আসক্তি পর্ব ৩৮

আসক্তি পর্ব ৩৮
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

সামিহা ঘরের মেঝেতে পায়চারি করছে।কয়েকজন লয়ারের সাথে কথাও বলেছে কোন কাজ হয় নি।কেউই নীরার কেইস টা নিতে চাইছে না।রংপুর, দিনাজপুরের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথেও কথা বলেছে সামিহা কিন্তু কোন লাভ হয় নি।সবার এক কথা ও মাদকের ব্যবসার সাথে জড়িত আর সমস্ত প্রমাণাদি সমেত এ্যারেস্টড তাই কোন সহযোগীতা করা সম্ভব না।

এদিকে বোনের সেদিনের কান্নাজড়িত আর্তনাদ মগজে গিজগিজ করছে সামিহার।
(দুদিন আগের থানার ঘটনা)
“আপা আমি নীরা বলছি রে, “-বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পরে নীরা।
সামিহা হকচকিয়ে প্রশ্ন করে, “তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বলবি তো?”
নীরা অনবরত কেঁদেই চলছে,”আপা আমি এ্যারেস্টেড আপা।শান মামলা করেছে তিনমাস আগে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বলিস কি এসব?”
“হ্যা আপা,কাল রেস্টুরেন্টে শানকে আমি ডাকি কিছু কথা বলার জন্যে।কিন্তু শান উল্টা চাল চেলে আমার মুখ থেকে সমস্ত কথা জেনে নেয়।আর তা আবার নিজের ফোনে রেকর্ড করে।সেখানে পিছনের টেবিলে পাখির বাবা আর ফুপা ছিলেন।তারা আমাদের সব কথা শুনে ফেলে।শান ওনাদের সামনেও আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলেছে।কিন্তু সে সবকিছুই যে ওর নাটক ছিলো বুঝতে পারি নি আমি”

এরপর দাঁতে দাঁত চিপে নীরা আবার বলে,”একটি বার যদি বুঝতে পারতাম সব ওর নাটক ছিলো এক রাতের ব্যবধানে ওকে ধ্বংস করে দিতাম আমি।কিন্তু আপা আমি আর কিচ্ছু করতে পারছি না।”
বলতেই কেঁদে ওঠে নীরা।
রাগে চোখের পানি ছেড়ে দেয় সামিহা।
“আপা, আমাদের গোপন ব্যবসার সমস্ত খুঁটিনাটি জেনে নেয় শান।এরপর থানায় প্রমাণ রাখে।কি করব আপা বুঝতে পারছি না। তুই একটা ব্যবস্থা কর, নইলে আমার ক্যারিয়ারের সাথে সাথে জীবনটাও জেলে পঁচবে”

নীরার কথায় সামিহার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।কি করবে, কিভাবে বোনকে বের করবে কিছুই খেলছে না মাথায়।হঠাৎ সামিহার মাথায় কুবুদ্ধি খেলে যায়।সকাল সকাল রেডি হয়ে টিনাকে ডাকে পাখিদের বাড়ি যাবে বলে।টিনাও যাওয়ার জন্যে রেডি ছিলো।দুজন একসাথে লালমনিরহাট চলে আসে।

ভোরবেলা থেকেই পাখিকে সবাই জিদ করছে কিছু না কিছু খাওয়ার জন্যে।কিন্তু কিছুতেই তাকে বশে আনা যাচ্ছে না।অনবরত কেঁদেই চলছে।একটু ক্ষান্ত হয় নি।
বাবার ছবির উপর হাত রেখে কেঁদেই চলেছে পাখি।মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চোখ তুলে মাকে দেখতে পায়।কেমন শুকনো মুখটা আরো শুকিয়ে গেছে মায়ের।এক রাতেই চোখের নিচে কালি পরে গেছে।মায়ের কোমড় আঁকড়ে ভাঙ্গা গলায় আবারও কেঁদে ফেলে পাখি।কান্না করার শক্তি গায়ে নেই তবুও যেন কান্না থামছেই না তার।

