আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৪২

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৪২
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

ডাক্তার ম্যাডামের দেওয়া ডেট পার হয়ে যাচ্ছে, তবুও বাচ্চা হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই তোড়ার।আবার কোনো অসুবিধাও হচ্ছে না।সেজন্য কুশান ডাক্তার ম্যাডামকে কল করে জানালো ব্যাপার টা।ডাক্তার ম্যাডাম শোনামাত্র বললো,
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোড়াকে যেনো আজকেই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়,কারণ আরেকবার চেকাপ করাতে হবে।
কুশান ডাক্তার ম্যাডামের কথা শোনামাত্র আর এক সেকেন্ড দেরি করলো না,তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো তোড়াকে।

আজ আবারও আল্ট্রাসোনোগ্রাফী করে, রক্ত পরীক্ষা করা হলো তোড়ার।
ডাক্তার ম্যাডাম পরীক্ষা নীরিক্ষা করে জানালেন আজকের মধ্যেই সিজার করাতে হবে,কারণ বাচ্চার পজিশন সেই আগের মতোই আছে,এ বাচ্চা নরমালে কিছুতেই হবে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ডাক্তার ম্যাডামের কথা শোনামাত্রই কুশানের চোখমুখ শুকিয়ে এলো।তোড়ার থেকে সে বেশি ভয় পেতে লাগলো।কিন্তু তোড়াকে এটা বুঝতে দিলো না কুশান।সে উলটো তোড়াকে শান্ত্বনা দিতে লাগলো যে ভয়ের কোনো কারণ নেই।
জারিফ চৌধুরী অন্য কোনো ভালো হাসপাতালে তোড়ার সিজার করার কথা বললেন।কুশান তা শুনে বললো,
আব্বু এই হাসপাতালটির চিকিৎসা ব্যবস্থাও মোটামুটি ভালোই আছে।আমার মনে হয় এই হসপিটালেও ভালো হবে।জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে আমি তাহলে তোড়াকে ভর্তি করালাম।

আজ বিকেল ৫টায় তোড়ার অপারেশন করা হবে।এক এক করে বাড়ির সবাই হাসপাতালে উপস্থিত হতে লাগলো।কারণ শুধুমাত্র কুশান আর জারিফ চৌধুরী এসেছিলেন তোড়াকে চেকাপ করার জন্য।ডাক্তার ম্যাডাম রক্ত ম্যানেজ করে রাখতে বললেন।

তোড়ার রক্তের গ্রুপ ছিলো ও পজেটিভ।কুশান তার একজন বন্ধু,আর জারিফ চৌধুরী তার একজন পরিচিত কে ঠিক করে রাখলেন। যেহেতু ডেট পার হয়ে গেছে সেজন্য আজকেই অপারেশন করানো হচ্ছে।এই অল্প সময়ের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে ফেললো কুশান।
অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ তোড়া কুশানের হাত ধরে বললো,আমার ভীষণ ভয় লাগছে কুশান।কেমন যেনো দূর্বল দূর্বল লাগছে শরীর।

কুশান তোড়ার কথা শুনে কিছু না বলে ওকে কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে থাকলো।কুশান তো নিজেই কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছে।আর সেখানে তোড়ার তো ভয় পাওয়ারই কথা।সবাইকে রেখে তাকে অপারেশন থিয়েটারে যেতে হচ্ছে।তোড়া ভয়ে কান্না করছে অনেক।

তোড়াকে কাঁদতে দেখে কামিনী আর চামেলি বেগম নানাভাবে তাকে শান্ত্বনা দিতে লাগলো।এক এক করে সবাই বোঝাতে লাগলো তোড়াকে যে ভয়ের কোনো কারণ নাই।কুশান শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে।কারণ দুশ্চিন্তায় তার নিজেরই পুরো শরীর অবশ হয়ে আছে।তোড়াকে শান্ত্বনা দেওয়ার শক্তিটুকুও সে পাচ্ছে না।তবুও সে হঠাৎ করে দৌঁড়ে গিয়ে আবার জড়িয়ে ধরলো তোড়াকে।আর ওর কপালে আলতো করে একটা কিস করে বললো,
ভয়ের কোনো কারণই নেই তোড়া।কিছুই হবে না।আমরা তো এখানেই আছি সবাই।এই বলে কুশান আবার তোড়াকে জড়িয়ে ধরলো।তোড়া তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো,

