আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৪৪

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৪৪
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

যেকোনো মানুষের জীবনে বাবা মা এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। মা এর ভালোবাসা এর মধ্যে কোনো ভেজাল নেই, নেই কোনো মলিনতা। যেকোনো পরিস্থিতি হোক না কেন মায়েরা সবসময় তাদের সবকিছু বিলিয়ে দেয়।মা ‘শব্দটির মধ্যে আছে এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি ; এক অনাবিল শান্তি ।

তবে পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে যাদের মা ছাড়া জীবন যাপন করতে হয় তাদের মতো অসহায় এবং দুর্ভাগা মানুষ বুঝি আর হয় না । মা ছাড়া জীবন এককথায় শুষ্ক মরুভূমির মতো ,জলহীন সমুদ্রের মতো ও বায়ুহীন প্রকৃতির মতন।মায়ের কোল যে কত বিশাল একটি আশ্রয় তা একজন যোগ্য সন্তান ছাড়া আর কেউ বোঝে না। আর সেই মা ‘কে ছাড়া যখন থাকতে হয় তখন এক মুহূর্তও হয়ে ওঠে দুর্বিষহ আর শ্বাসরুদ্ধকর ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কুশানকে যদিও তার মাকে ছাড়া অসহায় আর দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয় নি তবুও এতো দিন পর নিজের মায়ের খোঁজ পেয়ে জীবন টা কেমন যেনো খাঁ খাঁ করতে লাগলো তার।পুরো জীবনটাই যেনো ব্যর্থতায় ভরা মনে হচ্ছে।এটা কি হলো তার সাথে?যাদের কে এতোদিন সে আপন ভেবে আসলো তাদের সাথে কুশানের যে রক্তের কোনো সম্পর্কই নেই।আর যে মানুষ টিকে সে জানে না,ভালোভাবে চেনে না,দুই একদিন দেখা হয়েছে মাত্র সেই জামিলাই নাকি তার গর্ভধারিণী মা হয়।
সোলেমান চৌধুরীর মুখে সত্য টা জেনে কুশানের পায়ের তলার মাটি যেনো সরে যেতে লাগলো।সে আকাশের পানে চেয়ে ভাবতে লাগলো এমন টা তার সাথে না হলেও পারতো।

কুশানের সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে এই ভেবে যে তার মায়ের সন্ধান পেয়েও একটিবার তার পা জড়িয়ে ধরে কান্না করারও সৌভাগ্য হলো না তার।বা একটিবার তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারছে না,
আমাকে ক্ষমা করে দিও মা,তোমার খারাপ দিনগুলো তে তোমার পাশে থাকতে পারি নি আমি।জীবনের কঠিন মুহুর্ত গুলো তোমাকে একা একা পার করতে হয়েছে।অন্যদিকে কুশানের বাবা, মানে জামিলার হাজব্যান্ড তিনি কিছুদিন হলো মারা গিয়েছেন।

কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে তাকে মৃত্যু বরন করতে হয়েছে। এটা অবশ্য তার পাপের শাস্তিই ধরা যায়।তিনি জামিলার সাথে অনেক বেশি অন্যায় করেছেন।সংসার জীবনে সুখী ছিলো না জামিলা বেগম।সারাদিন কটু কথা শোনানোর পাশাপাশি কুশানের বাবা জামিলাকে মারধরও করতেন।সেজন্যই তো কুশানের বাবার সাথে জামিলার ছাড়াছাড়ি হয়েছে।জীবনের এই কঠিন সংগ্রামে জামিলা নিজেই নিজেকে আজ প্রতিষ্ঠিত করেছে।তবে এর জন্য তাকে অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।কিন্তু আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েও যেনো জামিলা আবার প্রকৃতির কাছে হেরে গেলো।নিজের ছেলের পরিচয় জেনেও তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারছে না বাবা আমিই তোর অভাগী মা হই,যে তোকে আগলে রাখতে পারে নি।