“মা গো, একটু কিছু খেয়ে নে মা।এসেছিস থেকে কিছুই খাইস নি।তোর বাবা নিশ্চই ভালো আছে মা।এভাবে কেঁদে কেঁদে নিজের ক্ষতি করিস না “-কান্না জড়িত কন্ঠে মেয়েকে শান্তনা দিচ্ছেন রাশিদা বেগম।
পাখির হঠাৎ মনে পড়ে তার অনাগত সন্তানের কথা। চমকে যায় নিমিশেই।মনে পড়ে কাল থেকে কতো জোড়ে কাঁদল সে, বেবির কিছু হবে না তো।ভাবতেই অজানা ভয় গ্রাস করলো। মুখে ভয়ের ছাপ দেখে রাশিদা বেগম দ্রুত বসে পড়লেন পাশে।

“কি হলো মা? কি হলো তোর?”
পাখি আমতা আমতা করে বলে,”মা কাল থেকে এতো কাঁদলাম, চিল্লাইলাম।আমার বাচ্চাটার কিছু হবে না তো!”
পাখির মা আকাশ থেকে পড়ে।এই শোকের মাঝে এমন একটা সুসংবাদ যেন কেউই আশা করে নি।
“মা কি বলছিস তুই এসব? “-অতিরিক্ত শকে মানুষ আবল তাবল বকে পাখির তাই হলো কিনা, সেটা জানতেই পাখির মা তার গা ঝাকিয়ে বলে।
পাখি চোখের পানি মুছে বলে,”হ্যা মা আমিও মা হবো”
পেটে হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে ওঠে পাখি।

পরোক্ষনে মুখটা থমথমে করে চোখের পানি ছেড়ে বলে,”বাবা দেখতে পারলো না মা আমার বেবিকে ”
রাশিদা বেগম মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে বুকে জড়িয়ে বলে,”শান্ত হ মা, আগে কিছু খেয়ে নে।এ অবস্থায় না খেয়ে থাকা যাবে না তোর।”
“মা, একটা কথা রাখবে?”-বুকে মুখ গুঁজেই বলে পাখি
“হ্যা মা বল, কি কথা? ”

“আমার প্রেগন্যান্সির খবর টা এখনি কাউকে জানানোর দরকার নাই।তোমার জামাইয়ের মন ঠিক নেই।বাবার ফেইল্ড অপারেশনের জন্যে নিজেকে দায়ি করছে ও।আমি চাই শোক টা কাটিয়ে সুসংবাদ টা দেবো।”-ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বলে পাখি।
রাশিদা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তাহলে তোকে আর কষ্ট পাওয়া যাবে না, নিজের যত্ন নিতে হবে মা।ঠিকমতো খেতে হবে তো!
পাখি মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।

“যা করার আমাকেই করতে হবে।আমি যদি ভেঙ্গে পরি আমার ছেলে-মেয়ে দুটার কি হবে।তারা দুজনেই সদ্য বাবা মা হওয়ার পথে।”-নিজের ভাবনা গুলো মনে রেখে রাশিদা বেগম কাউকে নির্দেশ দেয় একটা প্লেটে ভাত তরকারী নিয়ে আসতে।এরপর সমস্ত শোক একপাশে রেখে মেয়েকে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দেন তিনি।গলা দিয়ে ভাত নামছে না পাখির। তবুও বাচ্চাটার কথা ভেবে সামান্য কয়েকটা ভাত খায় সে।
এরই মধ্যে শান বাড়িতে ঢোকে দুহাতে বড় বড় দুটো বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে।বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনে গিজগিজ করছে । সকলের খাবারের ব্যবস্থাও তো করতে হবে!

ফজরের নামাজ পড়ে বেরিয়েছে সবে মাত্র ফিরলো সে।ফিরেই চোখ পড়ে বারান্দায় বসা মা-মেয়ের দিকে।
অবাক হয়ে যায় পাখিকে দেখে।নজর সরিয়ে বাজারের ব্যাগ গুলো রান্নাঘরে রেখে আসে।
“বাবা তুমি একটু ঘুমাও”-শ্বাশুরি মায়ের কথায় শান কোন কথা বলে না।পাশে থাকা শর্মিলা বেগমও বলে, “হ্যা তুই বরং একটু ঘুমিয়ে নে বাবা।”
শান পাখির দিকে একনজর তাকিয়ে উপরে চলে যায়।
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সমস্ত ক্লান্তি ঘুম হয়ে ধরা দেয়।