আমার কোনো কথায় যদি কষ্ট পেয়ে থাকো বা আমার ব্যবহারের কারনে যদি তুমি আঘাত পেয়ে থাকো তাহলে ক্ষমা করে দিও,জানি না আমাদের আর দেখা হবে কিনা?এই বলেই তোড়া হু হু করে কেঁদে উঠলো।
তোড়ার মুখে এরকম কথা শুনে কুশান বললো, এই পাগলি?কি বলছো এসব আবোলতাবোল? দেখা হবে না মানে?মাথা কি ঠিক আছে তোমার?বলছি না কিছু হবে না।আমাকে রেখে তুমি কই যাবে?

চামেলি বেগম তখন এগিয়ে এসে বললো, মা তোড়া এসব কি ভুলভাল বলছিস।আল্লাহর নাম নে মা।কিছুই হবে না।এতো ভয় পেলে চলবে?তুই নিশ্চিন্তে থাক মা।কিছুই হবে না।কুশান তুমি ওর হাত টা ছেড়ে দাও তো এখন।ওকে যেতে দাও।এই বলে চামেলি বেগম নিজে তোড়ার হাত ধরে ওকে রেখে আসলেন।
কুশানের হাত থেকে যখন তোড়ার হাত টা বের হয়ে গেলো তখন মনে হলো কেউ একজন কুশানের হৃদয় টা ক্ষতবিক্ষত করে দিলো।এই ক্ষনিকের বিচ্ছেদ টুকু সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলো না।
এরকম বাজে অনুভূতি কখনোই হয় নি কুশানের।

তোড়া শুধু বার বার পিছন ফিরে কুশানের দিকে তাকাচ্ছে।তোড়ার এই চাহনিতে এই মুহুর্তে কুশানের মনের ভিতর যে এখন কি চলছে সেটা শুধুমাত্র সেই জানে। কুশান ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তোড়ার কাছে ছুটে যেতে পারছে না,তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত্বনা দিতেও পারছে না।
তোড়ার কথাটা কুশানের কানে বার বার বাজতে লাগলো।আর কুশানের ভয় আরো দ্বিগুন গতিতে বেড়েই চলছে।ভয়ে কুশানের পুরো শরীর যেনো কাঁপছে।কুশানের এমন অবস্থা দেখে কামিনী ওর হাত ধরে পাশের সোফায় বসালো।আর কুশানকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো,

বাবা!এতো কেনো টেনশন করছিস?কিছুই হবে না দেখিস।এতো ভয় পেলে হবে নাকি?
কুশান চুপচাপ। সে কোনো কথা বললো না।কামিনী কুশানকে এখনো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আছে।
বাসার সবাই বসে বসে অপেক্ষা করছে।মিসেস চামেলি বেগম আর হেনা বেগম বেলকুনির এক কোনায় বসে দোয়া পড়তে লাগলো।সবার মুখ চোখেই আতঙ্ক।ভীষণ টেনশন হচ্ছে সবার।

আজ টিভিতে বাংলাদেশের খেলা হচ্ছে।ওয়েটিং রুমে বসা মানুষ জন সবাই টিভির দিকে তাকিয়ে খেলা দেখছে,যে কুশান ক্রিকেট খেলা দেখার পাগল তার চোখ আজ এক সেকেন্ডের জন্যও টিভির পর্দার দিকে গেলো না।সে তো বার বার শুধু অপারেশন থিয়েটারের দরজার দিকে দেখছে।
হঠাৎ একজন নার্স বাচ্চা কোলে নিয়ে কুশানদের দিকে আসতেই কুশান থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো।তার বুকের কম্পন যেনো বেড়েই চলছে।কুশান হাত বাড়াতেই নার্সটি পাশ কাটিয়ে পাশের এক ভদ্র মহিলার কোলে বাচ্চাটি দিয়ে দিলো।এইভাবে কয়েকটি বাচ্চা বের করলো নার্স।

অর্থাৎ এক একটি অপারেশন হচ্ছে আর বাচ্চাটাকে বাইরে এসে তার স্বজনদের দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মনে হলো প্রায় ১০ টি অপারেশন হয়েছে একই সময়ে।
কুশান তখন নার্সটিকে জিঙ্গেস করলো, অপারেশন রুমে ঢোকানোর কত সময় পর বাচ্চা দেখানো হয়?নার্সটি জানালো ১ ঘন্টা পরে।

