আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ১৮

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ১৮
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

জান্নাত হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনাকে তো বাসায় দেখিই না ভাইয়া। ”
আবির কিছুটা শক্ত কন্ঠে বললো,
“বাসায় ফিরতে একটু দেরি হয়ে যায়। তোমার পড়াতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”
জান্নাত শান্ত কন্ঠে বলল,

“না,না ভাইয়া৷ কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”
আবির এক পলক মেঘের দিকে চেয়ে পুনরায় জান্নাতের দিকে তাকালো, নিরেট কন্ঠে শুধালো,
“ও পড়ে তো ঠিকমতো?”
জান্নাত এবার মেঘের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললো,
“হ্যাঁ ভাইয়া।মেঘ অনেক মনোযোগী এবং খুব মেধাবী । আপনি চিন্তা করবেন না প্লিজ”
আবির ছোট করে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“খেয়েছো কিছু? বসো খাবার খেয়ে যেয়ো। ”
জান্নাত তৎক্ষনাৎ বললেন,
“নাস্তা করেছি ভাইয়া, আর কিছু খাবো না। আসি তাহলে আজ ”
ওদের কথোপকথন শুনার জন্য মেঘ কিছুটা হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে আসলো।
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“সাবধানে যেয়ো। ”

জান্নাত একগাল হেসে বললো,
“আপনি আমাদের বাসায় বেড়াতে যাইয়েন। ”
আবির হালকা হেসে উত্তর দিলো,
“সময় পেলে অবশ্যই যাবো। ”
প্রথমের কথা গুলো ঠিকমতো না শুনলেও শেষ কথাগুলো মেঘ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। জান্নাত মেঘকে আল্লাহ হাফেজ বলে বেড়িয়ে গেছে বাসা থেকে৷ এদিকে মেঘের বুক কেঁ*পে উঠলো। মেঘ যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আনমনে ভাবছে,

“জান্নাত আপু আবির ভাইকে বাসায় যেতে বলছেন? আবির ভাইও আবার হাসিমুখে বলছেন সময় পেলে যাবে। কই আবির ভাই তো আমার সাথে এত ভালো আচরণ করেন না, ওনি তো আমার সাথে আজ পর্যন্ত হাসিমুখে কথায় বলেন নি। তাছাড়া জান্নাত আপুকে তো তানভির ভাইয়া নিয়ে আসছিলেন। তাহলে আবির ভাই কিভাবে চিনেন?”
মেঘ আহ*ত চোখে তাকিয়ে রইলো আবির ভাইয়ের পানে।

আবির দরজা বন্ধ করে সিঁড়ির দিকে যেতে নিলে সহসা পথ আটকে সামনে দাঁড়ালো অষ্টাদশী। আজ আর তার শরীর কাঁপছে না, হাত-পা রিমরিম করছে না কারণ হাজারটা প্রশ্ন তার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যেগুলোর উত্তর শুধু আবির ভাই জানেন৷ ড্রয়িং রুমের কোথাও কেউ নেই। জান্নাত পড়িয়ে গেলেই মূলত খাওয়াদাওয়ার পর্ব শুরু হয়। তাই এ সময় সবাই যে যার রুমেই থাকেন ।

অষ্টাদশীর পথ আটকানো দেখে আবির বিস্মিত চোখে চাইলো। মেঘের এলোমেলো চুল, চোখের কাজল কিছুটা লেপ্টে রয়েছে, শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় তিরতির করে কাঁপছে । এ অবস্থায় মেঘকে দেখে ঘোর লেগে যাচ্ছে আবিরের। হাজারও নিষিদ্ধ চিন্তা জেগে উঠছে আবিরের মনে ।
টেনে হিঁচড়ে কোনোরকমে নিজেকে সামলে ঢুক গিলে কিছুটা শক্ত কন্ঠে বললো,
“পথ আটকে দাঁড়িয়েছিস কেন?”

