আমি ফাইসা গেছি শেষ পর্ব 

আমি ফাইসা গেছি শেষ পর্ব 
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

আন্টিকে হঠাৎ করে কিভাবে সরাসরি মা বলে ডাকা যায়?এতোদিন কুশান যাকে আন্টি বলে ডেকেছে আজ হঠাৎ করে তাকে মা বলে ডাকতে ভীষণ ইতস্তত বোধ করতে লাগলো কুশান। সেজন্য কুশান জামিলার দেখা পেয়েও বোবাগুলোর মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।অথচ মনে মনে জামিলার প্রতি তার ভালোবাসা যেনো উপচে উপচে পড়ছে।সে এতোদিন ভেবেছে যেদিন তার মায়ের সাথে ফাস্ট দেখা হবে সেদিন তাকে সাথে সাথে বুকে জড়িয়ে ধরে মা মা বলে ডাকবে।তার পায়ে পড়ে কামিনীর হয়ে ক্ষমা চাইবে।কিন্তু আজ সবকিছু উলটো হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে জামিলা বুঝতে পারলো কুশানের মনের অবস্থা। কুশান যে তাকে মা বলে ডাকতে লজ্জাবোধ করছে এটা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার।সেজন্য জামিলা নিজেই কথা বললো কুশানের সাথে।
জামিলা জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি কেমন আছো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কুশান উত্তর দিলো জ্বি ভালো আছি।তারপর আর কুশান নিজের থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না।সে কিছু বলতে ধরে বার বার আটকে যাচ্ছে।কুশান সেজন্য আজ নিজেই নিজেকে চিনতে পারছে না।সে বুঝতে পারছে না এমন কেনো হচ্ছে তার সাথে?কেনো সে জামিলার সাথে কথা বলতে পারছে না?
জামিলা কুশানের এমন নিশ্চুপতায় ধরে নিলো নিশ্চয় কুশান তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারে নি।সেজন্য জামিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

বাবা কুশান!তুমি আমাকে আন্টি বলেই ডাকো বাবা।তবুও কথা বলো আমার সাথে।তোমার কথা শোনার জন্য আমার বুকটা একদম ফেটে যাচ্ছে।তোমাকে মা বলে ডাকতে হবে না বাবা।আমি তোমাকে বড় করি নি ঠিক আছে কিন্তু জন্ম তো দিয়েছি।সেই হিসেবে একটু তো অধিকার আমার আছেই।প্লিজ বাবা কিছু বলো।

কুশান জামিলার মুখে এরকম কথা শুনে একদম কেঁদেই ফেললো।সে সাথে সাথে জামিলাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
মা এসব কি বলছেন?মা তো মা ই।মা কে আবার কেউ আন্টি বলে ডাকে নাকি।পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ডাক হলো মা। মায়ের কোনো তুলনা হয় না।দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না আপনি।আমি আপনাকে মন থেকেই মেনে নিয়েছি।আসলে এতো দিন ধরে শুধু একজনকেই মা ডেকে আসছি।সেজন্য হঠাৎ করে তাকে বাদ দিয়ে আপনাকে মা ডাকতে ভীষণ শঙ্কা লাগছে আমার।তাই বলে ভেবে নিয়েন না আপনাকে আমি অস্বীকার করছি।

আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, আমাকে দেখাশোনা করানো, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা- সব অন্য মায়ের হাতে হলেও আপনি যে আমার গর্ভধারিণী মা এটা তো কখনোই অস্বীকার করতে পারবো না।
জামিলা কুশানের মুখে এরকম কথা শুনে নিজেও কাঁদতে লাগলো।কুশান যে তাকে এতো সহজে মেনে নিবে সত্যি জামিলা বুঝতে পারে নি।