পাখি বসে বসে বাবার সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মূহূর্তকে ভাবছে আর ওড়নার আঁচলে চোখ মুছছে।
“বড় বউ মা তোমরা আসবে, কই বললে না তো!”-শ্বাশুরি মায়ের কথায় পাখি সেদিকে চায়।চোখের সামনে সামিহা আর টিনাকে দেখতে পায়।সামিহা পাখির কাছে আসতে আসতে বলে,”মা কাল তো রাত হয়ে গেছিলো দুটা গাড়ি দুটাই এ বাড়িতে তাই আসা হয় নি।ভাবলাম সকাল সকাল আসব তাই আরকি”
পাখির পাশে এসে বসে সামিহা আর টিনা।শান্তনা দেয় পাখিকে।

“কিরে পাখি শরীরের কি হাল করেছো দেখেছো একবারও”
সামিহার কথায় পাখি কয়েকবার চোখের পলক ফেলে ;কিছু বলে না।
“চলো গোসল সেড়ে কিছু খেয়ে নেবে”
পাখি অস্ফুট স্বরে বলে,”খেয়েছি”
সামিহা আবারও জোড় করে বলে,”খেয়েছো তো কি হয়েছে। তাহলে চলো শাওয়ার নেবে।কি হাল করেছো নিজের”-বলতে বলতে পাখির হাত টেনে নিয়ে যায়।
শানের মাও বলে ফ্রেশ হয়ে নিতে পাখি আর না করতে পারে না।

পাখির ঘরে শান ঘুমিয়েছে বলেই গেস্ট রুমে যায় তারা।পাখি নিজের জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে আর সামিহা ঘুরে ঘুরে ঘর টা দেখছে।
কিছুক্ষন পর পাখি শাওয়ার নিয়ে বের হয়।সামিহা চট জলদি দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে তড়িঘড়ি করে পাখির হাত দুটো ধরে সোফায় বসে পরে।পাখি হকচকিয়ে যায় সামিহার কাজের আকষ্মিকতায়।
“তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপন কথা আছে পাখি”-
সামিহার কথায় পাখি ভ্রুকুচকে প্রশ্নবাচক চোখে তাকায়।
“যা বলব মন দিয়ে শুনবা।তারপর কথা বলবা”

সামিহার কথায় পাখির টনক নড়ে যায়।ইতোপূর্বে তিনি শানের সাথে যা করেছে সবটাই মনে পড়ে পাখির।তড়িৎগতিতে হাত ছাড়িয়ে বলে,”ভাবি প্লিজ, আপনার আর কোন গোপন কথা আমি জানতে চাই না।তা আবার এই অবস্থায় তো নয়’ই।”
বলেই পাখি ঘর থেকে বের হতে দরজা অবধি যায়।সামিহার কথায় থমকে যায় সেখানে।
“তোমার বাবাকে শান মেরেছে পাখি”
চোখ মুখ খিচে পাখি সামিহার দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকায়।”লজ্জা করছে না আবারও এই নতুন প্ল্যান টা সাজাতে?বজ্জাত মহিলা।একবারও ভাবলেন না আমি বা আমার পরিবার কিসের মধ্যে দিয়ে সময় পার করছে?”

“ভেবেছি বলেই তো বলছি পাখি।আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি শানকেই জিজ্ঞেসা কর।গত পরশু শান নীরার সাথে রেস্টুরেন্টে বসে তোমায় নিয়ে কথা বলছিলো। কিভাবে তোমায় শানের জীবন থেকে সরানো যায় সে নিয়ে দুজন ডিসকাস করছিলো।শানের পিছনে তোমার বাবা বসা ছিলো তা শান বুঝতে পারে নি। ওদের সম্পূর্ণ কথা তোমার বাবা শুনে ফেলে।

