আসক্তি পর্ব ১১

আসক্তি পর্ব ১১
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

পাখি অনবরত কেঁদেই চলছে। থামাথামির নাম গন্ধও নেই।হাতের এ পিঠ ও পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছে বার বার।কেমন বাচ্চাদের মতো ফুফিয়ে কেঁদেই চলেছে।শানের বুকের ভেতর কেমন যেন তোলপাড় উঠে গেছে।

“এই মেয়ের কান্না কেন আমার সহ্য হয় না।এতো করূন করে কেন ওকে কাঁদতে হবে?মজা করাটা বেশিই হয়ে গেছে মনে হয়!বার বার আমার কারণে কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। শিটটট!”
শান দ্রুত এগিয়ে পাখির মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকে।
“সরি পাখি,আই’ম রিয়্যেলি ভেরি সরি। তোমায় একটু ভয় দেখাতে গিয়ে…. দেখি”
বলতে বলতেই পাখির চোখের পানি দুহাতে মুছিয়ে দিতেই অভিমানী পাখি শানের দু হাত বার বার সরিয়ে দিচ্ছে।এরপর আলতো হাতে পাখির মুখটা তুলে কয়েক সেকেন্ড অপলক চাহনীতে চেয়ে আছে আর মুচকি হাসির কিঞ্চিত রেখা ফুটে উঠছে শানের মুখে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বড্ডো মোহনীয় তুমি,মায়াবি লাগে ভারি
কাঁদলে তোমায় দেখতে লাগে, একটা বাচ্চা পরী”
পাখি লজ্জামিশ্রিত ভালো লাগার আবেশে চোখ তুলে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।কেমন যেন হালকা বাতাসে চুল উড়ছে তার। চোখের পাতা মৃদু কাপছে। এরপর কপালে গাঢ় চুম্বনে থেমে যায় শান।
“এদিকে আসো”

পাখি এবার চারদিকে চেয়ে এতোক্ষনে ঠাওর করতে পারলো এটা বাড়ির ছাদ।তারমানে অন্য কোথাও নয়, হার্ট সার্জন তাকে ছাদে আনার জন্যে এতো কিছু করলো।ভাবতেই বাম পাশে ফট করে একটা লাইট জ্বলে উঠল।পাখির নজর সেদিকে পড়তেই বুঝতে পারে একটা টেবিলের উপর কয়েকটা জ্বালানো ক্যান্ডেল সাজানো।দুটো চেয়ার পাতানো।শান তাকে হাত ধরে সেদিকে নিয়ে যায়।

পাখিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে মুখোমুখি হয়ে নিজে অপরটা টেনে বসে পরে।সাথে সাথেই উপরের লাইট নিভে যায়।ক্যান্ডেল গুলো যেন প্রজ্বলিত হয়ে উঠলো আরো।চারদিকে বেশ থমথমে অন্ধকার তার মাঝে ছাদের উপর ক্যান্ডেলের ক্ষীণ ক্ষীণ আলো।অজানা ভালো লাগায় সময়কে মুঠো বন্দি করতে ইচ্ছে করছে পাখির।চারিদিকে অগাধ মোহনীয়তায় চোখ বুলিয়ে চলেছে সে।আর শান মুচকি হেসে পাখিকেই দেখে চলছে।

“ভালো লাগে নি তোমার?”
“হুমমমম অনেক ভালো লেগেছে।জানেন আমি কল্পনাও করতে পারি নি আমি কোন পুরুষের সাথে এতোটাও ক্লোজ হতে পারবো।এবাবে ক্যান্ডেল লাইট তো মাথাতেও আসে নি কখনো, উপভোগ করা তো দূরের কথা।”
শান শুধু মুচকি হাসছে।আর মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনছে।
টেবিলের দিকে ভালো করে নজর পড়লেই খেয়াল হয়, দুটো প্লেট ভর্তি ফুসকা।এতো দিন পর ফুসকা দেখে পাখির চোখ ঝলমল করে উঠে।

এক গাল হেসে হামলে পরে নিজের প্লেটের দিকে।শান শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে।
“আপনি জানেন ফুসকা আমার ঠিক কতোটা পছন্দের! আমায় তিন বেলা ফুসকা দিলেও সাবার করে দিতে পারবো”-মুখে পরপর কয়েকটা ফুসকা ঠুসে অস্পষ্ট স্বরে বলেই চলেছে পাখি।কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সবটা শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে।
“আমার জন্যে একটুও অপেক্ষা করতে পারলে না!”
“সত্যি তো, কি হলো এটা!”

