আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩৭

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩৭
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

তানভিরের সাথে বেশকিছুটা সময় কথা বলে আবির নিচে আসছে৷ মেঘ সোফায় বসে টিভি দেখতেছে। ড্রয়িং রুমে আর কেউ নেই। আবির মেঘকে দেখেও না দেখার মতো করে রান্নাঘরে চলে গেছে। নিজের জন্য কড়া করে এক কাপ কফি করেছে৷ কফির কাপটা হাতে নিয়ে আবির সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে ৷

মেঘ কপাল কুঁচকে এক দৃষ্টিতে আবির ভাইকে দেখছে৷ আবিরের মনের ভেতরের দুশ্চিন্তাগুলো চেহারায় ভেসে উঠছে। অষ্টাদশী আবিরের তামাটে চেহারা দেখে বুঝার চেষ্টা করছে, আবির ভাইয়ের কি হয়েছে। মেঘ একবার ভাবছে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু সাহস ও হচ্ছে না৷ আবির সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই মালিহা খান নিজের রুম থেকে বের হতে হতে আবিরকে ডাকলেন।
আবির সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে পরেছে। মালিহা খান সোফায় এসে বসলেন, আবিরের দিকে তাকিয়ে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোর সাথে কথা আছে। ”
আবির নির্বিকার কন্ঠে বলল,
“আম্মু, তুমি যে বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছো, সেই বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না বলেই রাজশাহী থেকে ফেরার পর থেকে তোমার সাথে দূরত্ব রেখে চলছি। ”
“কথা বলতে চাই না বললেই কি সবকিছু এড়িয়ে যেতে পারবি? তোর কি বিয়ের বয়স হয় নি? বিয়ে কি করবি না?”
আবির তপ্ত স্বরে জানাল,

” বিয়ে করার সময় হলে নিজেই তোমাদের বলবো। ”
মালিহা খান শুষ্ককন্ঠে বলে উঠলেন,
” আমি আমার ছেলের এই রূপ দেখব বলে ছেলেকে বিদেশে পাঠায় নি। তোকে এতো মনমরা দেখতে আমার ভালো লাগে না। আমি চাই তুই বিয়ে কর। ”
একটু থেমে পুনরায় বললেন,

“জান্নাত মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লাগছিল।এতদিন মেঘের টিউটর ছিল, এখন তো আর সে আমাদের বাসায় পড়ায় না। মেয়েটার খোঁজ নিতে তো সমস্যা নেই। ”
আবির নিশ্চুপ। মেঘ হা হয়ে তাকিয়ে আছে বড় আম্মুর মুখের পানে।মেঘের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। কিভাবে বলবে জান্নাত আপুর যে বিয়ে হয়ে গেছে, তাও আবার আসিফ ভাইয়ার সঙ্গে। মেঘ সহসা আবিরের মুখের পানে তাকালো।
মালিহা খান মেঘের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“তোর কাছে জান্নাতের নাম্বার আছে ?”
মেঘ বলে,
“জান্নাত আপুর… ”
মেঘের কথার মাঝে আবির বলে উঠে,

“ওর কাছে নাম্বার থাকবে কোথা থেকে।তুমি কি শুরু করছো আম্মু। মেয়েটা পড়াতে আসছিল, পড়াইছে, আলহামদুলিল্লাহ মেঘ চান্স পাইছে। মেয়েটাকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে চাইছো, গিফট দিতে চাইছো সব ইচ্ছে ই পূরণ করা হলো। এরপরও এই বিষয় নিয়ে কথা কেন উঠে?”
মেঘ আহাম্মকের মতো আবিরের দিকে চেয়ে আছে। বলে দিলেই হয়, জান্নাত আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। আবির মেঘের দিকে চোখ রাঙিয়ে ইশারা করল, যাতে কিছু না বলে।
আবির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলল,

“সামনে মাইশা আপুর বিয়ে তুমি বরং সেদিকে মনোযোগ দাও৷ আর বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কোনোভাবে আমার বিয়ের কথা তুললে, আমি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে বাড়ি থেকে চলে আসবো৷ কথাটা মাথায় রেখো।”
মেইনগেইট থেকে ভেতরে দু কদম এগিয়ে আলী আহমদ খান উচ্চস্বরে বললেন,
“হয়ছে টা কি? মা ছেলের মধ্যে কি নিয়ে মনোমালিন্য চলছে?”
আবির মায়ের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,

“আব্বুকে কিছু বলবা না কিন্তু। ”
বাবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“কিছু না ৷ ”
আবির চলে গেছে। বড় আব্বুকে দেখে মেঘ ও টিভি বন্ধ করে চলে যাচ্ছে। আলী আহমদ খান সোফায় বসতে বসতে মালিহা খানকে শুধালেন,
“কি হয়ছে?”
মালিহা খান মনমরা হয়ে উত্তর দিলেন,