মেঘের সরু নাক ক্রমেক্রমে ফুঁসছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ধৈর্যহীন কন্ঠে শুধালো ,
“আপনি জান্নাত আপুকে চিনেন?”
আবির উপর নিচ মাথা নাড়ে শুধু ।
মেঘ দ্বিতীয়বার গম্ভীর কন্ঠে বললো,
ওনাকে আপনি কিভাবে চিনেন?
আবির রাশভারি কন্ঠে বললো,
” পরিচিত…..! ”

মেঘ ভেতর ভেতর ক্ষিপ্ত হলো। অষ্টাদশীর চেহারার পরতে পরতে ঘনিয়ে আসে মেঘ। এক সমুদ্র অভিযোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একে গায়ের রঙ ফর্সা তার উপর রাগে গালদুটো লাল হয়ে আছে মেঘের। দেখে মনে হচ্ছে টুকা দিলেই গাল বেয়ে রক্ত পরবে।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মেঘ বললো,
” শুধু পরিচিত হলেই কি মানুষ নির্দ্বিধায় বাসায় যেতে বলে?”
“তুই আমার কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছিস, মেঘ?”
চোয়াল শক্ত করে প্রশ্ন করলো আবির।

মেঘ আজ আবিরের শক্ত কন্ঠ শুনে আঁতকে উঠছে না। কারণ অষ্টাদশীর আজ মাত্রাতিরিক্ত রাগ হচ্ছে । অতিরিক্ত রাগলে মানুষের বোধশক্তি হারিয়ে যায়। তাছাড়া মেয়েমানুষের রাগ তো লিমিট ছাড়া, যখন রাগ হয় তখন দুনিয়ার কোনোকিছু দিয়েও শান্ত করানো যায় না,যতক্ষণ না নিজে থেকে শান্ত হয়৷
মেঘের নাকের ডগায় ঘাম জমে আছে। কপাল ঘামতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অষ্টাদশী ।

কয়েক মুহুর্ত পর নিরেট কন্ঠে শুধালো,
“আপনি ওনার বাসায় যাবেন?”
আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, গুরুভার কন্ঠে বললো,
“প্রয়োজন হলে যাব ”

মেঘ চোখ গোল গোল করে চাইলো৷ মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন ছুটছে এদিক সেদিক ।
মেঘের নিরবতা দেখে আবির গুরুভার কন্ঠে জবাব দিলো,
” তোকে আপাতত এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।পড়াশোনায় মনোযোগ দে। তুই এখনও অনেক ছোট। সময় হলে সব জানতে পারবি ”

মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগান্বিত কন্ঠে বলা শুরু করলো,
“আপনারা যা খুশি করতে পারেন যা খুশি বলতে পারেন তাতে কিছু হয় না আমি কিছু বলতে গেলেই ছোট, বয়স হয় নি এরকম করেন।”
আবির দাঁতে দাঁত চেপে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“মেঘ, আস্তে কথা বল। বাড়ির মানুষ শুনবে। তাছাড়া জান্নাতের ব্যাপারে আমি আপাতত কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। ”

মেঘ রা*গে ফুঁস*তে ফুঁ*সতে বললো,
“তা কেনো বলবেন, আপনার যত রাগ আর তেজ তো শুধু আমার উপরই দেখান।৷ কোথাকার কোন রাস্তার মেয়ের জন্য আপনার এত দরদ। ”
আবিরের চোখ লাল হয়ে গেছে, দাঁত কটমট করছে, কন্ঠ তিনগুণ ভারি করে ধমকে উঠলো,
“জান্নাত কোথাকার কোন মেয়ে না । ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলবি। ফারদার যদি তাকে রাস্তার মেয়ে বলিস তাহলে এর ফল ভালো হবে না বলে রাখলাম ”

তৎক্ষনাৎ মেঘের অভিব্যক্তি বদলে গেলো, সহসা মনে পরে গেলো আবির ভাইয়ের ফোনে দেখা ওয়ালপেপারের ছবিটার কথা। তারমানে কি আবির ভাইয়ের প্রিয়ত…….. আর কিছু ভাবতে পারছে না মেঘ। চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। হৃদয় ভেঙে খন্ড খন্ড হয়ে যাচ্ছে ।
আবির কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই মেঘ শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনি কি ওনাকে ভালোবা…..”