“আসলে এতোদিন পর ফুসকা দেখে নিজেকে না কন্ট্রোল করতে পারি নি।তাইইই”- অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলতে বলতেই চুপসে যায় পাখি।
“হাহাহা,তুমি সত্যিই একটা বাচ্চা।কোন ব্যপার না।এই প্লেটও তুমি শেষ করো।আমি এসব খাই না।ভেবেছিলাম যদি তোমার সাথে দুটো খেতে পারি! কিন্তু তুমি তো “-বলতে বলতেই শান অট্টোহাসিতে ফেটে পরে।

এদিকে পাখির ভীষণ লজ্জা লাগছে। লজ্জামিশ্রিত চোখে শানের হাসি দেখছে।
“একজন ছেলে মানুষের হাসি এতো সুন্দর হতে পারে!”
“কোথায় হারালেন ম্যাম?”-শান তুড়ি বাজাতেই ভাবনায় ছেঁদ পরে পাখির।
“এদিকে আসো তোমার জন্যে আরো কিছু আছে”
“আরো??”
বলতে বলতেই শান হাত টেনে নিয়ে ছাদের আরেক মাথায় চলে যায়।
“দেখো, পছন্দ হয়েছে?”

জলগোলাপের তিনটা চাড়া।তিনটাতেই ফুলে ফুলে ভরা।টবের নিচে বিশাল বোলে ছোট ছোট মাছ খেলা করছে।টবের চারদিকে খুব সুন্দর লাইটিং করা।এতে মাছ গুলো দেখতে আরো আকর্ষণীয় লাগছে।পাখি অবাক চোখে সেসবের দিকে চেয়ে আছে।হাঁটুমুরে বসে জলগোলাপ গুলোয় হাত বুলাচ্ছে।
“এদিকে আসো”-আবার শান পাখির হাত টেনে আরেকটু দূরে নেয়।
“পছন্দ হয়েছে?”

পাখি চোখ বড় বড় করে চেয়ে দেখে। মাঝারি সাইজের এডেনিয়াম গাছ ফুলে ফুলে দোল খাচ্ছে।আবারও হাঁটুভেঙ্গে বসে চমকিত চোখে পাখি ফুল গুলো ধরছে।পুরো এডেনিয়াম গাছেও ছোট ছোট লাইটিং করা।তারপর ফট করেই ছাদের লাইট জ্বলে ওঠে।চারদিকে চেয়ে পাখির চোখ ছানাবড়া।হাজার রকমের ফুল আর ছোট ছোট বাহারি রঙ্গের পাতার গাছে ছাদের রেলিং এর চারপাশ পরিপূর্ণ। চোখ ঝলমলিয়ে ওঠে পাখির।পাখি এদিক ওদিক ছুটে ছুটে সব গাছ গুলো দেখছে।আর শান্ত ভঙ্গিতে ছাদের মাঝে দাঁড়িয়ে সবটা দেখেই চলেছে শান।

একটু পর পাখি দৌড়ে এসে শানের থেকে দু হাত দূরত্ব রেখে সামনে দাঁড়ায়।
“সার্জন সাহেব, আমি কখনো ভাবিই নি আমার স্বপ্ন গুলো এভাবে বাস্তবে পরিণত হবে।”-চোখের কোণে চিকচিকে জল শানের দৃষ্টির অগোচর হওয়ার সুযোগ পায় নি।শানকে অবাক করে দিয়ে দু হাতের দূরত্ব ঘুচিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাখি।টাল সামলাতে না পেরে দুকদম পিছিয়ে যায় শান। বুঝতে পারে চোখের কোণের জলগুলো এবার তার শার্ট ভিজাচ্ছে।আলতো করে পাখির মুখ তুলে চোখের জল মুছে দেয়।

“আর ইউ হ্যাপি”
“অনেক”-ঠোঁটের কোণে পূর্ণ হাসি রেখে জবাব দেয় মেয়েটা।
??
রাত ১১ টা বেজে ১৫ ছুঁই ছুঁই।
“তোমার ঔষধ আছে। ঘুমাইও না এখন।”
“আমার জানামতে পায়ের তো আর কোন ঔষধ নেই,তাহলে!”
“বড্ডো বেশি কথা বলছো ইদানিং।যা বলি তাই করো। ডাক্তার তুমি না আমি”
“আপনি।তাই বলে….”

