আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ১৯

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ১৯
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

বেশখানিকটা সময় মেঘ নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। মনের যত কষ্ট, ক্ষো*ভ, অপ্রাপ্তি ছিলো সবই প্রকাশ করলো আপন মনে। ঘন্টাখানেক বসার পর সোফা থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করলো। একপাশে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আপন মনে গুনগুন করে গান গাইছে,

“আমি কি তোমায় খুব বিরক্ত করছি
বলে দিতে পারো তা আমায়
হয়তো আমার কোনো প্রয়োজন নেই
তবুও লেগে থাকি একটা কোণায়
তুমি বলে দিতে পারো তা আমায়
চিঠি লিখবো না এই ঠিকানায়
আমার ও তো মন ভাঙে
চোখে জল আসে
আর অভিমান আমার ও তো হয়।
অভিমান আমার ও তো হয়”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অন্য দিকে আবির এখনও চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। ১১ টার দিকে মালিহা খান কল করলেন,
আবির কল রিসিভ করে সালাম দিলো।
মালিহা খান সালামের উত্তর দিয়ে কিছুটা তপ্ত স্বরে বললেন,
“তুই কি বাসায় আসবি না?”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“আসবো একটু পর। কেনো?”
রাগান্বিত কন্ঠে মালিহা খান বলে উঠলেন,

“তোরা ভাই বোন মিলে কি শুরু করছিস? তুই বাহিরে বাহিরে থাকিস, তানভির নির্বাচনের ভেজালে ১২ টার আগে বাসায় ই ফিরতে পারে না। এদিকে তোর বোনের এক- দু’দিন পর পর কি হয়ে যায়,খায় না কিছু না। তোরা যদি রাতে না ই খাবি তাহলে বলে রাখতে পারিস না! আমরাও তোদের জন্য আর রান্না করবো না । ”
আবির হেলান থেকে উঠে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো, নিরেট কন্ঠে শুধালো,

“মেঘ খায় নি?”
মালিহা খান সহসা উত্তর দিলেন,
“না”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তুমি শুয়ে পরো আমি আসছি। ”

আর কিছু না বলেই উঠে পরলেন। আবিরকে রুম থেকে বের হতে দেখে রাকিব আর রাসেল দুজনই ছুটে আসে। অন্যান্য দিন কাজ শেষ করে ১০-১০.৩০ এর মধ্যেই চলে যায় সকলে। কিন্তু আজ আবিরের মুড অফ দেখে তারা কাজ শেষ করেও বসে আছে। আবিরকে কিছু বলার সাহসও পাচ্ছিলো না।
রাকিব স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“চল আমি তোকে দিয়ে আসি। ”
আবির শক্ত কন্ঠে জবাব দিলো,
“আমি একা যেতে পারবো। ”
রাকিব পুনরায় বলে উঠলো,

“তোর হাতের অবস্থা দেখছিস তুই? এই অবস্থায় বাইক চালালে তো এক্সিডেন্ট করবি। তার থেকে আমার কথা মান, আমি দিয়ে আসি তোকে। ”
আবির শক্ত দৃষ্টিতে তাকালো রাকিবের দিকে, দাঁতে দাঁত চেপে ঘোষণা করলো,
“বললাম তো যেতে পারবো। ”
রাসেল ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
“এত বৃষ্টিতে বাইক নিয়ে যেতে পারবি?”

আবির আর কিছুই বললো না। বড় বড় পা ফেলে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো। টানা ২ ঘন্টার উপরে ভারী বর্ষণ হচ্ছে, যার ফলে ঢাকার রাস্তাঘাটে পানি জমে একাকার অবস্থা। মাথায় হেলমেট পর্যন্ত নেই, চোখ মেলে দেখার অবস্থা নেই তবুও বাইক থামছে না এক সেকেন্ডের জন্য। বৃষ্টির পানি এতটায় ঠান্ডা, মনে হচ্ছে ফ্রিজ থেকে বের করে বরফের পানি ঢালছে কেউ । আপাদমস্তক ভিজিয়ে বাড়িতে ঢুকলো আবির।। ড্রয়িং রুমে কেউ নেই, সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজা নিজের রুমের দিকে হাঁটে। ৫ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে একটা ধূসর রঙের টিশার্ট আর টাওজার পরে রুম থেকে বের হয়। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা দেয় মেঘের রুমের দিকে,