কুশান তার মা বাবার কথা মনে করে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছে।তার বাবা মার জীবন টা কত কষ্টের ছিলো।বিশেষ করে তার মায়ের জীবন টা সবচেয়ে বেশি কষ্টের ছিলো।আর কুশান কত আভিজাত্যের মধ্যে বড় হয়েছে।অভাব,দুঃখ, কষ্টের ছিটাফোঁটাও তার শরীরে লাগতে দেয় নি জারিফ চৌধুরী আর কামিনী চৌধুরী। তার নানু সুলেমান চৌধুরী তো আদর করে সব সম্পত্তি তার নামে অনেক আগেই করে দিয়েছে।আর এদিকে তার নিজের মা কত দূর্বিষহ জীবন পার করেছে।

এখন আবার জামিলা জেলে আছে।সেলিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এট্যাক করায় জামিলার জেল হয়েছে।সে ছেলে হয়েও কিছুই করতে পারলো না তার মায়ের জন্য।কুশান অনেক বেশি ভেঙে পড়লো।মেয়ে হওয়ার সুবাদে তার মনের সকল দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা নিমিষেই দূর হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু নতুন করে আবার তার মন টা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।

তবে কুশানের চোখ দিয়ে একটুও জল বের হলো না আজ।কারণ তার বুকের ভিতর টা একদম জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো।একটু কাঁদলেই হয় তো তার যন্ত্রনা কিছুটা কমতো।কিন্তু আজ কেনো জানি তার একটুও পানি আসলো না চোখে।সে তার নানুর মুখে সব সত্যি কথা শুনেও একটি কথাও বললো না বরং তার নানুর রুম থেকে বের হয়ে সোজা নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো।
মেহমানরা এখনো আছে বাসায়।কুশানের মেয়েকে নিয়ে সবাই অনেক বেশি আনন্দ করছে।কুশানকে দেখামাত্র কামিনী ডাক দিয়ে বললো,

বাবা কুশান!এদিকে একটু আয় তো বাবা!
কুশান যেনো কামিনীর কথা শুনতেই পেলো না।কারণ সে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে আছে এখন।কামিনী তখন নিজে গিয়ে দাঁড়ালো কুশানের সামনে।আর কুশানের হাত ধরে বললো,
তোর নানু তোকে রুমে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে কি কথা বললো বাবা?
কুশান মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো কিছু বলে নি।
এই বলে সে তার রুমের ভিতর প্রবেশ করলো।সে কামিনীর দিকে তাকালোও না আবার তার সাথে কোনো কথাও বললো না।

কারণ কুশানের আজ কামিনীর উপর একটু অভিমান হলো।সে মনে করে কামিনী আর তার নানী অনেকটাই দোষী। তারা যদি সেদিন সেলিনার থেকে তাকে না কিনে নিতো তাহলে আজকের এই দিনটা দেখতেই হতো না।সে তার মায়ের সাথেই থাকতো।তার মা রাগ করে সেলিনাকে মারতেও যেতো না,আর তার মায়ের এতো বড় শাস্তিও হতো না।

পরক্ষনেই কুশান নিজে নিজেই হেসে উঠলো।কি স্বার্থপর ছেলে সে!যে আম্মু তাকে এতো ভালোবাসে,এতো আদর দিয়ে তাকে বড় করেছে আজ তাকেই সে অপরাধী ভাবছে।না,কেউ অপরাধী না।সব তার ভাগ্যেরই দোষ।
কুশানের মাথাটা যেনো একদম এলোমেলো হয়ে গেলো।নানা রকম চিন্তাভাবনা আসতে লাগলো মাথায়।
এদিকে কামিনী কুশানের এমন ব্যবহারে একদম হা হয়ে গেলো।তার ছেলে তাকে এভাবে এড়িয়ে যেতে পারলো?কেনো ভালোভাবে কথা বললো না কুশান এই টেনশনে কামিনী আবার নিজেই গেলো তার বাবার কাছে।

তোড়া মেয়েকে দোলনায় শুয়ে রেখে তার ড্রেসগুলো গুছিয়ে রাখছে।কারণ মেহমানদের অনেকেই তার মেয়ের জন্য ভালোবেসে রঙবেরঙের ড্রেস এনেছে।কেউ কেউ এনেছে হরেক রকমের খেলনা,সোনার আংটি পর্যন্ত দিয়েছে। গোলাপ সাহেব ভালোবেসে নাতনীর জন্য এক জোড়া ছোটো ছোটো স্বর্নের চুড়ি বানিয়ে এনেছে।অন্যদিকে সোলেমান চৌধুরী একটা স্বর্ণের চেইন গিফট করেছে।জারা আর শ্রাবন ও আংটি দিয়েছে কুশানের মেয়েকে।তারা নিজের হাতে পড়িয়েও দিয়েছে কথামনির হাতে।