“কি আর হবে! বিয়ের কথা বলছিলাম এজন্য রাগারাগি করছে৷ ”
আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বললেন,
“তুমি ছেলেরে আর কিছু বইলো না । মাথাটা একটু ঠান্ডা হোক আমিই কথা বলবো।”
মালিহা খান শীতল কন্ঠে জানালেন,
“ঠিক আছে।”

আজ মাইশার গায়ে হলুদ। মালিহা খান আর আলী আহমদ খান গতকাল ই বিয়ে বাড়িতে চলে গেছেন। মালিহা খান মাইশাদের বড় ফুপ্পি তাই ওনার দায়িত্বও একটু বেশি। আরও আগেই যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু অসুস্থতার কারণে আলী আহমদ খান স্ত্রীকে একা ছাড়তে রাজি নন। ডাক্তার দেখিয়ে গতকাল ওনি নিজেই নিয়ে গেছেন। তানভির ব্যতিত বাকিরা আজ বিয়ে বাড়িতে যাবে। আগে থেকেই বলা,আবির ইকবাল খানের গাড়ি নিয়ে যাবে। মামনি, কাকিয়া, মেঘ,মীম আর আদিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আবিরের।

মোজাম্মেল খান আর ইকবাল খান অফিস করে বিকেলের দিকে রওনা দিবেন। সকাল থেকে সাকিব আবিরকে কলের পর কল দিয়েই যাচ্ছে। যেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হয়। সকালের নাস্তা করে ইকবাল খান আর মোজাম্মেল খান অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছেন। বাকিরা রেডি হচ্ছে।
গায়ে হলুদের পাঞ্জাবি, শাড়ি নেয়ার দায়িত্ব ছিল আবিরের। নিজের কিছু জামাকাপড় সহ, সব ব্যাগ গাড়ির ডিকিতে রাখতে গিয়ে হঠাৎ কিছু একটা মনে করে বাড়ির ভেতরে ঢুকছে আবির৷ মীম,আদি, মামনিরা ততক্ষণে রেডি হয়ে মেঘকে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে পড়ছেন।
কাকিয়া আবিরকে জিজ্ঞেস করলেন,

“আবার কোথায় যাচ্ছিস?”
উত্তরে আবির জানাল,
“ওয়ালেট টা রুমে ফেলে আসছি। তোমরা গাড়িতে বসো আমি এখনি আসছি।”
হালিমা খান পুনরায় ডেকে বললেন,
“মেঘ রেডি হলো কি না একটু দেখিস তো। ”

আবির ” আচ্ছা ” বলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত পায়ে উঠে রুম থেকে ওয়ালেট আর একটা জ্যাকেট নিয়ে বের হয়েছে। জ্যাকেট টা পড়ে ওয়ালেটটা চেক করতে করতে মেঘের দরজা পর্যন্ত এসে ডাকলো,
“আর কতক্ষণ লাগবে তোর?”

আবিরের কন্ঠ শুনে মেঘ চমকে উঠে। ত্রস্ত ঘুরে দাঁড়ালো সে। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে জ্যাকেট টেনে গায়ে জরিয়ে নিয়েছে। মেঘের হুড়োহুড়ি কর্মকাণ্ডে আবির মেঘের দিকে তাকালো। মেঘের গায়ে এমনভাবে জ্যাকেট জড়ানো দেখে আবির কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। মেঘ চিবুক নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ কালো রঙের একটা গাউন পড়েছে, সাথে আবিরের গিফট করা একটা গর্জিয়াছ হিজাবও পরেছে।

মেঘকে দেখতে এত মায়াবী আর মোহময় লাগছে যে আবির দৃষ্টি সরাতে পারছে না। মেঘকে আপাদমস্তক দেখে আবির মেঘের আঁতকে উঠার কারণ টা বুঝার চেষ্টা করল। যদিও কিছু বুঝতে পারে নি তবুও আবির চোখ নামিয়ে “Sorry” বলে রুম থেকে বের হতে যাচ্ছিলো।
মেঘ অস্বস্তি কাটিয়ে ডাকল,
“আবির ভাই! ”
আবির দরজার বাহির থেকে উত্তর দিল,
“হুমমমমমমম।”
“মীমকে একটু ডেকে দিবেন, প্লিজ। ”

আবির বেলকনি থেকে ড্রয়িংরুমে একবার তাকালো। কোথাও কেউ নেই। আবির উচ্চস্বরে জানালো,
“সবাই বের হয়ে গেছে, মীমও গাড়ির কাছে চলে গেছে। কোনো সমস্যা? আমি কি কোনোভাবে হেল্প করতে পারবো? ”
মেঘ কি করবে বুঝতে পারছে না। মীমকে বেশ কয়েকবার ডেকেছে। আদি আর মীম হৈ-হুল্লোড় করে বেড়িয়ে গেছে তাই মেঘের ডাক মীম আর শুনে নি। আবির ভাইকে বলবে কি না বুঝে উঠতে পারছে না। মেঘকে নিস্তব্ধ থাকতে দেখে আবির পুনরায় মেঘের রুমে ঢুকেছে।
আবির রুমে ঢুকতেই মেঘ আঁতকে উঠল। বৃহৎ চোখে তাকালো। আবির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,