মেঘের দরজার সামনে এসেই বামহাতে দরজা ধাক্কা দিলো। অনবরত ঘু*ষির কারণে ডান হাতে তেমন শক্তি পাচ্ছে না, তারপর আবার হাতের উপর জোর দিয়ে বাইক চালিয়ে এসেছে। দরজা খুলতেই চোখ পরে ফাঁকা বিছানায়, কেনো জানি বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। ভিতরের দিকে দেখার চেষ্টা করলো, টেবিলের উপর ফোন,ল্যাপটপ পরে আছে, কিন্তু অষ্টাদশী কোথাও নেই৷ আবির রুমে ঢুকে বারান্দা সহ সব জায়গায় খোঁজলো কোথাও নেই। রুম থেকে বেরিয়ে সারা বাড়িতে চক্কর দিলো তবে কোথাও মেঘকে পেলো না । মীমের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আস্তে করে ডাকলো,

সঙ্গে সঙ্গে মীম দরজা খুললো। এক গাল হেসে বললো,
“ভাইয়া কিছু বলবেন?”
আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“মেঘ কোথায়?”
মীম স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,
“আপু তো রুমেই৷ সেই যে খাবে না বলে রুমে গেলো আর তো বের ই হতে দেখি নি। ”
আবিরের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ পরলো, গম্ভীর কন্ঠে শুধু বললো,
“ঠিক আছে ”

আবির আবারও মেঘের রুমে গেলো, সব জায়গা পুনরায় দেখলো কোথাও নেই। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আবিরের। চোখে মুখে উদ্বেগের মাত্রা বাড়ছে। রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে, ফোন রেখে এসেছে নিজের রুমে। হঠাৎ চোখ পরে সিঁড়ির দিকে।
মনের অজান্তেই বলে উঠে,
“ও ছাদে যায় নি তো?”

কোনো কিছু না ভেবে ছুটে যায় ছাঁদের দিকে। ছাদের দরজা বাতাসে একবার খুলছে, একবার বন্ধ হচ্ছে । আবির দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘাড় ডানে বামে ঘুরিয়ে ছাদ দেখার চেষ্টা করছে। ভারী বর্ষণের ফলে ছাদেও পানি জমে আছে অনেকটা, পাইপ দিয়ে গিয়েও যেনো কুলাতে পারছে না সাথে বৃষ্টির ছিটে ফোটা পরছে আবিরের শরীরে। কোথাও কাউকে চোখে পরছে না।

আবির বৃষ্টির মধ্যে পা বাড়ালো ছাদে, কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবির ছাদের চারপাশ দেখছে ঘুরে ফিরে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোতে আবিরের দৃষ্টিতে পরে, রেলিং ঘেঁষে ছাদের ফ্লোরে পরে আছে অষ্টাদশী । ছাদের সাইড দিয়ে যাওয়া পাইপের উপরে পরে আছে মাথা শরীরের বাকি অংশ ছাদের ফ্লোরে জমা পানির মধ্যে পরে আছে।
আবির অকস্মাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলো,
“মেঘ…….”

এক মুহুর্তে দৌড়ে গেলো মেঘের কাছে। অজ্ঞান হয়ে পরে আছে আবিরের প্রণয়িনী । আবিরের হাত কাঁপছে তবুও ঝাপটে ধরলো মেঘের পিট বরাবর, সহসা অষ্টাদশীর ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত আঁকড়ে ধরলো নিজের প্রশস্ত বুকে । মেঘের শরীর বরফের ন্যায় শীতল হয়ে আছে, শুধু মাথাটা একটু একটু গরম। আবির কয়েকবার আকুল স্বরে মেঘকে ডাকলো, কিন্তু মেঘ নিস্তেজ হয়ে পরে আছে। মেঘের এই অবস্থা দেখে আবিরের সমগ্র পৃথিবী ঘুরছে।