তখন পাশ থেকে কেউ একজন হাসির ছলে বলেছে, ছেলের বউকে আংটি পড়িয়ে দিচ্ছে জারা আর শ্রাবণ। কথাটা হাসি আর ঠাট্টার ছলে হলেও জারা স্পষ্ট বলে দিয়েছে কুশান ভাইয়া আর তোড়া ভাবি যদি রাজি থাকে তাহলে এখনি ছেলের বউকে নিয়ে যাবো আমি।নিজের ছেলে আর বউকে একসাথে বড় করে বিয়ে দেবো।শ্রাবণ অবশ্য কিছু বলে নি।কারণ সে হাসি মশকরা তেমন একটা পছন্দ করে না।শ্রাবণের রাগান্বিত লুক দেখে জারা থেমে গেলো।সে আর কিছু বললো না।
কুশান রুমে প্রবেশ করেই তার মেয়ের দোলনার পাশে গিয়ে বসলো।আর দোল দিতে লাগলো।তারপর ঘুমন্ত মেয়েকেই চুমু দিতে ধরলে
তোড়া চিৎকার করে বললো,

এই? কি করছো?ঘুমন্ত অবস্থায় চুমু দিচ্ছো কেনো?এতে মেয়ে কিন্তু তোমার ভীষণ রাগী হবে।এমনিতেই তো তোমার মেয়ে একটু জেদি হবেই তা আমি আগে থেকেই আন্দাজ করতে পারছি।
কুশান তোড়ার কথা শুনেও কোনো উত্তর দিলো না।সে হঠাৎ দোলনার পাশেই ধপাস করে বসে পড়লো।
তোড়া তা দেখে বললো,

কি হলো কুশান?ওভাবে ফ্লোরে বসে পড়লে কেনো?মেয়েকে চুমু দিতে দিলাম না দেখে কি বুকটা ফেটে যাচ্ছে?ও কি সারাক্ষণ ঘুমাবে নাকি?একটু পড়েই উঠে যাবে।তখন ইচ্ছামতো চুমু দিও।
কুশান এবারও কিছু বললো না।
তোড়া তখন কাপড় গুছানো বাদ দিয়ে এগিয়ে এসে কুশানের ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো,

কুশান?কি হইছে তোমার?কোনো কথা বলছো না যে?এই বলে তোড়া কুশানের মুখ টি উপরে তুললো।কিন্তু কুশান তার মুখটি উপরে তুলতে দিলো না।তোড়া তখন নিজেও কুশানের সামনে গিয়ে বসলো।আর আবার জিজ্ঞেস করলো,কি হয়েছে তোমার?আমি সেই থেকে একাই শুধু বকর বকর করছি।তুমি কিছুই বলছো না।না,মেয়েকে পেয়ে আমাকে একদম ভুলেই গেলে।একদিনেই দেখি আমার জায়গা মেয়ে কেড়ে নিলো।
কুশান হঠাৎ তোড়াকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
এই জড়িয়ে ধরা ব্যাপারটা কিন্তু মারাত্মক সুন্দর।

মন খারাপে, রাগে, অভিমানে, ক্ষোভে প্রিয় মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলেই অনেকের এক নিমেশেই সকল মন খারাপ ভালো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে কোন যৌ*ন আবেদন ছাড়াও প্রিয় মানুষটাকে কাছে টেনে এভাবে জড়িয়ে ধরতে হয়।
এতে করে বিপরীত মানুষটাও অনুভব করতে পারে জীবনের যেকোন মুহূর্তে অন্তত কেউ একজন আছে যে তাকে শক্ত করে বুকের মাঝে আগলে রাখবেই।একটুখানি মানসিক প্রশান্তি হয়ে তার পাশে থাকবেই। এই অনুভূতি টুকো মানুষকে স্বস্তি দেয়, ভরসা যোগায়।