“কি হয়েছে? ”
মেঘ চিবুক নামিয়ে নিল।মেঘ এখনও জ্যাকেট জরিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। অষ্টাদশীর অশান্ত মন কেমন করে কাঁপছে। কথা আঁটকে আসছে, মাথা নিচু করে অনেক কষ্টে বলল,
“জামার চেইন টা লাগাতে পারছি না। ”
আবির স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মেঘের কাছে এগিয়ে এলো। আবিরের আগানোতে অষ্টাদশীর হৃৎস্পন্দনের মাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। আবির মেঘের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“ঐদিকে ঘুর। ”

মেঘ না চাইতেও আবিরের দিকে পিঠ করে দাঁড়ালো। জ্যাকেট টা ধরে রাখার শক্তিটুকু পাচ্ছে না। আবির জ্যাকেটে হাত দিতেই মেঘ জ্যাকেট ছেড়ে দিয়েছে। পড়ে যেতে নিলে আবির তাড়াতাড়ি জ্যাকেট টা ধরে বিছানার উপর রাখল৷ হিজাব দিয়ে সম্পূর্ণ পিঠ ঘুরা। আবির অতি সন্তর্পণে পিঠ থেকে হিজাব টা সরায়, সহসা অষ্টাদশীর উজ্জ্বল বর্ণের পিঠ উন্মুক্ত হয়। না চাইতেও আবিরের নজর পরে সেই অচ্ছদ পৃষ্ঠে যেখানে পাশাপাশি দুইটা কৃষ্ণবর্ণের বিউটিস্পট ঝলমল করছে।

আবির ঢোক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে নিল, আবিরের বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ হৃদপিণ্ডটা দিগবিদিক ছুটছে। যেন পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসবে এখনি । আবিরের সর্বাঙ্গ ঘামতে শুরু করেছে । আবিরের হাত কাঁপছে। অন্য দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে জিপারের স্লাইডারে ছুঁতে গেলে উষ্ণ হস্তের তিন আঙ্গুল মেঘের উন্মুক্ত পিঠ স্পর্শ করে। আবির আর মেঘ দুজনের গাত্র এবার একসঙ্গে কম্পিত হলো। আবিরের স্পর্শে অষ্টাদশীর অঙ্গে অব্যক্ত শিহরণ জাগছে। দেহের প্রতিটা শিরা-উপশিরায় তুফান শুরু হয়ে গেছে।

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে শরীরের প্রতিটা লোম দাঁড়িয়ে পরেছে।মেঘ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে, তবে তার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ত্রমশ কমে আসছে। আবির তাড়াহুড়ো করে স্লাইডার টেনে উপরে উঠিয়ে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হয়ে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পড়নের জ্যাকেট টা খুলে ফেলল। মনে হচ্ছে সারাশরীর থেকে গরম বাতাস বের হচ্ছে। চোখের সামনে বার বার প্রেয়সীর উন্মুক্ত পৃষ্ঠ ভেসে উঠছে৷ নিচে এসে চেয়ার টেনে বসে, এক নিঃশ্বাসে এক গ্লাস পানি শেষ করল ৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। পকেটে থাকা ফোনটা অবিরত ভাইব্রেশন হচ্ছে । ফোন বের করে কল রিসিভ করল, সাকিব কল দিয়েছে। কথা বলতে বলতে মেইন গেইট পেরিয়েছে।

মামনি আর কাকিয়া গাড়িয়ে বসে আছেন। মীম আর আদি ছুটোছুটি করছে। কে সামনে বসবে সেটা নিয়েই দুই ভাইবোন বিবাদ করছে। আবির কে বের হতে দেখেই দুজন শান্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে আবিরের প্রস্তানের পরপরই অষ্টাদশী ধপ করে বিছানায় বসে পরেছে। উন্মুক্ত পৃষ্ঠে আবির ভাইয়ের স্পর্শ অনুভব করতেই বার বার শিহরিত হচ্ছে মেঘের গাত্র। যাও ভেবেছিল জ্যাকেট টা পরবে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গ্রীষ্মের প্রখর রোদে পু্ড়ছে তার দেহ৷
কিছুক্ষণের মধ্যে নিচে নামলো মেঘ। আবির গেইটে তালা ঝুলিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই শুনতে পেল তিন ভাইবোনের কথোপকথন। তিনজন ই সামনে বসার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে । আবির সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসে পরলো।

