আমি মায়াবতী পর্ব ২৭

আমি মায়াবতী পর্ব ২৭
তাহমিনা মিনা

“মারিয়াম আপু, শাপলা ফুল ফুটেনি কেন? সকালে তো ফুটে ছিল।এখন ফুটেনি কেন?”
“সাব্বির, অহন তো বিকেল। রাইতে ফুটবো। আবার সকালে বেশি আলোতে মুখ লুকাইব।”
“হোয়াট? কি বলো এইসব মারিয়াম?মুখ লুকাইবো মানে কি?”
“মানে হলো বুইজা যাইবো।”

সাব্বির গোলগোল চোখ করে বলে,”বুইজা কি?”
ওদের কথা শুনে মায়া হাসে। হাসতে হাসতে বলে,”সাবিহা, একটা গান শুনেছিলি?”
“কোন গান?”
“শালুক ফুলের লাজ নাই, রাইতে শালুক ফুটে লো, রাইতে শালুক ফুটে। মনে নেই?”
“হ্যাঁ, মনে আছে তো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হুমম। সেটাই। শালুক ফুলের লাজ নাই, তাই রাতের বেলা ফুটে৷ আর সকালের সূর্য যখন বেশি তাপ ছড়ায়, তখন নিজেকে আবার খোলসে আবৃত করে ফেলে। বুঝলি?”
“হুমম। ”

সাব্বির কাঁদোকাঁদো গলায় বলে,”আমি চেয়েছিলাম শাপলা ফুল বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু এখন তো ফুটে নি। কালকে সকালে তো আর এইখানে আসা যাবে না।আমাকে তো আর কেউ নিয়ে আসবে না।”
মরিয়ম সাব্বিরকে বলে,”কাইন্দো না সাব্বির। আমরা লইয়া যামু ফুল। গরুর চারের পানিতে ভিজায়ে রাখুমনি। তাইলে সকালে দেখবা ফুইটা রইছে।”

সাবিহা জিজ্ঞেস করে,”গরুর চার কি?”
“আরে, ঐ যে দেখলানা, গরুরে যেইহানে আমি ভুষি গুলায়ে খাওয়াইলাম। ঐহানে পানি দিয়া চুবাইয়া রাখুমনে শাপলার ডাট। তাইলে পানি পাইয়া ফুইটা উঠবোনে।”
“ইয়াক থু। জীবনেও না। ঐখানে গরু খাবার খায়।ঐখানে না। অন্য কোথাও।”

“বাচ্চারা। নাড়াচাড়া কইরো না। নৌকা ঢুলতাছে কিন্তু। বেশি ঢুলাইলে কিন্তু পানি উডবো। তহন কিন্তু ডুইবা যাইবো নৌকা।”
মায়ারা সবাই নৌকাতে ঘুরছে। তারা চেয়েছিল নদীতে ঘুরতে। কিন্তু তার মেজো কাকা নদীতে নামেনি। ওরা কেউই ভালোভাবে সাঁতার জানে না। তাই নদীর পাশের খালটাতেই নামিয়েছে নৌকা।

সেখানে ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের পানির ফুল ফুটে আছে। মায়ারা অবাক হয়ে একটা একটা করে দেখছে। নৌকার এক মাথায় কাকা নৌকা চালাচ্ছে। আরেকপাশে মরিয়মের ভাই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। সে চেয়েছিল সে সবাইকে নৌকায় ঘুরাবে।যাতে সবাই বুঝতে পারে সে এই কাজে দক্ষ। কিন্তু মায়ার কাকা রিস্ক নিতে চায়নি। তাই নিজেই চালাচ্ছে নৌকা।

“মরিয়ম, আমি শুনেছিলাম নদীর পাড়ে কাশফুল থাকে। কই কাশফুল? আমি তো দেখছিনা। এই বিলেও তো নেই। নদীর ঐখানেও তো দেখলাম না।”
সাবিহার কথা শুনে কাকা হাহা করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে বলে, ” কাশফুল তো ফুটবো শরৎ
কালে। এখন তো না।”