বৃষ্টির পানি বরাবর ই মানুষের উপকারে আসে। সাধারণত বৃষ্টিতে ভিজলে কেউ বেহুঁশ হয় না তবে যদি সেই মানুষটা অতিরিক্ত চিন্তা বা মানসিক চাপে থাকে তবে শরীরের তাপমাত্রা কমে একটা সময় অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে৷ মেঘের ক্ষেত্রে ঠিক এই ঘটনাটায় ঘটেছে। এক আকাশ অভিমান জমে ছিল মনে তার প্রতিফলন ঘটলো এইভাবে।
আবির সহসা দু’ হাতে কোলে তুলে নিলো মেঘকে, সিঁড়ি দিয়ে হাঁটছে ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি তার অষ্টাদশীর মলিন মুখের পানে।আবিরের চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গরিয়ে পরলো অষ্টাদশীর গালে। দুজনের শরীর বেয়ে অঝরে পানি পরছে। দীর্ঘ পা ফেলে করিডোর দিয়ে হেঁটে মেঘের রুমে ঢুকলো।

ফ্লোরে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে মেঘকে বসিয়ে দিলো। টাওয়েল এনে হাত মুখ আর মাথাটা কিছুটা মুছে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে গিয়ে বাইকের চাবি আর হেলমেট নিয়ে ছুটে গেলো নিচে। হালিমা খানের দরজার সামনে ভেজা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকছে। ২ বার ডাকার পরই হালিমা খান দরজা খুললেন,
আবিরের জলসিক্ত শরীর দেখে চিন্তিত স্বরে শুধালেন,

“ভিজে আসছিস?”
আবির তপ্ত স্বরে বললো,
“মামনি তুমি একটু মেঘের রুমে যাও, ওর অবস্থা ভালো না, আপাতত বাড়ির মানুষকে ডেকো না, আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি ”
একদমে কথাগুলো বললো আবির, হালিমা খান আঁতকে উঠে বললেন,
“কি হয়ছে?”
আবির চলে যেতে নিয়ে দ্বিতীয় বার ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
“আর হ্যাঁ৷ ওর শরীরটা একটু ধৌয়ে দিও। ”

আবির ছুটলো দরজার দিকে। হালিমা খান দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে ব্যস্ত হলেন, চোখে তার পানি টলমল করছে। একমাত্র মেয়ে বলে কথা, মেয়ের মুখ গোমড়া থাকলেই যেখানে চিন্তায় পরে যান হালিমা খান, সেখানে মেয়ে অসুস্থ মানে হালিমা খানের মাথায় আকাশ ভে*ঙে পরা।।

২০ মিনিটের মধ্যে আবির ডাক্তার নিয়ে চলে আসছে। ডাক্তারকে রেনকোট দিয়েছে ঠিক ই কিন্তু আবিরের সর্বাঙ্গ ভেজা। মেঘের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিলো আবির, নরম স্বরে বললো,
“আসবো?”
হালিমা খান কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন,
“আয়”

আবির ঢুকলো আবিরের পিছনে ডাক্তার ও মেঘের রুমে ঢুকলো। আবিরের গা থেকে পানি পরছে ফ্লোরে কিন্তু সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। তার দৃষ্টি অষ্টাদশীর মুখের পানে। ডাক্তার ১০ সেকেন্ড মেঘকে দেখলো কি না,
আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“ওর কিছু হবে না তো?”
ডাক্তার স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

“তেমন কোনো সমস্যা নেই। বেশিক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছে মনে হয়। তাছাড়াও হয়তো কোনো মানসিক চাপে আছে তারজন্য এমনটা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে। আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি জ্ঞান ফিরলে খাইয়ে দিও। যদি জ্ঞান না ফিরে তাহলে পরবর্তীতে জানিয়ো একটা স্যালাইন করতে হবে। জ্ঞান ফিরলেও কিছুদিন একটু রেস্টে রাখবা, কোনো প্রকার মানসিক চাপ দিও না। ”

ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে আবিরের হাতে দিলো। আবির ঔষধ গুলোর নাম পড়ে টেবিলের উপর প্রেসক্রিপশন রেখে ডাক্তারকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। ভেজা শরীরে পুনরায় বাইক দিয়ে ডাক্তারকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ঔষধ গুলো কিনে নিয়ে আসলো। নিজের রুমে গিয়ে ১ মিনিটে ড্রেস পাল্টে শুকনো কাপড় পড়ে মেঘের রুমে আসছে। মেঘ তখনও অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছে। হালিমা খান মেঘের হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন, কান্না করছেন আর বারবার মেঘকে ডাকছেন। মেঘের মাথার নিচে একটা টাওয়েল দিয়ে রেখেছেন।

আবির ঔষধ গুলো টেবিলের উপর রেখে, মেঘের ওয়ারড্রবের একটা ড্রয়ার খুললো, এটাতে জামাকাপড়, দ্বিতীয় ড্রয়ার খুলতেই চোখে পরলো সকল ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র। সেখান থেকে হেয়ার ড্রায়ার বের করে নিলো আবির।
মেঘের কাছে দাঁড়িয়ে হালিমা খানকে বললেন,
“”মামনি তুমি ওকে একটু ধরে বসো। ”

আবির নিজেই হেয়ার ড্রায়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চুল শুকাচ্ছে মেঘের । কোমড় ছাড়ানো চুল গুলো ভাগ ভাগ করে শুকাতে কিছুটা সময় লাগলো। পুনরায় মেঘকে শুইয়ে হাতে পায়ে তেল মালিশ করতে লাগলো দুজনে। হালিমা খান আবিরকে শীতল কন্ঠে বললেন,
“বাবা, তুই একটু বস আমি তোর চাচ্চুকে বলে আসি। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে তো ওনি আবার চিন্তায় পরে যাবেন। ”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

“মেঘের এই অবস্থার কথা বলো না। শুধু শুধু চিন্তা করে শরীর খারাপ হবে। ”
হালিমা খান “ঠিক আছে ” বলে চলে গেলেন।
হালিমা খান রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আবির মেঘের সন্নিকটে বসলো,
মেঘের বাম হাত আবিরের বুকের সাথে মিশিয়ে , ওষ্ঠ এগিয়ে নিলো মেঘের কানের কাছে, গুনগুন করে বললো,
“”Main sirf tera rahunga
Tujhse hai waada yeh mera
Tu maang le muskura ke
Mera pyar haq hai tera””

তারপর অষ্টাদশীর কপালে আলতোভাবে একটা চুমু দিয়েই বিছানা থেকে উঠে পরলো। চেয়ার টেনে বসলো বিছানার পাশে তারপর হাতে তেল নিয়ে মালিশ করতে লাগলো মেঘের হাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হালিমা খান ফিরে আসলেন। হালিমা খানও মেয়ের ডান হাতে, দুপায়ে মালিশ করে দিচ্ছেন আর একটু পর পর মেঘকে ডাকছেন,
বেশ খানিকক্ষণ পর মেঘের জ্ঞান ফিরেছে৷ সঙ্গে সঙ্গে আবির মেঘের হাত ছেড়ে দিয়েছে। হালিমা খান কান্না করতে করতে মেঘকে ডাকছে,
“মেঘ, এই মেঘ, কি হয়েছে তোর?”

মেঘ কয়েকবার পিটপিট করে চাইলো মায়ের দিকে, বুঝে উঠতে পারছে না তার সাথে এতক্ষণ কি ঘটেছে। মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো শক্তি তার নেই। চোখ ঘুরিয়ে নিজের অস্তিত্ব বুঝার চেষ্টা করছে। নিজের রুমটা পরখ করতে লাগলো মেঘ,হঠাৎ দৃষ্টি পরে বামপাশে চেয়ারে বসা আবির ভাইয়ের দিকে।

মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঘের পানে। মেঘও কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো আবির ভাইয়ের দিকে। মনে পরতে লাগলো সন্ধ্যার পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো আবির ভাইয়ের দিকে থেকে।
পুনরায় চোখ বন্ধ করে ফেললো মেঘ । হালিমা খান মেঘের কপালে হাত রেখে আঁতকে উঠলেন, সঙ্গে একবার গলাতেও হাত রাখলেন। সহসা বলে উঠলেন,