আকলিমা খান গাড়ির ভেতর থেকে ডাকলেন,
“কিরে, তোরা কি গাড়িতে উঠবি?”
মেঘ বাকিদের উদ্দেশ্যে বলছে,
“শুন, আবির ভাই যেই রা*গি, গাড়িতে বসে ঘাড় ঘুরালেই দিবে মা*ইর। তোরা কেউ সামনে বস। আমি বরং পিছনেই বসবো।”
মেঘের কথা শুনে মীম আর আদি দুজন দুজনের দিকে তাকালো। আদি দৌড়ে এসে মায়ের পাশে বসে পরেছে। আদির পিছন পিছন মীমও ছুটে এসে বলছে,

“আমিও আম্মুর সাথে যাব। ”
মেঘ মনমরা হয়ে বলল,
“কি আর করার, তাহলে তো আমাকেই সামনে বসতে হবে।”
উপরে উপরে মনমরা ভাব দেখালেও মনের ভেতরে তার রাজ্য জয়ের খুশি।
আদি একগাল হেসে বলল,
“মেঘাপু তুমি ই বরং সামনে বসো।”

মেঘ যে মনে মনে তাই চাইছিল এটা তো আর তারা জানে না। আবির ভাই গাড়ি চালাবে আর মেঘ পিছনে বসবে তা হতেই পারে না। গতকাল রাত থেকেই প্ল্যান করে রেখেছে যেভাবেই হোক তাকে সামনে বসতেই হবে৷ মেঘ মিটিমিটি হেসে গাড়িতে উঠেছে। আবির এতক্ষণ বেখেয়ালি থাকলেও পুরো ঘটনায় সে মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে মুচকি হাসল। আবির চাইলেই সবার মধ্যে মেঘকে সামনে বসতে বলতে পারতো না। মেঘ যে নিজে থেকে আবিরের পাশে বসার চেষ্টা করেছে এতেই আবিরের মন প্রশান্তিতে ভরে গেছে।
দিনকে দিন মেঘের করা পাগলামি গুলো আবিরকে তার প্রেয়সীর প্রতি আরও বেশি আসক্ত করে তুলছে।

খান বাড়ির রাজপুত্র আর রাজকন্যারা ঢাকা থেকে ত্রিশালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। আবিরের মামার বাড়ি ময়মনসিংহ বিভাগের ত্রিশালে। যানজট পেরিয়ে আসতে অনেকটায় সময় লেগে যায়। আবির পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। মেঘ একবার রাস্তার দিকে দেখছে, মাঝে মাঝে আড়চোখে আবিরকেও দেখছে। আবিরের দিকে যতবার তাকায়, ততবারই বাসার ঘটনার কথা মনে পরে যায়।

প্রতিবারই অষ্টাদশী লজ্জায় নুইয়ে পড়ে। আকলিমা খান আর হালিমা খান সাংসারিক আলোচনা করতে ব্যস্ত। গাজীপুর চৌরাস্তা পেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর আবির গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিয়েছে। শীতল পরিবেশ, রাস্তার পাশে বিশাল আকৃতির গাছ। মেঘ একমনে তাকিয়ে সেসব দৃশ্য দেখছে, আর আপনমনে কতকি ভাবছে৷ অষ্টাদশীর অশান্ত মনে ছুটোছুটি করছে কতশত প্রেমময় বার্তা। আচমকা আবির রাস্তার পাশে গাড়ি থাকাতে মেঘ সহ বাকিরাও চমকে উঠে৷ আবির মামনি আর কাকিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,

“তোমরা একটু বসো। আমি আসছি৷ ”
৫ মিনিটের মধ্যে একটা শপিং ব্যাগ আর কিছু খাবার নিয়ে গাড়িতে উঠেছে৷ খাবার গুলো মীমদের দিয়ে শপিং ব্যাগ টা মেঘকে দিয়ে বলল,
“এটা রাখ৷ পরে নিবো।”

দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আবিরের মামা বাড়িতে পৌছালো। তিন মামার বাড়ি পাশাপাশি। বড় মামার বাড়ি দুতলা বিল্ডিং৷ বিয়ে বাড়িত গেইট অনেক দূর থেকেই সবার চোখে পরেছে । গেইটের কাছে অনেকেই অপেক্ষা করছে। মীমদের নামতে দেখে বরণডালা নিয়ে মালা ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে।
মেঘ বের হতে যাবে এমন সময় আবির মেঘের হাত টেনে এক হাজার টাকার নোট মেঘের হাতে দিয়ে আস্তে করে বলল,