সাবিহা অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করে,”মায়া আপু, শরতকাল আসতে আর কত দেরি? শরতকাল কবে আসবে?”
মরিয়ম বলে,”শোনো, ঐযে দূরের বাঁশঝাড় দেখতাছো, ঐদিক থিকা দূর্গা পূজার ঢাক ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইবো, তহন ভালোমতো কাশফুল ফুটবো৷ তহন আইসো গেরামে। তাইলে দেখবার পারবা।”
সাবিহা আর মায়া, দুজনেরই মন খারাপ হয়ে যায়। সেই সময় কি আর তারা এখানে আসতে পারবে? বাবা কি তাদের নিয়ে আসবে এখানে?

“তোমার মা আমাকে আমার পরিবার থেকে বলতে গেলে অনেকটা কিনেই এনেছিল। বিনিময়ে আমার বাবা মা আর তাদের সন্তানদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল। বিয়ে হয়ে এই পরিবারে আসার পর আমার সময় লেগেছিল তোমাদের সবাইকে মেনে নিতে। সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছিল কবিতাকে মেনে নিতে।

একটা কুমারী মেয়ে, যার নিজের বিয়ে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন ছিল, সে বিয়ে করে এসে পড়লো এক বাচ্চার বাপের ঘাড়ে। কি মনে হয়, তার পক্ষে এটা মেনে নেওয়া এতো সহজ? তুমি কি দেখোনি, আমি আমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতাম না? তারা আমাকে আপনার মায়ের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। আমি তো একসময় কবিতাকে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি?

তুমি কি আমাকে মেনে নিতে পেরেছিলে? রাতের পর রাত আমার থেকে দূরে থেকেছো। কখনো ঘুম ভেঙে গেলে উঠে দেখতাম তুমি তোমার প্রথম স্ত্রীর ছবি বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছো। আমার কি অধিকার ছিল না, তোমার ভালোবাসা পাওয়ার? আর তোমার মা,সে তো সবসময়ই চাইতো আমি যেন একটা কাঠের পুতুলের মতো থাকি। আমি যেন সবসময়ই হাসিমুখে থাকি সবার সামনে।

আর আমার ভিতরটা যেমনই থাকুক না কেন, আমাকে সবার সামনে হাসিখুশি থাকতেই হবে। নিজের স্বামীর থেকে ভালোবাসা পাচ্ছি না, নিজের বাবা মায়ের উপরে ক্ষোভ থেকে তাদের সাথে কথা না বলা, বিবাহিত জীবনের শুরুতেই একটা বাচ্চা, সারাক্ষণ শাশুড়ীর আদেশ মতো হাসিখুশি থাকা অথচ ভিতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আমি কাকে বলতাম আমার কথা? আমার নিজের মনের কথা? আমার তো কেউই ছিল না। সবকিছুই হয়তো স্বাভাবিক থাকতো, যদি তুমি আমাকে একটুর জন্য হলেও ভালোবাসতে। ”

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে দম নেয় আনিকা। অনেক দিনের জমা ক্ষোভ আজ ঝাড়লো সে। বেশ হালকা লাগছে তার নিজের। তবে, শেষ হয়নি। তার ইচ্ছে হলো তার উপর হওয়া এতোদিনের অত্যাচারের সব কথা জানানো। সে আবার বলে,”কবিতাকে আমি ভালোবাসতাম। কারণ, আমার জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো আমি ওকেই বলতাম। যদিও বাচ্চা মেয়েটা কিছুই বুঝতো না। তবুও ওকে বলতাম। তুমি কিছুই জানো না। কিছুই না।