এতটুকু বলার পরই আবির ডান হাতে মেঘের বাম গালে শক্তপোক্ত চড় বসিয়ে দিলো। অকস্মাৎ মেঘের মুখ বন্ধ হয়ে গেলো, কথাটা শেষও করতে পারলো না। মেঘের সমগ্র পৃথিবী ঘুরছে, বিপুল চোখে চেয়ে আছে আবিরের দিকে। স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে, একটা বারের জন্য গালে হাতও রাখলো না । অনুভূতিরা যেনো বিলীন হয়ে গেছে। রক্তাভ চক্ষুদ্বয় আবির ভাইয়ের চোখে নিবদ্ধ ।

আবির ভীষণ চটে গেছে, ডান হাতে নিজের চুল মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলো, রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
“যা বুঝার তা বুঝিস না, আজাইরা বিষয় নিয়ে পরে থাকিস৷ ”
মেঘ নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে আবির ভাইয়ের দিকে। আবির সঙ্গে সঙ্গে পা পিছিয়ে ঘুরে গেলো। দরজার পাশে দেয়ালে স্ব বেগে ঘুষি বসিয়ে দিলো। তা দেখে কেঁপে উঠে অষ্টাদশী। বাম হাত দিয়ে মেইন গেইট খুলে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।

মেঘ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, দীর্ঘ সময় পর চোখ বেয়ে গরিয়ে পরে দুফোঁটা অশ্রু । ততক্ষণে মালিহা খান বেড়িয়ে আসলেন রুম থেকে।
মালিহা মেঘকে দরজা মুখী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন,
“কিরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ক্ষুধা লাগছে? ”
মেঘ কিছুটা নড়ে উঠলো, বড় আম্মুর দিকে না ঘুরেই
শীতল কন্ঠে বললো,
“না”

তারপর পড়ার রুমে থেকে বই গুলো নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। আকলিমা খান মেঘকে যেতে দেখে ডাকলেন,
“মেঘ, খাবি না? ”
মেঘ গম্ভীর স্বরে বললো,
“ক্ষুধা নেই! ”
মেঘ রুমে এসে হাতের বই খাতাগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয় বিছানায়,তারপর দরজা আঁটকে নিজেও বিছানায় লুটিয়ে পরে।মেঘের বুক ভে*ঙে আসে আকাশ সম ক*ষ্টে। চোখ বেয়ে অনর্গল নোনাজল গড়িয়ে পরছে। নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা নেই অষ্টাদশীর।

যেই আবির ভাইয়ের থাপ্পড়ের ভয়ে গত একটা মাস আবির ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলে নি, আবির ভাই যা বলেছে চুপচাপ মেনে নিয়েছে, নিজের রাগ, জেদ আর অভিমান আবির ভাইয়ের পদতলে চাপা দিয়ে দিয়েছিলো। সেই আবির ভাই কি না ১ মাস হওয়ার আগেই তাকে থাপ্প*ড় মা*রলো। তাও আবার কোথাকার কোন মেয়ের জন্য!
এত শক্তপোক্ত চড়ে এখনও মুখের বাম পাশে ব্যথা করছে মেঘের।

শুয়া থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। বামগালে পাঁচ আঙুলের দাগ হয়ে আছে, রক্তবর্ণের সেই পাংশু। নিজের বিধ্বস্ত ধৃষ্টতা দেখে আঁ*তকে উঠে মেঘ। মুখমন্ডলের ন্যায় অষ্টাদশীর কোমল হৃদয় টাকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছেন অনুভূতিহীন, কাটখোট্টা আবির ভাই। মেঘ আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহুর্ত, আনমনে কি ভাবছে কে জানে!