“বরণ করলে এটা দিয়ে দিস। ”
মেঘকে কেউ যেন কোনোভাবে কিছু বলতে না পারে, তাই আবির আগে থেকেই চোখ কান খোলা রাখার চেষ্টা করছে৷
আবিরের সামনে মালা বরণডালা ধরতেই আবির বিরক্তির স্বরে বলল,
“আমার এসব পছন্দ না। বরণ করলে ওদের কর।”
আবির বরণডালায় টাকা দিয়ে, মালা কে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকে পরেছে। মালা যথারীতি হাসিমুখে বাকিদের বরণ করল। আবির একটু ভেতরে আসতেই সাকিব দৌড়ে এসে আবিরকে জরিয়ে ধরে বলল,

“কেমন আছো ভাইয়া?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো। কত বছর পর তুমি আমাদের বাড়িতে আসছো৷ ভালো তো থাকতেই হবে।”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে শুধালো,
“বাকিরা কোথায়?”
“আছে। চলো।”

ততক্ষণে মেঘরাও বাড়িতে ঢুকে পরেছে। আবির বারান্দায় পা রাখতে রাখতে সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিল। সালামের উত্তর দিয়ে একেক জন একেক প্রশ্ন করছে। তাদের মধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা বলে উঠলেন,
“এইডা বাবু না? কত বড় হইয়া গেছে। মাশাআল্লাহ। বাবুরে চেনার তো কোনে উপায় ই নাই। ”
উঠান থেকে মেঘ কথাটা শুনেই ফিক করে হেসে দিল। আবির ভাইয়ের মত সুপুরুষ দেহী, এত লম্বা-চওড়া মানুষকে কেউ বাবু বলে সম্বোধন করছে এটা শুনেই হাসি পাচ্ছে। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধালো,

“বাবু কে আম্মু?”
হালিমা খান বললেন,
“আবিরকে ওর নানাবাড়ির মানুষ ছোটবেলা বাবু বলে ডাকতো। ওনি তোর বড় আম্মুর চাচি হোন।”
আবির মৃদু হেসে শুধালো,
“নানু কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালা আছি ভাই। তুমি ভালা আছো নি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। ”
বেশকিছুটা সময় আলাপচারিতা চলল। আবির মাইশার সঙ্গে দেখা করতে ভেতরে চলে গেছে। মাইশার রুমের সামনে এসে ডাকল,

“আপু আসবো?”
মাইশা আবিরকে দেখেই মিষ্টি করে হাসলো। বিছানা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছিস ভাই আমার! কত বছর পর তোকে দেখছি। ”
আবিরের ওষ্ঠদ্বয় প্রশস্ত হলো, উত্তরে আবিরও বলল,
” তোমাকেও। আচ্ছা আপু, এই বিয়েতে তুমি খুশি তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আব্বু আম্মু খুশি থাকলে আমিও খুশি। শুধু একটায় ইচ্ছে, যার কাছে বিয়ে দিচ্ছে সে মানুষটা যেন ভালো হয়। ”

“চিন্তা করো না। মানুষ হিসেবে ভাইয়া খুব ভালো। আমি খোঁজ নিয়েছি। তাছাড়া ওনার সাথে আমার দেখাও হয়েছে। ইনশাআল্লাহ তুমি সুখী হবে।”
“তুই দেখা করছিলি?”
এরমধ্যে মীম, মেঘ আর আদিও মাইশা আপুকে দেখতে আসছে। মাইশা বরাবর ই চাপা স্বভাবের একটা মানুষ। কখনো কারো বাড়িতে বেড়াতেও যায় না। তবে ফোনে প্রায় ই সবার সাথে কথা হয়। তাছাড়া মালিহা খান বেড়াতে আসলে ওনার মুখে বাসার সবার কথায় শুনে। সেভাবেই চিনে সকলকে।
আবির ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

“কেনো? ভাইয়া কি তোমায় বলে নি?”
” কথা বলি না তো। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর একদিন কথা হয়ছিল। আমার কথা বলতে খুব অস্বস্তি লাগে। ওনি মাঝে মাঝেই কল দেন কিন্তু আমি রিসিভ করি না। ”
আবির শপিং ব্যাগ আর নিজের পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে মাইশা আপুর হাতে দিয়ে বলল,
“তুমি কথা বলো না বলে তোমার জামাই মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে দিয়ে পাঠাইছে৷ এটা পড়ে ওনাকে কল দিতে বলছে। ”

মেঘ উত্তেজিত কন্ঠে শুধালো,
“রাস্তার ঐ লোকটা কি আপুর বর ছিল?”
আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে উপরনিচ মাথা নাড়লো। মেঘ মুচকি হেসে বলল,
“মাশাআল্লাহ, আপু ভাইয়া কিন্তু কিউট আছে৷ ”
মাইশা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাইশা কিছু বলার আগেই আবির মেঘকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
” হইছে তোর আর পাকনামি করতে হবে না। আপুর হাসব্যান্ড আপু বুঝবে। তোরা যা এখন । ”
মেঘ,মীম আর আদি রুম থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। আবির পা বাড়াতেই মাইশা আবিরের হাতে চিমটি কেটে আস্তে করে বলল,