“মেঘের তো জ্বর উঠতেছে।”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তুমি ওকে উঠাও, আমি খাবার নিয়ে আসছি।
ঔষধ খাইয়ে দিলে যদি একটু কমে!”
হালিমা খান চিন্তিত স্বরে বললেন,
“তানভির কোথায় আছে?”
আবির শক্ত কন্ঠে জবাব দিলো,
“ওকে জানিয়েছি, আসতেছে। ”

মেঘ নিস্তেজ অবস্থায় শুয়ে আছে। চোখ খুলে আবির ভাইকে দেখার শক্তিটুকু যেনো পাচ্ছে না, কথা বলা তো বহুদূরের বিষয় ।
আবির নিচে গিয়ে একটা প্লেটে অল্প ভাত আর একটু তরকারি নিয়ে আসলো। হালিমা খান মেঘকে কোনোরকমে উঠিয়ে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে নিজে ধরে রেখেছেন।
আবির ভাত মাখিয়ে মুখে সামনে ধরে ছোট করে বললো,

“হা কর”
পুরুষালী কন্ঠে কিছুটা কেঁপে উঠে মেঘ। তৎক্ষনাৎ ছোট করে হা করলো । আবির ভাই অষ্টাদশীকে নিজের হাতে খাইতে দিচ্ছে কিন্তু অষ্টাদশীর মনের ভেতর আনন্দ নেই, নেই কোনো উত্তেজনা। যেই আবির ভাই তার মনের ভেতর সারাক্ষণ এক্কা দোক্কা খেলতো সেই আবির ভাইকে চোখে মেলে দেখার সাধ্যি তার হচ্ছে না।

কয়েক লোকমা ভাত কোনোরকমে গিললো পরের বার দিতে গেলে আসতে করে বামে ডানে ঘাড় ঘুরালো। আবিরও বুঝতে পারলো মেঘের অভিব্যক্তি। জোর করলো না আর। হাত ধৌয়ে নিজের হাতেই মেঘের মুখ মুছে দিলো। তারপর ঔষধ খাইয়ে একবার মেঘের কপালে হাত রাখলো। জ্বরের মাত্রা বাড়ছে।
আবির শীতল কন্ঠে বললো,

“মামনি তুমি থাকো ওর কাছে। কোনো সমস্যা হলে আমায় ডেকো, আমি সজাগ আছি। ”
আবির প্লেট হাতে নিয়ে চুপচাপ বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।
১০-১৫ মিনিট পর তানভির দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে। এমপির গাড়ি করে ড্রাইভার এসে দিয়ে গেছে তানভিরকে। মেঘের রুমে গিয়ে কোমল কন্ঠে মাকে শুধালো,
“কি হয়ছে মেঘের?”

মেঘের পাশে বসে কপালে হাত রাখলো । থার্মোমিটার এনে জ্বর মাপলো ১০০°C+ তাপমাত্রা । মেঘ জ্বরে কাঁপতেছে। তানভির ছুটে গিয়ে নিজের রুমের কেবিনেট থেকে আর একটা কম্বল এনে বোনের গায়ে ছড়িয়ে দিলো৷ তারপর একটা ছোট রুমাল ভিজিয়ে কিছুক্ষণ জলপট্টি দিলো।
হালিমা খান এখনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন।
তানভির মায়ের দিকে চেয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললো,

“ডাক্তার কি বলছে?”
হালিমা খান কান্নারত কন্ঠে বললেন,
“”বলছেন সিরিয়াস কোনো সমস্যা না। রেস্ট নিতে আর চিন্তা কম করতে। ঔষধ দিয়ে গেছেন””
“ঔষধ খাওয়ানো হয়ছে?”
হালিমা খান কোমল কন্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ, আবির খাইয়ে দিয়ে গেছে!”
তানভির নমনীয় কন্ঠে মাকে প্রশ্ন করলো,

“ভাইয়া কোথায়?”
“কিছুক্ষণ হলো গেলো এখান থেকে। ”
তানভির আর কিছু বললো না। চুপচাপ কিছুক্ষণ জলপট্টি দিলো বোনের কপালে। তবে জ্বর কমার কোনো নাম গন্ধ নেই।