যে অষ্টাদশীর মনটাকে কাঁচের ভাঙা গ্লাসের মতো, হাজারও টুকরোতে পরিণত করেছে।
কোথায় সে দুরূহ পুরুষ?

আবির বাসা থেকে বেরিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো৷ কি কাগজ নিতে এসেছিল সেসব ভুলে গেলো। স্প্রীডে বাইক চালিয়ে আসলো নিজের অফিসে।
কোনোদিক না তাকিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পর রাসেল একজন স্টাফকে জিজ্ঞেস করলো,
“আবির স্যার কি এখনও আসে নি?”
স্টাফ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো,

“স্যার তো কিছুক্ষণ আগেই চলে এসেছেন। ”
“কি বলো, আবির আসছে অথচ আমায় ফাইল দিলো না!”
চিন্তিত স্বরে বললো রাসেল।

তৎক্ষনাৎ হাঁটা দেয় আবিরের রুমের দিকে। আবিরের রুমের দরজা ধাক্কা দিতেই চোখে পরলো বিধ্বস্ত রুম। যেনো কিছুক্ষণের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে এই রুমটার উপর দিয়ে। হেলমেট ভেঙে পরে আছে ফ্লোরে। কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে সম্পূর্ণ রুমে। সেগুলো এলোমেলো উড়ছে ফ্যানের বাতাসে,চেয়ার পরে আছে কাত হয়ে। আবিরকে দেখা গেলো না।আবিরকে দেখার জন্য রাসেল দরজায় দাঁড়িয়েই উঁকি দিলো ভেতরে।

জানালার পাশের দেয়ালে আবির অহিতেচ্ছা, অনবরত ডান হাতে ঘুষি দিয়েই যাচ্ছে। বিষ্ময় চোখে চাইলো রাসেল, এক সেকেন্ড দেরি না করে ছুটে গেলো আবিরের কাছে, চেষ্টা করলো আবিরকে থামানোর কিন্তু ব্য*র্থ হলো। ৬ ফুট লম্বা, শক্তিশালী, সুঠাম দেহি আবিরের সাথে ৫ ফিট ৭” লম্বা রাসেলের শক্তি কোনোমতেই কুলালো না। চেষ্টায় ব্য*র্থ হওয়ার দরজা পর্যন্ত দৌড়ে যায় রাসেল আর চিৎকার দিয়ে ডাকে,
“রাকিব,এদিকে আয়!”

ভয়ংকর সেই পুরুষালী চিৎকারের শব্দে রাকিব সহসা দৌড়ে আসে, সাথে ছুটে আসে অফিসের কিছু স্টাফ আর কিছু কর্মচারী ।
রাকিব আর রাসেল টেনে হিঁচড়ে আবিরকে দেয়াল থেকে দূরে সরিয়ে আনলো৷ আবিরের চোখে-মুখে ক্রো*ধ স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। শ্যামবর্ণের মুখবিবর পরিবর্তন হলো ঘুটঘুটে আঁধারে । উষ্কখুষ্ক চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, ঘামে ভেজা কপালে লেপ্টে আছে সামনের দিকের চুলগুলো। পরনের সাদা শার্ট ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। রুমে ফুল স্প্রীডে ফ্যান চলছে সাথে এসি অন থাকা স্বত্তেও আবিরকে দেখে মনে হচ্ছে সবেমাত্র ৪০°সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটবল খেলে এসেছে।

রাকিব মাটিতে কাত করা চেয়ারটা এক হাতে তুলে আবিরকে জোর করে বসালো। আবিরের হাতের দিকে চাইলো,
নিরবচ্ছিন্ন ঘু*ষির কারণে আঙুলের, হাতের কয়েক জায়গায় কেটে র*ক্ত পরছে । রাকিব তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো দেয়ালে। সাদা রঙের দেয়ালের কিছুটা অংশ বেড়ে র*ক্ত গড়িয়ে পরেছে ফ্লোরে।
রাকিব আঁতকে উঠে, একপ্রকার চিৎকার দিয়ে বললো,