“আমার জামাই রে কিউট বলছে তাতে তোর এত জ্বলে কেন! কাহিনী কি? কি চলে? ”
তখনই রুমে মালার আগমন হলো। আবির মালাকে দেখে থমথমে কন্ঠে জবাব দিল,
” কিছু না৷ ”
মালা বলল,
“ভাইয়া কেমন আছো? ”
“ভালো।”

আবির মাইশার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। আবির সাকিবের সঙ্গে থাকবে। তাই গাড়ি থেকে ব্যাগ নামিয়ে সাকিবের রুমে গেল। সাকিব আর মালারাও সম্পর্কে চাচাতো ভাই-বোন। মেঘ, মীম, দিশা, স্মৃতি ওরা চারজন এক রুমে থাকবে বলে ঠিক করেছে। দিশা মালার আপন ছোট বোন। স্মৃতি সাকিবের ছোট বোন। খাওয়াদাওয়া করে বিকেলের দিকে চার কাজিন মিলে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখছিল।

বিয়ে বাড়ি মানেই হৈ-চৈ। বিকেল হতে হতে আত্মীয় স্বজনদের ভিড় জমতে শুরু হয়েছে। মেঘ, মীম আগেও কয়েকবার এসেছিল তবে সেসব ছোটবেলার ঘটনা। এখন আর কিছুই মনে নেই তাদের। আবিরদের তিন মামার বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় তিনটা উঠান মিলে বাড়ির সামনে বিশাল মাঠের ন্যায় জায়গা। একপাশে খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আরেক পাশে গায়ে হলুদের স্টেজ করা হচ্ছে। সাকিব, মিলন, আবির এমনকি আদিও স্টেজ সাজানোতে ব্যস্ত। মেঘ আবিরকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো সেদিকে । স্মৃতি পেছন থেকে ডাকল,

“মেঘাপু কোথায় যাচ্ছো?”
“স্টেজ সাজানো দেখতে। ”
“ঘুরবা না?”
“তোমরা ঘুরে আসো। আমি যাব না। ”
মেঘ আর কোথায় যাবে । তার আবেগের কেন্দ্রবিন্দু তো আবির ভাই৷ আবির ভাইকে দেখাতে যতটা শান্তি, সেই শান্তি আর কোথাও নেই। তাই মেঘ স্টেজের দিকে এগিয়ে আসলো।
সাকিব মেঘকে দেখে জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছো, মেঘবতী? ”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
মেঘের কন্ঠ শুনে আবির পেছন ফিরে মেঘকে দেখলো। চুল গুলো বেঁধে, মাথায় ওড়না দিয়ে রেখেছে। আবির
লাইটিং সেট করতে করতে শুধালো,
“খাইছিস কিছু?”
“জ্বি৷”

সাকিব মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাইয়া কিন্তু এখনও খায় নি। তুমি ভাইয়ার খোঁজ নিলে না কেন?”
আবির দাঁতে দাঁত চেপে সাকিবের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বেশি কথা বললে তোর শরীরে তার পেঁচিয়ে দিব।”
মেঘ শীতল কন্ঠে বলল,
“আমি তো জানতাম না। ”
আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আমি খাইছি। সাকিব এমনেই মজা করছে। ”
আবির, সাকিবেরা কাজ করছে। মেঘ চেয়ারে বসে বসে তাদের কাজ করা দেখছে। কিছুক্ষণ পর স্মৃতি, দিশা আর মীমও চলে আসছে। সবাই চেয়ারে বসে গল্প করছে অথচ মেঘের নজর আবিরের দিকে। আশেপাশে কে কি বলছে সেসবে কোনো মনোযোগ নেই তার। স্টেজ সাজানো প্রায় শেষের দিকে, তখন মালা একটা প্লেটে অনেক রকমের পিঠা নিয়ে আসছে। আবিরকে ডেকে বলছে,
“আবির ভাইয়া, তোমার জন্য পিঠা নিয়ে আসছি।”

মালার কথায় আবির কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ফিরে তাকালোও না। অথচ মেঘের ছ্যাত করে রাগ উঠে গেছে। মনে পরে গেছে,বাসায় আবির ভাইয়ের উপর ঢলে পড়তে যাচ্ছিল এই মালা আপু। আবির ভাইয়ের প্রতি তখন তীব্র ভালোবাসা অনুভব করতে না পারলেও সেদিন ঠিকই কেঁদেছিল সে। তবে এখন তো সে আবিরকে ভালোবাসে। আবির ভাই ভালোবাসুক বা না বাসুক, অষ্টাদশী মনে প্রাণে আবিরকে ভালোবাসে। আবিরের আশেপাশে সে কাউকে সহ্য করতে পারবে না। মেঘ ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে।
মালা পুনরায় বলল,