রেস্টুরেন্টে সবার মাঝেই তোমার বাবা শানের গায়ে হাত তোলে আর সব কথা তোমায় জানাবে বলে চলে আসে।শান তোমার বাবাকে অনেক ভয়ভীতি দেখায়।কিন্তু তোমার বাবা সিদ্ধান্ত নেয় তিনি তোমায় সবটা জানবেন।শানের বলা কথায় তোমার বাবা দূঃচিন্তায় পরে, তারপর দিন আই মিন কাল সকালে তোমার বাবা হার্ট এ্যাটাক করে ফেলে।শানের কাছে নিলে সে তোমার বাবার ইচ্ছেকৃত ভুল অপারেশন করে তোমার বাবাকে মেরে ফেলে। যাতে কোনদিনও তুমি শান নীরার অবৈধ সম্পর্কটা না জানো”-কথাগুলো খুব দ্রুত বলে দম নেয় নীরা।

পাখির মাথা ঘুরছে, এতো জটিল জটিল কথা তার একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না।সবকিছু ঘোরপাক খাচ্ছে মাথার মগজে। পরোক্ষনে মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা, “শান সেদিন বিধ্বস্ত শরীরে বাড়িতে ঢোকে।নিষ্পলক চেয়ে দেখে আমার দিকে।বাবার কথা জানতে চাইলে তাকে তো অপ্রস্তুত দেখেছিলাম।কেন উনি বার বার বলেছিলেন যে, বাবা আমার সাথে আরো কথা বলেছে কিনা!আর গত কয়েকমাস ধরেই তো তিনি ফোনে কারোর সাথে সময়ে অসময়ে কথা বলত।তারমানে….”সবটা ঘটনা একের পর এক পাখির মাথায় তালঘোল পাকাচ্ছে।

দৌড়ে চলে যায় নিজের ঘরে।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে হাফাতে থাকে আর অনবরত কাঁদতে থাকে পাখি।কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে ধড়ফড়িয়ে ওঠে শান।
“কি হয়েছে পাখি?”?
পাখি ঘৃনার চোখে চেয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে যায় শানের কাছে।চোখে চোখ রেখে অনবরত কেঁদে চলে।শান দুহাতে জল মুছাতে এলে শানের দুইহাত ধরে খাটের নিচে নামায় পাখি।দাঁড় করায় চোখের সামনে।রক্তচক্ষু নিয়ে পাখি বলে,”আমার চোখের দিকে তাকান।আর যা যা বলবো তার জবাব হ্যা আর না তে দেবেন।কোন এক্সকিউজ বা এক্সপ্লেইনেশান নয়।

শান ভড়কে যায়।চোখ ছোট ছোট করে বলে, “কি বলছো এসব। কি হয়েছে তোমার বলবে তো?ওকে রিল্যাক্স বসো, বসে কথা বলি আমরা”-বিছানায় পাখিকে জোড় করে বসায় শান।পাখি বিদ্যুৎবেগে পূনরায় উঠে দাঁড়ায়।
“যা বলছি তাই করুন।”-কাটকাট গলায় বলে পাখি
শান উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”বলো কি বলবে?”
“পরশুদিন বাবা আর ফুপা গেছিলো আপনার চেম্বারে?”
“চেম্বারে বলতে তাদের সাথে রেস্টু…..”
“আমি হ্যা বা না তে জবাব চেয়েছি মি.শান”
শান অবাক হয়ে যায় পাখির অস্বাভাবিক আচরন দেখে।
“না”

“তাহলে কোথায় দেখা হয়েছিলো?”
শান প্রতিউত্তরে বলে,”রেস্টুরেন্টে ”
“আপনি নীরার সাথে বসে কথা বলছিলেন ঐ একই রেস্টুরেন্টে?”
শানের টনক নড়ে যায়।ভাবতে থাকে, ” তাহলে পাখি সবটা জেনে গেছে।আবারও কি আগের মতো ভুল বুঝবে।ওওও শিট!”
শান পাখির দুবাহু ধরে বলে,”আমি তোমায় সম্পূর্ণ ব্যপার টা বুঝিয়ে বলছি পাখি।আমায় দুটা মিনিট সময় দাও”

পাখি জোড়ে চিল্লিয়ে তর্জনি আঙ্গুল উচিয়ে বলে,”খবরদার,খবরদার বলছি কথা ঘোরাবার চেষ্টাটিও করবেন না।যা বলছি তার জবাব দিন”
“নীরার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন?”
শান এবার বুঝতে পারে বাস্তবতা তার পিছু ছাড়ে নি।এবারই হয়ত মুখোমুখি হতে হবে সেটার।শান অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়ে,”হ্যা,কিন্তু….”