এদিকে আবির রুমে এসে বেলকনিতে পায়চারি করতে লাগলো৷ বাহিরে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছুক্ষণ বিরতি নেয় আর ভারী বর্ষণ শুরু হয়। তাপমাত্রা কম থাকার পরও আবিরের শরীর ঘামছে। স্থির হতে পারছে না কোনোভাবেই। তামাটে চেহারা কুচকুচে কালো বর্ণের হয়ে আছে। দুপুরে খাবার খেয়েছিলো তারপর সন্ধ্যায় শুধু এককাপ কফি খেয়েছে। মধ্যরাত হয়ে গেছে, খায় নি এখনও তাই মুখটা মলিন হয়ে আছে। হাতের অবস্থাও করুন, বাসায় ফেরার পথে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছিলো। বৃষ্টির পানিতে কাটা অংশ গুলো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ পর আবির বড় বড় পা ফেলে ছাদে চলে গেলো। সম্পূর্ণ শরীর ভিজতে বেশি সময় লাগলো না। ছাদের কর্ণার থেকে সিঙ্গেল সোফা টেনে মাঝ বরাবর রেখে সেখানে বসে পরলো।
অসীম দূরত্বে চেয়ে থাকে অনেকটা সময় ধরে। পরপর চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে নিজেকে প্রশ্ন করলো,
“”আমি কি এখন ফিরে ভুল করে ফেললাম?””
আবিরের মনে পরছে পুরোনো স্মৃতি,

এক প্রণয়িনীর ২ বছরের নিরবতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো তাকে। প্রিয়মানুষের উপস্থিতি যেমন বক্ষস্পন্দন বাড়াতে সক্ষম তারথেকেও বেশি কষ্টদায়ক নিজের প্রেয়সিকে গুরুগম্ভীর থাকতে দেখা আর যার কারণ সে নিজেই। একটা সামান্য ভুলের কারণে গতদু’টি বছরে প্রেয়সী তার চোখে চোখ রাখে নি, এক টেবিলে, এক সাথে খেতেও বসে নি। মুখ ফোটে একটা কথা পর্যন্ত বলেনি।

এর বেশি সহ্য করার ক্ষমতা একটা ১৮ বছরের যুবকের পক্ষে কখনো সম্ভব ছিল না। প্রেয়সীর প্রতি অনুভূতি তার অতলস্পর্শী বিশালতার সমুদ্রের ন্যায় যা কখনো পরিমাণ করা সম্ভব না৷
যখন তার সহ্যের সীমা শেষ হতে চললো, তখন তার সামনে দুটি রাস্তা ভেসে উঠেছিল। এক, স্কলারশিপে বিদেশ যাওয়া, দ্বিতীয় হলো ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশোনা।

আবির বাড়ির প্রতিটা সদস্যের থেকে মতামত নিয়েছিল সেদিন। এমনকি তার হৃদয়হরনীর কাছেও সেদিন আকুল মিনতি করে জিজ্ঞেস করেছিল সে কি চাই৷ ছোট্ট হৃদয়হরনীর অভিমানের মাত্রা এতটায় তীব্র ছিল যে সেদিনও আবিরের চোখে চোখ রাখে নি, আবিরের কোনো কথার উত্তর ও দেয় নি।

২ বছর যে ললনার অভিমান ভাঙাতে অক্ষম সেই ললনার অভিমান কয়েক মাসে ভাঙানো সম্ভব ছিল না। তারপরও আবির শেষ বার যাওয়ার আগে অভিভূতের ন্যায় নিষ্পলক চেয়ে ছিল তার সেই ললনার দিকে, যদি একবার বলতো ‘ভাইয়া তুমি যেয়ো না’ কিন্তু না শেষদিনও মুখ ফোটে কিছু বলে নি তার প্রেয়সী৷

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ১৮

আবির পারি জমালো ভিনদেশে, পার্থিব জগতের মাঝে অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারী তার সেই ছোট্ট ললনাকে ফেলে চলে গিয়েছিল বহুদূর।

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ২০