“পিঠা গুলো খেয়ে নেও ভাইয়া। ”
আবির পেছনে না ফিরেই বলল,
“আমি খাব না পিঠা, ওদের দে। ”
হাত দিয়ে মেঘদেরকে ইশারা করল। আবিরের কথাটা মালার পছন্দ হয় নি। অকস্মাৎ সাকিব বলল,
“৩ দিন যাবৎ এত কাজ করতেছি। আমাকেও তো একটা পিঠা সাধতে পারিস।”
মালা সাকিবের উপর নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে,

“তুই কি বাড়ির মেহমান যে তোকে আলাদা করে পিঠা দিতে হবে”
সাকিব মন খারাপ করে বলল,
“আজ মেহমান হতে পারি নি বলে কেউ দাম ই দেয় না। ”
মালা আর কথা বাড়ালো না। মেঘের হাতে পিঠাগুলো দিয়ে চলে গেছে। পিঠাগুলো সে আবিরের জন্য আলাদা করে এনেছিল। নকশি পিঠার সবগুলোই লাভ আকৃতির। পিঠাগুলোর দিকে নজর পড়তেই দ্বিতীয় দফায় রাগ উঠে গেল মেঘের। মীম আর স্মৃতির দিকে পিঠাগুলো দিয়ে বলল,

“তোরা খা, আমি খাব না। ”
আবির সাকিবের দিকে তাকাতেই সাকিব জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে মেঘবতী ? পিঠা খাবে না কেন তুমি? আমাদের বাড়ির পিঠাগুলো কি অপরাধ করেছে যে তুমি তাদের ছুঁয়েও দেখছো না। ”
মেঘ গম্ভীর মুখ করে উত্তর দিল,
“পিঠা খাবো তবে এগুলো না। ”
সাকিব বলে,
“এই মিলন, মেঘবতীর জন্য পিঠা নিয়ে আয়। যত জাতের পিঠা ঘরে আছে সবগুলো নিয়ে আসবি। ”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমি এখন খাবো না পিঠা। ”

মিলন সেসবে পাত্তা দেয় নি, কিছুক্ষণের মধ্যে ই বড় প্লেট দিয়ে অনেক প্রকারের পিঠা এনে মেঘকে দিয়েছে। মেঘ না চাইতেও ২-১ টা পিঠা খেয়েছে। আবির লাইটিং এর কাজ শেষ করে মেঘের পাশের চেয়ারে বসেছে।
মেঘ আবিরের দিকে প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নেন পিঠা খান। ”
আবির দুহাত সামনে এগিয়ে বুঝালো হাতে ময়লা, খাবে কি করে। মেঘ ভণিতা ছাড়াই বলল,
“হাত ধৌয়ে আসুন। ”
আবির রাশভারি কন্ঠে বলে,

“কষ্ট লাগছে৷”
মেঘ মুচকি হেসে আস্তে করে বলল,
“খাইয়ে দিব আমি?”
“দিলে খারাপ হয় না।”
মেঘ কথাটা মজা করে বলেছিল। আবির ভাই যে এভাবে রাজি হয়ে যাবে এটা ভাবে নি। আবিরের পছন্দমতো কয়েকটা পিঠা খাইয়ে দিয়েছে। হঠাৎ আবিরের চোখে পরে, বড় মামার সঙ্গে আবিরের আব্বু বাড়িতে আসতেছেন। আবির মেঘকে বলে,

” আর খাবো না, তুই খা। ”
আবির তৎক্ষনাৎ চেয়ার থেকে উঠে স্টেজে চলে গেছে। স্টেজের বাকি কাজ করছে। আবির ভাইয়ের অকস্মাৎ পরিবর্তন দেখে মেঘ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভাবছে,
“এই বেটার সমস্যা কি, মাঝে মাঝে মনে হয় ওনার মতো রোমান্টিক মানুষ এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই, আবার মাঝে মাঝে মনে হয় ওনার মতো পাষাণ আর একটাও নেই। ওনি এমন কেন!”
আলী আহমদ খান মীম আর মেঘকে দেখে হাসিমুখে প্রশ্ন করলেন,

“তোমরা কখন আসছো?”
বড় আব্বুর কন্ঠস্বরে মেঘের ধ্যান ভাঙ্গে। মীম স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“দুপুরের দিকে আসছি বড় আব্বু।”
আবিরের বড় মামা শুধালেন,
খাওয়াদাওয়া করছো? নাকি শুধু পিঠায় খেতে দিছে তোমাদের? ”
মেঘ আলগোছে হেসে উত্তর দিল,
“আমরা এসেই ভাত খেয়েছি। এখন আবার পিঠা খাচ্ছি। ”
মামা পুনরায় বললেন,