মা আর ছেলে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলো।মনেই হচ্ছে না তাদের আজ মা ছেলের ফাস্ট আলিঙ্গন এটা।কেমন যেনো স্পর্শ টা চেনা চেনা লাগছে দুইজনের ই।মনে হচ্ছে কত বছর ধরে চেনা পরিচয় তাদের।আসলে মায়ের সঙ্গে সন্তানের এই মধুর সম্পর্ক টা যে সৃষ্টির শুরু থেকেই।এই সম্পর্ক কখনো ভোলার নয়।
কুশান হঠাৎ জামিলার পায়ে ধরে বললো,

আপনি দয়া করে আমার কামিনী আম্মুকে ক্ষমা করে দিয়েন।মনের ভিতর ওনার উপর কোনো ক্ষোপ বা অভিমান রাখিয়েন না।প্লিজ আমার এই রিকুয়েষ্ট টা রাখিয়েন মা।
“ছিঃ বাবা। কি করছো?ওঠো।” এই বলে জামিলা কুশানকে তার পা থেকে নিজে ওঠালো আর বললো,

কামিনীর উপর আমার বিন্দুমাত্র অভিমান নাই বাবা।তাছাড়া এ ফ্যামিলির প্রতিটা সদস্য দের কাছে আমি আগে থেকেই ঋনি।তোমরা সবাই আমার মেয়েটাকে নতুন করে সংসার দিয়েছো।এখন আবার সুলেমান চৌধুরী আর জারিফ চৌধুরী কত পরিশ্রম করে আমাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করলো।ওনাদের কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নাই।
কুশান জামিলার কথা শুনে বললো,আপনি সত্যি অনেক ভালো একজন মানুষ। কত সহজে আম্মুকে ক্ষমা করে দিলেন।সত্যি আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি আপনার গর্ভে জন্ম নিয়ে।

জামিলা তখন বললো, তোমার কামিনী আম্মু কোথায়?ওনার সাথে আমি কথা বলতে চাই।নিশ্চয় উনি তোমার টেনশনে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছেন।উনি যে তোমাকে কত বেশি ভালোবাসেন তা আমি নিজের চোখেই দেখেছি।তুমি সেদিন অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় তোমার মাও সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে গেলো।সত্যি তুমি অনেক বড় ভাগ্যবান এমন মাকে পেয়ে।
কুশান জামিলার কথা শোনামাত্র তাকে কামিনীর কাছে নিয়ে গেলো।
এদিকে কামিনী ছেলেকে হারানোর ভয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।জারিফ চৌধুরী এতো করে শান্ত্বনা দিচ্ছে তবুও কামিনী কিছুতেই থামছে না।

কামিনী কে এভাবে কাঁদা দেখে জামিলা এগিয়ে এসে বললো,
আপনি এভাবে কাঁদছেন কেনো আপা?আপনার ছেলেকে আমি নিয়ে গিয়ে কি করবো?আমি তো শুধু ওকে জন্মই দিয়েছে।কিন্তু আপনি ওকে বড় করেছেন,ওর দেখভালো করেছেন।ওর উপর পুরো অধিকার শুধু আপনারই আপা।এভাবে কাঁদলে আপনার ছেলেটাও কিন্তু ভীষণ ভেঙে পড়বে।প্লিজ কাঁদবেন না।
কামিনী জামিলার কথা শুনে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করলো।তবুও দু চোখ বেয়ে বেয়ে বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে লাগলো কামিনীর।সে যে তার মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না।

কামিনীর চোখের পানি দেখে কুশান কামিনী কে জড়িয়ে ধরে বললো, আম্মু এখন প্লিজ একটু চুপ করো।তোমার চোখের পানি কিন্তু আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না।মানুষ মারা গেলেও তো এভাবে কেউ কাঁদে না।প্লিজ আম্মু।আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।এই তোমায় ছুঁয়ে কথা দিলাম।
কামিনী তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি খুশিতে কাঁদছি কুশান।শেষ মেষ তুই যে তোর মাকে ফিরিয়ে পেয়েছিস সেজন্য কাঁদছি।আমি তোকে হারানোর ভয়ে কাঁদছি না।আর তুই কি আমার নিজের সন্তান নাকি?যে তোকে জোর করে ধরে রাখবো আমি?যার সন্তান তুই তার সাথেই থাকবি এখন।

