আসক্তি পর্ব ২৯

আসক্তি পর্ব ২৯
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“পাখি আমার জীবনের এই কালো অধ্যায়কে আমি একদম সামনে আনতে চাই নি আর না চেয়েছি তোমায় আঘাত করতে।এরকম আনুষঙ্গিক অনেক কারণে তোমার থেকে সবটা লুকিয়েছি পাখি , দ্যাট’স ইট”
আকাশের দিকে থমথমে মুখে চেয়ে শান কথা শেষ করে।
পাখি চোখের জল মুছে বলে,”তারপর কি হলো সার্জন সাহেব?আমি পুরোটাই জানতে চাই”
“সন্ধ্যা হলো যে, বাড়ি ফিরবে না? ”
“না, আরো কিছুক্ষন থাকি সবটা শুনে তারপর যাবো”

হেসে ফেলে শান।পূনারায় বলতে শুরু করে, “সেদিন মিটিং শেষে নীরাকে নিয়ে একা কথা বলতে চলে যাই।জিজ্ঞাসা করি চোখের পানি মুছে এসবের পিছনে কারণ জানতে চাই।নীরা যা বলেছিলো তা শুনে জীবনের চরম অভিজ্ঞতার খোঁজ পাই;সবথেকে বড় আঘাত টা প্রিয় মানুষরাই দেয়।বন্ধুত্বের সুযোগে নাবিদ আমায় ঠকায়।গোপনে নাবিদ আর নীরার মাঝে সম্পর্ক চলছিলো।নাবিদ অনেক বার নীরার চরিত্রের ব্যপারে আমায় বলেছিলো কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নি।আর নাবিদ নীরার সেই নোংড়া চরিত্রের সুযোগ গ্রহন করে আমায় পড়াশুনায় পিছনে ফেলতে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নাবিদ বিভিন্নভাবে নীরাকে ইম্প্রেস করে এরপর নীরা আর নাবিদকে ফেরাতে পারে নি।আমার অগোচরেই চলছিলো তাদের প্রেম।নীরা যখন কনসিভ করে তখন নাবিদও তাকে ইগনোর করা শুরু করে।নীরা সমাজ আর নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলে।

পরিশেষে, দুজনে আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলেছিলো।সেদিন নীরার সাথে কথা বলার পর আর পিছু ফিরে তাকাই নি নীরার দিকে।সোজা চলে এসেছি রুমে।ফিরে নাবিদকে কিচ্ছু বলার ক্ষমতা ছিলো না আমার।কেমন যেন বোবা হয়ে গেছিলাম।শাওয়ার নিয়ে উপাচার্যের সাথে কথা বলে হোস্টেল রুম চেইঞ্জ করেছিলাম শুধু।এরপর না রেখেছি নাবিদকে আমার লাইফে আর না নীরাকে।শুধু পড়া আর পড়া।মনে হয়েছিলো জীবনে কিছু করা উচিত।যাতে সামাজিক শ্রেনীভেদে আমাকে দেখতে সবার মাথাটা উপরে তুলতে হয়।

এরপর আর কি শুরু ফাইনাল ইয়ার এক্সাম।ডান বাম কোথাও তাকাই নি।নিজের কষ্টার্জিত ধনভাণ্ডার একত্রিত করে পরীক্ষা দিয়েছিলাম।অনেক ভালো পরীক্ষাও দিলাম।টপ রেজাল্ট আসলো।নাবিদেরও রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই আসলো সাথে নীরারও।হয়ে গেলাম এমবিবিএস ডক্টর। এবার পালা ইন্টার্ণশীপের।এক বছরের পর সেটার রেজাল্টও ভালোই আসলো।

