আসক্তি পর্ব ৩৯

আসক্তি পর্ব ৩৯
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“কিছু খেয়ে নাও পাখি, এভাবে শোক প্রকাশের নামে ন্যাকামি করছো নাকি শানের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়ছো জানি না।যাইই হোক খেয়ে নাও অন্তত বাচ্চাটার জন্যে”-রাগিস্বরে কথাটা বলে ঘরের দরজা থেকেই ফেরত যান রাশিদা বেগম।পাখি অবাক হয় মায়ের কথায়। তার মা তাকে এর আগে কখনোই এভাবে বলে নি।আজ তুমি করে বলছে তাও নাম ধরে, এ যেন অভাবনীয়,অকল্পনীয়।

অতিরিক্ত কান্না করার ফলে পাখির গলা ভেঙ্গে যায়।চোখ মুখ ফুলে ওঠে ।চোখ থেকে জলের ছাপটাও এখনো যায় নি।
ভাঙ্গা গলায় বলে,”দাঁড়াও মা।”
রাশিদা বেগম নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে যায়।বিপরীত মুখেই দাঁড়িয়ে থাকে।
“ও তোমাদের ভুলভাল বোঝালো আর তোমরা বুঝলে? একটি বারও বাবার কথা ভাবলে না মা?না হয় কয়টা টাকা দিয়ে বাবার হার্টে স্টেন্ট করেছে তাই বলে গেলে মা?তোমার কি মনে হয় না ঘরের থেকে পরকে বেশি মাথায় তুলছো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পাখি আবার কেঁদে ফেলে, গলার স্বর উঠছেই না তার।বলতে থাকে,”মা, আমার বাবা কম কষ্টে ওর কলার চেপে ধরেনি সেদিন।বুঝতে পেরেছো কতোটা আঘাত পেলে রেস্টুরেন্ট ভর্তি মানুষের সামনে ওমন কুলাঙ্গার জামাইয়ের গায়ে হাত তুলে কেউ?বুঝতে পেরেছো কম আঘাতে তিন মাসের মাথায়, এক রাতের ব্যবধানে বাবার হার্টে আবার এ্যাটাক আসে?”

“বড্ডো বেশিই বুঝে ফেলছ না পাখি?তোমাকে বার বার বলা হচ্ছে তোমার বাবার ইতোপূর্বে দুইবার হার্টে এ্যাটাক এসেছে।তার হার্টে আগে থেকেই সমস্যা ছিলো। হার্টের পেশেন্ট তিনি।তবুও এভাবে ছেলেটাকে ব্লেইম করতে লজ্জা করছে না একটুও?তোমার বাবার দিন রাতের সঙ্গী আমি ছিলাম।তাই আমি জানি তোমার বাবার কাছে শানের অবস্থান ঠিক কতোটা পাকাপোক্ত ছিলো।”

“সেটারই ফায়দা উঠিয়েছে সে মা!
“নির্লজ্জের মতো কথা বলো না।আচ্ছা তোমার ফুপাও তো সেখানে ছিলো আমরা না হয় শানের কথায় ভুলছি তিনি তো সেখানে বর্তমান ছিলেন তবে তার কাছ থেকেও তো সত্যিটা জেনে নিতে পারো।”
“আমি জানি মা, একটা সংসার ফেরত মেয়ে সমাজে বা পরিবারের জন্যে ঠিক কতোটা বোঝাস্বরুপ।তাই তোমরা চাইছো, যে চলে গেছে গেছে। তোমাদের মেয়ের সংসার যেন ওখানেই হয় তাই তো!আর ফুপাও তো এই চিন্তাই করবে তাই নয় কি!”

“প্রেগন্যান্সিতে মেয়েদের মুড সুইয়িং হয়। মেজাজ হারিয়ে ফেলে ঘনঘন কিন্তু তোমার মতো বিবেকহীন যে হয়ে যায় তা জানতাম না”-বলেই রাশিদা বেগম হনহন করে নিচে চলে আসে।
মায়ের কথায় পাখির কান্নার বেগ বেড়ে যায়।
“তোমাদের কি করে বুঝাই আমি তিনি তোমাদের মেয়েকে সড়ানোর প্ল্যান করেছিলো মা। ও ববহুরূপী মানুষ।”

চোখের পানি মুছে শান্ত করে নিজেকে বলে পাখি,” কেউ যদি আমার বাবা হত্যার বিচার না চায় ;চুপ করে থাকে আমি তো আর পারব না।কারণ বাবার মৃত্যুর জন্যে কোন না ভাবে আমিও দায়ি।কারণ আমার জন্যেই তো চলে গেল আমার বাবা”
আবারও বাবার কথা ভেবে কেঁদে ফেলে পাখি।