“ধরো ঔষধ নাও।খেয়ে ঘুমাও।আর আমাকে আমার কাজ করতে দাও। কেমন!”
পাখি মন খারাপ করে ঔষধ গুলো নিয়ে পানি দিয়ে একবারে গিলে পাশ ফিরে শুয়ে পরে।
“সরি পাখি,এভাবে না বললে তুমি ঔষধ নিয়ে আরো প্রশ্ন করতে ”

“একটা কথা ছিলো”
“হুমম বলে ফেলো”
“বলছিলাম যে!”
“হুমম কি বলছিলে?”
“মানে, আমি তো এখন মোটামুটি সুস্থ্য তাই না?”
“তো!”
“বলছি যে বাড়ি যেতাম।বিয়ের পর এতো ঝামেলায় আর যাওয়া হয় নি খুব যেতে ইচ্ছে করছিলো”
এতোক্ষন শান আয়নায় নিজেকে সেট করছিলো মেডিকেলের উদ্দেশ্যে।পাখির কথায় চট করে পিছে তাকায়।একটু চেয়ে আবার আয়নায় নিজেকে সেট করায় ব্যস্ত হয়ে পরে।

“আপনি কি আমায় রেখে আসবেন নাকি বাড়ির গাড়িতে যাবো নাকি বাসে….?”
পাখির কথা শেষ না হতেই শান রাগী চোখে ওর দিকে ফেরে কিন্তু কোন কথা বলে না।
শানের ভাবগাম্ভীর্য দেখে দুটো শুকনো ঢোক গিলে আবার বলে,”কি করবো?কিভাবে যাবো?”
“আমি এ কয়দিন খুব ব্যস্ত; যাওয়া হবে না”
“তাহলে রাফি ভাইয়া(ড্রাইভার) রেখে আসবে”
“নো”

“মানে কি? আমি বাড়ি যাবো না? বিয়ে হয়েছে এতো দিন হলো একদিনও বাড়ি যাওয়া হলো না আমার,হুহহ”-এক রাশ অভিমান নিয়ে গাল ফুলিয়ে বলে পাখি।
“তোমার কি মনে হচ্ছে না ইদানিং বড্ডো বেশি কথা বলে ফেলছো”-শান আড়চোখে পাখিকে দেখে ফাইল গুলো গুছাতে গুছাতে বলছে।
……(পাখি নিশ্চুপ)

“সময় হলে আমিই রেখে আসব।বেশি বাড়াবাড়ি করবে না। আমি তোমায় রাফির সাথেও যেতে দেবো না আর বাসের কথা তো ভুলেই যাও”-বলেই ফোন টা হাতে নিয়ে দরজা ভিড়িয়ে বেড়িয়ে যায় শান।
পাখি অপরদিকে মুখ করে মেঝেতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ চুলের খোপটা খুলে দেয়।পাখি চট করে পিছু ফেরে।শান চেয়ে আছে ওর দিকে। শানকে দেখে মুখে ভেংচি দিয়ে সরে যেতে নিলেই শান দ্রুত ওর মুখটা দুহাতে ধরে ফেলে। আর পাখির কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিয়ে বলে, “রাগ করো না।আর ক’টা দিন যাক তারপর ও বাড়ি রেখে আসব। প্রমিজ”

বলেই পাখির উত্তরের অপেক্ষা না করেই দ্রুত বাহিরে চলে আসে।
“আমি তোমায় ছেড়ে আমার একটা দিনও ভাবতে পারি না পাখি।তাই তো ইনিয়েবিনিয়ে বাড়ির যাওয়ার ডেইট পিচাচ্ছি”-ভাবতে ভাবতেই সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে শান।
এদিকে শানের এমন উদ্ভট আচরন আজ নতুন নয়।বিগত দিন গুলো ধরে এমনই করছে সে।অবশ্য পাখির আর খারাপ লাগে না।বেশ ভালোই লাগে।মুচকি হেসে ডান হাতে নিজের কপাল ছুঁয়ে চোখ বুজে ফেলে।পরোক্ষনেই বাড়ির কথা মনে পড়তেই মুখটা মলিন হয়ে যায়।