জামিলা বেগম কামিনীর কথা শুনে বললো,
আপা আমি আবারও বলছি আপনার কুশানকে নিয়ে আমি কি করবো?আপনার ছেলে আপনার কাছেই থাকবে।ওকে যে আমি ফিরিয়ে পেয়েছি,আর ও আমাকে মা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে এটাই অনেক বড় পাওয়া আমার কাছে।এর থেকে বেশি কিছু চাই না আমি।
কামিনী সেই কথা শুনে বললো, আপনি বললেই হবে নাকি?সারাজীবন আমি শুধু স্বার্থপর দের মতো নিয়েই যাবো।আপনার সন্তান এখন থেকে আপনার কাছেই থাকবে।যা কুশান,তুই তোর মায়ের সাথে চলে যা।
কুশান তার দুই মায়ের কথা শুনে বললো,

তোমরা প্লিজ এবার একটু দুইজনই চুপ থাকো।আমি কারো সাথেই যাবো না।না আমি কামিনী আম্মুর সাথে এ বাড়িতে থাকতে চাই না আমি জামিলা মায়ের সাথে তার বাড়ি যেতে চাই।আমি আমার বাড়ি থাকবো আজ থেকে।আর তোমরা দুইজন আমার সাথে থাকবে।যেহেতু আমি তোমাদের দুইজনেরই ছেলে হই সেজন্য ছেলে হিসেবে তোমাদের দুইজনের প্রতিই আমার কিছু দায়িত্ব আছে।আর আমার প্রথম আর প্রধান দায়িত্ব হলো তোমাদের দুইজনকে একসাথে নিয়ে একবাড়িতে বসবাস করা।

জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো, কি বলছিস এসব কুশান?কোথায় থাকতে চাচ্ছিস তুই?আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবি? শুধু মায়েদের কথাই বললি।আমরা কার কাছে থাকবো?
কুশান সেই কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো, আব্বু তুমিও কি মেয়ে দুই টার মতো পাগল হয়ে গেলে?আমি কাউকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।আমরা সবাই মিলে এক বাসাতেই থাকবো।

জামিলা সেই কথা শুনে বললো কিন্তু কুশান আমি তোমাদের সাথে এ বাড়িতে থাকতে পারি না।আমার নিজস্ব একটা পরিচয় আছে।আমি সেখানেই থাকতে চাই।তুমি আগে যেখানে ছিলে সেখানেই থাকো।
কুশান সেই কথা শুনে বললো, তাহলে মনে হয় আপনি নিজেই আমাকে মন থেকে মেনে নেন নি মা।যদি মন থেকে মেনে নিতেন তাহলে এমন কথা বলতেন না।

“না মানে,,।আমি সেভাবে বলি নি বাবা।তুমি মন খারাপ করো না।আমি আসলে বলতে চাচ্ছি,,,,”
“” আমি এতো কথা শুনতে চাই না।আমি আমার দুই মা, আব্বু,নানু,আমার স্ত্রী সন্তান সবাইকে নিয়ে এক বাড়িতেই থাকবো।আর এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।”

এদিকে বাহিরে সবাই কুশানের নতুন মাকে দেখার জন্য ভীড় ধরে আছে।কুশান আর দেরী না করে জামিলাকে সবার সাথে পরিচয় করে দিলো।সে মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার দুই মাকে দুই পাশে নিয়ে সবাইকে তার মনের অনুভূতি সম্পর্কে জানালো।তারপর তার বোন জারাকেও পাশে নিলো।জারা যখন জানতে পারলো কুশান তার আপন ভাই সে তার নিজের খুশিকে ধরে রাখতে পারলো না।কারন সে নিজেকে ভীষণ দুঃখী আর নিঃসঙ্গ মেয়ে মনে করতো যার এই দুনিয়ায় মা ছাড়া কেউ নাই।সে সবসময় আফসোস করতো ইসঃ তার যদি একটা বাবা থাকতো,