পাখি হাত উচিয়ে থামিয়ে চোখের পানি সংবরন করে বলে,”আমায় ডিভোর্স দেয়ার প্ল্যান করছিলেন?”
মনে মনে পাখি হাজার বার চাইছে যেন শানের উত্তর এবার না হয়।শান যেন গত বারের ন্যায় এবারও তাকে ভুল প্রমান করে।
শান চমকে যায়,”এতোকিছু তো পাখির জানা কথা নয় আর কে বললো এসব।আর আমি তো নাটক করেছিলাম নীরাকে ফাঁসাতে”
“আন্সার মি!”
“পাখি শোন এখানে আরো অনেক অনেক ব্যপার লুকায়িত আছে।তুমি মাথা ঠান্ডা করো আমি সবটা বলছি তোমায় প্লিজ”
পাখি দুহাতে মুখ চেপে কেঁদে চলেছে হু হু করে।তার আর বোঝার বাকি নেই সামিহার কথাগুলোই সত্যি।
শানকে কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না সে।

কান্না কিছুটা সংবরন করে বলে,”এরপরের ঘটনা আমিই বলি।আমাকে সড়ানোর প্ল্যান করতে পিছনে থেকে বাবা সবটা শুনে ফেলে।আপনাকে মারধোরও করে।আমায় সবটা জানাবে বলে উদ্যত হলে আপনি তাকে ব্ল্যাকমেইল করে থামিয়ে দেন;ভয়ভীতি দেখান।সেই দূঃচিন্তায় বাবা বাড়ি ফেরে।আর কাল সকালে হার্টে এ্যাটাক আসে।আর আপনি সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমার বাবাকে অটিতেই মেরে ফেলেন।এটাই না মি.ফয়সাল আহমেদ শান?”

শান বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পায় না।স্তম্ভের ন্যায় পাখির সব কথা শুনে চলেছে।তার মন মগজেও আসছে না পাখি তাকে এই ব্লেইম দেবে।
শানের নিশ্চুপতা দেখে পাখির মনের সন্দেহ আরো প্রগাঢ় হয়ে যায়।নিজের সাথে ঘটা সমস্ত ঘটনা তার কাছে দূঃস্বপ্ন লাগছে।
ঠোঁট কামড়ে কেঁদে কেঁদে পাখি বলে,”কেন এমন করলেন?আমায় বলে দিতেই পারতেন যে আমার কাথে সংসার করতে পারবেন না। তাহলেই তো সবটা বুঝতাম আমি!কেন আমার অসহায় বাবাকে এরমাঝে আনলেন?কেন মেরে দিলেন শান?কেন কেন কেন?”

শানের শার্টের কলার ধরে বলতে বলতে পাখি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
শান ভাবতেও পারছে না ঘটনাটা এতো দূর গড়াবে।কোনমতে পাখিকে একহাতে জড়িয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”কার না কার কথা শুনে আমায় এতো বড় ব্লেইম দিচ্ছো জান?সত্যিটা জানলে পারবে তো নিজেকে ক্ষমা করতে?”
পাখি ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় শানকে।চোখের পানি মুছে বলে, “কোন সত্যির কথা শুনবো আমি?নীরার সাথে লুকিয়ে দেখা করা অবৈধ সম্পর্ক রাখা এই সত্যি নাকি আপনাদের মাঝখান থেকে আমার অসহায় নির্দোষ বাবাকে হত্যা করা এই সত্যি?”

“তুমি যা যা শুনেছো সবটাই ঠিক আছে পাখি কিন্তু এর মাঝেও কিছু ব্যপার আছে।আমায় প্লিজ বলতে দাও”
পাখি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে,”নতুন করে আমি আর কিচ্ছু জানতে চাই না। আরে আমি তো আপনাকে মন থেকে ভালোবেসেছি তার প্রতিদান এভাবে দিলেন?”
“পাখি কে তোমায় বলেছে এসব সেটা তো বলবা?”
“কেন, তাকেও বুঝি কায়দা করে মেরে ফেলবেন?”
পাখির কথা শেষ হতে না হতেই ঘরে সামিহা চলে আসে
“আমি বলেছি শান। অনেক তো খেললে দুটো মেয়েকে নিয়ে আর কতো বলোতো,আর কতো খেলবে?এবার না হয় একজনে সন্তুষ্ট থাকো”