কুশানের চিন্তা আরো বেড়ে গেলো।এতো এতো বাচ্চার ভীড়ে তার সন্তান আবার না জানি বদলে যায়। এ যেনো কোনো সন্তান উৎপাদনের কারখানা। নার্স রা কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট ছোট্ট শিশু নিয়ে আসছে এক এক করে। যাদের পেয়ে স্বজনদের মধ্যে সে কি উৎসাহ, উদ্দিপনা আর আনন্দ।
এসব দেখে কুশানের আর ধৈর্য্য নেই। ভীষণ অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো আরো।কুশান সেজন্য শুধু পায়চারি করতে লাগলো।কখন যে সে টেনশনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
হ্যাঁ তাই হলো।অতিরিক্ত টেনশনে কুশান সত্যি সত্যি জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।একদিকে তোড়া অপারেশন রুমে আর এদিকে কুশান জ্ঞান হারিয়েছে।

বাড়ির লোকজন এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কি করবে সত্যি বুঝতে পারলো না।কামিনী কুশানকে অজ্ঞান হওয়া দেখামাত্র দৌঁড়ে গিয়ে ছেলেকে ডাকতেই একজন নার্স একটা বাচ্চা কোলে করে অপারেশন রুম থেকে বের হয়ে আসলো।আর বললো, তোড়ার পরিবারের লোকজন কারা?তোড়ার মেয়ে বেবি হয়েছে।

তোড়ার নাম নিতেই চামেলি বেগম,ইরা,মিরা,লিরা সবাই দৌঁড়ে গেলো নার্স টির কাছে।এদিকে কামিনী কুশানের মুখ চোখে পানি ঢালছে আর বলছে বাবা চোখ খোল বাবা,দেখ তোর কি সুন্দর একটা মেয়ে বেবি হয়েছে।এ বাবা ওঠ তাড়াতাড়ি?দেখ!একদম আকাশের চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করছে সোনাটার মুখ।
এদিকে নার্সের থেকে সবার প্রথম চামেলি বেগম কোলে নিলো তোড়ার বেবিটাকে।তারপর এক এক করে সবাই
কোলে নিচ্ছে আর কত কথা বলছে।

গোলাপ সাহেব নাতনিকে কোলে নিয়েই কানের কাছে আযান দিলেন।
বাচ্চাকে সুস্থ সবল অবস্থায় দেখে সবার টেনশন একদম দূর হয়ে গেলো।মুহুর্তের মধ্যে সবার মুখেচোখে হাসি ফুঁটে উঠলো।নার্সটি জানালো তোড়াও সুস্থ আছে।তবে ভিতরে কিছু কাজ আছে।এজন্য এখনি রোগীর সাথে দেখা করানো যাবে না।
এদিকে কুশান এখনো বেঁহুশ হয়ে পড়ে আছে।
জারিফ চৌধুরী এবার তাড়াতাড়ি করে অন্য একজন ডাক্তার নিয়ে আসলো কুশানের জন্য।তিনি কুশানের চেকাপ করার পর জানালেন কুশানের প্রেসার একদম লো হয়ে গেছে।

ডাক্তার সাহেব জানালেন অতিরিক্ত পরিশ্রম, দুশ্চিন্তা, ভয় ও স্নায়ুর দুর্বলতা থেকে লো ব্লাড প্রেসার হতে পারে। প্রেসার লো হলে মাথা ঘোরা, ক্লান্তি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব, বুক ধড়ফড়, অবসাদ, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া এবং স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসুবিধা দেখা দেয়।যার কারণে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায় সাথে সাথে।
জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো,ডাক্তার অন্য কোনো সমস্যা না তো?

“না,আমি ঔষধ দিয়ে দিচ্ছি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। এই বলে ডাক্তার চলে গেলো।
কামিনী আর জারিফ চৌধুরী কুশানের পাশে বসে আছে।এদিকে চামেলি বেগম, ইরা,মিরা,লিরা আর সোনিয়া তোড়ার বেবিকে নিয়ে আনন্দ করছে।কামিনী কুশানকে রেখে বাচ্চাকে এখন পর্যন্ত কোলে নিতে পারে নি।তখন চামেলি নিজেই চলে এলো কামিনীর কাছে আর বেবিকে কামিনীর কোলে দিলো।
বাচ্চার মুখ দেখে কামিনীর মুখে একদম হাসি ফুটে উঠলো।সে হাত দিয়ে মুখে চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, বাবা কুশান!তাকা একবার বাবা।দেখ! আমার কোলে কে?

