আসক্তি পর্ব ১০

আসক্তি পর্ব ১০
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“এমনিতেও কোথাও যাওয়া হয় না তারউপর পা ভেঙ্গে বসে আছি। এখন তো আরো ঘর থেকে বের হওয়াও পসিবল না।এভাবে ভালোও লাগছে সারাদিন। শুয়ে শুয়ে থাকতে হচ্ছে”-দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে আর আনমনেই ভেবে চলেছে পাখি
“ম্যাম কিছু লাগবে,কিছু খাবেন?”
“না ইকরা কিছু লাগবে না”-সৌজন্যমূলক হেসে জবাব দেয় পাখি।
সন্ধ্যার কিছু পরে শান ফিরে আসে।

“হ্যা হ্যা ওখানেই রাখো ওগুলো আমি ঘরে নিয়ে আসব,তুমি ওখানেই রাখো”
দরজার সামনে কিছু একটা রাখতে বলছে শান।পাখি ঘার উচিয়ে দেখার চেষ্টা করছে;পারছে না।
শানের আসায় ইকরা নিজের রুমে চলে যায়।
কতোকগুলো ছোট বড় টবে কতোকগুলো গাছ।ইনডোর প্ল্যান্ট আউটডোর প্ল্যান্ট মনে হচ্ছে।দেখেই ঝলমলিয়ে ওঠে পাখির চোখ।তার অনেক ইচ্ছে ছিলো ইনডোর প্ল্যান্ট লাগানোর।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এতো গাছ! ”
“হুমম আনলাম।পছন্দ হয়েছে তোমার? ”
“ভীষণণণ।অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো আমার”
“জানি।”
“মানে,কিভাবে?”
“জানা টা খুব জরুরী”-চোখ ছোট ছোট করে শান প্রশ্ন করে
চুপসে যায় পাখি।পরোক্ষনে গাছগুলোর দিকে নজর পরলে আবারও ভালো লাগায় ভরে ওঠে মন।সাইড টেবিলের উপর রাখা মানি প্ল্যান্টটা হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে আর হাসছে মেয়েটা।শান ফ্রেশ হয়ে এসে আড়চোখে দেখেই চলেছে সেসব,

“একটা লুকায়িত বাচ্চা”।
“মানুষটা কি করে আমার মনের কথাগুলো বুঝে যায়?ঘরে শুয়ে শুয়ে বোর হবো তাই এতোগুলো প্ল্যান্ট উপহার!”-ভাবতেই একরাশ ভালো লাগা এসে ভর করে।

পাখিকে খাইয়ে দেয় ইকরা।এরপর নিজের রুমে চলে যায়।শান বিছানায় পাখির পাশে গিয়ে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।আর পাখি এক ধ্যানে সেদিকে চেয়ে আছে।
“কি দেখছো?”
“কককই ককিছু না তো!”
“এমন করো কেন পাখি?আমি কি খুউব খারাপ দেখতে?বা ভয়ানক?”
“মানে!”

“শোন আমরা স্বামী স্ত্রী।এর মানে কি জানো নিজেদের সব কথা আমরা একে অপরের সাথে শেয়ার করবো।আমি চাই তুমি তোমার ছোট বড় সব কথা আমায় বলো।ট্রাস্ট মি তোমার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনব।আর তুমি কিনা!”-মুখটা থমথমে করে আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দেয় শান
“আপনি এতো ভালো কেন শান!”-শানের দিকে ভালো লাগার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আচমকা প্রশ্নটা করে সে।
শান দু এক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে মুচকি হেসে চোখ খুলে।পাখির পাশ ফিরে ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি রেখে বলে,”ভয় লাগে না এখন?যদি খেয়ে ফেলি তোমায়”

বলতে বলতেই পাখির কাছে চলে আসে।
“ধ্যাত”-বলেই পাখি সরে যেতেই পায়ে সামান্য ব্যথা পায়
“কি হলো আবার ব্যথা পাইলা, না?আমি মজা করছিলাম ড্যাম ইট!উঠো ঔষধের সময় হয়ে গেছে তোমার”-বলেই শান উঠে ঔষধ খুলে পাখির হাতে ধরিয়ে দেয়।আজও সাত টা ঔষধ।

কেটে যায় কয়েক দিন।এর মাঝে শানের প্রতি পাখির ভালো লাগা দিনকে দিন বেড়েই চলছে।শানের সাথে গল্প করা,অস্বস্তি ছাড়াই মনের কথাগুলো বলা আর শান সেগুলো পালনের যথেষ্ঠ চেষ্টা করে, আড় চোখে শানকে দেখা, শাওয়ার নেয়ার পর শানের ভেজা চুলের বিন্দু বিন্দু পানির রেশ সবই যেন অভ্যেসে পরিনত হচ্ছে।