সামিহাকে পারে তো চোখ দিয়েই ভষ্ম করে দেয় শান।
“তারমানে তুমি এসব বানিয়ে বলেছো ভাবি?এতোটাও নিচে নামলে ভাবি?ওহহহহ আচ্ছা আচ্ছা তারমানে সেদিন থানায় লাস্ট কলটা নীরা তোমাকেই করেছিলো তাই না?
শানের কথায় মাথা তুলে তাকায় পাখি।প্রশ্নবাচক চোখে দুজনার দিকে তাকায়। সামিহা ফট করে বলে,”জানো পাখি শান যখন বুঝলো সবটা হাতের বাহিরে চলে গেলো তখন মিথ্যে মামলায় নীরাকে ফাঁসিয়ে জেলে ভরলো আর প্রমান মুছে দিতে তোমার বাবাকে শেষ করে দিলো”

শান হা হয়ে যায় সামিহার আচরনে।পাখি চেয়ে আছে শানের প্রতিক্রিয়ার আশায়।পরোক্ষনে শান তেঁড়ে যায় সামিহার দিকে, “আর একটা বাজে কথা বললে জিহ্ব টেনে ছিড়ে ফেলব ভাবি”
পাখি বলে ওঠে,”বাহ, নিজের ফর্মে এলেন তবে।এবার সবটাই যেহেতু পরিষ্কার সেহেতু আমাকেই শেষ করে দিন না সার্জন সাহেব”-শেষের কথাটা বেশ করূন করে বলে পাখি।শানের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে সে কথায়।কোণ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পরে।পাখিকে ধরে বলে,”এতোটুকু বিশ্বাস নেই আমার উপর?আমার ভালোবাসার উপর?”

পাখি হাত ছাড়িয়ে বলে, “চলে যান”
শান অবাক হয়ে যায়।
“আমি বাড়ির কাউকে আপনার ব্যপারে কিচ্ছু জানাবো না।চলে যান।আমি চাই না আমার মা ভাই কোন মুখোশধারী লোকের জন্যে কষ্ট পাক।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই শান পাখির হাত টেনে নিচে নিয়ে আসে।ড্রয়িং রুমের মাঝে দাঁড় করিয়ে বলে,”এবার বলো সবটা?আমিও জানতে চাই তোমার মতো ঠুনকো বিশ্বাসে তোমার পরিবার চলে কিনা?”
পাখি শানের ব্যবহারে বেশ অবাক হয়ে যায়।অবাক চোখে চেয়ে চারিদিকে দেখে।

“কি হয়েছে বাবা?”-পাখির মা এগিয়ে আসতে আসতে বলে।
ইতোমধ্যে শানের বাবা,মা,চাচি, পাখির মা, ভাই, ভাবি অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনে ঘর ভরে গেছে।
“মা, আপনার মেয়ে মনে করে বাবাকে আমিই মেরে ফেলেছি”-শানের কথায় উপস্থিত সবাই ভড়কে যায়।
সোহান কপোট রাগ দেখিয়ে বলে,”পাখি আজকের দিনে এসব কি আবল তাবল বলছিস তুই?”
“তোমরা জানো না, তোমরা কেউ জানো না এই মানুষটা ঠিক কতোটা বহুরূপী? ”

পাখির বলা প্রত্যেকটা কথা শানের কলিজা পুড়িয়ে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে সবটা শুনছে সে।
এরপর পাখি সমস্ত কথা বাড়ির সবাইকে বলে দেয়।কথাগুলো শুনে পিছনে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়েন রাশিদা বেগম।তড়িঘড়ি করে তাকে ধরে সোফায় বসানো হয়। শানসহ সবাই দ্রুত এগিয়ে যায়।
“মা আপনার মেয়ের মতো কোন ভুল আমায় বুঝবেন না প্লিজ।আমি আপনাদের সবটাই বলবো। নিজেকে শান্ত করুন মা।”