জারিফ চৌধুরী তখন বললো, ওকে ডাকো না কামিনী। ডাক্তার তো বলেই গেলো সময় হলে এমনি ওর জ্ঞান ফিরে আসবে।
এবার জারিফ চৌধুরী কোলে নিলো বেবিটাকে।এ যেনো এক চাঁদের টুকরো বাচ্চা।পুরো ঘর যেনো আলোকিত করছে।জারিফ একবার বাচ্চার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার কুশানের দিকে।

হঠাৎ কিছুক্ষন পর কুশান চোখ মেলে তাকালো।সে তার হাত দিয়ে চোখ ঘষা দিতে দিতে উঠে বসলো।ভালো করে তাকিয়েই দেখে তার মায়ের কোলে বাচ্চা।বাচ্চাকে দেখামাত্র সে মুচকি একটা হাসি দিয়ে দ্রুত বেড থেকে নামলো।
কুশান তার মেয়ের কাছে গিয়ে ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইলো নিষ্পাপ ওই মুখ টির দিকে। তার মেয়ের গায়ের রং যেনো চাঁদের আলোকেও হার মানাবে।কুশানের জ্ঞান ফেরা দেখে কামিনী বললো, বাবা দেখ দেখ কি ফুটফুটে তোর মেয়েটা?দেখ কেমন সুন্দরী হয়েছে তোর মেয়ে?কামিনীর চোখে মুখে যেনো আনন্দের বন্যা।

কামিনী আর অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি করে কুশানের কোলে দিলো বেবিকে।কুশান তার মেয়েকে কোলে নিয়েই হাসতে হাসতে কেঁদে ফেললো একদম।
তার চোখ থেকে অনবরত পানি ঝড়ছে। এই কান্না যে আনন্দের!
মুখে এক রাশ সুখের হাসি আর চোখে অশ্রু। এ যেনো আনন্দ অশ্রুর মিলন ঘটেছে আজ।
কুশান এবার মেয়ের থেকে চোখ ফিরে নিলো আর কামিনী কে বললো, আম্মু তোড়া কেমন আছে?
কামিনী জানালো ভালো আছে তোড়া,সুস্থই আছে সে।

কুশান সেই কথা শুনে কামিনীর কোলে আবার তার মেয়েকে রেখে অপারেশন রুমের দিকে যেতেই একজন নার্স চিৎকার করে ডাক দিলো।এই?এই?কই যান আপনি?ভিতরে কাজকর্ম চলছে এখনো।
কুশান তখন বললো ম্যাডাম আমার স্ত্রী কেমন আছে?ও সুস্থ আছে তো?
নার্স টি তখন বললো কে আপনার স্ত্রী?নাম কি?
–তোড়া।

নার্স সেই কথা শুনে বললো হ্যাঁ ভালো আছে।এই বলেই নার্স টি চলে গেলো।এদিকে কুশানের তো আরো অনেক কথা জিজ্ঞেস করার আছে।সেসব প্রশ্ন করার সময় ই দিলো না নার্স টি।
কুশানের ঘরে এসেছে নতুন অতিথি। সেই অতিথির একের পর এক ছবি তুলছে সবাই।আজ যেনো সবার নজর শুধু তার দিকেই।

কুশান খেয়াল করলো তার মেয়ের হাতে টোকেন লাগিয়ে রেখেছে। যাতে মায়ের সঙ্গে সন্তানকে চিনতে কষ্ট না হয়।
মেয়েকে কোলে নিয়ে আছে কুশান।আর তোড়ার আসার অপেক্ষা করছে।মেয়েকে দেখে তার মনের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইলেও তোড়ার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত ওকে এক নজর না দেখা পর্যন্ত তার মনে যেনো শান্তি ফিরে আসছে না।প্রায় এক ঘন্টা পর অপারেশন রুম থেকে বের করা হলো তোড়াকে।তোড়া চোখ বন্ধ করে আছে যার কারণে কুশান কথা বলার সুযোগ পেলো না।তোড়াকে সোজা কেবিনে নিয়ে গেলো সবাই।