না হয় একটা ভাই বা বোন থাকতো।আজ কুশানকে ভাই হিসেবে পেয়ে জারা এতো বেশি খুশি হলো যে সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ভাইয়া আমি অনেক বেশি খুশি হইছি।আমি সত্যি বোঝাতে পারছি না কি পরিমান খুশি হইছি আমি।এই বলে সে কুশানকে জড়িয়েও ধরলো।কুশান নিজেও জারাকে বোন হিসেবে পেয়ে ভীষণ খুশি হলো।কুশান এবার শ্রাবণ এর সামনে গিয়ে বললো,

জারা কিন্তু আপন বোন হয় আমার।সেই হিসেবে তুমি কিন্তু আমার আপন দুলাভাই হও।বোনটার যত্ন করিও ভালো করে।এতোদিন যা যা করেছো সবকিছু ভুলে যাও।
শ্রাবণ কুশানের কথা শুনে জারার দিকে তাকালো।কারন শ্রাবণ ভেবেছে জারা নিশ্চয় তার নামে কম্পিলিন করেছে।তা না হলে এভাবে বলছে কেনো কুশান।

কুশান শ্রাবনকে এদিক ওদিক তাকানো দেখে বললো দুলাভাই চলেন এখন,আমার বোনের পাশে দাঁড়ান।এখন কয়েকটা ফ্যামিলি ফটো তোলা হবে।এই বলে শ্রাবণ কে জারার পাশে দাঁড় করালো কুশান।অন্যদিকে ইরা,মিরা,লিরা কে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে কুশান বললো, আপুরা?তোরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?যা আম্মুর পাশে গিয়ে দাঁড়া।ইরা,মিরা,লিরা সেই কথা শুনে বললো, ভাই আমরা তো তোর নিজের বোন নই।তুই তো এখন নিজের মা বোন সবার খোঁজ পেয়ে গেছিস।আমাদের কে কি আগের মতো আর ভালোবাসবি?

কুশান সেই কথা শুনে বললো না বাসবো না।তোদের কি কি কোনো কালে আমি ভালোবেসেছিলাম?
“এভাবে বলতে পারলি ভাই?”
“তো কিভাবে বলবো?তোরা যেভাবে কথা বলছিস আমিও সেই ভাবেই কথা বললাম।এখন বেশি কথা না বলে চুপচাপ আম্মুর পাশে গিয়ে দাঁড়া।আর দুলাভাই রা কই?
পিছন দিক থেকে তখন তিন ভাই একসাথে ডাক দিলো,এই যে আমরা এখানে।
কুশান তখন তার বোন আর দুলাভাইদের ও দাঁড় করালো।
কুশান এবার সবার উদ্দেশ্যে বললো,

আজকের দিনের এই খুশির মুহুর্ত টুকু আমি আমার আব্বু আর নানুর নামে উৎসর্গ করলাম।কারণ তারা না থাকলে আজকের এই মুহুর্ত টা কখনোই আসতো না।আমার আব্বু আর নানু সবসময় এভাবে আমার মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। তারা কখনোই আমাকে কাঁদতে দেন নি।আমার মন খারাপ হলেই তারা আমার মন ভালো করার জন্য সবসময় উঠেপড়ে লেগেছেন।
সোলেমান চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো, হইছে তোর প্রশংসা করা?যদি হয়ে থাকে তাহলে এবার তোর আসল খুশির মানুষ কে নিয়ে আয়?কই সে?তাকে কেনো দেখছি না?তাকেও ডেকে আন।