“রাসেল ফাস্ট এইড বক্স বের কর তাড়াতাড়ি। ”
আবির এখনও জোর করছে চেয়ার থেকে উঠার। কিন্তু রাকিব আবিরের পেট বরাবর শক্ত করে ঝাপ্টে ধরে পীতাভ কন্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো৷
তপ্ত স্বরে শুধালো,

“কি হয়ছে তোর? এমন করছিস কেন আবির?”
আবির সহসা চিৎকার দিয়ে বললো,
“ছাড় আমাকে!”
আবিরের রুষ্ট কন্ঠের চিৎকারে কিছুটা নড়ে উঠলো রাকিব কিন্তু তারপরও ছাড়লো না।
পুনরায় শান্ত কন্ঠে বললো,

“কেনো পাগলামি করছিস আবির? রা*গটা একটু কমা প্লিজ। কি হয়েছে বল আমায়!”
আবির দ্বিতীয় বার চেয়ার থেকে উঠার চেষ্টা করে কিন্তু এবার রাকিব আর একটু শক্ত করে আবিরকে চেপে ধরে। নিরেট কন্ঠে বললো,
“মাথা ঠান্ডা কর আবির। ”
আবির ব্যর্থ হয়ে বসে পরলো চেয়ারে৷ আবিরের র*ক্তবর্ণের চোখ বেড়ে গরিয়ে পরলো ক্রো*ধ মিশ্রিত এক ফোটা জল।

রাসেল ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আসছে। দরজায় দাঁড়ানো দু একজন প্রশ্ন করছে,
“কি হয়ছে স্যার?”
“কি হয়েছে স্যারের?”
“কোনো সমস্যা, স্যার?”
আবির তাদের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে চাইলো। সঙ্গে সঙ্গে নিরব হয়ে গেলো জনতা। রাকিব রাসেলের দিকে চেয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
“তুই সবাইকে নিয়ে ঐদিকে যা। আমি আছি আবিরের কাছে। ”
রাসেল চিন্তিত স্বরে বললো,
“কোনো প্রয়োজন হলে ডাকিস আমায়”
রাকিব শুধু মাথা দুলালো।

রাসেল ১ সেকেন্ড দেরি না করে সবাইকে নিয়ে যার যার কাজে চলে গেলো।
আবির চলন্ত ফ্যানের দিকে মুখ তুলে চেয়ে আছে।
সবাই চলে যাওয়ার পর রাকিব গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“দেখ হাতটার কি অবস্থা করেছিস!”
আবির এক পলক হাতের দিকে চেয়ে ক্রো*ধিত কন্ঠে বললো,
“আমি মস্ত বড় ভুল অপরাধ করে ফেলছি রাকিব, সেই অপরাধের কাছে আমার হাত কিছুই না। ”
রাকিব কিছুটা চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“কি হয়ছে? কি করছিস তুই?”

আবিরের কন্ঠস্বর ভিজে আসছে, পুনরায় দুফোঁটা পানি গরিয়ে পরলো গাল বেয়ে, শীতল কন্ঠে জবাব দিলো,
“আমি একই ভুল পুনরায় করে ফেলছি। ”
রাকিব আঁতকে উঠে শুধালো,
“কি…? তুই মেঘকে মেরেছিস? ”
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু।
রাকিবের বুঝতে বাকি নেই যে, আবির মেঘকে মারার ক্রো*ধে নিজেকে আহ*ত করছে।
ভ্রু গুটিয়ে রাকিব বললো,

“কেনো মেরেছিস? ”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবির বললো,
“আমায় জান্নাতের সাথে কথা বলতে দেখে মেঘের মাথায় র*ক্ত উঠে গেছে। যা তা উল্টা পাল্টা বলা শুরু করছে। আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারি নি। ”
“কি বলছিস আবির! জান্নাতের জন্য তুই মেঘকে মারলি?”
অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রাকিব।