তোড়াকে বের হওয়া দেখে সবাই কেবিনের দিকেই ছুটলো।কিন্তু কুশানের কোলে যেহেতু তার কলিজার টুকরো মেয়ে আছে সেজন্য সে ধীরে ধীরেই সিড়িতে হেটে হেটে নিচে নামলো।লিফটে করে যেহেতু ছোট বাচ্চা নেওয়া যাবে না সেজন্য সে লিফট ইউজ করলো না।
কুশানের কোলে বাচ্চা দেখে কামিনী আর চামেলি দুইজনই এগিয়ে এলো।
কামিনী বললো,
বাবা মনাকে আমাদের কাছে দিয়ে দে।তোর শরীর ভালো না বাবা।
কুশান তখন হেসে উঠে বললো,

বাবার কোলে মেয়ে থাকার পরও বাবা কি অসুস্থ থাকে নাকি?আমি এখন সুস্থ আছি আম্মু।কিছুই হবে না আর।আমি নিয়ে যেতে পারবো।কুশান শুধু বারবার তার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।তবে মেয়ে কার মতো হয়েছে এখনো বোঝা যাচ্ছে না। কারণ প্রথম দিন সব শিশুকেই এক রকম দেখায়।

কুশান কেবিনে আসতেই সোনিয়ার কোলে তার মেয়েকে দিয়ে সে তাড়াতাড়ি করে তোড়ার পাশে গিয়ে বসলো।আর ওর মাথার চুলগুলো বুলিয়ে দিতে লাগলো।তোড়া এতোক্ষন চোখ বন্ধ করেই ছিলো।কুশানের স্পর্শ পেয়ে সে চোখ মেলে তাকানো।চোখ মেলতেই তোড়ার চোখ বেয়ে বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।কুশান তখন তোড়ার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে ওর কপালে আলতো করে কিস করে তোড়ার হাতে হাত রেখে বললো,

চোখ বন্ধ করে থাকো এখন।আর ঘুমানোর ট্রাই করো।মেয়েকে নিয়ে ভাবতে হবে না,আর মেয়ের বাবাকে নিয়েও ভাবতে হবে না।আমরা দুইজনই ভালো আছি।তুমি এখন শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববে।
সোনিয়া তখন তোড়ার মেয়েকে এগিয়ে এনে বললো, ভাবি একবার দেখো তোমার মেয়েকে।কেউ বলছে তোমার মতো হয়েছে, কেউ বলছে কুশান ভাইয়ার মতো।কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে এ আমার মতো হয়েছে।দেখো তো তুমি একটু।
তোড়া এই প্রথম তার মেয়ের দিকে তাকালো।যেহেতু সে এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি সেজন্য কিছু বললো না,মেয়েকে দেখে শুধু মুচকি একটা হাসি দিলো।

কুশান তখন সোনিয়াকে বললো, যা এখন নিয়ে যা ওকে।তোর ভাবি এখন ঘুমাবে।তোড়া তুমি এখন ঘুমাও প্লিজ।এই বলে কুশান আবার তোড়ার মাথার চুলগুলো বুলিয়ে দিতে লাগলো।
প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার অনুভূতি আসলেই ভাষায় লিখে প্রকাশ করা যাবে না। তার উপর প্রথম কন্যা সন্তান। সবাই বলে যার প্রথম কন্যা সন্তান হয় তার সৌভাগ্যের দরজা খুলে যায়।কুশানের আত্নীয় স্বজনদের মধ্যে অনেকেই বলেছে একটা ছেলে হলে ভালো হতো।কিন্তু কুশান তাদের বলেছে ছেলে আর মেয়ে বড় কথা নয়, সন্তান হতে হবে মানুষের মত মানুষ।

আল্লাহ তাকে আজ একটি সুস্থ সন্তান দিয়েছে,সে জন্য সে সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।
কুশান তার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই সারা জীবন বাবার আদর নিয়ে থাকবি। তোর মাঝে আমি আমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আমার না পাওয়াগুলো তুই পূরণ করবি মা। তোর কাছে একটাই চাওয়া- জীবনে হতাশ হবি না, অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকবি, অহংকার, ঘৃণা যেনো তোকে স্পর্শ করতে না পারে। সর্বোপরি একজন মানুষ হয়ে উঠবি। যে হবে- মানবিক ও শিক্ষিত মানুষ।