ছেলের এমন আকুতি দেখে অসহায় চোখে তাকায় শর্মিলা বেগম।পাখিকে জড়িয়ে নিয়ে বলে, “বউ মা ও আমার ছেলে।এমন ঘৃন্য কাজ সে কখনোই করবে না।”
পাখি পাথরে পরিনত হয়ে যায় ততোক্ষনে।শক্ত গলায় বলে,”আপনার ছেলেই করেছে এসব।তা না হলে জীবনের প্রথম ব্যর্থ অপারেশনের বলি কেন হতে হলো আমার বাবাকে?বলতে পারবেন?
শর্মিলা বেগম অসহায় চোখে তাকায় পাখির দিকে।

“আর এতোটুকু তো জানি আমি, যে একবারের এ্যাটাকে বাইপাস করার প্রয়োজন হয় না!”
পাখির কথায় সোহান বলে ওঠে, “তোর মাথা ঠিক নেই।বাবার ২০ সালে একবার এ্যাটাক এসেছিলো।আমি আর বাবা ছাড়া কেউ সেটা জানত না।”
ছেলের কথায় অবাক হয়ে যায় রাশিদা।
সোহান আবার বলতে শুরু করে,”গত তিন মাস আগে আবারও এ্যাটাক আসে বাবার।শানের কাছে নেয়া হয়।শান নিজেই হার্টে রিং সেট করে দেয়।”

পাখি অবাক হয়ে যায়।অথচ এসবের কিছুই জানে না সে।তার অগোচরেই রয়ে যায় সবটা।বাবার সাথে একটু সময় কাটানোর সুযোগটাও পায় না সে।ভাবতেই চোখে ফেটে কান্না আসে পাখির।নিজেকে সংবরন করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সোহান চোখ মুছে বলে,”তুই কেন এসব জানিস না জানিস?এই যে, এই শান তোকে জানতে দেয় নি।যাতে তোর উপর কোন দূঃচিন্তার চাপ চলে না আসে। তাই সবাইকে বাড়োন করেছিল যাতে তোকে না বলি কিছু।আর তাকেই তুই ব্লেইম করছিস?সেবার বাবার হার্টে রিং পরানোর সমস্ত খরচাপাতিও শান দিয়েছে আর তাকেই তুই…..”

শান গম্ভীর মুখে সোহানকে থামিয়ে বলে,”ভাইয়া থামুন।আর কিছু বলার দরকার নাই ও ব্যপারে।ও যেদিন নিজে রিয়েলাইজ করবে সেদিন হয়ত অনেক কিছুই পাল্টে যাবে।আমি ওর কাছে নিজেকে প্রমান করব না আর। তবে হ্যা যেহেতু আপনারা আমায় বিশ্বাস করছেন সেহেতু পুরো ঘটনা টা আমি আপনাদের জানাবো”

“ওনাকে তোমরা বিশ্বাস করতে পারো, আমি করব না।উনি যদি কলিজা কেটেও বলে তবু আমি ওনার কোন কথা আর বিশ্বাস করছি না”- বলেই পাখি অনূভূতিহীন হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।
এরপর শান নীরার সাথে হওয়া সমস্ত ঘটনা সবাইকে খুলে বলে।ফয়েজ দ্রুত এগিয়ে সামিহার গালে কষে থাপ্পোর বসিয়ে দেয়।এরপর বলে,”বাবা আমি বাড়ি যাচ্ছে তোমরা চলে এসো পরে।”
টানতে টানতে সামিহাকে গাড়িতে নিয়ে তোলে।লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে ফয়েজের।সে ভাবতেও পারে নি সামিহা এরকম একটা কাজ করবে।

“তুমি আমাদের কিছু না বললেও আমাদের পরিবারের সবাই তোমায় বিশ্বাস করে শান।পাখির মনে সামিহা ভাবি যে ভুল ধারনা ঢুকিয়ে দিয়েছে তা একদিন ঠিক সরে যাবে।”-বলতে বলতে শানের ঘাড়ে হাত রাখে সোহান।
শানের ভিতর কি ঝড় চলছে তা সে কাউকেই বুঝতে দিতে চায় না।
“তোর ভাবির রুমে গাড়ির চাবি আর আমার ফোন আছে নিয়ে আয় , “-টিনাকে বলে শান বাহিরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায়।