স্বর্ণা তখন কুশানের মেয়েকে এগিয়ে এনে বললো, এই যে এখানে।তোমরা সবাই আমাদের কথামনিকে তো একদম ভুলেই গেছো।
কুশান তার মেয়েকে দেখামাত্র দৌঁড়ে চলে গেলো স্বর্ণার কাছে।আর ওর কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে ইচ্ছামত কয়েকটা চুমু খেয়ে বললো,
আমার আরেকজন খুশির মানুষ। যে দুনিয়ায় আসার সাথে সাথে আমি নিজে এতো টা চেঞ্জ হইছি যে, আমার এখন সমস্ত ভাবনা আমার মেয়েকে নিয়েই।

কামিনী আর জামিলা একসাথে এগিয়ে এসে বললো, দে আমার কোলে দে মনাকে।
কুশান দুইজনকে একসাথে আসা দেখে একবার কামিনীর দিকে তো আরেকবার জামিলার দিকে তাকাতে লাগলো।এখন সে কার কোলে দেবে তার মেয়েকে।
জামিলা তখন বললো, আচ্ছা তোমার আম্মুর কোলেই দাও ওকে।কামিনী তা শুনে বললো, না, না,কুশান।তোর মায়ের কোলেই দে।
কুশান এখন কার কোলে দেবে মেয়েকে সেটাই ভাবতে লাগলো।তখন জারিফ চৌধুরী এগিয়ে এসে বললো,
তোমরা দুইজনই হাত পাতো।

“কেনো?”
“আরে পাতো আগে হাত।তারপর বলছি।”
কামিনী আর জামিলা একসাথে হাত পাতলে কথামনিকে দুইজনার হাতের উপর রাখলো জারিফ চৌধুরী।আর বললো, আজ আমাদের কথামনি দুইজন দাদীর কোলে একসাথেই থাকবে। এই ক্যামেরা ম্যান ক্লিক ক্লিক করে কয়েকটি ছবি উঠিয়ে দাও তো।

সবাই জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে একদম হো হো করে হেসে উঠলো।
কুশান হঠাৎ করে খেয়াল করলো এতো মানুষের ভীড়ে সবাই থাকলেও তোড়া তো নেই।তোড়া আবার কোথায়?কুশান তখন সবাইকে রেখে তার রুমে চলে গেলো।রুমে গিয়ে দেখে দিনের বেলাতেও রুম একদম অন্ধকার।জানালার পর্দা গুলো টেনে রাখা।কুশান তখন তোড়া তোড়া বলে চিৎকার করতে লাগলো।ঘর এমন অন্ধকার দেখে ভয়ে তার শরীর একদম শুকিয়ে গেলো।

কুশান তখন বেলকুনিতে চলে গেলো।গিয়ে দেখে তোড়া বেলকুনিতে একা একা দাঁড়িয়ে আছে।তোড়াকে দেখামাত্র কুশান ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
পুরো ঘর অন্ধকার করে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো তোড়া?বাহিরে সবাই কত আনন্দ করছে আর তুমি একা একা দাঁড়িয়ে আছো?
তোড়া তখন উত্তর দিলো,

আমার কে আছে?যে আমি সবার সাথে গিয়ে আনন্দ করবো?কেউ কি আমার একবারের জন্য খোঁজ নিয়েছিলে?
কুশান তোমার এমন অভিমান মাখা কথা শুনে বললো,সরি।একদম ভুলে গিয়েছিলাম।এই মায়ে দের চক্ররে পড়ে সত্যি ভুলে গিয়েছিলাম।চলো এখন প্লিজ।
“না,যাবো না আমি।” এই বলে তোড়া বিছানায় গিয়ে শুইলো।”
কুশান তা দেখে নিজেও তোড়ার পিছু পিছু চলে গেলো।আর একলাফে সেও তোড়ার পাশে শুইলো।আর তোড়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