“বাড়িটাকে নিজের বাড়ি মনে করবে। যা ইচ্ছে হবে নিজের হাতে নিয়ে খাবে। সেটা গাছের কোনো ফল ই হোক অথবা ঘরের কোনো খাবার। ”
মীম আর মেঘ একসঙ্গে বলল,
“আচ্ছা বড় মামা। ”

হঠাৎ করেই বাড়ির পরিবেশ বদলে গেছে। হৈ-হুল্লোড় যেন তিনগুণ বেড়ে গেছে। মাইশার শ্বশুর বাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন গায়ে হলুদের শাড়ি,মেহেদী আরও কি কি নিয়ে আসতেছে । আবির আগন্তুকদেরকে কয়েক মুহুর্ত পর্যবেক্ষণ করলো। ৪-৫ টা অল্পবয়স্ক মেয়ে সাথে ৫-৭ টা ছেলে। মালা গেইটের সামনে গিয়ে তাদের বরণ করছে। স্মৃতি আর দিশাও গেইটের কাছে চলে গেছে। মীম যেতে নিলেই আবির ধমক দেয়। আবিরের ধমকে মীমের সঙ্গে সঙ্গে মেঘ ও কেঁপে উঠেছে ।
আবির মেঘ আর মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” তোরা এখন রুমে যা। মেহমান যাওয়ার আগপর্যন্ত, তোদের এক বোনের ছায়াও যদি আমি দেখি তাহলে খবর আছে বলে রাখলাম। ”
মেঘ মাথা নিচু করে বলল,
“আপুকে হলুদ লাগাবো না?”
আবির বিরক্তির স্বরে বলল,
“রাতে লাগাইস। এখন যা। ”

মেঘ আর মীম দুজনেই মাথা নিচু করে একে অপরকে অভিযোগ জানাতে জানাতে রুমে চলে গেছে। এতদিন তানভির ভাইয়া এমন করেছে। মীম আর মেঘ দুজনকেই অতিরিক্ত শাসনে রেখেছে৷ এবার তানভির আসে নি তাই ভেবেছিল একটু আনন্দ করবে। সব আনন্দে আবির ভাই পানি ঢেলে দিল।

সন্ধ্যার পরপরই মেহমান চলে গেছে। মাইশা আপু মীম আর মেঘকে খোঁজে না পেয়ে দিশাকে দিয়ে ডেকে পাঠাইছে। মাইশা আপুর ৪ জন বান্ধবী এসেছে। মালা আপুর ও ৩ টা বান্ধবী এসেছে। এছাড়াও খালাতো, মামাতো বোনেরা তো আছেই। সন্ধ্যার পর থেকে বাড়িতে শাড়ি পরার ধুম পরেছে। মীম আর মেঘ বিছানার এক পাশে বসে সবার সাজগোছ দেখছে। মাইশা আপু বারবার দুজনকে শাড়ি পড়তে বলছে।

মীম শাড়ি দুচোখে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু সবার শাড়ি পড়া দেখে মেঘের খুব ইচ্ছে করছে শাড়ি পড়তে। তবে আজ পর্যন্ত কখনও শাড়ি পড়ে নি সে, তাই শাড়ি সামলাতে পারবে না ভেবে ভয় পাচ্ছে। মাইশা আপুর এক বান্ধবীকে দেখে হঠাৎ মেঘের রাকিবের গার্লফ্রেন্ড এর কথা মনে পরে গেল। জান্নাত আপুর বিয়েতে কত সুন্দর করে সেজে আসছিল। রাকিব ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড কে দেখে সেদিন মেঘেরও শাড়ি পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল। তবে আজ আর সাহস পাচ্ছে না৷

আচমকা মাইশা আপু মেঘের দিকে তাকিয়ে জোড় গলায় বললেন,
“মেঘ তুমি কিন্তু শাড়ি পড়বে। একদম না শুনবো না। পড়বে মানে পড়বেই।”
“আপু আমি তো কখনো শাড়ি পড়ি নি৷”
“তোমার যেভাবে সুবিধা হবে সেভাবেই পড়ানো হবে৷ তুমি চিন্তা করো না।”

মীমের এসব শাড়ি পরা দেখতে দেখতে আর ভালো লাগছে না। মেঘ শাড়ি পড়বে শুনে মন খারাপ করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মেঘ ও রেডি হতে ওয়াশরুমে গেছে৷ মাইশা আপু মিটিমিটি হাসছে।
মাইশা আপুর বেস্টফ্রেন্ড জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,
“কিরে হাসছিস কেন?”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩৬

মাইশা আশেপাশে দেখে বান্ধবীর কানের কাছে বিড়বিড় করে বলল,
“আবিরের কথা বলছিলাম না তোকে, ওর চাচাতো বোন মেঘ। আমি সিউর আবির মেঘকে পছন্দ করে, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। মেঘকে শাড়ি পড়াচ্ছি যাতে আবিরের রিয়েকশন বুঝতে পারি, বুঝলি। ”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩৮