাই শুধু তার মর্জি আমার উপর ঝাড়ে। নিজেকে জড় বস্তু মনে হচ্ছিল আমার।বন্দি হয়ে গেছিলাম যেন এই বৃষ্টি বিলাস বাড়িটিতে। এভাবে ৬ মাস কেঁটে গেল। এক দিন তিথি রুমে দৌঁড়ে এলো। বলল,,

আমার একটাই যে তুই পর্ব ২৮