তুমি হলে আমার অভিমানী বউ।একটুতেই তুমি রেগে যাও।তোমার মান ভাঙাতে এখন আমার এক যুগ কেটে যাবে।তবুও তোমার অভিমানী মনের বরফ আমি গলাতে পারবো না কিছুতেই।প্লিজ সোনা নিজের থেকে তোমার অভিমানের বরফ টুকু গলিয়ে নাও না।আজ যে আমার তোমার অভিমান ভাঙার একটুও সময় নাই।হাতে সময় থাকলে এতো রিকুয়েষ্ট করতাম না কিন্তু।অন্যভাবে রাগ ভাঙিয়ে নিতাম।
তোড়া কুশানের কথা শুনে অন্য পাশ হলো।
কুশান তখন তোড়াকে পাশ ফিরিয়ে বললো,

প্লিজ তোড়া।এরকম করো না।তা না হলে কিন্তু জোর করে নিয়ে যাবো।
তোড়া এবার রাগ করে উঠে যেতে ধরলে কুশান ওর হাত টেনে ধরে বললো,
সময় টা অনেক খারাপ যাচ্ছে।ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছু করতে পারছি না।শুধু দিন আসতে দাও,তারপর খেলা দেখাবো।এই বলে কুশান জোর করেই তোড়াকে কোলে ওঠালো।
তোড়া তা দেখে চিৎকার করে বললো, কুশান ছেড়ে দাও।বাহিরে এতো লোকের মধ্যে তুমি আমাকে কোলে করে নিয়ে যাবে?

“হ্যাঁ যাবো।তুমি তো এটাই চাচ্ছো।”
“” নামিয়ে দাও আমাকে।আমি একাই যাচ্ছি।”
“না,দেবো না।”
এই বলে কুশান তোড়াকে কোলে করেই সবার মাঝে নিয়ে গেলো।
তোড়াকে এরকম কোলে করে আনা দেখে সবাই দৌঁড়ে গেলো কুশানের কাছে।আর জিজ্ঞেস করতে লাগলো কি হয়েছে তোড়ার?

তোড়া কিছু না বললেও কুশান বললো, ও পায়ে ব্যাথা পেয়েছে।সেজন্য আসতে পারছিলো না।কিন্তু আজ এতো বড় একটা খুশির দিনে ও ঘরে থাকবে সেটা কি মানা যায়?সেজন্য নিয়ে আসলাম।এই ক্যামেরাম্যান ছবি ওঠাও।আর তোমরা সবাই যে যার জায়গায় আবার দাঁড়িয়ে যাও।
এতোক্ষনে ফ্যামিলিটা কম্পিলিট হলো।
তোড়া এবার ফিসফিসিয়ে বললো,এই মিথ্যা কথাটা বলার শাস্তি কিছুক্ষন পর টের পাবে তুমি।যখন ব্যাথায় হাত টনটন করবে তখন কি করবে?তখন তো ঠিক নামিয়ে দেবে।

“সেটা পরে দেখা যাবে।এখন চুপচাপ ক্যামেরার দিকে তাকাও।
হঠাৎ কুশানের সায়কের দিকে নজর গেলো।এই খুশির দিনে সোনিয়া আর সায়কের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করলে কিন্তু মন্দ হয় না।যেই ভাবা সেই কাজ।কুশান এবার তোড়াকে নামিয়ে দিলো।
তোড়া তখন বললো, হাত লেগে গেছে নাকি?পাঁচ মিনিটও রাখতে পারলে না?

“শুধু মিনিট না,আমার যতক্ষন জীবন আছে ততোক্ষনই ধরে রাখতে পারবো তোমায় কিন্তু এখন আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।এই বলেই কুশান জারিফ চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে ব্যাপার টা জানালেন।জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো,
ওদের প্রেমের কথা প্রকাশ করার কোনো দরকার নাই।আমি ঘটকের মাধ্যমে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিবো।সবাই ভাববে এই বিয়েটা প্রস্তাবের মাধ্যমেই হয়েছে।
“” আব্বু তোমার এতো বুদ্ধি?”