প্রথম সন্তানের বাবা মা হওয়ার অনুভূতি কেমন হবে তা আসলে মুখে বলে সহজে অনুমান করে বোঝানো যাবে না যতক্ষন না কেউ একজন নিজে বাবা মা না হয়। ।সন্তান হলো সৃষ্টিকর্তার অফুরন্ত নেয়ামত। সন্তান হাসলে বাবা মা হাসে আর সন্তান কাঁদলে বাবা মাও কাঁদবে।

সন্তানের মুখ দেখলে প্রতিটা বাবা মার হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি হবেই হবে ।সন্তান হচ্ছে কাঁচের মতো সামান্য একটি আঘাতে ভেঙ্গে পড়লে আপনিও ভেঙ্গে পড়বেন । প্রত্যেকটি ব্যক্তির স্বপ্ন থাকে একদিন শিশুর পিতা হবে । তাই ঘুমিয়ে আছে সকল পিতা সব শিশুরই অন্তরে । প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার অনুভূতি এতটাই আনন্দের যা শুধু হৃদয় অনুভব করতে পারে ।

কুশান, চামেলি বেগম আর হেনা বেগম বাদে বাকি সবাইকে বাসায় পাঠানো হলো।কারণ হাসপাতালে এতো মানুষের ভীড় না করাই ভালো।কামিনী নিজেও থাকতে চাইলে কুশান জোর করেই পাঠিয়ে দিলো তাকে।কারণ কামিনী তো নিজেই অসুস্থ। হাসপাতালে রাত জেগে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে তিনি।

অনেক রাত হয়েছে।সেজন্য সবাই এখন ঘুমিয়ে যাবে একটু।তোড়ার কেবিন টা ভি আই পি কেবিন হওয়ায় তিনটা বেড,এক সেট সোফা আর একটা টিভি, সাথে এটাচ বাথরুমের ব্যবস্থা আছে।এক বেডে তোড়া একাই ঘুম পারছে আর অন্য বেডে চামেলি বেগম আর হেনা বেগম শুয়ে আছে।আর কুশান তার মেয়েকে নিয়ে অন্য আরেকটা বেডে।
কুশানের চোখে এক ফোঁটা ঘুম নাই।সে তার মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে ধীরে ধীরে উঠে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করার জন্য নামায পড়লো।মুনাজাতে সে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

আল্লাহ, আমার ঘরে এখন চাঁদের আলো।আপনি আমাকে মন খুশি করে এক রাজকন্যা উপহার দিয়েছেন।যার জন্য আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতঙ্গ থাকবো।
একটা সময় আমি একা ছিলাম।তারপর আমার হাতে হাত রেখে একটি মেয়ে আমার সব বাউন্ডুলেপনাকে কঠিন নিয়মের মধ্যে নিয়ে এলো। সেই থেকে স্বপ্ন আমার একটা পূর্ণাঙ্গ সংসার হবে। অর্থাৎ আমাদের সন্তান হবে। আপনি আমার সেই আশাটাও পূরন করলেন।এখন আমার আরেক টা আশা আমি যেনো আমার নিজের ফ্যামিলির সন্ধান পাই।

কে আমার আসল মা, কে আমার আসল বাবা, আমি তাদের কে দেখতে চাই।আজ আমি বাবা হয়েছি,তোড়া হয়েছে মা।বাবা মা হওয়ার অনুভূতি টা আমরা দুইজনই বুঝতে পারছি।আমি যার গর্ভে ছিলাম সেই গর্ভধারিণী মাকে দেখার আমার ভীষণ ইচ্ছা আল্লাহ। একটা সন্তান হতে কত কষ্ট সহ্য করতে হয় মা দের তা আমি নিজের চোখে দেখেছি।

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৪১

আমার মাও তো আমাকে জন্ম দিতে এতোটাই কষ্ট সহ্য করেছে। সেই মাকে একবার জড়িয়ে ধরে তার পায়ে সালাম করতে চাই আমি।আর আল্লাহ আমার আম্মু (কামিনী) যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তাকে ক্ষমা করে দিয়েন আল্লাহ। আমার আম্মুকে আপনি সবসময় সুস্থ রাখিয়েন।উনি আমাকে জন্ম না দিলেও নিজের মায়ের মতো এতো ভালোবাসা দিয়ে আমাকে বড় করেছেন যে আমি কখনো বুঝতেই পারি নি তিনি আমার আম্মু নন।তার সুস্থতা সবসময় কাম্য করি আমি।

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৪৩