শান এখন একটু আকটু মজাও করছে ইদানিং। এই যেমন হুটহাট গালে চুমু দেয়া,হাতের উল্টোপিঠে চুমু খাওয়া, গোসল সেড়ে ভেজা চুল পাখির সামনে এনে ঝাড়া দেয়া।ল্যাপটপে শানের আগের ছবি গুলো নিয়ে হাসি মশকরা। এসবই যেন পাখির অভ্যেসে পরিনত হচ্ছে। পাখির মধ্যকার জড়তাও খানিকটা কেটে গেছে।ইদানিং বোর লাগে না কোন কিছুই।বেশ ফুরফুরে লাগে তার নিজেকে।
পাখিকে ডক্টর মাহমুদের চেম্বারে আরেকবার নিয়ে আসে শান।প্লাস্টার খোলার সময় হয়েছে।
ডক্টর প্লাস্টার খুলে অবাক হয়ে যায়।বেশ অনেকটাই রিকোভার হয়েছে ভাঙ্গা হাড়টা।

“শান হাড়টা ৮০% জুড়ে গেছে।এখন আরেকটু কষ্ট করে পাখিকে কয়েকটা ব্যায়াম করতে হবে। এতে আশা করা যায় ও পুরোপুরিই সুস্থ্য হয়ে যাবে”-বলেই ডাক্তার মাহমুদ কয়েকটা ঔষধ লিখে দেয়।
প্লাস্টার খোলায় পাখি এখন শানের বাহু ধরে ধীরেধীরে হাঁটতে পারে।প্রথম প্রথম শানের এতো কাছে যেতে খুব সংকোচ লাগতো কিন্তু কিছু করার ছিলো না।প্রতিদিন একটু একটু হাঁটার নির্দেশ দিয়েছিলো ডাক্তার। শান প্রতিদিন মেডিকেল যাবার পূর্বেই সকালে ছাদে নিয়ে আস্তে আস্তে ব্যায়াম করতে সাহায্য করে পাখিকে।

এ কয়দিনে পাখি শুধু মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শানকে দেখেছে।তাকে ছোঁয়ার মাঝে কোন খারাপ ইনটেইনশন শানের মাঝে দেখতে পায় নি সে।নিজের মাঝেই অজানাকে পাখিকে খুঁজে পায় দিন দিন।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই ইনডোর প্ল্যান্ট গুলোতে হাত বুলাচ্ছে পাখি।হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।ধীর পায়ে ফোনের কাছে গিয়ে স্ক্রীনে জলজল করা নামটা দেখে আনমনেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।

“হার্ট সার্জন”
“আস্সলামু আলাইকুম ”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম,ম্যাডাম কি করছেন এই মূহূর্তে?”
শানের কথায় লজ্জার আভা ভেসে উঠে পাখির গালে।
“প্ল্যান্টেদের কাছে….
“হুমম জানি তো।আমার অল্টারনেটিভ হিসেবে তাদের সাথেই সময় কাটান তবে”
নিঃশব্দে হেসে ওঠে পাখি।

“রেডি হয়ে থাকুন।বোরখা নয় শাড়ি পরবেন আজ আর পারলে একটু সাজবেন”
“আমি তো বোরখা ছাড়া কোথাও যাই না।”
“বোরখা ছাড়া এমন কোথাও নিবো না তোমায় যেখানে মানুষের নজর পরে যায়।রেডি হয়ে থেকো”
শানের প্রতিটা কথাই আজকাল খুব মাদকতা খুঁজে পায় পাখি।ভালো লাগা ছেঁয়ে যায় তার মুখে উচ্চারিত প্রত্যেকটা বাক্যে।মধুমিশ্রিত লাগে।

“মানুষটা এতো করছেন আমার জন্যে আমি কি এটুকুও পারবো না!”-ভাবতে ভাবতেই পাখি কালো রঙ্গের সফট জর্জেটের শাড়িটা কাবার্ড থেকে বের করে কষ্ট করে হলেও শাড়িটা সেট করে নেয় নিজের শরীরে।শাড়ির সাথে ম্যাচিং হাফ স্লিভের ব্লাউজটা পরে নেয়।ঠোঁটে হালকা খয়েরি রঙ্গের লিপস্টিকের ছোঁয়া লাগায়।কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ।কানে ছোট ছোট দুটো রেগুলার ইউজের স্বর্নের দুল পরে নেয়।পাখির চুল শান বড্ডো পছন্দ করে ।মুচকি হেসে চুল গুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে রাখে।
“ব্যাস আমি রেডি। ”

“নিচে সার্জন সাহেবের গলা শোনা যাচ্ছে অনেক্ষন হলো অথচ ঘরে এখনো আসছে না কেন”-ভাবতেই দরজার দিকে এগোতে ফট করে বাহির থেকে কেউ একজন লক করে দেয়।
“কি হলো এটা?কে লক করলো?নিচে কারো কোন আওয়াজও আসছে না আর সবাই কোথায় গেলো? কোন দূর্ঘটনা হলো? উনি ঠিকাছেন তো?”-ভাবতেই ধক করে ওঠে পাখির বুক।
হঠাৎ ঘরের ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়।পাখির যেন দম বন্ধ হবার উপক্রম এবার।বার বার ঢোক গিলে কয়েকবার ডেকে ওঠে,”মা মা,ভাবি,দাদি,টিনা কোথায় সবাই ”