“যে ফ্যামিলিতে যে নিয়ম।তোর নানু এসব প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করে না।উনি শুনলে রাগ করবেন ভীষণ। এজন্য এ বুদ্ধি।তোর বিয়ে টাও কিন্তু আমি এভাবেই দিয়েছি।”
“মানে?” তুমি আগে থেকেই জানতে তোড়ার কথা?
“তো কি মনে হয় তোর?তোড়াকে দেখতে যাওয়া কাকতালীয় ভাবে হয়েছে?
কুশান একদম হা হয়ে গেলো।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো,তুই লুকিয়ে তোড়ার সাথে প্রেম করছিস,ওর সাথে রোজ রোজ কথা বলেছিস,আবার ওর সাথে দেখা করতেও গিয়েছিস,

সব জানি আমি।তুই যেমন এসব কাজ লুকিয়ে লুকিয়ে করেছিস আমিও তেমন লুকিয়ে লুকিয়েই সব ব্যবস্থা করেছি।
কুশান সেই কথা শুনে বললো, তুমি লুকিয়ে সবকিছু না করে অন্তত আমাকে জানাতে পারতে ব্যাপার টা। তাহলে তোড়ার পরিবারের লোকজন কে সেদিন ওভাবে অপদস্ত হতে হতো না।তুমি নিজেও তো ওয়াশ রুমে যেতে যেতে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছিলে।

জারিফ চৌধুরী তখন হাসতে হাসতে বললো কে জানতো তোরা লুকিয়ে লুকিয়ে আবার এই ফন্দি এঁটেছিস?সেদিনের কথা মনে হলে আর এভাবে লুকিয়ে কোনো প্রেমিক যুগল কে মিলিয়ে দিতে ভীষণ ভয় লাগে আমার।
কুশান জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে একদম হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো।অনেকদিন পর তার মুখে এরকম হাসি দেখা গেলো।
প্রস্তাবের মাধ্যমে সায়ক আর সোনিয়ার বিয়ে হয়ে গেলো।এদিকে সোনিয়ার বিয়ে হওয়ার পর থেকে স্বর্ণা আর সুমনের মধ্যে একটা ভাব গড়ে উঠলো।

জারিফ চৌধুরী যখন এদের প্রেমের ব্যাপার টা জানতে পারলো তখন তিনি আবার আরেকটা ফন্দি আঁটলেন কিভাবে এই দুই জুটিকে মিলাতে পারবেন।
আসলে জারিফ চৌধুরী প্রেম ভালোবাসাকে ভীষণ সাপোর্ট করেন।তিনি মনে করেন যে যাকে ভালোবাসে তার তাকেই বিয়ে করা উচিত।ভালোবাসার মানুষের সাথে বিয়ে হলে সেই কাপলদের আর আলাদা করে সুখ খুঁজতে হয় না।ভালোবাসার মানুষ কে বিয়ে করার মাঝে আছে আলাদা রকমের একটা তৃপ্তি। যেহেতু আগে থেকে তাদের চেনা পরিচয় থাকে নতুন করে কাউকে চিনতে হয় না আর জানতেও হয় না।

জারিফ চৌধুরী আর শায়লা দুইজন দুইজনকে ভীষণ ভালোবাসতো।কিন্তু তাদের ভালোবাসা কেউ সাপোর্ট করে নি বা তাদের কেউ হেল্পও করে নি।শায়লা মেয়েটার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়।
সেজন্য জারিফ চৌধুরী প্রতিটা কাপলদের মিলিয়ে দিলে যেনো অন্য রকম এক শান্তি খুঁজে পান।তার হারানো ভালোবাসাকে প্রতিটা কাপলদের মাঝে তিনি দেখতে পান।