শান পাখিদের বাড়ি থেকে ফিরে আর নিজের ঘরে যায় নি;বাগান বাড়িতে উঠেছে।কারণ ঘরের প্রতিটা কোণে কোণে পাখির বিচরন।ফোনের সব সিম গুলো বন্ধ রেখে হসপিটালে দেয়া নম্বরটাই খোলা রেখেছে সে। একাকিত্বের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় নিজের বাগান বাড়িকে।আধা নির্মান করা বেলকোনিতে পা নিচে ঝুলিয়ে বসে পরে ।সন্ধ্যে হয়েছে অনেক আগে।চাঁদটা আজও জ্বলজ্বল করছে।পানিতে প্রতিচ্ছবি পরেছে চাঁদের।মনে পড়ে যায় পাখির সাথে কাটানো এখানকার প্রথম রাতটার কথা।পাখিকে দেয়া কথাটা রাখতে পারে না শান।ভুল করে ফেলে প্রথমবারের মতো।দ্রুত ঘরে গিয়ে সিগারেটের আস্ত প্যাকেটটা দেয়াশালাই সহ নিয়ে আবারও বসে পড়ে।একে একে একই সময়ে দশটা সিগারেটই শেষ করে তবুও পাখির কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না।

“এভাবে এতোবড় বদনাম টা না দিলেও পারতে জান।আমি বাবাকে বাঁচানোর আপ্রান চেষ্টা করেছি জানপাখি।পারি নি আমি।এই বিশ্বাস আমার উপর রেখেছিলে?”-আনমনে ভাবতেই দুচোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে অঝোড়ে।আর অনবরত সিগারেটের ধোঁয়া ফুকছে।
“আমি জানি তোমার এই ভুলটা ভাঙ্গবে।তবে আমি কোনদিনও তোমার এই ভুলটা ভাঙ্গাবো না।তুমি নিজেই বুঝবে একদিন আমি নির্দোষ।হয়ত সেদিন অনেক দেড়ি হয়ে যাবে।আমি যা করেছি সবটাই তোমার জন্যে করেছি। তুমি ফিরলে আমি কোনদিনও তোমায় ফেরাবো না জান।কারণ বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়”

চাঁদের দিকে চেয়ে শান অস্ফুট স্বরে বলে,”আই লাভ ইউ ব্ল্যাক এঞ্জেল,আই মিস ইউ!”
অন্যদিকে পাখিও জানালার কাছে বসে অনবরত কেঁদেই চলেছে আর আকাশের দিকে চেয়ে ভাবছে,”কিভাবে এতো অভিনয় করতে পারলেন?আমায় সময়ে অসময়ে আদোর করা,চমকে দেয়া,গিফ্ট দেয়া,ঘুরতে নিয়ে যাওয়া সবটাই কি তবে অভিনয় ছিলো সার্জন সাহেব?মনে আছে সে রাতের কথা, যে রাতে আমরা একে অপরের হয়েছিলাম?”

পাখির হেচকি উঠে যায় কাঁদতে কাঁদতে। পেটের উপর হাত রেখে ভাবে,”আমাদের অনাগত সন্তানটার কথা আপনি কখনো জানবেনই না। মনে আছে কবে এসেছে সে?সেই রাতে যে রাতে বৃষ্টি বিলাশ করেছিলাম দুজন।আমায় কাছে পেয়ে পাগলপ্রায় আপনি।তার কিছুদিন পরই আমার পিরিয়ডের ডেইট ছিলো কিন্তু সেটা মিস যায়।সবটাই কি তবে অভিনয় ছিলো সার্জন সাহেব?আমার বাবা জীবন দিয়ে সে অভিনয়ের প্রতিদান দিলো।আমি কক্ষনো ক্ষমা করবো না আপনাকে। আই হেইট ইউ”
কাঁদতে কাঁদতে জানালার পাশে বসেই ঘুমিয়ে যায় পাখি।

আজ শফিক সাহেব গত হওয়ার তিনদিন।শোকের ছাঁয়া যেন এখনো কাটেনি।তবুও রাশিদা বেগম নিজেকে সহ সন্তানদের খেয়াল রাখছেন।অন্তঃসত্ত্বা বউমার সব কাজ করে দিচ্ছেন।মেয়েকে বকেঝকে খাওয়াচ্ছেন,গোসল করাচ্ছেন।সবটাই সামলে নিচ্ছেন একা হাতে।নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন সাংসারিক কাজে।যাতে স্বামীর শূন্যতা তেমন মনে না আসে।

পাখি আগের থেকে ঘঘরকুনো হয়ে গেছে আরো বেশি।চেহারা খুব খারাপ হচ্ছে প্রতিটা মূহূর্তে।ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনই মনে করছে না।মেয়েকে দেখে রাশিদা বেগমের মায়া হয় অনেক বেশি।মেয়েটা ভুলের উপর দাঁড়িয়ে আছে অথচ বুঝতে পারছে না এ ভুল টা ভুল নয় অন্যায়।।আর অন্যায়ের শাস্তি আল্লাহ্ সবাইকে দেয়।তার মেয়ের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হবে না।এসব ভাবতেই অজানা ভয়ে হাফিয়ে পরে রাশিদা বেগম।