“আমি মেঘকে মারতে চাই নি বিশ্বাস কর। ও একপর্যায়ে প্রশ্ন করে বসলো আমি জান্নাতকে ভালোবাসি কি না। এই কথাটা সহ্য করতে পারি নি। ”
রাকিব তপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
আবির বাম হাত দিয়ে কপাল থেকে চুল গুলো সরিয়ে মনোক*ষ্টে শুধালো,
“আমি এখন কি করবো রাকিব? ”
রাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেলছে বার বার। কিছুটা ভেবে বললো,

“দেখ, এখন তো মেঘ আগের মতো নেই। এখন তো মেঘও তোর প্রতি পসেসিভ, এজন্যই তো আজকে এভাবে রিয়েক্ট করেছে। আমার মনে হয় না যে এই থাপ্পড়ের জন্য ও কথা বন্ধ করবে। ”
আবির খরখরে কন্ঠে উত্তর দিলো,

” তুই তো জানিস, মেঘ খুব জে*দি। এটায় আমার একমাত্র ভ*য়ের কারণ। ও যদি একবার জে*দ করে বলে,আমার সাথে কথা বলবে না তাহলে এই জীবনে আর কোনোদিন ও কথা বলবে না। ”
রাকিব কপাল গুটিয়ে প্রশ্ন করলো
“বাই দ্য ওয়ে, কয়টা থা*প্পড় দিছিস?”
আবির তপ্ত স্বরে বললো,
“১ টা”

রাকিব স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“তুই চিন্তা করিস না। কিছু হবে না। জান্নাত কে নিয়ে কিছু ভাবছিস? মেঘ কি আর পড়তে চাইবে ওর কাছে?”
আবির গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলো,
“দুদিন পর পর ওর জন্য টিচার কোথা থেকে খোঁজবো আমি। ওকে জান্নাতের কাছেই পড়তে হবে। ”
রাকিব কোমল কন্ঠে বললো,
“আচ্ছা, সেসব পরে দেখা যাবে। এখন চল হাসপাতালে যাই একটু!”
আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
“হাসপাতালে যাব কেন?”
রাকিব স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

“এতটা কেটেছে। কোনো সমস্যা হয় যদি। ডাক্তার দেখালে ভালো হয়তো না?”
আবির সঙ্কটজনক স্বরে উত্তর দিলো,
“এটা আমার শাস্তি। ”
রাকিব খুব ভালো করে জানে আবিরকে জো*র করলে কোনো লাভ হবে না। তাই আর জো*র করে নি।
রাকিব চিন্তিত স্বরে বললো,
“এখন কি বাসায় যাবি? দিয়ে আসবো তোকে?”

আবির একপলক তাকালো দেয়ালে লাগানো ঘড়ির দিকে৷ ১০ টা বাজতেছে। গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলেন,
“কি করবো বুঝতে পারছি না। মেঘের মুখোমুখি হওয়ার মতো সা*হস পাচ্ছি না আমি। ”
রাকিব জানালার দিকে চেয়ে বললো,

“বাহিরে তো বৃষ্টি। একটু ওয়েট কর তাহলে। বৃষ্টি কমলে আমি দিয়ে আসবো নে। ”
আবির পকেট থেকে ফোন বের করে তানভির কে কল করলো। প্রথমবারেই রিসিভ হলো কল।
তানভির কল রিসিভ করে সালাম দিলো,
আবির সালামের উত্তর দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“কোথায় তুই?”