“নিচে যাই।তাহলে যদি মাইন্ড টা একটু ডাইভার্ট হয়”
নিচে এসে দেখে কেউ ড্রয়িং রুমে নেই।সকালের নাস্তা সেড়ে সবাই নিজেদের রুমে আছে।মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো।মায়ের রুমের দরজা খোলা দেখে সেদিকে চলে যায় পাখি।
“আসব মা?”
“আরে বউ মা! আসো আসো!অনুমতি নেয়া লাগবে না গো মা। যখন ইচ্ছে হবে চলে এসো।পান খাবে?”
“হ্যা মা, দিন ”
পান টা মুখে পুরে পাখির নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।ওর মা ও পান খায়।মুখটা মলিন হয়ে যায় পাখির।
“বউ মা”
“হহহ্যা মা”

“তোমার মন খারাপ?”
“নাতো মা, ককেন? ”
“কি হয়েছে মা বলোতো,শান আবারও খারাপ ব্যবহার করেছে?”
“না মা, উনি সেদিনের পর থেকে আর কোন দিন আমায় বকে নি।”
“তাহলে কি হয়েছে, মন খারাপ কেন তোমার?”
পাখি কিছুক্ষন শ্বাশুরি মায়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলে ওঠে,”মা আমার না খুব বাড়ির কথা মনে পড়ছে।কতোদিন হলো যাই নি”
বলতে বলতে চোখের কোণ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়তেই নিজেকে সামলে নেয়।
“সত্যিই তো!বিয়ে হয়েছে এতোদিন মেয়েটা তো এখনো প্রথম নাইওর ও করতে পারলো না”-মনে মনে ভেবেই শর্মিলা বলে ওঠে,”আচ্ছা বউ মা মন খারাপ করো না আজ শান আসলে বলবো তোমায় কিছুদিনের জন্যে ওখানে রেখে আসতে”

“উনি নাকি খুব ব্যস্ত মা, তাই সময় হবে না যাওয়ার। আমি রাফি ভাইয়ার কথা বলেছি তাতেও তিনি রাজি না”-মাথাটা নিচু করে বলে পাখি।
“এটা কেমন কথা, নিজেও যাবে না ড্রাইভারের সাথেও যেতে দেবে না।তাহলে কেমনে যাবে মেয়েটা!”
“তোমার শ্বশুরও তো বাসায় নেই। আচ্ছা রে মা আমি ব্যবস্থা করছি!
ওদের কথার মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে।
হাঁক ছেড়ে শর্মিলা বলে ওঠে,”সুমি দেখতো কে এলো”
“নতুন ভাবি ও নতুন ভাবি, দেহো কেডা আইচ্ছে!”
“কই গো আইসো, দেহো কেডা!”

সুমির ডাকে পাখি দ্রুত ড্রয়িং রুমে চলে আসে।শ্বাশুরি মা ও পাখির পিছে পিছে চলে আসে।এতোদিন পর নিজের ভাইকে দেখে খুশিতে চোখ ছলছল করে ওঠে পাখির।এদিকে সোহানও নিজের বোনকে এভাবে সুস্থ্য- সবল দেখে অবাক হয়ে যায়।
“ভাইয়া”-দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে ওঠে মেয়েটা।
বোনকে এতোদিন পর কাছে পেয়ে দুফোটা জল পড়ে যায় সোহানের চোখ থেকে।কিছুক্ষন পর পাখিকে ছাড়িয়ে শর্মিলা বেগমকে সালাম জানায়।কুশল বিনিময়ের এক ফাঁকে সোহানের রংপুর আসার কারণ জানতে চায় শানের মা।

“আসলে আন্টি ব্যবসায়িক কাজে প্রায় রংপুরে আসা হয়। আজও তাই।তো ভাবলাম পাখির সাথে দেখা করে ওকে নিয়ে যাই।অনেক টা দিন তো হলো ও বাড়ি ছাড়ার।বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ওকে ছাড়া।এভাবে এতোদিন কখনো বাড়ি ছেড়ে থাকে নি ও”-শেষের কথাটা বলতে সোহানের গলায় কান্নাগুলো যেন দলা পাকাচ্ছিলো।শর্মিলা বুঝতে নির্বাক হয়ে পেরে এক গাল হেসে দেয়।
“জেনি এসছে,তোকে নিয়ে যেতে বলেছে সাথে করে”
“জেনি!কবে এসছে ভাইয়া”

“কালকে এসছে।তোকে নাকি খুব মিস করছিলো”
জেনির কথা শুনে পাখির আর একদন্ড এ বাড়ি থাকতে মন চাইছে না।জেনি ওর ফুপাতো বোন;সমবয়সী।বেশ ভাব দুজনের ছোটবেলা থেকেই।
“ইশ! কতো দিন পর দেখা হবে জেনির সাথে।মা আমি যাই!প্লিজ মা!”
শর্মিলা ঠোঁটের কোণের হাসি এলিয়ে হ্যা বলে দেয়।
পরোক্ষনেই শানের কথা মনে আসে পাখির।
“উনি জানলে বকবে না তো!”
“কিন্তু মা, আপনার ছেলে!

“ওকে আমি ম্যানেজ করে নিবো বউ মা।তুমি যাও বেশ কিছুদিন থেকে চলে এসো।নয়তো শান গিয়ে নিয়ে আসবে”-পাখির মুখ থেকে তবুও যেন দূঃচিন্তার ছাপ যায় নি এখনো।
“আচ্ছা দাঁড়াও ওর থেকে শুনি কি বলে!”
তিনবার রিং হলো অথচ কল রিসিভ হলো না।এদিকে শানের জন্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করাও সম্ভব না।তাই পাখি বাড়ি যাওয়ার আনন্দে ব্যাগপত্র গুছিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেড়ে ৩ টার দিকে ভাইয়ের সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

রাত নয়টা বেজে গেছে।সকলের ডিনারের সময় এখন।শানের মা ছোট জা রহিমা আর হেল্পিং হ্যান্ড সুমিকে সাথে নিয়ে একে একে সমস্ত খাবার ডাইনিং এ সাজাচ্ছে।এমন সময় ক্লান্ত শরীরে টলতে টলতে বাড়িতে ঢোকে শান।বাড়ির মেয়েদের রান্নার কাজে দেখে এক ফাঁকে তাদের মাঝে পাখিকে খোঁজে। ব্যর্থ চোখে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়।নিজের রুমে আবারও খুঁজতে থাকে পাখিকে;কোথাও নেই।চাপা স্বরে কয়েকবার বেলকোনির দিকে ডেকে ওঠে। কন্ঠেই স্পষ্ট কতোটা ক্লান্ত সে।পাখিকে খুঁজে পায় না।

“কাল যা জিনিস এনেছি মনে হচ্ছে তাদের সাথেই কথা বলছে।শাওয়ার টা নিই তার পর ছাদে গিয়ে দেখছি।ওয়েট ম্যাম আপনাকে আচ্ছামতো বকব আজ”-ভাবতে ভাবতেই শান ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।
বেশ ক্ষানিকটা সময় পর ওয়াশরুম থেকে বের হয় শান।টাওয়াল দিয়ে চুল মুছে মনের অজান্তেই চুল গুলো ঝেড়ে ওঠে।পরোক্ষনে তাকিয়ে দেখে রুমের কোথাও পাখি নেই।খালি খালি মনে হয় নিজের মাঝে।
ভেজা তোয়ালেটা বিছানায় ফেলে চলে যায়।ইদানিং বদ অভ্যেস হয়েছে শানের।ভেজা তোয়ালে, টি-শার্ট সব বিছানার উপর ফেলে চলে যায়।আর পাখি রেগে দ্রুত সেগুলো নিয়ে শুকাতে দেয়।শানের বেশ মজা লাগে পাখির তখনকার রাগ দেখে।আজও তাই রেখে যায় শান।

ছাদের আনাচেকানাচে পাখিকে খোঁজে শানের চোখ।কিন্তু কোত্থাও পায় না।
“কোথায় যাবে ও?প্রতিদিন তো রুমেই থাকে নয়ত রান্না ঘরে।আজ কোথাও নেই ছাদেও নেই”-আনমনে বিড়বিড় করে সিড়ি ভাঙ্গাতে থাকে।
“মা,মা, ও মা”
“হ্যা বলো, শুনছি”
“মা তোমার আদরের বউমা কই?”
“তা আমি কি জানি! আছে হয়ত কোথাও।ছাদে বা তোর ঘরে বা বেলকোনিতে”
“মা সব জায়গায় খুঁজলাম তো। কোত্থাও নেই”
“কোত্থাও নেই, আহারে বেচারা শান চু চু চু!”-মুখে হাহুতাশের শব্দ তুলে শানের চাচি হেসে ওঠে।শানের কর্ণকুহর অবধি তা পৌঁছায় নি।

এবার রান্নাঘরে এসে মা কে আবার ডাকতে থাকে
“বলো না কই আছে ও”
“দেখো তোমার দাদিজানের ঘরে হয়ত…”
“কি রে ভাইয়া তুই তো এমন ছিলি না। ইদানিং হা হু ছাড়াও গড়গড় করে কথা বলিস।আগে তো ও দুটো ছাড়া কথাই বলতিস না।হিহিহি।”
“বড় মা তোমার ছেলে দেখো কেমন বউ পাগলা হয়ে গেছে”
টিনার দিকে কটমট করে চেয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই টিনা চোখ সরিয়ে নিজের রুমে দৌড় লাগায়।
“মা দাদিমা, একা একা শুয়ে তসবিহ গুনছে পাখি কোত্থাও নেই সেখানে”
ছেলের অবস্থা দেখে শর্মিলার বেশ ভালোই লাগছে।বউকে কেমন চোখে হারাচ্ছে!
“ও বাড়ি চলে গেছে”

“what!!!!!!”-এক প্রকার চিল্লিয়ে বলে ওঠে শান।
পরোক্ষনে সবাই তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে দেখে।শান বুঝতে পেরে নিজেকে সামলিয়ে চাপা স্বরে বলে ওঠে,”হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বাড়ি চলে গেছে?”
“কেন যাবে না? কোন মেয়ে বিয়ের পর প্রথম বারই এতোদিন শ্বশুর বাড়ি থাকে বলতো!তুই এতো অবাক হচ্ছিস কেন?বাড়ি মাথায় তুলে রাখছিস।এমন ভাব করছিস যেন চিরতরে হারিয়েছিস ওকে!
মায়ের শেষ কথা শুনে শানের বুকের বাম পাশে কিঞ্চিত ব্যথা অনুভব হলো।অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।

“তুই নাকি নিয়ে যেতে পারবি না;ব্যস্ত!রাফির সাথেও যাইতে দিবি না তাই বলে মেয়েটা মনমরা হয়ে বসে থাকবে আর আমি সেটা বসে বসে দেখব? তা পারব না বাপু”
“সত্যিই তো কতোদিন হলো এ বাড়িতে আসার।মন তো খারাপ করবেই।আমি কিনা নিজের স্বার্থ্যের জন্যে বন্দি রেখেছিলাম ওকে”-ভাবতে ভাবতেই শান্ত ভঙ্গিতে মা কে প্রশ্ন করে,”কার সাথে পাঠিয়েছো?এখন এটা বলো না বাসে পাঠিয়েছো?আর আমায় একটা বার জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না?”
“বউমা’র ভাই এসেছিলো ব্যবসার কাজে।মন খারাপ করেছিলো মেয়েটা তাই আমি আটকাই নি;যেতে দিয়েছি।যাওয়ার কথা শুনে কেমন সাথে সাথেই চোখ জ্বলজ্বল করছিলো।”

আসক্তি পর্ব ১০

” আর তোর ফোন চেক করেছিস একবারও?কতোবার ফোন দিয়েছি দেখেছিস?”-দাঁত চিপে বলে শানের মা
“বাটন ফোন টা তো আজ একবারও চেক করা হয় নি”
“কি এতো ভাবছিস?১০-১৫ দিন পার হলে গিয়ে নিয়ে আসিস।তোর বউ হারাবে না বাছা”-ডায়নিং এ বসতে বসতে শর্মিলা বলে ওঠে।তার কথা শুনে সবাই একসাথে হেসে দেয়।
শান সবার দিকে অনূভূতিহীন চাহনীতে একবার চেয়ে সিঁড়ির দিকে চলে যায়।
“কি রে খেলি না যে!”

“এখন ক্ষিদে নেই।পরে খেয়ে নিবো।”-বলতে বলতেই ঘরে ঢুকে যায় শান।
“খালাআম্মা ভাইজান মনে হয় মাইনবের চাইচ্ছে না যে ভাবি নাই”-
“আস্তে বল।নয়ত জানিস তো ও কেমন!চুপচাপ খেয়ে নে”সুমির কথায় ওকে মৃদু হাসিতে শাসিয়ে ওঠে শর্মিলা বেগম…..

আসক্তি পর্ব ১২