আমি যখন প্রথম কনসিভ করলাম, তোমার মা আমাকে এবোর্শন করিয়ে এনেছিল। তুমি কি সেটা জানো? জানো না। আমি তোমাকে বলার আগে তোমার মাকে বলেছিলাম। সেটাই ছিল আমার ভুল। উনি আমাকে ডাক্তার এর কাছে আল্ট্রা করানোর নামে এবোর্শন করিয়ে এনেছে। তোমাকে বলতে পারিনি। বলেছিলাম আমার স্বার্থপর বাবা মাকে। তারা কি বললো জানো? তারা বললো আমাকে নাকি মা হওয়া যাবে না। সেই চুক্তিতেই নাকি বিয়ে হয়েছে।

সেইজন্যই নাকি আমার মা বাবাকে টাকা দেওয়া হয়েছে। আমার ভাইবোনের দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে। এবার বলো তো, এই সংসারে আমার আপনটা কে? আমার সবকিছুই আমি হারিয়েছি কারণ কবিতার মা মারা গিয়েছিল। যদি কবিতার জন্ম না হতো, তবে কবিতার মা মরতো না। আর না আমাকে এই জাহান্নামে আসতে হতো। আর তুমি মেয়েকে আজ এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছো কেন?

আমি তো তবু তোমার মেয়েকে ভালোবেসেছি ছোট বেলা থেকেই। কিন্তু তুমি? তুমি তো তোমার মাসুম বাচ্চাকে তোমার স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে ভেবে কখনো মেনেই নাও নি। কোলেও নাও নি। তোমাকে স্বাভাবিক জীবনে আনার জন্যই আমাকে কিনে আনা হয়েছিল। এখন বলো, আমাকে এই সংসারে ভালো কে বাসে? যেখানে আমাকে আমার বাবা মা বিক্রি করে দিয়েছিল। তুমি ভালোবাসোনি। তোমার মা আমাকে মা হওয়ার অনুমতি দেয়নি। এবার বলো তো, এই সংসারে আমার অবস্থান টা কোথায়?”

কবিতা হকচকিয়ে উঠলো। কি শুনছে সে এইসব? তার বাবা ভাবে যে সে তার মায়ের মৃত্যুর কারণ? তার দাদী এতোটা ভয়ানক? একটা মেয়েকে মা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত করতে পারে কিভাবে? সে সোফার হাতল ধরে সোফায় বসে পড়ে। কাব্য এসে তাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে। কবিতার বাবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আনিকা আবারও বলে,”কি যেন বলছিলে তুমি? আমি আমার ভাইবোনকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসি? নাহ।

আমি নিয়ে আসি না। আমি তাদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলি না। কেন বলবো? ওরা আমার জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আমি কেন ওদেরকে এই সংসারে আসতে বলবো? ওদের এখানে আসার অনুমতি তো দিয়ে গেছে আপনার মা। মনে পড়ে, মৃত্যুর আগে সে আপনাকে বলে গেছে আমার ভাই বোনদের দেখাশোনা করতে? মনে পড়ে?আপনি কি জানেন হুট করেই কি এমন হলো যে আপনার হঠাৎ বড়লোক হওয়া মা, যে কি না দুটো পয়সা হওয়ার পর আর আমাদের মতো গরীবদের রাস্তার লোক মনে করতো, সে হঠাৎ করেই কেন আমার বাবা মাকে এতো মাথায় তুললো? জানতে চান আপনি?”
আনোয়ার সাহেব অস্ফুটস্বরে বললো,”কেন? কি হয়েছিল?”

“আরিয়ান জন্মের পর বিষয়টা ঘটেছিল।এই যে আমার এই বোনটাকে দেখছো, সে কই থেকে যেন শুনেছিল মা বাবার অনুমতি ছাড়া ভ্রুণ হত্যা করলে জেল খাটতে হবে। আমার স্বার্থপর বাবা মা তোমার মাকে পুলিশের ভয় দেখিয়েছিল। যার কারণে তোমার মা বাধ্য হয়েছিল আমার বাবা মাকে মেনে নিতে। কবিতাকে বড় আপার কাছে দিয়ে দিয়েছিল তোমার মা। কারণ হিসেবে সে বলেছিল আমি নাকি ভালো মা নই। তুমিও তোমার মেয়ের প্রতি কোনো ভালোবাসা দেখাওনি।