পাখির মা পথ আগলে দাঁড়ায়ে।কান্নাজড়িত গলায় বলে,”বাবা আমার মেয়েটা ওর বাবাকে খুব ভালোবাসে।ওর বাবার এমন চলে যাওয়া সে কোনভাবেই মানতে পারছে না।তাই সামিহার কথা শুনেছে।আমি তো জানি বাবা তোমার কাছ থেকে ফিরে এসে সোহানের বাবা কতোটা হাসিখুসি ছিলো।কোন দূঃচিন্তার ছাপ দেখতে পাই নি তার মাঝে।আর বার বার শুধু বলেছিলো ভাগ্য গুনে একটা জামাই পেয়েছি রাশিদা।আমি কিছু বলতে গেলেই বলতো সময় হলে সবটা জানতে পারবা।জানি না বাবা তোমার আর তোমার শ্বশুরের মাঝে কি হয়েছিলো! তবে তিনি বার বার তোমার গুনগান করছিলো”
বলতে বলতেই কেঁদে ফেলে রাশিদা।

“মা,আপনারা আমায় বিশ্বাস করেছেন এটাই আমার জন্যে অনেক।আমি আপনাদের খোঁজ খবর নিবো নিয়মিতই।তবে আপনার মেয়ে যদি আমার কাছে আসতে চায় তবেই এ বাড়িতে পা রাখব তার আগে নয়।এটা প্রথম না মা। এর আগে আরো একবার সে আমায় ভুল বুঝেছিলো।তবে এবার আমি চাই ও নিজে থেকেই সবটা জানুক।আমার প্রতি বিশ্বাস আনুক।আপনারা কেউ ওকে কোন প্রকার জোড় করবেন না।আমি আসছি মা”

আসক্তি পর্ব ৩৭

“কিন্তু বাবা ততোদিনে ও যদি ভুল কিছু করে”
শান রাশিদার দুবাহুতে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বলে,”আমি আছি তো মা।ওকে আমি ছাড়ছি না এ জীবনে সেটা জেনে রাখুন।ও যতো ভুল সিদ্ধান্তই নিক না কেন!”
ততোক্ষনে টিনা চাবি আর ফোন নিয়ে চলে এসেছে নিচে।শানের হাতে দিতেই শান সেগুলো নিয়ে চলে যায়।
“আমার প্রতি এতো বড় অপবাদ দিতে পারলে জান?আমার ভালোবাসার মূল্য এভাবে দিলে?”-আনমনে ভাবতে ভাবতেই পাখির বেলকোনিতে নজর রাখে শান।
পাখি পাথুরে মূর্তির ন্যায় চেয় থাকে সেদিকে।।

“আপনি এতোটাও নিচ লোক আমি ভাবতে পারি নি সার্জন সাহেব।নিজের স্বার্থে আমার বাবাকে মেরে ফেললেন!এ জীবনে আর কখনোই ক্ষমা করব না আপনাকে। আই হেইট ইউ, জাস্ট হেইট ইউ”-শানের দিকে রক্তচক্ষু দিয়ে তাকিয়ে বলে পাখি।শান কিছুক্ষন অসহায় হয়ে চেয়ে দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসে।গাড়ি স্টার্ট করে চলে যায়। পাখি সেদিকে চেয়ে পেটে হাত রেখে বলে,”আমায় যেভাবে বাবাহারা করলেন ঠিক সেভাবে আপনার সন্তানকেও বাবাহারা করলাম আজ এই মূহূর্ত থেকে।না আপনি কোনদিন জানবেন আপনার সন্তানের কথা না জানবে আমার সন্তান আপনার কথা।”

কেউ না বুঝুক শর্মিলা বেগম বুঝেছে ছেলের ভিতর কতো ঝড় বইছে।পুরো ব্যপারটার কি পরিমান প্রতিক্রিয়া যে তার ছেলের উপর পরেছে তা তিনি বেশ বুঝতে পারলেন।এরপর শানের বাড়ির সকলেই ও বাড়িতে সবাইকে শান্তনা দিয়ে বাড়ি আসার জন্যে প্রস্তুত হোন।

আসক্তি পর্ব ৩৯