তোড়া বুঝতে পারলো কুশানের আবার মন খারাপ হয়েছে।সে নিশ্চয় কোনো একটা বিষয় নিয়ে ভীষণ টেনশন করছে।সেই টেনশন এতোটাই তীব্র যে তাকে মানসিক অশান্তির মধ্যে রেখেছে।
তোড়া তখন আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না কুশানকে।সে নিজেও কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে থাকলো কুশানকে।তারপর কুশানকে উঠিয়ে বেডে নিয়ে যেতে ধরলে কুশান বললো,

যদি তুমি কোনোদিন শোনো যে ফ্যামিলিতে তুমি বড় হয়েছো,যাদের কে বাবা মা বলে ডাকছো তারা তোমার আসলে নিজের কেউ নয়।আর যে মানুষ টাকে তুমি বাহিরের মানুষ ভেবে এসেছো,যাকে কোনোদিন নিজের আপনজন বলে কল্পনাও করো নি সেই যদি তোমার নিজের রক্তের সম্পর্কের হয় তখন তোমার মনের অবস্থা কেমন হবে তোড়া?একবার এই সিচুয়েশনে নিজেকে বসিয়ে দেখবে একটু?আমার কেনো জানি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

তোড়া কুশানের কথা শুনে বেশ আশ্চর্য হলো।কুশান কি তাহলে তার ফ্যামিলির খোঁজ পেয়েছে?তোড়া তখন বললো,
তুমি কার কথা বলছো কুশান?কে তোমার ফ্যামিলির লোকজন?
কুশান চোখ মুছতে মুছতে বললো জারা আমার আপন বোন।আমরা জমজ ভাই বোন তোড়া।আর জেলে বন্দি সেই জামিলা আন্টিই আমার মা হয়?

তোড়া কুশানের কথার কি উত্তর দেবে? আর সে কুশানকে কিভাবে শান্ত্বনা দেবে সে ভাষাই খুঁজে পেলো না।জামিলাই যে কুশানের নিজের মা তোড়া এটা কল্পনাও করে নি কখনো।এটা কিভাবে সম্ভব?তার মানে জামিলা এই কারণেই সেলিনাকে মারতে চেয়েছিলো।আজ দিয়ে পুরো ব্যাপার টা ক্লিয়ার হয়ে গেলো তোড়ার কাছে।
তোড়া এবার কুশানকে তার বুকের সাথে ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে রাখলো।আর কুশানকে বোঝাতে লাগলো সব ঠিক হয়ে যাবে কুশান।তুমি এতো বেশি চিন্তা করছো কেনো?তোমাকে চিন্তিত দেখলে সবার মন খারাপ হয়ে যাবে।নিজেকে শক্ত করো কুশান।জামিলা আন্টি ঠিক ছাড়া পাবে।আব্বু আর নানু তো চেষ্টা করছে?তাছাড়া তুমি কি ভাগ্যের উপর দিয়ে তোমার হাত বাড়াতে পারবে?সব ভাগ্যে লিখা ছিলো।তুমি তো নিজেও সবসময় এটাই বলো।

এরই মধ্যে আবার কামিনী সোলাইমান চৌধুরীর কাছে জানতে গিয়েছে সবকিছু।সোলাইমান চৌধুরী এখনি কামিনী কে কিছু বলতে চাইছিলো না।কিন্তু কামিনী এমন ভাবে জিদ ধরে বসলো যে সোলাইমান চৌধুরী কামিনী কে সবকিছু বলেই দিলো।
কামিনী সবকিছু শুনে নিজেও ভীষণ টেনশনের মধ্যে পড়ে গেলো।তার নিজের প্রতি এতো বেশি ঘৃণা হচ্ছিলো যে নিজেই নিজেকে চড় মারলো কয়েকটা।