ঘরের কোণে থেকে থেকে কেঁদে ওঠে পাখি।নামাজের সিজদায় গেলে উঠার ইচ্ছে করে না তার।বাবার মৃত্যুর জন্যে নিজেকেই দায়ি মনে করে সে।
এরমাঝে কেটে যায় আরো একটা দিন।
শান বাড়ি ফেরে না দুইদিন হলো।শর্মিলা বেগম ছেলের দূঃচিন্তায় পাগল প্রায়।প্রথম দিন ভেবেছিলেন মন মেজাজ ঠিক নেই তাই বাড়ি ফেরে নি আর আজ তো দুদিন ;ছেলের কোন খোঁজ নেই।ফোন দিলেও ফোন বন্ধ পায়।

বাধ্য হয়ে পাখির কাছে ফোন দেয় তিনি।
“বৌমা, মা গো আমার ছেলে আজ দুদিন ধরে বাড়ি ফেরে না।জানি না কোথায় আছে ও!ফোনও বন্ধ রেখেছে।তুমি একটু খোঁজ করো না মা”
পাখি বসে যাওয়া শক্ত গলায় বলে,”মা আপনার ছেলের খবর কি করে দেবো আমি।দেখুন হয়ত অন্যকোন প্ল্যান করে লুকিয়ে আছে।নয়ত কাউকে নতুন করে মেরে ফেলার ফঁন্দি আঁটছে”
শর্মিলা বেগম আশাহত হয়ে ফোন কেটে দেয়।

খুব ভোরবেলা টলোমলো পায়ে শান সদর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।তিনদিনের নির্ঘুম রাত কেটে যায় বাগান বাড়িতে।ঘুমাতে গেলেই পাখির চোখে নিজের জন্যে ঘৃনা ছাড়া কিছুই দেখতে পারে না সে।
ধীর পায়ে সিঁড়িতে পা রাখে শান।উঠে যায় নিজের ঘরের দিকে।দরজা ঠেলতেই কাঠের দরজাটায় ক্যাচ ক্যাচ শব্দ উঠে যায়।বুঝার বাকি থাকে না গত তিনদিনে ঘরটায় কেউ ঢোকে নি।

ঘরে ঢুকে শান ভারি চোখের পাতায় খাটের দিকে নজর ফেলে।শূন্য খাটটা দেখে বুকটা ধ্বক করে ওঠে।এগিয়ে যায় সেদিকে।বিছানায় ধপ করে বসে ফোন দুটো আর গাড়ির চাবি টা সাইড টেবিলে রাখে।রাখতেই ড্রয়ারের চাপে সাদা কাগজের কোণা চোখে পড়ে শানের।ভ্রুকুচকে ড্রয়ার টেনে বের করে। বড় একটা সাদা কাগজে কালো কলমের কালিতে বড় বড় করে লেখা,”একটা জন ,দুই জন, তিন জন ”

আসক্তি পর্ব ৩৮

কাগজ টা টেনে বের করে আনতেই কাগজটার নিচে ছোট্ট ছোট্ট দুটো জিরো সাইজের সাদা জুতো নজরে পড়ে শানের।কিছুই বুঝতে পারে না সে।ভ্রুকুচকে একবার কাগজের দিকে আরেকবার জুতোর দিকে নজর বুলায় সে।কিছুতেই বোধগম্য হয় না শানের।হাতে নিয়ে মেঝেতে পায়চারি করে সমাধান বের করার চেষ্টা করে সে।হঠাৎ পিছন ফিরে চোখ পড়ে ওয়ারড্রবের উপরে দেয়ালে টাঙ্গানো ছোট্ট ফুটফুটে বেবিটার দিকে।বুকে ভর করে দুই হাত একখানে করে শুয়ে আছে বাচ্চাটা।হাতের মুঠোয় একমুঠো রঙবেরঙের ফুল। চোখ জুড়িয়ে যাবার মতো দৃশ্য।

“পাখির ছোট বাচ্চা খুব পছন্দ তাই হয়ত টাঙ্গিয়ে রেখেছে “ভাবতেই ছবির উপরে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসে শান।
অন্যদিকে ফিরতেই ভাবনায় ছেঁদ পরে,”ওয়েট, এক জন, দুই জন তিন জন।ছোট্ট একজোড়া জুতা,তারপর বেবির ছবি। তারমানে?তারমানে…….”
ভাবতেই শানের মনে পড়ে পাখির সে রাতের কথা ,”হাত ধরে টেনে নিয়ে আসছিলো ঘরের দিকে।তারমানে এটাই দেখাতে চেয়েছিলো পাখি।মানে আমি বা বা……”

আর কিছু ভাবতে পারে না শান।প্রথম বাবা হওয়ার খুশিতে জুতো জোড়ায় চুমু খেয়ে কেঁদে ফেলে সে।এএরপর পাখির হাতে লেখা কাগজটার উপর চুমু খেয়ে
হেসে দেয়।বুঝতে পারছে না কি রিএ্যাক্ট করা উচিত তার।হাসি কান্নার মিশ্রনে এক অন্যরকম অনুভুতি হয় শানের মাঝে।
পরিবেশ পরিস্থিতিকে একপাশে রেখে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পরে শান।দরজার কাছে মা’য়ের দেখা পায়।মাকে জড়িয়ে খুশির খবরটা জানাতে ভোলেনা সে।এরপর গাড়ি টেনে ছুটে আসে পাখির বাড়ি।

আসক্তি পর্ব ৪০