কারো কোন সাড়া পায় না।হঠাৎ ফোনের কথা মনে ওঠে।ল্যাম্পপোস্টেের আবছা বেলকোনি ভেদ করে ঘরে আসে। আবছা আলোতে ঠাওর করে করে ফোনটা হাতে নেয়। শানকে কল করতেই দরজা খোলার শব্দে পিছন ফিরে তাকায় পাখি।
প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে শান্ত ভঙ্গিমায় দাড়িয়ে আছে কোন পুরুষ অবয়ব।অন্যরকম পারমিউমের গন্ধ।ভয় পেয়ে দু পা পিছাতেই বিছানায় বসে পরে পাখি।আর অবয়ব টা ধীরেধীরে কাছে চলে আসে তার।কন্ঠনালি শুকিয়ে আসছে ভয়ে।”হঠাৎ কি হলো বাড়িতে, আর ইনিই বা কে?”

” কেককে আপনি, বেডরুমে কি আপনার?বাড়ির সবাই কই?মাআাআ”!”-বলে পাশ কেটে চলে যেতেই পাখির হাতের বাহু ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে লোকটা।
“কে আপনি ছাড়ুন আমায়, কি করছেন এসব?”
লোকটা কোন কথা না শুনে একহাতে পাখির কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে নেয়।পাখির পিঠে নিজের বুকে ঠেকিয়ে চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়।
“অসভ্য লোক, ছাড়ুন আমায়। নির্লজ্জ কোথাকার। অন্যের বউয়ের সাথে এসব করছেন,লজ্জা করে না?ছাড়ুন আমায় প্লিজ। কে আপনি?”

লোকটার কাজের গতি যেন বেড়েই চলছে।এদিকে পায়ের ব্যথা এখনো সাড়ে নি।পায়ের ব্যথায় শব্দ করে ওঠে পাখি।তৎক্ষণাৎ লোকটা ওরে ছেড়ে দেয় কিন্তু কোন কথা বলে না। পা চেপে ধরে নিচে বসে পরে মেয়েটা।
ফট করেই লোকটা প্যান্টের প্যাকেট থেকে কিছু একটা বের করে পাখির চোখ বেঁধে ফেলে।হতভম্ব হয়ে যায় পাখি।
“কি করছেন আপনি, ছাড়ুন আমায়।চোখ খুলে দিন আমার”

“আপনি কোথায় হার্ট সার্জন।আমার বড্ডো ভয় করছে” বলতে বলতেই করুনস্বরে কেঁদে ওঠে পাখি।
লোকটার বুকে এলোপাথাড়ি মেরে চলেছে সে।কিন্তু কি পাথর এক পা ও নড়ছে না মানুষটা।খপ করে পাখিকে কাঁধে তুলে নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় সে।
“কোথায় নিচ্ছেন আমায়?নামান বলছি।ছিঃনামান আমায় প্লিজ।আমি একজন বিবাহিত মেয়ে।আমায় ছেড়ে দিন দয়া করে”-এমন হাজারো কথার প্রলাপ বকছে পাখি।
মানুষটার কোন হেলদোল নেই। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
মিনিট খানেক পর নেমে দেয় সে পাখিকে।

আসক্তি পর্ব ৯

আস্তে করে চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে পাখির সামনে দাঁড়ায়।
এদিকে এতো সময় চোখ বাঁধার ফলে জোনাকি পোকার মতো চোখের কোণ ঘেষে বের হচ্ছে তার।চোখ ডলে সামনে তাকতেই আবার নজর পরে সেই অবয়বের দিকে।অন্ধকার রাতে আশেপাশের ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে ক্ষীন আলো জ্বলছে।চোখের অন্ধকার ভাব যেন চারপাশে অমানিশা গড়ে তুলেছে।পাখির বোধগম্য হয় না সে কোথায় এখন!
চারপাশে কয়েকবার চোখ বুলিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে,”
কেন এমনটা করছেন,কোথায় এনেছেন আমায়। আমি কারোর কোন ক্ষতি করিনি জীবনে আমায় ছেড়ে দিন, দয়া করুন ”

হঠাৎ ফোন স্ক্রীনের ক্ষীন আলোয় লোকটার অস্পষ্ট মুখটা দেখা যাচ্ছে।লেগে থাকা মুচকি হাসিটা জানান দিচ্ছে ইনি আর কেউ না, তার হার্ট সার্জন।
দিগ্বিদিক চিন্তা না করেই দৌড়ে শানের কাছে চলে যায়।পা উচিয়ে গলা জড়িয়ে কাঁদতে থাকে পাখি।কান্নার গতি যেন বেড়েই চলছে তার।কিছুতেই থামছে না।
শান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর শান্তনা দেবার বৃথা চেষ্টা করছে।
“রিল্যাাাাক্স পাখি, আমিই তো। এতো বোকা মেয়ে হলে চলে?নিজের স্বামীকেই চিনতে পারলে না।ভেরি স্যাড”-বলেই কিছুটা মন খারাপের ভান করে সরে আসে।
এদিকে পাখির কান্নার বেগ কিছুতেই যেন থামছে না।

আসক্তি পর্ব ১১