এটা তারা কি করেছে?জামিলার মতো এরকম অসহায় একটা মেয়ের কোল তারা কি করে খালি করতে পারলো?আজ ছেলেটা তার কাছে থাকলে কিছুটা হলেও জামিলা সুখ ফিরে এতো।এই দুনিয়ায় স্বামী ছাড়া একজন মেয়ের বেঁচে থাকা আর নিজে উপার্জন করে চলাফেরা করা সত্যি অনেক বেশি সাহসের কাজ।তার উপর জারাকেও লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করতে হয়েছে তাকে।কামিনী কোন মুখ নিয়ে আর কুশানের সামনে যাবে।নিশ্চয় কুশান সবকিছুর জন্য তাকেই দোষারোপ করছে।এখন কি করে সে তার কুশানের মুখে হাসি ফোঁটাবে?কামিনী মনে মনে ভীষণ অসুস্থ হয়ে গেলো।কারণ এই অপরাধবোধ বার বার তার মনে জেগে উঠতে লাগলো।

সুলেমান চৌধুরী আর জারিফ চৌধুরী প্রানপন চেষ্টা করছে জামিলাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য।তারা যে করেই হোক কুশানের মুখের সেই হাসি ফেরত আনতে চায়।আগের সবকিছু ভুলে এখন অন্তত কুশান তার মায়ের সাথে যাতে থাকতে পারে এখন সেই ব্যবস্থায় করবে সবাই।

আজ কথামনির জন্মের সাতদিন হলো।আজকেই আকীকা সম্পন্ন করানোর কথা ছিলো তার।কিন্তু কুশানের মন ভালো নেই বিধায় অনুষ্ঠান পিছিয়ে নেওয়া হলো।সোলেমান চৌধুরী নিজে ঘোষণা দিলেন ২১ দিনের মাথায় আকীকা করানো হবে।কুশান সেই কথা শুনে বললো,
নানুভাই আমি ঠিক আছি।কিছুই হয় নি আমার।আপনারা ডেট পিছায়েন না।সাতদিনে করার কথা ছিলো সাতদিনের দিনই হবে আকীকা।
সোলেমান চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো,

তুই কি আমার থেকে বেশি বুঝিস?আমি ২১ দিনের দিনে করতে চাচ্ছি সেজন্য সেদিনই হবে।কুশান সেজন্য আর কোনো জিদ করলো না।সে চুপচাপ থাকলো।
এইভাবে দেখতে দেখতে ২১ দিনের দিন আসলো।অনেক মেহমান কে ইনভাইট করেছে সোলেমান চৌধুরী আর জারিফ চৌধুরী।কুশান বার বার বলেছিলো কোনো অনুষ্ঠান করতে চায় না সে।শুধুমাত্র কয়েকজন নিকটতম আত্নীয়স্বজনকে নিয়ে আকীকা সম্পন্ন করা হবে।কিন্তু সোলেমান চৌধুরী কিছুতেই শুনলো না সে কথা।তিনি বিরাট বড় অনুষ্ঠান এর আয়োজন করলেন।কুশান আর তোড়ার নতুন করে বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিলো সেটাও আর হলো না। সেজন্য কুশানের মেয়ের আকীকার অনুষ্ঠানে সমস্ত মেহমানদের ডাকা হলো।

কুশান রেডি হওয়া বাদ দিয়ে তার মেয়েকে কোলে করে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে।আর দূরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
তোড়া তা দেখে বললো কুশান মেয়েকে আমার কোলে দাও।আর তুমি রেডি হয়ে নাও।নানু ঝটপট রেডি হতে বললো।
কুশান তা শুনে বললো, নানু একটু বেশি বেশি করছে।উনি কি জানেন না আমার মন ভালো নেই।তারপরেও এতো বড় আয়োজন কেনো করেছেন উনি?আমার এসব ভালো লাগছে না তোড়া।তুমি রেডি হয়ে চলে যাও।আমি যাবো না কোথাও।এই বলে মেয়েকে তোড়ার কোলে দিয়ে বেলকুনি থেকে রুমের ভিতর চলে গেলো কুশান।
তোড়া আর কুশানকে কিছু না বলে মেয়েকে রেডি করে চামেলি বেগমের কোলে দিলো।আর সে কুশানের পাশে এসে বসলো।

কুশান অন্য মুখ হয়ে আছে তোড়া তখন বললো,
কুশান!তোমার খুশির জন্যই কিন্তু এই আয়োজন করা হয়েছে।যাতে সবাইকে দেখে তোমার কিছুটা হলেও কষ্ট দূর হয়।তোমার এমন গোমড়া মুখ দেখতে কারো ইচ্ছা করছে না কিন্তু।
কুশান সেই কথা শুনে বললো,