তানভির স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
“আমি তো পার্টি অফিসে। কেনো ভাইয়া?”
আবির নিরেট কন্ঠে জবাব দিলো,
“এমনি। ”
তানভির চিন্তিত স্বরে বললো,

“কোনো সমস্যা ভাইয়া? তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেনো?”
আবির গলা খাঁকারি দিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“কোনো সমস্যা নেই। তুই কাজ কর। রাখছি। ”
কল কেটে মোবাইল পকেটে রেখে বাম হাত কপালের উপর রেখে চেয়ারে হেলান দিলো৷ রাকিবও আর কিছু বললো না। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

এদিকে মেঘ কিছুক্ষণ আয়নার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে৷ বাহিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বারান্দার দরজা দিয়ে আসা শীতল হাওয়ায় কেঁপে উঠলো অষ্টাদশী। আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বেলকনির দিকে তাকালো৷ ধীরগতিতে হেঁটে গেলো বেলকনিতে। গ্রিলে ধরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে দূরের ল্যামপোস্টের আলোর দিকে।ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টির মাত্রা বাড়ছে। বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছিটে ফোটা পরছে মেঘের চোখে মুখে। আজ আর হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ার চেষ্টা করে নি অষ্টাদশী।

বেশকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো বেলকনিতে। হঠাৎ ভেতরটা ছটফটিয়ে উঠে। নিজের ভেতরে থাকা এক আকাশ সম অভিযোগ কাউকে বলতে ইচ্ছে করছে মেঘের। বৃষ্টির পানি আপন গতিতে পৃথিবীর বুকে লুটিয়ে পরছে। তা দেখে মেঘেরও ইচ্ছে করছে মনের মধ্যে পুষে রাখা চাপা কথাগুলো খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি কর্তাকে জানাতে। কষ্ট শেয়ার করলে নাকি মন হালকা হয় ।

যেই অষ্টাদশী গত ১৭ বছরে রাতের বেলা একা ছাদে যায় নি সেই অষ্টাদশী আজ রাত ৯ টার পর একা ছাদে চলে গেছে। ছাদে পা দিতেই ভারি বর্ষণে কয়েক সেকেন্ডে ভিজে যায় অষ্টাদশীর সর্বাঙ্গ। হাতখোপা করা চুলগুলো খুলে যায় সহসা। বৃষ্টির পানি তোপে ধীরে ধীরে কোমড় ছাড়িয়ে নিচে নামতে থাকে চুল। মেঘ আশেপাশে তাকাচ্ছে । দূর-দূরান্তের উঁচু উঁচু বিল্ডিং এর ছাদ থেকে হালকা আলো ভেসে আসছে মেঘদের ছাদে। লাইটের আলোর প্রভাবে গাছভর্তি ছাদের এদিক সেদিক গাছের ছায়া পরে আছে। কিছু কিছু জায়গা দেখে মনে হচ্ছে ভূ*তেরা বসে মিটিং করছে। মেঘের দৃষ্টি সেদিকে পরতেই কিছুটা কেঁপে উঠে। তবে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানোতে বুঝতে পারে এগুলো গাছের ছায়া।

বিদ্যু চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে মেঘও সম্পূর্ণ ছাদে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে ছাদের একপাশে রাখা বেতের সোফাগুলোর একটাতে বসে পরলো। হেলান দিয়ে বসাতে চুলের কম অর্ধেক টা অংশ ছাদের ফ্লোরে পরে আছে। মেঘ আকাশের পানে তাকিয়ে বলা শুরু করলো,

“আল্লাহ! আমার জীবনে তো হি*টলার স্বভাবের ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব ছিলো না৷ তাহলে কেনো তুমি ওনাকে আমার সামনে নিয়ে আসলে?এই অনুভূতিহীন মানুষটা কেনো আমার জীবনের সাথে জরিয়েছে? ওনি যদি অন্য কাউকেই ভালোবাসেন, তাহলে আমায় কেনো ওনার প্রতি দূর্বল বানিয়েছো? আমি এখন কি করবো?”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ১৭

একসাথে প্রশ্নগুলো করে কয়েক মুহুর্ত নিরব থাকে। অক্ষি পল্লব বেয়ে অনর্গল নোনাজল গড়িয়ে পরছে, তার সাথে বৃষ্টি পানি মিশে কানের নিচ দিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে।
বেশখানিকটা সময় নিরব থেকে শীতল কন্ঠে শুধালো,
“আমি কি কখনো কারো প্রিয় হতে পারবো না?”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ১৯