দেখতে দেখতে কথামনির ছয় বছর পূর্ন হলো।সে সারাক্ষন এখন চিল্লায়ে চিল্লায়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রাখে।কুশানের মেয়ে এতো বেশি জেদি আর রাগী হয়েছে যে বাড়ির প্রতিটা সদস্য কে সে দৌঁড়ের উপর ই রাখে সবসময়।কুশান আর তোড়ার কোল জুড়ে আরো একজন ছেলে সন্তান এসেছে।যে দেখতে অবিকল কুশানের মতোই হয়েছে।বড় হলে কেমন হবে সেটা এখনি বলা যাচ্ছে না।তবে মেয়ে যে পুরোপুরি তোড়ার মতো হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

কুশান যখন তার একজন মা কে ডাকে তখন একসাথে তিনজন মা চলে আসে।সেজন্য কথামনি কুশান কে বলে,
বাবা তুমি বড্ড বোকা।তোমার একটুও বুদ্ধি নাই।আমি শিখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।যখন তুমি আমাকে ডাকবে তখন বলবে আমার লক্ষী মা কোথায়?আর যখন দাদীদের ডাকবে তখন বলবে আমার এক নাম্বার মা কোথায় আর আমার দুই নাম্বার মা কোথায়।

কুশান তার মেয়ের কথামতো সেভাবেই ডাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু কামিনী আর জামিলা দুইজনই এক নাম্বার মা হতে চায়।কেউ আর দুই নাম্বার মা হতে চায় না।কুশান পড়ে গেলো আবার বিপদে।
কথামনি তখন জানিয়ে দেয় বাবা তাহলে শুধু তাকেই মা বলে ডাকবে।তোমাদের কাউকে মা বলে ডাকার প্রয়োজন নাই তার।কারণ তোমরা পুরাতন হয়ে গেছো।নতুন জিনিস দের কদর সবসময় বেশি।আমিই এখন বাবার একমাত্র মা। তাই না বাবা?

কুশান মেয়ের মন রক্ষার জন্য মাথা নাড়ে।কারণ সে যদি তার কথার অবাধ্য হয় তাহলে সারাদিন রাত ধরে চলবে তার অভিমান ভাঙানোর পালা।তবুও তার অভিমান ভাঙবে না।
কথামনি শুধু তার দাদীদের জায়গায় দখল করে নেয় নি,সে তোড়াকে পর্যন্ত কুশানের কাছে আসতে দেয় না।কথামনি সারাক্ষন কুশানের সাথেই থাকে।

এমনকি রাতেও কুশানের গলা জড়িয়ে ধরেই সে ঘুমায়।কুশান অপেক্ষা করে কখন তার মেয়ে ঘুমিয়ে যাবে আর সে চুপি চুপি তোড়ার পাশে চলে যাবে।কিন্তু সেটা আর হয় না কখনো।কথামনি ঘুমিয়ে গেলে কুশান ধীরে ধীরে তাকে সরাতে ধরলে সে কুশানকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়।এদিকে তোড়া রাগ করে ফুলে থাকে।মাঝে মাঝে সে কাঁদতে কাঁদতে বলে মেয়েকে পেয়ে আমাকে একদম তুমি ভুলেই গেছো।খবরদার আমার কাছে আর কখনোই আসবা না।

কুশান যে তোড়ার রাগ ভাঙাবে সে সুযোগ টাও দেয় না তার মেয়ে।তোড়ার সাথে সে আর আগের মতো একাকি সময় কাটাতেও পারে না।যখন জারিফ চৌধুরী নাতি নাতনিদের নিয়ে একটু বাহিরে বেড়াতে যায় তখন একটু সময় পায় তোড়া কুশান।তখন আবার জামিলা আর কামিনী গল্পের আসর বসায় কুশানের সাথে।

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৪৪

কারন তারাও যে আর আগের মতো কুশানের সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না।কারণ কুশানকে এখন তার মেয়ের সাথে সবসময় খেলতে হয়,তাকে গল্প শোনাতে হয়,তার প্রশ্নের জবাব দিতে হয়।অন্য কাউকে সে সময় দিতেই পারে না।
এভাবেই চলছে কুশানের জীবন।

সমাপ্ত