কিন্তু কিছুদিন পর মেয়ের প্রতি ভালোবাসা উথলে উঠেছিল। তাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলে। কিন্তু না কবিতা আসতে চেয়েছিল আর না বড় আপা তোমাকে ওকে দিতে চেয়েছিল। কিছুই করতে পারোনি। আমি কবিতাকে এখানে আনতে চাইনি। আমি চাইনা ও কখনোই এইখানে পার্মানেন্টলি থাকুক। এইখানে থাকলে তুমি ওকে আবার ভালোবাসতে পারবে না। আবার কবিতার মায়ের মৃত্যুর জন্য ওকেই দায়ী ভাবতেন।

কি? ভাবতেন না? আপনার উচিত ছিল আমাকে আর কবিতাকে একসাথে ভালোবাসা। তাহলে হয়তো আজ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। কবিতা অন্যের ঘরে থাকতো না। আমার মা, বাবা, ভাই-বোনদের আমার কাছে খারাপ মনে হতো না। আপনার ভালোবাসা পেলে হয়তো আমি আমার দুঃখ ভুলতে পারতাম। আপনাদের দুজনকে ভালোবাসতে পারতাম।

একটা ছোট্ট সংসার গড়তে পারতাম। আমার প্রথম বাচ্চাটাও হয়তো বেঁচে থাকতো। মেয়েদের কাছে মাতৃত্ব কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তুমি সেটা জানোনা। তুমি যদি জানতে, তাহলে বুঝতে পারতে কবিতার মা চাইলে নিজে সেদিন বাঁচতে পারতো। কিন্তু সে চেয়েছিল তার সন্তান বাঁচুক। দুনিয়ার আলো দেখুক। তার একটা অংশ পৃথিবীতে থাকুক। আপনার উচিত ছিল কবিতাকে আগলে ধরে বাঁচা। অথচ আপনি তাকে কোলেও নেননি। আপনি কি বুঝতে পারছেন, আজকের এই সবকিছুর জন্য আপনিই দায়ী?”

আনোয়ার সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, আনিকা তাকে আপনি আপনি করে বলছে৷ তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হলে, কথা কাটাকাটি হলে সে তাকে আপনি আপনি বলে। সে কি এতোটাই পর তার?
কবিতা আস্তে আস্তে উঠে এসে তার বাবার সামনে দাঁড়ায়। তার কাঁধে হাত রেখে বলে,”আমি জানি যে আমার জন্মের সময় ডাক্তাররা চাইলে আমার মা বা আমাকে বাঁচাতে পারতো। আমার মা আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিল।

মা কে এতোটাই ভালোবাসতে যে আমার অস্তিত্বের কোনো মূল্য ছিল না তোমার কাছে। কিন্তু আমি তো আমার মায়েরই অংশ। ” কবিতা আনিকার দিকে তাকিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “তোমাকে ভালোবাসি মা। তুমি আমাকে ফুপির কাছে দিয়ে আমার সবচাইতে বড় উপকার করেছো।

আমি মায়াবতী পর্ব ২৬

আমি কারো কাছে খুনি হয়ে থাকতে চাইনা। আমি তোমাকে, আমার ভাই-বোনদের ভালোবাসি। আমি আমার মৃত ছোট্ট ভাই অথবা বোনটাকেও ভালোবাসবো। জীবনের কোনো এক পর্যায়ে হয়তো আমি তাকে খুঁজে পাবো। কিয়ামতে কিংবা হাশরের মাঠে। তখন আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো। দুর্ভাগা ভাই-বোনেরা আমার, আমার জন্যই এই পৃথিবীতে আসতে পারলোনা। মা, তুমিও কি আমাকে তোমার সন্তানের খুনী ভাবো?”

আমি মায়াবতী পর্ব ২৮