জীবনের এতো বড় ধাক্কার পর নিজেকে এমবিবিএস এর মতো এক্সামে টপে রাখা চাখটিখানি কথা নয় পাখি তবুও পেরেছি আমি।মাকে বা পরিবারের কাউকে জানাই নি কিছুই।একাই সামলেছি সবটা।
বাড়িতে এসেছি তিনদিন হলো। সামিহা ভাবি নাকি দিনাজপুরে বাবার বাড়ি গেছে।
পরদিন সামিহা ভাবি এসেছিলো সাথে নীরাও ।এতোদিন পর নীরাকে দেখে আমি একটু ঘাবড়ে গেছিলাম।কেমন শুকিয়ে গেছে মেয়েটা।জীর্ণদেহে জামাটা মানানসই লাগছিলো না।খুব কষ্ট হয়েছিলো ওকে দেখে।সন্ধ্যেবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম একা।হঠাৎ ঘাড়ে কারো হাতে স্পর্শে ফিরে তাকাই।নীরা, নীরা পাশে দাঁড়িয়ে।হুট করে আমার পা জোড়া জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।আমি হতবিহ্বলের ন্যায় দাঁড়ানো।

“আমার ভুল হয়েছে শান।আমি তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছি।ঠকিয়েছি তোমায়।নাবিদের কথায় আমি ওর ফাঁদে পা দেই শান।এরপর ও আমার সুযোগ নিয়ে আমায় নিঃস্ব করে দেয়।বাচ্চাটাকে রাখতে চেয়েছিলাম নাবিদ ভয় দেখিয়েছিলো বলে নষ্ট করতে বাধ্য হই। আমায় মাফ করে দাও। একটা সুযোগ দাও তোমার জীবনে ফেরার।ট্রাস্ট মি সবটা ঠিক করে দিবো।আমি বুঝতে পেরেছি কে আমার সত্যকারের ভালোবাসা।”-নীরা হেচকি তুলে কান্না করছিলো আর বলছিলো। আমার কি হলো জানি না নীরার সব ভুল ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছা হলো।ভাবলাম এখন তো দুজনেই স্টাবলিস্ট তাই সবটা মেনেই নেই।সত্যি বলতে খুব ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষের হাজার ভুল ক্ষমা করা যায় হাসি মুখে।(একদম উচিত নয়)।
আমিও তাই করলাম।জীবনের দ্বিতীয় ভুল করতে বসেছিলাম নীরাকে ঐদিন ক্ষমা করে আবার জীবনে জড়াতে চেয়ে।

ভুল হতে হতে বেঁচে গেছি।ভাগ্যিস মা ছাদের দরজার আড়ালে সবটা শুনে নেয়।কিন্তু অবাক করার বিষয় কি জানো, মা আমায় কিচ্ছুটি বুঝতে দেয় নি সেদিন।
তারপর থেকে আবারও আমাদের নিয়মিত কথা হতো।দেখাটা তেমন হতো না দুজনের কাজের চাপে।একদিন নীরা বিয়ের ব্যপারে কথা বলতে বললো বাড়িতে।আমিও মাকে জানালাম সবটা।মা জেনে শান্ত স্বরে বললো “নীরাকে এখানে আসতে বলো”

যথারীতি নীরা চলে আসলো ওর বাবা মা সহ।সবাই বসেছি বিয়ের ব্যপারে আলোচনায়।মা পুরোটা সময় নিশ্চুপ থেকেছে।এরপর মায়ের উত্তর ছিলো, “অসম্ভব।নীরাকে বউ করে আনব না আমি”
মা হয়ত নাবিদের সাথে নীরাকে দেখেই বুঝেছিলো নীরা কিরকম মেয়ে তাই সেদিন “না”সিদ্ধান্তেই অটল থেকে ছিলো।

মায়ের না’তে কেন জানি আমার তেমন কোন অভিযোগ ছিলো না।নীরার প্রতি আমার সহানুভূতি ছিলো নাকি ভালোবাসা তা বুঝতে পারছিলাম না।
হঠাৎ সামিহা ভাবি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,”যখন আমার বোনকে ব্যবহার করেছে আপনার ছেলে তখন কোথায় ছিলো মা আপনার এই “না”
কেন বাড়োন করতে পারেন নি আপনার ছেলেকে?শান আর নীরার বাচ্চাও এসেছিলো নীরার গর্ভে তা কি জানেন আপনি?”

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ভাবির কথায়।পরে বুঝতে বাকি রইল না নীরা সামিহা ভাবিকে মিথ্যে বলেছে।ওখানে বসা প্রত্যেকটা মানুষ অবাক হয়ে যায় ভাবির কথায়।আমি শুধু চেয়ে দেখছি মিথ্যে ক্রন্দনরত নীরার দিকে।অবাক হয়ে ভাবছি একটা মেয়ে এতো নিচে কি করে নামতে পারে!কিভাবে বলবো সবটা সবাইকে নীরার ব্যপারে নিজেরই লজ্জা লাগছিলো।

“আমি জানতাম এরকমই কিছু একটা ঘটবে। তাই আপনাদের এখানে ডেকেছি।বড় বউ মা তোমার বোনের বাচ্চার বাবা আমার শান নয় ;নাবিদ। ওদের বন্ধু”-মায়ের কথায় ভাবনায় ছেঁদ পরে আমার।এরপর মা ছাদে দাঁড়িয়ে আমাদের শোনা সবটা কথাই একে একে সবার সামনে বলে দেয়।
কিন্তু পরিশিষ্ট কি দাঁড়ালো, নীরার ফ্যামিলির কেউই আমাদের কথা বিশ্বাস করছিলো না।সামিহা ভাবিও না।ভাবিসহ ভাবির পরিবার সেদিন থানায় কমপ্লেইন রাখতে উদ্যত হয়।আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম।মা আঁচ করতে পেরেছিলো এই মিথ্যে বদনামের পরিনতি কি হতে পারে! কালো দাগ পড়তে পারে আমার ক্যারিয়ারে।তাই সেই রাতেই মা আমায় পাঠিয়ে দেয় আমেরিকায় চাচুর কাছে।

মা বাবা এদিকে সবটা সামলে নেয়।ফলে নীরার ফ্যামিলি আর থানা পুলিশ করার সুযোগ পায় নি।পরিবেশ পরিস্থিতি ঠান্ডা হবার ঠিক সাত মাস পর দেশে আসি।ততোদিনে সবটা শান্ত হয়ে যায়।কিন্তু ভাইয়া ভাবিকে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়।আমার অনুরোধে সবটা ঠিক হয় আবার।মায়ের সেদিনকার একটা সিদ্ধান্তই আমার জীবনের দ্বার উন্মোচন করে দেয়।আর বন্ধ করে দেয় আমার জীবনের কালো অধ্যায়টা।
আমার দেশে ফিরে আসার পর সামিহা ভাবি নিজের ভুলের জন্যে মাফ চায় আমার কাছে।এরপর আর কোনদিন ভাবি নিজের বোনের জন্যে আমাদের বাড়িতে উচু গলায় বলতে পারে নি।মিইয়ে ছিলো একদম।সেদিনের লজ্জা ভাবিকে মিশিয়ে দেয় মাটির সাথে।

তোমায় আরেকটা কথা কেউ বলেছে কিনা জানি না সামিহা ভাবি কখনো মা হতে পারবে না।প্রথম বাচ্চাটা মিসক্যারেজের পর ভাবি তার সেই স্বক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
নাবিদও নিজের ভুলে ক্ষমা চায়।তবে কি জানো আমি ক্ষমা করলেও আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করে নি।না করেছে নাবিদকে আর না নীরাকে।নাবিদের ওয়াইফ কিছুদিন আগে তাকে সর্বশান্ত করে মানমস্মান সবটা শেষ করে চলে যায় অন্য ছেলের হাত ধরে।আর নীরার তো ডিভোর্স হয়ে যায় তার বিয়ের তিনমাস পরেই।কেউ কারোর সাথে অন্যায় করে কখনো পার পায় না পাখি।সবটারই ফল পায়, তবে কিছুদিন আগে আর পরে।”

এরপর আমি সবটা ভুলে নিজের প্রফেশনে এক্টিভ হই।আর যার ফল আজ আমি, এক নামেই পরিচিত ডাক্তার ফয়সাল আহমেদ শান।অহঙ্কার করে বলছি না, গর্ব হয় যখন মানুষ নিজের আপনজনকে আমার উছিলায় অটিতে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে।

শান এবার পাখির কাছাকাছি এসে বলে,”আর রইল বাকি তোমার অসুস্থ্যতার কথা হ্যা তোমার সামন্য একটু সমস্যা ছিলো।যা পাপড়িই আমায় নীরার কাছে যেতে বলেছিলো।যাহোক তুমি সুস্থ হয়ে গেছো এটাই বেশি।তোমায় করূনা করিনি পাখি মায়ের সিদ্ধান্ত কখনোই ভুল হতে পারে না এ কথার উপর বিশ্বাস রেখেই তোমায় কাছে টেনেছি।কবে যেন ভালোবেসেছি জানি না পাখি।আর এবারও মায়ের সিদ্ধান্তই জিতে গেছে।”শান এবার অসুস্থ্যতার সব কথা বলে পাখিকে

“এবার বলো পাখি আমার কি দোষ?কেন অবিশ্বাস করেছিলা আমায়?কি শাস্তি দেবে বলো? তবে যাইই করো আমায় ছেড়ে যেও না।ইনফ্যাক্ট ছেড়ে যেতে দিবোই না।তুমি না চাইলেও আমি বাধ্য করব আমার সাথে থাকার।”-শান পাখির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলে।
পাখি টলমলে চোখে শানের বুকে ঝাপিয়ে পরে।কাঁদতে কাঁদতে বলে,”জীবনে এতোটা কষ্ট পেয়েছেন আর আমায় কিছুই জানান নি।অন্যদিকে দিনের পর দিন আমি মিসবিহ্যাভ করে গেছি সবটা সামলে আমার ট্রিটমেন্ট করেছেন তাও নিজের কালো অতীতের মানুষটার কাছ থেকে।আমায় যে ঋণী করে দিলেন সার্জন সাহেব।”

আসক্তি পর্ব ২৮

শান পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে চুপ করে থাকে।এরপর চোখের পানি মুছিয়ে বলে,”এসব বাদ দাও।আমি তোমাকে পেয়েছি, তোমার ভালোবাসা পেয়েছি এটাই অনেক আমার কাছে।এবার বাড়ি চলো।দুই ঘন্টার পথ যেতে হবে।নাকি এখানে থাকার নিয়ত আছে হুহহহ?”
“আরেকটু থাকি না!”-শানের গলায় মুখ ঠেকিয়ে বলে পাখি।

“রোম্যান্টিক ওয়েদার না?এতো কাছে তুমি,আমার কিন্তু সামথিং সামথিং হচ্ছে “-দুষ্টুমির স্বরে বলে শান।
পাখি শানের বুক দুহাতে ঠেলে বলে,”নোংড়া লোক।
পাখি শানের ঠোঁটে হাত রেখে বলে,”আপনার এই ঠোঁটে নীরা কিস করেছিলো না। সরুন আমি কোনদিন এটা মেনে নিতে পারব না।আমি কাছে আসলেই মনে হবে এই ঠোঁটে অন্য কারোর স্পর্শ রইছে।”
“সরি পাখি। আমি নিজেও এর জন্যে লজ্জিত আল্লাহ্ র কাছে।ক্ষমা চেয়েছি অনেক বার, নিশ্চই আল্লাহ্ ক্ষমাশীল।আমার একদম ইচ্ছে ছিলো না।অপ্রস্তুত ছিলাম আমি”

“সত্যিই!”
“একদম।এতোটাও খারাপ তোমার সার্জন সাহেব নয় জান পাখি”
এরপর দুজনে গাড়িতে উঠে বসে।শান গাড়ি ড্রাইভ করছে স্লো স্পিডে আর বাঁকা চোখে দেখছে পাখিকে।
পাখি বাহিরে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে সন্ধ্যার নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ উপভোগ করছে।

আসক্তি পর্ব ৩০