যাকে দেখলে আমি খুশি হবো এখন,যাকে দেখলে আমার সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যাবে সেই মানুষটিকেই কেউ হাজির করতে পারলো না।তখন অন্য মানুষ কে দেখে আমার মনে কি করে শান্তি ফিরে আসবে?
“তোমার বোন জারাও কিন্তু এসেছে।” তুমি ওর সাথে কথা বলেও তো নিজের কিছুটা কষ্ট দূর করতে পারো।”
“আমার মাকে দেখতে চাই আমি।তাকে এনে দাও তোমরা।না যদি আনতে পারো তাহলে আর কোনো কথা বলো না তোমরা।”
তোড়া কুশানের এমন মেজাজ দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলো না। সে চলে যেতে ধরলো।
কুশান তখন বললো,

আম্মু কই?আম্মু কেনো জানি আর আমার রুমে আসে না?
“কিভাবে আসবে তোমার রুমে?তুমি তার সাথে ঠিক করে কথা বলেছো এ কয় দিন?আসলে পর পরই হয়।যেই নিজের মায়ের খোঁজ পেলে আর সাথে সাথে তোমার এই আম্মুকে ভুলে গেছো।মানছি উনি অপরাধ করেছেন,কিন্তু উনি তো তোমাকে নিজের মায়ের মতো করেই বড় করেছেন।আর তুমি তাকে কথাও দিয়েছো কোনো দিন কষ্ট দিবে না,বা তাকে ছেড়ে যাবে না।”উনি যে অসুস্থ সেটা জানো?

কুশান তোড়ার কথা শোনামাত্র কামিনীর রুমে চলে গেলো। কামিনী রুমের মধ্যেই শুয়ে আছে।এ কয় দিন ধরে তার শরীর টা ভালো যাচ্ছে না।এতো টেনশনের মধ্যে কি ভালো থাকা যায়?
কুশানকে রুমে দেখামাত্র কামিনী উঠে বসলো।আর বললো,
বাবা তুই?কিছু বলবি?
কুশান কোনো কথা না বলে কামিনীর হাত ধরে বললো,
আম্মু ক্ষমা করে দিও আমাকে।আমি তোমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছি।তোমার খোঁজখবর পর্যন্ত রাখি নি।তুমি নাকি অসুস্থ।কি হয়েছে আম্মু তোমার।

কামিনী তা শুনে বললো,কিছু হয় নি বাবা।আমি ঠিক আছি।আর কিসের কষ্ট বাবা?তুই তো কোনো কষ্ট দিস নি আমাকে।কষ্ট তো আমি তোকে দিয়েছি।আমার জন্য তুই তোর নিজের মায়ের কাছে থাকতে পারছিস না।আমার জন্য তোর মা আজ জেলে।আমার কি শাস্তি হলে তুই খুশি হবি সেই শাস্তিই দে আমাকে।এই অপরাধবোধ নিয়ে আমি আর বেঁচে থাকতে পারছি না।নিজেই নিজেকে শেষ করার ইচ্ছা হচ্ছে আমার।
কামিনীর কথা শুনে কুশান তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললো, আম্মু প্লিজ চুপ করো।এভাবে বলো না তুমি।তোমার উপর সত্যি আমার কোনো রাগ নেই।

হঠাৎ জারিফ চৌধুরী রুমে প্রবেশ করলেন।আর কুশানকে বললেন,
বাবা কুশান আমরা তোকে কি দিয়েছি জানি না তবে আমাদের কারণেই যে তোর মাকে ছেড়ে তোকে এতোদিন থাকতে হয়েছে এটা তো আর মিথ্যা না।তুই মনে মনে আমাদের নিয়ে যেটাই ভাবিস না কেনো আমরা কখনোই তোর ক্ষতি চাই নি।তোর জীবন থেকে যে দিন গুলো হারিয়ে গেছে সেগুলো আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়,আমরা ইচ্ছা করলেও আর ফিরিয়ে দিতে পারবো না।তবে বাকি জীবন টুকু যাতে তুই তোর মায়ের সাথে কাটাতে পারিস তার জন্য তোর নানু আর আমি অনেক চেষ্টা করেছি।আর আজ আমরা সফলও।

কুশান জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে একদম চমকে উঠলো।
জারিফ চৌধুরী তখন বললো,জামিলা পাঁচ দিন আগেই ছাড়া পাইছে।আজকের দিনে অনুষ্ঠান করার একমাত্র উদ্দেশ্য তোর মায়ের সাথে সবার পরিচয় করে দেওয়া।তুই যে জামিলার ছেলে সেটা তোর নানু আজ সকল মেহমানদের সামনে ঘোষনা করতে চায়।

জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে কুশানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।এদিকে কামিনীও কাঁদছে।
জারিফ কামিনী কে কাঁদা দেখে বললো, তুমি আবার কাঁদতেছো কেনো?অন্যজনের ছেলেকে আর কত দিন নিজের নামে চালাতে চাও?এবার যার সন্তান তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দাও।খবরদার কান্দাকাটি করবে না।
কামিনী তখন বললো,

তুমিও তো কাঁদছো?তুমি কতদিন এভাবে অন্যজনের ছেলেকে নিজের বাড়ি রাখতে চাও।যার ছেলে তার হাতে স্বসম্মানে তুলে দাও।আমি নিজেও আর অন্যজনের ছেলে রাখতে চাই না এই বাড়িতে।
কুশান তখন চিৎকার করে বললো,
তোমরা প্লিজ চুপ করবে এবার।এরকম করতেছো কেনো তোমরা?আমি কখন বললাম আমি আর থাকবো না এই বাড়িতে আর কখন বলেছি তোমাদের অস্বীকার করবো।আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততোদিন পর্যন্ত তোমরাই আমার বাবা মা হয়ে থাকবে।আর কখনো যেনো শুনি না আমি এই কথা।

এবার সোলেমান চৌধুরী প্রবেশ করলো রুমে আর কুশানকে বললো, যা তোর মায়ের সাথে কথা বল।আর কামিনী তুই ও যা।জামিলার কাছে ক্ষমা চেয়ে নে।নিজের অপরাধ স্বীকার কর।আজকের এতোকিছু সব তোর জন্য হয়েছে।তোকে খুন করলেও আমার মনের দুঃখ যাবে না।
কুশান তখন বললো,

নানু!কি বলছো এসব?আম্মুকে বকছো কেনো তুমি?আম্মু কে বকবে না খবরদার।আর আম্মু কারো কাছে ক্ষমা চাইবে না।আমার আম্মুকে আমি কারো কাছে ছোটো হতে দিবো না।দরকার হলে আমি ক্ষমা চেয়ে নেবো।
এই বলে কুশান জামিলার সাথে কথা বলতে গেলো।
এদিকে কামিনী গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলো।তার আজ এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে।কুশান তার মাকে ফিরে পেয়েছে,তার তো খুশি হওয়ার কথা।এ কয় দিন ধরে তো সে এই দোয়ায় করতে লাগলো যাতে কুশান আর জামিলার দেখা হয়।

জামিলা ছেলের জন্য রুমে অপেক্ষা করছে।সে বুঝতে পারছে না ছেলেকে দেখার পর তার মনের অবস্থা কেমন হবে?এতোদিন কুশানকে অন্যজনের ছেলে ভেবে এসেছে সে।আজ যখন সেই কুশানই তার নিজের সন্তান আর তাকেই মা বলে ডাকবে সেই অনুভুতি টা কেমন হবে?

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৪৩

হঠাৎ কুশান প্রবেশ করলো রুমে।জামিলা তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলো।কিন্তু কুশান এগিয়ে গেলো জামিলার কাছে।মা ছেলে দুইজনই চুপচাপ। কি দিয়ে শুরু করবে দুইজন সেটাই ভুলে গেলো।অথচ এ কয় দিন ধরে দুইজনই পাগল ছিলো দুইজনকে দেখার জন্য।মা তার ছেলেকে কিভাবে কাছে টেনে নেবে আর ছেলেই বা তার মাকে কিভাবে ডাকবে কত প্রস্তুতি হচ্ছিলো মনে মনে।আজ সব প্রস্তুতি গোল্লায় গেলো তাদের।

আমি ফাইসা গেছি শেষ পর্ব